Saturday, May 22, 2021

বামপন্থার সেকাল একাল

_____________________________________________________________

(প্রবন্ধটি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত এবং পর্বগুলি ঐক্যসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পড়তে গেলে খাপছাড়া ঠেকতে পারে। তাই পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি পর্বের লিংক প্রবন্ধের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ) 

______________________________________________________ 

তুমি কি কেবলই ছবি! (প্রথম পর্ব) 

লিখেছেন

অ নি ন্দ্য ভ ট্টা চা র্য

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত


বামপন্থার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। তবে এবারের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ১৯৪৬ সালের পর এই প্রথম বামপন্থীদের কোনও প্রতিনিধি বিধানসভায় থাকছে না। এই ঘটনাচক্রে বামপন্থা নিয়ে আলোচনা যে এক নতুন মোড় নেবে তা বলাই বাহুল্য। তবে সে আলোচনা উপেক্ষার ও বামপন্থার আর তেমন কোনও ভবিষ্যৎ নেই- এমত নির্বিশেষে এসে দাঁড়াবে নাকি বামপন্থার গোটা চিত্রপটটাই বদলে যেতে বসেছে তেমন কোনওদিকে মোড় নেবে, তা সময়ই বলতে পারবে।

বরং একটু ইতিহাস থেকে শুরু করা ভাল। এই প্রশ্নটি সকলকে নাড়া দেয় কিনা জানি না, তবে আমাকে তো বেশ খোঁচা দেয়। তা হল, মার্কস সাহেবের কোনও লেখায় ‘বামপন্থা’ শব্দটির কোনও উল্লেখ পাই না কেন! এমত নয় যে ‘বামপন্থা’ কথাটির তখনও চল হয়নি। দিব্যি হয়েছে এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর গঠিত সে সময়ের সংসদে স্পিকারের বাঁ দিকে বসা বিরোধী পক্ষের লোকজনেরা বেশ হৈ-হট্টগোল করতেন এবং সেই থেকেই বামাধারীরা সকলের নজর কেড়েছেন। এঁরা মূলত ফরাসি বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন এবং রাজতন্ত্র ও পুরনো ব্যবস্থার বিরোধিতা করতেন। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস প্রণীত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’এ (যা বাস্তব রাজনীতির একটি অনন্য রূপরেখা) নানা শক্তি সম্পর্কে বলা হলেও ‘বাম’ বলে কোনও রাজনৈতিক আধারের উল্লেখ নেই। পরে ১৯০৫ সালে রাশিয়ার সংসদ ‘ডুমা’ সম্পর্কিত একটি আলোচনায় লেনিন ‘বাম’ শব্দবন্ধটিকে স্পিকারের বাঁ দিকে বসা প্রতিবাদীদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, সার কথাটা হল, সংসদে বিরোধীরা স্পিকারের বাঁ দিকে বসতেন এবং তাঁদের উত্থাপিত বাক্যবাণগুলিকে পত্র-পত্রিকায় সবিশেষ উল্লেখ করার কতকটা সুবিধার্থেই তাঁদের ওই অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল। কিন্তু সংসদের বাইরে এই সমস্ত সাংসদদের যেহেতু নানারকম রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচিতি থাকত আর সে সময়ে সংসদের নানান সীমাবদ্ধতার কারণে সংসদ-বহির্ভূত রাজনৈতিক আসরটিই ছিল উচ্চকিত ও নির্ধারক, তাই সংসদ-অনুষঙ্গ বিনা ‘বাম’ কথাটি আলাদা করে উনিশ শতক ও বাম শতকের গোড়ায় তেমন প্রাধান্য পায়নি। সে সময়ে বরং কমিউনিস্ট ব্যতীত সমাজতান্ত্রিক, নারোদনিক, নৈরাজ্যবাদী, চার্টিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক- এই সমস্ত ও আরও বহু বিচিত্র অভিধায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা অন্যান্য মতাবলম্বীদের নামকরণ করার চল ছিল। দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী শব্দবন্ধের অতি সক্রিয় আবির্ভাব মূলত বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে যখন ইউরোপে সংসদীয় গণতন্ত্র আরও প্রসারিত হচ্ছে এবং কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বিপ্লবীদের লড়াই সংসদের বাইরে থেকে সংসদের ভেতরেও প্রসার পাচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয় ১৯১৮ সালে লেনিন লিখিত এই বইটির কথা: ‘বামপন্থী কমিউনিজম- একটি শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’। খেয়াল করে দেখুন, লেনিন কিন্তু ‘অতি বাম’ বা ‘মৃদু বাম’কে দুষছেন না, তিনি ‘বামপন্থী কমিউনিজম’কেই শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা বলছেন। এই বইটি তিনি লিখেছিলেন জার্মানির কমিউনিস্টদের উদ্দেশ্যে, যেখানে তাঁদের সে সময়কার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে তাঁর ‘শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ বলে মনে হয়েছিল। সে সব নিয়ে লেনিনের সঙ্গে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী রোজা লুক্সেমবার্গের বিতর্কও সুবিদিত। কিন্তু আমার বলার কথা এই, মার্কস ও লেনিনের কালে কমিউনিস্ট আর বামপন্থা একই প্রকোষ্ঠের অন্তর্বস্তু ছিল না। বরং, সমাজতান্ত্রিকদের থেকেও কমিউনিস্টদের আলাদা করে ভাবা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতাহার’এর কোনও একটি সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস পরিষ্কার ভাবে জানিয়েছিলেন যে কেন তিনি এবং মার্কস খুবই সুচিন্তিত ভাবে নিজেদের ‘সমাজতান্ত্রিক’ না ভেবে ‘কমিউনিস্ট’ ভাবতে বেশি পছন্দ করেছিলেন।

