Monday, May 24, 2021

Why does Kerala getting so much attention in Covid19 Management?

Article By,

Jesbin Skariah Thomas


Kerala Covid19

Why Kerala, a small state in India, is getting so much attention in the context of Covid Management? We know Kerala leads all other states with regards to human development and any given demographic indicator. The state has the best health care system with state of the art infrastructure and doctors accessible to people at the primary level. The doctor-to-patient ratio in Kerala is 25 to 10,000, much, better than the 10:10,000 recommended by the World Health Organization. Nevertheless, Covid cases in Kerala are on the rise, though the state’s health department is handling it quite efficiently.

Here, we need to discuss some of the challenges unique to Kerala, not faced by the other Indian states.

  1. The state's old-age population is more than any other state in the country -- at 14%, it is 5% above the national average living over 60 years. Thus, the elderly with less immunity and high disease burden is undoubtedly the major contributing factor to fatality. 
  2. The state has the highest morbidity burden of lifestyle diseases, with one in every four adults having diabetes and nearly one-third of the adult population suffering from blood pressure.
  3. Every third household in Kerala has a migrant, and also another 2.5 million guest labourers residing within the state. The steady inflow of international and national migrants poses a serious challenge in containing the virus. During the first wave, the state had achieved ‘zero’ cases reported as the after-effect of lockdown imposed. But since then, it has opened up borders, the consequences of which are reflected in the surge of Covid-positive patients.
  4. Owing to its high population density (859 per sq km), the probability of any contagious disease spreading rapidly in the state, remains at the upper end of the spectrum.

Despite all these adversities, the state has proven its mettle in containing the virus and bringing down the fatality numbers. Therefore, not much chaos, panic or confusion is visible, though persistent and strenuous efforts are underway at all the levels of the Covid management system. District-level control cells connect every healthcare facility to the available logistic resources. These control-cells monitor daily activities to ensure that there is no shortage of bed, oxygen, ventilators and the likes. The state has also ramped up its Covid care infrastructure by adding more hospital beds, ventilators, ICUs etc., in addition to its already existing notable investment in public health. Expecting the second wave, the state had put in extensive efforts to boost its oxygen production from 73 metric tons to 219 metric tons a day. Besides all these, the most crucial practice Kerala has been following is to report the actual data which helps in an accurate forecast of expected cases and estimation of resources required to tackle the situation. The priority is to control the number of deaths regardless of the positivity rate, which even if spiraling is not something to worry about unless the healthcare system collapses, running out of beds, oxygen and ventilators. So far, the healthcare system in Kerala has succeeded in extending necessary medical services to all those who got infected with the novel Corona virus and thereby kept the death rate at its minimum.

 

Unlike the first lockdown (which was sudden and unplanned, leading to unexpected loss of livelihoods for many and the grave migrant crisis), the Center did not take any initiative in the second wave to restrict people's movements but left the same at the liberty of the state governments! If the first lockdown worked as a preparatory phase, Kerala’s motto in the second wave is to slow down the spread of the virus so that the system does not fall apart by an overwhelming number of cases.

Vaccination: As per the Covid dashboard of the Kerala government, nearly one-third of the state’s 18+ population has received at least one dose of the vaccine so far. Like many other states in India, paucity of vaccine is still a matter of concern for Kerala. However, the proficient handling and optimum use of vaccines by the nurses could help give more vaccine to the people than the allotted amount. Kerala is the only state to have reported zero wastage of vaccines.

Role of Local government bodies in Covid care: Local government bodies with their task force are at the front line to deal with the pandemic situation at the micro-level. Ward level Rapid Risk force has been constituted in all wards with respective ward members, ASHA workers and ANM and SHG personnel. They are the first to reach out to for families having a Covid patient or a migrant member. The ASHA workers after checking on their health status arrange for quarantine facilities, if needed, to avoid further spread of the virus in the family and the community, at large. If, however, the household does not have a separate room with attached washroom, the person is sent to a quarantine facility arranged by the local government. 

Community Participation: The state government’s coordination with local governments ensures that no person is left hungry in the state. Data suggests that food prepared in the community kitchens run by women from the SHG served around 8.6 million individuals, till May 17, 2021. Quarantined people, guest workers (migrants), and destitute had extensively availed these services, especially during lockdown. Not only the government officials and health workers, but social volunteers are also working shoulder to shoulder in the fight against this raging pandemic, supporting local governments in arranging quarantine facilities for the isolation of Covid positive patients. As per the Kerala Covid dashboard, till date around 3.7 lakh volunteers have registered themselves. Nearly 3700 destitute have been rehabilitated as of 25th April, 2021 and about 340,000 migrant labourers served in labour camps. 

The Kerala model of Covid management is nothing but a comprehensive care system for citizens with planning at the micro-level. In both phases of the Covid outbreak, the preparation and alertness of the government, well equipped with infrastructure and expertise is certainly outstanding. This has contributed to Kerala’s low fatality rates -- less than 0.3%, even amidst a multitude of challenges, which undoubtedly is a great achievement for the government.  Necessary preparations to address the forthcoming challenges of the pandemic are also continuing at the same time. 

 

Reference



Jesbin Skariah Thomas, from Kerala, is currently a research scholar in Population Sciences, Gokhale Institute of Politics and Economics, Pune, Maharashtra

Saturday, May 22, 2021

বামপন্থার সেকাল একাল

________________________________________________________________

(প্রবন্ধটি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত এবং পর্বগুলি ঐক্যসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পড়তে গেলে খাপছাড়া ঠেকতে পারে। তাই পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি পর্বের লিংক প্রবন্ধের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ) 

_____________________________________________________


পশ্চিমবঙ্গের বিধি (তৃতীয় পর্ব) 

লিখেছেন

অ নি ন্দ্য ভ ট্টা চা র্য

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত


এমনতর এক আবহে আমরা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থা নিয়ে খানিক আলোচনা করতে পারি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ ব্যতিরেকে আর যে সমস্ত বাম দলগুলিকে আমরা এ রাজ্যে দেখতে পাই, তারা সকলেই কমিউনিস্ট আদর্শের অনুসারী। ফরওয়ার্ড ব্লক ছিল ঘোষিত ভাবে সমাজতন্ত্রের অনুসারী কিন্তু কখনই তারা মার্কসবাদ বা লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনিএ ছাড়া বাকী দলগুলির প্রত্যেকটিই নানা ভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তাদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছে, যদিও স্টালিন ও মাও প্রসঙ্গে অনেকের নানাবিধ ওজর-আপত্তি বা অনুরাগ আছে।

এ ছাড়াও আমাদের দেশে রামমনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের নেতৃত্বে এক ধরনের ভারতীয় সমাজতন্ত্রের ঘরানা গড়ে উঠেছিল যেখানে মার্কস-লেনিন’কে আদর্শ হিসেবে মানা হয়নি কিন্তু সেই ঘরানা পশ্চিমবঙ্গে তেমন ভাবে দাগ কাটতে পারেনি। এ রাজ্যে বরং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের রকমফের কদর অনেক বেশি সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছিল। সিপিআই থেকে সিপিআইএমএল, আরএসপি থেকে এসইউসি(আই), মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আরসিপিআই- এমন বিবিধ মার্কসবাদী দলের কম বেশি শক্তির ওপর নির্ভর করেই স্বাধীন-উত্তর এ রাজ্যের বিরোধী ও শাসক রাজনীতির আবর্ত চলেছে। এই প্রথমবার ২০২১’এ এসে দেখা গেল, বাম-শূন্য এক বিধানসভা ও চলমান রাজনৈতিক সমাজে এমন এক শাসক ও প্রধান বিরোধী পক্ষ যাদের যথাক্রমে মধ্যপন্থী ও চরম দক্ষিণপন্থী বলে কেউ কেউ অভিহিত করছেন। আবারও বলি, নামে কী বা এসে যায়, কিন্তু অন্তত ঘোষিত ভাবে যারা নিজেদের বামপন্থী বলে, তারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে যে জনসমর্থনের কোন তলানিতে এসে তারা পৌঁছেছে। অতএব, প্রশ্ন হল, হচ্ছে টা কী?

এই লেখায় আগেই বলেছি, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ও সমাজ-অর্থনীতির বিকাশের সম্ভাব্যতার কথা। সে সম্ভাব্যতায় কঠিন-কঠোর স্টালিনপন্থী একটি দল সিপিএমের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বে বামফ্রন্ট এ রাজ্যে ৩৪ বছর একটানা সরকার চালাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম দিকে খানিক অসুবিধা ও আশঙ্কা থাকলেও বামফ্রন্ট সরকার ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে কখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি যে এই সরকারকে জোরজবরদস্তি ফেলে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ, দেখা গেল, বিবর্তনের ধর্মে একটি মার্কসবাদী দলকেও নির্বাচনে জিতে সরকার চালানোর সুযোগ দেওয়া সম্ভব এটা তাহলে কীসের বিবর্তন? কোথা থেকে কোথায় বিবর্তন হল? কেন এমনতর সম্ভব হল? একটি পুঁজিবাদী (অথবা আধা-পুঁজিবাদী) রাষ্ট্র কীভাবে ও কেনই বা একটি মার্কসবাদী দলকে নির্বাচনে জিতে সরকারে বসতে ও তা দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে সুযোগ দিল? তার কি এমন কোনও আশঙ্কা বা সন্দেহ ছিল না যে এই ধরনের দলের সরকার আরও ‘গোলযোগ’ সৃষ্টি করে পুঁজিবাদকেই হটিয়ে দিতে পারে অথবা পুঁজিবাদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে? সে আশঙ্কা যে ছিল না, তা নয়। ১৯৫৯ সালে সেই আশঙ্কা থেকেই কেরালার নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। চিলিতে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত আলেন্দে মন্ত্রীসভাকে সামরিক অভ্যুত্থান করে ১৯৭৩ সালে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্য একটা প্রবণতাও বেশ জোরালো ভাবে সচল ছিল। তা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘সামাজিক সুরক্ষা’র নিদান সহ সংসদীয় গণতন্ত্রের এক কল্যাণমূলক উদারবাদী আবহের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ যে পথকে ‘ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকস’ নাম দিয়ে নতুন পথে যাত্রা শুরু করল, সে পথে ‘ইনক্লুসিভিটি’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বিষয়ক একটি শক্তিশালী উপাদান সুপ্ত ছিল। এই পথ নির্মিত হয়েছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক অংশগ্রহণে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনে উন্নয়নের চিহ্ন দেখে। তাই, সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রের যে সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত, তা পুঁজিবাদী দেশে একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে হলেও গ্রাহ্য হল।

