লিখেছেন
স ন্মা ত্রা ন ন্দ
ছবি ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ |
গল্প, উপন্যাস মুখ্যত কল্পনার সৃজন। কিন্তু কল্পনার সৃজন
হলেও সে-কল্পনা বাস্তববিমুখ আকাশকুসুম কল্পনা
নয়। সেই সৃজনশীল কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো বিরোধ নেই। বাস্তব পৃথিবী
থেকে উপাদান সংগ্রহ করে কল্পনায় তাদের সাজিয়ে তোলেন গল্পকার। অবশ্য এই সূত্রে একটা
কথা বিশেষভাবে বলে রাখা দরকার। সেই কথাটি হচ্ছে এই: বাস্তবতার সংজ্ঞা ও পরিসরও
কিন্তু ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন। শিশুর কাছে রূপকথার জগতই বাস্তব, যোগী বা
মিস্টিকের কাছে তাঁর ভাব-জগতই বাস্তব, আবার আমার আপনার মতো মানুষের কাছে এই আটপৌরে
সংসারের টুটা-ফাটা ছবিটাই বাস্তব। শিকারির কাছে শিকার ধরার আনন্দই বাস্তব,
শিকারের কাছে শিকারির তির এড়িয়ে সভয়ে পালিয়ে যাওয়াই বাস্তব। এখন গল্পকার কোন ধরনের
বাস্তবতা থেকে তাঁর কাহিনির উপাদান গ্রহণ করবেন কিংবা কোন ধরনের বাস্তবতা থেকে
কাহিনির উপাদান তাঁর সংগ্রহ করা উচিত, সে-ব্যাপারে কোনো অমোঘ নির্দেশ দেওয়া সঙ্গত
হবে না কারও পক্ষেই। তেমন নির্দেশ দেওয়া খুবই অহংকারী মনের কাজ হবে। কথাকার কোন
বাস্তবতা থেকে তাঁর কাহিনির উপাদান চয়ন করবেন, সেটি নিতান্তই নির্ভর করছে কথাকারের
মানসিক প্রক্রিয়া ও স্বাধীন অভিরুচির উপর। সচেতন পাঠক ইচ্ছে করলে লেখকের সেই
মানসিক প্রক্রিয়া বা অভিরুচি কীদৃশ, তা
নিয়ে তলিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। তাতে লাভ হবে এই যে, লেখকের সাহিত্যভুবনটিকে আরও
একটু চিনে নেওয়ার একপ্রকার আন্তরিক প্রয়াস অন্তত করা যাবে।
কথাসাহিত্যে ‘ঐতিহাসিক কাহিনি’-অভিধায় পরিচিত এক বিশেষ
শ্রেণির রচনা রয়েছে। এই ধরনের গল্পও বস্তুত সৃজনশীল কল্পনা থেকেই উৎসারিত হয়, যদিও
সেই কল্পনা ইতিহাসবিরোধী হয়ে উঠলে চলে না। এসব গল্প ইতিহাসকে ‘আশ্রয়’ করে, কিন্তু
ইতিহাস তার ‘বিষয়’ নয়। গল্পকার পাঠককে যে-অনুভূতিতে পৌঁছে দিতে চান এসব গল্পে, সেই
অনুভূতি বা বোধ-ই এসব গল্পের বিষয়। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে ‘আশ্রয়’ হল সেটিই,
যার উপর সমস্ত দিক থেকে আখ্যায়িকাটি নির্ভর করে। আর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে ‘বিষয়’
হচ্ছে সেটিই, যা বিশেষভাবে পাঠকের কান্তিময় মনকে কাহিনির সঙ্গে বেঁধে দেয়।
ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্য দিয়ে লেখক পাঠককে যা দেখিয়ে দিতে চান, যা পাইয়ে দিতে চান,
সেই বোধ বা অনুভূতিই এসব কাহিনির বিষয়। সেই বিষয়ে পৌঁছোনোর জন্য লেখক এজাতীয়
কাহিনি রচনার কালে ঐতিহাসিক কোনো পটভূমিকার উপর নির্ভর করেন মাত্র।
ঐতিহাসিক গল্প বা উপন্যাস ফিকশনাইজড হিস্ট্রি নয়। ঐতিহাসিক
গল্প বা উপন্যাস আসলে হিস্টোরিকাল ফিকশন। এখন প্রশ্ন হল, ইতিহাসের বয়ানও কি
একরকমের? যদি একরকমের হত, তাহলে ঐতিহাসিকদের ভিতর
এত মতভিন্নতা থাকত না কিংবা ইতিহাসের এতগুলো স্কুল অব থটস গড়ে উঠত না। একেক ঐতিহাসিকের আছে
একেকরকম বয়ান। সেই ভিন্নতা শুধু ঘটনার ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য নিয়েই নয়, ঘটনার
বিবরণেও ভিন্নতা রয়েছে ইতিহাসের নানান
স্কুলের নানান বয়ানে। এবং সেই বয়ানগুলির প্রতিটিতেই যথেষ্ট যুক্তি লক্ষ করা যায়।
সেক্ষেত্রে ইতিহাসাশ্রয়ী কাহিনি যিনি লিখছেন, তিনি কোন বয়ানটিকে অসন্দিগ্ধ চিত্তে
গ্রহণ করবেন?
