Monday, September 20, 2021

আত্মঘাতী মৃত্যুর নিস্তব্ধ বীথিকা : এবাদুল হকের কবিতা

   লিখেছেন

অ রী ন্দ্র জি ৎ   ব্যা না র্জী


সাধারণের স্পর্শে শিহরিত হবার মুহূর্ত যখন গতিশীল দরজায় আচমকাই থমকে যায়, কিংবা শূন্য প্রান্তরে যখন হাজারো শুকনো পাতার পাণ্ডুলিপি হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সারারাত্রি, কখনও উড়ে আসে কর্পূরের গন্ধ, কখনওবা আবহমান শবযাত্রীদের অদৃশ্য ধূসরিত ধূপধূম বয়ে যায় আচম্বিতে। তখন মনে হয় জীবন তো মৃত্যুগন্ধী ক্ষণিকের এইসব যাতায়াতের জন্যই উদ্দিষ্ট। সেখানেই তো সাঁতার কাটা পৃথিবী আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকে। হ্যাঁ, এবাদুল হকের কবিতা যেন সেই পরস্পর দ্বিমুখী অন্বয়ের সাক্ষী যার একদিকে মৃত্যুর দুর্লঙ্ঘ ডাক আর অন্যদিকে একজন কবির সামাজিক দায়। এই দ্বিবিধ অভিমুখের দ্বন্দ্বে পর্যুদস্ত এক ধরণের জরুরি সংকেত এবাদুল হকের কবি-অভিপ্রায়কে নিয়ন্ত্রিত করেছে –

“ভারতীয় ইলেক্ট্রার প্রিয় সম্ভাষণ পারসিক কার্পেট

মাড়িয়ে হেঁটে এলো যেন এক জাতীয় ঐক্যমত

নব্বইয়ের গোধূলির নির্বাসিত নব্বইয়ের বিষণ্ণ ইমারত

হায় হতভাগ্য রাষ্ট্র, তোমাকে বাঁচাতে হবে বাজে জরুরি সংকেত।”

(জরুরি সংকেত, এক গ্লাস জলের ছায়ায়)

এক নির্দেশ্যমান পলাতকা ছায়ায় কাছাকাছি যেন সর্বদাই থাকতে চাইতেন কবি। অন্ধকার, ঘনঘোর ত্রস্ততা, মৌন নক্ষত্রপুঞ্জ, আত্মহননের করিডোরে যেন সবাই মৃত, প্রত্যেকেই যেন সারিবদ্ধ হয়ে ঢুকে যাচ্ছে কবরে। বহুকাল থেকেই সেই কবর যেন খুঁড়ে রাখা হয়েছে, কখনও অজান্তেই নিজেরা খুঁড়েছে নিজেদের কবর। মৃত্যুর সারিবদ্ধ অভিঘাতই তো একবিংশ শতকের শহরে নতুন স্থাপত্য। কবি ‘পলায়কা ছায়া’ কাব্যগ্রন্থে বলেছেন,

“এক টুকরো আগুনের খোঁজে যাযাবর শীত এসে গেল

মৃত যারা বেরিয়ে আসে আত্মার কক্ষগুলো খুলে বিদীর্ণ রোদ্দুরে।

তোমার বুকের মধ্যে আগুনের পেণ্ডুলাম পূর্ব পশ্চিমে গতিশীল

সৌন্দর্যের ময়ূরপুচ্ছ হারিয়ে গেছে কোন এক বইয়ের ভিতরে।”

আসলে সময়ের এক অপরিবর্তনীয় সংযোগচিত্রকে ধারণ করে ঘৃণার অন্ধকার চিত্রমালা সংযোজিত হয়। যেহেতু ‘এক গ্লাস জলের ছায়ায়’, ‘পলাতকা ছায়া’ ও ‘সময়ের জলছাপ’ – এই তিন কাব্যগ্রন্থ ধরেই মূলত আমাদের আলোচনা, তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা সম্পর্কে জেনে রাখার প্রয়োজন বলে মনে হয়। সময়ের এই জলছাপকে তিনি বুকে ধারণ করতে চেয়েছেন কোনো এক অলীক মন্থনক্লিষ্ট স্বপ্নের কাছে। মাঝে মাঝে জেগে ওঠে জীবনানন্দীয় সুর –

“আমার হৃদয় ভরে ভরে ছিল

শত সহস্র শঙ্খচিল,

কোথায় গিয়েছে তারা চলে।

 

অনেকেই যাবে ওরা ঘরে,

ফিরবে দ্বীপের নীড়ে ভগ্ন ডানা মেলে;

আনন্দের আতিশয্যে বিষাদের ঝড়ে

কেউ যাবে ছিন্নপথে একা শীর্ণ ডালে

মন্থনের অপেক্ষায় আলোর আকালে।”

যেন এক মৃত্যুবীজ ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে, অজস্র মৃত্যুশাখায় ভর করে ওঠা অবিনশ্বর ক্ষয়ের রাজ্যে যাদের তখনও মনে পড়েনি ক্ষতবিক্ষত মৃত মাকড়ের ভারে। কবি খুঁজে চলেন –

“অমরত্বের অন্ধকারে মৃত্যুর বীজ যতই ছড়িয়ে পড়ে

জীবন নামক মৌন শাখায় চমকে ওঠে আলো,

প্রেমিকার বুকে ক্ষত শিহরণ পেল কি সমুদ্রের জীব?”

বিমুগ্ধ প্রহরীর মতো তিনি অপেক্ষা করেন নতুন অবলম্বনের তাগিদে। সেখানে যে-সমস্ত প্রেমিকারা কবিতা লিখিয়ে নেয়, দুঃখ দেয়, প্রেমের চোরাবালিতে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রতিদিনের যন্ত্রণাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার ক্ষমতা দেয়। আসলে সত্যের ভাসমান দোলাচলমানতায় আমাদের স্বপ্নের সিঁড়িগুলি তছনছ হতে থাকে, ভেঙে যেতে থাকে বৃত্তের সমাজতাত্ত্বিক কাঠামো। একবিংশ শতকের এই পিপাসা বিক্ষুদ্ধ সমাজমানসিকতাকে যেমন ভাবে দেখেছেন কবি তেমনভাবেই বুনেছেন–

“আমার ও রানির এবং আমাদের জীবন পড়েছি

বুঝেছি আসলে আমাদের সভ্যতার উৎস কেড়ে

রত্নাকর দস্যুরা তাদের মতো করে ইতিহাস লিখে

নিজেদের মিথ্যার অহংকার কিংশুক উড্ডীন

প্রাচীন সভ্যতার উৎস গুহামুখের অন্ধকারে রেখে

আমাদের চোখের ভিতর কালঘুম ঢেলে সিংহাসনে আসীন।”

 যে-সমস্ত চিরজীবী প্রেম আমরা খুঁজতে থাকি কবিতায় ও অন্যান্য সৃজনের পরম্পরায়, তা শুধু আপাত মিথ্যা নয়, সর্বৈব মিথ্যাচারের নামান্তর – কবিতার সজ্জায় একের পর এক তাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। সময়ের চিহ্নায়নই মূলত তাঁর কবিতার সবথেকে বড় উপাদান ও উপকরণ হিসেবে থেকে গেছে। আমরা বিশেষত উল্লেখ করতে চাই – তাঁর ‘পলাতক ছায়া’ ও ‘সময়ের জলছাপ’ বইটির কথা। অপরিসীম বিশ্বাস যখন কঠিন কঠোর সময়ের কাছে অবশেষে হার মানে, পৃথিবীর হতবাক মানুষের অনর্গল নক্ষত্রের মুখে ঠিকানা পাঠিয়েও দিশেহারা হয়ে পড়ে, তখন এবাদুল হক সময়ের জলছাপে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে বলে ওঠেন –

“তর্ক বিতর্কের সোনালি দিনগুলি পিছনে ফেলে

আমি ছিলাম নিশ্চিন্ত, গর্ভিনী গাভির মতো কিছুটা বেপরোয়া”


সময়ের জলছাপ ও শব্দময় মহামারি পৃথিবীর সমস্ত জটিল অঙ্কের ছাপকে মুছে ফেলতে চায় ক্ষণিকেই। অনিবার্য অন্ধকার গহনে প্রতিটি দুর্ভাগ্য আমাদের প্রত্যেকের গোলাপের পরাজিত আবিরের মতো রাঙা করে রাখে। কী সেই দুর্ভাগ্য – কবির কথায় উঠে আসে মতদীর্ণ সেই ঘাতক সময়ের অভেদ্য রূপ –


“প্রতিটি দুর্ভাগ্য আমাদের প্রতিটি পোকার আক্রমণ

গোধূলি দিয়েছে ঠেলে দ্বন্দ্ববাদী মাথার কোটরে

জলের অলিন্দে যেন গোলাপের রক্ত ঝরে,

মতদীর্ণ পৃথিবীর পাঁজরের শ্রুতির ক্ষরণ

বিবশ করে নির্জন অশান্ত রাতে চাঁদের শরীর;

পাতার আত্মায় ক্রমাগত ঢুকে পড়ে কলঙ্কিত জল।

মেঘের বিষণ্ণ ঝুড়ি দূরতর একাকি উজ্জ্বল

ব্যর্থভাবে বিদ্ধ করে যেখানে নিমজ্জিত তুমি সমুদ্র গভীর।”


সময় ও শব্দময় আলেখ্যর মাঝেই মিশে গেছে দেশ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত সাধারণ মানুষের হাহাকার ও যন্ত্রণা। দেশের যুবসমাজের স্বপ্ন ও কল্পনার ফারাক যেন হাঁড়িকাঠে জ্বালানো ক্ষতবিক্ষত বুকের পাঁজরের আড়ষ্টতায় লীন হয়ে রয়েছে। এ যৌবন যেন প্রকৃত অর্থেই দিশাহারা দমবন্ধ অবস্থাকে তুলে ধরে –


