Thursday, May 13, 2021

করোনা অতিমারি কি একটি দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে - কিছু ঐতিহাসিক দলিল ও অন্যান্য

 লিখেছে

চ ন্দ ন দে ব না থ 

Source: Foreign Policy(Article by Kyle Harper)

এই সময়টাতে সব থেকে বেশি দরকার ছিল সমাজ জুড়ে ভাইরাস-বিরোধী ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা। অন্যদিকে এটাও আবার ঘটনা যে শ্রেণিবিভক্ত ও প্রতিযোগিতা নির্ভর এই সমাজে এরকম ঐক্য ও সহযোগিতা আশা করাটাও বোকামি। যদিও সমাজে অন্যান্য লড়াই বা যুদ্ধগুলো থেকে এটা একেবারেই আলাদা এই দিক থেকে যে, হামলাকারী ভাইরাস মানব সমাজের কোনও অংশ নয়; এটা হল ভাইরাস নামক একটা প্রাকৃতিক শক্তির সাথে গোটা সমাজের লড়াই। এবং ভাইরাসের কাছেও তো কোনও বাছবিচার নেই; সে জানে না, পরোয়াও করে না, মানব সমাজে শোষক কারা আর শোষিত কারা, কে ধনী আর কে গরীব। ভাইরাস এটাও জানে না যে ভারত ও পাকিস্তান নামক এই গ্রহের দুটো ভূখণ্ড একটা সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত এবং একইভাবে গোটা গ্রহটাই। ভাইরাস কোনও বর্ডার জানে না। সে বোঝে না, চেষ্টাও করে না, একটা মানুষ ব্রিটিশ নাকি আফ্রিকান, তার চামড়া তামাটে নাকি সাদা। অর্থাৎ সমস্ত দিক থেকেই ভাইরাসের কাছে আমরা সবাই একই, অভিন্ন। 

শুধু এটাই যদি বাস্তব হতো এতোটা দুর্দশা নিশ্চয়ই আমাদের হতো না। কিন্তু কঠিন সত্যি হল, ভাইরাসের কাছে আমরা অভিন্ন হলেও আর্থ-সামাজিক দিক থেকে মোটেই নই। সেই কারণে ভাইরাসজাত অতিমারি ও দুর্দশাও সমাজের সমস্ত অংশের কাছে মোটেই সমমানের নয় বরং সেখানেও আছে বৈষম্যের প্রকট প্রতিফলন, বিশেষ করে লকডাউনের সময়ে যেটা দেখা গেছে। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউটাতেও সেই একই সত্যের প্রকাশ যথেষ্ট স্পষ্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল অক্সিজেনের অভাবে নিকটজনের মৃত্যুজনিত ক্ষোভ চিকিৎসক বা নার্সদের ওপরে আছড়ে মতো ঘটনা। কারণ সবাই বোঝে গাফিলতিটা সরকারের, চিকিৎসক বা নার্সদের নয়; বিগত এক বছরেরও বেশি সময় জুড়ে ভাইরাস বিরোধী লড়াইয়ে একেবারে সামনের সারিতে যাঁরা আছেন তাঁরা হলেন ঐ চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরাই। 

অতীতের কিছু মহামারিতেও চিকিৎসকদের ওপরে আক্রমণ হতে দেখা গেছে, যেমন উনবিংশ শতকের কলেরা রায়টগুলোতে। অবশ্য আজকের কয়েকটা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে মোটেই “রায়ট” আখ্যা দেওয়া চলে না। আক্রমণের রূপ, তীব্রতা ও ব্যাপ্তির দিক থেকে উনবিংশ শতকের ঘটনাগুলো ছিল অনেক আলাদা। সেগুলো ছিল অনেক বেশি হিংস্র, মানুষের অংশগ্রহণের দিক থেকে অনেক বড় মাপের, আর ব্যাপ্তির দিক থেকে ছিল গোটা ইউরোপ জুড়ে এবং রাশিয়াতে। এতো বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও কিছু মিলের জায়গাও কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে সেটা বুঝতে আরও সুবিধা হবে যদি মধ্য যুগের ‘ব্ল্যাক ডেথ’কে (ব্যুবনিক প্লেগ) কেন্দ্র করে পরিচালিত হিংসাত্মক ঘটনাগুলোর সাথে কলেরা রায়টগুলোর পার্থক্যকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি।   

