Thursday, June 10, 2021

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আপনিও

 

লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী


ছবিঃ ইন্টারনেট

চলচ্চিত্র পরিচালনায় শুধু মেধা বা চিন্তাশক্তিই নয়, দরকার হয় শারীরিক শ্রমেরও। বয়সের কাছে মাঝে মাঝে হার মানতে হলেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মনে করতেন, একজন পরিচালক কখনও অবসর গ্রহণ করেন না। আজ তিনি চলে গেলেন চির অবসরের দেশে। ১৯৬৮ সালে ১০ মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি( দ্য কন্টিনেন্ট অফ লাভ) দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন বুদ্ধদেব।অর্থনীতির ছাত্র(স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং শিক্ষক(বর্ধমান ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) হওয়ায় ভারতীয় আর্থ সামাজিক অবস্থার বিস্তর দূরত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃত আর্থ সামাজিক অবস্থার তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে, মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার করেন তিনি। 

অন্য সব বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর একটা মৌলিক তফাৎ ছিল। তিনি কখনও কোনও নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে ছবি তোলেননি।তাই তাঁর ষাটের দশকের নির্মানগুলি আজও আধুনিক। সময়ের সঙ্গে বদলানো ভাবনার ছোঁয়া লেগেছে তাঁর প্রায় সব ছবিতেই। সত্যজিৎ, মৃনাল, ঋত্বিকের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমি একধরনের যথেচ্ছাচারে বিশ্বাসী। আমি খারাপ অর্থে যথেচ্ছাচার বলছি না। ক্রিয়েটিভ হওয়া দরকার, এটা না হলে ওই চারপাশের ট্র্যাডিশন মধ্যেই আটকে পড়তে হয়।" এই উক্তির যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর তোলা 'গৃহযুদ্ধ', 'কালপুরুষ','ফেরা', 'উড়োজাহাজ' - প্রভৃতি ছবিতে। তিনি নিজের চিন্তা শুধু নয় চেতনাকেও মেলে ধরতেন তাঁর ছবিতে, নির্ভীকভাবে। তাঁর প্রবলপ্রতাপ পূর্বসূরিদের মত শুধু বাস্তবতাকে ভর করে তিনি হাঁটেন নি, সঙ্গী করেছিলেন মানবমনে লুকিয়ে থাকা দিবাস্বপ্নগুলোকেও। 

যেখানে মানুষ কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মন খুলে ঘুরে বেড়াতে পারে। তাঁর ছবি ছিল স্বপ্ন,জাদু ও বাস্তবতার এক অদ্ভুত মিশেল।স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন তিনি, চেয়েছিলেন বাস্তবতার মাঝেই বেঁচে থাকুক আমাদের স্বপ্নরা। ২০১৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর শেষ ছবিতে (উড়োজাহাজ) তিনি শিল্পের স্বপ্নের কথা বলেছেন।ওই ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন একজন শিল্পীর স্বাধীন চিন্তাভাবনায় কিভাবে হানা দেয় শাসক গোষ্ঠীর প্রভাব। একটা এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি নিয়ে তৈরি এই ছবি অবশ্যই পুরোটা বাস্তব নয়। তাঁর এই বাস্তব ও জাদুর মিশ্রন তিনি রপ্ত করেছিলেন এই কারণে যে কবিতা থেকে শুরু করে শিল্পের নানা গলিতে তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। ষাটের দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি তিনি।তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে অন্যরকম ঘ্রাণ, তেমনই তাঁর ছবিতে রয়েছে অন্য স্বাদ। তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব কথনভঙ্গি দরকার। এই উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল কবিতা লিখতে গিয়ে। সমাজের চলমান অবক্ষয়ী মনোভাবের প্রতি বারবার গর্জে উঠেছে তাঁর ছবি ও কবিতা। 

বুদ্ধদেব ভালোবাসতেন চ্যাপলিন, কুরসওয়া, ডি সিকা, আন্তোনিয়নি ও তারকেভস্কির ছবি। বাস্তবধর্মী ছবির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিতের কাছে। নিজের সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য,  "আসলে আমি খুব প্যাশনেট মানুষ।সিনেমাকে পাগলের মত ভালোবাসি। আমি প্রেমে ডুবে থাকা একজন মানুষ।এই প্রেম কবিতার জন্য, সিনেমার প্রতিও।" তাঁর 'কালপুরুষ' ছবিতে দেখান নায়কের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক এতটাই হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল যে বহু মানুষ তাঁকে ফোন করে তাঁদের বাবার কথা বলতেন, আর কাঁদতেন, কথা বলতে বলতে রাত গড়িয়ে যেত।তাঁর কোনও ছবিই আত্মজীবনীমূলক নয় , তবে তাঁর জীবনমিশ্রিত অনুভূতির ছোঁয়া থাকত তাঁর ছবিতে, যেমন 'বাঘ বাহাদুর'। ছোটবেলার কয়েকটা বছর তিনি কাটিয়েছিলেন একেবারে বাঙালি সংস্কৃতির বাইরে তেলেঙ্গা জাতির সঙ্গে। এই তেলেঙ্গারা বাঘের মত সেজে, নাচত, গাইত, উৎসব করত। সেই ধারণা থেকেই নির্মিত হয় 'বাঘ বাহাদুর'। 

তাঁর সিনেমা চিন্তা এই উপমহাদেশেই সীমিত ছিল না, বিশ্ব সিনেমায় তিনি রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সিনেমা তাঁর কাছে ছিল ক্ষুধার মত। ক্ষুধা নিবারণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দৌড়ে বেড়াতেন।সিনেমা তৈরির এই অদম্য ক্ষুধা তিনি বজায় রেখেছিলেন তাঁর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের যাত্রা জুড়ে।বুদ্ধদেব অর্জন করেছিলেন বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার।খুব কম বাঙালি তাঁর মত এত পুরস্কার পেয়েছেন। সেরা নির্দেশক, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা চলচ্চিত্রকার, এসবের পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন সমালোচকদের পুরস্কার। সেই সব আজ শুধুই স্মৃতি। থেকে যাবে তাঁর কাজ।


শোভনলাল চক্রবর্তী



No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.