“যৌবন আজ কাঁপে থরথর চারিদিকে সন্ত্রস্ত

যৌবন ছিল একদিন জুঁই লবঙ্গলতিকার ফাঁসে।

আজ যৌবন হাজার বছর জপতপ করেও

লাটিম সুতোয় উড়ে যেন শঙ্খচিল আতঙ্কপ্রবর

ছত্রধর সেজে ক্ষমতার কাছে বন্দিজীবন।”


সত্যি এক দশকে দেশ ও দশের অবস্থা কেমন পাল্টে যায়, সাধারণে লেপ্টে যাওয়া ভবিতব্য, কিংবা অগোছালো ভাবে বেলাগাম জীবনযাত্রাই ক্রমে আমাদের সাম্যবাদকে নষ্ট করে। হ্যাঁ ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক অবস্থান্তরকেই কবি দায়ী করেন এর জন্য। আসলে সাধারণের সিদ্ধান্তের নিরিখে যে বা যারা দেশের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় আজ ক্ষয়ের মুখে সমস্ত দায় তো তাদেরই নিতে হবে। 

ভারতবর্ষের দীর্ঘতম ফুটপাত জুড়ে ভেসে থাকে যে-সমস্ত অপমান ও অপরাধের কালোছায়া, তারা জড়িয়ে রেখেছে প্রাচীন কুমড়োর মতো, পেটের ভিতর ফিতাকৃমির মতো অনলসে প্রতিমুহূর্তে। সেই উজ্জল সহবাসের অন্তরালে আজ যারা সন্ধ্যার পরগণায় মুখ ফেরায় তারা তো নির্বোধ ও বেহিসেবি। গভীর দুঃখের বিহ্বলতায় পা না বাড়িয়ে আনন্দ খোঁজে প্রাচুর্যভরা লাশঘরের অন্ধকারে। সেই আজন্ম অপঘাতী সন্তানের জন্ম আর মৃত্যু তো নিশ্চিত, চিরন্তন প্রস্থানের পথ খোলবার অপেক্ষায় – কবি তাই হাঁটতে চেয়েছেন মৃত্যুখণ্ডিত অভিনিবেশের পথ ধরে বাস্তুহারা, অন্নহীন জীবনযন্ত্রণাকে ধারণ করে –

“আমরা হেঁটে যাই স্বজন হারানোর মিছিলে বিহ্বলতায়

নিঃসঙ্গ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের মজ্জায় তাদের উদাসীন

চোখের চাহনি শীতল হীরার মতো জ্বলে, আমরা গলে যায়

আমাদের গভীরে ক্লিষ্ট আত্মজ সারাদিন একান্ত মলিন

আমাদের গ্রীবা স্পর্শ করে আত্মজের বিষাদ তাদের হতাশা।”

এবাদুলদাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা জানতেন বা চিনতেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এ বিষয়ে একমত হবেন যে, এত নিরন্তর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির পত্রিকা সংগঠন হিসেবেই নয়, ৪০ বছর ধরে নিরসল নিবিড় দৃষ্টিকোণ সম্প্রসারের ভিতর দিয়ে তিনি বহু তরুণ লেখককে তৈরিও করেছেন, কিন্তু এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের যে সেই সব তরুণদের সনির্বন্ধ সহযোগিতা আর সাহায্য এবাদুলদা কোনদিনই পাননি, এবং একটা সময় পরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে একলাই লড়েছেন পত্রিকার জন্য। আজ তাঁর অনুপস্থিতি যেন বড়ো বেশি করে সেই অভিমানকাতর যোদ্ধার দায়ভারকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তবুও কবি তো শেষ পর্যন্ত, আশা নিরাশার দোলাচলমানতার মাঝেই বুনে চলেন জাল, সুদীর্ঘ সৌন্দর্যময় অনাগতের অথবা নিজেরই –

“জন্ম ছাড়া মৃত্যুর গৌরব নেই কোন, যদি মরে যাই

অবশ্য জন্ম নেব মধ্যরাতে জেগে ওঠা নারীদের মনে

শিশিরে জলে ভেসে ভেসে আমার কাগজের নৌকাগুলি

ভেড়ে আমার রক্তের দরজায়।

আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তুমি অপার্থিব আলোর দিকে ঝুঁকে

শব্দ খুঁজছিলে আঙুরলতার বনে প্রজাপতির উড্ডয়নে

নিজের বুকে পাথর ছুঁড়ে মেঘলোভী পর্বত চূর্ণ করে

তুমি ছড়িয়ে দিয়েছিলে মেরু সমুদ্রের অকর্ষিত ঢেউয়ের গভীরে।”

 

অরীন্দ্রজিৎ ব্যানার্জী


 

গ্রন্থপঞ্জি –

১) এবাদুল হক – পলাতকা ছায়া, শিল্প নগরী, ২০২০

২) এবাদুল হক -  সময়ের জলছাপ, শিল্প নগরী, ২০২১

৩) এবাদুল হক -  এক গ্লাস জলের ছায়ায়, পালক পাবলিশার্স, ২০২১

Thursday, September 9, 2021

‘প্রথম প্রবাহ’: একজন নারীর হাতে নির্ণীত ভরতবংশের প্রাগেতিহাস

  লিখেছেন

সু ম ন   ব্যা না র্জি

ছবিঃ- ইন্টারনেট

মহাভারতের সত্যবতী চরিত্রটি পরিচিত হলেও অকর্ষিত। বাংলা সৃজনশীল সাহিত্যে মহাভারত নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে অদ্যাবধি। কিন্তু মহাভারতের আদিপর্বের সত্যবতী চরিত্রটি নিয়ে এমন গভীর অন্বেষণ একালের বিশিষ্ট কথাকার সৌরভ মুখোপাধ্যায় বিরচিত 'প্রথম প্রবাহ' উপন্যাসের আগে বাংলা সাহিত্যে কখন দেখা যায়নি। 

মহাভারত মানেই শুধু কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে অভূতপূর্ব ও রোমাঞ্চকর যুদ্ধ , শ্রী কৃষ্ণের রণনীতি নয়। মহাভারতের মত, যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য, এত জটিল, গহন একটি কাব্যের মহিমা ও গতিপথকে অনুধাবন করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মহাকাব্যের উৎসে। মহাভারত হল মহাকাব্য -- এই 'মহা' উপসর্গটি বিশেষ ব্যঞ্জনাবহ। বলা বাহুল্য যে, এটি ব্যক্তিক সুখ দুঃখের অনুভূতি বিজড়িত কাব্যকথা নয়, স্রষ্টার (স্রষ্টাদের) অনন্য নৈর্ব্যক্তিকতার গুণে এখানে সমাজ, ধর্ম, নীতি, নৈতিকতা, দর্শন সর্বোপরি রাজনীতির নানা পরত রয়েছে। সনাতন ভারতীয় পরম্পরার সমস্ত পদচিহ্নই মহাভারতে পাওয়া যায়।   

মহাভারতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক গ্রন্থ বললেও তা অমূলক বা অনৈতিহাসিক হয় না। কেন হয় না? বস্তুত সেই উত্তরকে অনুসন্ধান করাই এই প্রবন্ধের মূল অন্বিষ্ট। মহাভারতীয় রাজনীতির একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব হলেন সত্যবতী। এই চরিত্রটির গুরুত্বকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে সে নারী বলেই। ভারতীয় রাজনীতিতে যে নারীর ভূমিকা কতখানি সক্রিয় ছিল তা এই উপন্যাসটি (যার কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যবতী) পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যায়। 

উপন্যাসটি মোট ষোলোটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম দুই অংশে চেদিরাজ উপরিচয় বসু ও স্বর্গ গণিকা অদ্রিকার কথা রয়েছে। কিন্তু এখানেই রয়েছে তথ্যগত বিরাট ভ্রান্তি। মহাভারতের কাহিনি অনুসারে চেদি রাজের বীর্য শ্যেন পক্ষী নিয়ে যাবার সময় তা নদীতে পতিত হয় এবং তা পান করেই গর্ভবতী হন মৎস্যরূপা অদ্রিকা। অদ্রিকাকে গর্ভবতী অবস্থায় ধীবররাজ দাশরাজ পেয়েছিলেন।

বাস্তবিক পালিত পিতা হলেন ধীবররাজই। কিন্তু উপন্যাসে পাচ্ছি যে - মৃগয়া কালে রাজা বসু প্রেমাসক্ত ও কামমোহিত হয়ে পড়েন। এবং অদ্রিকারই গর্ভজাত সন্তান হল সত্যবতী। উপন্যাসকার কল্পনার আশ্রয়েই তাঁর মূল উপজীব্য বিষয়কে প্রকাশ করবেন এটাই খুব দস্তুর কিন্তু তথ্যগত এমন বিভ্রান্তি থাকাটা কাম্য নয়। 

এই উপন্যাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও কৌতুকপূর্ণ দিক হল গণেশ ও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মধ্যেকার কথোপকথন। মহাভারত রচনাকালে অনুলেখক গণেশ ও কথক বেদব্যাসের পারস্পরিক শর্তের কথা মহাভারতের সব পাঠকরাই অবগত। বেদব্যাস যখন চেদিরাজ ও অদ্রিকার (উপন্যাস অনুযায়ী) কামকেলির বর্ণনা দিচ্ছেন তখন কিছুটা বিরক্ত ও বিস্মিত হয়েই গণেশ জিজ্ঞাসা করছেন ব্যাসদেবকে যে - 

