Saturday, May 22, 2021

বামপন্থার সেকাল একাল

________________________________________________________________

(প্রবন্ধটি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত এবং পর্বগুলি ঐক্যসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি পড়তে গেলে খাপছাড়া ঠেকতে পারে। তাই পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি পর্বের লিংক প্রবন্ধের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ) 

_____________________________________________________


পশ্চিমবঙ্গের বিধি (তৃতীয় পর্ব) 

লিখেছেন

অ নি ন্দ্য ভ ট্টা চা র্য

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত


এমনতর এক আবহে আমরা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থা নিয়ে খানিক আলোচনা করতে পারি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ ব্যতিরেকে আর যে সমস্ত বাম দলগুলিকে আমরা এ রাজ্যে দেখতে পাই, তারা সকলেই কমিউনিস্ট আদর্শের অনুসারী। ফরওয়ার্ড ব্লক ছিল ঘোষিত ভাবে সমাজতন্ত্রের অনুসারী কিন্তু কখনই তারা মার্কসবাদ বা লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেনিএ ছাড়া বাকী দলগুলির প্রত্যেকটিই নানা ভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তাদের আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছে, যদিও স্টালিন ও মাও প্রসঙ্গে অনেকের নানাবিধ ওজর-আপত্তি বা অনুরাগ আছে।

এ ছাড়াও আমাদের দেশে রামমনোহর লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের নেতৃত্বে এক ধরনের ভারতীয় সমাজতন্ত্রের ঘরানা গড়ে উঠেছিল যেখানে মার্কস-লেনিন’কে আদর্শ হিসেবে মানা হয়নি কিন্তু সেই ঘরানা পশ্চিমবঙ্গে তেমন ভাবে দাগ কাটতে পারেনি। এ রাজ্যে বরং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের রকমফের কদর অনেক বেশি সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছিল। সিপিআই থেকে সিপিআইএমএল, আরএসপি থেকে এসইউসি(আই), মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আরসিপিআই- এমন বিবিধ মার্কসবাদী দলের কম বেশি শক্তির ওপর নির্ভর করেই স্বাধীন-উত্তর এ রাজ্যের বিরোধী ও শাসক রাজনীতির আবর্ত চলেছে। এই প্রথমবার ২০২১’এ এসে দেখা গেল, বাম-শূন্য এক বিধানসভা ও চলমান রাজনৈতিক সমাজে এমন এক শাসক ও প্রধান বিরোধী পক্ষ যাদের যথাক্রমে মধ্যপন্থী ও চরম দক্ষিণপন্থী বলে কেউ কেউ অভিহিত করছেন। আবারও বলি, নামে কী বা এসে যায়, কিন্তু অন্তত ঘোষিত ভাবে যারা নিজেদের বামপন্থী বলে, তারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে যে জনসমর্থনের কোন তলানিতে এসে তারা পৌঁছেছে। অতএব, প্রশ্ন হল, হচ্ছে টা কী?