এখানেও জড়িত থাকে লেখকের অভিরুচি ও রুচির প্রশ্ন।
ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পের কথাকারের দায় নেই অভ্রান্ত ইতিহাস রচনার। কারণ, তিনি ইতিহাস
লিখতে বসেননি। ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছেন কেবল তাঁর গল্পের বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলার
জন্য একটি উপযুক্ত আবহ রচনার তাগিদে। তাঁর অভিরুচি অনুযায়ী যথাসম্ভব মান্য
বয়ানটিকেই তিনি একাজের জন্য বেছে নেন— যদি সব কিছুর পরে সাহিত্যরচনাই তাঁর মুখ্য
উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, যদি কোনো বয়ানবিশেষের প্রতি আনুগত্যপ্রদর্শন তাঁর সাহিত্যরচনার
প্রধান অভিপ্রায় না হয়।
কোনো না কোনো সামাজিক আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ইতিহাসের
এইসব বয়ান আবিষ্কৃত ঘটনাসমূহের লিপিবদ্ধ নথি হয়ে ওঠায় (এমনটাই হওয়া উচিত, তা
কিন্তু বলছি না), সেই নথিতে অন্তর্ভুক্ত বহু ঘটনার মধ্যে ফাঁক দেখা যায়। তথ্যের
অপ্রতুলতা তার একটা কারণ। বহু ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না নানা অনুমান প্রয়োগের
পরেও। ওই ফাঁকগুলো ইতিহাসাশ্রয়ী কথাকারের পক্ষে স্বর্ণখনিস্বরূপ। ইতিহাসের কোনো না
কোনো মান্য বয়ানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ থেকে কিংবা মোটামুটিভাবে অবিরোধী থেকে
লেখকের সৃজনশীল কল্পনা ওই সব ফাঁকের ভিতর দিয়েই স্বাধীনতার আকাশ খুঁজে পায়। রচিত
হয় ইতিহাসাশ্রয়ী একেকটি কাহিনির স্মৃতিধার্য আদল।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রণীত ইতিহাসাশ্রয়ী কাহিনিগুলির
ক্ষেত্রে উপরের আলোচনা কম বেশি প্রযুক্ত হতেই পারে। দেখা যাবে, ইতিহাসাশ্রয়ী
কাহিনি রচনায় বিভূতিভূষণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কোনো চরিত্রকে তাঁর
গল্পের মুখ্য আশ্রয় করে তোলেননি। ইতিহাস তাঁর কাহিনির চালচিত্র রচনা করেছে মাত্র। সেই ঐতিহাসিক
চালচিত্রে তিনি যাঁদের কাহিনি লিখেছেন, তাঁরা আমার আপনার মতই সাধারণ মানুষ। অন্তত
বেশিরভাগ গল্পেই তাঁরা কেউ ইতিহাসপ্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব নন। দুয়েকটি ব্যতিক্রম
অবশ্যই আছে। তাঁর ‘শেষ লেখা’ গল্পে প্রধান
চরিত্র বুদ্ধ, কিংবা ‘নব বৃন্দাবন’ গল্পে কবি কর্ণপুর, ‘প্রত্নতত্ত্ব’তে অতীশ
দীপংকর। কিন্তু এ ধরণের উদাহরণ সংখ্যায়
কম। আর একথাও মনে রাখতে হবে যে, বুদ্ধের তুলনায় কর্ণপুর বা দীপংকর অনেক কম আলোচিত
চরিত্র। বস্তুত তাঁর ঐতিহাসিক গল্পের সিংহভাগ জুড়ে আছে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় সাধারণ
মানুষেরই রোদন-বেদন, প্রণয়-বিরহ, উল্লাস-পরিতাপের আখ্যান। এই বৈশিষ্ট্য এতটাই প্রবল
যে, পড়তে পড়তে মনে হয় এসব গল্প কোনো দূর কালের ছবি নয়, এরা যেন আমাদেরই কালের কোনো
না কোনো আখ্যান, যেন আমাদেরই জীবনপথের পরিচিত ধুলো আর ফেনা দিয়ে গড়া এদের
অবয়ব।
তাই যদি হল, তাহলে আদৌ ইতিহাসের আশ্রয়ে এসব কাহিনি রচনা
করতে গেলেন কেন বিভূতিভূষণ? তাঁর বক্তব্য তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তাঁর অতি
প্রসিদ্ধ ‘হিঙের কচুরি’ বা ‘অরন্ধনের নিমন্ত্রণ’-এর মতো অজস্র বহুবন্দিত,
সাম্প্রতিক কালের পটভূমিকায় রচিত, উচ্চ মানের গল্পের মধ্য দিয়ে। আদৌ কেন লিখতে গেলেন
বিভূতিভূষণ ইতিহাসাশ্রয়ী আখ্যানসমূহ? এই জরুরি প্রশ্নটির একটা সম্ভাব্য উত্তর
খোঁজার চেষ্টা করতে পারি আমরা এবার।
গল্প কেমন করে আসে গল্পকারের কাছে? কিংবা গল্পকার কেমন করে
গল্প পান তাঁর মনোলোকে? সেই মানসিক প্রক্রিয়াটিকে প্রথম প্রথম গল্প লিখতে এসে
চিনতে পারা যায় না। কিন্তু বেশ কিছু গল্প লেখা হয়ে যাওয়ার পর গল্প আসার সেই মানসিক
প্রক্রিয়ার একটা অস্পষ্ট আদল গল্পকার টের পেতে শুরু করেন। কেমন একটা আবছা ছাপছোপ,
কয়েকটা আলগোছে বলা কথা কারও, শেষ না হয়ে থমকে যাওয়া কোনো সুর, দিনানুদৈনিক
অভিজ্ঞতার ঢেউ ভেঙে জেগে ওঠা ক’টা ছবি কিংবা একেবারেই নিরবয়ব কোনো থমকে থাকা
চিন্তা, এইসব বা আরও অন্য কিছু মনের ভিতর