পাশাপাশি, ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫০ বছর অতিক্রান্ত করেও একটি একদলীয়, একনায়কতন্ত্রী ও গণতন্ত্রহীন ব্যবস্থা হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে প্রদর্শিত হচ্ছিল। বিপ্রতীপে, ইউরোপ ও অন্যান্য সদ্য স্বাধীন দেশে বহুদলীয় নির্বাচনমূলক ব্যবস্থায় জনগণের দাবি-দাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলি যেন একটি সেফটি-ভাল্ব’এর মতো বহু কিছু আদায়ের পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে উঠল। অন্তত চৈতন্যের জগতে এমন একটা প্রভাব নিশ্চয়ই কাজ করল যে, শুধু খাওয়া-পরার নিশ্চিন্তিই বড় কথা নয়, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন চলাচল, মতামত ও শাসককে বদলে দেবার ক্ষমতা (ভোটাধিকার)- এগুলোও বেঁচে থাকার পরম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমি মনে করি, এখানেই কমিউনিস্টরা রাজনৈতিক ভাবে হেরে গেল। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অনুশীলনে বাস্তবিক তারা ব্যর্থ হলগোড়ার দিকে বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্বের বিপরীতে তাদের শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই যখন পরবর্তী কালে বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সমাজতান্ত্রিক (বা শ্রমজীবী মানুষের) গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করার লড়াইয়ে পর্যবসিত হল, তখন কার্যত তারা নতুন ও উন্নততর কোনও সূত্রায়ন বা অনুশীলনে পৌঁছতে পারল না আশ্চর্যের হলেও, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বলেও তেমন কিছু ছিল না।

অর্থাৎ, কিঞ্চিৎ মজার হলেও বিবর্তনটা হল এমনতর যে, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অনুশীলনের সদর্থক দিকগুলিকে পুঁজিবাদী দুনিয়া নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে আরও পোক্ত করার স্বার্থে গ্রহণ করল। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তারই অঙ্গ ছিল। তাই পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আর এইভাবে সমাজতন্ত্রের অনুষঙ্গগুলিকে অঙ্গে নিয়ে পুঁজিবাদের যে বিবর্তন তাতে সে প্রথম প্রথম ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবের’ ভয়ে খানিক আশঙ্কিত থাকলেও পরে আর তেমন বড় করে ভয় পায়নি কারণ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র বহু মানুষের কাছে তার যাথার্থ্য প্রমাণে এতদূর এগিয়ে গেছে যে ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ সে তুলনায় একেবারেই প্রায় অস্তিত্বহীন ও পশ্চাদপদ একটি সত্তা হিসেবে বিরাজমান থেকেছে। তাই, এ আস্থা পুঁজিবাদের অল্প হলেও ছিল (পরে আরও বিধৃত হয়েছে) যে, নির্বাচনের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলেও তারা সংসদীয় ব্যবস্থার পরিসীমা ডিঙোতে পারবে না। কারণ, সে ডিঙোবার জন্য তাদের কাছে যথার্থ বা আরও উন্নত কোনও গণতান্ত্রিক কারুকৌশল নেই যার আদর্শ ও আকর্ষণে ব্যাপক মানুষ অমন কোনও ব্যবস্থার দিকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যেতে চাইবে। যা আছে, তা দিয়ে অল্প কয়েক দিনের জন্য খুব সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতির উদয় হলে জোর লড়াই দেওয়া যেতে পারে বড়জোর।

এই যে এইভাবে সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলি পুঁজিবাদের গহ্বরে অন্তর্লীন হয়ে গেল, তা এমন এক বাস্তবতা নির্মাণ করল যে কমিউনিস্ট নামধারী অথবা কার্যসূচি বহনকারী যে কোনও রাজনৈতিক শক্তি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দিনাতিপাত করতে পারে। আর কমিউনিস্ট শক্তি যেহেতু একটি দেশে একটি মাত্র পার্টিতেই সংগঠিত নয়, বহু ধরনের পার্টিতে তারা বহুতর, অতএব, এই গোটা শক্তিটা যখন কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় এক জায়গায় এসে জড়ো হয়, সঙ্গে আরও প্রতিবাদী শক্তি বা পার্টিকে পাশে পায়- তখন এই গোটা মহলটাকেই এক কথায় ‘বামপন্থী’ বলে সাব্যস্ত করা হয়। হতে পারে, এই সমগ্র শক্তিটা কোনও কোনও দেশের বা কোনও অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক কাজের নিরিখে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় বা জাতীয় ক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু ক্ষমতা দখল করে তারা কি আমূল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পথে এগোতে পারে? এই প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত। এখন পর্যন্ত যে কটি দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে আমূল পরিবর্তনের পথে এগিয়েছে, সেইগুলি কিন্তু বহু পুরাতন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জিত (যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি)। অবশ্য, সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন করে পুঁজিবাদের পথেই আবার হাঁটতে শুরু করার অভিযোগ কিন্তু এই দেশগুলির বিরুদ্ধে আছে।

তাহলে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে পরপর সাতবার নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসা বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুতির এত অল্প সময়ে জনপ্রতিনিধিত্বের গুনিতকে একেবারে শূন্যে নেমে গেল কেন? এ রাজ্যে বামপন্থার ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ বা নব-উত্থান বলতে কি সেই সিপিএমেরই গোয়ালে আবার ফিরে যাওয়া বোঝাবে? এই প্রশ্নগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বসে বামপন্থীরা যেমন তাদের শক্তি সঞ্চয় করে, আবার দুর্বলও হয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, ফ্রান্স ও আরও কিছু দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কেরা ও পুঁজিপতি শ্রেণি কমিউনিস্ট বিপ্লবের শঙ্কায় এতদূর পর্যন্ত ভীত ছিল যে আমেরিকা চার্লি চ্যাপলিনের মতো প্রতিভাধরকে শুধুমাত্র ‘কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন’ অভিযোগে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। সেইসব দেশে কমিউনিস্টরা আক্ষরিক অর্থেই জনসমর্থনের ভিত্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং যে কোনও সময়ে ক্ষমতা দখলের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। ইতিহাস অবশ্য সে পথে হাঁটেনি।

পশ্চিমবঙ্গেও ৬০’এর দশক থেকেই বামপন্থীরা প্রবল ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনে উত্তরোত্তর তাদের সমর্থন ও সাফল্য আসতে থাকে। ১৯৭৭ সালে এই সমর্থন একটি কার্যকরী রূপ পায় এবং তারা ক্ষমতায় আসীন হয়ে কিছু যুগান্তকারী কর্মসূচিও রূপায়ন করে (যেমন অপারেশন বর্গা, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি)। এর আগে ৬০’এর দশকের শেষে ও সত্তর দশকের গোড়ায় নকশালপন্থী (সিপিএম থেকে ভেঙে আসা ও সিপিআইএমএল নামে সংগঠিত হওয়া) কমিউনিস্টরা নির্বাচন ও সংসদীয় পথকে বর্জন করে সশস্ত্র বিপ্লবের (‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন’) ডাক দেয়। সারা দেশ জুড়ে এক ব্যাপক আলোড়ন ওঠে। কিন্তু প্রস্তুতির অভাব ও নানান রাজনৈতিক কারণে সেই বিপ্লবের আহ্বান ১৯৭২ সালেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শীর্ষ নেতৃত্বের মৃত্যু ও দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় তাদের অবশিষ্ট কর্মীরা নানা গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নতুন ভাবে কাজকর্ম শুরু করে। এই ধারা এখনও বহমান আছে, যদিও তাদের অধিকাংশই এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের অংশভাক হয়েই নিজেদের কর্তব্যকর্ম চালাচ্ছে। তাহলে তারাও কি উপলব্ধি করেছে যে সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন এক ভার ও গ্রহণযোগ্যতা দেশের মাটিতে তৈরি হয়েছে যে তাকে অস্বীকার করার কোনও জো নেই? এতে অসুবিধার কিছু নেই। বাস্তবতা হল, সংসদীয় রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ নানা ভাবে এতটাই সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন যে একে বাদ দিয়ে আজ ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক কর্তব্যকর্মই সমাধা হতে পারে না। সে পথে কীভাবে, কতটা এগোলে বামপন্থীদের পক্ষে রাজ্য বা জাতীয় স্তরে সাফল্য আসতে পারে সে অন্য আলোচনার বিষয়। তা ব্যতীত, বস্তুগত পরিস্থিতির আনুকূল্যের জন্য অপেক্ষা করতে জানতে হয়।

যে কথা এই লেখায় হয়তো ঘুরে ফিরে কয়েকবার উল্লেখ করেছি, সংসদীয় ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ একদিকে যেমন চাইবে তার মতো করে তার বিরুদ্ধ শক্তিগুলিকে আত্মসাৎ করে নিতে, একইভাবে অন্যদিকে পুঁজিবাদ বিরোধী শক্তিরাও চাইবে পুঁজিবাদ সংকটাগ্রস্ত হয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথকে উন্মুক্ত করে দিক। কিন্তু বিবর্তনের নিয়মে সম্ভবত তেমন সোজাসুজি- হয় এটা নয় সেটা- কোনও পথ আজ আর নেই। বলতে চাইছি, পুঁজিবাদও তার সংকটের (বারবার সে সংকটে পড়ে) উপায় হিসেবে বামপন্থাকে যতটা সম্ভব ধারণ করতে অপটু নয়। অর্থাৎ, প্রয়োজন পড়লে বামপন্থার বহু কিছুকে আত্মস্থ করে পুঁজিবাদ তার প্রাণবায়ুকে সচল রাখবে। ফলে, উল্টো পথে এমনও ঘটা অস্বাভাবিক নয় যে বামপন্থী কোনও শক্তি নিজেদের রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ধরে রাখতে পুঁজিবাদের বাতিল হয়ে যাওয়া উপাদানগুলিকেও ফিরিয়ে আনতে উদ্গ্রীব। এ রাজ্যে সিপিএম ও বামফ্রন্টের শরিকদের দীর্ঘকাল ক্ষমতা ভোগের কারণে কতকটা তেমন দশাই হয়েছে। আর মূলত সে কারণেই তাদের ভোটের জনসমর্থন আজ ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাশাপাশি, এই সরল কথাটাও তারা বুঝল না যে, পুঁজিবাদের বাতিল হয়ে যাওয়া অনুশীলনকে তারা যখন নির্মম ভাবে ধরতে চাইছে, তখন খুব স্বাভাবিক পুঁজিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কোনও শক্তি নতুন পথে এগোনোর চেষ্টা করে পুঁজিবাদকে প্রাণবায়ু দেবে।

