Wednesday, October 5, 2022

এবার কি তবে গণতন্ত্রের 'দিন ফুরালো' !

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী



ইতালিতে ​​ক্ষমতায় এলেন বেনিতো মুসোলিনি'র ভাবধারায় গঠিত পার্টির নেত্রী জর্জিয়া মেলোনি। পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই জয়ে গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত দেখতে শুরু করেছেন। গত ৪ জুলাই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৬তম স্বাধীনতা দিবস। পৃথিবীর প্রাচীনতম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মার্কিনদের দাবি অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের বাতিঘর। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান একসময় তাঁর নিজের দেশকে বাইবেলে বর্ণিত ‘পাহাড় শীর্ষে আলোকোজ্জ্বল নগর’ হিসেবে দাবি করেছিলেন। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান, বর্ণ ও ধর্ম, স্থানীয় ও বহিরাগত ইত্যাদি প্রশ্নে দেশটি যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাতে এমন প্রশ্ন ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এমন কথাও উঠছে, এই দেশ অবিভক্ত অবস্থায় টিকে থাকবে তো? ক্লিনটন মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য রবার্ট রাইখের কথায়, ভবিষ্যতে নয়, এখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এটা ঠিক প্রথাগত গৃহযুদ্ধ নয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে দাসব্যবস্থা নিয়ে যে যুদ্ধ বেধেছিল, এই যুদ্ধ তেমন নয়। এটা হলো অসুখী বিয়ের মতো। এই বৈবাহিক সম্পর্কের দুই শরিকের মধ্যে সম্পর্ক এখন এতটাই তিক্ত যে তারা আর একে অপরের সঙ্গে থাকতে নারাজ। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে রাইখ প্রশ্ন তুলেছেন, আর কত দিন জোড়াতালি দিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঠেকানো যাবে?

 ক্যাপিটল হিলে মার্কিন কংগ্রেসের ওপর সহিংস হামলার যে উন্মুক্ত শুনানি চলছে, তাতে এখন এ কথা স্পষ্ট, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রধান হুমকি দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে এসেছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অশাসনতান্ত্রিক ক্যু বা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র এঁটেছিলেন। এই ষড়যন্ত্রে তিনি একা নন, রক্ষণশীল রিপাবলিকান এস্টাবলিশমেন্টের প্রায় সবাই তাঁকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। এই দলের দুই-তৃতীয়াংশ এখনো বিশ্বাস করেন যে জালিয়াতি করে তাঁদের নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। হাতে গোনা যে কয়েকজন রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য ক্যাপিটল হিলের হামলার বিরোধিতা করেন, তাঁদের অধিকাংশই ট্রাম্পের ক্রোধের শিকার হয়ে হয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন অথবা দলীয় বাছাই পর্বের নির্বাচনে (প্রাইমারি) পরাস্ত হয়েছেন। আগামী নভেম্বরে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন, তাতে রিপাবলিকান দল নির্বাচন পরিচালনার জন্য এমন সব ব্যক্তির মনোনয়ন দিয়েছে, যাঁরা ট্রাম্পের মতোই মিথ্যা জয়ের দাবিদার।প্রশ্ন উঠেছে ২০২৪ সালে তাঁদের হাতে কি নির্বাচনের নিরপেক্ষতা রক্ষিত হবে? শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই গণতন্ত্র পিছু হটছে। ৩০ বছর আগেও ভাবা হচ্ছিল সব ধরনের স্বেচ্ছাচার অতিক্রম করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে গণতন্ত্র। কমিউনিজমের পতন হয়েছে, সামরিকতন্ত্র ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজছে, তথ্যব্যবস্থার ব্যাপক গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে। এ কেবল গণতন্ত্রের বিজয় নয়, ধনতন্ত্রেরও বিজয়। এই বিজয় সম্বন্ধে কোনও কোনও পণ্ডিত এতটাই সন্দেহশূন্য ছিলেন যে তাঁদের কেউ কেউ ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ পর্যন্ত ঘোষণা করে বসেছিলেন। 

তিন দশকও যায়নি, সেই সব পণ্ডিতই এখন হা-হুতাশ করে বলছেন, নামে গণতান্ত্রিক হলেও আসলে যাদের বিজয় হয়েছে, তাদের বড়জোর অনুদার বা ইললিবারেল গণতন্ত্র বলা যায়। এমন বিজয়ীদের একজন হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান, তিনি নিজের রাজনৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে এতটাই সন্দেহশূন্য যে নিজেই নিজেকে ‘ইললিবারেল’ বলে ঘোষণা করছেন।খোলা চোখে দেখলে বোঝা যায়, সামনে এগোনোর বদলে বিশ্বজুড়ে সর্বত্র গণতন্ত্র পিছু হটছে। গণতন্ত্রের বৈশ্বিক অবস্থান বোঝার একটি মাপকাঠি হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম ইনডেক্স বা গণতন্ত্র সূচক। এই সংস্থা তাদের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত বা গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা। অন্যদিকে ৩৮ শতাংশ মানুষের বাস ‘মুক্ত নয়’, অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক এমন দেশের বাসিন্দা। বস্তুত স্ক্যানডেনেভিয়ার গুটি কয় দেশ বাদ দিলে আর কেউই নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত বলে দাবি করতে পারে না। বাকি সব দেশ অংশত মুক্ত বা পার্টলি ফ্রি।গণতন্ত্রের ওপর এই আক্রমণ আসছে মূলত পপুলিস্ট বা জনতুষ্টবাদী নেতাদের হাত থেকে, যাঁরা একদিকে গণতান্ত্রিক বহুপাক্ষিকতাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন, অন্যদিকে সীমাহীন ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করছেন। এই ধরনের নেতাদের বলা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী, যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো, হাঙ্গেরির অরবান অথবা ফিলিপাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে।

 কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা নির্ণয়ের জন্য ফ্রিডম হাউস ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে একটি পরিসংখ্যানগত কাঠামো ব্যবহার করে থাকে। এই কাঠামোর দুটি সূচক: রাজনৈতিক অধিকার (অর্থাৎ নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ) এবং নাগরিক অধিকার (অর্থাৎ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা)। এই দুই সূচকেই ভারতের অবস্থান তেমন সুস্থ নয়। যেমন রাজনৈতিক অধিকারে তারা পেয়েছে ১৪ নম্বর, আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পেয়েছে ২০ নম্বর। সব মিলিয়ে ৩৪ নম্বর। সেই কারণে ভারতের অবস্থান ‘অংশত মুক্ত’ দলে ।অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদিও মোটের ওপর মুক্ত বা গণতান্ত্রিক, ২০২০ সালের নির্বাচন-উত্তর ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পর তার অবস্থান দুর্বল হয়েছে। ২০২০ সালে তার প্রাপ্ত মোট নম্বর ছিল ৮৬। ২০২১ সালে কমে তা ৮৩-তে দাঁড়িয়েছে। নম্বরের হিসাবে হেরফের সামান্য হতে পারে, কিন্তু এই অবনমনের তাৎপর্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্র বরাবর নিজেকে গণতন্ত্রের উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে দেখাতে ভালোবাসে। সে সবার চেয়ে সেরা, সবার জন্য অনুকরণীয়। সেই দেশরই আজকের যে হাল, তাতে তাকে আর যা–ই হোক "আলোকোজ্জ্বল নগরী" বলা যায় না। এর চারদিকে বড় বেশি আঁধার জমেছে। ফ্রিডম হাউসের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিতে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছে। নির্বাচনব্যবস্থা দলীয় ছলচাতুরীতে আক্রান্ত হয়েছে, বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায় রাজনৈতিক বিভাজন বেড়েছে।বামপন্থী মহলে মইসেস নাইম একটি সুপরিচিত নাম। ভেনেজুয়েলার হুগো শাভেজ সরকারের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক ও বিশ্বব্যাংকের পরিচালক, গত ৩০ বছর এ রকম নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। গত দেড় দশক অবশ্য তাঁর প্রধান পরিচয়, প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত ফরেন রিলেশন্স পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে।দীর্ঘদিন থেকে তিনি উত্তর-দক্ষিণ সব দেশেই অল্প কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় কীভাবে তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন।