এই লেখায় আগেই বলেছি, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ও সমাজ-অর্থনীতির বিকাশের সম্ভাব্যতার কথা। সে সম্ভাব্যতায় কঠিন-কঠোর স্টালিনপন্থী একটি দল সিপিএমের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বে বামফ্রন্ট এ রাজ্যে ৩৪ বছর একটানা সরকার চালাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম দিকে খানিক অসুবিধা ও আশঙ্কা থাকলেও বামফ্রন্ট সরকার ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে কখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি যে এই সরকারকে জোরজবরদস্তি ফেলে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ, দেখা গেল, বিবর্তনের ধর্মে একটি মার্কসবাদী দলকেও নির্বাচনে জিতে সরকার চালানোর সুযোগ দেওয়া সম্ভব এটা তাহলে কীসের বিবর্তন? কোথা থেকে কোথায় বিবর্তন হল? কেন এমনতর সম্ভব হল? একটি পুঁজিবাদী (অথবা আধা-পুঁজিবাদী) রাষ্ট্র কীভাবে ও কেনই বা একটি মার্কসবাদী দলকে নির্বাচনে জিতে সরকারে বসতে ও তা দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে সুযোগ দিল? তার কি এমন কোনও আশঙ্কা বা সন্দেহ ছিল না যে এই ধরনের দলের সরকার আরও ‘গোলযোগ’ সৃষ্টি করে পুঁজিবাদকেই হটিয়ে দিতে পারে অথবা পুঁজিবাদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে? সে আশঙ্কা যে ছিল না, তা নয়। ১৯৫৯ সালে সেই আশঙ্কা থেকেই কেরালার নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। চিলিতে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত আলেন্দে মন্ত্রীসভাকে সামরিক অভ্যুত্থান করে ১৯৭৩ সালে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্য একটা প্রবণতাও বেশ জোরালো ভাবে সচল ছিল। তা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘সামাজিক সুরক্ষা’র নিদান সহ সংসদীয় গণতন্ত্রের এক কল্যাণমূলক উদারবাদী আবহের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ যে পথকে ‘ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকস’ নাম দিয়ে নতুন পথে যাত্রা শুরু করল, সে পথে ‘ইনক্লুসিভিটি’ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বিষয়ক একটি শক্তিশালী উপাদান সুপ্ত ছিল। এই পথ নির্মিত হয়েছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক অংশগ্রহণে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনে উন্নয়নের চিহ্ন দেখে। তাই, সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রের যে সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত, তা পুঁজিবাদী দেশে একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে হলেও গ্রাহ্য হল।

পাশাপাশি, ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫০ বছর অতিক্রান্ত করেও একটি একদলীয়, একনায়কতন্ত্রী ও গণতন্ত্রহীন ব্যবস্থা হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে প্রদর্শিত হচ্ছিল। বিপ্রতীপে, ইউরোপ ও অন্যান্য সদ্য স্বাধীন দেশে বহুদলীয় নির্বাচনমূলক ব্যবস্থায় জনগণের দাবি-দাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলি যেন একটি সেফটি-ভাল্ব’এর মতো বহু কিছু আদায়ের পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে উঠল। অন্তত চৈতন্যের জগতে এমন একটা প্রভাব নিশ্চয়ই কাজ করল যে, শুধু খাওয়া-পরার নিশ্চিন্তিই বড় কথা নয়, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন চলাচল, মতামত ও শাসককে বদলে দেবার ক্ষমতা (ভোটাধিকার)- এগুলোও বেঁচে থাকার পরম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমি মনে করি, এখানেই কমিউনিস্টরা রাজনৈতিক ভাবে হেরে গেল। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অনুশীলনে বাস্তবিক তারা ব্যর্থ হলগোড়ার দিকে বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্বের বিপরীতে তাদের শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই যখন পরবর্তী কালে বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সমাজতান্ত্রিক (বা শ্রমজীবী মানুষের) গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করার লড়াইয়ে পর্যবসিত হল, তখন কার্যত তারা নতুন ও উন্নততর কোনও সূত্রায়ন বা অনুশীলনে পৌঁছতে পারল না আশ্চর্যের হলেও, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বলেও তেমন কিছু ছিল না।

অর্থাৎ, কিঞ্চিৎ মজার হলেও বিবর্তনটা হল এমনতর যে, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অনুশীলনের সদর্থক দিকগুলিকে পুঁজিবাদী দুনিয়া নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে আরও পোক্ত করার স্বার্থে গ্রহণ করল। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তারই অঙ্গ ছিল। তাই পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আর এইভাবে সমাজতন্ত্রের অনুষঙ্গগুলিকে অঙ্গে নিয়ে পুঁজিবাদের যে বিবর্তন তাতে সে প্রথম প্রথম ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবের’ ভয়ে খানিক আশঙ্কিত থাকলেও পরে আর তেমন বড় করে ভয় পায়নি কারণ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র বহু মানুষের কাছে তার যাথার্থ্য প্রমাণে এতদূর এগিয়ে গেছে যে ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ সে তুলনায় একেবারেই প্রায় অস্তিত্বহীন ও পশ্চাদপদ একটি সত্তা হিসেবে বিরাজমান থেকেছে। তাই, এ আস্থা পুঁজিবাদের অল্প হলেও ছিল (পরে আরও বিধৃত হয়েছে) যে, নির্বাচনের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলেও তারা সংসদীয় ব্যবস্থার পরিসীমা ডিঙোতে পারবে না। কারণ, সে ডিঙোবার জন্য তাদের কাছে যথার্থ বা আরও উন্নত কোনও গণতান্ত্রিক কারুকৌশল নেই যার আদর্শ ও আকর্ষণে ব্যাপক মানুষ অমন কোনও ব্যবস্থার দিকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যেতে চাইবে। যা আছে, তা দিয়ে অল্প কয়েক দিনের জন্য খুব সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতির উদয় হলে জোর লড়াই দেওয়া যেতে পারে বড়জোর।