জেগে উঠে গল্পকারকে টেনে নিয়ে যেতে চায় অতল জলের দিকে। এমন যখন হয়, গল্প লেখার
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখক টের পান একটি গল্প আসছে, ‘তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে
ঝিলমিল’ এক আশ্চর্য ভুবনের দিকে টিলাপাহাড় পেরিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হয়
গল্পকারকে, তখনও তিনি জানেন না কোথায় তিনি চলেছেন...কিছু পরে একটা অব্যর্থ ইশারা
এসে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় নিশিডাকের মতো... সম্মোহিত পদক্ষেপে গল্পকার সেই ডাক শুনে
এগিয়ে চলেন গল্পটির অন্তিম বাক্যটির দিকে, তাঁর আর অন্য উপায় থাকে না।
এই যে মানসিক প্রক্রিয়া গল্প আসার, সেটি গল্পকারভেদে ভিন্ন
ভিন্ন। এবং এই প্রক্রিয়াটিকে সাধারণত গল্পকাররা লুকিয়ে রাখেন মন্ত্রগুপ্তির শপথের
মতো। এবিষয়ে প্রকাশ্যে কখনও মুখ খোলেন না তাঁরা। আসলে এই অভিজ্ঞতাটি গল্পকারের কাছে
এত পবিত্র; আর পবিত্র বলেই তা গোপন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এই ক্ষেত্রে
ব্যতিক্রম, এই প্রক্রিয়াটিকে গোপন করে রাখতে হবে এমন অভিনিবেশ তাঁর নেই। সম্ভবত,
তাঁর ক্ষেত্রে যা পবিত্র, তা গোপন হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তিনি অনুভব করতেন না।
ফলত, গল্প লেখার গল্প তিনি লিখেছেন সোজাসুজি, হয়ত তাতে মিশিয়ে দিয়েছেন কল্পনার রঙ।
দিনলিপিতে তিনি লিখে চলেছেন তাঁর গল্প বা উপন্যাসের পরিকল্পনা, ইঙ্গিত দিয়েছেন
কীভাবে গল্প আসে তাঁর কাছে, সেই প্রক্রিয়ারও। সেসব ছাপার অক্ষরে প্রকাশিতও হয়েছে
তাঁর জীবদ্দশায়। তাতে অস্পষ্টতা আছে, আড়ালও আছে কিছু কিছু। কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে
তাঁর গল্প লেখার পদ্ধতির কথা অন্তত একবার তিনি মুখ ফুটে বলেছিলেন একটি
আলাপচারিতায়। সেই পদ্ধতিটিকে বুঝতে গিয়ে
আমরা পেয়ে যাই আমাদের পূর্বে উত্থাপিত প্রশ্নের অন্তত একটা মোটামুটি সন্তোষজনক
উত্তর—সেই অনুমেয় হেতু; কেন তিনি তাঁর কতগুলি গল্পে মানবসম্পর্কের আয়াতটিকে ধরতে
চেয়েছেন ঐতিহাসিক পটভূমিকায়— তারই একপ্রকার সম্ভাব্য কারণ।
ওই আলাপচারিতাটি ধরা আছে একটি বইতে। বইটি হিন্দি ভাষায়
রচিত। বইটির নামঃ ‘পথের পাঁচালী কে বিভূতিবাবু’। লেখক যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। মূল
হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ড. তারাপদ ভৌমিক। অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছে ‘বাঙলার
মুখ’ প্রকাশনী থেকে। জন্মসূত্রে বাঙালি না হয়েও বাঙালি সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা
বিভূতিভূষণের এই ঘনিষ্ঠ অনুরাগী যোগেন্দ্রনাথ সিংহ ছিলেন ঘাটশিলায় ডিভিশনাল
ফরেস্ট অফিসার। প্রথম দর্শনে তিনি
বিভূতিভূষণকে একজন সাধারণ মানুষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রকৃত পরিচয় তখনই
পাননি। পরে ধীরে ধীরে পরিচয় প্রগাঢ় হলে তিনি বিভূতিভূষণের প্রকৃত পরিচয় পান। বইটি
সেই বিভূতিসান্নিধ্যেরই স্মৃতিলিপি। নানাবিধ কারণেই বইটি বিশেষ মূল্যবান, এখানে
কিন্তু আমরা আমাদের বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে যাব বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে, যেখানে
জিজ্ঞাসু যোগেন্দ্রনাথকে বিভূতিভূষণ গল্প লেখার পদ্ধতির কথা বলেছেন।
এই প্রসঙ্গে বইটির ৩৮-৪৪ পৃষ্ঠায় বিভূতিভূষণ গল্পসাহিত্যের
অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ কতগুলি কথা সূত্রাকারে বলেছেন, যার থেকে তাঁর মনে গল্প
কেমন করে আসত, সেই মানসিক প্রক্রিয়ার হদিস পাই। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য
প্রাসঙ্গিক অংশটুকু এখানে উৎকলন করব। বিভূতিভূষণ বলছেনঃ