Source: National Army Museum(UK)

 

প্রথমত, ইউরোপের সমস্ত জায়গা, এবং রাশিয়াতেও, কলেরা রায়টগুলো পরিচালিত হয়েছিল মূলত শহুরে শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষদের দিক থেকে। অনেক জায়গাতে গ্রামের গরীবেরাও এগুলোতে অংশ নিয়েছিল। এক কথায় বললে, রায়টগুলো হয়েছিল সমাজের শোষিত-নিপীড়িত বর্গের গরীব মানুষদের দিক থেকে। সেই অর্থে, রায়টগুলোর একটা স্পষ্ট শ্রেণি  চরিত্র ছিল। সেটা হয়তো এই কারণে যে মহামারিতে মৃত্যু ঘটছিল মূলত সমাজের এই অংশের মধ্যেই। আর প্রচণ্ড হিংসাত্মক হয়ে ওঠার পেছনে এই সত্যটা হয়তো বিশেষ ভাবে কাজ করেছিল যে ব্যাপক ভাবে মৃত্যু ঘটছিল শিশুদের; এবং সেই কারণেই হয়তো রায়টগুলোতে বিরাট অংশগ্রহণ ছিল, এমনকী সামনের সারিতেও, মহিলাদের। ব্ল্যাক ডেথকে কেন্দ্র করে হওয়া হিংসাত্মক ঘটনাগুলোর এরকম সুস্পষ্ট শ্রেণি  চরিত্র কিন্তু ছিল না। তবে আরও স্পষ্ট বৈসাদৃশ্যের দিক ছিল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুর প্রশ্নে। ব্ল্যাক ডেথের ক্ষেত্রে, ইউরোপের সমস্ত জায়গাতেই আক্রমণ হয়েছিল মূলত ইহুদী সম্প্রদায়ের ওপরে, অনেক ক্ষেত্রে আবার কুষ্ঠ রুগীদের ওপরেও। আর কলেরা রায়টগুলোতে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল চিকিৎসক ও নার্স সহ চিকিৎসা ব্যবস্থা (হাসপাতাল) এবং আনুষঙ্গিক সরকারী আমলা ও  পুলিশ।

Source: National Army Museum(UK)


এই দুই বৈসাদৃশ্য ছাড়াও, ঘটনাগুলোর সূত্রপাতের প্রশ্নে একটা সাদৃশ্য কিন্তু ছিল। দুই ক্ষেত্রেই কাজ করেছিল এই সন্দেহ যে “শত্রুপক্ষ” পরিকল্পনা করেই, হয়তো বিষক্রিয়ার দ্বারা, তাদের মধ্যে মৃত্যুলীলা ঘটিয়ে চলেছে। ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ নগরীগুলোতে বীভৎস কলেরা রায়ট শুরু হওয়ার পেছনে এই সন্দেহ কাজ করেছিল যে গরীব শ্রমজীবীদের মধ্যে এই মৃত্যু মিছিল আসলে তাদের  জনসংখ্যা কমানোর মতলবে এলিট সম্প্রদায়ের কোনও পরিকল্পনা মাফিক, যেখানে চিকিৎসক, নার্স ও সরকারী আমলারা এজেন্ট হিসাবে কাজ করে চলেছে। বস্তুত, মাত্র ত্রিশ বছর আগেই প্রকাশিত হয়েছিল থমাস ম্যালথাসের সেই কুখ্যাত রচনা “An Essay on the Principle of Population”,  যেখানে শ্রমিক শ্রেণি কে নিন্দা করা হয়েছে তাদের জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলার জন্য। গোটা উনবিংশ শতক জুড়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতেও এই তত্ত্বের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল, এবং তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল গোটা ইউরোপ জুড়েই। শাসক শ্রেণি র দিক থেকে কথা বলা হচ্ছিল দারিদ্র্য কমাতে গৃহীত কর্মসূচিগুলো গরীবদের আলস্যে উৎসাহ জোগাচ্ছে, তারা কাজ না করে উল্টে জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। ১৮৩৪ সালে, ব্রিটেনে এমনকী আইন সংশোধনও করা হয়েছিল (Poor Law Amendment Act) এই মর্মে যে কাজ না করলে রিলিফ দেওয়া হবে না।   

