লিখেছেন : মুকুলিকা দাস
ছবি ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত(লিংকে ক্লিক করুন) |
বাংলা সাহিত্যের
প্রসার, সংস্কৃত
সাহিত্যের সহজসরল অনুবাদ নারী শিক্ষা বিস্তারে বহু প্রবন্ধ লিখে সমাজে আলোড়ন
তুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নারীর সম্মান ও আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন
তিনি। সমাজে বিধবা
বিবাহ প্রচলন করে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
এই বিধবা বিবাহ
প্রচলন নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ছোটবেলায় রাইমণি নামে খেলার এক সঙ্গিনী ছিল বিদ্যাসাগরের। রাইমণিকে
ভালোবাসতেন তিনি। রাইমণির খুব
অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কিছু বছর পরে বিধবা হয়ে একমাত্র সন্তান গোপালকে নিয়ে নিজের
গ্রাম বীরসিংহে ফিরে আসে রাইমণি। বিদ্যাসাগরও গ্রামে ফিরে একদিন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন রাইমণি
শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন ছিল একাদশী। সারাদিন রাইমণির উপবাসের করুণ চিহ্ন প্রত্যক্ষ করে
বিদ্যাসাগরের মনে একদিকে যেমন বৃষ্টির মতো কান্না ঝরছিল তেমনি অন্যদিকে আগুনও
জ্বলছিল। তিনি অনুভব
করেছিলেন হিন্দু বাল্য বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে প্রয়োজন
তাঁদের পুনর্বিবাহ।
রামমোহন রায়
জ্বলন্ত চিতার আগুন থেকে বিধবাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু সংসার আর
সমাজের নির্মমতায় তাঁরা প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছিলেন। সেই চিতার আগুন
নেভানোর উদ্দেশ্যে বিধবা বিবাহের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে এগিয়ে এলেন
বিদ্যাসাগর।
উনিশ শতকের
মাঝামাঝি। বীরসিংহ গ্রামে
বাবা ঠাকুরদাসের সঙ্গে গ্রামের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এমন সময়ে মা
ভগবতীদেবী অকাল বিধবা পড়শি কিশোরীর দুঃখে আকুল হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রে কাছে বিধবাদের
বাঁচার উপায় জানতে চাইলেন। একই প্রশ্ন রাখলেন ঠাকুরদাসও। বিদ্যাসাগর
জানালেন, এমন
বিধবার আবার বিয়ে শাস্ত্র সিদ্ধ। এ বিষয়ে তাঁর বই লেখার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সমাজে
বিরোধের আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। ঠাকুরদাস ও ভগবতীদেবী দু’জনেই এগিয়ে যেতে বললেন। তিনি বুঝেছিলেন
ধর্মের, সমাজের
শাস্ত্রের গোঁড়ামি শাস্ত্র দিয়েই ভাঙতে হবে।
বিধবাদের
যন্ত্রণা দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে যদি বিবাহ
করাটা শাস্ত্র বিরুদ্ধ না হয়, তা হলে নারীর ক্ষেত্রে তা শাস্ত্র
বিরুদ্ধ হবে কেন? তাই রাতের পর রাত জেগে কঠোর অনুশীলন করে সমস্ত শাস্ত্র তিনি
পড়তে শুরু করেছিলেন৷ নারীর দ্বিতীয়বার বিবাহ করার কোনও বিধান শাস্ত্রে আছে কি না
তা খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠছিলেন৷ কারণ, শাস্ত্রের প্রমাণ পেলে কুসংস্কারগ্রস্তদের
মুখ বন্ধ করা সহজ হবে৷ অবশেষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ মিলল৷
শিবনাথ
শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, এই সময়ে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের
পাঠাগারে সারা দিন ধরে নানা শাস্ত্র পড়তে শুরু করলেন। মাঝে এক বার
শুধু খেতে উঠতেন। সালটা ১৮৫৩, শীতকাল। রাজকৃষ্ণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, এক দিন তাঁর সামনেই বিদ্যাসাগর ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে
আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি পেয়ে গিয়েছেন পরাশর সংহিতার দু’লাইনের একটা শ্লোক।
“নষ্টে মৃতে
প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ” অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক
আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারেন।
ছবি ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত(লিংকে ক্লিক করুন ) |
এই যুক্তির
নিরিখে বিধবাদের বিয়ের পক্ষে দুটি বই লিখলেন তিনি। এছাড়াও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বিধবা বিবাহের সপক্ষে জনমত গঠন
