Thursday, September 2, 2021

রাজ্য ভাগের রাজনীতি ও অন্যান্য

 লিখেছেন

শু ভ জি ৎ   পা ত্র


ভারতবর্ষে রাজ্য ভাগ কিংবা নতুন রাজ্যের সৃষ্টি মোটেই কোনো অভিনব বিষয় নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই ১৮৯৫ সালে বিহার রাজ্যের ওড়িয়াভাষী মানুষেরা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরেছিল। ওড়িয়া জাতীয়তাবাদী নেতা মধুসূদন দাসের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন সফলতা অর্জন করে ১৯৩৬ সালে পৃথক ওড়িশা রাজ্য গঠনের মধ্যে দিয়ে। তারপর ভারতের একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত তৎকালীন মাদ্রাজ রাজ্যের তেলুগুভাষী মানুষেরা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরেছিল এবং সাধারণ মানুষের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১৯৫৩ সালে তেলুগুভাষীদের নিজস্ব রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে তামিলভাষীদের জন্য তামিলনাড়ু রাজ্য গঠিত হয়। 

এই রাজ্যগুলি গঠনের পেছনে কাজ করেছে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি,সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ করবার আকাঙ্ক্ষা। তাই ভাষা-সংস্কৃতির ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের এই ন্যায্য দাবি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালে,সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপরেও এই আইনকে হাতিয়ার করে বিভিন্ন নতুন রাজ্য গড়ে উঠেছে।  ২০০০ সালে বিহারের একটি অংশ আলাদা ভাবে ঝাড়খণ্ড রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। একই বছর উত্তরপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয় উত্তরাখণ্ড রাজ্য। ২০১৪ সালের ২ জুন তেলুগুভাষী অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলা নিয়ে গড়ে ওঠে তেলেঙ্গানা রাজ্য। এই নতুন রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া এখনো থেমে নেই।

আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠেছে। অতি সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের সাংসদ জন বার্লা উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করবার দাবি জানিয়েছেন,সেই দাবিকে সমর্থন করেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। শুধু উত্তরবঙ্গেই নয়,বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ঝাড়গ্রাম,বিষ্ণুপুর,দুই মেদিনীপুর সহ জঙ্গলমহলকে পৃথক রাজ্য করার দাবি জানিয়েছেন। তবে এই দাবিগুলি কি জনগণের কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন?নাকি নেহাত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!বলাই বাহুল্য,সমগ্র উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে দিয়ে নতুন রাজ্য গঠনের দাবি উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের দাবি নয়। আসলে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিটা দার্জিলিং জেলার গোর্খা জনগোষ্ঠীর মানুষদের।  ১৮১৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে নেপালের রাজার একটি চুক্তি হয়,যা সুগাউলি চুক্তি নামে খ্যাত। 

সেই চুক্তি অনুযায়ী নেপালের অধিকারে থাকা হিমাচল প্রদেশ,সিকিম ও দার্জিলিং ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। সেই সময় কিন্তু দার্জিলিং জেলায় মাত্র চারটি লেপচা পরিবার ছিল,কোনো গোর্খা পরিবারের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৩৫ এর কাছাকাছি সময় ইংরেজরা সেখানে চা-বাগান গড়ে তোলে এবং সেই সূত্রে শ্রমিক হিসেবে নেপালের গোর্খা নামক জেলার বাসিন্দারা দার্জিলিং এ আসতে থাকে। এই দার্জিলিংও ১৭৬৭ সালে মাল্লা রাজাদের অধিকারে ছিল। ভারতভুক্তির পূর্বে চিরকালই যে দার্জিলিং নেপালের অধিকারে ছিল,একথাও ইতিহাসসম্মত নয়।  স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে,১৯৫০ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে নেপাল সরকারের একটি অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি ভারতের হাতে চলে যাওয়া অংশগুলিকে নেপালে ফিরিয়ে এনে 'গ্রেটার নেপাল' গড়ে তোলার জন্য শুরু হয় আন্দোলন। গড়ে ওঠে ইউনিফায়েড ন্যাশনাল ফ্রন্ট।

(সম্পাদকীয় সংযোজন - এই বিষয়ে ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওটিও নিচে দেওয়া হল (মোবাইল মোডে না দেখা গেলে, প্রদত্ত লিংক অথবা পেজের শেষে 'ওয়েব ভার্সন'-এ ক্লিক করুন।) 

লিংকঃ- শুভজিৎ পাত্রের ইউটিউব ভিডিওর লিংক, ক্লিক করুন।



এই ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গ্রেটার নেপালের যে ম্যাপ প্রকাশ করা হয় তার সঙ্গে দার্জিলিঙের সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের প্রস্তুত করা মানচিত্রের অদ্ভুত মিল রয়েছে। অর্থাৎ পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যগঠন এদের চূড়ান্ত দাবি নয়,ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেপালের অন্তর্ভুক্ত হওয়াই এদের গোপন পরিকল্পনা। তাই এদের পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিকে আমল দিলে বড়ো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও কোচবিহার জেলায় মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে গ্রেটার কোচবিহার বা কামতাপুরী আন্দোলন। তাদেরও দাবি পৃথক কামতাপুর রাজ্য গঠন। কিন্তু কতখানি যৌক্তিক এই দাবি?ইতিহাস তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়,অতীতে এই কোচবিহার জেলাটি কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে,এবং এই চুক্তির মধ্যে দিয়েই কোচবিহার ইংরেজদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ভারত স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে কোচবিহারের তৎকালীন রাজা কোচবিহারকে ভারতের হাতে তুলে দেয়। এবং তার পর থেকেই কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলাতে পরিণত হয়। এখানে কামতাপুরী ভাষা ও জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন হয়েছে ১৯৬৯ ও ২০০৮ সালে। 

কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কামতাপুরী কোনো ভিন্ন ভাষা নয়,বাংলা ভাষার রংপুরী উপভাষার উন্নত এক বুলি। তাছাড়া বর্তমানে ভূভারতে কামরূপ রাজ্যের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ফলত পৃথক ভাষা ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে পৃথক রাজ্যের দাবি এখানে তেমন পোক্ত নয়। ১৯০৫ সালে ইংরেজরা আঞ্চলিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে বঙ্গভঙ্গ করবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই অপচেষ্টার পেছনে সক্রিয় ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল বাংলাকে দুর্বল করে দেওয়া। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমানের সৌভ্রাতৃত্বের জন্য রাখিবন্ধন উৎসব পালন করেন,বাংলার প্রতিটি ঘরে পালিত হয় অরন্ধন। 

এই আন্দোলনের ফলে ভাঙা বাংলা সংযুক্ত হয় ১৯১১সালে। কিন্তু সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃবিচ্ছেদ ঘটে ১৯৪৭ সালে। এই বিভক্তি যে বাংলার অর্থনৈতিক,সামাজিক প্রগতিকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল তা বাঙালি মাত্রেরই চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা। তাই রাজ্য ভাগ উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। বরং অতি ক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবে,রাজ্য সরকারের স্বল্প বাৎসরিক রাজস্বের কারণে নিজস্ব জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। ফলে সেই রাজ্যগুলির অতিরিক্ত কেন্দ্র-নির্ভরতা বেড়ে যাবে। যা আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের পক্ষেও ক্ষতিকর। তাই সুষম উন্নয়ন যাতে রাজ্যের সর্বত্র পৌঁছতে পারে সেটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।


শুভজিৎ পাত্র



No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.