“এই আপনার মহান ভারতবৃত্তান্ত, কবীশ! ধর্মপরায়ণ নরপতি ইন্দ্রিয়ের ফাঁদে পড়ে বেশ্যাগমন করছেন - শ্লোকের পর শ্লোক জুড়ে এই কামতাড়িত অধঃপতনের কাহিনি শোনাচ্ছেন, হায়! ... কামই যে ধর্ম- অর্থ- মোক্ষ সব আচ্ছন্ন করে ফেলল দেখতে পাই।”

 প্রত্যুত্তরে বেদব্যাস বললেন যে - 

“এই ভরতবৃত্তান্ত বাস্তবিকই ব্যাপ্ত হয়ে থাকবে নরনারীর বহুস্তরীয় সম্পর্কে - দেহসঙ্গম তাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে - ... এই সঙ্গম থেকেই ভরতকথার জন্য হল...।” 

কামই যে কীভাবে মানবজীবনের আরও বৃহত্তর অর্থে রাজনীতি ও সমাজের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে তারই এক-টুকরো কাহিনি আকারে বিধৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। রাজক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই কাম ও যৌনতা ঘুরেফিরে আসছে নানান মাত্রায়। 

আবাল্য ধীবর গৃহে প্রতিপালিতা হবার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সত্যবতীর শরীর হয়ে উঠেছিল শক্ত ও কর্মক্ষম। যা ঠিক কমনীয় 'লবঙ্গলতিকাতুল্য' সৌন্দর্য নয়, এক রকমের দৃপ্ত ‘ক্ষত্রাণীসুলভ’ মহিমা ছিল শ্যামলী সত্যবতীর। বলাই বাহুল্য যে, সে বহন করছে রাজরক্ত। ঠিক এই কারণেই তাঁর মানসিক গড়নটি ছিল অন্যদের থেকে আলাদা।  তাঁর গভীর বেদনা নিয়তির অদ্ভুত নিয়ম নিয়ে যে তাঁর সহোদর ভ্রাতা রাজপরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছে। সে পরে যুবরাজ ও রাজা হবে।  কিন্তু তাঁকে প্রতিপালিত হতে হচ্ছে দরিদ্র ধীবর পরিবারে নির্মম কষ্ট ও দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে ! অপ্সরার কন্যা বলেই কি সে ব্রাত্য? সমাজের অদ্ভুত অনুশাসন যে একজন অপ্সরাকে ভোগ করা যায় কিন্তু তাঁর গর্ভজাত সন্তানকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।  ঔপন্যাসিক এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই শকুন্তলার প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন দাসরাজের বয়ানে যে - শকুন্তলাও বিশ্বামিত্রের সন্তান কিন্তু অপ্সরার গর্ভজাত বলেই তিনি স্বীকার করেননি। এমনকি সেই শকুন্তলাকে গোপনে দুষ্মন্ত বিবাহ করল অথচ অনেক কষ্ট করে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হল। ধীদীপ্ত সত্যবতী সঙ্গে সঙ্গে বলে যে - শকুন্তলার পুত্র ভরতই আর্যাবর্তের রাজবংশের জনক ছিল।  বর্তমান উত্তরপুরুষ মহারাজ শান্তনুর মধ্যেও সেই অপ্সরাজাত শকুন্তলারই রক্ত বইছে। 

দাসরাজ অনুমান করে সত্যবতীকে বলেন যে - তুই কি চাস না কোন ধীবর-পরিবারে বিবাহিত হতে? আনমনা সত্যবতী বলে যে - 

“আমার কানের মধ্যে কে যেন বারবার বলে, এ জীবন তোমার জন্য নয়...এই যে-জীবন তুমি কাটাচ্ছ ...! তোমার ভাগ্য লেখা আছে অন্যত্র, হয়তো বিশাল বিপুল কোনও রাজপুরীর ছায়াময় অলিন্দে ... জটিল ও মহান কোনও ঘটনার আবর্ত তোমাকে বন্দি করার অপেক্ষায় রয়েছে ... এক আশ্চর্য অবিস্মরণীয় নাটক বহু দূরে স্থির হয়ে আছে, শুধু তুমি গিয়ে পর্দাটুকু ওঠাও!”  

হয়তো এই কারণেই বলা হয় রক্ত কথা বলে। ধীবররাজের অনুমান অমূলক ছিল না। যুবরাজ দেবব্রত'র প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন সত্যবতী। সে তাঁর নিজের জন্ম বৃত্তান্ত অনাবৃত করে দেবব্রতের কাছে।  কিন্তু সে যেহেতু অপ্সরার গর্ভজাত তাই দেবব্রত দ্বিধান্বিত ছিলেন। সে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে আর্য বংশের রীতি নয় ধীবরপল্লি থেকে রাজবধূ সংগ্রহ করা। তৎক্ষণাৎ সত্যবতীও শকুন্তলার দৃষ্টান্ত আনয়ন করেছিল। যদিও দেবব্রতের একথা অজানা ছিল না যে ‘নিম্নবংশজাত’ সুকন্যাকে বধূ করে আনতে শাস্ত্রমতে কোন বাধা নেই। আর গান্ধর্ব বিবাহ তো শাস্ত্রসম্মত। উল্টোদিক থেকে একথাও সত্য যে সত্যবতীর রূপ,গুণ, মর্যাদা, ব্যক্তিত্বের অনন্য গুণে দেবব্রত নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট হয়েছে হয়েছিল। সে প্রকৃতই রাজবধূ হবারই যোগ্য।  কিন্তু দেবব্রতের কাছে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাশীরাজের জ্যেষ্ঠ দুহিতা অম্বার প্রতি তাঁর প্রণয়।  অর্থাৎ সে বাগবদ্ধ। সত্যবতী যখন তাঁর রূপের বর্ণনা চান তখন তা দেয় দেবব্রত। আসলে প্রেমে ব্যর্থ অভিমানিনী ক্রুদ্ধ সত্যবতী তাঁর মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিল।  তাঁর মনে হয়েছিল দেবব্রত তাকে বারবার বিদ্রুপ করছে; প্রথমে বংশ মর্যাদা নিয়ে দ্বিতীয়বার তার শরীরের মৎস্যগন্ধ নিয়ে। 

কিন্তু বাস্তবিক তো দেবব্রতের সেরকম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। যা সত্য সে সেটাই অকপটে ব্যক্ত করেছিল সত্যবতীর কাছে। কোন ছল চাতুরি বা কামমোহিত হয়ে সে সত্যবতীকে গ্রহণ করেনি। এতে তার প্রেমাস্পদ অম্বার বিশ্বাস ও ভালোবাসার চূড়ান্ত অবমাননা হত। সে তো অন্যান্য রাজাদের মত ছিলেন না। এমনকি তার পিতা শান্তনুর মতোও নন। ঠিক এখানেই দেবব্রত অনন্য-সাধারণ।  কিন্তু মহাভারতের সবচেয়ে ভাগ্য বিড়ম্বিত পুরুষ কর্ণ। ভরতবংশের প্রাক্-ইতিহাসে সত্যবতীর সঙ্গে বাধা পড়ে গেলেন তিনিও। এরপর সত্যবতী একের পর এক লোভ ও স্বার্থের নীরব দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন তাঁর সঙ্গে। যার কারণ সেই সময় জেনেছিল শুধু তাঁরা দু'জনেই কিন্তু ছিল অপ্রকাশিত। এখান থেকেই কাহিনি এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিল। 

রপরের ঘটনা প্রবাহকে আমরা মোটের ওপর সংক্ষেপে আলোচনা করব, 

। ক।   পরাশর মুনি ও সত্যবতীর মিলনে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম।  দীর্ঘদিন নারী সঙ্গ বিবর্জিত মুনি সত্যবতীর রূপ দেখে চূড়ান্তভাবে কামমোহিত হয়ে পড়েন। সত্যবতীও নিজেকে স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন তাঁর কাছে। এটাই সত্যবতীর প্রথম যৌন ও শারীরিক সংসর্গ হলেও উদ্দেশ্য নিছকই যৌনতৃপ্তি ছিল না।  তিনি একরকম পরাশর মুনিকে ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করেন। মুনির আশীর্বাদেই তাঁর শরীর থেকে মৎস্যগন্ধ দূরীভূত হয় এবং সুগন্ধের অধিকারীণী হন। বহু দূর থেকে যে গন্ধ পাওয়া যেত।  পাশাপাশি তিনি দীর্ঘ যৌবনেরও অধিকারী হন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় যে প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছিল মুনির আশীর্বাদে বা যোগবলে তা হল ভরতবংশে প্রবেশের অধিকার -

 

“এত শতবার এই যমুনা নদীতে যাত্রীদের পারাপার করিয়েছিল সে -- কিন্তু তার অঙ্গযমুনাতে একটি যাত্রীকে একবার খেয়া পার করিয়েই তো সারা জীবনের পারানি মিলে গেল তার!”  