ও সেইসঙ্গে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এই মত সমর্থন করলেন বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান লেখক, ব্রাহ্ম
সমাজের প্রথম আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ। এক বছর পরেই ১৮৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের
সভাপতিত্বে ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’-র সভায় হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ
রোধ ও বাল্যবিবাহ বর্জন নিয়ে কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব আর অক্ষয়কুমার দত্তের
সমর্থনের বিস্তারিত একটি প্রতিলিপি ব্রিটিশ লিগ্যাল কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছিল। আইনের মাধ্যমে
বিধবা বিবাহকে বৈধ করার লক্ষ্য নিয়ে ৯৮৭ জনের সই সংগ্রহ করে বিদ্যাসাগর আবেদনপত্র
জমা দিলেন তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে। তাঁর আবেদনপত্রের প্রবল বিরোধিতা করলেন সনাতন পন্থী
হিন্দুরা। রক্ষণশীল সমাজের
নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬,৭৬৩ জনের সই সংগ্রহ করে পাল্টা আবেদনপত্র ভারত সরকারকে জমা
দিলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তির কাছে হার মানল বিরোধীদের আবেদন।
রাধাকান্ত দেব
কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে পণ্ডিতসভা ডাকলেন। সেখানে তীব্র
বাদানুবাদ হল বিদ্যাসাগর ও পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের মধ্যে। বিদ্যাসাগর
শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পণ্ডিতরা তা প্রমাণ করার জন্য জোর সওয়াল করলেন। তবুও ব্যর্থ
হলেন তাঁরা। রাধাকান্ত দেব
এই বিধবা বিবাহে সমর্থন না করলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এক জোড়া শাল
তাঁকে দেন।
১৮৫৫ সালের
জানুয়ারিতে বিধবা-বিয়ে নিয়ে লেখা
বিদ্যাসাগরের বইয়ের প্রথম সংস্করণের দু’হাজার কপি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গেল। উৎসাহিত
বিদ্যাসাগর আরও তিন হাজার বই ছাপালেন। সংস্কারাচ্ছন্ন পণ্ডিতেরা তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচনা শুরু করলেন। বিভিন্ন
সংবাদপত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের মতের বিরুদ্ধে অসংখ্য চিঠি প্রকাশিত হতে শুরু করল। পাল্টা জবাব
দিলেন বিদ্যাসাগর। বইটি সারা
ভারতবর্ষে জুড়ে ঝড় তুলেছিল। বিদ্যাসাগরকে আরও দশ হাজার কপি ছাপাতে হয়েছিল। ১৮৫৫ সালের
অক্টোবর মাসে ৯৮৬ জনের সই নিয়ে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে বিধবা বিবাহের দাবি পেশ
করলে দেশ জুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠল।
সেই সময়ের
খবরের কাগজগুলি দু’ভাগ হয়ে গেল। শোভাবাজারের
রাজা রাধাকান্ত দেব, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-সহ অনেক প্রভাবশালী মানুষ সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা
করলেন। ব্যঙ্গ পদ্য
বেরোল ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ পত্রিকায়,
‘‘…সাজ গো বিধবাগণ
ফুটিয়াছে ফুল।
তোমাদের সৌভাগ্য
ঈশ্বর অনুকূল।’’
নামে, বেনামে
বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে বহু চিঠি প্রকাশিত হতে থাকল। প্রশ্ন উঠল, বিধবার
গর্ভের সন্তান সম্পত্তির অধিকারী হবে কি না।
১৮৫৬ সালে
বর্ধমান থেকেও বিধবা বিবাহের সমর্থকদের একটি আবেদন সরকারকে দেওয়া হল। বর্ধমানের রাজা
মহতাব চাঁদ বিদ্যাসাগরের সমর্থনে সই করলেন। প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, প্যারীচাঁদ
মিত্র, ভূদেব
মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ
শিকদার, দীনবন্ধু
মিত্র প্রমুখ বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবের সমর্থনে সরকারের কাছে আবেদন পাঠালেন। বিরুদ্ধে
দরখাস্তের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ত্রিপুরা, পুণে, মুম্বই, উত্তর
ভারত আর নবদ্বীপ থেকেই প্রায় তিরিশ হাজার প্রতিবাদ সরকারের দফতরে জমা পড়ল। সাবধান করে বলা
হল, এমন
বিয়ে চালু হলে ভারতে নিশ্চিত ধর্মদ্রোহ হবে। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেই বছরে ২৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন
পাশ হল। এই আইন পাশের
পিছনে গ্রান্ড সাহেবের অবদান ছিল। কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রীশচন্দ্র বাহাদুর, পাইকপাড়ার
রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির সঙ্গে গ্রান্ড সাহেবের
বাংলোয় গিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এলেন।
বঙ্গদেশে যেন এক
নতুন যুগের সৃষ্টি হল। যাঁরা সমাজের ভয় করতেন তাঁরাও এগিয়ে এসে বিধবা বিবাহকে
সমর্থন জানান। উমেশ চন্দ্র
মিত্র লিখলেন বিধবা বিবাহ নাটক। প্রথমে সিঁদুর পাটির গোপাল মল্লিকের বাড়ি, পরে
পাইকপাড়ার রাজবাড়িতে সেই নাটকের অভিনয় হল। যার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। বিধবা বিবাহ
নাটকের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা। নাটক বেশ
কয়েকবার দেখেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর।
আইন তো পাশ হল
কিন্তু বিধবাদের বিয়ে দিচ্ছে কে? বর্ধমানের শাকনাড়ার বাসিন্দা, বিদ্যাসাগরের
মাস্টারমশাই প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ ঈশ্বরকে সাবধান করলেন, ‘‘উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু তোমার অর্থবল কই? এ কাজ
ধনবান রাজা লোকদের। আগে টাকার জোগাড়
কর, দিশি
জমিদারদের নিজের মতে নিয়ে এস, তার পরে না হয় এগিয়ে যেও।’’ বিদ্যাসাগর কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তিনি
উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘বিধবার বিয়ে হবে, আমিই
দেব।’’
১৮৫৬ সালের ৭
ডিসেম্বর। সময় রাতের
দ্বিতীয় প্রহর। কলকাতার সুকিয়া
স্ট্রিটের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে অসংখ্য নিমন্ত্রিতের ভিড়। ৮০০ জনকে কার্ড
দিয়ে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। রাস্তায় গোরা পুলিশের পাহারা। পালকি চেপে
পাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিয়ে করতে এলেন। তিনি এক সময়ের
সংস্কৃত কলেজের আসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এখন মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিত। পাত্রী কালীমতি বর্ধমানের পলাশডাঙার প্রয়াত ব্রহ্মানন্দ
মুখোপাধ্যায়ের দশ বছরের বিধবা মেয়ে। তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল চার বছর বয়সে, বিধবা
হন ছ’বছর বয়সে। বিদ্যাসাগর বিস্তর খরচ করে প্রথম বিধবা বিবাহের জমকালো
অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ, পণ্ডিত প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ-সহ আরও অনেকের উপস্থিতিতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যাসাগর
কনের মা লক্ষ্মীদেবীকে দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করালেন। বাংলা তথা
ভারতের ইতিহাসে সোনার জলে লেখা থাকল উনিশ শতকের এই তারিখটি।
বাংলার লাটসাহেব
স্যার ফ্রেডেরিক হ্যালিডেও এই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঐতিহাসিক ঘটনাটির
সাক্ষী হিসাবে। এ ছাড়া বিবাহ
বাসর উজ্জ্বলতর হয়েছিল প্যারিচাঁদ মিত্র, কালিপ্রসন্ন সিংহ, শম্ভুনাথ
পণ্ডিত, রাজা
প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রাজা দিগম্বর মিত্র, বিচারক হরচন্দ্র ঘোষ, দ্বারিকানাথ
মিত্র প্রমুখের উপস্থিতিতে।
এই বিয়ে নিয়ে
জনসমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। খবরের কাগজে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর ভয়ঙ্কর নিন্দের ঝড় উঠেছিল। বিদ্যাসাগরকে
নিয়ে পক্ষে, বিপক্ষে নানা ধরনের তরজা, গান
বাঁধা হয়েছিল। এমনকি, তাঁকে
হত্যার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল।
বিধবার বিয়ে
দিয়ে এক অসাধ্যসাধন করলেন বিদ্যাসাগর। আর কোনও ক্রমেই বিধবা বিবাহ বন্ধ করতে না পেরে হিন্দু
সমাজপতিরা রাগে অন্ধ হয়ে শ্রীশচন্দ্রকে সমাজ থেকে পতিত ঘোষণা করেন। এদিকে
ধর্মান্ধরা আইনের বিচারে হেরে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে রাতের অন্ধকারে কলকাতার ঠনঠনিয়ার
কাছে গুন্ডাদের দিয়ে মারার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের সঙ্গী বীরসিংহের লাঠিয়াল শ্রীমন্ত সেই
গুন্ডাদের হটিয়ে দেন।
অমৃতবাজার-এর মতো হিন্দু ধর্মের প্রতি নিষ্ঠ পত্রিকাও সোৎসাহে এমন সব
বিবাহের খবর ছাপতে কসুর করেনি— ‘২৪ শে কার্ত্তিক রবিবার রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময়
শ্রীযুক্ত বাবু ব্রজসুন্দর মিত্র মহাশয়ের ঢাকাস্থ বাসাবাটীতে একটী বিধবা বিবাহ