“আধুনিক গল্প অনুভূতি আর কল্পনার প্রতিমূর্তি মাত্র। অনুভূতি যত গাঢ় হবে, কল্পনা যত তীক্ষ্ণ হবে গল্প ততই সফল হবে। এতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, যে বিষয় নিয়ে আপনি লিখছেন সে বিষয়ে আপনার পুরো জ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকা চাই। ... যে ভাবনাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি গল্প লিখতে বসবেন তাকেই মোমেন্ট বা চরম অনুভূতি বলে। এই জন্যই প্রত্যেক গল্পের একটি মোমেন্ট থাকা দরকার। এই মোমেন্টই আপনার গল্পের হাল বা পথনির্দেশক। বাস্তবিক পক্ষে এই বলা যায় যে, এই মোমেন্টই আপনার গল্পের স্রষ্টা। মোমেন্ট আপনার (অর্থাৎ নিজের) দরকারে পাত্রপাত্রী গড়ে নেয় ও ঘটনাকে আবিষ্কার করে। গল্পে সেই পাত্র ও ঘটনার স্থান থাকবে যা সেই মোমেন্টকে মূর্ত করতে সহায়তা করবে। সেই জন্য গল্পে পাত্র ও ঘটনাকে পরিবেশন করার আগে ভেবে দেখতে হবে যে এরা মোমেন্টের কোন অংশকে পূর্ণ করছে। পাত্র যতই ভালো হোক, বিষয়বস্তু যতই বিলক্ষণ হোক, তারা যদি চরম মোমেন্টের কোনো অঙ্গই পূরণ করতে না পারে তবে তাদের থাকা নিরর্থক।”
লক্ষ করুন, বিভূতিভূষণ এখানে বারবার ‘মোমেন্ট’ শব্দটি
ব্যবহার করছেন। এই ‘মোমেন্ট’এর বাংলা অনুবাদ মুহূর্ত নয়। এটি আসলে সনাতন বলবিদ্যা
বা ক্লাসিকাল মেকানিকসের পরিভাষা। এই ‘মোমেন্ট’এর অর্থ হচ্ছে ‘the product of a force and
the perpendicular on its line of action from the point of application.’ যাঁরা পদার্থবিদ্যার পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁদের জন্য সহজ করে এই ‘মোমেন্ট’
শব্দের অনুবাদ করা যেতে পারে ‘ভ্রামক’। অর্থাৎ যা বস্তুকে গতি দেয়,
প্রেরণা দেয়, তাকেই এখানে ‘মোমেন্ট’ বলা হয়েছে। এই মোমেন্ট থেকেই গল্পটি মোমেন্টাম
বা ভরবেগ পায়। বিভূতিভূষণ বলেছেন, ‘যে ভাবনাতে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি গল্প লিখতে
বসবেন তাকেই মোমেন্ট বা চরম অনুভূতি বলে।’ অর্থাৎ গল্প আসার প্রাক্লগ্নে লেখকের
মনে যে বস্তুটি এসে পৌঁছোয়, তা হচ্ছে একটি বিমূর্ত ভাবনা বা অনুভূতি। একেই ‘মোমেন্ট’
বলা হচ্ছে। এই বিমূর্ত প্রেরণা বা মোমেন্টকে প্রাণবন্ত ও মূর্ত করে তোলার জন্যই
গল্পের অবতারণা।
শুধু এটুকুই নয়। এর পর বিভূতিভূষণ যোগেন্দ্রনাথ সিংহের কাছে
তাঁর নিজেরই লেখা দুটি গল্পের রীতিমতো কেস স্টাডি করে দেখিয়েছেন, তিনি ‘মোমেন্ট’
বলতে কী বোঝাচ্ছেন, ওই দুটি গল্পের ‘মোমেন্ট’ কী ছিল এবং ওই গল্প দুটি তাদের ওই ‘মোমেন্ট’-কে কীভাবে এবং
কতটা মূর্ত করে তুলতে পেরেছে। এর মধ্য থেকে শুধু দ্বিতীয় গল্পটি ‘কিন্নর দল’-এর
মোমেন্ট কী ছিল এবং সেই মোমেন্ট কীভাবে গল্পটির পরিবেশ, চরিত্র ও আখ্যানভাগকে
স্থির করে দিয়েছে বা এককথায় গল্পটিকে সর্বার্থে নিরূপণ করেছে, তা খুব সংক্ষেপে
বলতে চাইছি। পাঠক একবারের জন্যেও যেন না ভাবেন, আমরা ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি।
এই আলোচনাটুকুর বড়ই প্রয়োজন শুধু সেই প্রশ্নটির উত্তর দেবার জন্যই; কেন বিভূতিভূষণ
তাঁর বিশেষ এক ধরনের গল্পে আমাদের
দিনানুদৈনিক সুখ-দুঃখ, রোদন-বেদন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা লিখবার জন্য ঐতিহাসিক
পটভূমিকার আশ্রয় নিয়েছেন? শুধু সেই উত্তরটুকু বের করবার জন্যই এই আলোচনার বিশেষ
প্রয়োজন। অতএব, হে পাঠক! হে পাঠিকা! অনুগ্রহ করে আর সামান্য ক্ষণ ধৈর্য ধারণ
করুন।
এলাহাবাদ সঙ্গীত সম্মেলনে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ গাইবেন।
বিভূতিভূষণ ছিলেন শ্রোতার আসনে। মাঝরাতে ফৈয়াজ খাঁ ভৈরবী রাগিনীর আলাপ আরম্ভ
করলেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। একজন বলেই ফেললেন, ভৈরবী তো ভোরের রাগিনী।
ওস্তাদজি! আপনি মাঝরাতে ভৈরবী ধরলেন কেন? স্মিতহাস্যে ফৈয়াজ খাঁ বলেছিলেন, আপনাদের
কথা ঠিক। ভৈরবী ভোরেই গাওয়া নিয়ম। কিন্তু মাঝরাতে ভৈরবী গেয়ে যদি শ্রোতাদের মনে ভোরের ছবি
তৈয়ার করতে না পারি, তবে আমি কীসের ওস্তাদ? এরপর সেই মধ্যরাত্রে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর
কণ্ঠনিঃসৃত ভৈরবী রাগিনী শুনে শ্রোতাদের সত্যিই মনে হয়েছিল, ভোর হয়ে গেছে।
সঙ্গীতের প্রভাবে মানুষের মন প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বাস্তবকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণ
ভিন্ন বা একেবারে বিপরীত অবস্থায় চলে যেতে পারে, এটি বিভূতিভূষণ সেদিন নিজে