 অধিকাংশ আধুনিক কর্তৃত্ববাদী শাসকই তাঁর তীব্র রোষের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ দ্য রিভেঞ্জ অব পাওয়ার–এ গণতন্ত্রকে হটিয়ে সেই গণতন্ত্রের জামা পড়েই কর্তৃত্ববাদ কীভাবে আসন গেড়ে নিচ্ছে, তার নতুন বিশ্লেষণ হাজির করেছেন নাইমের চোখে কর্তৃত্ববাদ ও একনায়কতন্ত্র এই দুইয়ের মধ্যে মস্ত কোনো তফাত নেই। উভয়ের লক্ষ্য একটাই, যেভাবে সম্ভব ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। আগে সামরিক একনায়কেরা বন্দুক উঁচিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেন। কিন্তু এখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাঁদের রয়েছে নতুন রণকৌশল, নতুন সরঞ্জাম। নাইম এই নতুন রণকৌশলের নাম দিয়েছেন ‘থ্রি পি’—পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদ, পোলারাইজেশন বা সামাজিক/রাজনৈতিক মেরুকরণ, এবং পোস্ট ট্রুথ বা বিকল্প সত্য।ট্রাম্প, পুতিন, মোদি, বলসোনারো ,এরদোয়ান বা  অরবান–এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের যাঁর যাঁর দেশের নাগরিক গোষ্ঠীর একাংশের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থিত করে থাকেন। বিষয়টি এমন যে , ‘দেশের ভেতরে-বাইরে শত্রু সদা জাগ্রত, একমাত্র আমিই পারি তোমাদের রক্ষা করতে, আগলে রাখতে।’ নাইম একে জনতুষ্টিবাদ বলছেন বটে, কিন্তু সতর্ক করে দিয়েছেন, এটা নতুন কোনো রাজনৈতিক মতবাদ নয়। এটা একটা রণকৌশল মাত্র, যার একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। কর্তৃত্ববাদী নেতা একা নন, তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ থেকে লাভবান হয়, এমন একটি ক্ষুদ্র চক্র সর্বদা তাঁকে ঘিরে থাকে।এর বড় প্রমাণ বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিন ও তাঁর সহচর অলিগার্কবৃন্দ এবং অতীতে ট্রাম্পের বশংবদ রিপাবলিকান নেতৃত্ব।কিন্তু শুধু ‘জনতুষ্টিবাদ’ দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায় না, এর জন্য প্রয়োজন নিজের সমর্থক ছাড়া অন্য সবাইকে শত্রু হিসেবে প্রমাণ করা। এই রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে দেশের ভেতরে যে মেরুকরণ ঘটে, তাতে সবকিছুই ‘পক্ষে অথবা বিপক্ষে’ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটা সময় ছিল যখন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান দেশের সব মানুষের নেতা হিসেবে শাসন করতেন। কিন্তু ট্রাম্প থেকে মোদি, পুতিন থেকে অরবান, এখন এঁদের সবাই নিজের প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রের ভয়াবহ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে কেবল নিজেদের দলীয় সমর্থকদের কাঁধে ভর করেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান।কর্তৃত্ববাদের তৃতীয় অস্ত্র, সত্যকে ডিঙিয়ে বিকল্প সত্য হাজির করা।

 ক্ষমতাসীন মহল তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভবান, এই বিবেচনায় সর্বপরিচিত এমন সত্য বা বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে এক বিকল্প সত্য বা বাস্তবতা প্রস্তাব করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। এ কাজে সাহায্যের জন্য অনুগত সংবাদমাধ্যম তো রয়েছেই, তার ওপরে রয়েছে নয়া সামাজিক তথ্যমাধ্যম। এই দুই শক্তি মিলে অনুগত সমর্থকদের জন্য নির্বাচনে পরাস্ত ট্রাম্পকে বিজয়ী প্রমাণ করতে পারে, অথবা সব পরিচিত ইতিহাস উপেক্ষা করে তাজমহলকে একটি হিন্দু মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সত্যের তো কোনো বিকল্প হয় না, নাইম একে তাই নাম দিয়েছেন পোস্ট-ট্রুথ বা উত্তর-সত্য। পপুলিজম,উত্তর-সত্য। পপুলিজম, পোলারাইজেশন ও পোস্ট-ট্রুথের এই কাঠামোর সাহায্যে নব্য একনায়কেরা নিজেদের শুধু গণতান্ত্রিক নয়, জনগণের ইচ্ছার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণেও বদ্ধপরিকর।ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। রাজা-বাদশাহ থেকে আজকের পাতি নেতা, সবাই একবার ক্ষমতার স্বাদ পেলে তা আর ছাড়তে চান না। তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানের তফাত হলো, শুধু বন্দুকের জোরে নয়, নির্বাচন নামক গণতান্ত্রিক বড়ি গিলিয়ে রাজনৈতিক ও আইনগত বৈধতা আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রের এই পোশাকি চেহারা ধরে রাখার জন্যই প্রয়োজন তিন প-এর ইয়ারি।আধুনিক অনুদার গণতন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, কর্তৃত্ববাদী নতুন যে শাসনব্যবস্থা, তার কেন্দ্রে সর্বদাই এমন ব্যক্তি, যাঁদের ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্ট্রংম্যান’। এঁরা নিজেদের শক্তির প্রতীক, আপসহীন এবং দৃঢ়সংকল্প হিসেবে প্রকাশ করতে অভ্যস্ত। সামরিক শক্তির যত্রতত্র ব্যবহার এই আপসহীনতার একটি লক্ষণ।এই স্ট্রংম্যানদের প্রথম জন ট্রাম্পের কথাই ভাবুন। ২০২০ সালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন রুখতে তিনি যুদ্ধ মন্ত্রী ও যৌথ সামরিক বাহিনীর প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। শোনা যায়, তিনি সে সময় ১০ হাজার সৈন্যকে রাস্তায় নামার আবদার করেছিলেন, কিন্তু সেনাপ্রধানের আপত্তির কারণে তা কাজে লাগেনি।অথবা মোদির কথা ভাবুন। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসী হিসেবে সন্দেহভাজন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে নিজের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করেছিলেন। সে সময় তাঁর নির্বাচনী স্লোগান ছিল, আমাকে ভোট দেওয়া মানে শুধু ভোট মেশিনে একটা বোতাম টেপা নয়, বরং সব সন্ত্রাসীর মাথা লক্ষ্য করে ট্রিগার টেপা। ব্রিটিশ সাংবাদিক গিডিয়ন রাখমান তাঁর নতুন গ্রন্থ দ্য রাইজ অব স্ট্রংম্যান–এ এই রাজনৈতিক লেঠেলদের পরিচয় করিয়েছেন এভাবে যে এসব নেতা বোলচালে জাতীয়তাবাদী, সাংস্কৃতিক প্রশ্নে রক্ষণশীল, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে অসহিষ্ণু, সব রকম ভিন্নমতের বিরোধী।দেশের ভেতরে এঁরা সবাই নিজেদের ‘ক্ষুদ্র মানুষের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে দাবিদার এবং ব্যক্তিপূজার প্রবর্তক। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত আদালত ব্যবস্থার এরা ঘোর বিরোধী।