বলার এই, যা সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনেও বোঝা গেল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ও আন্দোলন থেকে সিপিএম কোনও শিক্ষাই নেয়নি। এই শতকের প্রথম দশকে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া যখন উত্তুঙ্গে এবং পুঁজি পাগলের মতো নিজেকে স্ফীতকায় করার বাসনায় নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন স্বভাবতই তা পুঁজির বাজারের ফাটকা কারবারে ও আরও নানাবিধ এমন সব কাজেকর্মে অতি সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়বে যেখান থেকে সম্পদ ও তাৎক্ষণিক মুনাফা খুব দ্রুত হস্তগত হতে পারে। তেমনই একটি ক্ষেত্র ছিল জল-জঙ্গল-জমি অধিগ্রহণ করে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও তৎপ্রসূত অতি-মুনাফার বাণিজ্য করা। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কর্পোরেটরা শিল্পের নামে বিশাল জমি অতি স্বল্পমূল্যে সরকারি সাহায্যে বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে তা বেশ কয়েক বছর ফেলে রেখে হয় সেখানে আবাসন গড়েছে বা চড়া দামে আবার হাতবদল করেছে। সে এক বিশদ কাহিনি। আর সে কাহিনিরই অংশ ছিল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে শিল্প গড়ার নাম করে জোরজবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ করে হাজার হাজার কর্মযুক্ত মানুষকে উচ্ছেদ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। আর তা হচ্ছিল দীর্ঘকাল এ রাজ্যে অধিষ্ঠিত বামফ্রন্টেরই হাত ধরে বামপন্থার নাম করেই।

২০০৬ সালের ২৫ মে টাটার এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে সরকারি আধিকারিকরা যখন চুপিসারে দুপুরবেলা সিঙ্গুরে জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন খবর পেয়ে কৃষক রমণীরা হাতে ঝাঁটা-খুন্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসে সে দলকে তাড়িয়েছিলেন। সে খবর চাউড় হতেই অসুস্থ জ্যোতি বসু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওখানে কৃষক সভাকে না জানিয়ে টাটার দল গেল কেন? প্রশ্নটি খুবই অর্থপূর্ণ। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, একটি বামপন্থী দলের স্থানীয় কৃষক সংগঠনের অজান্তেই কৃষিজমি সম্পর্কে নতুন কোনও প্রস্তাবের রূপরেখা কেন ভাবা হয়েছিল? এই মত স্পষ্টতই, একটি বামপন্থী দলের স্বাভাবিক গণভিত্তি যে কৃষক সমাজ, তার গুরুত্বের কথা অনুধাবন করতে বলে। কিন্তু পুঁজিবাদের মায়ামোহে তদানীন্তন বামফ্রন্টের নেতারা এতটাই মশগুল যে নিজ পার্টির শ্রেণি ভিত্তি বা কর্তব্যকর্ম তাঁরা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। এর পরের ঘটনাবলী আমরা জানি।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সারা রাজ্য জুড়ে এক তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে আন্দোলনের ভাষা তাঁরা পড়ে উঠতে পারেননি। বিরোধী দলনেত্রী তাঁর সংসদীয় রাজনীতির কারুকৌশলে অচিরেই এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকায় চলে আসেন এবং ২০১১ সালের নির্বাচনের রায়ে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘকালীন সরকারের পতন ঘটে। বামফ্রন্ট বহির্ভূত অন্যান্য বামপন্থী শক্তি এই আন্দোলনে থাকলেও তাদের নানা ধরনের জড়তা ও মতান্ধ চিন্তাভাবনা থাকার ফলে তারা এই আন্দোলনের দায়ভাগকে শেষাবধি বহন করতে ব্যর্থ হয়এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের এক অবিমৃশ্যকারী আচরণ।

মুশকিল হল, বামফ্রন্ট বা সিপিএমের তরফে এই বিচ্যুতিটা তারা আজও বুঝে উঠে পারল না। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের প্রার্থী সিঙ্গুরে গিয়ে ‘শিল্পের শিলন্যাস’ করে এলেন। আর ভোটের ফলাফলে আবারও তাদের ভরাডুবি হল। সচ্ছল মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে বামপন্থাকে দেখার যে ভয়ঙ্কর পরিণাম, তা তাদের কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে হল। তবুও তাদের হুঁশ নেই। শ্রেণি আন্দোলন থেকে বিচ্যুত তাদের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব নিঃশব্দে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে ফেলেছেন যে! তাঁরা ভাবলেন, একরের পর একর জমি পেয়ে কর্পোরেটরা এসে সুবোধ বালকের মতো শিল্প গড়ে তুলবে আর সেই শিল্পে রাজ্যের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে! কী বিপদ! সাধারণ খবর রাখা একজন সচেতন মানুষও জানেন যে, প্রথমত, সস্তায় জমি পেয়ে কর্পোরেটরা যে সেখানে শিল্প গড়ে তুলবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই (এ হল বিগ মিডিয়া নির্মিত একটি মিথ); দ্বিতীয়ত, যদিও বা সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে তা হবে এতটাই অত্যাধুনিক যে সেখানে খুব সীমিত সংখ্যক দক্ষ বেকারেরই কর্মসংস্থান হতে পারে; আর তৃতীয়ত, সব থেকে মূল্যবান কথাটি হল (যা আমাদের শীর্ষ আদালতও তুলে ধরেছে) যে, উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মচ্যুতি হবে, তা নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থেকে অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ, নতুন শিল্প, সহায়ক-শিল্প মিলিয়ে সর্বমোট যারা কাজ পাবেন তাঁদের থেকে যারা কাজ হারাবেন তাঁদের সংখ্যাটা অনেক পরিমাণে অধিক।

এও মনে করে দেখুন, সিঙ্গুরে যে জমিটি নিয়ে এত লড়াই, সেই জমির উল্টোদিকে (হাইওয়ের ওপারে) সমপরিমাণ ঈষৎ নিচু একটি প্রায়-পরিত্যক্ত জমি ছিল, যে জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় মানুষজনের কোনও আপত্তিও ছিল না, সেখানে টাটাদের প্রস্তাবিত শিল্প গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কেন? কারণ, জমিটি যেহেতু অল্প নিচু ছিল, তাই সেখানে কিছু পরিমাণে মাটি ফেলে ভরাট করার দায় পড়েছিল তাদের ওপরটাটারা সেই সামান্য ব্যয়টুকুও করতে রাজী ছিল না মুনাফার কিয়দংশে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে ভেবে। আর বামফ্রন্ট সরকার এমন নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেটদের পক্ষে দাঁড়াল যে, তারা টাটার সামান্য ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধিকে পর্যন্ত কৃষক ও বর্গাদারদের জীবনযাপন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার থেকেও বড় করে দেখল।

শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সোচ্চার প্রতিধ্বনি হয়ে যে বামপন্থী দলগুলির উত্থান ও বিকাশ, সেই তারাই এইভাবে হাতে লাল পতাকা নিয়ে ও মার্কসবাদের নাম করে প্রকারান্তরে শ্রমিক-কৃষকের বিপক্ষে গিয়ে রাজনীতির অতল জলে ডুবে গেল। অন্যদিকে, ভারতের প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের থেকে নিজেদের আলাদা করে  যে আঞ্চলিক নতুন দলটি রাজ্যে ১৯৯৮ সালে তৈরি হয়, তারাই কৃষকদের স্বার্থে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও অন্যত্র কঠিন লড়াই চালিয়ে এক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হল। অথচ, এই দলের তেমন কোনও ঘোষিত মতাদর্শ নেই। দু’ দফায় সরকার চালিয়ে তৃতীয় বারের জন্যও তারা নির্বাচিত হল বেশ প্রবল সংখ্যাধিক্য নিয়ে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, তৃণমূল সরকারের কোনও ব্যর্থতা বা অসাফল্য ছিল না। অবশ্যই ছিল। কিন্তু এমন একটা আস্থা তারা রাজ্যের মানুষের থেকে আদায় করতে পেরেছে যে এক বড় সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেছেন, অন্য সব দলের থেকে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের পাশে তৃণমূল সরকার আছে। দুর্ভাগ্যের হলেও বাস্তবতা এই যে, পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা দলের মতোই তৃণমূলও নিজ দলীয় ক্ষমতা জাহির করতে পিছপা হয়নি, স্থানীয় স্তরে আগের জমানাগুলোর মতোই অনেক জায়গাতেই গায়ের জোর দেখিয়েছে। দুর্নীতিও কম করেনি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাতাবরণ তারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যার ভিত্তিতে মানুষ তাদের অপকর্মগুলিকে সার্বিক বিচারে কম গ্রাহ্য করে সুকর্মের ভিত্তিতে তাদের ওপরে আস্থা রেখেছে। উপরন্তু, এবারের নির্বাচনে বিজেপি নামক এমন এক ফ্যাসিবাদী শক্তি এ রাজ্যের নির্বাচনে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার বিরোধিতায় তৃণমূলও এক অটল লড়াইয়ের স্বাক্ষর রেখেছিল, তা দেখে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ওপর কুণ্ঠাহীন আস্থা জ্ঞাপন করেছে। 

