লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
Source: Internet |
লাক্ষাদ্বীপের মহিলা চিত্রপরিচালক আইসা সুলতানার ওপর দেশদ্রোহীতার তকমা লাগানো হল। তাঁর অপরাধ তিনি প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। কার্টুনিস্ট মঞ্জুল প্রধানমন্ত্রী
মোদির দেশের উদ্দেশ্যে ভাষণের আগে একটি কার্টুন টুইট করেন। সেই অপরাধে তাঁর চাকরি চলে
গেল। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এবং সমাজজীবনে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা
তোলপাড় করা ম্যাকার্থিবাদ ক্রমশ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। কী ছিল ম্যাকার্থিবাদের
মূল ভাবনা?
বিরোধী যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন বা দলকে হেনস্থা করতে দ্বিধাহীন কণ্ঠে
মিথ্যা অভিযোগ করে যাও, কুৎসা প্রচার করো। এবং কুৎসা প্রচারের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি
করার চিন্তা মনে স্থান দিও না। ১৯৫০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি 'লিঙ্কন দিবস'-এ আমেরিকার
পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় রিপাবলিকান পার্টির মহিলা সদস্যদের একটি সভায় সেনেটর জোসেফ ম্যাকার্থি
ভাষণের মাঝপথে হটাৎই পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে বললেন, 'আমার কাছে একটি নামের তালিকা
আছে। যে তালিকায় কমিউনিস্ট পার্টি ও রুশ গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্কের ২০৫-জনের নাম
আছে। যারা স্টেট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছে।' ম্যাকার্থির এই কথা আগুনে ঘি দেওয়ার কাজ
করল। প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল ওই তালিকার খবর।
সেই ঘটনার ৭১
বছর পর আজকের ভারত। এ এক অদ্ভুত অবস্থা দেশে। সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র যেন আজ ভীত এবং সন্ত্রস্ত।
আর এই ভীতি থেকেই জন্ম নিচ্ছে হঠকারিতা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে নস্যাৎ করার প্রবণতা।
বলাই বাহুল্য বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্র এই ভারতে একটি সংবিধান আছে। এবং সেই
সংবিধানে দেশের মানুষের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভীত,সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র
এখন মনে করছে দেশের সংবিধানে স্বীকৃত 'নাগরিক অধিকার' রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এক
বিপদজনক ধারণা। এতদিন প্রকাশ্যে এ কথা বলেননি রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা, কারণ দেশের ১৩৮
কোটি মানুষ ও বিশ্বদরবারে গণতন্ত্রের মুখোশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর ওই মুখোশটাকেই
ধ্রুব সত্য মনে করে দেশের একটা বড়ো অংশের মানুষ প্রকৃত গণতন্ত্রের মূল ধারণাটাই ভুলে
যেতে বসেছেন। সেটা টের পেয়েই এখন মুখ আর মুখোশের ভেদাভেদ ভুলে প্রতিবাদী কৃষকদের 'পরজীবী' এবং তাঁদের যাঁরা সমর্থন করছেন
তাঁরা 'আন্দোলনজীবী' উচ্চারণ শোনা গেল। এই আন্দোলনজীবীদের পেছনে বিদেশি শক্তির হাত আছে একথাও বলা হচ্ছে, এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে শহুরে নকশাল ও মাওবাদীদের কথা।
শাসক বুঝেছেন যে, যাঁরা নিপীড়িত
মানুষের লড়াইয়ের সামনের সারিতে, তাঁদের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করার সহজ উপায় হল তাঁদের
