Wednesday, October 7, 2020

কোভিড-১৯ এবং বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের চর্চাপদ (পর্ব ১)


ইতিহাসের আলোকে কোভিড-১৯ মোকাবিলার ব্যর্থতা ও সাফল্য

লিখেছেন : চন্দন দেবনাথ

Image Source: Economics Times(Please Visit)


[প্রথম পর্বটি মূলত, অতিমারী প্রতিরোধে ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থতা প্রসঙ্গে। সঙ্ক্রমণ প্রসার রোধে লকডাউন একটা হাতিয়ার হলেও, লকডাউন থেকে তৈরি হওয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বিশেষ করে গরীব মানুষ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্থিক দুর্দশা একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। তাই সেই আলোচনা এখানে করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলোর বেশীর ভাগেরই উৎস বা অরিজিন কোনও প্রাণী। এই ইতিহাসেও সেটা আমরা দেখেছি। এবারের নয়া করোনাভাইরাসও তাই, যদিও বিজ্ঞানী মহল এখনও নিশ্চিত নন ঠিক কোন প্রাণী এর অরিজিন। কিন্তু একই রকম জিনিস বারবার কেন এমন হচ্ছে, সেই বিষয়য়েও এখানে কোনও আলোচনা করা হয়নি। সেই আলোচনা সম্পূর্ণ আলাদা ভাবেই হওয়া দরকার। তাই সেগুলি পরের পর্বগুলিতে প্রকাশিত হবে ।]

 

 নয়া কোরোনাভাইরাসের (SARS-CoV-2) বিপদ কেটে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা শুধু নয় মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর আফ্রিকার মতো গরীব দেশগুলোতে এই ভাইরাসের থাবা তো এখনও ভালো মতো পড়েইনি কিন্তু তার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি। এরকম একটা অবস্থায় আতঙ্কিত মানুষ যে বাজারে খুব দ্রুত একটা ভ্যাকসিন চলে আসার দিকে তাকিয়ে থাকবে, সে তো খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেও কিছু সংশয় রয়েছে। সংশয় রয়েছে বিজ্ঞানী মহলেই। সংশয় রয়েছে ভ্যাকসিনগুলো কতোটা কার্যকরী হবে, এই নয়া ভাইরাসটার বিরুদ্ধে মানুষের দেহে স্থায়ী ইমিউনিটি তৈরি করতে পারবে কি না, তাই নিয়ে। সংশয় রয়েছে ধনী-গরিব নির্বিশেষ সমস্ত মানুষের কাছে সেগুলো সহজলভ্য কি না তাই নিয়েও।

 

উপায় তাহলে কী? এর উত্তরে বলা হচ্ছে, ব্যক্তি মানুষ হিসাবে সবার উচিৎ ঠিক ঐ পরামর্শগুলোই মেনে চলা - অর্থাৎসামাজিক দুরত্ববজায় রাখা, মাস্ক পরে বাইরে বেরনো এবং নিয়মিত হাত ধোয়া। যদিও আমরা সবাই জানি, ভারতের ঘনবসতিপূর্ণ গরীব দেশে অনেকের পক্ষেই এগুলো মেনে চলা সম্ভব নয়। তার মানে অবশ্য এই নয় যে পরামর্শগুলো সঠিক নয়। কিন্তু সব থেকে বড় প্রশ্ন হল সরকারের দায়ীত্ব কী? যদি শুধু এই দেশের কথা ধরা হয়, দীর্ঘদিন লকডাউন জারী করে রাখা ছাড়া কাজের কাজ সরকার করেছে কতোটুকু? আর এখন চলছে ধাপেধাপে হলেও লকডাউন তুলে নেওয়ার প্রবল চেষ্টা। একটাই কারণেঃ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ চিন্তা করে নয়, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আর বিজনেস হাউসের স্বার্থ চিন্তা করে, তাদের অনেক লোকসান হয়ে চলেছে বলে। নানা মাত্রায় একই জিনিস দেখা গেছে এবং যাচ্ছে সব দেশেই। যদিও সামান্য কিছু ছোট দেশ বাদ দিয়ে, বড় বড় অনেক দেশের সরকারই মহামারী প্রতিরোধে চরম ব্যর্থ। যেমন এই মুহূর্তে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারত। তার আগে বেশ ভালমতো ব্যর্থতা দেখিয়েছিল ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং ইউকে।

 

এই ব্যর্থরা সবাই সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম একটা ধারণা গেঁথে দিতে চেয়েছে যে, মারাত্মক এই ভাইরাসটা যেহেতু একেবারেই নতুন এবং তার কোনও ভ্যাকসিন নেই, তাই লকডাউন জারী করে সঙ্ক্রমণ প্রসারকে ঠেকানোর চেষ্টা করা ছাড়া তাদের আর কীই বা করার ছিল। এখন লকডাউন তুলে নিতে মরীয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী তো এমনকী সম্প্রতি জনগণের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছেন সঙ্ক্রমণ বেড়ে চলার জন্য। শুধু তাদেরলাপড়বাহীআচরণের কারণেই কারণেই নাকি সঙ্ক্রমণ বেড়ে চলেছে। নিজেদের ব্যর্থতা, অপদার্থতা, বা বলা ভালো নিষ্ক্রিয়তাকে আড়াল করতে সরকার তরফ থেকে এরকম কথা শুনতে হওয়ার মধ্যে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে সঙ্ক্রমণ প্রসার রোধে সরকারগুলোর সত্যিই কি খুব বেশী কিছু করার ছিল না, শুধু লকডাউন জারী করা ছাড়া? 

এই প্রশ্নকে কখনোই উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের সমালোচনাকে মোটেই ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না। উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না এই প্রশ্নকেও যে, নয়া ভাইরাসটা যতোই নয়া এবং মারাত্মক হোক না কেন, সেটা কি একেবারেই আপ্রতিরোধ্য? ভ্যাকসিন না থাকলে সঙ্ক্রমণ ছড়াবেই? আর ছড়াতে থাকলে তার জন্য জনগণেরলাপড়বাহীর দিকে আঙ্গুল তুলতে হবে? সরকারের কাজ তাহলে কী? শুধুই লকডাউন জারী করা? আর দীর্ঘদিন সেটা চলার পরেও সঙ্ক্রমণ প্রসার বন্ধ না হলে তার দায় জনগণের ঘাড়ে চাপানো?  

Image Source: MoHFW

বিশ্ব মহামারীর (প্যানডেমিক) দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে যদি আমরা চোখ রাখি তাহলে দেখতে পাবো এই প্যানডেমিক তৈরি হওয়াটা মোটেই অনিবার্য ছিল না, যদি সেই ইতিহাসের রেখে যাওয়া শিক্ষাগুলোকে সম্বল করে সরকারগুলো যথেষ্ট সক্রিয় হতো। মহামারীর একটা সম্ভাবনা (আউটব্রেক) দেখা দিলেই সরকারগুলোর কী কী করা উচিৎ আর কী কী একেবারেই নয়, সেই ব্যাপারে যথেষ্ট শিক্ষা ইতিহাস রেখে গেছে।

 

এটা ঠিক যে আউটব্রেকটার সূত্রপাত চিনে। সুতরাং এটা খুব স্বাভাবিক যে, গোটা পরস্থিতিটার জন্য প্রথমেই এবং সব থেকে বেশী  সমালোচনা উঠবে চিনের বিরুদ্ধেই। নিঃসন্দেহে চিন সরকারের এটা একটা বিরাট অপরাধ যে, আউটব্রেকটা সেখানে শুরু হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে বেশ কিছু দিন বিশ্বকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, চাইনীজ সোশ্যাল মিডিয়াতে যাঁরা সেটা প্রকাশ করে ফেলেছিলেন তাঁদেরও ধমক দেওয়া হয়েছিল। সেরকম একজন হুইসেলব্লোয়ার চিকিৎসকের এই রোগে পরে মৃত্যুও হয়েছিল। কিন্তু এগুলো তীব্র সমালোচনাযোগ্য অপরাধ হলেও, গোটা বিশ্বের কাছে যখন আউটব্রেকটার কথা প্রকাশ করা হল, তারপরে কি এই প্যানডেমিক তৈরি হওয়াটাকে ঠেকানো যেতো না? কেন সেটা করা গেল না? ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইউকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশগুলোর সরকারের কাছ থেকে এই প্রশ্নের কি কোনও সদুত্তর পাওয়া গেছে?

 

ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে, মহামারী প্রতিরোধে সরকারগুলোর করণীয় অনেক কিছুই ছিল যেগুলো তারা ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক মতো করেনি বিলেই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, সরকার পক্ষ থেকে সেই ইতিহাস কখনোই আমাদের সামনে হাজির করা হচ্ছে না। স্কুল-কলেজে সেই ইতিহাস পড়ানোও হয় না। এভাবে আমাদের ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম ধারণা তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেছে যে, ভ্যাকসিনের অনুপস্থিতিতে সরকারের সত্যিই কি খুব কিছু করার ছিল, জনগণও কি আত্মরক্ষার পরামর্শগুলো ঠিক ঠিক মতো মেনে চলেছে? 

 

এভাবে নিজেদের কাঁধে দায় নিয়ে সরকারকে ছাড় দেওয়ার মধ্যে একটা বিরাট ভুল রয়েছে। কারণ এখানে সব থেকে বড় সত্য হল, সরকারী তৎপরতা ও দায়িত্বের প্রশ্নে ইতিহাসের শিক্ষাগুলো থেকে গেছে চরম ভাবে উপেক্ষিত। আর সেই কারণেই হতে পেরেছে গোটা পৃথিবী জুড়ে সঙ্ক্রমণের প্রসার এবং এই প্যানডেমিকের এই বর্তমান অবস্থাটা। এই সত্যকে সজোরে সামনে আনার তাগিদ থেকেই শুধুমাত্র বিগত প্রায় ১০০ বছরের প্যানডেমিকের ইতিহাসকে যথাসম্ভব সংক্ষেপে হাজির করার একটা চেষ্টা হয়েছে এই লেখাতে, যদিও প্যানডেমিকের ইতিহাস আরও অনেক লম্বা। আশা করা যায় শুধুমাত্র বিগত ১০০ বছরের ইতিহাস থেকেই বুঝতে পারা যাবে সরকারগুলোর কী কী করা উচিৎ ছিল যেগুলো তারা ঠিকমতো করেনি এবং কী কী করা একেবারেই উচিৎ হয়নি। এবং এই ইতিহাসের আলোকেই, লেখাটার একেবারে শেষে, সরকারী তরফে সেই উচিৎ আর অনুচিতের দিকগুলোকে পয়েন্ট আকারে স্পষ্ট করে হাজির করার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। 

 

Spanish Flu (1918-1920)

বেশীর ভাগ ইতিহাসই বলছে এই রোগের প্রাদুর্ভাবটা শুরু হয়েছিল ১৯১৮-র মার্চের গোরার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে একটা আর্মি ক্যাম্পে।[1][2][3] তবে London School of Economics-এ সোশ্যাল পলিসি ডিপার্টমেন্টে জনসংখ্যা পরিবর্তন বিষয়ক (demography) বিশিষ্ট পণ্ডিত Christopher Langford-এর কথাতে, প্রথম সঙ্ক্রমণ হয়েছিল চিনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও চলমান। এই আউটব্রেকট থেকে তৈরি প্যানডেমিককে বলা হয়ে থাকে “mother of all pandemics”  

Image Source: Amarujala(Please Visit)


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সূত্রপাতটা ঘটেছিল কানসাসের ঐ আর্মি ক্যাম্পে একটা মেস থেকে। ঐ মেসের একজন কুক, আলবার্ট গিচেল (Albert Gitchell), একদিন সকালে ফ্লু-জাতীয় সমস্যায় কষ্টের কথা জানিয়েছিলেন। লাঞ্চ টাইমের মধ্যে একই রকমের সমস্যা দেখা দেয় আরও ১০৭ জন সেনার মধ্যে। পাঁচ সপ্তাহ বাদে ১ হাজারের ওপরে সেনা সঙ্ক্রমিত হয়ে পড়েছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে ৪৭ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। মারাত্মক সেই ইনফ্লুয়েঞ্জাটা গাদাগাদি করে থাকা আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোকেও গ্রাস করেছিল, যেখানে ১০ লাখ নতুন রিক্রুট হয়েছিল। সেখান থেকে অনেককে আবার পাঠানো হয়েছিল ইউরোপে। অর্থাৎ তাদের মাধ্যমে সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল ইউরোপেও। গোটা এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে রোগটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও ইতালিতে। ফ্রেঞ্চ মিলিটারির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং ব্রিটিশ বাহিনীর প্রায় অর্ধেকই সঙ্ক্রমিত হয়ে পড়েছিল। সেখানেই থেমে থাকেনি, আক্রান্ত হয়েছিল উত্তর আফ্রিকা এবং সুদুর চিন ও জাপানও; আর এরপরে অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং ভারতের বন্দর নগরী বম্বেও।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Centers for Disease Control and Prevention (CDC)-র দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর প্রায় ৫০ কোটি মানুষ, যেটা ছিল সেই সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, এবং গোটা পৃথিবীতে মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ৫ কোটি মানুষের, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার।[4] যদিও বেশীর ভাগ রিসার্চেই বলা হয়েছে গোটা পৃথিবীতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা সংখ্যাটা ছিল অন্তত ৫ কোটি, কিছু কিছু মতে সংখ্যাটা ছিল আরও বেশী, আবার কিছু মতে কিছুটা কম। WHO-এর দেওয়া হিসাবে, সংখ্যাটা ৪ কোটির ওপরে। কিন্তু সব থেকে কম হিসাবটাও যদি ধরা হয়, গোটা পৃথিবীতে মৃত্যুর মোট সংখ্যাটা ছিল বিশ্বযুদ্ধের কারণে মোট মৃত্যুর (প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ) তুলনায় অনেক বেশী। আর যদি সংখ্যাটা প্রায় ৫০ কোটি ধরা হয়, তাহলে সেটা ছিল ১৩৪৭-১৩৫১-র প্লেগে মৃত্যুর থেকেও বেশী।[5] 

   

ভারতে মৃত্যু হয়েছিল ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের! একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, মৃতদেহ সরানোরও কোনও লোক ছিল না, সেগুলো হয়ে উঠেছিল শিয়ালের খাদ্য।[6] অন্য এক হিসাবে বলা হয়েছে, ভারতে মৃত্যু সংখ্যাটা ছিল ১ কোটি থেকে ২ কোটির মধ্যে।[7]

 

রোগটা কতোটা মারাত্মক (deadly) সেই দিক থেকে স্প্যানিশ ফ্লু প্যানডেমিকের তিনটে পর্যায় (waves) ছিল। এতক্ষণ যেটা বলা হল সেটা ছিল ফার্স্ট ওয়েভ। এটা তেমন মারাত্মক ছিল না। ১৯১৮-র গ্রীষ্মকালটা জুড়ে এই ওয়েভটা ক্রমশ দুর্বল বা ক্ষীণ হতে থাকে। এরপরে শুরু হয় একটা সেকেন্ড ওয়েভ। এটা স্থায়ী হয়েছিল সেপ্টেম্বর ১৯১৮ থেকে ডিসেম্বর ১৯১৮ অবধি। এই ওয়েভটা ছিল প্রথমটার তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেকেন্ড ওয়েভটা ছড়িয়েছিল বোস্টনে দুজন নাবিক এই রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে। তারপর খুব দ্রুতই সেটা ছড়িয়ে পড়েছিল নিকটবর্তী মিলিটারি ব্যবস্থাগুলোতে (military installations)। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি, তারপরে এই ওয়েভটা গ্রাস করেছিল গোটা দেশজুড়ে অসামরিক জনগণকেও (civilian populations)   

    