এই যে নবতর এক সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগের কাণ্ডারী তারা হতে পেরেছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক আস্থাভাজন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠতে পেরেছে, বহু প্রকল্প ও জনমুখি অনুশীলনের দ্বারা প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে কল্যাণমূলক কার্যধারাগুলিকে পৌঁছে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলেছে। দেখে মনে হবে, তারা বোধহয় কোনও বাম মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে তাদের অগ্রাধিকার পিছিয়ে পড়ে মানুষদের প্রতি। লক্ষণীয়, ঘোষিত ভাবে তারা কোনও মতাদর্শের অনুসারী নয়। বামপন্থীদের যে দাবিগুলি চারপাশে বারবার উচ্চারিত হতে শোনা যায়, তারা সেইগুলিকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করে। হতে পারে তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, হতে পারে তা নির্বাচনে জেতার জন্য। এতে সমস্যা কোথায়? বরং, এ তো বেশ ভাল ব্যাপার যে, সংসদীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে ও বহু ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর সে কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত ও উদার করা অতীব জরুরি। আর এইভাবেই তো চাপে পড়ে সংসদীয় গণতন্ত্র উত্তরোত্তর আরও বৈধতা পায় ও মানুষের আস্থা অর্জনে বেশি বেশি করে সক্ষম হয়ে ওঠে। আর যতই তা হয়, সাবেকি ও সনাতন বামপন্থীরা যেন পিছিয়ে পড়তে থাকে। দেখা যায়, নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তি সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করে বামপন্থার কর্মসূচিগুলিকেই আরও উন্নত স্তরে ধারণ করে। সে অর্থে বলাই যায়, এ রাজ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার দৌড়ে তৃণমূলিরা সাবেকি বামপন্থীদের একেবারে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এ এক অভিনব প্যারাডক্স। বামপন্থাকে অন্তঃস্থ করেই সংসদীয় গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যেন আরও সবল হয়ে উঠছে। অথচ সেখানে বামপন্থী নামধারীদের কোনও ঠাই নেই। কারণ, তারা চিন্তা-চেতনা ও কর্মে পড়ে আছে কয়েক দশক পিছনে। আর সে জন্যই আজ এই একুশ শতকের বিশের দশকের গোড়ায় এসে আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশধারা কোন পানে এগোচ্ছে আর সংকটের সূত্রগুলি কোথায় আবর্তিত হচ্ছে ও সুপ্ত আছে, তা বোঝার আদৌ কোনও এলেম তাদের নেই। কারণ, বহুদিন হল তারা রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চাকে সমূলে বিসর্জন দিয়েছে। বামপন্থী নামধারী যাদের বলি (কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাসীদেরও সে তালিকায় ফেলে) তাদের আজকের সংকট ঠিক এইখানটাতেই (তবে অবশ্যই অন্য কিছু বামপন্থী শক্তি নতুন ভাবে এগিয়ে আসছে)। অথচ যারা বামপন্থী নামধারী নয়, তারা ঘোর বাস্তবে বেমালুম ধাক্কাটাক্কা খেয়ে বামপন্থীদের সম্ভাব্য ইস্যুগুলিকে নিয়েই বেশ এগিয়ে পড়েছে। এই ‘ধাক্কাটা’ ওই তথাকথিত ‘অ-বাম’পন্থীদের আরও গায়ে লাগে কারণ, সংসদীয় রাজনীতিই তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। তাদের পক্ষে তা বেশ আয়াসসাধ্যও, কারণ তাদের অত মতাদর্শের পিছুটান নেই। তাই বলি, নামে কী বা আসে যায়!

এই যে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি সম্পর্কে সাবেকি বামপন্থীদের অজ্ঞতা, তার আলোকেই নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে এখন তাঁরা সামাজিক ন্যায়-প্রকল্পগুলিকে ‘ভিক্ষার ঝুলি’ হিসেবে বক্রোক্তি করছেন। কারণ, তাঁরা জানেন না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে যে বহু কথিত ‘গিগ অর্থনীতি’র জমানা শুরু হয়েছে, সেখানে স্থায়ী ও যথেষ্ট কর্মসংস্থানের কোনও আয়োজন নেই। আধুনিক যন্ত্র এখন আয়েসেই বহু মানুষের কায়িক ও মানসিক শ্রম দুইই বেশ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম। অতএব, আগামী দিনে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্রমেই আরও সংকুচিত হবে। যে কারণে, ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর আলোচনা এখন কান পাতলেই সর্বত্র শোনা যায়। অর্থাৎ, বহু সংখ্যক মানুষের হাতে টানা কাজ থাকবে না, প্রযুক্তি ও তার আনুষঙ্গিক দক্ষতা বহুল পরিমাণে খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকবে, কাজের বাজারে এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হবে। তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে সমাজকল্যাণ মূলক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা শত গুনে বেড়ে যাবে। তাই, ‘ভিক্ষার ঝুলি’ বলে সেইসব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে অবজ্ঞা করাটা আসলে অজ্ঞতার দিকচিহ্ন। শিল্প স্থাপনা ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির যে বড়াই সাবেকি বামপন্থীরা করে থাকে তা অশ্বডিম্ব বৈ আর কিছু নয়। কারণ, সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানা শিল্প আর কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্য প্রবণতা নয়, যা কিছু নতুন গড়ে উঠছে তা সব মেঘের আড়ালে (ক্লাউড প্রযুক্তি)। এই নতুন ভার্চুয়াল শিল্পে বিশেষ ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু কাজের অধিকাংশ পরিসরটা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। এই সামগ্রিক উত্থানটাকে কি বামপন্থীরা বুঝতে পারছেন? বিপদটা সেখানেই।

তাহলে কি বলব যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বাধ্যত ক্রমেই বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠছে? অর্থাৎ, নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির অভিসারে তা কি আরও কল্যাণমূলক অবস্থান গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার বিষয়। এর উত্তর এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে কিছু হয় না। আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্প, বোলসোনারো, এর্ডোগান, নরেন্দ্র মোদির মতো চরম দক্ষিণপন্থী ও মতান্ধ শক্তিকেও নির্বাচনের ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসতে দেখছি। তা নিয়ে এ লেখায় বিশেষ কিছু বলার নেই। বরং বলা যাক- যারে তুমি বাম দেখ সে কি বাম নয়/ যারে তুমি পর ভাবো সে কি বাম হয়’। অতএব, এ এক জটিল ধাঁধাঁ।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই লেখায় শেষ কথাটি হল, যারা নামে ও কাজে বামপন্থী বলে নিজেদের মনে করেন (নানাবিধ কমিউনিস্ট সহ) তাদের আজ সময় হয়েছে একুশ শতকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সম্পূর্ণত নতুন উত্থানকে সম্যক অনুধাবন করে তাকে এমন ভাবে উপলব্ধি করা যাতে একটি যথার্থ সমাজ বদলের (পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে) কার্যসূচি আবারও নির্মাণ করা যায়। বলাই বাহুল্য, পুঁজিবাদ তার নিজ জোরেই টিকে থাকছে, দরকার পড়লে সে বামপন্থাকেই যতটা সম্ভব আত্মসাৎ করছে, আর সেই সুবাদে নামধারী বামপন্থীদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির কালবেলায় পুঁজিবাদকে অতিক্রমণের মহামন্ত্র নামধারী বামপন্থীদের এখনও জানা নেই, কারণ, তারা রাজনীতির এক গোলকধাঁধায় আপাতত বাঁধা পড়ে আছে।

(সমাপ্ত)


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত ।

বামপন্থার সেকাল একাল

_____________________________________________________________

(প্রবন্ধটি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত এবং পর্বগুলি ঐক্যসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পড়তে গেলে খাপছাড়া ঠেকতে পারে। তাই পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি পর্বের লিংক প্রবন্ধের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ) 

______________________________________________________


বহু মতে বামপন্থা (দ্বিতীয় পর্ব) 

লিখেছেন

অ নি ন্দ্য ভ ট্টা চা র্য

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত



তবে বাস্তবতা হল, রাজনৈতিক অর্থনীতির যত বিবর্তন হয়েছে, ততই যেন বামপন্থী রাজনীতিরও নানান ধারা-উপধারা তৈরি হয়েছে। এক সময় ভাবাই যেত না যে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দেশে বা কোনও রাজ্যে কমিউনিস্ট নামধারী কোনও সংগঠন শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। গত ৫০ বছরের অনুশীলনে দেখা গেল, আমাদের দেশে তা সম্ভব। ১৯৫৯ সালে রাজ্য নির্বাচনে জিতে কেরলে নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বে অভিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম আঞ্চলিক সরকার তৈরি হয়। যদিও সে সরকারকে বেশিদিন চলতে দেওয়া হয়নি। তখন এমন একটা আশঙ্কা তৈরিও হয়েছিল যে, যদিও বা কমিউনিস্টরা (নিজেরা একক ভাবে হোক কি অন্যদের সাথে জোট করে) নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যান, তবুও সে সরকারকে এ দেশে চলতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সে চিন্তাকে কিছুটা আশাহত করে ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে দু’ দুবার পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের (তখন পার্টি দু’ ভাগ হয়ে গেছে) নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার অধিষ্ঠিত হয়। যদিও দুটি সরকারই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার কারণ অবশ্য যতটা না তাদের প্রতি ভারত সরকারের বিরাগ তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল যুক্তফ্রন্টের আভ্যন্তরীণ কোন্দল যা বহু জায়গায় রক্তাক্ত হানাহানিতে পর্যবসিত হয়। সে তর্ক বাদে, ১৯৭৭ সালে আবারও বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম নেতৃত্বাধীন জোট (এবার বামফ্রন্ট) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়। সেই সরকারকেও চলতে দেওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কা ও আতান্তর ছিল। কিন্তু শ্ত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বামফ্রন্ট রাজ্য সরকারে শুধু এককালীন টিকে গেল না, উত্তরোত্তর আরও বেশি বেশি ভোট পেয়ে ও বারবার নির্বাচিত হয়ে সাত দফায় ৩৪ বছর ধরে একটানা রাজ্য শাসন চালিয়ে গেল। নিঃসন্দেহে এ ছিল এক অভিনব ঘটনা। পাশাপাশি, ত্রিপুরা ও কেরলেও বামফ্রন্ট তাদের একাধিপত্য বজায় রাখল (যদিও কেরলে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতা খুইয়ে আবার তাদের পরের দফায় ফেরত আসতে হয়েছে। এই বছরই প্রথম দেখা গেল যে তারা পরপর দু’বার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছে)।  

এই অভিনব ঘটনার কোনও নিদর্শন মার্কসবাদের কোনও হ্যান্ডবুকে নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ, এমনতর ঘটনা গোটা বিশ্বে খুব অল্পই ঘটেছে এবং তার স্থায়িত্বও অতি স্বল্পকালীনসম্প্রতি নেপালে নির্বাচনে জিতে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তবে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ মতান্তরের জন্য সে সরকারও টলোমলো। সে বাদে আরও কিছু কিছু বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বা মার্কসবাদী দল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছেযেমন, ১৯৭০ সালে চিলিতে সালভাদোর আলেন্দে’এর নেতৃত্বে ‘পপুলার পার্টি’ একটি জোট গঠন করে নির্বাচনে জিতে সরকারে আসীন হয়কিন্তু সে সরকারকে টিকতে দেওয়া হয়নি। ১৯৭৩ সালে আমেরিকার মদতে একটি সামরিক ক্যু করে আলেন্দে’কে হত্যা করা হয় ও সামরিক প্রধান অগাস্টো পিনোশেট ক্ষমতা দখল করেন। অবশ্য, ভেনেজুয়েলায় ‘ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ ভেনেজুয়েলা’ পার্টির অবিসংবাদী নেতা হুগো সাভেজ ১৯৯৯ সাল থেকে পরপর তিনবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হন এবং ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেনশেষের দিকে তাঁর জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা এসেছিল। যদিও সাভেজ নিজেকে ‘মার্কসবাদী’ বলে ঘোষণা করেছিলেন কিন্তু তাঁর পার্টি অন্যান্য ধ্রুপদী কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ধরনের ছিল না। শুধু তিনি নন, এমত ধরনের নতুন ঘরানার বামপন্থী বা মার্কসবাদীদের নেতৃত্বে ব্রাজিল, ইকুয়েডর, বলিভিয়া প্রভৃতি দেশে তখন এক নতুন রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘোরতর বাস্তব। আর এদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কিউবা’র অবিসংবাদী ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, বাস্তবতার কষ্টিপাথরে সংসদীয় রাজনীতির পথ ধরেই গত দু-এক দশকে সারা বিশ্ব জুড়ে এমন এক শক্তির উত্থান ও রাজনীতির উদয় হচ্ছে যা পুরনো ব্যবস্থা ও সনাতনী স্থবিরতাকে আঘাত করতে চাইছে বা তাকে পর্যুদস্ত করে ক্ষমতাও দখল করছে। এই শক্তি কখনও ধ্রপদী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অবয়ব নিয়ে উঠে আসছে অথবা তেমন কোনও চিহ্নবহনকারী না হয়েও বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্মের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। গত ৩০ থেকে ৫০ বছর ধরে ধীরে ধীরে এই ধরনের শক্তির ক্রম উদয়ে তাদের একটি প্রকোষ্ঠে বিচার করার সুবাদেই মূলত মিডিয়া ও রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের বাচনে তারা ‘বামপন্থী’ হিসেবে সূত্রায়িত হয়েছে। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, বামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য কমিউনিস্ট হওয়ার আবশ্যিকতা নেই।