সাক্ষাৎ অনুভব করেছিলেন। এই অনুভবটিই তাঁর ‘কিন্নর দল’ গল্পের মোমেন্ট বলে তিনি
জানিয়েছেন।
সেই মোমেন্টের প্রেরণায় তাঁর মনের মধ্যে ফুটে উঠল পাড়াগাঁর
এক গণ্ডগ্রাম। যেখানকার বেশিরভাগ মানুষ কূপমণ্ডূক, কেচ্ছাপ্রিয় ও কুচুটে। সেই
গ্রামের ছেলে শ্রীপতি, পশ্চিমে চাকরি করে। কালেভদ্রে তারা গ্রামে আসে। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সে শ্রীপতি
বিয়ে করে ও বউ নিয়ে গ্রামে আসে। বউয়ের বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, সেকালের পক্ষে মেয়ের
বিয়ের বয়স হিসেবে সেটা বেশিই, উপরন্তু মেয়েটি শ্রীপতিদের থেকে তুলনায় নিম্নজাতীয়।
এ নিয়ে পাড়ার মেয়েমহলে গালমন্দ, পরচর্চা ও পরনিন্দার বান ডাকে। পরে মেয়েটিকে
চাক্ষুষ দেখে ধীরে ধীরে এই নিন্দামন্দ স্তিমিত হতে শুরু করে। মেয়েটি সুশ্রী এবং
তার মিষ্টি ব্যবহার। সে খুবই গুণী মেয়ে, এস্রাজ বাজিয়ে গান করে। এই শ্রীপতির বউয়ের
চরিত্রপ্রভাবে এবং তার গানে ক্রমশ পাড়াগাঁর বউ-ঝিরা প্রভাবিত হয় এবং তাদের
স্বভাবসিদ্ধ পরশ্রীকাতরতার ভাব পাল্টাতে শুরু করে। গাঁয়ের শান্তি ও কমলা নামের
দুটি মেয়ে বউদিদির অত্যন্ত ন্যাওটা। শ্রীপতির বউ কিন্তু কাউকে বলেনি তার আসল
পরিচয়। সে কলকাতার একজন গুণী সঙ্গীতশিল্পী। শান্তির বিয়ে হয়ে যায় অন্য গ্রামে
কিন্তু তার বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। ইতোমধ্যে শ্রীপতির বউ কলকাতায় যায় এবং
অসুস্থ হয়ে সেখানে মারা যায়। তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গাঁয়ের মেয়েবউরা খুবই
শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে শান্তিও শ্বশুরবাড়ির বিড়ম্বনায় বিব্রত হয়ে নিজ গ্রামে
ফিরে আসে। তারপর একরাত্রে শ্রীপতি গ্রামের
বাড়িতে ফিরে এসে গ্রামাফোন রেকর্ডে শ্রীপতির বউয়ের শেষ গাওয়া একটি গানের
রেকর্ড বাজায়। গ্রামের মেয়েরা নৈশ আবহে বসে সেই গান শুনতে পেয়ে অবাক হয়ে যায়—মনে
হয় শ্রীপতির বউ আবার তাদের মধ্যে ফিরে এসেছে। শান্তির মনে হয়, ফিরে এসেছে তার
আইবুড়ো বেলার সুখের মুহূর্তগুলি। তাদের সকলের সময় ভুল হয়ে যায় গানের প্রভাবে এবং
কিছুক্ষণের জন্য তাদের মন স্বভাবসিদ্ধ সঙ্কীর্ণতা থেকে উত্তীর্ণ হয় এক অন্যতর
ভুবনে।
এই হচ্ছে মোমেন্ট আর এই তার ফলীভূত গল্প। এই মোমেন্টটিই
গল্পটিকে গড়ে নেয় একটি বিশেষ আবহে, নির্মাণ করে একের পর এক চরিত্র, বয়ন করে গল্পের
আখ্যানভাগ ও সংলাপ। বিমূর্ত ভাবনাটি মূর্ত হয়ে ওঠে গল্পটির ভিতর দিয়ে।
এখন ওই মোমেন্ট বা প্রাথমিক বিমূর্ত ভাবনাটি যদি
প্রকৃতিগতভাবেই এমন হয়, যার যথাযথ বিকাশ একালের পটভূমিকায় একেবারেই সম্ভব নয়? যদি
ওই মোমেন্ট বা বিমূর্ত চিন্তাটিকে মূর্ত করে তুলতে হলে প্রয়োজন পড়ে অতীত কালের
কোনো পরিবেশের বা আবহের, তাহলে তখন সেই কাহিনী ইতিহাসাশ্রয়ী না হয়ে পারে না।
অত্যধিক শাস্ত্রচর্চায় মন শুষ্ক হয়, প্রেমের কথা ভুলে গিয়ে
মন বিশুষ্ক জ্ঞানের পথ ধরে। শুকিয়ে যাওয়া সেই মন জীবনের সকল পরমতাকে অস্বীকার করে
ধীরে ধীরে নাস্তিবাদী হয়ে ওঠে। যার ফল বিনাশ। এবং বিনাশের পরে হয়তো বা জীবনের নূতন
আবর্তন, শূন্যতার টিলাপাহাড় পার হয়ে গিয়ে হয়তো পরমতার প্রতি কোনো নবীনতর বিহ্বল
জিজ্ঞাসা উদিত হয়। এই বিমূর্ত চিন্তাটি একটি গল্পের মোমেন্ট বা প্রেরণা।
এই প্রেরণাকে রূপ দিতে গেলে দরকার হয়েছিল অতীত যুগের এমন
একটি পর্বের যখন জিজ্ঞাসা বা নাস্তিকতা ধর্মবিশ্বাসের মতনই পবিত্র এক সুমহান
উচ্চতায় উঠেছিল। দরকার হয়েছিল এমন একটা যুগের যখন কেবলমাত্র জ্ঞানের অন্বেষণের
জন্য সমাজের কোলাহল থেকে দূরে সম্পূর্ণ নির্জন অবস্থায় কোনো তপোব্রতী মানুষ
নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে পারতেন। সেই যুগ বৌদ্ধ জৈনদের যুগ, ভারতের প্রাচীন যুগ।
সমকালের আবহাওয়ায় এই মোমেন্ট বিকশিত হতে পারত না। তার বিকাশের জন্যই বিমূর্ত
চিন্তাটি অতীত কালের আবহ বেছে নিয়েছে। বিভূতিভূষণের সেই গল্প ‘নাস্তিক’। এই জন্যেই তা একালের
কোনো গল্প হয়ে উঠতে পারেনি, ইতিহাসাশ্রয়ী গল্প হয়ে উঠেছে।