এই যে এইভাবে সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলি পুঁজিবাদের গহ্বরে অন্তর্লীন হয়ে গেল, তা এমন এক বাস্তবতা নির্মাণ করল যে কমিউনিস্ট নামধারী অথবা কার্যসূচি বহনকারী যে কোনও রাজনৈতিক শক্তি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দিনাতিপাত করতে পারে। আর কমিউনিস্ট শক্তি যেহেতু একটি দেশে একটি মাত্র পার্টিতেই সংগঠিত নয়, বহু ধরনের পার্টিতে তারা বহুতর, অতএব, এই গোটা শক্তিটা যখন কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় এক জায়গায় এসে জড়ো হয়, সঙ্গে আরও প্রতিবাদী শক্তি বা পার্টিকে পাশে পায়- তখন এই গোটা মহলটাকেই এক কথায় ‘বামপন্থী’ বলে সাব্যস্ত করা হয়। হতে পারে, এই সমগ্র শক্তিটা কোনও কোনও দেশের বা কোনও অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক কাজের নিরিখে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় বা জাতীয় ক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু ক্ষমতা দখল করে তারা কি আমূল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পথে এগোতে পারে? এই প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত। এখন পর্যন্ত যে কটি দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে আমূল পরিবর্তনের পথে এগিয়েছে, সেইগুলি কিন্তু বহু পুরাতন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জিত (যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি)। অবশ্য, সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন করে পুঁজিবাদের পথেই আবার হাঁটতে শুরু করার অভিযোগ কিন্তু এই দেশগুলির বিরুদ্ধে আছে।

তাহলে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে পরপর সাতবার নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসা বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুতির এত অল্প সময়ে জনপ্রতিনিধিত্বের গুনিতকে একেবারে শূন্যে নেমে গেল কেন? এ রাজ্যে বামপন্থার ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ বা নব-উত্থান বলতে কি সেই সিপিএমেরই গোয়ালে আবার ফিরে যাওয়া বোঝাবে? এই প্রশ্নগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বসে বামপন্থীরা যেমন তাদের শক্তি সঞ্চয় করে, আবার দুর্বলও হয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, ফ্রান্স ও আরও কিছু দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রনায়কেরা ও পুঁজিপতি শ্রেণি কমিউনিস্ট বিপ্লবের শঙ্কায় এতদূর পর্যন্ত ভীত ছিল যে আমেরিকা চার্লি চ্যাপলিনের মতো প্রতিভাধরকে শুধুমাত্র ‘কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন’ অভিযোগে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। সেইসব দেশে কমিউনিস্টরা আক্ষরিক অর্থেই জনসমর্থনের ভিত্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং যে কোনও সময়ে ক্ষমতা দখলের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। ইতিহাস অবশ্য সে পথে হাঁটেনি।