মোটা দাগে, বামপন্থী তারাই, যারা বৃহৎ পুঁজি চালিত কর্পোরেট স্বার্থকে উপেক্ষা করে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা (ভোটে জেতার জন্য হলেও) নেয়, বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিসরে বৃহত্তর মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যাকে অগ্রাধিকারে রাখার চেষ্টা করে এবং সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে সেই লক্ষ্যেই কার্যসূচিকে বহমান রাখেফলে দেখা যায়, ঘোষিত সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট শক্তিরাও এইসব শক্তির সাথে জোট তৈরি করে কখনও বা সবল শক্তি হয়ে উঠে কোথাও কখনও ক্ষমতাও দখল করতে সক্ষম হয়েছে এই সবটাই কিন্তু সম্ভবপর হচ্ছে বা হয়েছে সংসদীয় রাজনীতির চত্বরেই। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্ব জুড়েই সংসদীয় ব্যবস্থা দেশে দেশে কায়েম হয়েছে বা পোক্ত হয়ে উঠেছে এবং এক সময়ে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তি অর্জনে বিশ্বাসী শক্তিরাও, নানা ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ক্রম আস্থা গড়ে ওঠার কারণে, ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই ক্ষমতা দখলের সম্ভাব্যতাকে বাস্তবোচিত বলে মনে করেছে। এ অবশ্যই এক প্যারাডাইম শিফট। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বা বাস্তবতা তার অভিঘাতের অনুশীলনে রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েও কতকটা এগোতে পারে। হয়তো, এমন এক সম্ভাব্যতাকে অনুমান করেই এঙ্গেলস মনে করেছিলেন, ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণি শান্তিপূর্ণ বা সংসদীয় পথেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে।

এই পরিবর্তনকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সর্বাগ্রে এই কথাটি বলা যেতেই পারে যে, সংসদীয় ব্যবস্থাটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে ‘মন্দের ভাল’ অর্থে আস্থাশীল হয়ে ওঠার কারণে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলির পরস্পরের কাছে নির্বাচনে জিতে আসাটা একটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, নির্বাচনে জনগণের স্রেফ আস্থা অর্জনের লক্ষ্যেই তাদের বাধ্যত নানাবিধ জনমুখি কার্যসূচির কথা বলতেই হয়। আর এই আস্থা অর্জনের প্রশ্নটি শুধুমাত্র জাতীয় স্তরে নীতি নির্ধারণের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্র স্বভাবতই জনগণের আকাঙ্ক্ষাস্বরূপ আরও বিকেন্দ্রিকৃত হয়ে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থাতেও (শহর-গ্রামের পঞ্চায়েত-পৌরসভা) প্রসারিত হয়েছে। ফলে, মানুষের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া, জীবনযাপন, সুবিধা-অসুবিধা সবই এই সংসদীয় ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে একে এমন এক সর্বজনীন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছে যে শাঁখের করাতের মতো যে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে না থাকে এর কবল থেকে বেরবার কোনও রাস্তা, না থাকে এর মধ্যে একচ্ছত্র হয়ে থেকে যাওয়ার উপায়। অতএব, মানুষের সার্বিক মঙ্গলচিন্তার দ্যোতক হয়েই (অন্তত লোক প্রদর্শনের আলোকেও) রাজনৈতিক দলগুলিকে এই পরিসরে কাজ করে যেতে হয়।

কমিউনিস্টদের বিড়ম্বনা!?

এই একই পরিপ্রেক্ষিতে নানাবিধ বাম ও কমিউনিস্ট দলগুলিকেও এমনই এক ক্রমউত্থিত সংসদীয় গণতন্ত্রের আধারেই শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবাহী রাজনৈতিক অনুশীলনকে চালিয়ে যেতে হয়। মার্কস-লেনিন-মাও’এর সময়কার রাজনৈতিক অনুশীলন থেকে কমিউনিস্টদের পক্ষে এ প্রকৃত অর্থেই ভিন্ন ও অভিনব। আর এখানেই যত সমস্যা ও ঝঞ্ঝাটেরও সূত্রপাত। কারণ, আজ বিশ্ব বিপ্লবের কোনও কেন্দ্র নেই, আর মান্য তেমন কোনও নেতাকুলও নেই যাদের চিন্তা-প্রসূত এই নব-অনুশীলন উদ্ভুত সর্বজনমান্য তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে। বরং, ক্রমশই লক্ষণীয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোকে তথাকথিত সমাজতন্ত্রের বহু নিদান আজ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি গ্রহণ করছে ও প্রয়োগেও সেগুলির বাস্তবায়ন হচ্ছে বহু সময়েই তাই, বাম ও অ-বাম দলগুলির মধ্যকার বিভেদরেখা ক্রমেই ম্লান হয়ে আসে। কমিউনিস্ট দলগুলি বাম-প্রকোষ্ঠে থাকার কারণে তাদেরও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতায় বিশিষ্ট করে সব সময়ে খেয়ালে পড়ে না। এখানেই তাদের স্বকীয় হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জটি সুপ্ত হয়ে আছে। তবে হতে পারে, উপরে যে বিবর্তনমূলক সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছি, তার অভিমুখটাই হয়তো এমনতর। কারণ, দেখে মনে হতে পারে, অ-বাম দলগুলিরও বাম হয়ে ওঠার রাজনৈতিক বাসনা বেশ জোরালো। অতএব, সবটা মিলিয়ে, এক হযবরল পরিস্থিতি। সে আলোচনা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।

মোদ্দা কথায় বলার এই, বামপন্থা আজ নানা অর্থে, নানা আঙ্গিকে এক বৃহত্তর রূপ ও মর্মবস্তু অর্জন করেছে। যেহেতু, সনাতনী, সেকেলে ও স্বল্পসংখ্যক লোকের জন্য যে রাষ্ট্র ও সামাজিক বিধান, তার বিপক্ষে যারা মাঠেঘাটে, সংসদে সোচ্চার হয়েছে, আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তাদেরই বামপন্থী বলার একটা সর্বমান্য চল তৈরি হয়ে গিয়েছে; সেই আলোকে অনেক সময় অ-বাম বিরোধী শক্তি নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ও ক্ষমতা দখলের জন্য শক্তিবৃদ্ধির তাড়নায় বামপন্থী অবস্থানের কাছাকাছি সরে এসেছে অথবা বামপন্থার জনপ্রিয় কার্যসূচিগুলিকে আশ্রয় করেছে। এর মধ্যে অনৈতিকতা খোঁজার কিছু নেই। এ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলিকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধি হিসেবেই প্রাসঙ্গিক থাকতে হয়। অতএব, তাদের দিক বদল খুবই স্বাভাবিক, এই অর্থেও যে, তারা বৃহত্তর মানবসমাজের স্বার্থকে অগ্রাধিকারে রেখেই রাজনৈতিক অনুশীলনে ব্যাপ্ত আছেতা কতটা ভড়ং আর কতটাই বা আন্তরিক- এর বিচার করার দায় ভবিষ্যতের। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কথায় ও কাজে জনস্বার্থের পক্ষে আছে, ততক্ষণ তাদের আসল উদ্দেশ্য বিচার করার ভার কোন দেবতা নেবে? একইভাবে, কোনও স্বঘোষিত বাম দল যদি কথায়, শ্লোগানে বামপন্থার বড়াই করেও কাজেকর্মে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী অবস্থান নেয়, তবে তাদের সম্পর্কেও বলা যেতে পারে যে তারা বামপন্থা থেকে দূরে সরে গেছে ও বৃহত্তর মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তা সাময়িক বিচ্যুতি হতে পারে আবার দীর্ঘকালীন কোনও ব্যামোও হয়ে উঠতে পারে।

(চলবে ... )


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত ।

বামপন্থার সেকাল একাল

_____________________________________________________________

(প্রবন্ধটি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত এবং পর্বগুলি ঐক্যসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পড়তে গেলে খাপছাড়া ঠেকতে পারে। তাই পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি পর্বের লিংক প্রবন্ধের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ) 

______________________________________________________ 

তুমি কি কেবলই ছবি! (প্রথম পর্ব) 

লিখেছেন

অ নি ন্দ্য ভ ট্টা চা র্য

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত


বামপন্থার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। তবে এবারের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ১৯৪৬ সালের পর এই প্রথম বামপন্থীদের কোনও প্রতিনিধি বিধানসভায় থাকছে না। এই ঘটনাচক্রে বামপন্থা নিয়ে আলোচনা যে এক নতুন মোড় নেবে তা বলাই বাহুল্য। তবে সে আলোচনা উপেক্ষার ও বামপন্থার আর তেমন কোনও ভবিষ্যৎ নেই- এমত নির্বিশেষে এসে দাঁড়াবে নাকি বামপন্থার গোটা চিত্রপটটাই বদলে যেতে বসেছে তেমন কোনওদিকে মোড় নেবে, তা সময়ই বলতে পারবে।