অতএব প্রকৃতিগতভাবেই কোনো কোনো গল্পের মোমেন্ট এমন যে তা
অতীত কালের আবহ দাবি করে। মোমেন্ট বা
বিমূর্ত প্রেরণাটিই যদি এমন হয় যে যার বিকাশ একালের পরিবেশে ঘটালে তা নিতান্তই
অসম্ভব ঠেকবে, তাহলে একমাত্র সেক্ষেত্রেই ‘মেঘমল্লার’-এর মতো ঐতিহাসিক গল্প সৃজিত
হতে পারে। জ্ঞান ও সৌন্দর্য কামনার দ্বারা
সাময়িকভাবে বশীকৃত হতে পারে; কিন্তু তরুণ চিত্তের আত্মদানের ভিতর দিয়েই সেই
কুক্ষিগত জ্ঞানের মুক্তি ঘটে। হৃদয়াবেগই হৃদয় দিতে উদ্বুদ্ধ করে, প্রাণের সংবেগই
প্রাণদান করতে প্রেরণা জোগায়—প্রেমিকের প্রাণ প্রেমের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে
পাথর হয়ে যেতে পারে এক লহমায়। এই বিমূর্ত চিন্তা বা মোমেন্ট নিজেকে ফুটিয়ে তোলে
তান্ত্রিক বৌদ্ধযুগের পটভূমিকায় ‘মেঘমল্লার’ গল্পে। অন্তিমে বন্দিনী সরস্বতীকে
সম্মোহন থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে প্রদ্যুম্ন পাথর হয়ে যায়। এই যে পাথর হয়ে যাওয়ার
ঘটনা কিংবা এমন চরম আত্মদানের কাহিনি আজকের যুগের পটভূমিকায় বিকশিত হলে, তা
নিতান্ত অসম্ভব ঠেকত না কি? এর জন্যেই দরকার পড়েছে একটা প্রত্ন-আবহের, শত
পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-ধোওয়া অবসিত যুগের চালচিত্রের, যা গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে
তুলতে পেরেছে।
বিজাতীয়ের প্রতি ঘৃণা, স্বজাতীয়দের প্রতি সংকীর্ণ অনুরাগ
ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে পারে সুন্দরের আকর্ষণে। প্রেম নিয়মিত করে দেয় বিশৃঙ্খল
জীবনকে। এতদূর পরিবর্তন আসতে পারে যে, একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ নিজ জাতের
গৌরব পরিত্যাগ করে নতজানু হতে পারে প্রেমাস্পদ বা প্রেমাস্পদার সাংস্কৃতিক বৈভবের
কাছে। এই বিমূর্ত ভাবনা বা মোমেন্টকে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন দুটি ভিন্ন জাতির
পরস্পর সংঘর্ষ এবং সহাবস্থানের কালিক পটভূমিকার। এক গ্রিক যুবক সেখানে এক হিন্দু
রাজকন্যাকে ভালোবেসে প্রেমিকার উপাস্য বিষ্ণুর শরণাগত ভক্ত হয়ে ওঠে। রচিত হয় ‘স্বপ্নবাসুদেব’-এর
মতো একটি ঐতিহাসিক গল্প উপরের মোমেন্টটিকে রূপ দিতে গিয়ে।
যে বিদেশিরা অত্যাচার করতে এসেছিল, কালক্রমে শোষণ ও
লুণ্ঠনের পর তাদের উত্তরপুরুষেরা এ দেশের পলল মৃত্তিকার সঙ্গে মিশে যায়, এদেশের
সংস্কৃতি হয়ে ওঠে তাদেরও সংস্কৃতি। পূর্বপুরুষের রক্তের দাপট আজও ঝাপটা মারে তাদের
শিরায় ধমনীতে, তবু সেই দাপটও শীতল হয়ে আসে ধীরে ধীরে। এই হচ্ছে গল্পের মোমেন্ট, যা
রূপ নেয় ‘নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব’ গল্পে। এ গল্পের পাত্রপাত্রী অতি সাধারণ, তারা
কেউ ইতিহাসপ্রখ্যাত নয় একেবারেই, তাদের রোদন-বেদন আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষেরই
রোদন-বেদন, কিন্তু পশ্চাদ্বর্তী এই মোমেন্টটি এমন যেখানে একটা যুগাবসান দেখাতে
হবে। সাধারণত ঐতিহাসিক গল্পে আমরা যাত্রা করি বর্তমান থেকে অতীতের দিকে,
বিভূতিভূষণের এই গল্পটি কিন্তু যাত্রা করেছে অতীত থেকে বর্তমানের দিকে। সেই
হিসেবেও গল্পটি ঐতিহাসিক গল্পের পর্যায়ে একেবারে ব্যতিক্রমী চরিত্রের।
মানুষ মানুষকে শিকার করে, নিমন্ত্রণের অছিলায় টোপগাঁথা
মাছের মতন মানুষ মানুষকে হত্যা করতে চায়। আবার মানুষই স্নেহের আকর্ষণে বন্দী
মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। মানুষের ভিতর জিঘাংসা ও করুণা দুই-ই আছে। জিঘাংসার
প্রবৃত্তি কখনও বা প্রবল হয়ে উঠে করুণার কণ্ঠরোধ করে। তখন জিঘাংসা চির অভিশাপের
বৈতরণীতে ডুব দিয়ে চলে যায় অবচেতনার গাঢ় অন্ধকারে; সেই প্রেতলোকেই তার
চির-নির্বাসন। এই চিন্তাটিকে গল্পে রূপ দিতে হলে দেখাতে হবে ক্ষমতাদর্পী
স্বেচ্ছাচারী একটা সময়ের। সেই ক্ষমতাদর্পী সময় হতেই পারত সাম্প্রতিক কোনো কাল,
কিন্তু অবচেতনার ওই পাতালঘর, ওই প্রেতলোক বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত হতে হলে
একালের পরিসরে তা আঁটত না। তার জন্যই দরকার পড়েছে বারো ভুঁইয়ার আমল,
ক্ষমতা-করুণা-হননের ত্রিকোণ সম্ভব হতে পেরেছে এক অতিপ্রাকৃত অথচ ঐতিহাসিক