 আইন ও বিচারব্যবস্থা নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য এঁরা প্রথম সুযোগেই নিজেদের পছন্দমতো বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। পোল্যান্ড থেকে তুরস্ক, হাঙ্গেরি থেকে যুক্তরাষ্ট্র, সর্বত্রই এই চেষ্টার কথা আমাদের জানা।ময়শে নাইমও নব্য কর্তৃত্ববাদীদের ব্যক্তিপূজায় উৎসাহদাতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ট্রাম্পের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁর কট্টর সমর্থকেরা শুধু রাজনৈতিক অনুসারী নয়, রীতিমতো ‘ফ্যান’ বা মুগ্ধ ভক্ত। ট্রাম্প নিজেও সে কথা বিশ্বাস করতেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘আমি ফিফথ অ্যাভিনিউতে দাঁড়িয়ে কাউকে যদি গুলি করি, তারপরও আমার সমর্থকেরা আমার পক্ষেই ভোট দেবে।’ কথাটা বোধ হয় একদম মিথ্যা নয়। ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও রিপাবলিকান ভোটাররা যে তাঁকে এখনো মাথায় করে রাখেন, তা থেকেই বোঝা যায় জনতুষ্টিতাবাদ কেন গণতন্ত্রের জন্য এত বড় হুমকি।একজন বাক্‌সর্বস্ব ‘ডেমাগগের’ হাতে কী বিপদ হতে পারে, আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর আগে, ১৭৭৯ সালে তাঁর ‘বিদায়ী ভাষণে’ সে কথার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। সেই লিখিত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি ও দলাদলির সুযোগ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সময়ে এমন ক্ষমতালোভী নেতার আবির্ভাব হতে পারে, যার লক্ষ্য নাগরিক কল্যাণ নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি। জর্জ ওয়াশিংটনের সেই বিপদবার্তা যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়নি, ফল হয়েছে ট্রাম্পের মতো বিপজ্জনক ও চতুর ডেমাগগের আবির্ভাব। ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রথম যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন, সে সময়েই সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য ক্যানসার নামে অভিহিত করেছিলেন।পরবর্তী সময়ে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে সে কথা। যে প্রথাগত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছিল, আমাদের চোখের সামনে, কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই আজ তা কীটগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। লাল ও নীলের (অর্থাৎ রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক) রাজনৈতিক বিভক্তি সামাজিক অর্থাৎ রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক) রাজনৈতিক বিভক্তি সামাজিক বিভক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই বিভক্তি এতই তীব্র যে এ দেশের ৪২ শতাংশ মানুষ ভিন্নদলভুক্ত মানুষদের ‘শয়তান ও ক্ষতিকর’ মনে করে। একে অপরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারেও তাদের ঘোর আপত্তি। ভার্জিনিয়ার সেন্টার ফর পলিটিকসের এক জনমত জরিপ অনুসারে, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট অধিকাংশ ট্রাম্প সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে ৪১ শতাংশ বাইডেন সমর্থক মনে করে, দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করাই যথাযথ হবে। আরও ভয়ের কথা, দেশের প্রতি চারজনের একজন মনে করেন, তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠায় সহিংস পথ অনুসরণে অন্যায় কিছু নেই। ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিরা এক শাসনতান্ত্রিক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের সামনে প্রধান প্রশ্ন ছিল, এই নতুন দেশটি কোন পথে এগোবে, রাজতন্ত্র না প্রজাতন্ত্র? যুক্তরাষ্ট্রের আদি পিতাদের একজন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে সে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রজাতন্ত্র, তবে তা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র ধরে রাখতে পারবে তো?

 স্বাধীনতার ২৪৬তম বার্ষিকীতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে উদার গণতন্ত্র ব্যবস্থা নিয়ে আশা নয়, ভয় জাগছে। 


Monday, May 9, 2022

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ও এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

Source - Internet

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে বহু দেশি বিদেশি যুদ্ধ-বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছিলেন যে যুদ্ধ যদি আদৌ শুরু হয় তবে তা খুব বেশিদিন হলে তিন-চার দিন গড়াবে। রুশ আক্রমণে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে ইউক্রেন, এই ছিল তাঁদের মত। আরও এক দল বিশেষজ্ঞ স্থির প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে,  রুশ-ইউক্রেন সীমান্তে যদি একটি গুলিও চলে, তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, কেউ আটকাতে পারবে না। বিশেষজ্ঞদের মুখে ছাই দিয়ে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিগত দু'মাস ধরে চলছে এবং তার থেকেও বড় কথা যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে যুদ্ধের খবর খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে তৃতীয় পাতা ও পাঁচের পাতা হয়ে দশের পাতা ছাড়িয়ে এখন অতীত। যুদ্ধ কিন্তু হয়েই চলেছে। সম্প্রতি একদল মার্কিন পররাষ্ট্র-বিশারদ এই যুদ্ধ নিয়ে তাঁদের খোলামেলা মত দিয়েছেন। তাতে তিনটি বিষয় তাঁরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন,

  • এই যুদ্ধে আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির মুখ পুড়েছে। গোটা দুনিয়ার সামনে এই মুখ পোড়া শুরু হয়েছিল মার্কিন সেনার আফগানিস্তান থেকে প্রায় বিনা নোটিশে চলে আসার সময় থেকে।
  • মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনকে তাঁদের বৈশ্বিক ক্ষমতার দাবার ছকে নেহাতই একটি বোরের মত ব্যবহার করেছে।
  • এই যুদ্ধ এড়ানো যেত যদি ন্যাটো এবং ইউরোপ তাঁদের জেদ দমন করতে পারত, যদি রাশিয়া ঘরের দরজায় ন্যাটোর উপস্থিতিতে বিচলিত না হত, যদি ইউক্রেন ন্যাটো এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গে একটা মধ্যপন্থা বজায় রাখতে পারত।

তবে এসবই সম্ভবনার প্রশ্ন। অনেক মার্কিন পররাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ এমনও বলেছেন যে, যদি কিউবায় রাশিয়ান অস্ত্রের সম্ভার অথবা মেক্সিকোয় চিনা অস্ত্র কারবার আমেরিকা অতীতে সহ্য না করতে পেরে থাকে, তবে রাশিয়াইবা নাকের ডগায় আমেরিকার অস্ত্রের সম্ভার সহ্য করবে কেন?