এই কথাগুলো না বলে নিলে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বামপন্থা নিয়ে আলোচনাগুলি কোনও সদর্থক দিকে গড়াবে না। কারণ, বামপন্থার সঙ্গে কমিউনিজমের যেন এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে বলে অনুমান করে নেওয়া হয়। এই অতিকথাটি আমাদের প্রথমে ভাঙ্গা দরকার।

যার যে পথ

সোভিয়েত বিপ্লবের পর ইউরোপ ও আমেরিকায় যে উত্তাল শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ ওঠে তাতে ক্ষমতাধারীরা অনেকেই সচকিত হয়ে যান এই ভেবে যে কমিউনিস্টরা বোধহয় এবার নানান দেশে ক্ষমতা দখল করে ফেলবে। তাই, শ্রমিক আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন নামিয়ে আনার পাশাপাশি এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলি নিজ নিজ সংসদ ব্যবস্থাকেও পাকাপোক্ত করে তোলে, জনগণের ভোটাধিকারের অধিকারকে সম্প্রসারিত করে ও জনকল্যাণে কিছু আইন প্রণয়নের পথেও এগোয়। কিছুটা আশ্চর্যের হলেও ঘটনা ছিল এই যে, বৃটেন ও জার্মানিতে মহিলারা ভোটাধিকার পায় ১৯১৮ সালে, অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডে ১৯১৯ সালে এবং গণতন্ত্রের স্বধ্বজাধারী আমেরিকায় ১৯২০ সালে। আর যে দেশটি ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’র ঝাণ্ডা তুলে অষ্টাদশ শতকে প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লবটি সম্পন্ন করেছিল, সেই উদার মনের দেশ ফ্রান্সে মাত্র ১৯৪৪ সালে মহিলারা সর্বজনীন ভোটাধিকার পায়।

এরই সঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার অর্জনের লড়াইও ছিল খুবই কঠিন ও কঠোর। ২০০০ সালে এসে তবে ফ্রান্সের শ্রমিকেরা সপ্তাহে ৩৫ ঘন্টার কাজের অধিকার আদায় করতে পেরেছেন। শুধুমাত্র কমিউনিস্টরা নয়, উনিশ ও বিশ শতকের গোটা কাল ধরে অন্যান্য সংস্কারবাদী ও রাজনৈতিক মতালম্বীদের সংগঠনগুলিও শ্রমিকশ্রেণির দাবি আদায়ে সচেষ্ট থেকেছে। যেমন, শ্রমিক আন্দোলনের উর্বর ভূমি বৃটেনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী ও নানান ট্রেড ইউনিয়নের মিলিত উদ্যোগে ১৯০০ সালে গড়ে ওঠে ‘লেবর পার্টি’। এই লেবর পার্টি ১৯২৪ সালে প্রথম বৃটেনে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা দখল করে এবং কালপ্রবাহে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ সালে তাদেরই আমলে কয়লা শিল্পে মজুরি বাড়ানো হয়। এই সময়ে কিন্তু বারবার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শ্রমিক আন্দোলনের শক্তিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে বৃটেন কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতা দখলের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা পেরে ওঠেনি বা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, লেবর পার্টি’র সংসদীয় রাজনীতির অনুশীলন সমাজে এমন একটা প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ তাদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আসীন করতে পারে- এমনতর একটা বিশ্বাস সমাজের বৃহদাংশে জারিত হয়েছিল। অর্থাৎ, সোভিয়েত বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ইউরোপে সংসদীয় রাজনীতি বেশ সবল হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক বদলের সম্ভাবনা অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে সাব্যস্ত হয়। এছাড়াও, আরও নানা ধরনের আন্দোলন সমাজে বিকাশ লাভ করতে থাকে।