দাঙ্গাগুলোর পেছনে আরও কিছু সন্দেহ কাজ করেছিল, যেমন এই সন্দেহ যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রুগীদের চিকিৎসকরা আসলে মেরে ফেলতে চাইছে মৃতদেহগুলো অ্যানাটমিক্যাল স্কুলগুলোতে বেচে দেওয়ার মতলবে। এই সন্দেহ তৈরি হওয়ার একটা  কারণও অবশ্য ছিল। রায়ট শুরু হওয়ার মাত্র তিন বছর আগে দুটো লোক সত্যিই অভিযুক্ত হয়েছিল ১৬ জনকে খুন করে তাদের বডিগুলো একজন চিকিৎসককে তাঁর অ্যানাটমি লেকচারের কাজে বেঁচে দেওয়ার অভিযোগে। এই ব্যাপারে চলমান মামলার খবরাখবর সংবাদপত্রগুলোতে নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছিল, যেগুলো রায়ট শুরু হওয়ার সময়ে মানুষের মনে টাটকা অবস্থাতেই ছিল। তাছাড়া কর্তৃপক্ষও যেহেতু মৃতদের খুব দ্রুতই কবর দিয়ে দিচ্ছিল সম্পূর্ণ আলাদা একটা জায়গাতে, সেটাও গরীব মানুষের কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল। তাছাড়া এই অভিযোগও তাদের ছিল যে মৃতদের সম্মানজনক ভাবে কবর দেওয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে, হাসপাতালগুলো তাদের চোখে আসলে “মৃত্যুর কারখানা” বলেই মনে হচ্ছিল, এবং সেই কারণে চিকিৎসক ও নার্সদের ওপরে হিংস্র আক্রমণ ছাড়াও রুগীদের হাসপাতাল থেকে বের করে এনে “মুক্ত” করে দেওয়ার মতো ঘটনাও অনেক ছিল।   

রাশিয়াতে হওয়া রায়টগুলো ছিল আরও হিংস্র। সেখানেও এই সন্দেহ বিরাট ভাবে কাজ করেছিল যে গরীব মানুষের জনসংখ্যা ছেটে ফেলার মতলবে জলের কুয়োগুলোতে আসলে বিষ মেশানো হয়েছে। কোয়ারান্টিন ভেঙ্গেচুরে ক্ষুব্ধ জনতা বিশাল সংখ্যায় রক্তাক্ত দাঙ্গায় লিপ্ত হয়েছিল। হাসপাতাল তছনছ করা, এ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা ইত্যাদি ছাড়াও শুরু হয়ে হয়েছিল ডাক্তারদের হত্যা করার এক উন্মাদনা। বিশাল সংখ্যায় আক্রমণ চালানো হচ্ছিল ধনী মানুষদের বাড়ীগুলোতেও। 

সেই একবারই নয়, এরপরেও রাশিয়াতে কলেরা রায়ট হয়েছে - যেমন ১৮৯২ সালে, যখন সেই দাঙ্গা দমনে জার স্বৈরতন্ত্র সেনাবাহিনী নামিয়েছিল। ঐ একই সময়ে কলেরা রায়ট চিনেও হয়েছে, মূলত সেইসব শহুরে এলাকাতে যেখানে ছিল তখনকার  ঔপনিবেশিক শাসক বর্গের বসবাস, যাদের চোখে চাইনীজরা ছিল কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণি র নাগরিক। সেই কারণে সেখানেও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল ঐ এলাকাগুলোতে থাকা পশ্চিমী দুনিয়ার মানুষেরাই। তাদেরও অভিযুক্ত করা হয়েছিল কুয়োর জলে বিষ মেশানোর অভিযোগে।