 সত্যবতীর জীবনতরী এবার এক অভূতপূর্ব বাঁক নেবার মুখে।

 । খ।   সত্যবতীকে দেখে শান্তনুর কামাসক্ত হয়ে পড়া, দাসরাজের অঙ্গীকার যে সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তান ভিন্ন কেউ সিংহাসনের অধিকারী হবে না, পিতার ইচ্ছা পূরণের জন্য দেবব্রতের সিংহাসন ত্যাগ, সত্যবতীর কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়ে (কারণ সে আশঙ্কা করেছিল যে ভবিষ্যতে যদি জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রতের পুত্রেরা সিংহাসনের উত্তরাধিকার দাবি করে !) দেবব্রতের আমৃত্যু ব্রহ্মচারী থাকার সংকল্প।

 প্রাথমিকভাবে সত্যবতীর সমস্ত ইচ্ছার বৃত্তই পরিপূর্ণ হল। এখন প্রশ্ন হল এত কিছু করে সত্যবতীর লাভ কী হল? তাঁর তো রাজবধূ হবার পথে তো ভীষ্ম কোন বাধাই দেননি! আসলে এখানে তীব্রভাবে কাজ করেছে সত্যবতীর প্রবল যৌন ঈর্ষা। আসলে মহারাজ শান্তনুকে সে বিবাহ করলেও তিনি তাঁর প্রণয়ীনি নন। তাঁদের বয়সের ফারাক ছিল অনেক। এই বিবাহ ছিল সত্যবতীর কাছে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার একটা হাতিয়ার। ভীষ্ম যখন আমাত্যের মুখে শুনেছিলেন যে তাঁর পিতা কোন এক ধীবর কন্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং বিবাহেচ্ছু তখনই বিচক্ষণ ভীষ্মের সত্যবতীর ভবিষ্যতের রূপরেখা বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

 আসলে সত্যবতী ভালোবেসেছিল (এবং আমৃত্যুই ভালোবেসেছিল) দেবব্রতকেই।  কিন্তু একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি তাঁদের প্রণয়ের সমস্ত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেয়। সত্যবতীর অন্ধত্ব ও একরোখা মনোভাবই এই ঘটনার জন্য ঐকান্তিকভাবে দায়ী। সে তখন থেকেই মনে মনে এই প্রতীজ্ঞায় অবিচল ছিল যে - আমি যেমন আমার প্রেমাস্পদকে পাইনি তেমনই আমিও ভীষ্মের প্রেমকে পরিণত হতে দেবো না।  এবং সে তাইই করে দেখাল। এই ছিল সত্যবতীর নীরব প্রতিশোধ। নিয়তির কী অদ্ভুত লিখন - যার হবার কথা ছিল পুত্রবধূ সে হল রাজবধূ ও ‘রাজমাতা’, প্রেমাস্পদ হল পুত্রতুল্য ! সত্যবতীর রাজবধূ হওয়া ইস্তক ভীষ্ম ‘রাজমাতা’ বলেই দস্তুর মাফিক সম্বোধন করত। আসলে এই ‘রাজমাতা’ শব্দবন্ধটির মধ্যে যে প্রচণ্ড মর্মঘাতী ব্যঙ্গের তীরটি আছে তা আঘাত করত সত্যবতীকে। ভীষ্মের অন্তরে যে পর্বতপ্রমাণ যন্ত্রণা ও বেদনা পুঞ্জীভূত হয়েছিল এবং তাঁর সমগ্র ভবিষ্যতের সমুজ্জ্বল সম্ভাবনা বিনষ্টীভূত হয়েছিল  শুধু এই সত্যবতীর জন্য তার অভিপ্রেত প্রতিশোধটুকু ভীষ্ম এইভাবেই তুলত। আর তা নীরবে সহ্য করতে হত সত্যবতীকে।  শুধু দু'জন নর-নারীর মধ্যে ক্ষমতার এই অসম ও অদৃষ্টপূর্ব প্রতিযোগিতা গোটা ভরতবংশের ইতিহাসকে এক ক্রান্তিলগ্নে এনে দাঁড় করায়।

 । গ।  কিন্তু এও বাহ্য।  সত্যবতীর লক্ষ্য ছিল যত শীঘ্র সম্ভব পুত্রোৎপাদন।  কিন্তু বয়স্ক রাজার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছিল না।  তাই কবিরাজি গুপ্তৌষধি প্রয়োগ করে দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের জন্ম দেন সত্যবতী।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দু'জনেই ছিল যৌনক্ষমতা রহিত। কবিরাজ বলেছিলেন দ্বিতীয় পুত্রের যৌনক্ষমতা কুড়ি বছরের পর থেকে কমতে থাকবে।  কবিরাজকে এই কথা গোপন রাখতে বলা হলেও তাকে পরে গুম খুন করা হয়।  কিন্তু সে ভীষ্মকে এইসব কথা বলে গেছিলেন। নিয়ম (অস্যার্থ হিসাব) অনুযায়ী রাজা হন অপরিণত মনস্ক দুর্বিনীত চিত্রাঙ্গদ। হঠাৎ একজন গন্ধর্বের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।  এই মৃত্যু কি ছিল কিছুটা কাঙ্ক্ষিত এবং একই সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পিত? মূল উদ্দেশ্য কি ছিল রাতারাতি যৌন অক্ষম চিত্রাঙ্গদকে সরিয়ে বিচিত্রবীর্যকে রাজা করে উত্তরাধিকার আনা? কারণ সত্যবতী দ্বিধান্বিত ও শঙ্কান্বিত ছিলেন যে বিচিত্রবীর্য যদি উত্তরাধিকার দিতে না পারে তাহলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এত দিনের লালিত ইচ্ছা সব বিফলে যাবে। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রহস্য ভীষ্মের মনে প্রশ্ন তুলে ছিল। কিন্তু এর উত্তর মহাভারতে পাওয়া যায় না। উপন্যাসকার খুব সুন্দরভাবে এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করে পাঠকের আগ্রহকে উস্কে দিয়েছেন।

 । ঘ।  প্রায় বাল্যাবস্থাতেই বিচিত্রবীর্যের (ইতিমধ্যেই সে সিংসাসনে আরূঢ়। এবং বলাই বাহুল্য সে অযোগ্য ও নামমাত্র শাসক) বিবাহ দেওয়া হল। কাশীরাজের স্বয়ম্বর সভা থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে আনা হল তাঁর তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে।  তাঁর ক্ষাত্রোচিত পরাক্রমে মনে মনে তিন কন্যাই অভিভূত হয়েছিলেন।  স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভেবেছিলেন যে ভীষ্ম তাঁদের বিবাহ করবে।  কিন্তু বাস্তবটা তাঁরা তখনও জানতেন না। অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হল।  কিন্তু সন্তান সে দিতে পারল না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত যৌন সংসর্গের ফলে (কিছুটা বিকৃতকামও বটে। তাঁর নাম থেকেই তির্যক ইশারা পাওয়া যায়) তাঁরও অকালপ্রয়াণ ঘটল। গোটা ভারতবংশ এক অভূতপূর্ব ও বিচিত্র সঙ্কটের মুখে পড়ল।  এবার সিংহাসন সামলাবে কে ?

 সত্যবতী যে স্বপ্নের সৌধটি নির্মাণ করেছিল নিয়তি যেন বারবার তা চুরমার করে দিচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা (বস্তুত লোভ), স্বার্থমগ্নতা শুধু তাঁকে নয়, গোটা রাজবংশকে এই বিরাট সঙ্কটের মুখোমুখি করেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে নিজের তৈরি করা সমাধি ক্ষেত্রেই। এবার কী হবে? কারণ তখন উপায় একটাই ভীষ্মকে রাজা করে দেওয়া। এক্ষেত্রে সত্যবতী যদি তাঁর শর্ত তুলে নেয় তবেই তা সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি তা হতে দেবে সত্যবতী? কারণ তাহলে তো তাঁর এতদিনকার সমস্ত শ্রমই বিফলে যাবে! সে তা হতে দিল না কারণ --

 

“যে-দেবব্রতর বংশগৌরবে কালিমালেপন করার মানসে সত্যবতী ভরতজাঙ্গালে অনার্য রক্তধারা প্রবাহিত করলেন, সেই দেবব্রতর বীর্যই আবার ফিরিয়ে আনবে আর্য গরিমা? তার আত্মজদের হাত ধরেই আবার স্বপথে প্রত্যাবর্তন করবে বিপথগামী গৌরবমহিমার উত্তরাধিকার?”

 হ্যাঁ ঠিক এটাই ছিল তাঁর অন্তর্নিহিত অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য। তিনি অনার্য রক্ত আরো নির্দিষ্ট করে বললে দাসরক্তকে অনুপ্রবিষ্ট করাতে চেয়েছিলেন ভরতবংশে।

 ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়ানমিক ক্যারেক্টার সত্যবতী ছিল বস্তত তাই।  ভাগ্য বা নিয়তি তাঁকে যতবার কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে সে ততবারই অভিনব এক একটি অভাবনীয় পরিকল্পনা উদ্ভাবন করেছে। সে যেন কিছুতেই ভাগ্যের কাছে হার মানবে না। সে অংশত হলেও সফল হয়েছে।

 কেন বলছি এ কথা? কেননা এরপর তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন তাঁর কুমারীবস্থায় গর্ভবতী হবার কথা।  তাঁর পুত্র বেদব্যাসের কথা তিনি বললেন।  স্বীয় পুত্রকে প্রতিপালন না করলেও তাঁর অলৌকিক যোগশক্তি ও অতুলনীয় মেধার কথা শুনেছিলেন।  তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁর এই কানীন পুত্রই পারে এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ দিতে। এটাই ছিল তাঁর শেষ তূণ, শেষ অস্ত্র।  বেদব্যাসের ঔরসেই গর্ভবতী হয়েছিল অম্বিকা ও অম্বালিকা।  এবং একজন দাসী।  এঁদেরই পুত্র যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর।  এঁদের জন্ম নিয়ে বিস্তারে আমরা যাব না।  শুধু এটুকু স্মরণযোগ্য যে বিদুর বাদে বাকি দু'জনেই ছিলেন শারীরিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। সবচেয়ে লক্ষণীয় শূদ্র দাসীর গর্ভেই জন্ম নিলেন সবচেয়ে প্রাজ্ঞ,ধীমান, দীর্ঘায়ু ও ধার্মিক বিদুর। একথা ঠিক যে সত্যবতী পূর্ণ সফল হলেন না কিন্তু দাসরক্তকে ঘুরে পথে আর্য বংশে প্রবাহিত করিয়েই ক্ষান্ত হলেন। মহাভারতের স্রষ্টা বেদব্যাসের ধমনীতেও তো সেই দাসরক্ত বইছে।  কাজেই এই চরিত্রটি মহাভারতের এক অনস্বীকার্য স্তম্ভ।  একজন নারীর অস্খলিত ধৈর্য নাছোড়বান্দা মনোভাব গোটা ভরতবংশের ইতিহাসকেই ওলটপালট করে দিল। সরলরৈখিক গতিকে জটিল করে দিল।  প্রস্তুত হল ভবিষ্যৎ কুরু ও পাণ্ডবের দীর্ঘ কুটিল সংগ্রামের ক্ষেত্র।  যার যবনিকাপতন ঘটবে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে।  কিন্তু সে অন্য ইতিহাস !