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন কয়েকটি ঘটনার দিকে যদি আমরা চোখ রাখি, তবে দেখতে পাবো এই যুদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসছে এক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা। যুদ্ধ শুরুর পরে পরেই আমেরিকা বেশ কয়েকটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার উপর। সেই নিষেধাজ্ঞায় হাত মেলায় পশ্চিম ইউরোপের অনেকগুলো দেশ। এর পাল্টা চাল হিসেবে রাশিয়া ওই সমস্ত দেশে তেল আর গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে  চুক্তিতে এক নতুন শর্ত আরোপ করে। ওই শর্ত অনুযায়ী পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়া তেল ও গ্যাস সরবরাহ করবে যদি ঐ তেল ও গ্যাসের দাম ইউরো বা মার্কিন ডলারে নয় রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে মেটানো হয়। শুরুতে জার্মানি সহ অনেকগুলো দেশ একসঙ্গে রাশিয়ার এই নতুন শর্তের প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু রাশিয়া তাদের শর্ত থেকে সরে তো আসেইনি উল্টে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়াতে তেল, গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার যুক্তি হল ন্যাটো এবং আমেরিকা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে এক রকমের ছায়া যুদ্ধ লড়ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।

Source - Internet


পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এবং অবশ্যই আমেরিকা তাদের অতিবড় স্বপ্নেও ভাবেনি যে রাশিয়া সত্যি সত্যি তেল ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। তাই রাশিয়ার এই পদক্ষেপ এক নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে রাশিয়া ভদ্রলোকের চুক্তি ভঙ্গ করেছে, অন্তত আন্তর্জাতিক পশ্চিম গণমাধ্যম তেমনটাই বলছে। কিন্তু বাস্তব হল, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যখন আমেরিকা রাশিয়ার সমস্ত ডলার অকেজো করে দিয়েছে তখন রাশিয়া বাধ্য হয়েই তাদের নিজেদের মুদ্রা রুবেল-এ বাণিজ্য করতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল বিক্রির ক্ষেত্রে। বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার যে একক ক্ষমতা ছিল তা আজ স্পষ্টভাবে কিছুটা হলেও দুর্বল। আজ যদি চিন-রাশিয়া এবং তাদের লেজুর হিসেবে ভারত নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে দেয় তা হলে বিশ্বে এক নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হবে। এর প্রধান কারণ এটা আজ গোটা দুনিয়ার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমেরিকার সামরিক সক্ষমতার চাইতে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টির সক্ষমতা অনেক গুণ বেশি। সেই জোরেই তারা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ডলারের শক্তিতেই তারা গোটা বিশ্বের উপর একধরনের কর্তৃত্ববাদ চালাচ্ছে।

বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির নয়া অক্ষ এখন চিন-রাশিয়া ও লেজুর ভারত। চিন এবং রাশিয়া এখন এটা টের পেয়ে গেছে যে যদি তারা মিলিত ভাবে একটা নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে তাহলে অনেকটা ধাক্কা খাবে ডলার, আর সেই ডলারের কলার খোসায় পা পিছলে একবার পড়লে আমেরিকার দাদাগিরি আর চলবে না। 'ব্রিকস' গঠন করার শুরুর সময় থেকেই এই নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়েছে চিন, রাশিয়া ও ভারত সহ অন্যান্য 'ব্রিকস' সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে। কিন্তু ভারত ও চিনের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ। প্রায়শই, সীমান্তে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এই দুই দেশ। ফলে, যৌথ মুদ্রা ব্যবস্থার ধারণাটা পিছিয়ে গিয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ সামনে নিয়ে এসেছে এক নতুন অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্ষমতার অক্ষ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে। ভারতের সামনেও নতুন করে বর্তমান বৈদেশিক নীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে। বিশ্ব বাণিজ্যে নিজেদের স্থানকে উন্নীত করার সুযোগ করে দিয়েছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। ওদিকে পোল্যান্ড আর বুলগেরিয়াতে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে ঐক্যের ফাটল। অনেক দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও গ্যাস কেনা শুরু করেছে রাশিয়ান মুদ্রা রুবেলের বিনিময়ে।

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তাই আজ কোনও আর পাঁচটা যুদ্ধের জায়গায় নেই। এই যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক ক্ষমতার  ভারকেন্দ্রের একটা পরিবর্তন ঘটছে। আমেরিকা-ইউরোপের দিক থেকে সেটা ক্রমেই সরে আসছে চিন-রাশিয়ার দিকে। এই বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন যত দিন না সম্পূর্ণ হবে, ততদিন চলবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই পট পরিবর্তন চলাকালীন বিশ্ব বাণিজ্যের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে, সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয়না।একই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মার খাবে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। সার্ক দেশগুলির মধ্যে চিনের প্রভাব শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশেও প্রবল। ভারত চিন এবং রাশিয়া এই দুটি দেশের সঙ্গে যদি সঠিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে পারে, তবে তা দেশের জন্য লাভজনক হবে, নচেৎ ভারত পরে থাকবে এক বাজার হয়েই। সেখান থেকে লাভের গুড় খেয়ে যাবে পিঁপড়ে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ভারত একটি সহকারী দেশ হবে নাকি লেজুড়বৃত্তি করে চলবে তার উত্তর একমাত্র সময় দিতে পারবে। তবে ভারতের বৈদেশিক নীতির আমূল সংস্কার ছাড়া ভারতের পক্ষে এই নতুন ব্যবস্থায় সহকারী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমাদের কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর এতটাই অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন, যে তাঁদের উপর বেশি আশা না করাই শ্রেয়। তবে আমি আপনি চাই বা না চাই, নতুন বিশ্বব্যবস্থা দ্রুত একটি স্পষ্ট অবয়ব নিতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির কানে কি সেই পদধ্বনি পৌঁছেছে?


Monday, March 14, 2022

ফিনফ্লুয়েন্সর ও একুশ শতকের নয়া-অর্থনীতির দিকচিহ্ন

   লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

FINFLUENCER BENGALI

সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ও তাদের বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি ইউটিউবের। সেখানে দাবি করা হয়েছে যে ইউটিউবের সাহায্যে এক বিশেষজ্ঞ উদ্যোগীর দল ভারতে রোজগারের এমন সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যা প্রায় সাত-লক্ষ পূর্ণ-সময়ের কাজের সমতুল্য। করোনাকালে চাকরির আকালের বাজারে যা প্রায় অসাধারণ এক দাবি। এইসব উদ্যোগপতিরা ভারতের অর্থনীতিতে গড় জাতীয় উৎপাদনে ৬,৮০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছেন। এই রিপোর্ট অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স-এর দ্বারা প্রদত্ত। ইউটিউবের তরফে হ্যাশট্যাগ ক্রিয়েটিং ফর ইন্ডিয়া-কে প্রায় একটি জন-আন্দোলনে রূপান্তরিত করা হয়েছে।



আজকের দিনে, কোনো ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি বা কোনো অনুপ্রেরণা নিয়ে যে-কেউই ইউটিউবের বিশ্বজোড়া দর্শকের দরবারে পৌঁছে যেতে পারেন। সেখানে উপভোক্তা বা দর্শকের সংখ্যা কত? নয়-নয় করে প্রায় ২০০ কোটি। কিন্তু দর্শকের কাছে পৌঁছে হবেটা কী? দেখা যাচ্ছে অতিমারির প্রকোপে ভারতীয় অর্থনীতির বেহাল দশা ধীরে-ধীরে ছন্দে ফিরে আসার পেছনে কোনও টাটা, গোদরেজ, আম্বানি বা উঠতি আদানিদের মত বড় বিনিয়োগকারীদের হাতযশ নেই। যাঁদের আছে তাঁরা হলেন ফিনফ্লুয়েন্সর- শব্দটা কি অচেনা ঠেকছে? তাহলে একবারে শুরু থেকে শুরু করা যাক।