Source: Foreign Policy(Article by Kyle Harper)


সমস্ত দিক বিচার করা হলে, উনবিংশ শতকের কলেরা রায়টগুলো তাদের অন্তর্বস্তুর দিক থেকে ছিল আসলে শোষক-শাসক বর্গের বিরুদ্ধে শোষিত-শাসিতের দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভেরও এক বহিঃপ্রকাশ। এবং এটাও ঘটনা যে ঐ শতকের প্রথম দিক থেকেই ইউরোপে শ্রেণি  সংগ্রামের একটা জোরালো স্রোত জারি ছিল, যেটা ক্রমাগত আরও জোরালো হয়ে ওঠার দিকে এগোতে চাইছিল। কলেরা রায়টগুলোকে সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাও সেই কারণে ঠিক হবে না। তবে এই কথা বলার অর্থ মোটেই এটা নয় যে রায়টগুলো খুব ভালো কাজ ছিল বা ঐতিহাসিক ভাবে প্রগতিশীল কাজ ছিল। একই ভাবে, আজকের অতিমারির সময়েও চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের ওপরে খুব বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত আকারে হলেও যেসব আক্রমণ হয়েছে সেগুলো মোটেই ভালো কাজ হয়নি, বিশেষ করে যখন অতিমারি কী থেকে সেটা মানুষ জানে, যেটা ১৮৩০-এর দশকের কলেরা রায়টগুলোর সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও জানা ছিল না। কলেরা সৃষ্টিকারী জীবাণু (cholera bacillus) আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক পরেঃ প্রথম আবিষ্কারক ছিলেন (১৮৫৪ সালে) এক ইতালীয় বিজ্ঞানী, ফিলিপো পাসিনি; নিশ্চিত ভাবে আবিষ্কৃত হওয়ার স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছিল আরও অনেক পরে (১৮৮৩ সালে), ইতিহাস খ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কোচের এক অনুসন্ধানে পাওয়া আবিষ্কার থেকে। তবে রোগটা যে শহরের দূষিত জল থেকে হচ্ছে সেটা অনেক আগেই (১৮৪৯ সালে) আবিষ্কার করেছিলেন এক ব্রিটিশ চিকিৎসক, জন স্নো। সুতরাং চিকিৎসা বিজ্ঞানেই যখন জানা ছিল না রোগটা কী থেকে ও কীভাবে হচ্ছে, যখন রোগের “মায়াজমা তত্ত্ব” চিকিৎসাবিদ মহলে তখনও প্রধান জায়গাতে, সেরকম একটা সময়ে সাধারণ গরীব মানুষ স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে চিকিৎসকদের ওপরে মারমুখী হওয়া আর এখন অক্সিজেন না পেয়ে রুগীর মৃত্যু হওয়ার জন্য চিকিৎসকদের আক্রমণ করার মধ্যে নিঃসন্দেহে অনেক তফাৎ। মিলের দিক আছে একটা অন্য জায়গাতেঃ কলেরা রায়টগুলোর পরোক্ষ অবদান হিসাবে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় বড় ধরনের অগ্রগতি শুরু হওয়া, যেটা আজকের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ চাহিদা। আরেকটা মিলের দিক হল, আজকের ঘটনাগুলোও আসলে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধেই পরিচালিত; সম্পূর্ণ অসংগঠিত ও অসহায় অবস্থায় ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে হাতের কাছে পাওয়া চিকিৎসকদের ওপরে, আসলে যেগুলো সরকার এবং সেই অর্থে শাসক শ্রেণিরই বিরুদ্ধে।



[ন্দন দেবনাথ, বিজ্ঞানসাধক ও মননে আপামর তথ্য ও 
তত্ত্বভিত্তিক সত্যনিষ্ঠ । মনোজ্ঞ বিশ্লেষণেই তাঁর মূল আগ্রহ । প্রকাশিত হয়েছে নানা বই । সাম্প্রতিকতম বইটি ই-বুক 
আকারেও প্রকাশিত । নিচের লিংক থেকে কিনে নিতে পারেন পাঠক ।]






No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.