Friday, May 14, 2021

হিন্দু ভোটের কতটা কোথায় গেল: 'দ্য হিন্দু'র লোকনীতির সমীক্ষা ও 'দ্য টেলিগ্রাফে'র উত্তর-সম্পাদকীয়

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী 

Source: The Hindu and The Telegraph

১৯৬৩ সালে ভারতবর্ষের বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী  কোঠারি দিল্লিতে স্থাপন করেছিলেন সেন্টার ফর দ্য স্টাডিজ অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস(সিএসডিএস) যার কালক্রমে নতুন নামকরণ হয়েছে "লোকনীতি"। এই সংস্থা বিভিন্ন ধরনের সমীক্ষা সারা বছর ধরে করে থাকেন, এবং তাঁদের বুলেটিনে তা নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলার ভোটে হিন্দু ভোটের বিভাজন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের একটি রিপোর্ট, যা অনেকটাই ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে এবারের পশ্চিমবঙ্গের ভোটে হিন্দু ভোটের, বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় হিন্দু ভোটের বিন্যাস। এবারের ভোট প্রচারের শুরু থেকে বিজেপি এবং তার পোঁ ধরা কয়েকজন সাংবাদিক একটি নতুন শব্দবন্ধ আমদানি করেছিলেন - তা হল 'নিম্নবর্গীয় হিন্দুত্ব"। এবং এঁরা খুব দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলতে শুরু করেন যে গ্রামের যাঁরা গরিব, পিছিয়ে পরা শ্রেণী , দলিত ,আদিবাসী প্রভৃতি তাঁরা বিজেপির হিন্দুত্বকে আশ্রয় করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁদের ধারণার ভিত্তিতে তাঁরা প্রচার শুরু করেন যে ২০১১ সালে এই বর্গের যে মানুষগুলো তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা আজ তৃণমূলের উপর বিরক্ত। কেউ কেউ নিম্নবর্গের মানুষের বিজেপিকে আশ্রয় করার এই ঘটনাকে হিন্দুত্বের এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জয় বলে বর্ণনা করেন, এবং এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন উচ্চ বর্ণের প্রতি নিম্নবর্গের অনীহা ও ক্ষোভ, যেখান থেকে এই ভদ্রলোক বিরূপতার সৃষ্টি। 

এই তত্ত্বকে জোরদার করতে অমিত শাহরা বারবার দলিত ও দরিদ্র ঘরে বসে দিনে দুপুরে রুটিতে ঘি মাখিয়ে লাউকি সবজি দিয়ে লাঞ্চ সেরে বোঝাতে চেয়েছেন, দেখো আমি তোমাদেরই লোক! ভোট পরবর্তী সমীক্ষার ফল দেখাচ্ছে যে নিম্নবর্গের এবং ভদ্রলোক শ্রেণী দুই তরফের ভোটই ২০১৯-এর তুলনায় অনেকটাই চলে গেছে তৃণমূলের ঘরে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি যে সব শ্রেণীর মানুষের ভোট সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ওবিসি ( যাদব, তেলি, কুর্মি, লোহার, কুমহার প্রভৃতি একত্রিত করে) ভোট , যা ৬৮% থেকে নেমে এসেছে ৪৯% -এ। আদিবাসীদের ভোটও বিজেপি হারিয়েছে, সেখানে ভোট কমেছে ৬২% থেকে ৪৬%-এ। এই সব ভোট ফিরেছে তৃণমূলের ভোট বাক্সে। সেই কারণে তৃণমূল রাজ্যের আদিবাসী অঞ্চলে অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করেছে। যে দলিত শ্রেণীর প্রতি এবার প্রচুর আস্থা রেখেছিল বিজেপি, সেখানেও দেখা যাচ্ছে ২০১৯-এর তুলনায় ভোট অনেক কম।রাজবংশী ভোটেও বড় ধ্বস নেমেছে বিজেপির, ৭৫% থেকে কমে এসেছে ৬০%-এ। তবে এ কথা মানতে হবে যে রাজবংশী ভোট হারালেও বিজেপি তুলনামূলক ভাবে ভালো ফল করেছে উত্তরবঙ্গে। তার মানে অন্য শ্রেণীর মানুষ এবার বিজেপিকে বেশি ভোট দিয়েছেন উত্তরবঙ্গে। দলিত ভোটের যে অংশটিকে বিজেপি এবার  কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পেরেছে সেটি হল  মতুয়া সহ নমশূদ্রদের ভোটের একাংশ। তৃণমূলকে হারাতে গেলে বিজেপির দরকার ছিল ২০১৯-এর ভোটব্যাংক ধরে রাখার কাজটি মন দিয়ে করে যাওয়া, কিন্তু তাঁরা সে পথে হাঁটেন নি। 

