Wednesday, February 2, 2022

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাঠতন্ত্র' - সংখ্যাতত্ত্ব পেরিয়ে এগোচ্ছে পাঠক

 লিখেছেন

ড. অ মৃ তা  ঘো ষা ল 



কিছু কিছু বইয়ের বেশ ধারালো আওয়াজ থাকে। ফ্যাতাড়ুরা সেই আওয়াজ শুনতে পায়। আমরা মধ্যবিত্ত পাঠক। এক লাইন পড়ি, আত্মতুষ্টিতে ডগমগ হই। সেই মধ্যবিত্তকে বেশ জোরে একটা ধাক্কা মারলো অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাঠতন্ত্র : পাঠকের রুচি-অরুচি নির্মাণ -বিনির্মাণ ও অন্যান্য' বইটি। বইটি প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, শব্দের ঘনত্ব বাড়ায় রক্তের ঘনত্ব। মানুষ অবসন্ন হয়, নতুন নন্দনতত্ত্বের সন্ধান করে। কখনও পায় অবয়বহীন অত্যাচার, কখনও দ্যাখে  '-ইজম'-এর উল্লাস! গ্রাফিতি, রাজনীতি, প্রতাপের ফিসফিসানির মধ্যেই জেগে থাকে শব্দের জটিল মনস্তত্ত্ব। অর্ধেন্দু বোধহয় সেখানেই খুঁজে পেলেন লেখকের অ-তৃপ্তি। প্রাচ্যের উত্তরাধিকার - এই ব্যাপারটার একটা নিজস্ব আধিপত্য আছে। কিন্তু কালাতিক্রমী তত্ত্বরা আবার সেই উত্তরাধিকারকে উল্টে দিতে পারে। যেমন গ্রিক সাহিত্যে স্মৃতিবিদ্যারও একটা ভিত্তি ছিলো। আসলে পাঠক বোধহয় শুধুই স্মৃতির ঈশ্বর-কণা আঁকড়ে বাঁচে ! এই আঁকড়ানোর সূত্রেই লিপি বিবর্তনের ধারাবাহিকতাও  খুঁজেছেন প্রাবন্ধিক। এখন প্রশ্ন হলো, যত লিখছি, ততই  কী স্মৃতি কমছে ! কই আদিরস তো কমে না, তাহলে কৌতুক কমে কেন! পাঠক সমাজ তাহলে নিপাট সুশীল?

       আচ্ছা, চুম্বনের পরেও সম্পর্ক কিভাবে লুপ্ত হয়? ঠিক সেভাবেই হয়, যেভাবে মহানগর রূপকথা ধুয়ে দেয়। সাদামাটা, অ-বুদ্ধিজীবী, মাথামোটা প্রেমিকা যেমন ভাবে, 'কে আমার প্রেমিক?'; তেমনই লেখক ভাবেন -'Who is my reader?' সহোদর শব্দগুলোকে যেন আলাদা আলাদা নক্ষত্রের মর্যাদা দিলেন প্রাবন্ধিক। 'পাঠ' আর 'পাঠকৃতি' কিংবা 'পাঠ-প্রতিক্রিয়া' আর 'পাঠ-নির্মাণ'-- এদের ব্যঞ্জনা কিন্তু পৃথক! আসলে 'পাঠ' শব্দটাই মধ্যবিত্তের কাছে যেন সর্ষের ভেতরে থাকা ভূতের মতোই গোলমেলে। ওদিকে রোলাঁ বার্থও কী খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন 'সহৃদয়-হৃদয় সংবেদী'-কে! অর্ধেন্দুর গদ্যে এলো প্রাকরণিক বিচিত্র কৌশল তত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা অনেকটাই জুড়ে , তবু যেন এতে চাকুরিজীবীর একঘেয়েমি নেই। তত্ত্ব-সন্ধান ক্লান্তির পরিবর্তে চাপল্যও আনতে পারে। কখনও বা প্রাবন্ধিক  দেখিয়েছেন পাঠবিশ্লেষণে  ইকো-ক্রিটিসিজমেরও তীব্র ভূমিকা থাকে।

    আচ্ছা, বাঙালি-মানসে কী অনেকার্থবোধক বক্তব্য বেশি দাগ কাটে? ঊনবিংশ- বিংশ  শতাব্দীতে থাকা স্মৃতির উপকারী ভূতদের (ত্রিকালজ্ঞ অর্থে ) জাগিয়ে তুললেন প্রাবন্ধিক। শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু থেকে সুকুমার সেন অবধি একটা অক্লান্ত স্বপ্নের প্রবাহ তুলে ধরলেন। একটু বেশি অনুসন্ধিৎসু পাঠক অবশ্য এখানে উত্তরটীকা-পাদটীকা আস্বাদনের আবদার জুড়তে পারেন। তাদেরকে একটু  নিরাশ করলেও, 'সহৃদয় সামাজিক' কিন্তু এই বই থেকে তৃপ্তি পাবেন। আসলে এই বইয়ের শব্দবিশ্ব বেশ আত্মমগ্ন আর সহজসঞ্চারী। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পাঠতন্ত্র ব্যাপারটা যেন 'অতি অল্প হইল'। অবশ্য সে ক্যারিশমা এতটাই অনন্ত যে স্বল্প পরিসরে তাকে বিম্বিত করা অসম্ভব।

      স্ট্যাটিসটিক্স ছাড়া কি আর কোনও সিদ্ধান্তকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়! রাশিবিজ্ঞানের গবেষক-অধ্যাপক অর্ধেন্দু পাঠকের সমস্যা প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন বেশ কিছু রাশিভিত্তিক সংকলন। এখন প্রশ্ন - সেগুলো কী অ-স্থানিক আর অ-কালিক বিমূর্তন? একেবারেই না। স্থান ও কাল সেখানে সমাজের অনুষঙ্গী বলেই বিষয়টা হয়ে উঠেছে শাশ্বত। কখনও গদ্যভঙ্গিতে 'wit' এসেছে বেশ রূপকধর্মিতায়। যেমন - 'পাঠক বড্ড ঢ্যাঁটা'--এই কথার সমালোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক বেশ স্পর্ধিত উচ্চারণে। মোদ্দা কথা হলো, 'পাঠ' কিংবা জীবন -- এই দুটোরই একটা সন্দর্ভবাচী রূপ গড়ে তুলতে হবে, যথেষ্ট অধ্যবসায়ের সঙ্গে।

      তাই বিশ্ব জুড়ে দাবি হোক একটাই -- সকলেরই  ভাবনার অধিকার জুটুক। কোনও একটা নির্দিষ্ট তত্ত্ব-প্রসূত ভাবনার ধুয়ো ধরে কিন্তু প্রাবন্ধিক হাঁটেননি, যদিও 'পাঠতন্ত্র'কে রীতিমতো ইতিহাসের আয়না ধরে সাজিয়েছেন। 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স'কে কী আমরা শুধুই তথ্য দলাইমলাই করার জন্যে আশ্রয় করি -- সেই মোক্ষম প্রশ্নও উসকে দিয়েছেন অর্ধেন্দু। আসলে পাঠক কখনও হয়তো টানা-পোড়েনের মধ্যে ফেঁসে যাওয়া টিকটিকির মতো ! আর তখনই পাঠক আত্মকে খুঁজতে গিয়ে আত্মহত্যা করে বসে । অর্ধেন্দু এই বইয়ের আগাগোড়া পাঠকের 'আত্ম'-এর অমরাবতী খুঁজেছেন। পাঠক বোকা পাঁঠা নয়। একবিংশ শতাব্দীর খাটো গণতন্ত্র কিংবা বাথরুমের বিষন্নতা সমস্তটাকেই নগ্ন করলেন অর্ধেন্দু। প্রবন্ধে  কিছুটা অংশ জুড়ে বড়ো বড়ো কবি-প্রাবন্ধিকের নামের ঝড়কে অবশ্য এক ঝলকে বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইনের মতো লাগে। তবু শেষ অবধি লোক দেখানো নয়, আসলে কিছু নামের নিজস্ব অহং আর আদর দুটোই থাকে। পাঠকেরাও তো অপরাধ করে, তারাই তো লেখকের সৃষ্টির ওপর সিগারেটের ছাই ঝেড়ে দেয়। এবার লড়াইটা অর্ধেন্দু জমালেন সংখ্যাতত্ত্ব আর রাজনীতির মধ্যে। ক্ষমতার  আস্ফালনকে অ্যানিমেটেড করে দেওয়া হোক। আর যৌবনের স্মৃতিচারণের মতো পাঠতন্ত্রের চোরা গলিঘুঁজিতে  প্রবেশ করা হোক। আসলে অর্ধেন্দুর বক্তব্যের ভরকেন্দ্রে রয়েছে স্বপ্নের বাস্তবতা। তাই পশ্চিমের স্ট্রাগলগুলো আদৌ কতটা অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছে তাকেও বিচার করেছেন প্রাবন্ধিক। গোঁড়া দুষ্টুরা মনে রাখবেন 'পাঠকৃতি'-র কোনও সতীচ্ছদ হয়না।

         এবারের দ্বন্দ্বটা আরও অদ্ভুত! বুদ্ধিজীবীর সংগ্রহ আর বোধি-সত্তার দ্বন্দ্ব। বেশ কিছু বিখ্যাত বইয়ের তালিকা সংযোজন করেছেন অর্ধেন্দু। তবু মিটিল না আশ ! এ তালিকা কোথাও যেন মনে হয় অসম্পূর্ণ কিংবা বড্ড কেন্দ্রীভূত। পরিশিষ্ট দুই -এই অংশে তো স্পষ্টতই ঘটে গ্যাছে সংরূপের মিশ্রণ। এসেছে চলচ্চিত্রের স্পর্শকাতরতা। কিন্তু এই সিনেম্যাটিক বেনোজলে উদ্ধার পেয়েছে সংবেদনশীল পাঠক। বুকের ওপর পাঠতন্ত্রের রসায়ন গাঁথা পাঠক যেন এক বৌদ্ধিক পরিসরকে বিনির্মিত করার তাগিদ পায়। পরিশেষে গ্রন্থে ব্যবহৃত ব্যক্তিনামের একটা তালিকা লেখক সংযোজিত করলে হয়তো আরেকটু সম্পূর্ণতা আসতো। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পাঠতন্ত্রের যে বুদ্ধিগ্রাহ্য বিবরণ অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তার এই বইতে এঁকেছেন, তা ভাবীকালের গবেষকদের সহায়ক স্বরলিপি হয়ে উঠতেই পারে।