পশ্চিমবঙ্গেও ৬০’এর দশক থেকেই বামপন্থীরা প্রবল ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনে উত্তরোত্তর তাদের সমর্থন ও সাফল্য আসতে থাকে। ১৯৭৭ সালে এই সমর্থন একটি কার্যকরী রূপ পায় এবং তারা ক্ষমতায় আসীন হয়ে কিছু যুগান্তকারী কর্মসূচিও রূপায়ন করে (যেমন অপারেশন বর্গা, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি)। এর আগে ৬০’এর দশকের শেষে ও সত্তর দশকের গোড়ায় নকশালপন্থী (সিপিএম থেকে ভেঙে আসা ও সিপিআইএমএল নামে সংগঠিত হওয়া) কমিউনিস্টরা নির্বাচন ও সংসদীয় পথকে বর্জন করে সশস্ত্র বিপ্লবের (‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন’) ডাক দেয়। সারা দেশ জুড়ে এক ব্যাপক আলোড়ন ওঠে। কিন্তু প্রস্তুতির অভাব ও নানান রাজনৈতিক কারণে সেই বিপ্লবের আহ্বান ১৯৭২ সালেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শীর্ষ নেতৃত্বের মৃত্যু ও দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় তাদের অবশিষ্ট কর্মীরা নানা গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নতুন ভাবে কাজকর্ম শুরু করে। এই ধারা এখনও বহমান আছে, যদিও তাদের অধিকাংশই এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের অংশভাক হয়েই নিজেদের কর্তব্যকর্ম চালাচ্ছে। তাহলে তারাও কি উপলব্ধি করেছে যে সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন এক ভার ও গ্রহণযোগ্যতা দেশের মাটিতে তৈরি হয়েছে যে তাকে অস্বীকার করার কোনও জো নেই? এতে অসুবিধার কিছু নেই। বাস্তবতা হল, সংসদীয় রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ নানা ভাবে এতটাই সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন যে একে বাদ দিয়ে আজ ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক কর্তব্যকর্মই সমাধা হতে পারে না। সে পথে কীভাবে, কতটা এগোলে বামপন্থীদের পক্ষে রাজ্য বা জাতীয় স্তরে সাফল্য আসতে পারে সে অন্য আলোচনার বিষয়। তা ব্যতীত, বস্তুগত পরিস্থিতির আনুকূল্যের জন্য অপেক্ষা করতে জানতে হয়।

যে কথা এই লেখায় হয়তো ঘুরে ফিরে কয়েকবার উল্লেখ করেছি, সংসদীয় ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ একদিকে যেমন চাইবে তার মতো করে তার বিরুদ্ধ শক্তিগুলিকে আত্মসাৎ করে নিতে, একইভাবে অন্যদিকে পুঁজিবাদ বিরোধী শক্তিরাও চাইবে পুঁজিবাদ সংকটাগ্রস্ত হয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথকে উন্মুক্ত করে দিক। কিন্তু বিবর্তনের নিয়মে সম্ভবত তেমন সোজাসুজি- হয় এটা নয় সেটা- কোনও পথ আজ আর নেই। বলতে চাইছি, পুঁজিবাদও তার সংকটের (বারবার সে সংকটে পড়ে) উপায় হিসেবে বামপন্থাকে যতটা সম্ভব ধারণ করতে অপটু নয়। অর্থাৎ, প্রয়োজন পড়লে বামপন্থার বহু কিছুকে আত্মস্থ করে পুঁজিবাদ তার প্রাণবায়ুকে সচল রাখবে। ফলে, উল্টো পথে এমনও ঘটা অস্বাভাবিক নয় যে বামপন্থী কোনও শক্তি নিজেদের রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ধরে রাখতে পুঁজিবাদের বাতিল হয়ে যাওয়া উপাদানগুলিকেও ফিরিয়ে আনতে উদ্গ্রীব। এ রাজ্যে সিপিএম ও বামফ্রন্টের শরিকদের দীর্ঘকাল ক্ষমতা ভোগের কারণে কতকটা তেমন দশাই হয়েছে। আর মূলত সে কারণেই তাদের ভোটের জনসমর্থন আজ ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাশাপাশি, এই সরল কথাটাও তারা বুঝল না যে, পুঁজিবাদের বাতিল হয়ে যাওয়া অনুশীলনকে তারা যখন নির্মম ভাবে ধরতে চাইছে, তখন খুব স্বাভাবিক পুঁজিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কোনও শক্তি নতুন পথে এগোনোর চেষ্টা করে পুঁজিবাদকে প্রাণবায়ু দেবে।

বলার এই, যা সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনেও বোঝা গেল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ও আন্দোলন থেকে সিপিএম কোনও শিক্ষাই নেয়নি। এই শতকের প্রথম দশকে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া যখন উত্তুঙ্গে এবং পুঁজি পাগলের মতো নিজেকে স্ফীতকায় করার বাসনায় নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন স্বভাবতই তা পুঁজির বাজারের ফাটকা কারবারে ও আরও নানাবিধ এমন সব কাজেকর্মে অতি সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়বে যেখান থেকে সম্পদ ও তাৎক্ষণিক মুনাফা খুব দ্রুত হস্তগত হতে পারে। তেমনই একটি ক্ষেত্র ছিল জল-জঙ্গল-জমি অধিগ্রহণ করে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও তৎপ্রসূত অতি-মুনাফার বাণিজ্য করা। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কর্পোরেটরা শিল্পের নামে বিশাল জমি অতি স্বল্পমূল্যে সরকারি সাহায্যে বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে তা বেশ কয়েক বছর ফেলে রেখে হয় সেখানে আবাসন গড়েছে বা চড়া দামে আবার হাতবদল করেছে। সে এক বিশদ কাহিনি। আর সে কাহিনিরই অংশ ছিল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে শিল্প গড়ার নাম করে জোরজবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ করে হাজার হাজার কর্মযুক্ত মানুষকে উচ্ছেদ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। আর তা হচ্ছিল দীর্ঘকাল এ রাজ্যে অধিষ্ঠিত বামফ্রন্টেরই হাত ধরে বামপন্থার নাম করেই।

২০০৬ সালের ২৫ মে টাটার এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে সরকারি আধিকারিকরা যখন চুপিসারে দুপুরবেলা সিঙ্গুরে জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন খবর পেয়ে কৃষক রমণীরা হাতে ঝাঁটা-খুন্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসে সে দলকে তাড়িয়েছিলেন। সে খবর চাউড় হতেই অসুস্থ জ্যোতি বসু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওখানে কৃষক সভাকে না জানিয়ে টাটার দল গেল কেন? প্রশ্নটি খুবই অর্থপূর্ণ। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, একটি বামপন্থী দলের স্থানীয় কৃষক সংগঠনের অজান্তেই কৃষিজমি সম্পর্কে নতুন কোনও প্রস্তাবের রূপরেখা কেন ভাবা হয়েছিল? এই মত স্পষ্টতই, একটি বামপন্থী দলের স্বাভাবিক গণভিত্তি যে কৃষক সমাজ, তার গুরুত্বের কথা অনুধাবন করতে বলে। কিন্তু পুঁজিবাদের মায়ামোহে তদানীন্তন বামফ্রন্টের নেতারা এতটাই মশগুল যে নিজ পার্টির শ্রেণি ভিত্তি বা কর্তব্যকর্ম তাঁরা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। এর পরের ঘটনাবলী আমরা জানি।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সারা রাজ্য জুড়ে এক তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে আন্দোলনের ভাষা তাঁরা পড়ে উঠতে পারেননি। বিরোধী দলনেত্রী তাঁর সংসদীয় রাজনীতির কারুকৌশলে অচিরেই এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকায় চলে আসেন এবং ২০১১ সালের নির্বাচনের রায়ে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘকালীন সরকারের পতন ঘটে। বামফ্রন্ট বহির্ভূত অন্যান্য বামপন্থী শক্তি এই আন্দোলনে থাকলেও তাদের নানা ধরনের জড়তা ও মতান্ধ চিন্তাভাবনা থাকার ফলে তারা এই আন্দোলনের দায়ভাগকে শেষাবধি বহন করতে ব্যর্থ হয়এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের এক অবিমৃশ্যকারী আচরণ।

মুশকিল হল, বামফ্রন্ট বা সিপিএমের তরফে এই বিচ্যুতিটা তারা আজও বুঝে উঠে পারল না। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের প্রার্থী সিঙ্গুরে গিয়ে ‘শিল্পের শিলন্যাস’ করে এলেন। আর ভোটের ফলাফলে আবারও তাদের ভরাডুবি হল। সচ্ছল মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে বামপন্থাকে দেখার যে ভয়ঙ্কর পরিণাম, তা তাদের কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে হল। তবুও তাদের হুঁশ নেই। শ্রেণি আন্দোলন থেকে বিচ্যুত তাদের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব নিঃশব্দে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে ফেলেছেন যে! তাঁরা ভাবলেন, একরের পর একর জমি পেয়ে কর্পোরেটরা এসে সুবোধ বালকের মতো শিল্প গড়ে তুলবে আর সেই শিল্পে রাজ্যের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে! কী বিপদ! সাধারণ খবর রাখা একজন সচেতন মানুষও জানেন যে, প্রথমত, সস্তায় জমি পেয়ে কর্পোরেটরা যে সেখানে শিল্প গড়ে তুলবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই (এ হল বিগ মিডিয়া নির্মিত একটি মিথ); দ্বিতীয়ত, যদিও বা সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে তা হবে এতটাই অত্যাধুনিক যে সেখানে খুব সীমিত সংখ্যক দক্ষ বেকারেরই কর্মসংস্থান হতে পারে; আর তৃতীয়ত, সব থেকে মূল্যবান কথাটি হল (যা আমাদের শীর্ষ আদালতও তুলে ধরেছে) যে, উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মচ্যুতি হবে, তা নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থেকে অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ, নতুন শিল্প, সহায়ক-শিল্প মিলিয়ে সর্বমোট যারা কাজ পাবেন তাঁদের থেকে যারা কাজ হারাবেন তাঁদের সংখ্যাটা অনেক পরিমাণে অধিক।

এও মনে করে দেখুন, সিঙ্গুরে যে জমিটি নিয়ে এত লড়াই, সেই জমির উল্টোদিকে (হাইওয়ের ওপারে) সমপরিমাণ ঈষৎ নিচু একটি প্রায়-পরিত্যক্ত জমি ছিল, যে জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় মানুষজনের কোনও আপত্তিও ছিল না, সেখানে টাটাদের প্রস্তাবিত শিল্প গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কেন? কারণ, জমিটি যেহেতু অল্প নিচু ছিল, তাই সেখানে কিছু পরিমাণে মাটি ফেলে ভরাট করার দায় পড়েছিল তাদের ওপরটাটারা সেই সামান্য ব্যয়টুকুও করতে রাজী ছিল না মুনাফার কিয়দংশে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে ভেবে। আর বামফ্রন্ট সরকার এমন নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেটদের পক্ষে দাঁড়াল যে, তারা টাটার সামান্য ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধিকে পর্যন্ত কৃষক ও বর্গাদারদের জীবনযাপন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার থেকেও বড় করে দেখল।

শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সোচ্চার প্রতিধ্বনি হয়ে যে বামপন্থী দলগুলির উত্থান ও বিকাশ, সেই তারাই এইভাবে হাতে লাল পতাকা নিয়ে ও মার্কসবাদের নাম করে প্রকারান্তরে শ্রমিক-কৃষকের বিপক্ষে গিয়ে রাজনীতির অতল জলে ডুবে গেল। অন্যদিকে, ভারতের প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের থেকে নিজেদের আলাদা করে  যে আঞ্চলিক নতুন দলটি রাজ্যে ১৯৯৮ সালে তৈরি হয়, তারাই কৃষকদের স্বার্থে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও অন্যত্র কঠিন লড়াই চালিয়ে এক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হল। অথচ, এই দলের তেমন কোনও ঘোষিত মতাদর্শ নেই। দু’ দফায় সরকার চালিয়ে তৃতীয় বারের জন্যও তারা নির্বাচিত হল বেশ প্রবল সংখ্যাধিক্য নিয়ে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, তৃণমূল সরকারের কোনও ব্যর্থতা বা অসাফল্য ছিল না। অবশ্যই ছিল। কিন্তু এমন একটা আস্থা তারা রাজ্যের মানুষের থেকে আদায় করতে পেরেছে যে এক বড় সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেছেন, অন্য সব দলের থেকে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের পাশে তৃণমূল সরকার আছে। দুর্ভাগ্যের হলেও বাস্তবতা এই যে, পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা দলের মতোই তৃণমূলও নিজ দলীয় ক্ষমতা জাহির করতে পিছপা হয়নি, স্থানীয় স্তরে আগের জমানাগুলোর মতোই অনেক জায়গাতেই গায়ের জোর দেখিয়েছে। দুর্নীতিও কম করেনি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাতাবরণ তারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যার ভিত্তিতে মানুষ তাদের অপকর্মগুলিকে সার্বিক বিচারে কম গ্রাহ্য করে সুকর্মের ভিত্তিতে তাদের ওপরে আস্থা রেখেছে। উপরন্তু, এবারের নির্বাচনে বিজেপি নামক এমন এক ফ্যাসিবাদী শক্তি এ রাজ্যের নির্বাচনে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার বিরোধিতায় তৃণমূলও এক অটল লড়াইয়ের স্বাক্ষর রেখেছিল, তা দেখে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ওপর কুণ্ঠাহীন আস্থা জ্ঞাপন করেছে। 