পটভূমিকার ভিতর। ‘অভিশপ্ত’ সেই গল্প।
এ জগৎ প্রলোভনময়। কিন্তু সেসব প্রলোভনের মধ্যেও আছে
উচ্চ-নীচ ভেদ। মানুষ তার বর্তমান অবস্থান থেকে এক লাফে সকল প্রলোভনহীন ভানহীন কোনো
সত্যে আরূঢ় হতে পারে না। তার মনকে আরোহণ করতে হয় ধাপে ধাপে। নিম্নতর প্রলোভনকে জয়
করতে হয় উচ্চতর প্রলোভনের আকর্ষণে। তারপর সে যখন সকল লোভশূন্য, বাসনাশূন্য অবস্থায়
উপনীত হয়, তখন দেখে নিম্ন থেকে উচ্চ সমস্ত প্রলোভনই কল্পিত ছিল, যাকে সে প্রাণপণে
এতদিন সত্য বলে জেনে এসেছে। এই নির্মোহ ভাবনাটি একটি বিমূর্ত মোমেন্ট, যা গতি
দিয়েছে একটি অসামান্য গল্পকে। মোমেন্টটির সমুচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবই লেখককে হাত পাততে
বাধ্য করেছে অলোকসামান্য কোনো চরিত্রের কাছে। সে চরিত্র একালের হতে পারেন না, আবার
একান্তভাবে পুরাকল্পের কোনো পুরুষোত্তমও হতে পারেন না তিনি, কেননা তা হলে তত্ত্বটি
বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। এ জন্যেই ইতিহাসপুরুষ বুদ্ধের কাছে গেছেন বিভূতিভূষণ। রচিত
হয়েছে ‘শেষ লেখা’র মতো গল্প।
সাহিত্যিক ও কবিদের ভিতর প্রায়শই নিজ রচনার প্রতি শ্লাঘাবোধ
থাকে। নিজ রচনাকে তাঁরা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতার্থে কালাতিক্রমী
কিছুই হতে পারে না। বিপুল কাল অতিক্রান্ত হলে শ্লাঘনীয় রচনাও বিস্মৃতির অতলগর্ভে
হারিয়ে যায় কিংবা বিকৃতির শিকার হয়। এমনকি মূল রচয়িতার নামটুকুও হারিয়ে যায়
মানুষের মন থেকে অথবা নামমাত্র বেঁচে থাকে পণ্ডিতের স্মৃতিকোষভাণ্ডারে। যদি
বিভিন্ন যুগের প্রখ্যাত কবিকুল কোনো না কোনো উপায়ে একবার ধূসর অতীত থেকে বর্তমান
কালের মধ্যে টাইম-ট্রাভেলের সুযোগ পান, তাহলে আপন
কাব্যগৌরব যে কত হাস্যকর, তা তাঁরা বুঝতে পারবেন। তাঁরা দেখবেন এই
কবিখ্যাতি ইতিহাসের অরণ্যে যজ্ঞডুমুর খোঁজার মতই প্রায় অসম্ভব। ডুমুরকে সংস্কৃত
ভাষায় বলা হয় উদুম্বর। উদুম্বরেরই পাঠভেদ উড়ুম্বর। এই মোমেন্ট বা বিমূর্ত ভাবনাটিকে রূপ দিতে হলে
নানা যুগের চরিত্রদের মধ্যে দেখা করিয়ে দিতে হবে। শুধু একালের গল্প বললেই চলবে না।
ব্যাস, ভাস, কালিদাস, ভবভূতি, বাণভট্ট, গ্যেটে প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন কালের চরিত্রকে
অতএব বিভূতিভূষণ পরস্পরের মুখোমুখি করিয়েছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে নামিয়ে
এনেছেন কলকাতার ‘প্রদীপ’ সিনেমাঘরে,
যেখানে ‘মেঘদূত’ নামে একটা টকি শো হচ্ছে, কালিদাসের মেঘদূত নয়, আজকের কোনো
খ্যাতিমান লেখক অতীন ঘোষের লেখা অন্য কোনো মেঘদূত। সব দেখে তাঁরা মহা বিরক্ত! এই
বিশিষ্ট মোমেন্টটিই বাধ্য করেছে নানা কালসঞ্চারী এক ঐতিহাসিক গল্প রচনায়। সেই গল্প
‘উড়ুম্বর’।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাবে, এই গল্পগুলির চরিত্রসমূহের
প্রবণতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষারাশি আমাদের সময়েও সমানভাবে বহমান। বহু চরিত্র আমাদেরই মতো
সাধারণ। কিন্তু যে সমস্ত ‘মোমেন্টস’ গল্পগুলির ভরকেন্দ্র, তারা এমনই প্রকৃতির ছিল
যে, তাদের রূপদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হলে অতীতকালের পটভূমিকা ব্যবহার করা ছাড়া
লেখকের গত্যন্তর ছিল না। বিভূতিভূষণের অন্য ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পগুলি নিয়েও আলোচনা
করলে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যাত হয় না। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেন বিভূতিভূষণ
ঐতিহাসিক কাহিনি রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, কিংবা সাধারণভাবে কেন একজন লেখক
ইতিহাসাশ্রয়ী আখ্যান রচনায় অভিনিবিষ্ট হন।
পরিশেষে দুটি ‘বলাই বাহুল্য’ যোগ করা দরকার। এদুটিকে
সতর্কবার্তাও বলতে পারেন আপনারা।
প্রথমত, এই প্রবন্ধে বর্ণিত গল্প লেখার পদ্ধতিটি একান্তই বিভূতিভূষণের নিজস্ব পদ্ধতি। তার সঙ্গে অন্য লেখকদের গল্প-লেখার বা তাঁদের কাছে গল্প-আসার মানসিক প্রক্রিয়া এক হতেও পারে, নাও হতে পারে। প্রত্যেক কথাকারের আছে নিজস্ব প্রকরণ, লেখকভেদে তা ভিন্ন হতেই পারে। কেউ যেন বিভূতিভূষণ-বর্ণিত প্রক্রিয়াটিকে একমাত্র অমোঘ প্রক্রিয়া বলে ভুল না করেন।