হিন্দু উচ্চবর্ণের যে ভোট (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ,বৈদ্য ইত্যাদির) সেখানেও দেখা যাচ্ছে বিজেপির ভোট অনেক কমেছে। ২০১৯-এর ৫০%-,এর নিরিখে এবার ভোট কমে হয়েছে ৪৬%। তবে সমীক্ষা অনুযায়ী উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোটের এই হ্রাস যে তাঁদের বিজেপির প্রতি অনাস্থার প্রতিফলন তা বলা ঠিক হবে না। কারণ দেখা যাচ্ছে যে বিজেপি  উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত হিন্দু ভোটের নিরিখে তৃণমূল অপেক্ষা প্রায় ১৩ থেকে ১৪% ভোটে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু নিম্নবিত্তের ভোটের নিরিখে তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে রয়েছে বিজেপির তুলনায়, প্রায় ১৭ থেকে ১৮%। এই ভোটের পার্থক্য তৃণমূলকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। আসলে বিজেপি মুখে আমরা গরিবের সরকার, বড়লোকের যম, ইত্যাদি বলে বড়লোকদের টাইট করার জন্য নোটবন্দি করলাম, এ রকম একটা ভাব দেখিয়ে, শুরুর দিকে খানিকটা গরিবের কাছে আসার চেষ্টা করেছিল। তার সুফল তারা এই রাজ্যে তুলেছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে। যদিও সেই ভোটে বামের ভোট ঢেলে গিয়েছিল রামের বাক্সে, তা না হলে ওই ফল বিজেপি করতে পারত না। ক্রমেই নীল শেয়ালের গায়ের রং উঠতে শুরু করল, গরিবের সরকারের প্রকৃত রূপ কি তা ক্রমশ সামনে আসতে শুরু করলো। একদিকে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আস্ফালনে বিরক্ত মানুষের সামনে মুখোশ আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছিল। এ রাজ্যে এসে অমিত শাহরা যতই দলিতদের মাথায় হাত বুলিয়ে ভোট টানার চেষ্টা করুন না কেন, দলিতদের মনে ছিল সারা ভারত জুড়ে দলিতদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করেছে এই বিজেপি সরকার। দলিত লাইফ ম্যাটার্স - সেই স্লোগান ও আন্দোলন কি মিথ্যা হতে পারে? দলিতরা তাই সমুচিত জবাব দিয়েছেন ভোট বাক্সে।রাজবংশীরাও মিলিটারিতে নারায়ণী সেনা হতে চায়নি তা বোঝাই যাচ্ছে। নিম্নবর্গের কাছে বিজেপির স্বরূপ সবটা উন্মোচিত হয়েছে লকডাউনের পর।গরিব মানুষগুলোকে পথে বসিয়ে ছেড়েছে এই বিজেপি সরকার। পরিযায়ী শ্রমিকদের যে বিপুল অংশ এই বাংলায় ফিরেছেন, তাঁদের বেশ কয়েক পুরুষ আর বিজেপিকে ভোট দেওয়ার নামগন্ধ করবেন না, এতটাই তারা ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতা ও অমানবিকতার প্রতি।মতুয়াদের জন্য বিজেপির খুড়োর কল ছিল, নাগরিকত্ব। তা দেশের নাগরিক না হয়ে কি ভোট দেওয়া যায় নাকি? এই প্রশ্নের উত্তর স্থানীয় বিজেপি নেতারা দিতে পারেননি, ফলে অমিত শাহ - মোদি হাত পা নেড়ে কি বললেন তাতে কিচ্ছু এসে যায় নি। উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত হিন্দুর জন্য বিজেপির দাওয়াই ছিল, দেশভাগের স্মৃতি উস্কে দেওয়া। বিজেপি নেতা, নেত্রীরা যদি দেশভাগ নিয়ে বাঙালি যত গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, এমনকি ইতিহাস লিখেছে সেগুলোর দিকে একটু নজর দিতেন, তা হলে দেখতে পেতেন দেশভাগ নিয়ে মানুষের মনে কোনও মুসলমান বিদ্বেষ নেই, আছে শুধুই নস্টালজিয়া। 

কেন নেই মুসলমান বিদ্বেষ ? সেই অপার ক্ষমা হয়ত বাংলার রেনেসাঁর উত্তরাধিকার, যা বহন করেছেন বাংলার ভোটাররা। আর একটা কথা, দেশভাগের যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ, তাকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছিল বামপন্থীদের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব। সাম্প্রদায়িকতার কড়াল গ্রাস থেকে বাংলাকে উদ্ধারে এক বড় অবদান বামপন্থীদের রয়েছে। একথা অস্বীকার করলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে।অতি সম্প্রতি বিজেপির এক তাত্বিক নেতা, তাঁর ইংরেজি কলামে লোকনীতির এই সমীক্ষার এক সম্পুর্ন উল্টো ব্যাখ্যা করেছেন, যা থেকে স্পষ্ট যে হিন্দুত্ববাদীরা বাংলায় সামাজিক শেকড় গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাঁরা এবার ধীরগতিতে এক আদর্শগত লড়াই বাংলার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দেওয়ার মতলব করছেন। লম্বা দৌড়ে এই আদর্শগত লড়াইয়ের মোকাবিলা করার জন্য, শুধু জনমুখী প্রকল্প যথেষ্ট নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের এই মুহূর্তে কোনও আদর্শগত ম্যানিফেস্টো মানুষের সামনে নেই। এই লড়াইকে শুধু জয় শ্রীরাম আর জয় বাংলার বাইনারিতে ভাবলে মস্ত ভুল হবে।বিজেপি টের পেয়ে গেছে যে উত্তর ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদ, বাংলায় চলবে না। ফলে এখন চৈতন্য, বঙ্কিম, বিবেকানন্দের আগ মার্কা হিন্দু জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে বাংলার উপর ঝাঁপানোর নীল নকশা বিজেপির হাতে তৈরি। তাকে প্রতিহত করার নীল নকশা কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি?

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.