 শেষ করা যাক উপন্যাসকারের উত্থাপিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও একটি দৃশ্যকল্প দিয়ে,

 । এক। ধীদীপ্ত গণেশ প্রশ্ন করছেন বেদব্যাসকে অম্বিকা ও অম্বালিকা গর্ভবতী হলেন কিন্তু সাধারণ নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছা আবেগকে বলি দেওয়া হল রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে; কার্যত বলাৎকার করাই হল তাঁদের। বেদব্যাস কি নিযুক্ত হলেন না সেই ধর্ষণকারী পীড়কের ভূমিকায়? এর কোন উত্তর তিনি দিলেন না। মহাভারতে এই কূট প্রশ্নের কোন উত্তর নেইও। আরো একটি বিব্রতকারী প্রশ্ন করলেন আপনি জিতেন্দ্রিয় ও কখনো রমণী সংসর্গ না করেই এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে প্রথম সঙ্গমেই গর্ভাধান! বেদব্যাস বললেন অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে রতি শাস্ত্রও আমাকে পড়তে হয়েছে। ঔপন্যাসিক কৌতুককে আর একটু বাড়ানোর লক্ষ্যে গণেশের বয়ানে বললেন যে - নিশ্চয়ই দ্বীপের অধিবাসী কোন রমণী আপনার কাছে এই শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে ‘কেবল পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে আর যে-কোনও ক্ষেত্রে সাফল্য আসুক, শয্যায় তা সম্ভব নয়।’

 । দুই।  উপন্যাসের শেষে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় চুরমার হয়ে যাওয়া সত্যবতীকে পাই। একজন নারী নিজের হাতে গড়ে তোলা পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় যেন নিজেই বন্দি হলেন।  সমাজে এক শ্রেণির নারীর স্বাধীনতা, সম্মান এবং এমনকি ক্ষমতাও যে কতখানি ছিল তাঁর স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে সত্যবতীর মধ্যে।  এ যেন এক অন্য সত্যবতীর ছবিকে অনবদ্যভাবে প্রতিকায়িত করেছেন লেখক।  যাঁর হাত ধরে গোটা ভারতবংশের ইতিহাসের এক অপ্রত্যাশিত মোড় ঘুরে গেল।  নির্মিত হবে কুরু-পাণ্ডবের রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের পটভূমি। যার যবনিকা উত্তোলিত হবে কুরুক্ষেত্রে কিন্তু সে তো অন্য ইতিহাস।

সুমন ব্যানার্জি



Sunday, September 5, 2021

ময়না-বাঈ থেকে যশোদা-মাঈ - একটি উত্তরণের কাহিনি

  লিখেছেন

 সু ম না   সা হা


ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে রাজত্ব করেছেন বহু রাজারাজরা। কেউ কল্যাণ-কর্ম দ্বারা প্রজারঞ্জক রূপে মানুষের হৃদয়-সিংহাসনে স্থান পেয়েছেন, কেউ বা বেহিসেবী ভোগে জীবন অতিবাহিত করেছেন, কেউ বা অত্যাচারী-প্রজাপীড়ক রূপে কালের কষ্টিপাথরে চিহ্নিত হয়ে আছেন। তবে অধিকাংশ রাজা ও সম্রাটরা ছিলেন গুণগ্রাহী, নৃত্যগীতাদি কলার পৃষ্ঠপোষক। বহু প্রসিদ্ধ গায়ক-গায়িকা, নর্তকী ও কলাকারের জীবন ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় না। কিন্তু জীবনে যখন ঘটে মহাজীবনের সংযোগ, তখন সে-জীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। এমনই এক রাজনর্তকীর জীবন ধন্য হয়েছিল পরশমণির ছোঁয়ায়, শিবাবতার স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং যাঁকে ‘মা’-এর আসন দিয়েছিলেন।             

খেতরিরাজের ওয়াকত রেজিস্টার মতে, মহারাজা অজিত সিংহ ১৮৯১ সালের ৪ জুন থেকে ২৩ শে জুলাই পর্যন্ত প্রায় দু’মাস আবুপাহাড়ের খেতরি হাউসে অবস্থান করছিলেন। তারপর স্বামীজীকে সঙ্গে নিয়ে মহারাজা খেতরিতে উপস্থিত হন ৭ই আগস্ট ১৮৯১। পণ্ডিত ঝাবরমল শর্মা জানিয়েছেন (মুনসি জগমোহনলালের কাছ থেকে তিনি যেমন শুনেছেন)— 

“৯ই আগস্ট ১৮৯১, রবিবার রাজকর্মচারীরা মহারাজাকে সেলাম আলম (অভিবাদন) জানাতে জমায়েত হয়। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে রাজাসাহেব এলে রাজস্থানী নিয়মানুসারে রাজকর্মচারীগণ তাঁকে নজরানা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হয়। স্বামীজী মহারাজার সঙ্গে বেলা ২ টা পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। মহারাজা বিকালে টেনিস খেলতে যান। সন্ধ্যার সময় তিনি পার্ষদসহ ফিরে দোতলার দেওয়ানখানার ছাদে বিশ্রাম নিতে আসেন। এই দোতলা সংলগ্ন তিনতলার কুটিরটি নির্ধারিত ছিল স্বামীজীর জন্য। তখন সন্ধ্যা সাতটা। মহারাজা স্বামীজীকে আহবান জানালেন। স্বামীজী দোতলার বারান্দায় উপস্থিত হলে উভয়ে শাস্ত্র-আলোচনায় মগ্ন হন। এমতাবস্থায় একদল নর্তকী মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। (ওয়াকতনামা থেকে আরও জানা যায় যে, একদল নর্তকী তথা সঙ্গীতজ্ঞা রাজদরবার কর্তৃক প্রতিপালিত হতো। সকলের নাম পাওয়া না গেলেও রাজবাড়ির নর্তকীগোষ্ঠীর তিনজনের নাম পাওয়া গেছে—ময়নাবাঈ, ভামরিবাঈ ও জানকিবাঈ)। ঐ দলের নেত্রী মহারাজাকে বলেন, তিনি কি মহারাজার কাছে একটি ভজন গান গাইতে পারেন? (পণ্ডিত ঝাবরলাল শর্মা লিখেছেন, ‘সমাগত নর্তকীয়োঁ কে দল কী এক সুগায়িকা নে জিসকা যৌবন সুলভ চাপল্য প্রৌঢ়তা কী গম্ভীরতা কে রূপ মে বদল চুকা থা, গানা সুনানে কী আজ্ঞা মাগী’, পৃষ্ঠা-৫৮) মহারাজা নর্তকীকে সম্মতি জানালে ময়নাবাঈ বীণা হাতে সুরদাসের ‘হমারে প্রভু অবগুণ চিত ন ধরো’ ভজনটি গাইতে আরম্ভ করেন। স্বামীজী তখন সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। কিন্তু ময়নাবাঈ-এর গানের কলি তাঁর গতি শিথিল করে। তিনি ফিরে আসেন এবং আসর বসে গায়িকার ভজন শোনেন।”

সন্ন্যাসীর পক্ষে ঐরকম নাচগানের আসরে উপস্থিত থাকা অনুচিত, এই যুক্তিতে স্বামীজী গানের আসর থেকে উঠে যাচ্ছিলেন, মর্মাহত হয়ে গায়িকা যেন স্বামীজীর কথার নীরব প্রতিবাদস্বরূপ সুকণ্ঠে গান ধরলেন—‘প্রভু, হমারে অবগুণ চিত না ধরো/সমদরশী হ্যায় নাম তিহারো, অব মোহে পার করো।’ গানের ভাষা রাজস্থানী হিন্দি হলেও স্বামীজী তা ভালোই বুঝতেন, আর সঙ্গীতের তিনি আজীবন রসগ্রাহী। গানের মধ্যে দিয়ে গায়িকা এই কথাই বললেন, 

‘তুমি যে সন্ন্যাসী, সমদর্শীত্ব সাধুর ধর্ম। লোহার বঁটি—তা দিয়ে ঠাকুরঘরে পূজার নৈবেদ্যর ফল কাটা হয়, আবার ব্যাধের ঘরে ঐ বঁটি মাংস কাটার কাজে ব্যবহার হয়—এতে বঁটির কি দোষ? পরশমণি ছুঁয়ে দিলে উভয়ই সোনা হতে পারে। অতএব, হে প্রভু, তুমি আমার দোষ দেখো না!’ 

