Thursday, June 25, 2020

সৈয়দ কওসর জামালের কবিতাগুচ্ছ

স্বগতোক্তিপ্রায়

৩৮

যেকোনো ওষধির ভিতর লুকিয়ে আছে নশ্বরতার ছায়া

ছায়ার ভিতর অজস্র অন্ধ গলিপথ যা স্বপ্ন দেখানোর ছলে

ঘুরিয়ে মারছে, গুপ্তহননের আড়কাঠি নিস্পৃহ ঘোলাটে চোখ

অজানা ভাষাসংকেত দূর ঘন্টাধ্বনি মতো না-লেখা কবিতা 

দিন শেষ হলে অন্ধ বালকের লাঠি হয়ে নিভৃতে বাস করি

বসবাস সরলরৈখিক, যতিচিহ্নহীন ডায়েরির খোলা পাতা

সেখানে ওড়ে না নিঃসঙ্গ পাখিদের ডাক, শুধু খেয়াঘাট

একই পথে পারাপার, মাঝিদের দীর্ঘশ্বাস কখনো শোনেনি

আমি কি এখানে লিখেছি ভূতগ্রস্ত জলস্রোতের ক্রন্দন

নির্জন তীরে কুড়িয়ে পেয়েছি কখনও নিজের প্রতিরূপ

কে আজ গুপ্তলিপি খোদাই করে রেখে গেল গাছের ছায়ায়

এই যে ভূমিকাহীন শিরোনামহীন গ্রন্থের জীবন

আমি কি প্রচ্ছদ তার, অন্তর্লিপির সঙ্গে যার চিরশত্রুতা

জ্যা-মুক্ত করা বা না-করায় কিছু কি এসে যায়, স্থবিরতা !

 

৩৯

বিষণ্ণতা লিখে দিয়েছিল কেউ পরিদের দুধসাদা ডানায়

সেই থেকে ঘুম নেই তাদের চোখে, স্তব্ধ উড়ান

এই যে নিস্তব্ধ গ্রহ তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না তাদের

সময়ের ধাঁধায় জড়িয়েছে আমাদেরও পা, যত খুলি

ততই জড়ায়, বিষণ্ণতা থেকে ঝরে পড়া ধুলোবালি

আমাদের বিস্ময়ের ওপর পড়ে, স্বপ্নছুট আমি কবচহীন

আত্মবিস্মরণের কাল অচেনা পথিকের মতো পাশে হাঁটে

এ সময় চাঁদ জ্যোৎস্নার সঙ্গে গলে যেতে যেতে ক্ষীণ

কে এখন উড়ান শেখাবে নতুন করে পাখিদের, পরিদের

অসমাপ্ত সব গান আকাশে আকাশে ওড়ে, দমকা বাতাস

কখনও কখনও বধির কানে ঝাপটা মেরে চলে যায়

হাতে মায়ামুকুরের জাদু একান্ত সম্বল এই তাঁবুর জীবনে

ইন্দ্রিয়নির্ভর ভাষার সন্ধানে ফিরি, দর্শন ও স্পর্শ দিয়ে

পড়ে নিতে চাই লুপ্ত উড়ানলিপি, ডানা খুলে পড়ার আগে...

 

 

৪০

নির্জনতা একক পাখির ব্যর্থ উড়ান বিষুবরেখার দিকে

উদ্ভ্রান্ত হাওয়া ছিন্নভিন্ন করেছে যূথচারী জীবনের মুঠি

একএকটি ছিন্ন শাখা নতুন বৃক্ষের জন্ম দেবে বলে

পরিক্রমা করে নক্ষত্র ও আকাশের সম্মোহিত ছায়া

যতই দাঁড়াতে যাই বৃক্ষের নীচে, সেও সরে সরে যায়

কোথায় হোরি নামের গোপন অভিসার বসন্তের গানে

সমস্ত রাগসংগীত আজ অশ্রুত বেদনার কাছে ঋণী

কোনো উৎসবই আর সূচিত হবে না রূপের মূর্ছনায়

পাখির বিষাদঘন চোখ দিয়ে আমি চেয়েছি আকাশে

তাকে বলি, বরং তুমিই নেমে এসো মাথার ওপরে

ছুঁয়ে দেখি মেঘ, কতদিন আর এই আত্মঘাতী আর্তনাদ

বয়ে বেড়াবে হাওয়া, অসময়ে বৃষ্টিকে পারি না ফেরাতে

স্মৃতিহারানোর এই এক মুগ্ধবোধ সরল প্রকরণ

আত্মবিস্মরণের এই কাল খুব কি মৃত্যুর কাছাকাছি...

 

৪১

সময়ের এই শূন্য পরিসরে আগুন জ্বলেনি কতদিন

সব শূন্যতা হাওয়ার দখলে, যদি একে অন্তরিক্ষ ভাবি

নক্ষত্রমণ্ডলীর নীচে পোড়া দেশ, যেখানে পেতেছি সংসার

অক্ষরেখা বরাবর অনাত্মীয় পৃথগন্ন ক্ষুদ্র তাঁবুর প্রহরা

এত প্রশস্ত শূন্যতা তার চারপাশে, তবু উল্লম্ফন রীতি

শেখা হয়ে উঠল না এ জীবনে আর, কখনও অনন্ত রাত

তবু পৌছোনো গেল না কোনো নিজস্ব নক্ষত্রের কাছে

প্রতিটি পথের বাঁকে আমি পুঁতে রেখেছি ভ্রমণবিভ্রম

মৃতদের চিঠি পাই, তাদের সুষুপ্তির মধ্যে রাখি স্বপ্ননির্মাণ

আমাকে ঘিরে রাখে মৌনের আকাঙ্ক্ষাহীন গুচ্ছসংকেত

যে কোনো সংকেতই রহস্যের বোধিবৃক্ষ হয়ে আছে

যে কোনো রহস্যই আজ মানুষের কাছে কৌতূহলহীন

দূরে আকাশের গায়ে জেগে উঠেছে স্যানাটোরিয়াম

শুশ্রূষাহীন এ জীবনে তার হাতছানিটুকু থেকে গেল...  



[ লেখকের কর্পোরেট বায়োডাটা হয় না । লেখকের পরিচয় জন্মসাল-মৃত্যুদিনের উৎসব পালনে নেই । লেখক বেঁচে থাকেন স্রেফ লেখায় । সৈয়দ কওসর জামাল, একজন দাপুটে বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্প্রচারক। আছে ১০ টি প্রকাশিত কবিতার বই এবং কবিতা সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধের সংকলন । শত শত সাহিত্য প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

পেয়েছেন, ১৯৯৫ সালে আশালতা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার । সোপন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে, কবিতা গ্রন্থ 'চেরনোবিলার মেঘ' এর জন্য ।]

সৈয়দ কওসর জামালের বইগুলি পড়ুন,







2 comments:

  1. পড়লাম অসাধারণ লাগলো। কবিকে ভালোবাসা,ভালোথাকুন।

    ReplyDelete
  2. দারুন জামালদা

    ReplyDelete

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.