গায়ে 'দেশদ্রোহী'র তকমা দিয়ে দেওয়া। আর এই কাজে ম্যাকার্থিবাদকেই যে আঁকড়ে ধরা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রের তরফে দুটি রাজ্যে ঘোষণা করা হয়েছে
যে, কেউ যদি দেশদ্রোহী কোনও পোস্ট করেন তবে তা নাগরিকদের মধ্যে নিয়োজিত ভলান্টিয়াররা
যথাস্থানে জানিয়ে দেবেন। এই ঘোষণা এক কথায় মারাত্মক। নাগরিককে সহ নাগরিকের বিরুদ্ধে
হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার সামিল। সাত দশক গণতন্ত্রে বসবাসের পর যে অন্য-বাস্তবে নাগরিকদের
ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এই একই কায়দায় ম্যাকার্থি মার্কিন জনগণের
মধ্যে একটি খাড়া দেওয়াল তৈরি করেছিলেন। তবে ইতিহাস ম্যাকার্থিকে ক্ষমা করেনি।
আসলে,
প্রতিবাদ প্রতিরোধকে রাষ্ট্র সর্বকালে, সর্বক্ষণে ভয় পেয়ে এসেছে। আজকের ভারতবর্ষে যাঁরা
মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীকে গুরু মানেন, তাঁরা দেশদ্রোহী নন। দেশদ্রোহী তাঁরা , যাঁরা
আদিবাসী, দলিতসহ সমাজের নানা স্তরের নিপীড়িত মানুষের কাছের মানুষ, যাঁরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের
অধিকার রক্ষায় সদা তৎপর, যাঁরা নারীর অধিকার ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে। দেশদ্রোহী, এই শব্দটির কোনও আইনগত ভিত্তি নেই। এখনও পর্যন্ত
কে যে ঠিক দেশদ্রোহী এটাই সংজ্ঞায়িত নয়। কেউ যদি মূলস্রোতের বাইরের রাজনীতি করেন তাহলেই
কি তিনি দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হবেন? এসবের কোনও ঠিক নেই। ভারতের সংবিধান যেহেতু এখনও
মুক্তচিন্তার অধিকারের সঙ্গে বাকস্বাধীনতার কথাও বলে থাকে, তাই দেশের শীর্ষ আদালতের
পক্ষেও দেশদ্রোহী কে, সেই বিচার করা সহজ হবে না।
ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০০-এর ৬৬(এ)
ধারা বিলোপের সময় শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, যে কোনও আক্রমণাত্মক কিংবা বিরক্তি
উৎপাদক মন্তব্যই হিংসায় ইন্ধানকারী মন্তব্য হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে না। স্পষ্টতই এটা
একটা সূক্ষ্ম বিচারের প্রশ্ন, অর্বাচীন নাগরিকের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। সাধারণ
মানুষ সচেতন হোন বা না হোন, রাষ্ট্র জানে যে কোনকিছু রাষ্ট্রবিরোধিতার বিবেচ্য বিষয় হলে তা কোনও
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতাধীন হতে পারে না, তার ভিত্তি একান্ত ভাবেই আইনের উপর। সে ক্ষেত্রে
নতুন নির্দেশিকার উদ্দেশ্য শুধু নাগরিককে নাগরিকদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া।
ম্যাকার্থিবাদের
পথে হেঁটে আজ রাষ্ট্র এক গুরুতর অস্ত্র তুলে দিচ্ছে কিছু মানুষের হাতে, স্বনিযুক্ত
সমাজপুলিশের হাতে - যাঁরা গরুর মাংস খাওয়া থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন,
যে কোনও কিছুকেই দেশদ্রোহীতা বলে দাগিয়ে দিতে প্রস্তুত। সমাজবিরোধী, অপরাধী কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ
ব্যক্তিও যে কোনও অপছন্দের লোককে অবলীলায় এই অছিলায় অভিযুক্ত করতে পারবেন, বিপদে ফেলতে
পারবেন। কোনও সুস্থ সমাজ
এমন নির্দেশিকায় চলতে পারে না। ম্যাকার্থির ভারতীয় অনুগামীরা আসলে 'বিরোধী মুক্ত ভারতের'
ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে রাষ্ট্র ও দেশবাসীকে দেশদ্রোহিতার ভূত দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি
করতে চাইছেন।
এই বিষয়ে ভিডিওটি দেখার লিংক,
ReplyDeletehttps://youtu.be/QSrpE9KTjfM