Wednesday, April 21, 2021

জীবনের ছন্দের শিক্ষক

 লিখেছেন অংশুমান কর

কবির হাতে "সীমানা ছাড়িয়ে" তুলে দেওয়ার মুহূর্ত (দ্বিতীয় ছবি)

ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কীভাবে এখন আর মনে পড়ে না। তবে এটুকু মনে আছে যে, ওঁর সঙ্গে প্রথম কথা বলেছিলাম ফোনেই। তার আগে অবশ্য নানা অনুষ্ঠানে ওঁকে দেখেছিলাম একাধিকবার। কী নিয়ে প্রথম কথা বলেছিলাম তাও ভুলে গেছি আজ। তবে ওঁর সঙ্গে যত কথা বলেছি ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে, তার চেয়ে বেশি কথা বলেছি ফোনেই। রবিবারের আড্ডাতেও গিয়েছি খুবই কম। হাতে গোনা কয়েকদিনই। কখনও কবিতা দেখানোর সাহস পাইনি। পাণ্ডুলিপি পড়ানোর কথা ভাবতেও পারিনি কোনোদিন। মাঝে মাঝেই অবশ্য নানা শব্দের শুদ্ধ বানান জিগ্যেস করেছি। শুধু একবার আমার একটি ছোট্ট বইয়ের নামকরণ নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। ওঁকে ফোন করতেই মুহূর্তে সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন। আমার কয়েকজন বন্ধুর মতো ওঁর পায়ের কাছে বসে কবিতা লেখার পাঠ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি; বলা ভালো, আমার দিক থেকেই  সাহস ও সংকল্পের অভাব ছিল। তবে সাহিত্যের প্রকরণ কৌশল ওঁর কাছে শিখিনি কি কিছুই? একলব্যের মতো যেমন অনেক তরুণ কবিই দূর থেকে ওঁকে দেখে দেখেই শিখেছে অনেক কিছু, ওঁর লেখা পড়ে কিছুটা বুঝেছে রবীন্দ্রনাথ, কিছুটা ছন্দ, তেমন আমিও বুঝেছি। কবিতার পর কবিতা পড়ে শিখেছি নির্মাণের কৃৎকৌশলও। কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতা আজ লিখব না। বছর তিনেক আগে ওই পাহাড়ের মতো স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটি সরাসরি ছোট্ট একটি শিক্ষা দিয়েছিলেন আমায়, বলব সেই শিক্ষালাভের কথা।

        সেবার বইমেলায় আমার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশ পেয়েছে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা 'বীরুৎজাতীয়' সাহিত্য সম্মিলনী থেকে। নাম “সীমানা ছাড়িয়ে”। ভারতবর্ষের পাঁচটি ভাষার তরুণ কবিদের কবিতার বাংলা অনুবাদ ছিল সেই বইয়ে। প্রকাশনা সংস্থার ছেলেগুলি খুবই যোগ্য এবং তরুণ। তাঁদের আবদার বইটি শঙ্খ ঘোষের হাতে দিয়ে একটি ছবি তুলে আনতে হবে। স্যারের জন্মদিনে আমি চেষ্টা করতাম প্রতিবার যাওয়ার আর নিজের বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলি ওঁর হাতে তুলে দেওয়ার। কিন্তু ছবি তুলতাম না সাধারণত। আমাদের বন্ধু সন্দীপন কতগুলো ছবি এমনিই তুলে দিত, বা অন্য কেউ তুলতেন, সেই ছবি পরে পেতাম–এমনটাই হত। নিজের থেকে আমারই সম্পাদিত একটি বই ওঁকে দিয়ে সেই বইয়ের ছবি তুলে ফেসবুকে দেব এটি ওঁকে বলতে আমার সঙ্কোচ হবে জানিয়েছিলাম প্রকাশক ভাইদের। কিন্তু ওদের আব্দার, চেষ্টা করে দেখতে হবে, ছবি যদি পাওয়া যায়। অগত্যা, স্যারকে সেবার ৫ ফেব্রুয়ারি বললাম যে, স্যার একটি বই আপনার হাতে দিয়ে ছবি তুলব। উনি রাজি হলেন। এল ছবি তোলার পালা। আমি ওঁর হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাকালাম ফোনের ক্যামেরার দিকে। সাধারণত, এভাবেই ছবি তোলা হয়। এটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। একটা ছবি তোলাও হয়ে গেল। এরপরই উনি প্রায় ফিশফিশ করে আমাকে বললেন, “এটা কি ঠিক হল?” আমি তো গেলাম ঘাবড়ে! ভুল করলাম কোথায়? কিসে হল ভুল? উনি ঘরের আর কেউ যেন শুনতে না পায় সেভাবেই মৃদু স্বরে আমাকে বললেন, “এই যে তুমি আমার হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাকালে ক্যামেরার দিকে, এতে কি মনে হল যে, বইটা তুমি আমাকে দিচ্ছ? এতে তো মনে হল ছবিটা সাজানো। ক্যামেরা না-থাকলে কি তুমি এভাবেই দিতে আমাকে বইটা?” বুঝলাম কোথায় হয়েছে ভুল! বুঝলাম ছোট্ট দু’তিনটি বাক্যে উনি আমাদের দেখনদারিত্বের ফাঁপা দিকটা কেমন মুহূর্তে উন্মুক্ত করে দিলেন! বলে দিলেন, স্বাভাবিক ছবি তোলার নিয়মটুকুও। আমি আবার সন্দীপনকে বললাম, নতুন করে ছবি তুলতে। এইবার ক্যামেরা না-থাকলে যেভাবে দিতাম বই, দিলাম সেভাবেই। ওঁর মুখে তখন স্মিত হাসি।

        এই ঘটনাটির পরে আজ পর্যন্ত আর কাউকেই বই দিয়ে ছবি তুলিনি। কিন্তু তুললে, ওই ছোট্ট শিক্ষাটুকু ভুলব না। আসলে শঙ্খ ঘোষ ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি চাইতেন শুধু কবিতায় নয়, তরুণ কবিদের জীবনের ছন্দেও যেন ভুল না থাকে।


অংশুমান কর

অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় 

এবং 

প্রাক্তন সচিব, সাহিত্য আকাদেমি, পূর্ব অঞ্চল

অংশুমান কর সমসময়ের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কলমের মুগ্ধতায় মাতোয়ারা হয়েছেন বহু পাঠক। কবিতা ছাড়াও গদ্যের মুক্তাঞ্চলে তাঁর অবাধ গতায়াত। প্রকৃত অর্থে তিনি হলে লেখক, লেখাই তাঁর ধর্ম । তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ  "মৃত অশ্বের সওয়ার" ।  সংগ্রহ করুন নিচের লিংকে ক্লিক করে,

'বইঘর' - অনলাইনে বই কিনুন ও পড়ুন

 

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.