সঙ্গীতের এই হৃদয় মন্থনকারী অপূর্ব মর্মার্থ স্বামীজীকে আকুল করে তুলল। তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ নারী মাত্রই জগন্মাতার প্রকাশ দর্শন করতেন, এমনকি পতিতা ও কুচরিত্রা রমণীর মধ্যেও তিনি জগজ্জননীকেই দর্শন করেছিলেন। স্বামীজীর এক সত্য উপলব্ধি হল—‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’—এই হল অদ্বৈত অনুভূতির চরম লক্ষ্য। এক ব্রহ্ম বিরাজিত সর্বত্র—ভেদবুদ্ধি কল্পনা মাত্র। অতএব তিনি সঙ্গীতের আসরে উপস্থিত হলেন। গান সমাপ্ত হলে তিনি ঐ বাঈজীকে ‘মা’ সম্বোধন করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন। বললেন, 

‘মা, আমি অপরাধ করেছি, আপনাকে ঘৃণা করে উঠে যাচ্ছিলাম। আপনার গানে আমার চৈতন্য হল।’ 

পণ্ডিত ঝাবরলাল শর্মা লিখেছেন, 

‘গানা সমাপ্ত হুয়া, স্বামীজী গদ্গদ হো গয়ে। উনকে নেত্র সে অশ্রুধারা বহ্ চলী। স্বামীজী কে মুঁহ্ সে তৎকাল নিকল পঢ়া—ওহ, ইস পতিতা স্ত্রী নে এক ভক্ত কা পদ গাকর ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’—কে তত্ত্ব কো হৃদয়ঙ্গম করা দিয়া হ্যায়। ... উসকে বাদ উস গায়িকা কো স্বামীজী নে ‘জ্ঞানদায়িনী মা’ কহকর সম্বোধন কিয়া, বেশ্যা কা হৃদয় সে নিকলা ভাবগর্ভিত আশীর্বাদ ‘যুগ যুগ জীও মেরে লাল’।  

‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের বিবরণ অনুসারে, পরে এই ঘটনার উল্লেখ করে স্বামীজী বলেছিলেন, 

‘গানটি শুনে আমার মনে হল, এই কি আমার সন্ন্যাস? আমি সন্ন্যাসী, অথচ আমার ও এই নারীর মধ্যে আমার ভেদজ্ঞান রয়ে গেছে, সে ঘটনাতে আমার চোখ খুলে গেল। সর্ব বস্তু সেই এক সত্তার অভিব্যক্তি জেনে আমার আর কাউকে নিন্দা করার জো ছিল না।’

ঘটনাটি সামান্যই, কিন্তু রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারা ও ভারতীয় সনাতন ধর্মে সন্ন্যাসীর উচ্চ আদর্শ বুঝবার পক্ষে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বামীজী পেলেন সকল নারীতে মাতৃদর্শনের বাস্তব পাঠ। আর ময়নাবাঈ কী পেলেন? তিনি স্বামীজীর মধ্যে পেলেন তাঁর ‘নন্দলালা’-কে। সেদিনই গান সমাপ্ত হলে স্বামীজী যখন তাঁকে ‘মা’ সম্বোধন করেছিলেন, ময়নার মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত আশীর্বাণী ঝরে পড়ে—‘যুগ যুগ জীও মেরে লাল!’ (ঐ, পৃষ্ঠা-৬০)। স্বামীজীর অন্তরের শ্রদ্ধাসঞ্জাত সেই ‘মা’ ডাক নারীর চিরন্তন মাতৃত্ববোধের মর্মমূল স্পর্শ করেছিল, আর সেই মায়ের আশীর্বাদ যে কতদূর সত্য হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বামীজী লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন ও থাকবেন যুগ যুগ ধরে। আর নন্দলালার সঙ্গে বেঁচে থাকবেন তাঁর যশোদামাঈ। ময়নার জীবনের পরবর্তী পর্ব খুব লোকই জানে। পরশমণির ছোঁয়ায় লোহা সোনা হয়ে যায়। আর ময়না ছিলেন ভক্তিমতী এক সুরসাধিকা। তাই অতি অনায়াসে তাঁর জীবনে প্রবেশ করেছিল বিবেকানন্দ নামক সেই উজ্জ্বল-ভাস্করের জ্যোতিকিরণ। যে গবাক্ষ-পথে এল সেই কোটি-ভানু-কিরণ, কৃপা-দাক্ষিণ্যের দক্ষিণাপবনবাহী সেই বাতায়নটি উন্মোচন করেছিলেন অবশ্যই খেতরি-রাজ অজিত সিংহজী।

আমরা চলে যাই ময়নাবাঈ-এর জীবনের ফ্ল্যাশ-ব্যাকে। জয়পুরের মেয়ে সরমা কাংক্ষানিয়া ছেলেবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে ভাগ্যের ফেরে পৌঁছে যায় চাঁদপোল বাজারে কেরামতি বাঈজীর কাছে। বাঈজী তাকে সস্নেহে লালন-পালন করে নাচ-গানে তালিম দিতে থাকেন। যৌবনে সঙ্গীতে ও নৃত্যে অসামান্যা পারদর্শিনী সরমা ‘ময়নাবাঈ’ নামে হয়ে ওঠেন বাঈজী সমাজে ‘আনমোল-হীরা’। কোনও রাজাই এমন গুণী শিল্পীর কদর করতে পারবেন জেনেই কেরামতিবাঈ তাকে পাঠালেন যোধপুর রাজদরবারে। ময়নাবাঈ যোধপুর রাজপ্রাসাদে ঠাঁই পেলেন। যোধপুর রাজ-পরিবারের গুরু ছিলেন আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য দয়ানন্দ সরস্বতী। এই সংবাদ পেয়ে রাজগুরু দয়ানন্দজী ময়নাবাঈ-এর যোধপুরে অবস্থান না-মঞ্জুর করে দিলেন। যোধপুররাজ এমন গুণী শিল্পীকে হারাতে চাননি, কিন্তু রাজগুরুর নির্দেশ অমান্য করার স্পর্ধাও দেখাতে পারেননি। তাই পাশের রাজ্যের প্রিয় বন্ধু খেতরির রাজা অজিত সিংহজীকে অনুরোধ করেন ময়নাবাঈ-এর দায়িত্ব নিতে। অজিত সিংহ ছিলেন দক্ষ বীণাবাদক ও প্রকৃত সঙ্গীত-রসজ্ঞ। তিনি ময়নাবাঈ-এর প্রতিভাকে সম্মান জানালেন এবং রাজ্যে নবাগতা এই শিল্পীর বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। খেতরি রাজ্যে শুরু হল ময়নাবাঈ-এর নতুন জীবন—রাজার খাস গায়িকা রূপে উৎসবে অনুষ্ঠানে বিশেষ পালাপার্বণে তার ডাক পড়ে রাজদরবারে, সঙ্গীতলহরী পরিবেশন দ্বারা রাজা, রাজ-অতিথি ও অমাত্যবর্গের মনোরঞ্জনের ফরমায়েস হয়। অন্যান্য সময়ে শহরের নির্দিষ্ট বাসগৃহে ফরমায়েসী সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। দিনগুলো এমনি করেই কাটছিল। গজল-ঠুমরী রেওয়াজের সুরে মুখরিত, আতর-গুলাব সুবাসিত ময়নাবাঈ-এর বাড়ি খেতরি রাজ্যের জোয়ান-মদ্দ সকলেরই পরিচিত।

কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে ময়নার জীবনের বাঁক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রচনা করছিলেন। ময়নার গান শুনে, বেদান্তের ‘প্র্যাকটিকাল’ পাঠ হৃদয়ঙ্গম করে সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষির চোখ ভরে এল জলে, তিনি ময়নাকে ডাকলেন ‘মা’ বলে—সন্ন্যাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত সে সম্বোধন কেবল কথার কথা নয়, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত সত্য, তা যেন ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ আসার মতোই ময়নার অন্তরের সুপ্ত মাতৃত্বের রুদ্ধ দুয়ারে হানলো আঘাত! তার মনোরাজ্যে জলপ্রপাতের অঝোর ধারার মতো আরম্ভ হল বিপুল আন্দোলন।



এরপর দ্বিতীয়বার স্বামীজীর খেতরিতে আগমন বিশেষ উপলক্ষে। তখন বিশ্ব-ধর্মমহাসম্মেলনে যোগদান করতে স্বামীজীর পাশ্চাত্য যাত্রার আর খুব বেশী দিন বাকি নেই। কিন্তু যাত্রার আগে একবার তাঁকে খেতরিতে পদার্পণ করতেই হবে—শিষ্য, পরম হিতৈষী, অনুরাগী সুহৃদ রাজা অজিত সিংহ-এর এই অনুরোধ তিনি কি করে ফেলবেন? স্বামীজীর আশীর্বাদে অপুত্রক রাজা ও রানীর পুত্রসন্তান লাভের দীর্ঘকালের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, ছেলে জয়সিংহ-এর জন্মোৎসবে যোগদান করে স্বামীজী শিশুপুত্রকে আশীর্বাদ করবেন—খেতরি রাজের একান্ত বাসনা। সেই উপলক্ষ্যে অল্পসময়ের জন্য স্বামীজীকে খেতরিতে ধরে এনেছেন অজিত সিংহ-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মুন্সি জগমোহন। সেইবার ১৯ দিন খেতরিতে ছিলেন স্বামীজী—২১ এপ্রিল থেকে ১০ই মে, ১৮৯৩। সেই জন্মোৎসব উপলক্ষে সুসজ্জিত পান্নাতালাব সরোবরে একটি সুশোভিত নৌকার উপরে নিমন্ত্রিত রাজন্যবর্গসহ উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং মহারাজা এবং ভজন পরিবেশনকারী নর্তকীদের দল। সেখানেই জগমোহনলাল স্বামীজীকে নিয়ে রাজসকাশে উপস্থিত হলেন, রাত্রি দশটা পর্যন্ত নৌকায় অবস্থান করে মহারাজা ও স্বামীজী পান্নাতালাব ত্যাগ করে রাজপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। সেদিনও স্বামীজী প্রাণভরে উপভোগ করেছিলেন ময়নাবাঈ-এর সুরেলা কণ্ঠের গীতসুধা। সব কাজ সুসম্পন্ন হওয়ার পরে স্বামীজী জয়পুর হয়ে বোম্বাই রওনা হলেন।