দ্বিতীয়ত, উপরে যা আলোচিত হয়েছে, তা যদি কোনো পাঠক নাও পড়েন, কিংবা পড়ে ভুলে যান অথবা উপরের আলোচনা পড়বার পর তাকে মনের একপাশে সরিয়ে রেখে বিভূতিভূষণের ইতিহাসাশ্রয়ী গল্পগুলি পড়তে বসেন, তাহলেও তাদের রসাস্বাদনের পথে অণুমাত্র বাধা তৈরি হবে না, মনে করি। এসব তত্ত্বকথা সাহিত্যামোদীদের বৌদ্ধিক বিলাসের উপকরণ কিংবা গল্পলিখিয়েদের টেকনিকচর্চার উপাদান মাত্র, প্রকৃত পাঠকের তাতে কিছু যাবে আসবে না। বিভূতি-সাহিত্যের মর্মবাণী রয়েছে ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রে। মানবাত্মার যে-জার্নির কথা বিভূতিভূষণ বলেন শৈশব, কৈশোর অতিক্রম করে পরিণত বয়সের দিকে তাঁর ‘পথের পাঁচালী’তে, নাগরিক জীবন থেকে বনেচর জীবনের দিকে তাঁর ‘আরণ্যক’-এ, অতীত থেকে সাম্প্রতিকের দিকে তাঁর ‘ইছামতী’তে কিংবা ইহলোক থেকে পরলোকের দিকে তাঁর ‘দেবযান’ উপন্যাসে, সেই চলার গানই তাঁর ঐতিহাসিক গল্পগুলির মধ্যেও বিধৃত রয়েছে। সেই চলমান জীবনস্রোত এত প্রবল যে, তার প্রবাহপথে আমাদের এসব তত্ত্বকথা খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। এই প্রবাহই বিভূতিভূষণের নিজস্ব আধ্যাত্মিকতা। মন যত বড়ো হতে থাকে সেই প্রবাহপথে, ততই তা গ্রহিষ্ণু হয়ে ওঠে, চলার পথের পাশে পড়ে থাকা জীবনের আপাত-তুচ্ছ শাখাপল্লবগুলিকেও পরম মমতায় সেই পথিক দেবতা কুড়িয়ে নেন তাঁর ঝুলিতে। চলতে চলতে পথিপার্শ্ব হতে এই পত্রপুষ্পচয়ন কারও কারও কাছে ‘ফিরে আসা’ মনে হতেও পারে, কিন্তু ফিরে আসা তা নয়, তা এক বিরতিবিহীন অভিযাত্রিকের জীবনসঙ্গীতেরই মীড় বা মূর্ছনা। আমরা যতই কেন না বারবার কাতর কণ্ঠে বিভূতিভূষণের উদ্দেশে বলি, পায়ে পড়ি, ঠাকুর! আমাদের যেন সাম্প্রতিক ইহলোকেই ফেরা হয়...
অজেয় কথাকার বিভূতিভূষণ সহাস্যে উত্তর দেন—মূর্খ বালক, পথ
তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের পরিচিত জীবনের বৃত্তে, তোমাদের ইহসর্বস্বতার ভিতর কিংবা
সাম্প্রতিকের আখ্যানসর্বস্বতায়। তোমাদের তত্ত্বের প্রাসাদ ভেদ করে, অধ্যাপনাকে
বিচূর্ণ করে, তোমাদের মুগ্ধতার অতিসরলীকরণকে পাশ কাটিয়ে, কালের ইতিহাসের খেয়ায়
পাড়ি দিয়ে পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে... ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ছেড়ে
ইন্দ্রিয়াতীতের দিকে, বর্তমান ছেড়ে অনাগতর দিকে, জ্ঞাতসত্যের গণ্ডী এড়িয়ে
অপরিজ্ঞাত সত্যের উদ্দেশে...
... তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা-ছাতার দলে
ভরে আসে, পথ আমার তখনও ফুরোয় না...
চল এগিয়ে যাই।
সন্মাত্রানন্দ |
অত্যন্ত মায়াবী গদ্য এবং বিশ্লেষণে ক্ষুরধার প্রজ্ঞা। কিন্তু আবেগের ছায়া থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি নেই। পাঠসুখেও তৃৃপ্তি...
ReplyDeleteমনে হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে উনার রচনার সৃষ্টির বিশ্লেষণ পড়লাম। মহারাজ এভাবে উনার ইতিহাসভিত্তিক রচনার পেছনের সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ একমাত্র আপনিই পারেন। নমন।
ReplyDeleteবেশ লাগলো পড়ে... বিশেষ করে ঐ moment বিষয়টা যেটা গল্পে একটা গতি আনে। আপনি সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
ReplyDeleteLekhati porlam.onoboddoy.khub chomotkar bisleshon.
ReplyDeleteএত গভীর ও ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে যে বিশ্লেষন করা যায় এবং তা কেবলমাত্র নীরস তথ্যপূর্ণ না হয়ে সুখপাঠ্য সাহিত্যের রূপ নিয়ে পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করে, তা সত্যিই অবাক করে। মনে হয় লেখক তাঁর সমস্ত কিছু লেখাটিতে দিয়েছেন। এত নিখুঁত যে আর বাকি কিছুই থাকেনা। অসাধারণ রচনা।
ReplyDeleteঐতিহাসিক গল্প, বিশেষ করে বিভূতিভূষণের ঐতিহাসিক গল্পের এত প্রাণবন্ত সুনিপুণ বিশ্লেষণ আগে কখনো পড়েছি বলে মনে হয় না। চমৎকার, সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDelete