Monday, March 14, 2022

ফিনফ্লুয়েন্সর ও একুশ শতকের নয়া-অর্থনীতির দিকচিহ্ন

   লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

FINFLUENCER BENGALI

সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ও তাদের বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি ইউটিউবের। সেখানে দাবি করা হয়েছে যে ইউটিউবের সাহায্যে এক বিশেষজ্ঞ উদ্যোগীর দল ভারতে রোজগারের এমন সুযোগ সৃষ্টি করেছেন যা প্রায় সাত-লক্ষ পূর্ণ-সময়ের কাজের সমতুল্য। করোনাকালে চাকরির আকালের বাজারে যা প্রায় অসাধারণ এক দাবি। এইসব উদ্যোগপতিরা ভারতের অর্থনীতিতে গড় জাতীয় উৎপাদনে ৬,৮০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছেন। এই রিপোর্ট অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স-এর দ্বারা প্রদত্ত। ইউটিউবের তরফে হ্যাশট্যাগ ক্রিয়েটিং ফর ইন্ডিয়া-কে প্রায় একটি জন-আন্দোলনে রূপান্তরিত করা হয়েছে।



আজকের দিনে, কোনো ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি বা কোনো অনুপ্রেরণা নিয়ে যে-কেউই ইউটিউবের বিশ্বজোড়া দর্শকের দরবারে পৌঁছে যেতে পারেন। সেখানে উপভোক্তা বা দর্শকের সংখ্যা কত? নয়-নয় করে প্রায় ২০০ কোটি। কিন্তু দর্শকের কাছে পৌঁছে হবেটা কী? দেখা যাচ্ছে অতিমারির প্রকোপে ভারতীয় অর্থনীতির বেহাল দশা ধীরে-ধীরে ছন্দে ফিরে আসার পেছনে কোনও টাটা, গোদরেজ, আম্বানি বা উঠতি আদানিদের মত বড় বিনিয়োগকারীদের হাতযশ নেই। যাঁদের আছে তাঁরা হলেন ফিনফ্লুয়েন্সর- শব্দটা কি অচেনা ঠেকছে? তাহলে একবারে শুরু থেকে শুরু করা যাক।

সালটা ২০২০, ভারতীয় অর্থনীতি একেবারে যাকে বলে মুখ থুবড়ে মাটিতে, মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া সব বেবাক ফেল। এমন একটা সময় হঠাৎ দেখা গেল ভারতের অর্থনীতির রাজধানী মুম্বাইয়ের ব্যাংকে হু-হু করে বাড়ছে ডিম্যাট একাউন্টের সংখ্যা। অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়ে দেখল যারা এই আকাউন্ট খুলেছে তাদের সবার বয়স ২৬-২৭-এর বেশি নয়। এরা কোথায়  বিনিয়োগ করছে দেখে আরও আশ্চর্য হল সংস্থাগুলো। দেখা যাচ্ছে যে, শেয়ার বাজারের(বাঙালির কাছে আজও শেয়ার বাজার এক ম্লেচ্ছ শব্দ!) প্রথাগত বিনিয়োগ এখানে হচ্ছে না। খুব অল্প পরিমাণ টাকা খুব ছোটখাট কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন লগ্নিকারী এবং সেই টাকা গড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তুলে নেওয়াও হচ্ছে।

কোভিড-এর সময়ে বহু মানুষের চাকরি চলে যায়, বা বেতন কমে যায়। তখন রোজগারের বিকল্প হিসাবে তৈরি হয়েছিল আরেকটি পথ, তা হল শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লাভের মুখ দেখা। কিন্তু বিনিয়োগ করলে যে টাকা জলে যাবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? এইখানেই মস্ত বড় ভূমিকা পালন করছেন ফিনফ্লুয়েন্সরা। তাঁরা মানুষকে কোন্‌ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ হবে, এ-কথা না বলে শেয়ার বাজার বস্তুটা আসলে কী - সেটা সম্পর্কে অবগত করছেন। শেয়ার বাজারে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বিনিয়োগ করা শুরু করবেন সেই সম্পর্কে ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করছেন। খুব অল্প পরিমাণ টাকা নিয়ে কিভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে বলছেন। সোজা কথায় ফিনান্সিয়াল মার্কেট নিয়ে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছে।



এতে দু'তরফেই লাভ হচ্ছে। প্রথমত, যাঁরা অল্প টাকা বিনিয়োগ করে কিছু টাকা বেশি ফেরৎ পাচ্ছেন, এই আকালের দিনে সেটাই তাঁদের কাছে লাভ। এমন বহু উদাহরণ আর্থিক সংস্থার সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, যেখানে কাজ হারানো শ্রমিক বউয়ের গয়না বেচে সেই টাকাকে লগ্নি করে মাস চালিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, যে-শেয়ার বাজারকে আমরা ফাটকা, জুয়া, ইত্যাদি তকমা দিতাম, সেই বাজার করোনার কালবেলায় বহু মানুষের সংসার বাঁচিয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশের (তার মধ্যে অবশ্যই ভারত অন্তর্ভুক্ত) জিডিপির পতনের পরেও শেয়ার বাজার কেন চাঙ্গা থাকছে এই নিয়ে প্রথম সমীক্ষায় নামে অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স। সেখান থেকেই প্রথম প্রকাশ্যে আসে ফিনফ্লুয়েন্সরদের ভূমিকা ও শেয়ার বাজারের এই নয়া দৌড়।

এরপর আলাদা করে ভারতবর্ষের শেয়ার বাজারের উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে, ২০২০-২১ পর্বে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া সত্ত্বেও, মানুষের আয় কমে যাওয়া সত্ত্বেও, মানুষ কাজ হারানো সত্ত্বেও, না খেতে পাওয়া মানুষের মিছিল, বা তাদের আর্তনাদ যে আমরা শুনতে পেলাম না তার একটা বড় কারণ ফিনফ্লুয়েন্সরা, যাঁরা প্রথা ভেঙে সাধারণ মানুষকে শেয়ার বাজারমুখী করেছেন, সাধারণ মানুষ কিছু বাড়তি টাকার মুখ দেখেছেন, যেটা এই কালবেলায় একটা বড় খবর। এ তো গেল প্রথম লাভের কথা ,দ্বিতীয় যেটা হয়েছে সেটাও একটা নীরব বিপ্লব।

অক্সফোর্ডের সমীক্ষা বলছে ফিনফ্লুয়েন্সরা শুধু নন, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে, যাঁদের বলা হয় ক্রিয়েটর, ১ লক্ষ বা তার বেশি টাকা রোজগার করেন এমন মানুষের সংখ্যা ভারতে প্রতি বছর ৬০% হারে বাড়ছে। যে-পরিসংখ্যান সঠিকভাবে না জানলেও তা আন্দাজ করে, অনেকেই ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্বপ্ন আর বিপুল খরচের পেছনে না ছুটে এখন ইউটিউবকেই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। সমীক্ষা বলছে ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক উপায় রয়েছে ভিডিও প্রোমোশন ও মানিটাইজেশনের, যার একটা দুটো কাজে লাগলেই ডাল-ভাতের সংস্থান আটকানো শক্ত। এই সব নতুন পথের সন্ধানে বাঙালি যে নেই তা নয়, তবে যা আছে তা হাতে গোনা। শেয়ার বাজার সম্পর্কে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে প্রথম অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তোপসে-খ্যাত সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সেখানে মূলত বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হত। পরে তিনি একক উদ্যোগে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, শেয়ার বাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবগত করার জন্য। কিন্তু বাঙালির কাছে বিনিয়োগ মানেই ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্ট অফিসে রাখা টাকা, আর জীবন বীমা।

বাঙালির মতোই বাঙালির প্রত্যেকটি বিনিয়োগের জায়গা এখন শুকিয়ে মজে গেছে। তাই নতুন প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েরা অনেকেই অল্প অল্প করে শেয়ার বাজারে আসছেন পা টিপে-টিপে। অনেকে বাড়িতে লুকিয়ে, কারণ বাড়ির বাবা-জ্যাঠাদের কাছে শেয়ার বাজার জুয়া হয়েই রয়ে গেছে। যে-বাঙালি প্রতি সন্ধ্যায় টেলিভিশনের সামনে বসে শেয়াল কুকুরের যুদ্ধ দেখেন, তাঁরা কি এবার একটু নজর ফেরাবেন? দুনিয়াটা শুধু বদলাচ্ছে তাই নয়, বদলাচ্ছে একবারে লাফিয়ে লাফিয়ে। একুশ শতকে অর্থনীতি থেকে শুরু করে আগামী দিনে কাজকর্মের ক্ষেত্রেও আসবে নতুন নতুন ধারণা, যা ধুলোয় লুটিয়ে দেবে পুরানো ধারণাকে। বাঙালি কি সেই ধাক্কা সামলাবার জন্য ভাবা শুরু করেছে, চিনতে পারছে নতুন দিকচিহ্নের সংকেত ? ভাবলে, চিনলে  ভালো।  তা না হলে বাড়ির চেয়ারে বা খাটের খুঁটির সঙ্গে অচিরেই বাঙালিকে সিট বেল্ট বাঁধতে হবে, নইলে ছিটকে পড়ে যাওয়া অনিবার্য।