ময়নাবাঈ-এর কণ্ঠে গীত সুরদাস রচিত একটি ভজন স্বামীজীর খুবই প্রিয় ছিল, ‘দয়ানিধে তেরি গতি লখি ন পরে/ধর্ম অধর্ম, অধর্ম ধর্ম করি,/অকরণ করণ করৈ’। এই গানটি ও ময়নাবাই-এর কণ্ঠে তাঁর প্রথম শ্রুত ভজনটি, ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত না ধরো’, যেটি তাঁর সকল নারীতে মাতৃদর্শনের পাঠ সম্পূর্ণ করেছিল—দুটিই তিনি নিজের নোটবই-এ টুকে রাখেন ও পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পরিব্রজনকালে অনুরুদ্ধ হয়ে গেয়ে শোনাতেন। ‘স্বামী বিবেকানন্দ কা রাজস্থান প্রবাস’ নিবন্ধে স্বামী বিদেহাত্মানন্দ লিখেছেন, ‘স্বামী অখণ্ডানন্দজী বলেন, স্বামীজী যখন জুনাগড়ে ছিলেন, তখন ঝান্ডুভটজী স্বামীজীর কণ্ঠে ‘দয়ানিধে তোরি গতি...’ ভজনটি শুনে কেঁদেছিলেন। জামনগরে শংকর শেঠ প্রতিদিন ভজন শোনার জন্য মূলজী নামে জনৈক ব্রাহ্মণ গায়ককে বহাল রেখেছিলেন। মূলজী স্বামীজীর স্নেহধন্য এবং স্বামীজীর কাছ থেকে বহু ভজন রপ্ত করেছিলেন। কাথিওয়াড় ভ্রমণকালে অখণ্ডানন্দজী এক সম্পন্ন গ্রামে হাজির হলে তিনি মূলজীর কণ্ঠে ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত’, ‘দয়ানিধে তোরি গতি’ এবং ‘শশধর তিলক ভাল গঙ্গা জটাপর’ গান তিনটি শুনেছিলেন। বলা বাহুল্য এই গানগুলি স্বামীজীর কাছ থেকেই মূলজীর শেখা। ১৮৯৩ সালে মাদ্রাজে মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের গৃহে স্বামীজী ‘প্রভু মেরো অবগুণ চিত’ ভজনটি গেয়েছিলেন। ডঃ এম সি নাজুন্ডা রাও তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘সাগরতটে চাঁদিনী রাতে স্বামীজীর মুখমণ্ডল থেকে এক অপরূপ জ্যোতি বিকীর্ণ হতো। সেই সময় তিনি হৃদয়স্পর্শী ভজন গাইতেন। সেই ভজনগুলির মধ্যে ‘দয়ানিধে তেরী গতি লখি ন পড়ো’ বিশেষ স্মরণীয়।’    



১৮৯৭ সাল, ডিসেম্বর মাসে স্বামীজী খেতরি এলেন তৃতীয় বার। সেবার মহারাজাও ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন ও তাঁর গুরু বিবেকানন্দও পাশ্চাত্যবিজয় সম্পন্ন করে স্বদেশে ফিরেছেন। খেতরিবাসী মহারাজাসহ রাজগুরু স্বামীজীকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য পান্নাতালাব সংলগ্ন ময়দানে ১২ ডিসেম্বর, ১৮৯৭ এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। স্বামীজী ও অন্যান্য কেউ কেউ সেদিন ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপরে রাজনর্তকীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সেই অনুষ্ঠানের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ময়নাবাঈ। স্বামীজী আগাগোড়া রাজাজীর সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।  

ময়না স্বামীজীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের আবেদন জানালো রাজাজীর কাছে। স্বামীজীর সম্মতি পেয়ে ময়না এল, দর্শন ও প্রণামান্তর প্রকাশ করল তার অন্তরের আকুল প্রশ্ন—‘স্বামীজী, মেরে লালা, আমাদের কি মুক্তি হবে না?’ এর ঠিক কয়েক দশক আগে ‘চৈতন্যলীলা’ পালা দর্শনে চৈতন্যের সাজে বিনোদিনী-কে দেখে যখন আনন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—‘আসল-নকল একাকার দেখলাম!’ এই একই আকুল প্রশ্ন ধ্বনিত হয়েছিল নটী বিনোদিনীর কণ্ঠে। পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ নটী বিনোদিনীকে দিয়েছিলেন উদ্ধারের মন্ত্র—‘বল্ মা, গুরু হরি হরি গুরু!’ স্বামীজী ময়নার সংশয় দূর করে উত্তর দিলেন, ‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে সকলের মুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কেবল তাঁর স্মরণ-মনন কর!’ ময়না আরও জানতে চায়—‘মনের সংশয় অশান্তি কিভাবে দূর হবে লালা?’ স্বামীজী নিদান দিলেন, ‘তীর্থভ্রমণ কর এবং সাধ্যমত অনাথদের সেবা কর। তাহলেই অফুরন্ত আনন্দ ও শান্তির সন্ধান পাবে।’

স্বামীজীর আশ্বাস পেয়ে ঘুচে গেল ময়নার মনের সংশয়ের আঁধার-মেঘ। তীর্থভ্রমণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তাঁর মন। মহারাজা অজিত সিংহ তাকে অনুমতি দিলেন, পাথেয়ও জোগালেন। ময়নাবাঈ তার বান্ধবী ভামরিবাঈকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তীর্থদর্শনে। গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে তাঁরা পৌঁছালেন নৈনিতাল। সেখানেই তখন অবস্থান করছিলেন ময়নার জীবন-দেবতা। এক মন্দিরে সে সংবাদ তাঁরা পেলেন। অনেক সন্ধান করে অবশেষে স্বামীজীর সাক্ষাৎ মিলল। সিস্টার নিবেদিতা তাঁর The Master As I Saw Him গ্রন্থে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন— 

‘আমরা নৈনি সরোবরের উপর অবস্থিত একটি মন্দিরে দুই বাঈজীকে পূজায় রত দেখিলাম। পূজান্তে তাহারা আমাদের নিকট আসিল এবং আমরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় তাহাদের সহিত আলাপ করিতে লাগিলাম। স্বামীজী তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে অস্বীকার করায় উপস্থিত জনমণ্ডলীর মনোমধ্যে একটা আন্দোলন চলিয়াছিল, কিন্তু স্বামীজী গ্রাহ্য করেন নাই।’ 

ভামরিবাঈ জানিয়েছেন, তাঁরা তীর্থদর্শনকালে স্বামীজীকে দর্শন ও প্রণাম করেছিলেন এবং স্বামীজী তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন। তীর্থ পর্যটন সেরে ময়নাবাঈ ও ভামরিবাঈ আবার গতানুগতিক জীবনস্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন।

এরপর তাদের জীবনে পরপর ঘটে গেল দুটি হৃদয়বিদারী দুর্ঘটনা। ১৯০১ সালে একটি দুর্ঘটনায় অকালে প্রয়াত হলেন তাদের পরম শুভাকাংক্ষী অভিভাবক রাজা অজিত সিংহজী। পরের বছর আরাধ্য দেবতা স্বামীজীও পরমধামে যাত্রা করলেন। শোক-বিহ্বল ময়নাবাঈ কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন খেতরি ছেড়ে পা বাড়ালেন অনির্দিষ্টের পথে। খেতরির প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে শোনা গেছে যে তাঁরা ময়নাবাঈকে বৃন্দাবনে ভিখারিনীর বেশে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। সেখানে তিনি ভজন ও কীর্তন গেয়ে ভিক্ষা করতেন, ভিক্ষালব্ধ অর্থে কয়েকটি অনাথ বালককে পালন করতেন। স্বামীজীকে জীবনের ধ্রুবতারা করে তিনি তাঁর নির্দেশেই পথ চলছিলেন। ঐ অনাথ বালকরা ময়নাকে ডাকত ‘দেবী মা!’ ময়নার জীবন মাতৃত্বের সুধায় ভরে উঠেছিল। বালকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলে খেতরি থেকে তিনি ভামরিকেও নিজের কাছে আনিয়ে নিয়েছিলেন। দুই সখী মিলে বহু পরিশ্রমে সেই অনাথ-আশ্রমটি চালাতে থাকেন। এর অনেক পরে বৃদ্ধাবস্থায় ময়না অসুস্থ হয়ে পড়লে ময়নার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ভামরি তাঁকে খেতরির পুরনো আস্তানায় রেখে আসেন। 

স্বামীজীর সঙ্গে যখন ময়নার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তখন সে ২১ বছরের পূর্ণ যুবতী। খেতরি রাজের বদান্যতায় খেতরি সবজিমাণ্ডির পাশে কানুরিয়া হাভেলি-তে বাঈজীদের বসবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। ঐ এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিদের মুখে শোনা যায়—‘এই বাঈজী কুটিরটি কোন অজানা যাদুস্পর্শে পালটে গিয়েছিল, সেখানে মুজরোর ঘুঙ্গুর-ধ্বনি স্তব্ধ হয়ে বেজে উঠেছিল শংখঘণ্টা। সন্ধ্যায় আতরগন্ধের বদলে ছড়িয়ে পড়েছিল ধূপের গন্ধ। সুরেলা চটুল সঙ্গীত হারিয়ে গিয়েছিল ভক্তিরসাশ্রিত কৃষ্ণ-আরাধনার ভজনে। শ্রীরামকৃষ্ণ-শ্রীমা-স্বামীজীর পট স্থাপন করে তাঁদের সাধনভজনেই শেষের দিনগুলো যাপন করেছিলেন বৃদ্ধা সাধিকা ময়না।