সালটা ২০২০, ভারতীয় অর্থনীতি একেবারে যাকে বলে মুখ থুবড়ে মাটিতে, মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া সব বেবাক ফেল। এমন একটা সময় হঠাৎ দেখা গেল ভারতের অর্থনীতির রাজধানী মুম্বাইয়ের ব্যাংকে হু-হু করে বাড়ছে ডিম্যাট একাউন্টের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়ে দেখল যারা এই আকাউন্ট খুলেছে তাদের সবার বয়স ২৬-২৭-এর বেশি নয়। এরা কোথায়  বিনিয়োগ করছে দেখে আরও আশ্চর্য হল সংস্থাগুলো। দেখা যাচ্ছে যে, শেয়ার বাজারের(বাঙালির কাছে আজও শেয়ার বাজার এক ম্লেচ্ছ শব্দ!) প্রথাগত বিনিয়োগ এখানে হচ্ছে না। খুব অল্প পরিমাণ টাকা খুব ছোটখাট কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন লগ্নিকারী এবং সেই টাকা গড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তুলে নেওয়াও হচ্ছে।

কোভিড-এর সময়ে বহু মানুষের চাকরি চলে যায়, বা বেতন কমে যায়। তখন রোজগারের বিকল্প হিসাবে তৈরি হয়েছিল আরেকটি পথ, তা হল শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লাভের মুখ দেখা। কিন্তু বিনিয়োগ করলে যে টাকা জলে যাবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? এইখানেই মস্ত বড় ভূমিকা পালন করছেন ফিনফ্লুয়েন্সরা। তাঁরা মানুষকে কোন্‌ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ হবে, এ-কথা না বলে শেয়ার বাজার বস্তুটা আসলে কী - সেটা সম্পর্কে অবগত করছেন। শেয়ার বাজারে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বিনিয়োগ করা শুরু করবেন সেই সম্পর্কে ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করছেন। খুব অল্প পরিমাণ টাকা নিয়ে কিভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে বলছেন। সোজা কথায় ফিনান্সিয়াল মার্কেট নিয়ে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছে।



এতে দু'তরফেই লাভ হচ্ছে। প্রথমত, যাঁরা অল্প টাকা বিনিয়োগ করে কিছু টাকা বেশি ফেরৎ পাচ্ছেন, এই আকালের দিনে সেটাই তাঁদের কাছে লাভ। এমন বহু উদাহরণ আর্থিক সংস্থার সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, যেখানে কাজ হারানো শ্রমিক বউয়ের গয়না বেচে সেই টাকাকে লগ্নি করে মাস চালিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, যে-শেয়ার বাজারকে আমরা ফাটকা, জুয়া, ইত্যাদি তকমা দিতাম, সেই বাজার করোনার কালবেলায় বহু মানুষের সংসার বাঁচিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশের (তার মধ্যে অবশ্যই ভারত অন্তর্ভুক্ত) জিডিপির পতনের পরেও শেয়ার বাজার কেন চাঙ্গা থাকছে এই নিয়ে প্রথম সমীক্ষায় নামে অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স। সেখান থেকেই প্রথম প্রকাশ্যে আসে ফিনফ্লুয়েন্সরদের ভূমিকা ও শেয়ার বাজারের এই নয়া দৌড়।

এরপর আলাদা করে ভারতবর্ষের শেয়ার বাজারের উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে, ২০২০-২১ পর্বে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া সত্ত্বেও, মানুষের আয় কমে যাওয়া সত্ত্বেও, মানুষ কাজ হারানো সত্ত্বেও, না খেতে পাওয়া মানুষের মিছিল, বা তাদের আর্তনাদ যে আমরা শুনতে পেলাম না তার একটা বড় কারণ ফিনফ্লুয়েন্সরা, যাঁরা প্রথা ভেঙে সাধারণ মানুষকে শেয়ার বাজারমুখী করেছেন, সাধারণ মানুষ কিছু বাড়তি টাকার মুখ দেখেছেন, যেটা এই কালবেলায় একটা বড় খবর। এ তো গেল প্রথম লাভের কথা ,দ্বিতীয় যেটা হয়েছে সেটাও একটা নীরব বিপ্লব।

অক্সফোর্ডের সমীক্ষা বলছে ফিনফ্লুয়েন্সরা শুধু নন, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে, যাঁদের বলা হয় ক্রিয়েটর, ১ লক্ষ বা তার বেশি টাকা রোজগার করেন এমন মানুষের সংখ্যা ভারতে প্রতি বছর ৬০% হারে বাড়ছে। যে-পরিসংখ্যান সঠিকভাবে না জানলেও তা আন্দাজ করে, অনেকেই ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বপ্ন আর বিপুল খরচের পেছনে না ছুটে এখন ইউটিউবকেই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। সমীক্ষা বলছে ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক উপায় রয়েছে ভিডিও প্রোমোশন ও মানিটাইজেশনের, যার একটা দুটো কাজে লাগলেই ডাল-ভাতের সংস্থান আটকানো শক্ত। এই সব নতুন পথের সন্ধানে বাঙালি যে নেই তা নয়, তবে যা আছে তা হাতে গোনা। শেয়ার বাজার সম্পর্কে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে প্রথম অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তোপসে-খ্যাত সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সেখানে মূলত বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হত। পরে তিনি একক উদ্যোগে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, শেয়ার বাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবগত করার জন্য। কিন্তু বাঙালির কাছে বিনিয়োগ মানেই ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্ট অফিসে রাখা টাকা, আর জীবন বীমা।

বাঙালির মতোই বাঙালির প্রত্যেকটি বিনিয়োগের জায়গা এখন শুকিয়ে মজে গেছে। তাই নতুন প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা অনেকেই অল্প অল্প করে শেয়ার বাজারে আসছেন পা টিপে-টিপে। অনেকে বাড়িতে লুকিয়ে, কারণ বাড়ির বাবা-জ্যাঠাদের কাছে শেয়ার বাজার জুয়া হয়েই রয়ে গেছে। যে-বাঙালি প্রতি সন্ধ্যায় টেলিভিশনের সামনে বসে শেয়াল কুকুরের যুদ্ধ দেখেন, তাঁরা কি এবার একটু নজর ফেরাবেন? দুনিয়াটা শুধু বদলাচ্ছে তাই নয়, বদলাচ্ছে একবারে লাফিয়ে লাফিয়ে। একুশ শতকে অর্থনীতি থেকে শুরু করে আগামী দিনে কাজকর্মের ক্ষেত্রেও আসবে নতুন নতুন ধারণা, যা ধুলোয় লুটিয়ে দেবে পুরানো ধারণাকে। বাঙালি কি সেই ধাক্কা সামলাবার জন্য ভাবা শুরু করেছে, চিনতে পারছে নতুন দিকচিহ্নের সংকেত ? ভাবলে, চিনলে  ভালো।  তা না হলে বাড়ির চেয়ারে বা খাটের খুঁটির সঙ্গে অচিরেই বাঙালিকে সিট বেল্ট বাঁধতে হবে, নইলে ছিটকে পড়ে যাওয়া অনিবার্য।