বরং একটু ইতিহাস থেকে শুরু করা ভাল। এই প্রশ্নটি সকলকে নাড়া দেয় কিনা জানি না, তবে আমাকে তো বেশ খোঁচা দেয়। তা হল, মার্কস সাহেবের কোনও লেখায় ‘বামপন্থা’ শব্দটির কোনও উল্লেখ পাই না কেন! এমত নয় যে ‘বামপন্থা’ কথাটির তখনও চল হয়নি। দিব্যি হয়েছে এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর গঠিত সে সময়ের সংসদে স্পিকারের বাঁ দিকে বসা বিরোধী পক্ষের লোকজনেরা বেশ হৈ-হট্টগোল করতেন এবং সেই থেকেই বামাধারীরা সকলের নজর কেড়েছেন। এঁরা মূলত ফরাসি বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন এবং রাজতন্ত্র ও পুরনো ব্যবস্থার বিরোধিতা করতেন। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস প্রণীত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’এ (যা বাস্তব রাজনীতির একটি অনন্য রূপরেখা) নানা শক্তি সম্পর্কে বলা হলেও ‘বাম’ বলে কোনও রাজনৈতিক আধারের উল্লেখ নেই। পরে ১৯০৫ সালে রাশিয়ার সংসদ ‘ডুমা’ সম্পর্কিত একটি আলোচনায় লেনিন ‘বাম’ শব্দবন্ধটিকে স্পিকারের বাঁ দিকে বসা প্রতিবাদীদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, সার কথাটা হল, সংসদে বিরোধীরা স্পিকারের বাঁ দিকে বসতেন এবং তাঁদের উত্থাপিত বাক্যবাণগুলিকে পত্র-পত্রিকায় সবিশেষ উল্লেখ করার কতকটা সুবিধার্থেই তাঁদের ওই অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল। কিন্তু সংসদের বাইরে এই সমস্ত সাংসদদের যেহেতু নানারকম রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচিতি থাকত আর সে সময়ে সংসদের নানান সীমাবদ্ধতার কারণে সংসদ-বহির্ভূত রাজনৈতিক আসরটিই ছিল উচ্চকিত ও নির্ধারক, তাই সংসদ-অনুষঙ্গ বিনা ‘বাম’ কথাটি আলাদা করে উনিশ শতক ও বাম শতকের গোড়ায় তেমন প্রাধান্য পায়নি। সে সময়ে বরং কমিউনিস্ট ব্যতীত সমাজতান্ত্রিক, নারোদনিক, নৈরাজ্যবাদী, চার্টিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক- এই সমস্ত ও আরও বহু বিচিত্র অভিধায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা অন্যান্য মতাবলম্বীদের নামকরণ করার চল ছিল। দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী শব্দবন্ধের অতি সক্রিয় আবির্ভাব মূলত বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে যখন ইউরোপে সংসদীয় গণতন্ত্র আরও প্রসারিত হচ্ছে এবং কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বিপ্লবীদের লড়াই সংসদের বাইরে থেকে সংসদের ভেতরেও প্রসার পাচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয় ১৯১৮ সালে লেনিন লিখিত এই বইটির কথা: ‘বামপন্থী কমিউনিজম- একটি শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’। খেয়াল করে দেখুন, লেনিন কিন্তু ‘অতি বাম’ বা ‘মৃদু বাম’কে দুষছেন না, তিনি ‘বামপন্থী কমিউনিজম’কেই শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা বলছেন। এই বইটি তিনি লিখেছিলেন জার্মানির কমিউনিস্টদের উদ্দেশ্যে, যেখানে তাঁদের সে সময়কার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে তাঁর ‘শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ বলে মনে হয়েছিল। সে সব নিয়ে লেনিনের সঙ্গে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী রোজা লুক্সেমবার্গের বিতর্কও সুবিদিত। কিন্তু আমার বলার কথা এই, মার্কস ও লেনিনের কালে কমিউনিস্ট আর বামপন্থা একই প্রকোষ্ঠের অন্তর্বস্তু ছিল না। বরং, সমাজতান্ত্রিকদের থেকেও কমিউনিস্টদের আলাদা করে ভাবা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতাহার’এর কোনও একটি সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস পরিষ্কার ভাবে জানিয়েছিলেন যে কেন তিনি এবং মার্কস খুবই সুচিন্তিত ভাবে নিজেদের ‘সমাজতান্ত্রিক’ না ভেবে ‘কমিউনিস্ট’ ভাবতে বেশি পছন্দ করেছিলেন।

এই কথাগুলো না বলে নিলে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বামপন্থা নিয়ে আলোচনাগুলি কোনও সদর্থক দিকে গড়াবে না। কারণ, বামপন্থার সঙ্গে কমিউনিজমের যেন এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে বলে অনুমান করে নেওয়া হয়। এই অতিকথাটি আমাদের প্রথমে ভাঙ্গা দরকার।

যার যে পথ

সোভিয়েত বিপ্লবের পর ইউরোপ ও আমেরিকায় যে উত্তাল শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ ওঠে তাতে ক্ষমতাধারীরা অনেকেই সচকিত হয়ে যান এই ভেবে যে কমিউনিস্টরা বোধহয় এবার নানান দেশে ক্ষমতা দখল করে ফেলবে। তাই, শ্রমিক আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন নামিয়ে আনার পাশাপাশি এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলি নিজ নিজ সংসদ ব্যবস্থাকেও পাকাপোক্ত করে তোলে, জনগণের ভোটাধিকারের অধিকারকে সম্প্রসারিত করে ও জনকল্যাণে কিছু আইন প্রণয়নের পথেও এগোয়। কিছুটা আশ্চর্যের হলেও ঘটনা ছিল এই যে, বৃটেন ও জার্মানিতে মহিলারা ভোটাধিকার পায় ১৯১৮ সালে, অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডে ১৯১৯ সালে এবং গণতন্ত্রের স্বধ্বজাধারী আমেরিকায় ১৯২০ সালে। আর যে দেশটি ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’র ঝাণ্ডা তুলে অষ্টাদশ শতকে প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লবটি সম্পন্ন করেছিল, সেই উদার মনের দেশ ফ্রান্সে মাত্র ১৯৪৪ সালে মহিলারা সর্বজনীন ভোটাধিকার পায়।

এরই সঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার অর্জনের লড়াইও ছিল খুবই কঠিন ও কঠোর। ২০০০ সালে এসে তবে ফ্রান্সের শ্রমিকেরা সপ্তাহে ৩৫ ঘন্টার কাজের অধিকার আদায় করতে পেরেছেন। শুধুমাত্র কমিউনিস্টরা নয়, উনিশ ও বিশ শতকের গোটা কাল ধরে অন্যান্য সংস্কারবাদী ও রাজনৈতিক মতালম্বীদের সংগঠনগুলিও শ্রমিকশ্রেণির দাবি আদায়ে সচেষ্ট থেকেছে। যেমন, শ্রমিক আন্দোলনের উর্বর ভূমি বৃটেনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী ও নানান ট্রেড ইউনিয়নের মিলিত উদ্যোগে ১৯০০ সালে গড়ে ওঠে ‘লেবর পার্টি’। এই লেবর পার্টি ১৯২৪ সালে প্রথম বৃটেনে নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা দখল করে এবং কালপ্রবাহে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ সালে তাদেরই আমলে কয়লা শিল্পে মজুরি বাড়ানো হয়। এই সময়ে কিন্তু বারবার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শ্রমিক আন্দোলনের শক্তিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে বৃটেন কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতা দখলের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা পেরে ওঠেনি বা সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, লেবর পার্টি’র সংসদীয় রাজনীতির অনুশীলন সমাজে এমন একটা প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ তাদের পছন্দের দলকে ক্ষমতায় আসীন করতে পারে- এমনতর একটা বিশ্বাস সমাজের বৃহদাংশে জারিত হয়েছিল। অর্থাৎ, সোভিয়েত বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ইউরোপে সংসদীয় রাজনীতি বেশ সবল হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক বদলের সম্ভাবনা অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে সাব্যস্ত হয়। এছাড়াও, আরও নানা ধরনের আন্দোলন সমাজে বিকাশ লাভ করতে থাকে।

এইরকম এই প্রেক্ষাপটেই, যখন সংসদীয় রাজনীতির জোর বেশ বাড়ছে ও সংসদের অভ্যন্তরে নানারকম বাদ-বিতণ্ডা হচ্ছে, তখন মূলত মিডিয়ার দৌলতে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী শব্দবন্ধটি আবারও জনপ্রিয়তা পায়। বামপন্থা অর্থে ধরে নেওয়া হয়, যারা প্রতিবাদী, গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের পক্ষে, তারা সেইসব বিবিধ দাবিদাওয়া ও অসুবিধাগুলিকে রাজনৈতিক ধর্তব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। যেমন, পরবর্তীকালে নারী ও পরিবেশ আন্দোলনও বামপন্থার মধ্যকার প্রবণতা বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সোজা কথায়, বামপন্থা অর্থে সরাসরি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বোঝায় না, এমন একটি বৃহত্তর পরিধিকে ইঙ্গিত করে যেখানে সমাজের শ্রমজীবী মানুষ ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করার পক্ষে মন্থন চলে। তাই, বহু বিরোধী দলও (যারা এক সময় হয়তো শাসক ছিল) নানা সময়ে ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে বামপন্থী সুলভ কথাবার্তাও বলে। সে অর্থে, শুধুমাত্র দলগুলির চেহারা-পতাকা দেখে বামপন্থার সীমারেখা টানাটা যথার্থ হবে না; বরং বামপন্থার এমন একটা পরিসর আমাদের ভাবনা জগতে গড়ে উঠেছে যে সেই পরিসরে কখনও কখনও কোনও ‘অবাঞ্ছিত’ দলও ঢুকে পড়তে পারে। তা বামপন্থার গরিমা বই অন্য কিছু নয়। তবে বামপন্থার অনুষঙ্গগুলি ধারণ করল মানেই যে সে দল যথেষ্ট গণতান্ত্রিক ও উদারচেতা হয়ে উঠল, তা নাও হতে পারে।

যেমন, আমাদের দেশে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারী করে যে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করেছিল, তার পিছনে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এ দেশের সিপিআই দলের মদত ও সমর্থন ছিল। উল্টোদিকে সিপিএম ও অন্যান্য বাম দলগুলি তার বিরোধিতা করে। এমনকি, নিজেকে বাম প্রমাণ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সমাজতান্ত্রিক’ অভিধাটি যুক্ত করেছিলেন। তার মানেই কি আমাদের দেশ একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠেছিল ও তার যাত্রাপথ বামপন্থার আধারে নির্ণীত ছিল? সে সময়ে তাঁর নানাবিধ কাজকর্ম কিন্তু বৃহত্তর জনগণের অনুমোদন পায়নি। ১৯৭৭ সালে জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়েছিল। স্পষ্টতই, শুধুমাত্র ঘোষণায় নিজেকে বাম বা সমাজতান্ত্রিক বলার মধ্যেই মুশকিল আসানের হদিশ নেই। তাই, নামকরণের থেকেও কাজের হদিশ নেওয়াটা অনেক বেশি দস্তুর। তবে প্রচলিত প্রথায়, নামের কিছু মাহাত্ম্য থাকে। কথায় বলে, চেনা বামুনের পৈতে লাগে না! পৈতে গলায় জড়িয়ে যিনি ভুল পুজো করেন, তাঁর থেকে তো পৈতেহীন যিনি যথাযথ পুজোটা করতে পারেন, তিনিই বেশি গ্রহণযোগ্য।