এই যে নবতর এক সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগের কাণ্ডারী তারা হতে পেরেছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক আস্থাভাজন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠতে পেরেছে, বহু প্রকল্প ও জনমুখি অনুশীলনের দ্বারা প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে কল্যাণমূলক কার্যধারাগুলিকে পৌঁছে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলেছে। দেখে মনে হবে, তারা বোধহয় কোনও বাম মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে তাদের অগ্রাধিকার পিছিয়ে পড়ে মানুষদের প্রতি। লক্ষণীয়, ঘোষিত ভাবে তারা কোনও মতাদর্শের অনুসারী নয়। বামপন্থীদের যে দাবিগুলি চারপাশে বারবার উচ্চারিত হতে শোনা যায়, তারা সেইগুলিকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করে। হতে পারে তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, হতে পারে তা নির্বাচনে জেতার জন্য। এতে সমস্যা কোথায়? বরং, এ তো বেশ ভাল ব্যাপার যে, সংসদীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে ও বহু ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর সে কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত ও উদার করা অতীব জরুরি। আর এইভাবেই তো চাপে পড়ে সংসদীয় গণতন্ত্র উত্তরোত্তর আরও বৈধতা পায় ও মানুষের আস্থা অর্জনে বেশি বেশি করে সক্ষম হয়ে ওঠে। আর যতই তা হয়, সাবেকি ও সনাতন বামপন্থীরা যেন পিছিয়ে পড়তে থাকে। দেখা যায়, নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তি সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করে বামপন্থার কর্মসূচিগুলিকেই আরও উন্নত স্তরে ধারণ করে। সে অর্থে বলাই যায়, এ রাজ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার দৌড়ে তৃণমূলিরা সাবেকি বামপন্থীদের একেবারে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এ এক অভিনব প্যারাডক্স। বামপন্থাকে অন্তঃস্থ করেই সংসদীয় গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যেন আরও সবল হয়ে উঠছে। অথচ সেখানে বামপন্থী নামধারীদের কোনও ঠাই নেই। কারণ, তারা চিন্তা-চেতনা ও কর্মে পড়ে আছে কয়েক দশক পিছনে। আর সে জন্যই আজ এই একুশ শতকের বিশের দশকের গোড়ায় এসে আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশধারা কোন পানে এগোচ্ছে আর সংকটের সূত্রগুলি কোথায় আবর্তিত হচ্ছে ও সুপ্ত আছে, তা বোঝার আদৌ কোনও এলেম তাদের নেই। কারণ, বহুদিন হল তারা রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চাকে সমূলে বিসর্জন দিয়েছে। বামপন্থী নামধারী যাদের বলি (কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাসীদেরও সে তালিকায় ফেলে) তাদের আজকের সংকট ঠিক এইখানটাতেই (তবে অবশ্যই অন্য কিছু বামপন্থী শক্তি নতুন ভাবে এগিয়ে আসছে)। অথচ যারা বামপন্থী নামধারী নয়, তারা ঘোর বাস্তবে বেমালুম ধাক্কাটাক্কা খেয়ে বামপন্থীদের সম্ভাব্য ইস্যুগুলিকে নিয়েই বেশ এগিয়ে পড়েছে। এই ‘ধাক্কাটা’ ওই তথাকথিত ‘অ-বাম’পন্থীদের আরও গায়ে লাগে কারণ, সংসদীয় রাজনীতিই তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। তাদের পক্ষে তা বেশ আয়াসসাধ্যও, কারণ তাদের অত মতাদর্শের পিছুটান নেই। তাই বলি, নামে কী বা আসে যায়!