১৯৬২ সালে ৯২ বছর বয়সে স্বামীজীকে, তাঁর ‘নন্দলালা’-কে স্মরণ করতে করতে ময়নাবাঈ থেকে যশোদামাঈ-এ উত্তীর্ণা এই সাধিকা রামকৃষ্ণলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ কথা—‘আমার কোন ভয় নেই, আমার কোন আকাংক্ষা নেই, আমার কোন দুঃখ নেই—স্বামীজী যে মেরা নন্দলালা।’ শাস্ত্রবাণীর চিরন্তন সত্য মূর্ত হয়েছিল তাঁর জীবনে—‘অভী’-তে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন তিনি, নির্বাসনা হয়েছিলেন, তিনি দুঃখের তিমির-রাত্রি পেরিয়ে অনন্ত আনন্দলোকের ভূমিতে বসতি গড়েছিলেন—কারণ অবতীর্ণ ঈশ্বর স্বামী বিবেকানন্দকে তিনি পুত্র জ্ঞান করেছিলেন।

এভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে একটি জীবন ‘বিবেকানন্দ সূর্য’-এর কিরণে স্নাত হয়ে মানবজীবনের পরম সার্থকতা লাভ করেছিল।

 

সুমনা সাহা

তথ্যসূত্র—

  • Swami Vivekananda: A forgotten Chapter of His Life—Beni Shankar Sharma; Sharman Publishers, 1963
  • ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’, স্বামী গম্ভীরানন্দ, প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠা-৩৩৯-৪০); উদ্বোধন কার্যালয়, মে ১৯৮৪।
  • উদ্বোধন পত্রিকা, আশ্বিন-১৪২০, নবম সংখ্যা (সেপ্টেম্বর-২০১৩); ‘স্বামীজী-সান্নিধ্যে রাজপুতানার তিন কন্যা’—তড়িৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • ‘বিবেক জ্যোতি’ পত্রিকা; নিবন্ধ—‘স্বামী বিবেকানন্দ কা রাজস্থান প্রবাস’—স্বামী বিদেহাত্মানন্দ; জুলাই-সংখ্যা, ২০০৬।
  • রাজস্থান মে স্বামী বিবেকানন্দ, পণ্ডিত ঝাবরমল শর্মা, মিলাওয়াড়া সংস্কৃতি প্রকাশন, নিউ দিল্লী,    (প্রথম প্রকাশ-১৯৮৯)


Thursday, September 2, 2021

রাজ্য ভাগের রাজনীতি ও অন্যান্য

 লিখেছেন

শু ভ জি ৎ   পা ত্র


ভারতবর্ষে রাজ্য ভাগ কিংবা নতুন রাজ্যের সৃষ্টি মোটেই কোনো অভিনব বিষয় নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই ১৮৯৫ সালে বিহার রাজ্যের ওড়িয়াভাষী মানুষেরা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরেছিল। ওড়িয়া জাতীয়তাবাদী নেতা মধুসূদন দাসের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন সফলতা অর্জন করে ১৯৩৬ সালে পৃথক ওড়িশা রাজ্য গঠনের মধ্যে দিয়ে। তারপর ভারতের একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত তৎকালীন মাদ্রাজ রাজ্যের তেলুগুভাষী মানুষেরা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরেছিল এবং সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১৯৫৩ সালে তেলুগুভাষীদের নিজস্ব রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে তামিলভাষীদের জন্য তামিলনাড়ু রাজ্য গঠিত হয়। 

এই রাজ্যগুলি গঠনের পেছনে কাজ করেছে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি,সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ করবার আকাঙ্ক্ষা। তাই ভাষা-সংস্কৃতির ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের এই ন্যায্য দাবি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালে,সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপরেও এই আইনকে হাতিয়ার করে বিভিন্ন নতুন রাজ্য গড়ে উঠেছে।  ২০০০ সালে বিহারের একটি অংশ আলাদা ভাবে ঝাড়খণ্ড রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। একই বছর উত্তরপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয় উত্তরাখণ্ড রাজ্য। ২০১৪ সালের ২ জুন তেলুগুভাষী অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলা নিয়ে গড়ে ওঠে তেলেঙ্গানা রাজ্য। এই নতুন রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া এখনো থেমে নেই।

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠেছে। অতি সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের সাংসদ জন বার্লা উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করবার দাবি জানিয়েছেন,সেই দাবিকে সমর্থন করেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়,বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ঝাড়গ্রাম,বিষ্ণুপুর,দুই মেদিনীপুর সহ জঙ্গলমহলকে পৃথক রাজ্য করার দাবি জানিয়েছেন। তবে এই দাবিগুলি কি জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন?নাকি নেহাত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!বলাই বাহুল্য,সমগ্র উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে দিয়ে নতুন রাজ্য গঠনের দাবি উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের দাবি নয়। আসলে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিটা দার্জিলিং জেলার গোর্খা জনগোষ্ঠীর মানুষদের।  ১৮১৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে নেপালের রাজার একটি চুক্তি হয়,যা সুগাউলি চুক্তি নামে খ্যাত। 

সেই চুক্তি অনুযায়ী নেপালের অধিকারে থাকা হিমাচল প্রদেশ,সিকিম ও দার্জিলিং ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। সেই সময় কিন্তু দার্জিলিং জেলায় মাত্র চারটি লেপচা পরিবার ছিল,কোনো গোর্খা পরিবারের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৩৫ এর কাছাকাছি সময় ইংরেজরা সেখানে চা-বাগান গড়ে তোলে এবং সেই সূত্রে শ্রমিক হিসেবে নেপালের গোর্খা নামক জেলার বাসিন্দারা দার্জিলিং এ আসতে থাকে। এই দার্জিলিংও ১৭৬৭ সালে মাল্লা রাজাদের অধিকারে ছিল। ভারতভুক্তির পূর্বে চিরকালই যে দার্জিলিং নেপালের অধিকারে ছিল,একথাও ইতিহাসসম্মত নয়।  স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে,১৯৫০ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে নেপাল সরকারের একটি অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি ভারতের হাতে চলে যাওয়া অংশগুলিকে নেপালে ফিরিয়ে এনে 'গ্রেটার নেপাল' গড়ে তোলার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। গড়ে ওঠে ইউনিফায়েড ন্যাশনাল ফ্রন্ট।

(সম্পাদকীয় সংযোজন - এই বিষয়ে ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওটিও নিচে দেওয়া হল (মোবাইল মোডে না দেখা গেলে, প্রদত্ত লিংক অথবা পেজের শেষে 'ওয়েব ভার্সন'-এ ক্লিক করুন।) 

লিংকঃ- শুভজিৎ পাত্রের ইউটিউব ভিডিওর লিংক, ক্লিক করুন।



এই ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গ্রেটার নেপালের যে ম্যাপ প্রকাশ করা হয় তার সঙ্গে দার্জিলিঙের সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের প্রস্তুত করা মানচিত্রের অদ্ভুত মিল রয়েছে। অর্থাৎ পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যগঠন এদের চূড়ান্ত দাবি নয়,ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেপালের অন্তর্ভুক্ত হওয়াই এদের গোপন পরিকল্পনা। তাই এদের পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিকে আমল দিলে বড়ো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও কোচবিহার জেলায় মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে গ্রেটার কোচবিহার বা কামতাপুরী আন্দোলন। তাদেরও দাবি পৃথক কামতাপুর রাজ্য গঠন। কিন্তু কতখানি যৌক্তিক এই দাবি?ইতিহাস তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়,অতীতে এই কোচবিহার জেলাটি কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে,এবং এই চুক্তির মধ্যে দিয়েই কোচবিহার ইংরেজদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ভারত স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের তৎকালীন রাজা কোচবিহারকে ভারতের হাতে তুলে দেয়। এবং তার পর থেকেই কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলাতে পরিণত হয়। এখানে কামতাপুরী ভাষা ও জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন হয়েছে ১৯৬৯ ও ২০০৮ সালে। 

কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কামতাপুরী কোনো ভিন্ন ভাষা নয়,বাংলা ভাষার রংপুরী উপভাষার উন্নত এক বুলি। তাছাড়া বর্তমানে ভূভারতে কামরূপ রাজ্যের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ফলত পৃথক ভাষা ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে পৃথক রাজ্যের দাবি এখানে তেমন পোক্ত নয়। ১৯০৫ সালে ইংরেজরা আঞ্চলিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে বঙ্গভঙ্গ করবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই অপচেষ্টার পেছনে সক্রিয় ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল বাংলাকে দুর্বল করে দেওয়া। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমানের সৌভ্রাতৃত্বের জন্য রাখিবন্ধন উৎসব পালন করেন,বাংলার প্রতিটি ঘরে পালিত হয় অরন্ধন। 

এই আন্দোলনের ফলে ভাঙা বাংলা সংযুক্ত হয় ১৯১১সালে। কিন্তু সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃবিচ্ছেদ ঘটে ১৯৪৭ সালে। এই বিভক্তি যে বাংলার অর্থনৈতিক,সামাজিক প্রগতিকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল তা বাঙালি মাত্রেরই চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। তাই রাজ্য ভাগ উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। বরং অতি ক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবে,রাজ্য সরকারের স্বল্প বাৎসরিক রাজস্বের কারণে নিজস্ব জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। ফলে সেই রাজ্যগুলির অতিরিক্ত কেন্দ্র-নির্ভরতা বেড়ে যাবে। যা আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের পক্ষেও ক্ষতিকর। তাই সুষম উন্নয়ন যাতে রাজ্যের সর্বত্র পৌঁছতে পারে সেটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।


শুভজিৎ পাত্র