Wednesday, February 2, 2022

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাঠতন্ত্র' - সংখ্যাতত্ত্ব পেরিয়ে এগোচ্ছে পাঠক

 লিখেছেন

ড. অ মৃ তা  ঘো ষা ল 



কিছু কিছু বইয়ের বেশ ধারালো আওয়াজ থাকে। ফ্যাতাড়ুরা সেই আওয়াজ শুনতে পায়। আমরা মধ্যবিত্ত পাঠক। এক লাইন পড়ি, আত্মতুষ্টিতে ডগমগ হই। সেই মধ্যবিত্তকে বেশ জোরে একটা ধাক্কা মারলো অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাঠতন্ত্র : পাঠকের রুচি-অরুচি নির্মাণ -বিনির্মাণ ও অন্যান্য' বইটি। বইটি প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, শব্দের ঘনত্ব বাড়ায় রক্তের ঘনত্ব। মানুষ অবসন্ন হয়, নতুন নন্দনতত্ত্বের সন্ধান করে। কখনও পায় অবয়বহীন অত্যাচার, কখনও দ্যাখে  '-ইজম'-এর উল্লাস! গ্রাফিতি, রাজনীতি, প্রতাপের ফিসফিসানির মধ্যেই জেগে থাকে শব্দের জটিল মনস্তত্ত্ব। অর্ধেন্দু বোধহয় সেখানেই খুঁজে পেলেন লেখকের অ-তৃপ্তি। প্রাচ্যের উত্তরাধিকার - এই ব্যাপারটার একটা নিজস্ব আধিপত্য আছে। কিন্তু কালাতিক্রমী তত্ত্বরা আবার সেই উত্তরাধিকারকে উল্টে দিতে পারে। যেমন গ্রিক সাহিত্যে স্মৃতিবিদ্যারও একটা ভিত্তি ছিলো। আসলে পাঠক বোধহয় শুধুই স্মৃতির ঈশ্বর-কণা আঁকড়ে বাঁচে ! এই আঁকড়ানোর সূত্রেই লিপি বিবর্তনের ধারাবাহিকতাও  খুঁজেছেন প্রাবন্ধিক। এখন প্রশ্ন হলো, যত লিখছি, ততই  কী স্মৃতি কমছে ! কই আদিরস তো কমে না, তাহলে কৌতুক কমে কেন! পাঠক সমাজ তাহলে নিপাট সুশীল?

       আচ্ছা, চুম্বনের পরেও সম্পর্ক কিভাবে লুপ্ত হয়? ঠিক সেভাবেই হয়, যেভাবে মহানগর রূপকথা ধুয়ে দেয়। সাদামাটা, অ-বুদ্ধিজীবী, মাথামোটা প্রেমিকা যেমন ভাবে, 'কে আমার প্রেমিক?'; তেমনই লেখক ভাবেন -'Who is my reader?' সহোদর শব্দগুলোকে যেন আলাদা আলাদা নক্ষত্রের মর্যাদা দিলেন প্রাবন্ধিক। 'পাঠ' আর 'পাঠকৃতি' কিংবা 'পাঠ-প্রতিক্রিয়া' আর 'পাঠ-নির্মাণ'-- এদের ব্যঞ্জনা কিন্তু পৃথক! আসলে 'পাঠ' শব্দটাই মধ্যবিত্তের কাছে যেন সর্ষের ভেতরে থাকা ভূতের মতোই গোলমেলে। ওদিকে রোলাঁ বার্থও কী খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন 'সহৃদয়-হৃদয় সংবেদী'-কে! অর্ধেন্দুর গদ্যে এলো প্রাকরণিক বিচিত্র কৌশল তত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা অনেকটাই জুড়ে , তবু যেন এতে চাকুরিজীবীর একঘেয়েমি নেই। তত্ত্ব-সন্ধান ক্লান্তির পরিবর্তে চাপল্যও আনতে পারে। কখনও বা প্রাবন্ধিক  দেখিয়েছেন পাঠবিশ্লেষণে  ইকো-ক্রিটিসিজমেরও তীব্র ভূমিকা থাকে।

    আচ্ছা, বাঙালি-মানসে কী অনেকার্থবোধক বক্তব্য বেশি দাগ কাটে? ঊনবিংশ- বিংশ  শতাব্দীতে থাকা স্মৃতির উপকারী ভূতদের (ত্রিকালজ্ঞ অর্থে ) জাগিয়ে তুললেন প্রাবন্ধিক। শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু থেকে সুকুমার সেন অবধি একটা অক্লান্ত স্বপ্নের প্রবাহ তুলে ধরলেন। একটু বেশি অনুসন্ধিৎসু পাঠক অবশ্য এখানে উত্তরটীকা-পাদটীকা আস্বাদনের আবদার জুড়তে পারেন। তাদেরকে একটু  নিরাশ করলেও, 'সহৃদয় সামাজিক' কিন্তু এই বই থেকে তৃপ্তি পাবেন। আসলে এই বইয়ের শব্দবিশ্ব বেশ আত্মমগ্ন আর সহজসঞ্চারী। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পাঠতন্ত্র ব্যাপারটা যেন 'অতি অল্প হইল'। অবশ্য সে ক্যারিশমা এতটাই অনন্ত যে স্বল্প পরিসরে তাকে বিম্বিত করা অসম্ভব।

      স্ট্যাটিসটিক্স ছাড়া কি আর কোনও সিদ্ধান্তকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়! রাশিবিজ্ঞানের গবেষক-অধ্যাপক অর্ধেন্দু পাঠকের সমস্যা প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন বেশ কিছু রাশিভিত্তিক সংকলন। এখন প্রশ্ন - সেগুলো কী অ-স্থানিক আর অ-কালিক বিমূর্তন? একেবারেই না। স্থান ও কাল সেখানে সমাজের অনুষঙ্গী বলেই বিষয়টা হয়ে উঠেছে শাশ্বত। কখনও গদ্যভঙ্গিতে 'wit' এসেছে বেশ রূপকধর্মিতায়। যেমন - 'পাঠক বড্ড ঢ্যাঁটা'--এই কথার সমালোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক বেশ স্পর্ধিত উচ্চারণে। মোদ্দা কথা হলো, 'পাঠ' কিংবা জীবন -- এই দুটোরই একটা সন্দর্ভবাচী রূপ গড়ে তুলতে হবে, যথেষ্ট অধ্যবসায়ের সঙ্গে।