আগস্ট ১৯১৮-তে, ইংল্যান্ডের একটা বন্দর নগরী (Plymouth) থেকে সেনাবাহিনী বোঝাই কিছু জাহাজ এসে হাজির হয়েছিল ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম আফ্রিকার বন্দর শহরগুলোতে। ঐ সেনারা প্রথমে নিজেরাও জানতেন না তাঁরা সঙ্ক্রমিত ছিলেন। কিন্তু এভাবে এক দেশের বন্দর শহর থেকে অন্যান্য দেশের বন্দর শহরগুলোতে জাহাজগুলোর হাজির হওয়াটাই ছিল সেকেন্ড ওয়েভটা তৈরি হওয়ার কারণ। এই ব্যাপারে আমেরিকার Ohio State University-তে জনৈক ঐতিহাসিক জেমস হ্যারিসের (James Harris), যিনি ছোঁয়াচে রোগ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দুটো নিয়েই অনেক স্টাডি করেছেন, বক্তব্য হলঃবিশ্বজুড়ে সৈন্যদের দ্রুত চলাচলের একটা ভূমিকা ছিল রোগটার প্রসার ঘটানোর ব্যাপারে। গাদাগাদি করে থাকা অবস্থায় চলমান মানুষ আর জিনিসপত্রগুলো নিয়ে গোটা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সটা নিশ্চিত ভাবেই ছিল প্যানডেমিকটা কীভাবে ছড়িয়েছিল সেই ব্যাপারে একটা বিরাট অবদানকারী ফ্যাক্টর।” (“The rapid movement of soldiers around the globe was a major spreader of the disease. The entire military industrial complex of moving lots of men and material in crowded conditions was certainly a huge contributing factor in the ways the pandemic spread.”)[2] 

     

তিনটে ওয়েভের মধ্যে সেকেন্ড ওয়েভটাই ছিল সব থেকে মারাত্মক। এখনকার ইতিহাসবিদের বিশ্বাস, মৃত্যুর হারের দিক থেকে এই ওয়েভটা এতোটা তীব্র হতে পেরেছিল রোগ সৃষ্টিকারী আদি ভাইরাসটার একটা মিউটেশন হওয়া (mutated) উত্তরসূরিতে সঙ্ক্রমিত সৈন্যদের পৃথিবীজুড়ে চলাচলের কারণে। ১৯১৮-র সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর অবধি সময় জুড়ে মৃত্যুর হার বিরাট মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র অক্টোবর মাসেই মৃত্যু হয়েছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষের।[2] মধ্যযুগের সেই Black Death-এর পরে, ছোঁয়াচে রোগে মৃত্যুর হারের দিক থেকে ১৯১৮-র অক্টোবর মাসটা ছিল মার্কিন ইতিহাসে সব থেকে মারাত্মক মাস (deadliest month)        

 

আউটব্রেক থেকে প্যানডেমিক তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ যেহেতু ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সেখানে ভারতবর্ষ কি আক্রান্ত না হয়ে থাকতে পারে, বিশেষ করে তখনও যেহেতু এখানে ব্রিটিশের ঔপনবেশিক শাসন? যুদ্ধে ব্রিটিশ রাজের পক্ষে প্রত্যক্ষ সক্রিয় ভূমিকায় থাকতে হয়েছে ভারতীয় সেনাদেরও। এখানে মহামারীর সূত্রপাতটা ঘটেছিল বম্বেতে, এবং সেটাও সেকেন্ড ওয়েভের পর্যায়টাতে। সেটা শুরু হয়েছিল যুদ্ধ ফেরত ভারতীয় সেনাদের মাধ্যমে। অবশেষে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মৃত্যুর হার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার জনসংখ্যার ৪.% থেকে ৬%-এর মধ্যে। অন্যদিকে দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে, সঙ্ক্রমণ যেখানে পরে ছড়িয়েছিল এবং ইতিমধ্যে তার তীব্রতাও কমতে শুরু করেছিল, এই সংখ্যাটা ছিল ১.% থেকে ৩%-এর মধ্যে। গোটা পৃথিবীর কথা ধরলে, সেকেন্ড ওয়েভটাতে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ২.%। থার্ড ওয়েভটা (ফেব্রুয়ারী ১৯১৯-এপ্রিল ১৯১৯) ছিল তুলনায় কম মারাত্মক। ১৯১৯-এর মে মাসে গিয়ে থার্ড ওয়েভ প্যানডেমিকটা বন্ধ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, তবে সেটা শুধু পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে। জাপানে থার্ড ওয়েভটা শুরু হয়েছিল ১৯১৯-এর একেবারে শেষ দিকে, বন্ধ হয়েছিল ১৯২০ সালে। 

 

এবারে দেখা যাক এই প্যানডেমিক মোকাবিলায় সরকারী ভূমিকাগুলো কেমন ছিল। এখানে প্রথম কথা হল, কোনও ভ্যাকসিন না থাকাতে সঙ্ক্রমণের প্রসার ঠেকাতে নির্ভর করতে হয়েছিল যে উপায়গুলোর ওপরে, সেগুলো ছিল এরকমঃ সঙ্ক্রমিত হওয়ার সন্দেহজনক কেসগুলোর ওপরে নজরদারী (surveillance), স্বেছায় অথবা কোথাও কোথাও বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইন, সঙ্ক্রমিত হওয়ার নিশ্চিত কেসগুলোর আইসোলেশন, পার্সোনাল হাইজিন, বিভিন্ন জায়গাতে জীবাণুনাশক (disinfectants) ছড়ানো, এবং স্কুল, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি বন্ধ রাখা, পাবলিক গ্যাদারিংকের নিষিদ্ধ বা সীমিত করা ইত্যাদি[3][4]। অর্থাৎ ঠিক এখনকার মতোই, সঙ্ক্রমণ প্রসার ঠেকাতে নির্ভর করতে হয়েছিল “non-medical interventions”-এর ওপরে। তবে খুব কম জায়াগাতেই এগুলো কঠোর ভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল।  

 

তাছাড়া, সরকারী স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলোর ভূমিকা ছিল যতো না প্যানডেমিক মোকাবিলা তার থেকেও বেশী ছিল সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হতে বার্তা দেওয়ার, যেমন এবারের প্যানডেমিকের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। মানুষকে আশ্বস্ত থাকার বার্তা দেওয়ার তাড়নায় বিপদকে অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছিল। সেই সময়ে মার্কিন সার্জেন জেনারেল, রুপার্ট ব্লু (Rupert Blue), বলেছিলেন, “সতর্কতাগুলো মেনে চলা হলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।” (“There is no cause for alarm if precautions are observed.”) আর বিশেষ করে যখন যুদ্ধ চলছে, এবং সেটাও আবার বিশ্বযুদ্ধ, সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, নিউজ পেপারগুলোর ওপরে প্যানডেমিক সংক্রান্ত খবর প্রাকাশের ওপরে যথেচ্ছ সেন্সরশিপ চাপানো হয়েছিল। এমন কোনও খবর বা লেখা, যেটা সরকারের যুদ্ধ প্রয়াসের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে হতো, সেরকম কিছু ছাপানো হলে ২০ বছর অবধি হাজতবাসের আইনকে সক্রিয় করা হয়েছিল। এর ফলে প্যানডেমিকটার দ্রুত প্রসারের খবরাখবর ছাপানো হচ্ছিল খুবই কম বা হলেও খুব হাল্কা ভাবে।[1]        

এখানেই বলা দরকার, স্প্যানিস ফ্লু-এর সূত্রপাতটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও রোগটার নামের সাথেস্প্যানিশকথাটা কেন যুক্ত রয়েছে। আসলে এই প্রশ্নেরও উত্তর লুকিয়ে আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই। নিজেদের যুদ্ধ লক্ষ্যপূরণের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও ইতালি সহ যুদ্ধরত সব রাষ্ট্রই সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপরে কমবেশী সেন্সরশিপ জারি করেছিল, এবং সেটা করা হয়াছিল প্যানডেমিকের খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রেও। এখানে স্পেন ছিল ব্যতিক্রম। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সাপেক্ষে সে ছিলনিরপেক্ষ দেশ” (neutral country), যুদ্ধরত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির কোনও পক্ষেই সে ছিল না। তাই সেই দেশে এই প্যানডেমিক কেমন চেহারা নিয়েছিল, সেই সংক্রান্ত তথ্যগুলো তুলনায় অনেক বেশী মুক্তভাবে প্রকাশ করা হচ্ছিল। ১৯১৮-র শেষ দিকে, সেই দেশে এই মহামারীতে কাদের কাদের মৃত্যু ঘটেছে, স্প্যানিশ নিউজ পেপারগুলোর ফ্রন্ট পেজে এমনকী তাঁদের নামও প্রকাশ করা হচ্ছিল। এইসব কারণে অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণার জন্ম হয়েছিল যেনবা এই ফ্লুটার সূত্রপাত ঘটেছিল স্পেন থেকেই। সেখান থেকেই চালু হয়ে যায়স্প্যানিশ ফ্লুকথাটা। পরে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় এই রোগের নাম।[3][8]

 

আগেই আমরা দেখেছি, আউটব্রেকটা শুরু হয়েছিল ১৯১৮-র মার্চের গোরাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে একটা আর্মি ক্যাম্পে, এবং এটাই ইতিহাসবিদদের মধ্যে সাধারণ মত। যদিও পূর্বোক্ত ক্রিস্টোফার ল্যাংফোর্ডের কথাতে প্রথম সঙ্ক্রমণটা হয়েছিল চিনে। তবে ইতিহাসবিদদের মধ্যে এটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই যে, দৃশ্যগোচর প্রথম আউটব্রেকটা শুরু হয়েছিল আমেরিকার পূর্বোক্ত আর্মি ক্যাম্পেই। তারপরে সেটা মহামারীর (epidemic) স্তরকেও ছাড়িয়ে গিয়ে একটা প্যানডেমিকের রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। যুদ্ধ চলেছে যুদ্ধের নিয়মে, যার মূল কথাই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে অস্ত্র ও সৈন্য ক্ষমতার জোরে পৃথিবীর ভূখণ্ডগুলোকে, সেগুলোর শ্রম সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সহ, নিজেদের মধ্যে নতুন করে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া। প্যানডেমিকের কারণে সেটা থামিয়ে দেওয়া হবে, সেই আশা কি আমরা করতে পারি? 

 

পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক জেমস হ্যারিসের কথাতে, গোটা পৃথিবীজুড়ে রোগটা এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম বড় কারণ ছিল সরকারী স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলো চাইছিল না যুদ্ধকালীন সময়ে কোয়ারান্টাইন ব্যবস্থা বলবত করতে। যেমন ব্রিটেনে আর্থার নিউজহোল্ম (Arthur Newsholme) নামে এখন সরকারী অফিসার নাকি খুব ভালো করেই জানতেন কঠোর লকডাউন (strict civilian lockdown) জারি করা ছিল প্রচণ্ড সঙ্ক্রামক ঐ রোগটার প্রসার রোধে সব থেকে ভালো উপায়। কিন্তু যুদ্ধ স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিন্তা থেকে, লকডাউন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র তৈরির ফ্যাক্টরি ওয়ার্কারদের তাঁদের বাড়ীতে আটকে রাখার ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। এই ব্যাপারে হ্যারিস তাঁর এক রিসার্চে জানিয়েছেন, নিউজহোল্ম সাফাই গেয়েছিলেন এই কথা বলে যে, “যুদ্ধ চালানোর নিরন্তর প্রয়োজনগুলো সঙ্ক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি নেওয়াকে ন্যায্যতা দিয়েছিল।” (“the relentless needs of warfare justified incurring [the] risk of spreading infection”)      

 

প্যানডেমিক মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম সমস্যা তৈরি হয়েছিল আরও একটা কারণেঃ প্রয়োজন মতো নার্সের সংখ্যার বিরাট অভাব। আর সেই অভাবটা তৈরি হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল যুদ্ধের প্রয়োজনে হাজার হাজার নার্সকে মিলিটারি ক্যাম্প আর ফ্রন্ট লাইনগুলোতে নিয়োগ করা হয়েছিল। অভাবটা প্রকট হয়ে উঠেছিল আরও একটা কারণেঃ American Red Cross কিছুতেই রাজী ছিল না ট্রেনিং থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকান আমেরিকান নার্সদের প্যানডেমিক মোকাবিলার কাজে নিয়োগে, অন্তত সেই সময় পর্যন্ত যখন প্যানডেমিকের সব থেকে খারাপ অবস্থাটা কেটে গেছে। তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছিল জার্মান বন্দী সেনাদের (prisoner of war) সেবার কাজে।[2]       

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী Centers for Disease Control and Prevention (CDC) তখনও কিন্তু গঠিত হয়নি। এটা গঠিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১ জুলাইয়ে। এরকম একটা অবস্থাতে, একেক সিটিতে একেক মাত্রার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।[1] কিছু কিছু জায়গাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল মিউনিসিপালিটিগুলো থেকে। স্কুল, চার্চ, থিয়েটার, সেলুন, এরকম জায়গাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে সান ফ্রান্সিস্কো সিটিতে, কোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়নি কিন্তু কোর্ট সেশনগুলো চালানো হয়েছিল পাবলিক স্কোয়ারগুলোতে, এবং সিটিজেনরা মাস্ক (protective gauze masks) না পরে বাইরে বেরোলে ৫ ডলার ফাইন অথবা এমনকী জেইল হওয়ার ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছিল। এই কথা লিখে সরকারী ভাবে পোস্টার দেওয়া হয়েছিলঃ “Obey the laws, and wear the gauze.” 

      

নিউ ইয়র্ক সিটিতে নেওয়া হয়েছিল অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত। স্কুলগুলো চালু রেখে দেওয়া হয়েছিল এই যুক্তি দিয়ে যে, বাড়ীতে থাকার তুলনায় বাচ্চারা তুলনায় নিরাপদ থাকবে স্কুল নার্সদের ঘেরাটোপের মধ্যে। খোলা রেখে দেওয়া হয়েছিল অন্যান্য পাবলিক ভেন্যুগুলোও। আর বিজনেস ও ফ্যাক্টরিগুলোর ক্ষেত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ওপেনিং ও ক্লোসিং আওয়ারগুলোকে এমন ভাবে রাখার যাতে সাবওয়ে ট্রেনগুলোতে রাশ-আওয়ারে ভিড় হয় কম। 

    

ফিলাডেলফিয়াতে হয়েছিল সব থেকে খারাপ অবস্থা। কারণ, সেখানকার পাবলিক হেলথ ডিরেক্টর চিকিৎসকদের আবেদনকে উপেক্ষা করে সরকারী ওয়ার বন্ড (government war bonds) সেলকে প্রোমোট করার একটা প্যারেড, যুদ্ধের খরচ তুলতে, বাতিল করতে রাজী হননি। যার ফলে সেই প্যারেডে প্রায় ২ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। ফলাফল দাঁড়িয়েছিল, “More Deadly Than War: The Hidden History of the Spanish Flu and the First World War” নামে বইয়ের লেখক কেনেথ ডেভিসের (Kenneth C. Davis) কথাতে, “তিন দিন বাদে সিটির হসপিটালগুলোতে প্রত্যেকটা বেডই ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। একটা ফাংশনিং সিটি হিসাবে ফিলাডেলফিয়া চলে গিয়েছিল প্রায় টোটাল কলাপ্সের মুখে।” (“Three days later every bed in the city’s hospitals was filled. Philadelphia was almost on the verge of a total collapse as a functioning city.”) [এখানে বলে রাখা ভালো যে, এই বইটি পড়ার সুযোগ আমার হয়নি, কারণ অনেক খুঁজেও কোনও  পিডিএফ কপি আমি পাইনি, অথচ পড়ার খুব আগ্রহ ছিল।]   

 

এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, মধ্যযুগের Black Death-এর পর, মহামারীর দিক থেকে মার্কিন ইতিহাসেসব থেকে মারাত্মক মাসহয়ে ওঠা  ১৯১৮-র অক্টোবরের কঠিন দিনগুলো দ্রুত কেটে গেলেও সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রোগটা আবার দেখা দিয়েছিল। কারণ ঐ মাসের ১১ নভেম্বরে যুদ্ধ সমাপ্ত ঘোষণা উদযাপনে আমেরিকার রাজপথগুলো জনতার ভিরে ভরে উঠেছিল। 

     

দুঃখজনক ব্যাপার হল, এতো বড় একটা বিশ্বব্যাপী মহামারীর ঘটনা খুব দ্রুতই কিন্তু ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যেতে থেকেছে। আর এখন তো আমরা ১০০ বাদে। পূর্বোক্ত ডেভিসের কথাতে, “It fell into this black hole of history.” আমরা জানি ব্ল্যাক হোলের গর্ভে কিছু চলে গেলে তাকে ফিরে পাওয়া আর সম্ভব নয়। ডেভিসের কথাতে, স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাসও খুব দ্রুতই সেরকম এক গর্ভে হারিয়ে গেছিল। কথাটা তিনি বলেছিলেন প্যানডেমিক পরবর্তী মার্কিন জনগণ প্রসঙ্গে। এই ব্যাপারে তাঁর পর্যবেক্ষণ হলঃআঘাতপ্রাপ্ত পরিবারগুলো এই [প্যানডেমিকের] ব্যাপারে কখনোও আলোচনা করেছে বলে মনে হয় না, হয়তো এই কারণে এটা ছিল এতোই সাংঘাতিক যে কেউই আর এটা নিয়ে ভাবতে চাইছিল না। দেশটাও সেই ভাবেই  এটাকে ডিল করেছিল।” (“Impacted families never seemed to talk much about it, perhaps because it was so terrible that no one wanted to think about it again. That’s the way the country also dealt with it.”)[1]  

 

তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম অবস্থা তৈরি হয়েছিল শুধু প্যানডেমিকের ভয়াবহতার কারণে নয়। এটা ছিল বিশ্বযুদ্ধ ও প্যানডেমিক এই দুইয়ে মিলে তৈরি হওয়া ভয়ঙ্কর স্মৃতির এক অনুচ্চারিত অভিব্যক্তি। এখানে ডেভিসের এই কথাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেটার সাথে COVID-19 প্যানডেমিক থেকে তৈরি বর্তমান পরিস্থিতির যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যাবেঃফ্লু আর যুদ্ধের সমন্বয় আমেরিকানদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল বৃহত্তর পৃথিবীতে কী রয়েছে সেই ব্যাপারে, তাই বিদেশী উপাদানগুলোকে বাইরে রেখে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী দেশ হয়ে ওঠার ধারণা ক্রমশ বেড়ে চলেছিল।” (“The combination of the flu and the war made Americans afraid of what was out there in the wider world, so there was a growing notion of becoming an isolationist country and keeping out foreign elements.”) 