(চলবে ... )


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত ।

Friday, May 21, 2021

নাসেরের কবিতার স্বাদ-আস্বাদন

 লিখেছে

উ জ্জ্ব ল  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য় 

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত

যে-লেখা প্রকাশিত হয় তা সকলের জন্যে তার গোপনীয়তা থাকে না আর তা পাঠ করে যে-ভাবনা দানা বাঁধে তার আনন্দ একা-একা ভোগ না করে অংশভাগের ইচ্ছাটাও কোনো ধৃষ্টতা নয় সে-কারণে গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো করার মতোই নাসেরের কবিতায় এই নাসের বন্দনা পাঠকের মনোযোগ পেলে বাধিত হব

ডাক

খুব সহজ-সরল করে, খুব পরিচিত শব্দবন্ধে কবি নাসের প্রকাশ করেছেন কাব্যিক ব্যঞ্জনা আসলে কবিতার শব্দবন্ধ যাই হোক না কেন, বাক্যবন্ধে যতই চমক থাকুক না কেন, নির্মাণ বা গঠনগত বৈচিত্রে যতই মুনশিয়ানা থাকুক না কেন, তার আবেদন অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে সেই দুর্লভ বিষয়টি হলো তার ব্যঞ্জনা দুর্লভ বলছি এই কারণেই যে ব্যঞ্জনা তৈরি করা যায় না - তা ব্যঞ্জিত হয় তাই তার সহজলভ্যতা নেই এখানে কবি পশ্চিমাকাশের অস্তমিত সূর্যের বিদায়লগ্নটিকে ধরতে চেয়েছেন খুব স্বল্প পরিসরে সে কেবল একটি সূর্যাস্তের বর্ণনা নয় যেখানে অস্ত-আসন্ন সূর্য ও পশ্চিমাকাশের লালিমা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয়ে হয়ে থাকছে না নিসর্গ থেকে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠতেই মানব জীবনের সর্বজনীন লীন-বেদনা কেমন সুন্দরভাবে ব্যক্তিক চেহারায় নৈর্ব্যক্তিলাভ করল, ‘এইবার কষ্ট শুরু হল প্রকৃত সে-কষ্টটা কীসের? কষ্ট ঠিক নয় - সারাদিনের ব্যস্ততার অবকাশে দেখা হয়নি যে-সব চিঠি তাদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখন গুরুত্ব মাফিক দরকারি হয়ে উঠবে, অথবা অদরকারি বলে তাকে ছিঁড়ে ফেলা হবে প্রস্রবণ যেন জলীয়বাষ্প অথবা অশ্রুর সমার্থক যা উষ্ণতায় ভরে ওঠে না, কৃতজ্ঞতা আরও আর্দ্র হয়তা উষ্ণতায় উবে যায় - বাষ্পীয় হয় এক ধরনের বেদনাবোধ, শূন্যতা, এক ধরনের মেলানকলি সময় এখানে কিছু জ্ঞাপন করে প্রত্যক্ষতসময়জ্ঞাপক ঘড়ির অস্তিত্ব দিয়ে ভালোবাসা-প্রেম-বিরহ খুব নতুন শব্দ নয় তাও তার ব্যবহারে কবি বেশ সপ্রতিভ ঘড়ি কি ভালবাসার তড়িঘড়ি দ্রুততার পরিমাপক শব্দ? হতে পারে তবু তার ব্যাখ্যা নিয়ে কবিতার বোধে কোন অসুবিধা ঘটায় না আর কবির সেই ভালবাসার গভীর প্যাশন আক্রোশ হয়ে ধরা পড়ে, যদিও আক্রোশ এখানে পাঠকের অপছন্দের শব্দ হতেও পারে কবির মনোগত শবব্যবচ্ছেদ এই অংশটিকে ইন্দ্রিয়ঘন, শরীরী করে তুলেছে মুহূর্তের নিসর্গ - চলে যাওয়ার শেষ যন্ত্রণাটুকু যেন টেনে বের করে আনল কবির মনোজগতের ক্যানভাসে লেগে গেল বিদায়ের বিষন্ন রঙ প্রতিদিন ওই একই বিদায়-বিষন্নতা, প্রতিদিন ওই একই চলে যাওয়া, প্রতিদিনই স্মরণের, মরণের নির্বাচনী রুটিন ব্যস্ততা কবির ব্যক্তিক অনুভূতি এখানেই যেন পাঠকের হৃদয়ে বিদায়-রাগের অনুভবি বিস্তার ঘটিয়ে দিয়েছে

সুসামঞ্জস্যময়

কবিতাটির প্রাথমিক পাঠ আমাকে অমিয় চক্রবর্তীর মেলাবেন তিনি, মেলাবেনকবিতার ভাবনায় টেনে নিয়ে গেল সেই দর্শনটি যেন অন্যভাবে পেলাম নাসেরের কবিতায় চারপাশের সবকিছুই যে মনোমতো হচ্ছে তা নয়, যা চাইছি তাই ঘটছে - তাও নয় একেবারে বেসুরেই যেন বাজছে তবু মৌলিক দর্শন বলছে যে সুরহীনতা বলে কিছু নেই যা আপাত বেসুরো তা আপাতই বটে যা সুরেলা নয় - তার থেকেই নতুন সুরের জন্ম হচ্ছে বলেই তা আর বেসুরো থাকল না সুর ছিল বলেই অন্য সুর জন্মায় এমন তো নয় - যে বেসুরোই সুর যাবতীয় বিশৃঙ্খলা, যাবতীয় অসুর-কুশ্রীতা, অসামঞ্জস্য বিপরীত প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক এক মহাসত্য এই কবিতায় নতুন করে উঠে এসেছে সংঘর্ষ বা বিরোধ থেকে যে-ক্ষয় তৈরি হয় তাই সঞ্চিত হতে-হতে আবার নতুন সৃষ্টিকে স্বাগত জানায় ধ্বংসটা শেষ কথা নয় তার ভেতরেই থাকে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ছে – ‘সৃষ্টির মনের কথা, মনে হয় দ্বেষ তাই অসামঞ্জস্য থাকবেই - তার ভেতর থেকেই উঠে আসবে নতুন সামঞ্জস্য রবীন্দ্রনাথও বলেছেনঃ শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্ন শেষ পরে, ওরা কাজ করে মনে পড়ে যাচ্ছে Thomas Hardy-এর কবিতা, ‘This will go onward the same, though dynasties pass’ অথবা ‘War’s annals will fade into the night, “Ere their story die”?’

নাসের তাঁর কবিতাকে গদ্যধর্মী করে রেখেছেননিছকই গদ্যিক অনেকটাই বিবৃতিমূলক যদি পরপর সাজানো যায় - ঠিক গদ্যরচনা যেভাবে সাজে ঠিক সেইভাবেই পদ্য রচনার দায় নিশ্চয়ই তাঁর নয় তবু এই কবিতাগুলো পড়ে, যে-কটি আমার হাতে এসেছে, আমার মনে হয়েছে যে অত্যন্ত গদ্যধর্মী তাঁর এই কবিতাগুলি তাই ক্লান্তিকর, বেশ ক্লান্তিকর দার্শনিকভাব, কাহিনিগতভাব নাসেরের কবিতায় অসম্ভব গুরুত্ব পায় প্রথাগতভাবে কবিতার স্নিগ্ধতা অলৌকিকত্ব তা এখানে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না জাহাজ কবিতায় সিন্ধবাদের কাহিনিটাই যেন পদ্যের বা কবিতার গাঠনিক কৌশলে সাজিয়ে পরিবেশন করা হল সেটা মুক্তগদ্যের ফরম্যাটে সাজালেই বা কী হত?

জাহাজ

জাহাজ যদি যদি কবিতা হয় (-বিষয়ে আমার কবিতার আলোচক হিসাবে কোন ব্যক্তিমত নেই - কেননা একজন লেখক কীভাবে তাঁর বক্তব্যকে উপস্থাপিত করবেন তা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় - কেবল মুদ্রিত অবস্থায় যখন তা সকল পাঠকের আস্বাদনের জন্যে উপস্থাপিত হবে তখন নানা অনুভূতির কথা তাঁকে শুনতে হবে) তাহলে সেই অলৌকিক ভাবনাটি আমরা খুঁজে খুঁজে পাবো না যা কিনা কবিতার কাঠামোয় একটা না-বলা বাণী পৌঁছে দেয় সিন্ধবাদ নাবিকের গল্প, দুর্ঘটনা, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত, সৌভাগ্য, ধনরত্নপ্রাপ্তি, প্রত্যাবর্তন - চোখের জল - আনন্দের মিলিত আবেগের মিশ্রণ গল্পটা আমাদের সকলেরই জানা আমরা কবিতা খুঁজছিলাম, গল্প নয় আসলে উনিশ শতক চলে যাবার পর আখ্যায়িকাকাব্য-মহাকাব্যের জগৎ শেষ করে দিয়েছিল গীতিকবিতা তারপর থেকেই ওই গীতিকবিতারই যুগ রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে জীবনানন্দে তার অন্য ঘনীভূত শরীর দেখল বাঙালি-পাঠক ছন্দটা কিন্তু হারালো না প্রবহমান যাপন হয়ে থেকে গেল অন্তর্লীন কাব্যিক ব্যঞ্জনা যে-কারণে মাটির শিল্পীদের পক্ষে আধুনিক গদ্য কবিতার আবৃত্তি সমানভাবেই জনপ্রিয় থেকে গেল কেবল তাকেও ভাঙার যে-প্রচেষ্টা শুরু হলো পাঁচের দশক থেকে - সেখানকার অহংকার যেন পড়তে পড়তে নাসেরে এসে বিবৃতি কবিতা হয়ে গেল এই কবিতায় কেবল অন্যের সমারোহ, ঘটনার ক্রমিক বিবরণ তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক কোনও অর্থেই কবিতা পেলাম না পদ্য পেলাম এর পাশাপাশি যখন আধুনিক কোন কাহিনিচিত্রে ততোধিক আধুনিক গান শুনছি, ‘এই জাহাজ মাস্তুল ছারখার, তবু গল্প লিখছি বাঁচবার’, যেখানেও ছন্দ পাচ্ছি - কোথাও যেন একটা দোলা অনুভব করছি জাহাজ নিয়ে নিতান্তই গদ্যধর্মী আলোচনায় আমি আলোচক হিসেবে একটু বিব্রত বোধ করছি

তিনি বলেছিলেন

কবিতা যখন জ্ঞানগর্ভবাণী প্রচার করে তখন তাকে কবিতা বলা যাবে কিনা এ-বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারলেও সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারব না ‘তিনি বলেছিলেন’ কবিতাটি সম্মাননীয় শ্রদ্ধেয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে কেন্দ্র করে লেখা ১২১ লাইনের কবিতা সাল ২০১৯, তারিখ ১৩ই নভেম্বর হল রচনাকাল সেখানে যে-উপদেশ দেওয়া হয়েছে, জীবনযাপন ও জীবনচর্চার যে-আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে, যে-সব আচরণীয় বা পালনীয় নীতি-নির্দেশ করা হয়েছে তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসভ্যতার আদর্শ কল্পনা তো এইসব নবী-মনীষীরাই করে গেছেন নাসের অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে নিছক কথোপকথনের ভঙ্গিতে তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের মত পার্থিব কামবাসনা ও মোহে অন্ধদের জন্যে এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয় স্বর্গ কোথায়? মায়ের চরণে সবচেয়ে পুণ্যস্থান কোনটি? মায়ের চরণ নারী সম্মাননীয়া নারী-পুরুষ পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের ভেতর দিয়েই সম্মানিত হবে প্রত্যেকেই অনন্ত সম্ভবনা নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে প্রত্যেকের ভেতরে আছে মহানুভবতা তারা সকলেই আপন-আপন ধর্ম পালন করবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহিষ্ণুতার ভাব বজায় রাখতে হবে দান-ধ্যান করতে হবে, ইন্দ্রিয়সংযম অনুশীলন করতে হবে, শৈথিল্য - তা চারিত্রিক হোক বা নৈতিক ত্যাগ করতে হবে। লোভ-লালসা কামনা-বাসনাকে দমন করতে হবে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা, আক্রোশ দূর করতে হবে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, জাতিদাঙ্গা ও ভ্রাতৃদাঙ্গা থেকে দূরে থাকতে হবে

এইভাবেই নাসিরের কবিতায় সেই পরম পুরুষ ও পরমগ্রন্থেরই সারাৎসার উঠে এসেছে একেবারে গদ্যে লেখা নিছকই ধর্মবাণী এখানে কাব্যের ব্যঞ্জনা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন এই কবিতা লেখার যে-গভীর প্রয়োজন কবির মধ্যে এসেছিল, সেই বোধটাই একে মানবপ্রেমের জীবনরসে জারিত করেছে এভাবে বললেই যেন সঠিক বলা হয় আমি বলতেও চাই সেইভাবেই আজ পৃথিবীতে মানুষে-মানুষে যে সম্পর্কের অবনতি, সংকীর্ণ জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের যে-লড়াই চলছে, বৃহৎ শক্তির দাবিদারিত্বে যে-অস্থিরতা তৈরি হয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে - মানবাধিকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, সেখানে উপদেশ কতটা কার্যকরী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে জানি, Preaching can do nothingতবু মানুষের সদর্থক প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করতে উপদেশ এর প্রয়োজন আছে এই কবিতায় নাসের সেই পরিত্রাণের বাণী পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কেননা কবিরা পরিত্রাতাদেরই একজন, পথপ্রদর্শক, আলোকদিশারী সত্যের বাণী তো অমৃতময় বটেই নবীর মানবিক জীবনভাবনা, তাঁর মৈত্রীভাবনা, বিশ্বমানবাত্মার মর্যাদা রক্ষার স্বপ্ন যেন কবির লেখনীর মধ্যে দিয়ে মানুষের হৃদয় সজ্ঞাত হচ্ছে শুভভাবনা, মাঙ্গলিকভাবনা যে মাধ্যমেই আসুক না কেন - তার পৃথক মূল্য আছে সেই মূল্যের বিচারে এ-কবিতাও তাই সচেতনতভাবে সার্থক

কবিতার সমালোচনা মানে কবির দোষত্রুটি বের করা নয় ছিদ্রান্বেষণ নয় অভিভাবকত্ব ফলানো নয় তার চেয়ে অনেক কাজের হল - তা সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে আলোচ্য ক্ষেত্রে কতদূর ব্যাকরণসম্মত বা কতটা উত্তীর্ন তা দেখা ও দেখানো পাঠক নিজে যা বোঝেন তার সঙ্গে যদি অন্য পাঠকের সমালোচনার উদ্দেশ্য বোঝেন, তাহলে তা একটু মিলিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই কবিতার পাঠ অর্থগত দিক থেকে সম্পূর্ণ হয় সেই চেষ্টাই করেছি তবু ভরিল না চিত্ত কবিতার যে-ন্যূনতম ব্যাকরণ সূত্রগুলি থাকে তা আমার পঠিত, যদিও শেষ রচনাটিতে তার তত পাইনি তবে তা আমারই দুর্ভাগ্য বটে পরবর্তীতে তাই আরও নাসের পাঠ করার ইচ্ছে থাকল

পুনশ্চঃ নাসেরের আরেকটি কবিতা নিয়ে দু-চার কথা

‘দেশ’-এর কবিতা সংকলন(১৯৮৩-২০০৭) ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলাম নাসের হোসেনের কবিতা ভারতবর্ষ’, একটি রূপকধর্মী কাহিনিপ্রবণ, সহজ-সরল কবিতা দুই ভবঘুরের গল্পটিতে নাটকীয় চমক আছে আছে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ-রসিকতা আছে রূপকথার আবেশ - যা নাসেরের কবিতায় প্রায় মুখর হয়ে ওঠে কবিতার বক্তা আমিসর্বনামধারী কবি ঘোষিত মুসলমান আর উদ্দিষ্টতুমিহিন্দু দুই ভবঘুরে বন্ধু এই বিষয়টাতে কোনো চমক নেই চমক আছে এই ঘোষনায় যে, আমি মুসলমান আর তুমি হিন্দু অথচআমিচেয়েছিল এই ভারতবর্ষে (যেখানে তারা ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিল) একটা মন্দির বানাতে আরতুমিচেয়েছিল মসজিদ যেন একটা বৈপরীত্য এনে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়

আমাদের চাওয়াটাই এমন উদ্ভট তারপর দুজনেই কাজের চাপে ভুলে গেল মন্দির-মসজিদের কথা আরও তো অনেক কিছুই করার ছিল তো সেগুলোতেই তারা মন দিল শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান-আলো-পানীয়জল-বিজ্ঞানপ্রযুক্তি, হ্যাঁ, সেই উন্নয়নের মহাযজ্ঞে ঝাঁপ দিল দুজন দুই ভবঘুরে মনুষ্যত্ব নীতি-আদর্শ বিবেক মানবিক মূল্যবোধে মানুষ এখন সেখানে পরিপূর্ণ মানুষ কুসংস্কার দূর হয়ে গেছে অপবিজ্ঞান, অধিজ্ঞান দূর হয়েছে, যুক্তিতর্ক বিচারে সিদ্ধান্ত গ্রহণপর্ব শুরু হয়েছে এখন আর নরক নেই, হয়েছে স্বর্গ এমন সময় দুজনেই গেল সেই জায়গায় যেখানে মুসলমান বানাতে চেয়েছিল মন্দির আর হিন্দু চেয়েছিল মসজিদ তো সেখানে গিয়ে দেখা গেলো -গিয়ে দেখি সেখানে চমৎকার হ্রদে কতরকমের হাঁস খেলে বেড়াচ্ছে/চারপাশের বাগানে কত যে পাখি/ পুরুষ নারী ও বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়/ জমে উঠেছে তুমুল পিকনিক

চমৎকার ফ্যান্টাসি ইউটোপিয়া সব পেয়েছির দেশ ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ/কোথায় গেলে পাবে কেহ ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ভারততীর্থকবিরা তো স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন স্বপ্ন দেখান কোটি কোটি নিরক্ষরদের যারা চালনা করে সেই রাজনীতি ও ধর্মব্যবসায়ীরা এই এক সদর্থক পাঠের মর্ম বোঝেনা কার্যত তারা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই পড়েন না পড়েন দু-চারজন সুশীল সমাজের সদস্য তাও তো আবার তাদের মতামত প্রভাবিত গোঁড়া, মৌলবাদীদের দল যা কিনা বুদ্ধিজীবীদেরও দল! এমনই উদ্ভট এই পরিকল্পনা মন্দির-মসজিদ বিতর্কে ওই দাবিদার বৈপরীত্য এমন যদি সত্যি হত, আহা! সত্যি হয় না, কিছুই সত্যি হয় না মূর্খদের আরও মূর্খ বানিয়ে এখানে মুষ্টিমেয় ধান্দাবাজরা আখের গোছায় সেই ফাঁদে পা দেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ

কাহিনির উপস্থাপনা, কল্পনা ও বিন্যাসটি চমৎকার এটাকে একটা অর্ধগল্প ভাবা যেতে পারে উদ্দেশ্যসূচকতা এর সর্বাঙ্গে তাকে চেপে রাখার কোনো ইচ্ছেও কবি দেখাননি মন্দির-মসজিদ নিয়ে অর্থহীন ঝগড়াকে অর্থবহ করে রেখে হাস্যকরভাবে দেশটাকে কয়েক দশক পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে - সেটাই কবি এখানে দেখাতে চেয়েছেন - অবশ্যই রূপকাশ্রিত একটি কাহিনির আড়ালে সদ্ভাবনা, সদর্থক কল্পনার একটি সার্থক প্রকাশ হিসাবে এটি শিক্ষনীয়ও বটে তবে ওই যে, Preaching can do nothing



পেশা আর নেশা যে-মানুষের একই সে নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই হিসাবে কেবল সুখী তা নয়, বরং সুখস্বর্গে তাঁর বাস। একদিকে পেশা ও নেশা যেমন শিক্ষকতা, তেমনই পক্ষান্তরে কবিতার নেশাও সমান্তরালে বজায় রেখেছেন আজীবন। বহু বিখ্যাত ছাত্রছাত্রীর ভবিষত্যের রূপকার যেমন তিনি, তেমনই কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মননেরও আত্মাকেও ধারণ করেছেন পাঠকসমাবেশে। লেখা ও বইপড়ার জীবনচর্যায় নিবিষ্ট এই কবি-মানুষটির প্রকাশিত বইগুলি হল - কবিতার বই(বিকেলের মুখ ভাসে নদীর জলে,তবু বেঁচে থাকে প্রেম, দুয়ারে তোমার প্রতিভাস,সত্তরের কবিতা,প্রিয়মুখ প্রিয় কবিতা) ও অণুগল্পের বই(পাঁচ মিনিটের গল্প,অণু গল্পের মুখগুলি)