হইয়া গিয়াছে। বরের নাম শ্রীযুক্ত নবকুমার বিশ্বাস, বয়স প্রায় ২৬ বৎসর। পাত্রীর
নাম শ্রীমতী ভুবনময়ী দেবী, বয়স প্রায় ২০ বৎসর। ১৫/১৬ বয়ঃক্রমের সময় ইনি বিধবা হন।’ (১৯ নভেম্বর ১৮৬৮)
বিদ্যাসাগর গোটা
নারীসমাজকে পথ দেখিয়ে নিজেও কিন্তু পিছিয়ে থাকলেন না। নিজের একমাত্র
ছেলে নারায়ণ চন্দ্রর বিয়ে দিয়েছিলেন ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে। গ্রামের
প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা বিয়েতে না এলেও বিদ্যাসাগরের সংগ্রাম সফল ও সার্থক হয়েছিল। যদিও
পরবর্তীকালে পুত্র নারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হলেও একথা
নিঃসন্দেহে ঠিক
যে বিধবা বিবাহ করে নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরকে তৃপ্তি দিয়েছিলেন।
এতোকিছু
সত্ত্বেও "বিধবা বিবাহ"-এর প্রসার ঘটাতে গোঁড়া হিন্দু সমাজের মাথারা প্রবল বাধা
দিল৷ অনেক কষ্ট করে বিধবা বিবাহ করতে কাউকে রাজি করালে তাকে ভয় দেখানো হত, শারীরিক
নির্যাতন করা হত, এক ঘরে করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত৷ বিদ্যাসাগর এই সব বাধার
বিরুদ্ধে নিজে পাত্র–পাত্রী ঠিক করে, সব
খরচ নিজে বহন করে দাঁড়িয়ে থেকে বিধবা বিবাহ দিতে শুরু করলেন৷ বিয়ের পর অনেকের
সংসার চালানোর খরচও তিনি বহন করতেন৷ এজন্য তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দেনায়
ডুবে গিয়েছেন, তবু পিছিয়ে যাননি৷ এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম৷ এ
জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার
সম্ভাবনা নাই৷ এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলেপ্রাণান্ত
স্বীকারেও পরান্মুখ নহি৷’ অর্থাৎ এ জন্য মরতেও তিনি রাজি ছিলেন– এমনি
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল তাঁর৷
বিধবাদের
বিবাহের জন্য বিদ্যাসাগরের সহানুভূতি ও সাহায্য নিয়ে একদল সুবিধাবাদী লোক তাঁকে
ঠকাতে শুরু করেছিল৷ তারা টাকার লোভে বিধবাকে বিয়ে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিত, কেউ
বা টাকা নিয়ে আর বিয়ে করত না, আবার কেউ বিয়ে করে কয়েক দিন পরে সেই
বিধবাকে ছেড়ে পালিয়ে যেত৷ তখন ওই অসহায় মেয়েটির সব খরচ বিদ্যাসগরকেই বহন করতে হত৷
এমনি করেই অসহায় নারীর চোখের জল মোছাতে তিনি ঋণ করে করে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন৷
বাল্যবিবাহ
প্রথা, বহুবিবাহ
প্রথা ও পণ প্রথার মতো নিষ্ঠুর সামাজিক প্রথার উচ্ছেদ করতেও তিনি চেষ্টা করেছিলেন৷
এই সব কুপ্রথার বলি হয়ে মেয়েদের যে দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করতে হত তা তিনি মর্মে
মর্মে উপলব্ধি করতেন৷ অতি দুঃখে তাই লিখেছিলেন–‘যে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম
নাই, ন্যায়
অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সৎ অসৎ বিবেচনা নাই, কেবল
লৌকিকতা রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি
জন্মগ্রহণ না করে৷’
বাল্য বিবাহেরও
তিনি বিরোধী ছিলেন৷ নিজেরে মেয়েদের তাই তিনি বেশি বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন৷
উনিশ শতকের
দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাংলায় সামাজিক সংস্কারের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এসেছিল। ১৮৫৬ সালে (২৬ শে জুলাই) বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হওয়ার পর থেকে বিদ্যাসাগর নিজেকে ব্যস্ত
রেখেছিলেন হয় স্কুল-কলেজ পরিচালনায় (মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন ও কলেজ) নতুবা
বিধবাদের বিবাহের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে।
বিধবা বিবাহ
প্রচলনের পাশাপাশি তাদের দুরাবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি
ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। সারা জীবন কঠোর সংগ্রামী, স্বাজাত্যভিমানী, কোনও
কারণেই আপোস না করা— এই চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন—
“আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ
হইবে তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হব না।”
ছবি ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত(লিংকে ক্লিক করুন) |