      তাই বিশ্ব জুড়ে দাবি হোক একটাই -- সকলেরই  ভাবনার অধিকার জুটুক। কোনও একটা নির্দিষ্ট তত্ত্ব-প্রসূত ভাবনার ধুয়ো ধরে কিন্তু প্রাবন্ধিক হাঁটেননি, যদিও 'পাঠতন্ত্র'কে রীতিমতো ইতিহাসের আয়না ধরে সাজিয়েছেন। 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স'কে কী আমরা শুধুই তথ্য দলাইমলাই করার জন্যে আশ্রয় করি -- সেই মোক্ষম প্রশ্নও উসকে দিয়েছেন অর্ধেন্দু। আসলে পাঠক কখনও হয়তো টানা-পোড়েনের মধ্যে ফেঁসে যাওয়া টিকটিকির মতো ! আর তখনই পাঠক আত্মকে খুঁজতে গিয়ে আত্মহত্যা করে বসে । অর্ধেন্দু এই বইয়ের আগাগোড়া পাঠকের 'আত্ম'-এর অমরাবতী খুঁজেছেন। পাঠক বোকা পাঁঠা নয়। একবিংশ শতাব্দীর খাটো গণতন্ত্র কিংবা বাথরুমের বিষন্নতা সমস্তটাকেই নগ্ন করলেন অর্ধেন্দু। প্রবন্ধে  কিছুটা অংশ জুড়ে বড়ো বড়ো কবি-প্রাবন্ধিকের নামের ঝড়কে অবশ্য এক ঝলকে বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইনের মতো লাগে। তবু শেষ অবধি লোক দেখানো নয়, আসলে কিছু নামের নিজস্ব অহং আর আদর দুটোই থাকে। পাঠকেরাও তো অপরাধ করে, তারাই তো লেখকের সৃষ্টির ওপর সিগারেটের ছাই ঝেড়ে দেয়। এবার লড়াইটা অর্ধেন্দু জমালেন সংখ্যাতত্ত্ব আর রাজনীতির মধ্যে। ক্ষমতার  আস্ফালনকে অ্যানিমেটেড করে দেওয়া হোক। আর যৌবনের স্মৃতিচারণের মতো পাঠতন্ত্রের চোরা গলিঘুঁজিতে  প্রবেশ করা হোক। আসলে অর্ধেন্দুর বক্তব্যের ভরকেন্দ্রে রয়েছে স্বপ্নের বাস্তবতা। তাই পশ্চিমের স্ট্রাগলগুলো আদৌ কতটা অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছে তাকেও বিচার করেছেন প্রাবন্ধিক। গোঁড়া দুষ্টুরা মনে রাখবেন 'পাঠকৃতি'-র কোনও সতীচ্ছদ হয়না।

         এবারের দ্বন্দ্বটা আরও অদ্ভুত! বুদ্ধিজীবীর সংগ্রহ আর বোধি-সত্তার দ্বন্দ্ব। বেশ কিছু বিখ্যাত বইয়ের তালিকা সংযোজন করেছেন অর্ধেন্দু। তবু মিটিল না আশ ! এ তালিকা কোথাও যেন মনে হয় অসম্পূর্ণ কিংবা বড্ড কেন্দ্রীভূত। পরিশিষ্ট দুই -এই অংশে তো স্পষ্টতই ঘটে গ্যাছে সংরূপের মিশ্রণ। এসেছে চলচ্চিত্রের স্পর্শকাতরতা। কিন্তু এই সিনেম্যাটিক বেনোজলে উদ্ধার পেয়েছে সংবেদনশীল পাঠক। বুকের ওপর পাঠতন্ত্রের রসায়ন গাঁথা পাঠক যেন এক বৌদ্ধিক পরিসরকে বিনির্মিত করার তাগিদ পায়। পরিশেষে গ্রন্থে ব্যবহৃত ব্যক্তিনামের একটা তালিকা লেখক সংযোজিত করলে হয়তো আরেকটু সম্পূর্ণতা আসতো। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পাঠতন্ত্রের যে বুদ্ধিগ্রাহ্য বিবরণ অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার এই বইতে এঁকেছেন, তা ভাবীকালের গবেষকদের সহায়ক স্বরলিপি হয়ে উঠতেই পারে।


Tuesday, October 5, 2021

জাল ‘বর্ণপরিচয়’: বিদ্যাসাগরকে বাঙালির শ্রদ্ধার্ঘ্য

  লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী


বর্ণপরিচয়কার লেখা? উত্তর আমাদের সকলের জানা, কিন্তু বইবাজারে বা বইয়ের ছোট দোকানে চোখ রাখলে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার উপক্রম ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’, বাংলা প্রাইমারের এক মাইলফলক এই বইকে সঙ্গী করে আজ দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে চলছে বাঙালির বর্ণশিক্ষা এই দেড়শো বছরে বর্ণপরিচয়’-এর বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে অন্যান্য প্রাইমার লেখক শুরুতে বর্ণপরিচয়নামে বই লিখলেও তার আগে জুড়ে দিতেন - সহজ, সরল, সুবোধ, সচিত্র, নব, নতুন, প্রথম প্রভৃতি বিশেষণ কিন্তু বর্ণপরিচয়’ -এর প্রভাব বা তার অনুকরণে প্রকাশিত প্রাইমারের মাঝে ঘটল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা, প্রকাশিত হল নকল বর্ণপরিচয় বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থের হুবহু কপি বেরিয়ে পড়ল এই নকলনবিশির সূচনা বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই 

তৎকালীন অনুসন্ধানপত্রিকার বিশেষ সন্ধানে ধরা পড়েছিল এক জুয়াচোর গ্রন্থকারের ১৮৮৯ সালে এই জুয়াচুরি প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের কোনো অভিমত পাওয়া যায় না বিদ্যাসাগর প্রয়াত হলেন ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগর তাঁর জীবদ্দশায় বর্ণপরিচয়’ -এর প্রথম ভাগের ৬০তম সংস্করণে এবং তাঁর দ্বিতীয় ভাগের ৬২তম সংস্করণের বিন্যাসে শেষবারের মত সংস্কার করেছিলেন বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নারায়ণ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বর্ণপরিচয়গ্রন্থের স্বত্বাধিকার  দখল করেন সেই স্বেচ্ছাচারী বিপথগামীনারায়ণ, বিদ্যাসাগর যাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিলেন, ১৮৯৫-৯৬ সালে তিনি বিদ্যারত্নউপাধি নিয়ে বর্ণপরিচয়’- হস্তক্ষেপ ঘটালেন 

খানিকটা সময়ের দাবি মেনেই তিনি অক্ষর বিন্যাসে, সংশ্লিষ্ট অক্ষর যোগে ছবি অন্য শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটালেন বিদ্যাসাগর কৃত সারিবদ্ধ আ ক খ নবপরিচয়ে হল -অজগর, -আনারস, -কোকিল, -খরগোস - প্রতিটি শব্দের সাদাকালো সচিত্র পরিচয় বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালে অন্যান্য সচিত্র প্রাইমার গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বর্ণপরিচয়-কে চিত্রভূষিত করেননি সেটা করলেন নারায়ণ শুধু তাই নয়, বর্ণযোজনার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয়’- যেসব বানান নির্দিষ্ট করেছিলেন, নারায়ণ বানান তালিকা থেকে সেগুলি যথেচ্ছ খারিজ করলেন, নতুন বানানের অনুপ্রবেশ ঘটালেন, বদল আনলেন বাক্যবন্ধেও নমুনা হিসেবে সবচেয়ে যেটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল গোপাল-রাখালপাঠ বদল খুব বেশিদিন অবশ্য নারায়ণ তাঁর দখলে বর্ণপরিচয়’-এর স্বত্বাধিকার রাখতে পারলেন না কারণ বিদ্যাসাগরের উইল অনুযায়ী বহু ব্যক্তি বৃত্তি পেতেন নারায়ণ তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সেই বৃত্তিভোগীরা এবার আদালতের দ্বারস্থ হলেন 

ঋণ - সংবর্তক বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা


আদালতের নির্দেশ এল, বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি বন্ধক রেখে, বৃত্তির টাকা মিটিয়ে দিতে হবে বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি হিসাবে বন্ধক রাখা হল তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িটি এবং তাঁর রচিত বর্ণপরিচয়সহ অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকগুলি এইভাবে কিছুদিন বৃত্তিভোগীরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ পেলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায় এরপর একদিন যখন বন্ধক রাখা সম্পত্তি ছাড়ানোর মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেল, তখন পাঠ্যপুস্তকগুলির স্বত্ব বিক্রির জন্য ডাকা হল নিলাম সেখানে সর্বোচ্চ দর দিয়ে বইগুলির স্বত্ব অধিকার করেন আশুতোষ দেব, যিনি টি দেব নামে অধিক পরিচিত ততদিনে বিদ্যাসাগর পুত্র নারায়ণ বিদ্যারত্ন-কৃত বর্ণপরিচয়সর্বসাধারণের মান্যতা লাভ করেছে, ফলে বর্ণপরিচয়’-এর রিসিভার সংস্করণ এবং পরবর্তীকালে টি দেবের তত্ত্বাবধানে, দেব সাহিত্য কুটির প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত বর্ণপরিচয়আসলে যতখানি না বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’, তার চেয়ে বেশি নারায়ণ বিদ্যারত্নের বর্ণপরিচয় 

মনে রাখতে হবে, ওই পরিবর্তিত বর্ণপরিচয়-ই আজকের প্রচলিত বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় অন্যদিকে গ্রন্থস্বত্বের নিয়ম অনুযায়ী টি দেবের স্বত্বাধিকারের মেয়াদ ফুরোলে যে কোনো প্রকাশন সংস্থাই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়প্রকাশের যথেচ্ছ স্বাধীনতা পেয়ে যান প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়’-এর নির্মল সংস্করণ, নন্দন সংস্করণ, সংসদ সংস্করণ এছাড়াও নানা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে বর্ণপরিচয় প্রকাশনা সংস্থার রুচি অনুযায়ী সেগুলি সেজে উঠছে, আধুনিক বানান-বিধির দোহাই দিয়ে পুরনো বানানে পরিবর্তন আনা হচ্ছে আমদানি করা হচ্ছে নতুন বানান পাঠ শেষে সংযোজিত হয়েছে প্রশ্ন অনুশীলনী নারায়ণ বিদ্যারত্নের সময়ের সাদা কালো ছবির বদলে এখন রঙিন ছবির ছড়াছড়ি -অজগর থেকে শুরু করে গোপাল-রাখালএবং দ্বিতীয় ভাগের ভুবন তার কুখ্যাত মাসি -সবই এখন রঙিন, চটকদার 

পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় জাল বর্ণপরিচয়’-এর সন্ধান দিয়েছিল যে অনুসন্ধানপত্রিকা, সেই জাল এখন আরও বিস্তৃত সুদূরপ্রসারী। বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকাকালীন যদি জুয়াচোরেরা তাঁর গ্রন্থের হুবহু কপি করে, তাঁর নাম ছবি ব্যবহার করে লোক ঠকাতে পারে, তাহলে আজকের দিনে সেই চৌর্যবৃত্তির রমরমা হওয়াই স্বাভাবিক বর্ণপরিচয়আজ অভিভাবকহীন, স্বত্বহীন তাই জাল গ্রন্থের অসাধু ব্যবসায়ীরা দিব্য বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’-কে অবিকল নিজের নামে বা একটু-আধটু নিয়মরক্ষার হেরফের ঘটিয়ে ঢালাও ব্যবসা করে চলেছেন বাংলা বই বাজারের নিয়মকানুন তাঁদের ছোঁয় না বা ছুঁতে পারে না গ্রন্থস্বত্বের মেয়াদ শেষ হলে কোনো লেখকের লেখা যে-কোনো প্রকাশক ছাপাতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কি কেউ সে লেখা নিজের নামে ছাপাতে পারেন? ছাপাখানার নিয়ম যাই হোক, এটি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা বোধ করি কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না এই জাল বর্ণপরিচয়লেখকরা মদনমোহন তর্কলঙ্কারের শিশুশিক্ষাগ্রন্থের প্রথম ভাগের প্রভাত বর্ণনকবিতাটি (পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল) দিব্য বর্ণপরিচয়গ্রন্থে ঢুকিয়ে দিয়েছেন এছাড়াও শিশুশিক্ষাগ্রন্থের অসংখ্য বাক্য বর্ণপরিচয়গ্রন্থে ঢুকে আছে আজ গ্রামেগঞ্জে-মফঃস্বলে এই জাল বর্ণপরিচয়’-এর রমরমা 

বিশেষত গ্রামেগঞ্জে মুদির দোকানে যে বর্ণপরিচয়মেলে, সে-সবের প্রায় সম্পূর্ণটাই জাল বর্ণপরিচয় এই জাল বইগুলিতে যথারীতি বড় হরফে লেখা থাকে, ‘বর্ণপরিচয় - প্রথম ভাগ/দ্বিতীয় ভাগ’, তলায় বড় হরফে লেখা থাকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এরপর ছোট হরফে লেখা থাকে মহাশয়ের পন্থানুসারে  শেষে লেখকের নাম, সেই নাম আজ আর অনুসন্ধানপত্রিকা যেমনটা লিখেছিল, ‘জুয়াচোর লেখকদের নাম অণুবীক্ষণের তলায় ফেলিয়া দেখিতে হয়’, তেমনটা নয়, যথেষ্ট বড় হরফে লেখা আজকের জুয়াচোরেরা অকুতোভয়, বিদ্যাসাগরের নামের সমান মাপের হরফে তাঁদের নাম মলাটপাতায় ছাপাখানার ঠিকানা, দাম দশ টাকা আর অতি অবশ্যই গোলাপি মলাটের মাঝখানে বিদ্যাসাগরের সাবেকি ছবিটি শুধু বর্ণপরিচয়নয়, ‘বর্ণবোধ’, ‘ধারাপাত-সহ বাংলা বানানের নানা বই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’-এর মুখোশে প্রকাশিত হয়ে চলেছে সেই সব বইও গোলাপি মলাটের, বিদ্যাসাগরের ছবিযুক্ত 

বিদ্যাসাগরের নাম ভাঁড়িয়ে, ‘বর্ণপরিচয়জালগ্রন্থে আজ শিশুপাঠ্যের বাজার ছেয়ে গেছে কালোত্তীর্ণ একটি শিশুশিক্ষার গ্রন্থ , যার রচয়িতা বাংলা ভাষা শিক্ষার বিস্তারে তথা বাঙালির শিক্ষারম্ভের এক মহান ব্যক্তিত্ব, তাঁর নিকৃষ্ট নকল বা তাঁর চিত্র স্বাক্ষর দেখিয়ে লোক ঠকানোর এই অসাধু ব্যবসা কি চলতেই থাকবে? যে-বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যাসাগরের মৃত্যু জন্মবার্ষিকীতে নিয়ম করে সংবাদপত্রে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় শ্রদ্ধার্ঘ্য উগরে দিয়ে থাকে, তাঁরা কী এ-ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন? জবাব মেলে না।


শোভনলাল চক্রবর্তী