এই যে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি সম্পর্কে সাবেকি বামপন্থীদের অজ্ঞতা, তার আলোকেই নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে এখন তাঁরা সামাজিক ন্যায়-প্রকল্পগুলিকে ‘ভিক্ষার ঝুলি’ হিসেবে বক্রোক্তি করছেন। কারণ, তাঁরা জানেন না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে যে বহু কথিত ‘গিগ অর্থনীতি’র জমানা শুরু হয়েছে, সেখানে স্থায়ী ও যথেষ্ট কর্মসংস্থানের কোনও আয়োজন নেই। আধুনিক যন্ত্র এখন আয়েসেই বহু মানুষের কায়িক ও মানসিক শ্রম দুইই বেশ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম। অতএব, আগামী দিনে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্রমেই আরও সংকুচিত হবে। যে কারণে, ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর আলোচনা এখন কান পাতলেই সর্বত্র শোনা যায়। অর্থাৎ, বহু সংখ্যক মানুষের হাতে টানা কাজ থাকবে না, প্রযুক্তি ও তার আনুষঙ্গিক দক্ষতা বহুল পরিমাণে খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকবে, কাজের বাজারে এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হবে। তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে সমাজকল্যাণ মূলক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা শত গুনে বেড়ে যাবে। তাই, ‘ভিক্ষার ঝুলি’ বলে সেইসব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে অবজ্ঞা করাটা আসলে অজ্ঞতার দিকচিহ্ন। শিল্প স্থাপনা ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির যে বড়াই সাবেকি বামপন্থীরা করে থাকে তা অশ্বডিম্ব বৈ আর কিছু নয়। কারণ, সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানা শিল্প আর কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্য প্রবণতা নয়, যা কিছু নতুন গড়ে উঠছে তা সব মেঘের আড়ালে (ক্লাউড প্রযুক্তি)। এই নতুন ভার্চুয়াল শিল্পে বিশেষ ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু কাজের অধিকাংশ পরিসরটা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। এই সামগ্রিক উত্থানটাকে কি বামপন্থীরা বুঝতে পারছেন? বিপদটা সেখানেই।

তাহলে কি বলব যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বাধ্যত ক্রমেই বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠছে? অর্থাৎ, নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির অভিসারে তা কি আরও কল্যাণমূলক অবস্থান গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার বিষয়। এর উত্তর এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে কিছু হয় না। আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্প, বোলসোনারো, এর্ডোগান, নরেন্দ্র মোদির মতো চরম দক্ষিণপন্থী ও মতান্ধ শক্তিকেও নির্বাচনের ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসতে দেখছি। তা নিয়ে এ লেখায় বিশেষ কিছু বলার নেই। বরং বলা যাক- যারে তুমি বাম দেখ সে কি বাম নয়/ যারে তুমি পর ভাবো সে কি বাম হয়’। অতএব, এ এক জটিল ধাঁধাঁ।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই লেখায় শেষ কথাটি হল, যারা নামে ও কাজে বামপন্থী বলে নিজেদের মনে করেন (নানাবিধ কমিউনিস্ট সহ) তাদের আজ সময় হয়েছে একুশ শতকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সম্পূর্ণত নতুন উত্থানকে সম্যক অনুধাবন করে তাকে এমন ভাবে উপলব্ধি করা যাতে একটি যথার্থ সমাজ বদলের (পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে) কার্যসূচি আবারও নির্মাণ করা যায়। বলাই বাহুল্য, পুঁজিবাদ তার নিজ জোরেই টিকে থাকছে, দরকার পড়লে সে বামপন্থাকেই যতটা সম্ভব আত্মসাৎ করছে, আর সেই সুবাদে নামধারী বামপন্থীদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির কালবেলায় পুঁজিবাদকে অতিক্রমণের মহামন্ত্র নামধারী বামপন্থীদের এখনও জানা নেই, কারণ, তারা রাজনীতির এক গোলকধাঁধায় আপাতত বাঁধা পড়ে আছে।

(সমাপ্ত)


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত ।

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.