এইরকম এই প্রেক্ষাপটেই, যখন সংসদীয় রাজনীতির জোর বেশ বাড়ছে ও সংসদের অভ্যন্তরে নানারকম বাদ-বিতণ্ডা হচ্ছে, তখন মূলত মিডিয়ার দৌলতে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী শব্দবন্ধটি আবারও জনপ্রিয়তা পায়। বামপন্থা অর্থে ধরে নেওয়া হয়, যারা প্রতিবাদী, গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের পক্ষে, তারা সেইসব বিবিধ দাবিদাওয়া ও অসুবিধাগুলিকে রাজনৈতিক ধর্তব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। যেমন, পরবর্তীকালে নারী ও পরিবেশ আন্দোলনও বামপন্থার মধ্যকার প্রবণতা বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সোজা কথায়, বামপন্থা অর্থে সরাসরি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বোঝায় না, এমন একটি বৃহত্তর পরিধিকে ইঙ্গিত করে যেখানে সমাজের শ্রমজীবী মানুষ ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করার পক্ষে মন্থন চলে। তাই, বহু বিরোধী দলও (যারা এক সময় হয়তো শাসক ছিল) নানা সময়ে ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে বামপন্থী সুলভ কথাবার্তাও বলে। সে অর্থে, শুধুমাত্র দলগুলির চেহারা-পতাকা দেখে বামপন্থার সীমারেখা টানাটা যথার্থ হবে না; বরং বামপন্থার এমন একটা পরিসর আমাদের ভাবনা জগতে গড়ে উঠেছে যে সেই পরিসরে কখনও কখনও কোনও ‘অবাঞ্ছিত’ দলও ঢুকে পড়তে পারে। তা বামপন্থার গরিমা বই অন্য কিছু নয়। তবে বামপন্থার অনুষঙ্গগুলি ধারণ করল মানেই যে সে দল যথেষ্ট গণতান্ত্রিক ও উদারচেতা হয়ে উঠল, তা নাও হতে পারে।

যেমন, আমাদের দেশে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারী করে যে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করেছিল, তার পিছনে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এ দেশের সিপিআই দলের মদত ও সমর্থন ছিল। উল্টোদিকে সিপিএম ও অন্যান্য বাম দলগুলি তার বিরোধিতা করে। এমনকি, নিজেকে বাম প্রমাণ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সমাজতান্ত্রিক’ অভিধাটি যুক্ত করেছিলেন। তার মানেই কি আমাদের দেশ একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠেছিল ও তার যাত্রাপথ বামপন্থার আধারে নির্ণীত ছিল? সে সময়ে তাঁর নানাবিধ কাজকর্ম কিন্তু বৃহত্তর জনগণের অনুমোদন পায়নি। ১৯৭৭ সালে জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়েছিল। স্পষ্টতই, শুধুমাত্র ঘোষণায় নিজেকে বাম বা সমাজতান্ত্রিক বলার মধ্যেই মুশকিল আসানের হদিশ নেই। তাই, নামকরণের থেকেও কাজের হদিশ নেওয়াটা অনেক বেশি দস্তুর। তবে প্রচলিত প্রথায়, নামের কিছু মাহাত্ম্য থাকে। কথায় বলে, চেনা বামুনের পৈতে লাগে না! পৈতে গলায় জড়িয়ে যিনি ভুল পুজো করেন, তাঁর থেকে তো পৈতেহীন যিনি যথাযথ পুজোটা করতে পারেন, তিনিই বেশি গ্রহণযোগ্য।

(চলবে ... )


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত ।

2 comments:

  1. এমন একটি অসাধারণ একাডেমিক লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.