          

পাচ্ছি না এখানে আমরা বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মিল? COVID-19 সৃষ্ট প্যানডেমিক অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী জিগিরকে কি বাড়িয়ে তোলেনি? বিশেষ করে আমেরিকা, চিন ও ভারত কি সেটাই দেখাচ্ছে না? এরকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অনিবার্য ছিল কি না, তখনও এবং এখনও, সেটা অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ডেভিসের এই কথাটাও এখানে উল্লেখ করে রাখা দরকারঃএটা সমন্বয় ঘটিয়েছে বিরাট আতঙ্কের পর্যায়ের - কম্যুনিজম, বলশেভিজম ও সোশ্যালিজমের আতঙ্ক। Ku Klux Klan-এর একটা মারাত্মক বিকাশ ঘটেছে কারণ যা কিছু বিদেশী তাই নিয়ে মানুষ আতঙ্কিত ছিল। গোটা আঞ্চলিকতাবাদী তাড়নাটায় ইন্ধন জুগিয়েছিল মানুষের মধ্যে ফ্লু আর যুদ্ধ সৃষ্ট ভয়।” (“It combines for a period of great fear—fear of communism, bolshevism and socialism. There’s a tremendous growth of the Ku Klux Klan because people were afraid of what was foreign. The whole nativist impulse was fed by people’s fear generated by flu and war.”) [কু ক্লুক্স ক্লান হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী, এখনও যার অস্তিত্ব রয়েছে।]  

 

এখনকার সাথে স্প্যানিশ ফ্লু প্যানডেমিক পর্বটার আরও একটা মিল আমরা খুঁজে পাবো। সেটা হল এই ফ্লু-এর উদ্ভবের প্রশ্নকে ঘিরে গুজব (rumours) ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (conspiracy theories)। গুজব ছড়ানো হয়েছিল, এটা নিশ্চয়ই কোনও শত্রুপক্ষের কাজ। সন্দেহের তির ছিল জার্মানির দিকে। যেমন এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যে, কাইজারের ইউ-বোটগুলো (U-boats) হয়তো আমেরিকার বন্দরগুলোতে কোনও বিষাক্ত পদার্থ ছেড়ে দিয়ে গেছে, অথবা জার্মানির ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি Bayer হয়তো তার তৈরি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেটে বিষাক্ত কিছু মিশিয়েছে।[1] এখন কোনও বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে না, তবুও নয়া কোরোনাভাইরাসটার আবির্ভাব সম্পর্কে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছে প্রবল ভাবে; অর্থাৎ এই তত্ত্ব যে, এটা মোটেই কোনও প্রাকৃতিক (natural) ভাইরাস নয়, মানুষের তৈরি (man-made), নিশ্চয়ই চিনের ঐ উহান ল্যাবে এই ভাইরাসটা তৈরি করা হয়েছে (engineered) প্রতিপক্ষ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জৈবাস্ত্র (bio-weapon) হিসাবে। বিশ্বের বিজ্ঞানী মহল অবশ্য এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে স্রেফ খারিজ করে দিয়েছে। এখন কোনও বিশ্বযুদ্ধ না থাকা সত্ত্বেও এরকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যদি এতো ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হতে পারে, তাহলে সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একইরকম হওয়ার মধ্যে অবাক হওয়ারও কিছু নেই, জাতি বিদ্বেষ ও জাতীয়তাবাদের হাওয়া যখন অত্যন্ত প্রবল। বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও গুজগুলো সেই সময়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারার অন্যতম বড় কারণ ছিল ভাইরাস সম্পর্কিত বিজ্ঞানও ছিল সেই সময়ে অজানা। এই ব্যাপারে অবস্থাটা ছিল এমনই যে, U.S. Navy Bureau of Sanitation এই বলে রিপোর্ট দিয়েছিল যে স্প্যানিশ ফ্লু রোগটার জন্ম ব্যাকটেরিয়া থেকে, এবং সঙ্ক্রমণ মুক্ত হতে পরামর্শ হিসাবে বলেছিল, “fresh air and sunshine kill the germ in a few minutes.”

 

অনেক দিন ধরেই সায়েন্টিস্টদের জানা ছিল না কী থেকে এই রোগের উদ্ভব। অক্টোবর ১৯১৮-তে, Pasteur Institute-এর দুই সায়েন্টিস্ট প্রথম এই অনুমান (hypothesis) হাজির করেছিলেন যে, ফ্লুটার সঙ্ক্রামক এজেন্ট (infectious agent) হিসাবে দায়ী অতি ক্ষুদ্র আকারের এক প্যাথোজেনঃ ভাইরাস। তবে একমাত্র ১৯৩০ সালে গিয়েই এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়েছিল, এবং ১৯৩৩ সালে প্রথম human influenza virus-কে আইসোলেট করা হয়েছিল।

 

Hong Kong Flu (1968-1970)

এই প্যানডেমিকটার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৮-র জুলাই মাসে। অর্থাৎ এটা ছিল স্প্যানিশ ফ্লুর পঞ্চাশ বছর বাদের ঘটনা। এটা স্থায়ী হয়েছিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। এটাও ছিল একটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ঘটিত প্যানডেমিক। মৃত্যু্র সংখ্যা ছিল ১০ লাখ থেকে ৪০ লাখের মধ্যে। শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১ লাখ মানুষের।[9]

 

এটা ছিল আসলে স্প্যানিশ ফ্লু পরবর্তী গত শতকের তৃতীয় প্যানডেমিক। অর্থাৎ মাঝে আরও একটা ঘটনা ছিল। সেটা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, যেটা ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে এশিয়ান ফ্লু নামে। মনে করা হয়ে থাকে, যে ভাইরাস থেকে এই এশিয়ান ফ্লুর উদ্ভব হয়েছিল, সেটার বিবর্তনই (evolution) ১০ বছর বাদে নতুন করে তার আবির্ভাব ঘটিয়েছিল এবং হংকং ফ্লুর জন্মটা ছিল তারই ফল।  

 

Image Source: Medium(please Visit)

হংকং ফ্লু-এর প্রকোপকটা অবশ্য স্প্যানিশ ফ্লুর মতো অতোটা মারাত্মক (deadly) ছিল না কিন্তু তুলনায় ছিল অনেক বেশী ছোঁয়াচে। হংকং-এ প্রথম কেসটা রিপোর্টেড হওয়ার মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যেই প্রায় ৫ লাখ মানুষ সঙ্ক্রমিত হয়েছিল। বিশেষ করে এই প্যানডেমিকটাই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রকোপগুলোর প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরির তাগিদের জন্ম দিয়েছিল 

  

এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার গত ২৫ মে ২০২০-তে বিশ্ব বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল The Lancet-এ প্রকাশিত এই  লেখাটাঃ “Revisiting the 1957 and 1968 influenza pandemics”[10] লেখকের নাম মার্ক হনিগসবম (Mark Honigsbaum)। তিনি একজন মেডিক্যাল হিস্টরিয়ান। লেখাটাতে বলা হয়েছে, ১৯৫৭-র এপ্রিলে হংকং-এ একটা বড় মাপের প্যানডেমিকের সূত্রপাত ঘটেছিল, প্রায় ২,৫০,০০০ মানুষ সঙ্ক্রমিত হয়েছিল, এরপরে সেটা ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং জুনের শেষ দিকে এখানে সঙ্ক্রমণের সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১০ লাখের ওপরে। এরপরে খুব দ্রুতই গ্রেট ব্রিটেনেও রোগটার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং স্কটল্যান্ডে আউটব্রেকের ঘটনা রিপোর্টেড হয়। ভাইরাসটার বিপদ সম্পর্কে চিকিৎসক মহল থেকে সরকারকে সতর্ক করা হয় এবং এর মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয় গড়ে তোলার পরামর্শও দেওয়া হয়। কিন্তু হলে কী হবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কোনও নড়চড় হয়না, বরং এর বদলে ভাইরাসটাকে তার নিজের পথে চলার সুযোগ দেওয়া হয়। (“… the ministry of health demurred. Instead, the virus was permitted to run its course.”)    

 

১৯৫৭-র আউটব্রেকটাও হয়েছিল একটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকে। কিন্তু The Lancet-এ প্রকাশিত পূর্বোক্ত লেখা অনুযায়ী, সেই সময়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারেননি এটা কোনও নয়া ভাইরাস (“a new pandemic strain”) নাকি ১৯১৮-১৯-এর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসেরই একটা উত্তরসূরী (“a descendant of the previous 1918–19 pandemic influenza virus”)। ইতিহাসেএশিয়ান ফ্লুনামে পরিচিত হয়ে থাকা সেই প্যানডেমিকটা ১৯৫৭-র এপ্রিলে গিয়ে থেমে গিয়েছিল; কিন্তু সেই সময়ে ইউকে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে ২০ হাজার ও ৮০ হাজার, আর গোটা পৃথিবীতে ১০ লাখেরও বেশী।  

১৯৬৮ সালে পরবর্তীহংকং ফ্লু”-তে, পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে যেটাকেমাও ফ্লুনামেও আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, ইউকে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছিল যথাক্রমে ৩০ হাজের ও ১ লাখেরও বেশী মানুষের। অথচ ডিসেম্বরে আউটব্রেকটা যখন তার সর্বোচ্চ স্তরে, তখনও স্কুলগুলোকে বন্ধ করা হয়নি এবং ব্যবসায়িক কার্যকলাপকেও বেশীর ভাব ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক মতোই চলতে দেওয়া হয়েছে।     

 

The Lancet-এ প্রকাশিত উপরোক্ত লেখাটাতে এইসব তথ্য দেওয়া হলেও লেখক নিজে কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের সেই সময়কার ভূমিকাকে সমালোচনা করেননি। বরং সরকারী অবস্থানের যৌক্তিকতা বোঝাতে লন্ডনের St Thomas’ Hospital-এ সেই সময়কার তরুন এক মেডিক্যাল স্টুডেন্টের সাম্প্রতিক এক লেখা থেকে তিনি এই তথ্য তুলে ধরেন যে, ১৯৫৭ সালে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট তখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি এবং ভেন্টিলেটর টেকনোলজিও ছিল আদিম অবস্থায়। এই তথ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, এরকম অবস্থায় সঙ্ক্রমণ প্রতিরোধের কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বাড়তি খুব কিছু লাভ হতো বলে তাঁর মনে হয় না। এই কথাগুলো তিনি বলেছেন আজকের সেইসব সমালোচনার জবাবে যেগুলোতে বলা হয়েছে COVID-19 প্যানডেমিকের মোকাবিলার প্রশ্নে ইতিহাসের শিক্ষাকে সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া হয়েছে। যেমন তাঁর লেখাতে উল্লেখ করা হয়েছে The Guardian (6 March 2020) পত্রিকাতে প্রকাশিত এক লেখার কথা। সেই লেখাতে বলা হয়েছিল, “When hysteria is rife, we might try some history.”[11] মোদ্দা বাংলায় এই কথাটার মানে হল, এতো ইতিহাস যখন আমাদের সামনে রয়েছে, আমাদের উচিৎ সেগুলোকে কাজে লাগানো। The Lancet-এ প্রকশিত লেখাটির লেখক কিন্তু এই কথাটা মানতে চাননি। এছাড়াও তাঁর লেখাতে উল্লেখ করা হয়েছে The Wall Street Journal (24 April 2020)-এ প্রকাশিত এক লেখার কথা। সেটাতে বলা হয়েছিল, “[১৯৬৮-] প্যানডেমিকটা তিন বছর ধরে চলেছে, তা সত্ত্বেও অনেকটাই আজ ভুলে যাওয়া হয়েছে, যেটা হল একটা একই রকমের সঙ্কটকে সমাজ এখন যেভাবে অনেকটা অন্যভাবে মুখোমুখি হচ্ছে তারই সাক্ষ্য।” (“The [1968] pandemic raged over three years, yet is largely forgotten today, a testament to how societies are now approaching a similar crisis in a much different way.”)[12]   

            

COVID-19 মোকাবিলায় ব্যর্থতার সমালোচনায় ইতিহাসকে এভাবে তুলে ধরাকে সমর্থন না করা হলেও, এই লেখাতে এই তথ্যও কিন্তু দেওয়া হয়েছে যে সেই সময়েও ব্রিটিশ সরকারের উদাসীনতা নিয়ে চিকিৎসক মহল থেকে সমালোচনা ছিল। যেমন ১৯৫৭-র জুনে, British Medical Journal-এ ডক্টর কিচিং-এর (Dr Kitching) লেখা এক চিঠি থেকে এই কথাটা উদ্ধৃত করা হয়েছেঃজনগণ মনে হয় এই ধারণা নিয়ে আছে যে দুর্যোগটা প্রতিহত করতে কিছুই করার নেই যেটার বিপদ রয়েছে সুদুর প্রাচ্যে এগিয়ে চলার। উল্টে বরং সরকার করতে পারে এরকম অনেক কিছুই আছে; সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্ট করার মধ্যে দিয়ে কয়েক লক্ষ্য জীবন তারা বাঁচাতে পারে।” (“The public seems under the impression that nothing can be done to prevent the calamity that is threatened by the advance of influenza in the Far East. On the contrary there is a great deal that the Government can do; by acting at once they may save hundreds of thousands of lives.”)

 

এই চিঠিটার উল্লেখ দিয়ে লেখক এরপরে নিজেও লিখেছেন, “কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রক শুনছিল না। কারণ, লেখকের কথাতে, প্যানডেমিকটার ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে “prominent warning” ইস্যু করা হলে প্রেস একেবারে হামলে পড়তো (“would have a field day”) - অর্থাৎ সেটাকে এতো ভয়ঙ্কর ভাবে মানুষের কাছে হাজির করতো যে আতঙ্ক ছড়াতো - তাই সেটা না করে স্বাস্থ্য মন্ত্রক লোকাল মেডিক্যাল অফিসারদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ।

 

HIV/AIDS (1981-2018)

১৯৮০-র দশকে এবং ১৯৯০-এর দশকের গোরার দিকে AIDS রোগটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বাকী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথম কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল ১৯৮১ সালে। তারপর থেকে শুধু সঙ্ক্রমিত মানুষের সংখ্যা নয়, মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমাগত বেড়েছে। WHO-র দেওয়া অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে মোট প্রায় ৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষ HIV ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের। ২০১৮ সালে পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ (৩ কোটি ২৭ লাখ থেকে ৪ কোটি লাখ রেঞ্জের মধ্যে) HIV ভাইরাস নিয়ে বেঁচে থেকেছে। আফ্রিকাই হল সব থেকে বেশী আক্রান্ত মহাদেশ। সেখানে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি ২৫ জন পিছু ১ জন মানুষ এই ভাইরাস নিয়ে বেঁচে আছে, যেটা গোটা পৃথিবীতে এরকম মানুষের সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী।[13]

 

সবাই আমরা জানি HIV আক্রমণ করে মানুষের ইমিনিউটি সিস্টেমকে, বিশেষ করে মানুষের শরীরে একটা বিশেষ কোষকে (CD4 cells)। ভাইরাসটা শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রকমের bodily fluids-এর মাধ্যমে, যেমন ব্লাড, সিমেন (বীর্য), ব্রেস্ট মিল্ক ইত্যাদি। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে ভাইরাসটার প্রসার ঘটেছে অসুরক্ষিত যৌনসঙ্গম (unprotected sex), ইঞ্জেকশনের জন্য একই ছুঁচ (needles) বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা এবং জন্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ক্রমান্বয়ে এই ভাইরাসটা একটা মানুষকে এতোদূর অবধি আক্রান্ত করে ফেলে যে শরীরের তখন আর ক্ষমতা থাকে না সঙ্ক্রমণ ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের, অবশেষে পরিণতি দাঁড়ায় সব থেকে মারাত্মক একটা HIV ইনফেকশনঃ AIDS

 

Image Source : NIH

এখনও পর্যন্ত এই রোগ থেকে আরোগ্যলাভের (cure) কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে কিছু চিকিৎসা আছে, যেগুলো সঙ্ক্রমিত হওয়ার একেবারে প্রথম দিকে শুরু করা হলে সঙ্ক্রমিত না হওয়া মানুষদের মতো প্রায় একই সময় ধরে বেঁচে থাকা যেতে পারে। ২০১৯ সালে মেডিক্যাল জার্নাল Lancet-এ দেখানো হয়েছিল, এক ধরনের অ্যান্টি-ভাইরাল ট্রিটমেন্ট HIV-র প্রসারকে যথেষ্ট রোধ করতে পারে।[14]

 

এই ভাইরাসটার উদ্ভব কোথা থেকে? COVIV-19 প্যানডেমিক থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তরের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। জানা গেছে, HIV-র অরিজিন হল শিম্পাঞ্জি এবং Simian Immunodeficiency Virus (SIV) নামে HIV-র মতো একটা ভাইরাস, যেটা বনমানুষ (apes)   বাঁদরদের ইমিউন সিস্টেমকে অ্যাটাক করে। 

 

কিন্তু মানুষ কীভাবে আক্রান্ত হল? এই ব্যাপারে সায়েন্টিস্টদের ধারণা হল, আফ্রিকার শিকারী মানুষেরা হয়তো SIV ভাইরাসে (SIVcpz) সঙ্ক্রমিত শিম্পাঞ্জিদের মাংস খেয়েছিল অথবা সেইসব শিম্পাঞ্জিদের সঙ্ক্রমিত রক্ত তাদের রক্তে গিয়ে মিশেছিল তাদের কোনও ক্ষতস্থানের মধ্য দিয়ে। গবেষকদের বিশ্বাস, মানুষের শরীরে SIV থেকে HIV ট্রান্সমিশনটা প্রথমে হয়েছিল ১৯২০ সালে কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসাতে এবং এটা থেকেই অবশেষে প্যানডেমিক তৈরি হয়েছিল। 

  

১৯৬০ সালে, HIV ছড়িয়ে পড়েছিল আফ্রিকা থেকে হাইতি ও ক্যারিবিয়ানে। কঙ্গো তখন ছিল বেলজিয়াম শাসিত একটা ঔপনিবেশিক দেশ। হাইতির প্রফেশনালরা কঙ্গো থেকে নিজেদের দেশে ফেরার মধ্য দিয়েই HIV সেখানে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপরে ১৯৭০ নাগাদ, ক্যারিবিয়ানে থেকে HIV প্রবেশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে এবং পরবর্তী দশকে ক্যালিফোর্নিয়া ও সান ফ্রান্সিস্কোতে।[14][15] এরপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলের মাধ্যমে। 

 

হেলথ অফিসিয়ালরা AIDS-এর ব্যাপারে প্রথম ওয়াকিবহাল হয়েছিলেন ১৯৮১-র গ্রীষ্মের সময়ে। লক্ষ করা যাচ্ছিল, লস এঞ্জেলস ও নিউ ইয়র্কে তরুন ও স্বাস্থ্যবান সমকামী পুরুষরা একটা অজানা কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং মৃত্যুও ঘটছে। ঐ বছরেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Centers for Disease Control and Prevention (CDC) একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেটাতে বলা হয়েছিল, প্রায় পাঁচজন সমকামী পুরুষ, যাঁরা আগে স্বাস্থ্যবান ছিলেন, এক ধরনের নিউমোনিয়াতে (Pneumocystis pneumonia) সঙ্ক্রমিত হয়েছেন। রিপোর্টে এই কথাও বলা হয়েছিল যে, ইমিউন সিস্টেম অসুরক্ষিত না থাকা (uncompromised immune systems) মানুষেরা প্রায় কখনোই এই ধরনের নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয় না। 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে AIDS-এর আগমন ১৯৭০-এর দশকে হলেও, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টা খবর হয়েছিল অনেক পরে। কারণ সঙ্ক্রমিতের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলতে থাকলেও মিডিয়া হাউস থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে এটাকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যদিও জুলাই ১৯৮১-তে, প্রথমে The New York Times পত্রিকা এই ব্যাপারে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। কিন্তু বড় আকারে ফ্রন্ট পেজে খবরটাকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল আরও অনেক পরে, ২৫ মে ১৯৮৩-তে। ইতিমধ্যেই এই রোগে প্রায় ৬০০ জনের মৃত্যু ঘটে গেছে। আর ১৯৮৪-র শেষে, এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল অন্তত ৭,৭০০ এবং মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩,৫০০-র ওপরে।  

 

হেলথ এক্সপার্টরা ১৯৮৩ সালেই উপলব্ধি করেছিলেন বিষয়টা কতো সিরিয়াস এবং এর প্রতিরোধে দরকার দ্রুত সরকারী তৎপরতা। কিন্তু সরকারী মহল তখনও ছিল এই প্রশ্নে নীরব ও উদাসীন। সেই কারণে AIDS সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় রিসার্চে যথেষ্ট ফান্ডিংও পাওয়া যায়নি। অথচ সায়েন্টিস্টরা ইতিমধ্যেই AIDS রোগের কারণ (অর্থাৎ HIV) চিহ্নিত করে ফেলেছন। কিন্তু ১৯৮৫-র সেপ্টেম্বরের আগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন রোনাল্ড রেগন, সরকারী মহল থেকে প্রকাশ্যে AIDS কথাটার উল্লেখ পর্যন্ত হয়নি। সেই সময়ে এসে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫-তে) তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে AIDS-এর উল্লেখ করেন, একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে। AIDS প্রতিরোধে সরকার যে যথেষ্ট তৎপর, এবং এই সংক্রান্ত রিসার্চে ফান্ডিং-এর প্রশ্নেও, সেটা বোঝাতে তিনি বলেছিলেন, ইস্যুটা সরকারের কাছে একটা “top priority”। কিছু দিন বাদে (২ অক্টোবরে), মার্কিন কংগ্রেস থেকে প্রায় ১৯ কোটি ডলার বরাদ্দ করা হয় রিসার্চের কাজে।

 

ইস্যুটা অবশেষে সরকারী গুরুত্ব পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল কিছু হাই প্রোফাইল সেলিব্রিটির মৃত্যু। যেমন ঐ একই দিনে, এই রোগে মৃত্যু হয়েছিল অভিনেতা রক হাডসনের (Rock Hudson), যিনি আবার ছিলেন রেগনের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাভাবিক যে, ইস্যুটা অবশেষে গুরুত্ব পেয়েছিল শুধু তিনি রেগনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার কারণে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই মৃত্যুর খবরটা AIDS-এর বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট আতঙ্ক তৈরি করেছিল বলে। 

 

১৯৮৬ সালে, আমেরিকার Institute of Medicine/National Academy of Science এবং রেগনের সার্জেন জেনারেলের (C. Everett Koop) তরফ থেকে এক রিপোর্টে AIDS প্রতিরোধের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয়কারী কর্মসূচির পক্ষে অভিমত জানানো হয়। চাপে পড়ে মহামারীটার অনুসন্ধানের কাজে রেগন প্রশাসন থেকে একটা কমিশন তৈরি করা হয়, এবং ১৯৮৭-র শেষ দিকে গিয়ে AIDS সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর কাজে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে HIV সঙ্ক্রমিত মানুষের সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪৭ হাজার 

 

প্রসঙ্গত, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রোগটা যেহেতু দেখা গিয়েছিল সমকামী পুরুষদের মধ্যে, তাই সরকারী মহল থেকে প্রথম দিকে রোগাটাকে উল্লেখ করা হচ্ছিল “gay-related immune deficiency” (GRID) নামে। সেই কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রোগটাকে কেবল সমকামী পুরুষদের রোগ হিসাবেই দেখা শুরু হয়েছিল। যেসব রুট ধরে রোগটা ছড়িয়েছিল সেগুলোকে আবিষ্কার করাই শুধু নয়, রোগটা যে AIDS-পজিটিভ পুরুষদের যৌন সঙ্গিনীদেরও (female partners) সঙ্ক্রমিত করতে পারে, ১৯৮৩ সালে CDC-র পক্ষে থেকে সেগুলো আবিষ্কৃত হলেও বহু বছর ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে চল ছিল রোগাটাকে এমনকী “gay plague” নামে উল্লেখ করা। রোগটাকে AIDS নামে উল্লেখ করা হয়েছিল প্রথমে CDC-র পক্ষ থেকেই, ১৯৮২-র সেপ্টেম্বরে। সেই বছরের শেষে, কয়েকটা ইউরোপীয়ান দেশ থেকেও AIDS কেসের রিপোর্ট এসেছিল। তখনও কিন্তু এই রোগের কারণ (অর্থাৎ HIV ভাইরাস) চিহ্নিত হয়নি। সেটা হয়েছিল ১৯৮৪-র সেপ্টেম্বরে।

 

AIDS প্রতিরোধে দেশের জন্য প্রথম একটা প্ল্যান CDC তৈরি করেছিল ১৯৮৫-র গোরাতে। সেই প্ল্যান তৈরির কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ফ্রান্সিস (Donald Francis) নামে একজন মহামারী বিশারদ (epidemiologist)। কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫-তে, সরকারী লীডাররা সেই প্ল্যানকে অবশেষে বাতিল করে দিয়েছিল। অনেক বছর বাদে Journal of Public Health Policy-তে লেখা তাঁর একটা আর্টিকেলে ফ্রান্সিস জানিয়েছিলেন, AIDS-এর জন্য CDC-র সেন্ট্রাল কোঅর্ডিনেটর এবং AIDS Task Force-এর চেয়ারম্যান, ডক্টর জন বেনেট (Dr. John Bennett), তাঁকে বলেছিলেন, “ডন, প্ল্যানটাকে তাঁরা বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘ভাব দেখাও ভালোই আছি এবং যতোটা কম পারো করো” (“Don, they rejected the plan. They said, ‘Look pretty and do as little as you can.’”)  

  

তবে মার্কিন প্রশাসনের Health and Human Services (HHS) ডিপার্টমেন্টের এজেন্সি Food and Drug Administration (FDA) ১৯৮৫ সালে প্রথম HIV-র জন্য কমার্শিয়াল ব্লাড টেস্টের লাইসেন্স ইস্যু করেছিল। এরপরে ১৯৮৮ সালে, WHO থেকে প্রতি বছরের ১ ডিসেম্বরকে World AIDS Day হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এইসব আপাত তৎপরতা সত্ত্বেও ঐ দশকের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ১ লাখ AIDS কেস রিপোর্টেড হয়, আর গোটা পৃথিবীতে কেসের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় ৪ লাখ।

এরপরে ১৯৯৪ সালে, FDA থেকে প্রথম HIV-র নন-ব্লাড টেস্টের (oral test) অনুমোদন দেওয়া হয়। দুবছর বাদে অনুমোদন দেওয়া হয় হোম টেস্ট কিট ও ইউরিন টেস্টের।

 

প্রসঙ্গত, red ribbon-কে AIDS সম্পর্কিত সচেতনতার একটা ইন্টারন্যাশনাল সিম্বল হিসাবে চালু করা হয়েছিল এগুলোর কিছু আগে, ১৯৯১ সালে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, নতুন কিছু ওষুধপত্র এবং HAART চালু হওয়ার দৌলতে উন্নত দেশগুলোতে ১৯৯৫- AIDS সম্পর্কিত মৃত্যু ও হসপিটালাইজেশন বিরাট হারে কমে যেতে শুরু করলেও, ১৯৯৯-এ গিয়েও AIDS ছিল আফ্রিকাতে মৃত্যুর সব থেকে বড় কারণ এবং গোটা পৃথিবীতে চতুর্থ বৃহত্তম কারণ।

 

এরপরে AIDS চিকিৎসায় আরও কিছু অগ্রগতি ঘটে। ২০০১ সালে কিছু কিছু জেনেরিক ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারার্স HIV-র পেটেন্ট প্রাপ্ত ড্রাগ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কম দামে বেচা শুরু করে, যার ফলে কয়েকটা বড় ওষুধ কোম্পানিও তাদের তৈরি ড্রাগের দাম কমিয়ে দেয়। এর পরের বছরেই HIV/AIDS-এর ব্যাপারে সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের যৌথ কর্মসূচি, Joint United Nations Programme on HIV/AIDS (UNAIDS), এই কথা জানিয়ে রিপোর্ট করে যে, সাব-সাহারান আফ্রিকাতে AIDS ছিল তুলনামূলক ভাবে মৃত্যুর সব থেকে বড় কারণ। ২০০৯ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা HIV-পজিটিভ লোকেদের তাঁদের দেশে প্রবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, যেটা চালু করা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে।

 

এই মহামারী থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার এই ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ ডক্টর পিটার ডাসজাকের (Dr. Peter Daszak) কিছু কথা। তিনি হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক এক সংস্থা Eco Health Alliance-এর প্রেসিডেন্ট। গত ১ ডিসেম্বর ২০১৭-তে প্রকাশিত তাঁর এক লেখাতে[16] তিনি জানিয়েছিলেন, তখনও পর্যন্ত জানা থাকা মানুষের রক্তে HIV সঙ্ক্রমণের প্রথম কেস ছিল ১৯৫৯ সালে নেওয়া বেলজিয়াম শাসিত কঙ্গোতে এক রুগীর একটা স্যাম্পল, যিনি মারা গিয়েছিলেন। AIDS অতিমারী থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐ ১৯৫৯ সময়টাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত পিটার ডাসজাকের কথা মতো। তিনি লিখেছিলেনঃএই সত্যটাই আমাকে রাতজাগা করে রাখে। কল্পনা করুন, এক মুহূর্তের জন্য, যে ১৯৫৯ সালের ঐ স্যাম্পলটাতে HIV ভাইরাসকে স্টাডি করা হয়েছিল এবং চিহ্নিত করা হয়েছিল। যদি, ১৯৫০-এর দশকে, বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় উপলব্ধি করতো সম্ভাব্য কেমন ক্ষতি এই নয়া ভাইরাসটা করতে পারে। আমরা তাহলে কী করতে পারতাম? মানব ইতিহাসে এটা সব থেকে মারাত্মক অতিমারীগুলোর অন্যতম হয়ে ওঠার আগেই কী থেরাপি আমরা তৈরি করতে পারতাম? এই সময়ের মধ্যে একটা আরোগ্য কি আমরা পেতাম? কল্পনা করুন আরও পিছনে আমরা ফিরে গেছি সেইখানে পৌঁছোতে যখন একজন শিকারি একটা সদ্য হত্যা করা শিম্পাঞ্জির মাংস কেটেছিল এবং ভাইরাসটা আমাদের প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রথম প্রবেশ করেছিল।” (“It’s this fact which keeps me awake at night. Imagine, for a moment, that the HIV virus in that 1959 sample had been studied and identified. If, in the 1950s, the scientific community realized the potential harm this new virus could unleash. What could we have done? What therapies could we have developed before it became one of the deadliest pandemics in human history? Would we have a cure by now? Imagine if we could travel back even further to be there when a hunter chopped into the flesh of a freshly killed chimpanzee and the virus slipped into our species for the first time.”)

 

বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই কথাগুলো আসলে ডক্টর পিটার ডাসজাকের একটা বিরাট আক্ষেপের অভিব্যক্তি। সব থেকে বড় কথা হল তিনি একজন মহামারী বিশারদ এবং বিশেষ করে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী। তিনি খুব ভালো করে জানেন HIV ছাড়াও আরও কতো রকমের বিপজ্জনক ভাইরাস আছে, যেগুলো থেকেও অতিমারী তৈরি হতে পারে এবং সেই কারণেই দরকার ভাইরাস নিয়ে গবেষণাকে মারাত্মক গুরুত্ব দেওয়া, অর্থাৎ এই গবেষণায় যথেষ্ট সরকারী অর্থ বরাদ্দ ও উৎসাহ প্রদান দরকার, যাতে সম্ভাব্য অতিমারীগুলোর মোকাবিলায় বিজ্ঞানী মহল আগে থেকেই অনেকটা তৈরি থাকতে পারে। কিন্তু সেটারই তো বিরাট অভাব, যেটা একটু আগেই আমরা দেখেছি। ডাসজাক তাঁর ঐ লেখাটাতে জানিয়েছিলেনঃপৃথিবীতে হিসাব মতো প্রায় ১৫ লাখ অজানা ভাইরাস আছে; সেগুলোর সবই যে মানুষকে সঙ্ক্রমিত করতে পারে তা নয়, কিন্তু অনেকগুলোই পারে। এবং সেগুলোর সবই যে আগামী অতিমারী তৈরি করবে তা নয়, কিন্তু অনেকগুলোই পারে।” (“There are an estimated 1.5 million unknown viruses in the world. Not all of those can infect humans, but many can. And not all of those will cause the next pandemic, but many could.”)    

 

ডাসজাকের কথাতে, তাঁদের EcoHealth Alliance-এর লক্ষ্য হল AIDS-এর ক্ষেত্রে যেটা করা যায়নি সেটাই করাঃনতুন ভাইরাসগুলো মানুষকে সঙ্ক্রমিত করার আগেই তাদের থামিয়ে দেওয়া।” (“to stop new viruses from ever infecting people in the first place.”) সেই লক্ষ্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা তিনি লিখেছিলেনঃ ১) আঞ্চলিক বন্যপ্রাণীগুলো কী কী ধরনের প্যাথোজেন বহন করে সেগুলোকে চিহ্নিত করতে সার্ভে করা (“Surveying local wildlife to identify which pathogens they carry.”) এবং তাদের রক্ত, লালা ও অন্যান্য শারীরিক তরলগুলোকে (fluids) পরীক্ষা করে দেখা সেগুলোতে অজানা ভাইরাস কী কী আছে, যাতে কোনও একটা বিপজ্জনক প্যাথোজেনের কথা মানুষের কাছে খবর হওয়ার আগেই এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ধারণা থাকে; ) মানুষকে শিক্ষা দেওয়া কীভাবে পরিবেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে জীবনযাপন করতে হয়। (“Teaching communities how to live in concert with the environment.”) [প্যাথোজেন মানে হল, মানুষের শরীরে রোগ সৃষ্টিকারী কোনও জীবাণু।] 

 

দ্বিতীয় পয়েন্টে বলা বিষয়টা সম্পর্কে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতো ডাসজাকেরও বক্তব্য হলঃযদিও এটা ঠিক যে মানুষকে আক্রমণ করা উদীয়মান বেশীর ভাগ রোগই আসছে বন্যপ্রাণী থেকে, অনেক ক্ষেত্রে মানুষের আচরণই দায়ী সঙ্ক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য। ফরেস্টগুলোকে মানুষ কেটে ফেলছে এবং অভূতপূর্ব হারে বন্য প্রাণীগুলোকে শিকার করছে, খাচ্ছে, এবং বিক্রি করছে। পোষ্যপ্রাণী হিসাবে বেচার জন্য মহাসাগরগুলোকে পারি দিয়ে জাহাজে করে পাঠানো প্রত্যেকটা বহিরাগত প্রাণীই (exotic animal) একটা নতুন মহাদেশে একটা নতুন প্যাথোজেনের শিকড় গেঁড়ে বসার একটা চমৎকার সুযোগ। তার শিকড় উপড়ে ফেলা প্রত্যেকটা গাছই মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে মিথষ্ক্রিয়াকে বাড়িয়ে তোলে, আর এভাবে ভাইরাসগুলো পেয়ে যায় নতুন জনতাকে সঙ্ক্রমিত করার সুযোগগুলো।” (“While it’s true that most emerging diseases affecting humans come from wildlife, it’s often human behavior that is to blame for the spillover. Humans are tearing down forests and hunting, eating, and selling wild animals at unprecedented rates. Each exotic animal shipped across the ocean to be sold as a pet is an sveacasino opportunity for a new pathogen to take root in a new continent. Each tree ripped from its roots increases interactions between humans and wild animals, and thus the odds that viruses will find new populations to infect.”) 

 

উপরোক্ত কথাগুলো ডাসজাক বলেছিলেন AIDS অতিমারীর শিক্ষাকে সম্ভাব্য আগামী বিপদগুলোর মোকাবিলায় আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার লক্ষ্যে কাজে লাগাতে। অথচ বাস্তবে কী দেখলাম আমরা? বর্তমান COVID-19 সহ এরপরেও একগুচ্ছ অতিমারী বা মহামারী, যেখানে ভাইরাসটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, বিজ্ঞানীরাও ছিলেন অজ্ঞ! এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং পরিবেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার গুরুত্ব এখনও কতো অবহেলিত।  কিন্তু এর জন্য সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই, দায়িত্ব তো সরকারগুলোরই নেওয়া উচিৎ। এখন সবাই আমরা জানি মানুষের শরীরে নয়া কোরোনাভাইরাসটার অনুপ্রবেশও কোনও একটা প্রাণী থেকে, যদিও নিশ্চিত ভাবে সেই প্রাণীকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি।

 

SARS (2002-2003)

Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS) নামক এই প্রাদুর্ভাবের ঘটনাটা একটু বিস্তারিত ভাবেই বলা দরকার, যেহেতু বর্তমান COVID-19 অতিমারীর অভিজ্ঞতার সাথে অনেক মিল আমরা খুঁজে পাবো।

 

কোরোনাভাইরাস আছে অনেক রকমের। এই প্রাদুর্ভাবটাও হয়েছিল একটা কোরোনাভাইরাস থেকে, যেটা পরে জানা গেছে। WHO-র তরফে রোগটার SARS নামকরণ হয়েছিল ১৫ মার্চ ২০০৩-এ। যে কোরোনাভাইরাসটা সেই রোগের কারণ, এখন তার নাম হয়েছে SARS-CoV। আর COVID-19-এর পেছনে যে নয়া কোরোনাভাইরাস, তার নাম রাখা হয়েছে SARS-CoV-2। বিজ্ঞানী মহলে ধারণা, ২০০২-০৩-এর ভাইরাসটারও আদি উৎস বা অরিজিন ছিল বাদুর, কিন্তু মানুষে সঙ্ক্রমণটা ঘটেছিল সরাসরি বাদুর থেকে নয়, মাঝখানে ছিল হিসাবে অন্য এক প্রজাতি, সম্ভবত civet cats, বাংলায় যাকে বলা হয় ভাম বিড়াল।

 

এই রোগের প্রাদুর্ভাবটাও শুরু হয়েছিল চিনে, ২০০২-এর নভেম্বরে দক্ষিণ চিনের গুয়াংডং প্রদেশে। কিন্তু এবারের মতো সেই প্রাদুর্ভাবের ঘটনাটাও রিপোর্ট করা হয়েছিল দেরী করে, ২০০৩-এর ফেব্রুয়ারীতে। এপ্রিলে গিয়ে, রোগটা ছড়িয়ে পড়েছিল বেজিং সহ চিনের আরও কিছু প্রদেশ ও নগরীতে। ২০০৩-এর ১২ মার্চে WHO-র তরফে গ্লোবাল অ্যালার্ট ইস্যু করা হয়েছিল, যখন হংকং এবং ভিয়েতনাম থেকেও একগুচ্ছ অজানা নিউমোনিয়ার (atypical pneumonia) কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক মাসে রোগটা ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া সহ ২৬টা দেশে। WHO-র দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গোটা পৃথিবীতে এই রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ৮,০৯৮ জন মানুষ, মৃত্যু হয়েছিল ৭৭৪ জনের।[17][18] 

Image Source: CDC


 

আজকের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হলেও, এই রোগটাও পৃথিবীর নানা জায়গাতে ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণের (person-to-person infection) মাধ্যমে, মূলত আক্রান্ত মানুষের কাশি বা হাঁচি থেকে আসা respiratory droplets-এর মাধ্যমে। মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণের বেশীর ভাগ কেসই হয়েছিল স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোতে। সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল infectious droplets-এ দূষিত হওয়া কোনও সারফেস বা অবজেক্ট টাচ করে চোখে-মুখে-নাকে হাত দেওয়ার মধ্যে দিয়েও। এগুলো সবই আমরা লক্ষ করেছি COVID-19-এর ক্ষেত্রেও। সুতরাং এগুলো নতুন কিছু নয়, যদিও ভাইরাসটা নতুন। সেই কারণেই বলা হয় নয়া কোরোনাভাইরাস। কিন্তু বাদবাকী অনেক কিছুই ২০০২-০৩-এও দেখা গেছে।  

 

এখনকার তুলনায় সেবারে সব থেকে ভালো দিক ছিল শুধু এটা নয় যে আক্রান্ত মানুষ ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অনেক কম, রোগটা চলেছিলও অনেক কম দিন ধরে। ৫ জুলাই ২০০৩-, WHO ঘোষণা করে জানিয়েছিল প্রাদুর্ভাবটার অবসান ঘটেছে।

 

এতো তাড়াতাড়ি কেন অবসান ঘটেছিল? আক্রান্ত মানুষ ও মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল কেন এতো কম? তারও আগে প্রশ্ন, গোটা পৃথিবীতে রোগটা ছড়িয়েছিল কীভাবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে আসার আগে দেখে নেওয়া যাক প্রাদুর্ভাবের গোরার দিকের ছবিটা।

 

BBC News-এ নিউজে প্রকাশিত এক লেখা[19] অনুযায়ী, বড় আকারে প্রথম সঙ্ক্রমণের ঘটনাটা ঘটেছিল ২০০৩-এর মার্চে, হংকং-এ একটা ঘনবসতিপূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে (Amoy Gardens)। সেখানে বসবাস ছিল ১৯ হাজার মানুষের। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই এই অ্যাপার্টমেন্টের ২০০ জন সঙ্ক্রমিত হয়েছিলেন। কেউ বুঝেও উঠতে পারেননি কোথা থেকে বা কীভাবে এটা হচ্ছে। অনেকের মনে হয়েছিল কালপ্রিট হল ইঁদুর কিংবা আরশোলা। অনুমান যাই হোক, খুব দ্রুতই ঐ অ্যাপার্টমেন্টটা তো বটেই গোটা হংকংও হয়ে উঠেছিল যেনবা একটা ভূতুরে নগরী। এরপরে আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছিল এই কারণে যে, ৩১ মার্চে গিয়ে এই ব্লকের বাসিন্দারা জানতে পেরেছিল তারা বাইরে বেরোতে পারবে না, যেহেতু স্বাস্থ্য দপ্তর ও পুলিশ প্রশাসন থেকে তাদের ওপরে কোয়ারান্টাইন বলবত করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইতিমধ্যেই যারা বাইরে বেরিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে আবার বিল্ডিং-এ ফিরিয়ে আনার। কিছু দিন বাদে এখানকার বাসিন্দাদের দুটো আলাদা হলিডে ক্যাম্পে কোয়ারান্টাইন করা হয়। 

  

এবারে দেখা যাক পৃথিবীর আরও অনেক জায়গাতে রোগটা কীভাবে ছড়িয়েছিল। ২০০৩-এর আগস্টে, “The SARS epidemic in Hong Kong: what lessons have we learned?” হেডিং- National Center for Biotechnology Information (NCBI)-তে প্রকাশিত এক লেখাতে[20] বেশ স্পষ্ট করেই এই ছবিটা হাজির করা হয়েছিল। [NCBI হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের National Institutes of Health-এর অন্যতম শাখা National Library of Medicine-এর একটা অংশ।)] সেই লেখাতে জানানো হয়েছিল, হংকং-এ মহামারীটা ঘটেছিল তিনটে পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়টা ছিল একটা বিস্ফোরক প্রাদুর্ভাব (“an explosive outbreak”)। সেটা শুরু হয়েছিল একটা টিচিং হসপিটালে। আক্রান্ত হয়েছিলেন বেশ কিছু হসপিটাল স্টাফ ও মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। এটা ছিল ২০০৩-এর মার্চের ঘটনা। দ্বিতীয় পর্যায়টা হয়েছিল কমিউনিটির মধ্যে, এবং সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল ঐ হসপিটাল থেকেই। এরপরে প্রাদুর্ভাবটা তার সর্বোচ্চ স্তরে (peak) পৌঁছেছিল ২০০৩-এর এপ্রিলে। Amoy Gardens নামে পূর্বোক্ত হাউসিং এস্টেট আক্রান্ত হয়েছিল ঐ সময়টাতেই। এই লেখাটা যখন প্রকাশিত হয়, অর্থাৎ ২০০৩-এর আগস্টে, সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী এই এস্টেটের মোট ৩২৯ জন এই রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৩৩ জনের। প্রাদুর্ভাবের তৃতীয় পর্যায়টা শুরু হয়েছিল মে মাসের গোরাতে। রোগটা ছড়িয়ে তখন পড়েছিল ৮টা হসপিটাল এবং হংকং-এর আরও ১৭০টা হাউসিং এস্টেটে। তবে জুনের মাঝামাঝি সময় নাগাদ ইনফেকশনের ডেইলি কেসের সংখ্যা দুই অঙ্কের সংখ্যা থেকে এক অঙ্কে নেমে এসেছিল।

        

হংকং-এ প্রাদুর্ভাবের শুরুটা হয়েছিল একজন চিকিৎসক মারফৎ। চিনের মূল ভূখণ্ডে (মেইনল্যান্ড চায়না) একটা হসপিটালে তিনি ছিলেন এই প্রাদুর্ভাবের একেবারে গোরার দিকে আক্রান্ত রুগীদের চিকিৎসকের ভূমিকায়। তাঁর মাধ্যমেই সঙ্ক্রমণটা হংকং-এও ছড়িয়েছিল এই কারণে যে, ২০০৩-এর ফেব্রুয়ারীতে তিনি হংকং-এ গিয়েছিলেন, উঠেছিলেন সেখানকার একটা হোটেলে (Metropole Hotel)। ২১ ফেব্রুয়ারীতে মাত্র একটা রাত সেখানে তিনি কাটিয়েছিলেন। কিন্তু বিপত্তিটা হয়েছিল সেখান থেকেই। হংকং-এ ট্র্যাভেল করার সময়েই তিনি অসুস্থ বোধ করছিলেন। ২২শে ফেব্রুয়ারীতে তাঁকে হসপিটালে অ্যাডমিট করতে হয়েছিল। দুঃখজনক ভাবে, এরপরে তাঁর মৃত্যুও হয়। এর আগে, তাঁর মাধ্যমেই ঐ হোটেলে আরও ৭ জন গেস্টের মধ্যে সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল, যাঁরা ঐ হোটেলের একই ফ্লোরে ছিলেন। সেই ৭ জনের মধ্যে ৩ জন ছিলেন সিঙ্গাপোর থেকে, ১ জন ভিয়েতনাম থেকে, ২ জন কানাডা থেকে, আরেকজন ছিলেন স্থানীয় মানুষ। গোটা হংকং জুড়ে সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল শেষোক্ত ঐ একজন মাত্র স্থানীয় গেস্টের মাধ্যমেই। ৪ মার্চ ২০০৩-, তাঁকে অ্যাডমিট করা হয়েছিল স্থানীয় এক হসপিটালে। এরপরে সেখানকার ১০০ জন চিকিৎসক ও নার্সও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।  

 

চিনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে, হংকং সহ বাইরের দেশগুলোতে রোগটা ছড়িয়ে পড়েছিল এভাবেই। আমাদের বর্তমান অভিজ্ঞতার সাথে এগুলোর অনেক মিল নিশ্চয়ই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।  

 

তবে রোগটা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লেও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তুলনায় অনেক কম, বিশেষ করে ঐ একই বছরে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জাতে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর তুলনায়।[19] কিন্তু ২০০৩-এর মার্চে এবং এপ্রিলের গোরাতে, আতঙ্ক গ্রাস করে ফেলেছিল গোটা হংকং-কে, যেহেতু মহামারীটা চলে গিয়েছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সার্জিক্যাল মাস্ক হয়ে উঠেছিল একটা হট কমোডিটি। সাধারণত মানুষের ভিড়ে গমগম থাকা শপিং মল ও রেস্তরাঁগুলো সুনসান চেহারা নিয়েছিল। একই চেহারা হয়েছিল মাস ট্রান্সপোর্টগুলোতেও। বিদেশীরা হংকং ছেড়ে পালিয়েছিল। স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর চাকুরীজীবীদের ক্ষেত্রে, যাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল তাঁরা নিজেদের ঘরে থেকেই কাজ করছিলেন। নিঃসন্দেহে, COVID-19 আমাদের কাছে নতুন মনে হলেও ২০০২-০৩-র এই ছবিটা অন্তত বলে দিচ্ছে এগুলো মোটেই নতুন কিছু নয়।

 

এবারে দেখা যাক রোগটার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। NCBI-এ প্রকাশিত পূর্বোক্ত লেখাটাটে এই ব্যাপারে পাঁচটা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে সেগুলো সবই হংকং সম্পর্কে। ব্যবস্থাগুলো ছিল এরকমঃ ১) সঙ্ক্রমণ প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রদান ও প্রচার কর্মসূচি; ) সঙ্ক্রমণের উৎসগুলোকে খুঁজে বের করা; ) পাঁচটা বড় মাপের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যেগুলোর মধ্যে ছিল সঙ্ক্রমিত হওয়া মানুষদের বাধ্যতামূলক আইসোলেশন ও তাঁদের কন্টাক্টদের ওপরে নজরদারী, স্কুল ও ইউনিভার্সিটি সেশনগুলোকে বন্ধ রাখা, হংকং ও মেইনল্যান্ড চায়নার মধ্যে মহামারী সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়, এন্ট্রি ও এক্সিট পয়েন্টগুলোত ট্র্যাভেলারদের টেম্পারেচার চেকিং ও জেলা-ব্যাপী পরিছন্নকরণ অভিযান ; ) মেইনল্যান্ড চায়না ও WHO-র সাথে সহযোগিতা ও যোগাযোগ রাখাকেজোরদার করা; এবং ৫) SARS-এর জন্য খুব দ্রুত একটা ডায়াগনস্টিক টেস্ট তৈরি করা।

 

প্রথম কয়েকটা কেস চিহ্নিত হওয়ার পরেই, হংকং-এর স্বাস্থ্য দপ্তর আইনসম্মত উপায়ে SARS-কে একটা নোটিফাইযোগ্য ছোঁয়াচে রোগ (notifiable infectious disease) হিসাবে ঘোষণা করেছিল। SARS আক্রান্ত পেশেন্টদের বিভিন্ন হসপিটালে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। তাদের ফ্যামিলি মেম্বার ও ক্লোস কন্টাক্টদের নজরদারীতে (surveillance) রাখা হয়েছিল। শুরুর দিকে রাখা হয়েছিল তাদের নিজেদের বাড়ীতে কিন্তু পরে আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে, যেখানে তাদের ১০ দিন ধরে অবসার্ভ করা হতো।

 

সরকারী স্বাস্থ্য কর্মীরা যথেষ্ট তৎপরতা নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সঙ্ক্রমণের উৎস ও কন্টাক্টগুলোকে খুঁজে বের করার। মানুষকে মাস্ক পরতে ও কঠোর ভাবে পার্সোনাল হাইজিন মেনে চলতে বাধ্য করার কাজ ছাড়াও, আক্রান্ত পরিবার ও হাউসিং এস্টেটগুলোকে পরিষ্কার করার কাজ পুরোদমে চালানো হয়েছিল। ইনকামিং ও আউটগোয়িং ট্র্যাভেলারদের মধ্যে যাদের টেম্পারেচার ছিল ৩৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের ওপরে, তাদের স্ক্রীন করা হচ্ছিল। তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল একটা “health declaration form” কমপ্লিট করা। NCBI-এ প্রকাশিত পূর্বোক্ত লেখাটার লেখকের মতে, “সেগুলোর অন্তর্নিহিত মূল্য ছাড়াও, এই ব্যবস্থাগুলো জনগণকে সতর্ক করার ভূমিকাও রেখেছিল SARS-এর বিরাট সঙ্ক্রমণ ঘটানোর ক্ষমতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। (“Apart from their intrinsic value, these measures served to alert the public to the high infectivity of SARS and the need for preventive measures.”) ২০০৩-এর মে মাসের মাঝামাঝি, মহামারীটা যখন কমতে শুরু করেছে, সরকার কিছু ব্যবস্থা ঘষোণা করেছিল। সেগুলোর মধ্যে ছিল সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ অভিযান ও হাউসিং এস্টেটগুলোর পরিবেশগত দিকের উন্নতি ঘটানো; ট্যুরিজম, ট্রেড ও এমপ্লয়মেন্টে সহ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য কর্মসূচি তৈরি করা; এবং নগরীর আর্থিক, ভৌতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে জনগণের অংশগ্রহণ ও পার্টনারশিপ তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারী সিনিয়র অফিসারদের নেতৃত্বে আলাদা করে তিনটে কমিটি গঠন করা। এছাড়াও ছিল SARS-এর ডায়াগনোসিস, ট্রিটমেন্ট ও ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বাড়তি ফান্ড বরাদ্দ করা।  

 

এটাও ঘটনা যে, হংকং-এ সেই সময়ে সরকারী Centre for Disease Control and Prevention প্রতিষ্ঠানের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। SARS-এর ধাক্কা খেয়ে সেটা গঠন করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটার কাজ হিসাবে ঠিক হয়েছিল এই ধরনের রোগগুলোর প্রতিরোধের জন্য নজরদারী, রিসার্চ, ট্রেনিং এবং আঞ্চলিক তথা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলোর সাথে পারস্পরিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করা।  

 

২০০৩-এর মে মাসের শেষে, জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে হংকং সরকার আরও একটা কমিটি গঠন করেছিল। তাঁরা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, মেইনল্যান্ড চায়না ও হংকং থেকে। এই কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল রোগটার ভবিষ্যৎ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। NCBI-এ প্রকাশিত লেখাটির লেখক, লী শিউ হুং (Lee Shiu Hung), নিজেও ছিলেন সেই কমিটিতে। এখন অবশ্য তিনি আর বেঁচে নেই, গত ২০১৪ সালে ৮০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।[21]

 

BBC News-এ নিউজে প্রকাশিত পূর্বোক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৩-এর এই অতিমারীর ১০ বছর বাদেও হংকং-এর কিন্ডারগার্টেনগুলোতে বাচ্চাদের মা-বাবাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল প্রতিদিন সকালে একটা স্পেশ্যাল নোটবুকে তাঁদের সন্তানদের বডি টেম্পারেচার রেকর্ড করানো। যেকোনও নতুন প্রাদুর্ভাবের বিপদকে প্রচণ্ড সিরিয়াসলি নেওয়া হতো, যেটা অন্যান্য জায়গাতে বাড়াবাড়ি বলে মনে হতে পারতো। ২০০৯ সালে এরকমই একটা ঘটনা হয়েছিল। একজন মেক্সিকান ট্র্যাভেলার সোয়াইন ফ্লুতে সঙ্ক্রমিত হয়েছেন নিশ্চিত হওয়াতে একটা হোটেলে ২৮৬ জন গেস্টকে ৭ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাছাড়া, আপার্টমেন্ট কমপ্লেস ও শপিং প্লাজাগুলোরও অনেক উন্নতি ঘটানো হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো, কারণ SARS-এর দ্রুত প্রসার ঘটার ক্ষেত্রে সেগুলোর আগের অবস্থার  ভূমিকা ছিল বলে দেখা গিয়েছিল। প্রাদুর্ভাবের সময়টাতে টু-বেডরুম আপার্টমেন্টগুলোর খদ্দের পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ২০১৩-তে এসে দেখা গিয়েছিল সেই সমস্যা কেটে তো গেছেই বরং একটা প্রোপার্টি বুম তৈরি হয়ে গেছে।  

 

তবে ঘটনা মোটেই এমন ছিল না যে এই অতিমারীর গোটা পর্যায়টাতে শুধু হংকংকেই ভুগতে হয়েছিল। যথেষ্ট ভুগতে হয়েছিল সিঙ্গাোপর, তাইপেই, বেজিং এবং কানাডার টরন্টোর লোকজনকেও। তবে হংকংই ছিল সব থেকে বেশী আক্রান্ত। মৃত্যুর সংখ্যাও সেখানে ছিল সব থেকে বেশী।  

 

এখানে কানাডার কথাও উল্লেখ করা দরকার। এশিয়ার বাইরে কানাডাই ছিল সব থেকে বেশী আক্রান্ত দেশ। আগেই আমরা দেখেছি, হংকং-এর সেই Metropole Hotel-এ দুজন কানাডাবাসীও গেস্ট হিসাবে ছিলেন। দেশে ফিরে তাঁর মধ্যে এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। এরপরে তাঁর মাধ্যমে এই রোগের আরও ১৬টা কেসের ক্লাস্টার তৈরি হয়। এঁদের মধ্যে ৪ জন ছিলেন তাঁদেরই ফ্যামিলি মেম্বার, ২ জন ছিলেন তাঁদের ক্লোস কন্টাক্ট এবং বাকী ১০ জন স্বাস্থ্য কর্মী। টরন্টোতে প্রাদুর্ভাবটা শুরু হয়েছিল ২০০৩-এর মার্চে। বিপদ বুঝে ঠিক তখনই এই সিটিতে ট্রাভেলের ব্যাপারে WHO থেকে একটা ওয়ার্নিং নোটিস ইস্যু করা হয়েছিল। কিছু পরে নোটিসটা অবশ্য তুলেও নেওয়া হয়েছিল, এবং সেটা করা হয়েছিল কানাডার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রতিনিধিদের কথামতো। এরপরে সেখানে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার নতুন কোনও কেস রিপোর্ট করা হয়নি। মনে করা হয়েছিল প্রাদুর্ভাবটা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। কিন্তু মে মাসের মাঝামাঝি আবার কিছু নতুন কেস ধরা পড়ে। সেটা জানতে পেরে WHO আবার নতুন করে টরন্টোকে সঙ্ক্রমিত এলাকাগুলোর লিস্টে ফিরিয়ে আনে। ১৪ জুনে, সম্ভবত ৯০-এর ওপরে কেসের পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল। এই ঘটনাটার কথা উল্লেখ করে পূর্বোক্ত লী শিউ হুং তাঁর লেখাটিতে বলেছিলেন, “কেসের সংখ্যা কমে যেতে শুরু করলেও কানাডার এই অভিজ্ঞতাটা বুঝিয়ে দিচ্ছে নজরদারী চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্বকে।” (“This Canadian experience highlights the importance of continuing vigilance even when cases begin to decline.”)

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এই রোগে খুব একটা আক্রান্ত হয়নি; ল্যাবরেটরি টেস্ট থেকে দেখা গিয়েছিল মাত্র আটজন সঙ্ক্রমিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই কেসগুলোর সবই হয়েছিল SARS আক্রান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এই লোকেদের ট্রাভেলের কারণে।[17]  

২০০৩-এর জুলাইয়ে অতিমারীর অবসান ঘটেছে বলে WHO থেকে ঘোষণা করা হলেও, তারপরে আরও চারবার SARS-এর আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনবার হয়েছিল সিঙ্গাপোর এবং চাইনীজ তাইপেইয়ে ল্যাবরেটরি অ্যাকসিডেন্ট থেকে। আরেকবার হয়েছিল দক্ষিণ চিনে, যেখানে সঙ্ক্রমণের উৎসটা অজানাই থেকে গিয়েছিল, যদিও পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বলছিল সেটা ছিল প্রাণী থেকে মানুষে পরিবহণের ঘটনা (animal-to-human transmission)[18]

 

আরও একটা কথা এখানে বলা দরকার। সবাই আমরা জানি, বর্তমান COVID-19 অতিমারী সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড সহ অনেকেই বলেছিলেন গরম আবহাওয়ার সময়ে এই রোগটা নিজে থেকেই থেমে যাবে। কেউ কেউ এমনকী এই  দাবীও করেছিলেন, ২০০৩-এর প্যানডেমিকের অভিজ্ঞতা সেই কথাই বলে। কিন্তু বর্তমান অভিজ্ঞতা যে আদৌ সেরকম নয় সেটা তো সবাই আমরা বুঝতে পেরেছি। ২০০৩-এও কিন্তু রোগটার অবসান ঘটার ক্ষেত্রে গরম পড়ার কোনও ভূমিকাই ছিল না। এই কথা জানিয়েছেন Harvard T.H. Chan School of Public Health- Center for Communicable Disease Dynamics-এর ডিরেক্টর এবং মহামারী বিষয়ক (epidemiology) প্রফেসর, মার্ক লিপসিচ (Marc Lipsitch), গত ২৬ নভেম্বর ২০২০-তে “Seasonality of SARS-CoV-2: Will COVID-19 go away on its own in warmer weather?” হেডিং-এ প্রকাশিত তাঁর এক লেখাতে।[22] সেখানে তিনি লিখেছেনঃ “[২০০৩-] SARS-এর মৃত্যু ঘটেছিল প্রাকৃতিক কারণে নয়। মেইনল্যান্ড চায়না, হংকং, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কানাডা এবং অন্যান্য জায়গাতে এটাকে মেরে ফেলা হয়েছিল প্রচণ্ড তীব্র সরকারী স্বাস্থ্য হস্তক্ষেপের দ্বারা। সেগুলোর মধ্যে ছিল কেসগুলোকে আইসোলেট করা, তাঁদের কন্টাক্টদের কোয়ারান্টাইন করা, “সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং”-এর একটা ব্যবস্থা, এবং অন্যান্য তীব্র প্রয়াস। SARS-এর জন্য এগুলোতে ভালো কাজ হয়েছিল কারণ যাঁরা ছিলেন সব থেকে বেশী ছোঁয়াচেসম্পন্ন তাঁরা ছিলেন আলাদা রকম ভাবে বেশ অসুস্থ - সিক কেসগুলো [অর্থাৎ অসুস্থরা] ছিল ট্রান্সমিটার্স [অর্থাৎ রোগ পরিবহণের ভূমিকায়], তাই অসুস্থদের আলাদা করাটা (isolating) পরিবহণকে দমন করেছিল। টরন্টোতে, SARS-এর পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল প্রাথমিক ওয়েভটাকে নিয়ন্ত্রণ করে আগাম সতর্কতাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পরে। এই পুনরাবির্ভাবটা ছিল অবশেষে প্রথম ওয়েভটা থেকে হওয়া একটা কেসের সাথে যুক্ত। পুনরাবির্ভাবটা এটা নিশ্চিত করেছিল যে প্রথম বারে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলোই পরিবহণকে থামিয়ে দিয়েছিল।” (“SARS did not die of natural causes. It was killed by extremely intense public health interventions in mainland Chinese cities, Hong Kong, Vietnam, Thailand, Canada and elsewhere. These involved isolating cases, quarantining their contacts, a measure of “social distancing,” and other intensive efforts. These worked well for SARS because those who were most infectious were also quite ill in a distinctive way — the sick cases were the transmitters, so isolating the sick curbed transmission. In Toronto, SARS resurged after the initial wave was controlled and precautions were discontinued. This resurgence was eventually linked to a case from the first wave. The resurgence confirms that it was control measures that stopped transmission the first time.”)

 

COVID-19 মোকাবিলায় বেশীর ভাগ দেশেরই চরম গাফিলতি ও ব্যর্থতার তুলনায় ২০০৩-এ যথেষ্ট ইতিবাচক সক্রিয়তা ও সাফল্য ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকলেও, এখনকার তুলনায় একটা উল্লেখযোগ্য খামতিও সেই সময়ে ছিল। সেটা ছিল রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসটার জেনোম সিকোয়েন্সের কাজে দ্রুততার প্রশ্নে। এবারে চিনের বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট দ্রুততার সাথে সেই কাজটা করেছিলেন এবং গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের জন্য সেটা প্রকাশ করেছিলেন, যাতে COVID-19-এর কেমন চিকিৎসা দরকার সেই ব্যাপারে সাহায্য হয় এবং প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন তৈরির কাজও দ্রুতগতিতে হতে পারে। দ্রুততার সাথে এই কাজ করার জন্য চিনের বিজ্ঞানীরা এবারে প্রশংসাও পেয়েছেন। বিপরীতে, আগের বারের প্রাদুর্ভাবটা ২০০২-এর ডিসেম্বরে শুরু হয়েছিল জানা গেলেও সংশ্লিষ্ট কোরোনাভাইরাসটার জেনোম সিকোয়েন্সে অনেক বেশী সময় নেওয়া হয়েছিল। সঙ্ক্রমণটা তার শীর্ষস্তরে উঠেছিল (peaked) ২০০৩-এর ফেব্রুয়ারীতে। কিন্তু সম্পূর্ণ জেনোম সিকোয়েন্সের কাজটা এপ্রিলের আগে হয়নি[23]

 

Swine Flu (2009-2010)

২০০৯-এর ১১ জুনে Nature পত্রিকাতে প্রকাশিত ১৩ জন বিজ্ঞানীর এক যৌথ লেখা[24] অনুযায়ী, ২০০৯-এর মার্চ ও এপ্রিলের গোরাতে এই রোগটার আবির্ভাব ঘটেছিল মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই (১১ মের মধ্যে) মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাসটার পরিবহণ মারফৎ রোগটা ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর ৩০টা দেশে। WHO-কে সেই কারণে সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল, লেভেল ৫ থেকে লেভেল ৬-এ।

 

এটাও ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ঘটিত একটা রোগ। কিন্তু এর আগে মানুষকে সঙ্ক্রমিত করার ক্ষেত্রে এই ভাইরাসটা কখনোও চিহ্নিত হয়নি। ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১০-, WHO থেকেই এই কথা জানানো হয়েছিল।[25] COVID-19-এর মতো সেবারেও ভাইরাসটার জেনেটিক অ্যানালিসিস করে দেখা গিয়েছিল, একটা প্রাণী ছিল সেই ভাইরাসের উৎস। রোগটার পরিচয় “swine flu” নামে দেওয়া শুরু হয়েছিল এই কারণে যে, ল্যাবরেটরি টেস্ট থেকে দেখা গিয়েছিল রোগের কারণ হিসাবে কাজ করা ভাইরাসটার উৎস ছিল শুয়োর (pigs)। ২৫ নভেম্বর ২০০৯-, আমেরিকার Centers for Disease Control and Prevention (CDC) থেকেই এই কথা বলা হয়েছিল।[26] কিন্তু CDC-র ধারণা অনুযায়ী, মানুষকে সঙ্ক্রমিত করা ভাইরাসটা শুয়োরের দেহে থাকা কোনও বিশেষ একটা ভাইরাস ছিল না, বরং ছিল শুয়োর-জাত একাধিক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মধ্যে একটা “reassortment”-এর প্রক্রিয়া থেকে তৈরি এক নতুন ভাইরাস। এভাবে তৈরি হওয়া ভাইরাসের গুনাবলী (characteristics) তার জন্মদাতা ভাইরাসগুলোর গুনাবলী থেকে আলাদা হতে পারে - যেমন হতে পারে মানুষের ক্ষেত্রেও, কোনও দম্পতির দুজনের গুনাবলী সাপেক্ষে সন্তানের গুনাবলীর ক্ষেত্রে।

 

Image Sorce: CDC

CDC-র কথাতে, ভাইরাসটার উদ্ভব হয়েছিল সম্ভবত উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়াতে থাকা শুয়োরের পালগুলোতে ঘুরপাক খেয়ে চলা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসগুলোর মধ্যে “reassortment” প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। বিগত ২৮ এপ্রিল ২০০৯-, WIRED পত্রিকাতে প্রকাশিত এক রিপোর্ট[27] অনুযায়ী, একই রকম কথা বলেছিলেন University of Edinburgh-এ বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অ্যান্ড্রু রামবাউট (Andrew Rambaut)। তাঁর কথাতেও, সোয়াইন ফ্লু সৃষ্টিকারী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটা ছিল আসলে দুটো কমন “pig flu strains”-এর একটা হাইব্রিড (সঙ্কর)। এই কথা তিনি বলেছিলেন ল্যাবরেটরি অ্যানালিসিস থেকেই। 

 

একই রকম মত জানিয়েছিলেন আরও দুই বিজ্ঞানীঃ University of Pennsylvania-তে ভাইরাস বিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এডি হল্মস (Eddie Holmes) এবং University of Maryland-এ জনৈক “bioinformaticist” স্টিভেন স্যালজবার্গ (Steven Salzberg) 

 

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, শুয়োরের দেহকে আশ্রয় করে থাকা যে দুটো আলাদা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের হাইব্রিড ছিল নয়া সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস, সেগুলো কিন্তু অনেক বছর আগে থেকেই বিজ্ঞানীদের কাছে চিহ্নিত ছিল। উত্তর আমেরিকারটা (North American strain) চিহ্নিত হয়েছিল ১৯৩০-এর দশকে, আর ইউরেশিয়ারটা (Eurasian strain) ১৯৭৯ সালে। শেষোক্তটা সাধারণত দেখা যায় ইউরোপ ও এশিয়াতে, উত্তর আমেরিকাতে নয়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই দুটোর কোনওটাই ছোঁয়াচে বলে কখনোও প্রমাণিত হয়নি। অ্যান্ড্রু রামবাউটের কথাতে, সেই কারণেই এই দুইয়ের হাইব্রিড থেকে অতিমারী তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। যুক্তি হিসাবে তিনি বলেছিলেনঃখুব কম মানুষের মধ্যেই এই বিশেষ কম্বিনেশনটাতে ইমিনিউনিটি থাকবে, যেটা থেকে এই দুশ্চিন্তা তৈরি হচ্ছে যে জাস্ট একটা সিজনাল ফ্লু আউটব্রেকের বদলে এটা হবে একটা প্যানডেমিক। এটা দেখার আছে বর্তমান ইমিউনিটি কতোটা ও কী মাত্রায়।” (“Very few people will have any immunity to this particular combination, which is what gives the concern that this will be a pandemic rather than just a normal seasonal flu outbreak. It remains to be seen how much and to what extent there is existing immunity.”)

 

এই ব্যাপারে WIRED পত্রিকাতে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছিল। মেক্সিকোতে সোয়াইন ফ্লুর একেবারে প্রথম কেসগুলো দেখা গিয়েছিল সেই দেশের লা গ্লোরিয়া নামে এক শহরে। জায়গাটা ছিল বিশাল এবং কুখ্যাত ভাবে নোংরা একটা শুয়োরের খামার (hog farm) থেকে বেশী দূরে নয়। এই ফার্মটা ছিল জায়ান্ট আমেরিকান ফুড কোম্পানি Smithfield Foods-এর একটা সাবসিডিয়ারি। এলাকার বাসিন্দারা ছাড়াও কিছু কিছু সাংবাদিক বলেছিলেন ভাইরাসটার আবির্ভাব হয়তো এই ফার্ম থেকেই। অনেক গবেষকও আগে এই ফার্মটা থেকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন, যেমন করা হয়েছিল Pew Commission on Industrial Farm Animal Production-এর এক রিপোর্টেও।

 

অভিযোগ পেয়ে WHO থেকে এই ফার্ম পরিদর্শনে ইনস্পেক্টরও পাঠানো হয়েছিল। সেই অনুসন্ধানের ফলাফল কিন্তু ঘোষণা হয়নি। উল্টে, ফার্ম কর্তৃপক্ষ থেকে এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছিল ফার্মের শুয়োরের পালে কিংবা তার কর্মীদের মধ্যে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসটার অস্তিত্বের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোম্পানির চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সংবাদ সংস্থা USA Today-কে পরে বলেছিলেন, “সোয়াইন ফ্লুকথাটাই হলএকটা ভুল নামকরণ” (misnomer)। পূর্বোক্ত তিন সায়েন্টিস্ট - অ্যান্ড্রু রামবাউট, এডি হল্মস এবং স্টিভেন স্যালজবার্গ - অবশ্য নিশ্চিত ভাবে বলতে চাননি ভাইরাসটার উদ্ভব এই ফার্ম থেকেই।   

        

১৯৭৭ থেকে মানুষের মধ্যে নিয়মিত ঘোরাফেরা করা সিজনাল ফ্লু ভাইরাসের সাথে সোয়াইন ফ্ল ভাইরাসের কোনও মিল ছিল না। অ্যানালিসিস করে এটাও দেখা গিয়েছিল, মানুষের শরীরে সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি থাকলেও সেই অ্যান্টিবডি সোইয়ান ফ্লু থেকে তাদের রক্ষা করতে পারে না। তবে অন্য কিছু পরীক্ষাতে দেখা গিয়েছিল ৬৫ বা তার থেকে বেশী বয়সী মানুষদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছিল। সেরকম বয়সী মানুষদের একটা বেশ উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে সোইয়ান ফ্লুর বিরুদ্ধে ইমিউনিটি লক্ষ করা গিয়েছিল। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, এরকম বয়স্ক মানুষদের একটা অংশের মধ্যে এই ইমিউনিটি তৈরি হয়েছিল সম্ভবত আরও অতীতে মানুষের মধ্যে ঘোরাফেরা করা ভাইরাসগুলো থেকে।

 

২০০৯-এর এপ্রিলে উত্তর আমেরিকাতে প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবের পরে নয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবী জুড়ে। ২০০৯-এর জুনে, WHO প্যানডেমিক (অতিমারী) ঘোষণা করেছিল। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর মোট ৭৪টা দেশ ও অঞ্চল থেকে গবেষণাগারে নিশ্চিত হওয়া সঙ্ক্রমণের কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে বিরাট মাত্রায় সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল গ্রীষ্মকালে, টিপিক্যাল সিজনাল ফ্লুর ক্ষেত্রে যেটা কখনোও দেখা যায়নি, এবং পৃথিবীর সেই অংশেই ঠাণ্ডার মাসগুলোতে ভাইরাসটার সক্রিয়তা (activity) ছিল তুলনায় আরও বেশী।

 

তাছাড়া, এই অতিমারীতে সব থেকে বেশী মৃত্যু ঘটেছিল তুলনামূলক ভাবে অল্প বয়সীদের মধ্যে, যাঁদের অনেকেই ছিলেন শারীরিক ভাবে স্বাস্থ্যবান। তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী জটিল অথবা মারাত্মক অসুস্থতার বিপদ দেখা গিয়েছিল গর্ভবতী মহিলা, অল্পবয়সী বাচ্চা এবং ফুসফুসে ক্রনিক সমস্যা বা অন্য কোনও সমস্যা থাকা যেকোনও বয়সী মানুষের মধ্যে।

     

পৃথিবী জুড়ে এই রোগটারও প্রসার ঘটেছিল মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণ থেকে, যেমন হয়ে এসেছিল সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও। COVID-19 অতিমারীর মতো এই সঙ্ক্রমণটাও খুব সহজেই ছড়াতে পেরেছিল আক্রান্ত মানুষদের হাঁচি-কাশি থেকে বেরিয়ে আসা “infected droplets” থেকে।   

 

সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতি বছরই ঘটে থাকে আর ভাইরাসগুলোও প্রতি বছর পাল্টে যেতে থাকে। কিন্তু অনেক মানুষের মধ্যেই এর বিরুদ্ধে ইমিনিউটি তৈরি হয়ে আছে, যেটা সঙ্ক্রমণের প্রসারকে সীমিত রাখতে সাহায্য করে। এই রোগে অসুস্থতা ও মৃত্যুকে কমাতে কিছু কিছু দেশে ভ্যাকসিনের প্রয়োগও হয়ে থাকে। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু অতিমারী সৃষ্টিকারী ভাইরাসটা ছিল নতুন। বেশীর ভাগ মানুষের মধ্যেই এই ক্ষেত্রে কোনও ইমিনিউটি ছিল না। এটার প্রতিরোধে সিজনাল ফ্লুর জন্য প্রচলিত ভ্যাকসিনে কোনও কাজই হতে দেখা যায়নি। যদিও ইতিহাসের শিক্ষা ছিল এটাই যে, ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারী লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে কোনও ভ্যাকসিন তখনও তৈরি হয়নি।   

 

একটা ভ্যাকসিন অবশ্য তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বড় পরিমাণে সেটা পাওয়া যায়নি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই যখন রোগটা তার দ্বিতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্তর পেরিয়ে থেমেও গিয়েছিল। CDC হিসাব দিয়েছিল, ১২ এপ্রিল ২০০৯ থেকে ১০ এপ্রিল ২০১০-এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই রোগে কেসের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৮ লাখ (৪৩.৩ মিলিয়ন থেকে ৮৯.৩ মিলিয়ন রেঞ্জের মধ্যে), হসপিটালাইজ করতে হয়েছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৩০৪ জনকে (,৯৫,০৮৬ থেকে ৪,০২,৭১৯ রেঞ্জের মধ্যে), মৃত্যু হয়েছিল ১২ হাজার ৪৬৯ জনের (,৮৬৮ থেকে ১৮,৩০৬ রেঞ্জের মধ্যে)। আর ভাইরাসটার প্রথম বছরে সার্কুলেশনের পর্যায়ে গোটা পৃথিবীতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১,৫১,৭০০ থেকে ৫,৭৫,৪০০-র মধ্যে। এই মৃত্যুগুলোর ৮০ শতাংশ ছিল ৬৫ বছরের কম বয়সী মানুষদের মধ্যে। টিপিক্যাল সিজনাল ফ্লুতে মৃত্যুর সাথে এখানে একটা বড় তফাৎ, কারণ সেটাতে মৃত্যুগুলোর ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ হয়ে থাকে ৬৫ ও তার তার চাইতে বেশী বয়সীদের মধ্যে।[28]    

   

এই অতিমারীতে মৃত্যুর হার (mortality) ছিল অবশ্য আগেরগুলোর তুলনায় কম। যেমন, ১৯১৮-র অতিমারীতে পৃথিবীতে মৃত্যুর হার ছিল ১ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে, ১৯৬৮-র অতিমারীর ক্ষেত্রে ছিল ০.০৩ শতাংশ। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের প্রথম বছরটা জুড়ে সার্কুলেশনের পর্যায়ে মৃত্যুর হার ছিল মাত্র ০.০০১ থেকে ০.০০৭ শতাংশ। 

  

২০১০-এর ১০ আগস্টে WHO থেকে এই অতিমারীর অবসান ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও ভাইরাসটার সার্কুলেশন অব্যাহত থেকেছে; মানুষের মধ্যে এটা থেকে অসুস্থতা তৈরি হওয়া, তাদের হসপিটালাইজ করতে হওয়া, এবং প্রতি বছরই পৃথিবী জুড়ে এই কারণে মৃত্যু হওয়া চলতে থেকেছে।   

 

Ebola (2014-2016)

ইবোলা রোগটা (Ebola virus disease, সংক্ষেপে EVD)[29][30] ভাইরাস-জাত সব থেকে মারাত্মক রোগগুলোর অন্যতম। রোগটা আবিষ্কার হয় ১৯৭৬ সালে, যখন মধ্য আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে পরপর দুটো প্রাদুর্ভাব হয়; এক ধরনের মারাত্মক জ্বরে (fatal hemorrhagic fever) কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়। প্রথম প্রাদুর্ভাবটা হয়েছিল ডেমোক্র্যাটিক রিপাব্লিক অফ কঙ্গোতে (আগে যার নাম ছিল জাইরে) ইবোলা নামে এক নদীর কাছে একটা গ্রামে। রোগটার ইবোলা নামকরণ হয়েছে সেখান থেকেই। দ্বিতীয়টা হয়েছিল যেখানে দক্ষিণ সুদানে (বর্তমানে যেটা নাজারা)। প্রথম প্রাদুর্ভাবের জায়গাটা থেকে এই দ্বিতীয়টার দুরত্ব ছিল প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার।  

সরকারী স্বাস্থ্য আধিকারিকদের প্রথম দিকে মনে হয়েছিল দুটো প্রাদুর্ভাব ছিল একটাই ঘটনা (a single event), একটাই সঙ্ক্রমিত মানুষের মাধ্যমে, যিনি এই দুটো জায়গাতেই ট্র্যাভেল করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরে আবিষ্কার করেছিলেন, দুটো প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল দুটো আলাদা ধরনের ভাইরাস (two genetically distinct viruses) থেকেঃ জাইরে ইবোলাভাইরাস ও সুদান ইবোলাভাইরাস। এই আবিষ্কারের পরে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্ত টানেন যে ভাইরাস দুটো এসেছিল দুটো আলাদা উৎস থেকে এবং প্রত্যেকটা আক্রান্ত জায়গাতে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল পরস্পরের থেকে স্বাধীন ভাবে। 

         

Image Source : CDC

১৯৭৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকাতে আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে ইবোলা প্রাদুর্ভাবের বেশীর ভাগ কেসই হয়েছে আফ্রিকাতে। সব থেকে বড়টা হয়েছিল ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে। এটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম গিনির একটা গ্রাম্য ব্যবস্থাতে। তারপরে সেটা ছড়িয়ে পড়েছিল শহুরে এলাকাগুলোতে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বর্ডারগুলো ছাড়িয়ে তার প্রসার ঘটেছিল সিয়েরা লিওন এবং লিবেরিয়াতে, এবং এভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই ঘটনাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা গ্লোবাল প্যানডেমিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের CDC-র দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, মৃত্যু হয়েছিল ১১,৩২৫ জনের এবং বেশীর ভাগই হয়েছিল গিনি, সিয়েরা লিওন এবং লিবেরিয়াতে।[31]

এখন প্রশ্ন হল ভাইরাসটার উদ্ভব কোথা থেকে? বিজ্ঞানীরা বলছেন এটাও একটা প্রাকৃতিক ভাইরাস, এবং এগুলোর হোস্ট (আশ্রয়দাতা) হল বাদুর (fruit bats of the Pteropodidae family)। বিগত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে LiveScience পত্রিকাতে প্রকাশিত এক লেখাতে[32], ইউকে- Lancaster University-তে বায়োইনফর্মেটিকস সংক্রান্ত জনৈক গবেষক, ডেরেক গ্যাথারারের (Derek Gatherer) এরকমই একটা জোরালো ধারণার কথা উদ্ধৃত করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ যথেষ্ট জোরালো, যদিও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। (“There's a strong circumstantial case, but we haven’t actually got a total smoking gun.”) ১৯৭৬ সালে প্রাদুর্ভাবটা শুরু হওয়ার অনেক বছর বাদে (২০০৫ সালে), ইবোলা ভাইরাসের ধারক (reservoir) অনুসন্ধানের জন্য গবেষকরা ইবোলায় আক্রান্ত হওয়া আফ্রিকার নানা জায়গা থেকে (কঙ্গো সহ) বাদুর, নানা রকমের পাখী ও ক্ষুদ্র মেরুদণ্ডী প্রাণী সহ ১ হাজারেরও বেশী ছোট ছোট প্রাণী থেকে স্যাম্পল নিয়েছিলেন। দেখা গিয়েছিল একমাত্র কিছু বাদুরই ইবোলা ভাইরাসের ধারক হিসাবে কাজ করে, বিশেষ করে তিন রকম প্রজাতির ফ্রুট ব্যাটস। এগুলোর মধ্যে অন্তত দুটো প্রজাতি পাওয়া গিয়েছিলি গিনিতে, ২০১৪-২০১৬ পর্বে সব থেকে বড় প্রাদুর্ভাবটা যেখানে শুরু হয়েছিল। সেই কারণেই Live Science পত্রিকাকে গ্যাথারার বলেছিলেন সম্ভবত সেই বাদুরগুলোই ছিল উৎস।    

  

গত ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২০-তে WHO থেকে প্রকাশিত এক লেখাতে[30] বলা হয়েছিল, মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটে সঙ্ক্রমিত প্রাণীদের, যেমন ফ্রুট ব্যাটস, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বাঁদর, আফ্রিকার জঙ্গলে দেখতে পাওয়া এক প্রজাতির হরিণের মতো এক ধরনের প্রাণী (forest antelope) বা রেইনফরেস্টে দেখতে পাওয়া এক ধরনের অসুস্থ কিংবা মৃত সজারুর (porcupines) রক্ত, নিঃসরণ (secretions), শারীরিক অঙ্গ (organs) অথবা অন্যান্য শারীরিক তরলের (bodily fluids) সাথে ক্লোজ কন্টাক্ট থেকে। কিন্তু ...

 

কিন্তু রোগটা ছড়ালো কীভাবে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণ ঘটেছিল দুটো উপায়েঃ ১) ইবোলাতে অসুস্থ অথবা মৃত ব্যক্তিদের রক্ত অথবা অন্যান্য শারীরিক তরলের সাথে ডিরেক্ট কন্টাক্টের মাধ্যমে; ) ইবোলাতে অসুস্থ অথবা মৃত ব্যক্তিদের রক্ত অথবা অন্যান্য শারীরিক তরলের দ্বারা দুষিত হওয়া জিনিসপত্রের সাথে ডিরেক্ট কন্টাক্টের মাধ্যমে, ফাটা চামড়া (broken skin) অথবা শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির (mucous membranes) মধ্য দিয়ে।

   

জানা গেছে, প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে রুগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা ইঞ্জেক্সনের নীডল ও সিরিঞ্জগুলো পরেও ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেই কারণেই রোগটা সহজেই ছড়াতে পেরেছিল। জাইরেতে (এখন যেটা ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো - DRC) প্রথম প্রাদুর্ভাবের সময়ে একটা মিশন হসপিটালে প্রতিদিন পাঁচটা সিরিঞ্জ ৩০০ থেকে ৬০০ জন রুগীর জন্য নার্সদের ব্যবহার করতে হয়েছিল। যথেষ্ট আত্ম-সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে, ইবোলা আক্রান্তদের চিকিৎসার কাজে যুক্ত স্বাথ্য কর্মীরা নিজেরাও প্রায়ই সঙ্ক্রমিত হয়েছেন, যেমন বর্তমান COVID-19-এর ক্ষেত্রেও এরমক প্রচুর নজির দেখা আছে। প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকটাতে মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছিল মূলত এভাবেই।

 

পশ্চিম আফ্রিকাতে ২০১৪-২০১৫-র সময়ের প্রকোপটাতে মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণের অধিকাংশটাই (৭৪%) হয়েছিল ফ্যামিলি মেম্বারদের মধ্যে। ইবোলাতে যাদের মৃত্যু হয়েছিল, তাদের মৃতদেহের সাথে ডাইরেক্ট কন্টাক্ট সঙ্ক্রমণ ছড়ানোর সব থেকে বেশী বিপজ্জনক ও কার্যকরী উপায়গুলোর অন্যতম বলে প্রমাণিত হয়েছিল। মহামারীটাকে আয়ত্ত্বে আনতে, মৃতদের জন্য শোকপালন ও তাদের কবরস্থ করার চালু রীতির পরিবর্তন ঘটানো এবং কবর দেওয়ার নিরাপদ প্র্যাকটিস অবলম্বন করা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

 

ইবোলার ক্ষেত্রে মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণ ছড়ানোর উপাগুলোর মধ্যে আরও একটা বড় দিক আছে। কোনও গর্ভবতী মহিলা যিনি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাঁর ব্রেস্ট মিল্কের মধ্যে কিংবা প্রেগনেন্সি সংক্রান্ত ফ্লুয়িডস ও টিস্যুগুলোতে ভাইরাসটা থেকে যেতে পারে, যেটা জন্ম দেওয়া সন্তানের মধ্যেও প্রবেশ করতে পারে। তবে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পরে কোনও মহিলা গর্ভবতী হলে এই বিপদ নেই। ইবোলা থেকে আরোগ্যলাভ করতে থাকা কোনও ব্রেস্টফীডিং মহিলা ব্রেস্টফীডিং চালিয়ে যেতে চাইলে, তাঁর ব্রেস্ট মিল্ক আগে টেস্ট করে নেওয়া দরকার। সব শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, WHO-র কথামতো, এই রোগের প্রতিরোধে তৈরি হওয়া একটা পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন ২০১৫ সালে যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছিল, এবং গত ২০১৮-১৯-এ কঙ্গোতেই নতুন করে এই রোগের একটা প্রাদুর্ভাব চলার সময়ে সেটা প্রয়োগ করা হয়েছিল।

 

এবারে এই ইতিহাসের শিক্ষার আলোকে বর্তমান অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করা যাক,

 

Ø  কোথাও একটা আউটব্রেক (প্রাদুর্ভাব) শুরু হলে কী করতে হয়ে ইতিহাসে তার যথেষ্ট শিক্ষা ছিল। চিনের উচিৎ ছিল আউটব্রেকটা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হওয়া। প্রথম কাজ হওয়া উচিৎ ছিল ঘটনাটাকে গোপন না রেখে সমগ্র চিন তো বটেই গোটা পৃথিবীকেও সরকারী ভাবে জানানো (officially inform), যাতে সম্ভাব্য বিপদের মোকাবিলায় তারা আগে থেকেই প্রস্তুত হতে পারে। যদি দেখা যেতো বিপদ যতোটা ভাবা হয়েছিল ততোটা আসলে ছিল না, তবুও এটাই করা উচিৎ ছিল। এই কাজে অবশ্যই দেরী করা হয়েছে, তার কারণ যাই হোক। কিন্তু বাকী দেশগুলোরও উচিৎ ছিল খবর পাওয়ার সাথে সাথেই চিনের সাথে এয়ার ট্র্যাভেলকে বন্ধ করে দেওয়া। এবং শুধু চিন কেন, যখন জানতে পারা গেলো ইতিমধ্যেই কয়েকটা দেশে সঙ্ক্রমণের কেস ধরা পড়েছে, তখন দরকার ছিল সেই দেশগুলোর মধ্যেও এয়ার ট্র্যাভেলকে ছিন্ন করে দেওয়া।

এটা ঠিক যে বাইরের দেশগুলোতে রিপোর্ট হওয়া প্রথম কেসগুলোর অনেকগুলোই তৈরি হয়েছিল সেই ব্যক্তিদের খুব সম্প্রতি চিন যাওয়ার হিস্ট্রি থেকে। কিন্তু পরে একটা সময়ে গিয়ে দেখা গেছে, ১৩ মার্চে WHO-র ঘোষণা অনুযায়ী, ইউরোপ হয়ে উঠেছিল এই অতিমারীর “epicenter”[33] সত্যি বলতে কী, ভারত সহ এশিয়ার অনেক দেশে, এবং বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে, সঙ্ক্রমণের প্রসারের একটা বড় কেন্দ্রবিদু ছিল আসলে ইউরোপ।[34] আর সেটার কারণ ছিল অন্যান্য দেশগুলোর সাথে এয়ার ট্র্যাভেলকে যথাসময়ে বন্ধ না করা। একই যুক্তিতে, ভারতে সঙ্ক্রমণ প্রবেশের দায় ভারত সরকারকেই নিতে হবে, অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না। 

 

কোনও একটা জায়গাতে শুরু হওয়া একটা প্রাদুর্ভাব কীভাবে অতিমারীর চেহারা নেয়, বিশেষ করে ১৯১৮-তে শুরু স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাস থেকে সেটা কি আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়? সেই সময়ে প্রাদুর্ভাবটা শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে একটা আর্মি ক্যাম্পে। তাহলে সেই অতিমারী তৈরি হওয়ার সম্পূর্ণ দায় কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের? প্রায় গোটাটাই তো তৈরি হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচলের কারণে। কেউই তো চায়নি যুদ্ধ বন্ধ করতে। বরং অতিমারী সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপরে ব্যাপক ভাবে সেন্সরশিপ চাপানো হয়েছিল, এবং যুদ্ধরত সব রাষ্ট্রই কমবেশি সেটা করেছিল। অন্যভাবে একই জিনিস হয়েছে এবারেও, ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্র্যাভেল মারফৎ। যথাসময়ে সেগুলো বন্ধ করা হয়নি। অতিমারীর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই।

 

এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের University of Manitoba-তে বিশিষ্ট অধ্যাপক ভ্যাকলাভ স্মিলের (Vaclav Smil) এই কথাটাঃ  “In 1918 it took six days to cross the Atlantic on a liner; now it takes six hours on a jetliner, and there is no doubt that air travel plays an important role in the diffusion of annual epidemics.”[5] অর্থাৎ ১৯১৮ সালে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে লাগতো ছয় দিন; এখন লাগে ছঘণ্টা, “এবং কোনও সন্দেহ নেই যে বার্ষিক মহামারী প্রসারে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এয়ার ট্র্যাভেল।শোনা উচিৎ তাঁর এই কথাটাওঃ “The global economy is incomparably more integrated, and modern travel and traffic in goods (including live animals and other agricultural products) are several orders of magnitude faster and more voluminous than nine decades ago, a near-ideal condition to spread infections around the world.” অর্থাৎবিশ্ব অর্থনীতি এখন অতুলীয় ভাবে আরও বেশী পরস্পরযুক্ত, এবং নয় দশক আগের তুলনায় পণ্য (জীবন্ত প্রাণী ও অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য সহ) সম্পর্কিত মডার্ন ট্র্যাভেল ও ট্র্যাফিক কয়েক গুণ দ্রুততর এবং আয়তনেও বেশী, যেটা হল বিশ্ব জুড়ে সঙ্ক্রমণ প্রসারের একটা আদর্শ অবস্থা। 

 

এরকম একটা বিশ্ব অর্থনীতির জমানায়, অতিমারী রোধে অতীতের তুলনায় তো আরও বেশী দরকার ছিল প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়ার সাথে সাথেই মানুষের আন্তর্জাতিক চলাচলকে অন্তত বন্ধ করে দেওয়া। স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ে সেটা করা হয়নি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে। এবারে করা হয়নি বিশ্ব বাজার সাপেক্ষেজাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থথেকে। যদিও বিশ্ব যুদ্ধটাও ছিল এই একই স্বার্থ থেকে, এবং এটাও আমরা সবাই বুঝি যেজাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থআর সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ একেবারেই আলাদা জিনিস। এক কথায় বললে, অতিমারী তৈরি হয়েছেজাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ”-কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে, অতিমারী ঠেকানোর কাজগুলোকে নয়। দায় চিন, জাপান, সাউথ কোরিয়া, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত, এরকম অনেকেরই। 

 

Ø  দেশের মধ্যে মানুষ থেকে মানুষে সঙ্ক্রমণ প্রসার রোধে সরকারকে কী করতে হয়, ইতিহাস সেই শিক্ষাও রেখে গেছে। এই ব্যাপারে স্প্যানিশ ফ্লু অবধি পিছনোরও দরকার নেই, মাত্র ১৭ বছর আগের সেই SARS অতিমারীই তো দেখিয়ে দিয়েছে কী করতে হয়। বস্তুত সেগুলোই তো করতে হয়েছে। অভিনব কিছু আবিষ্কার করতে হয়নি। অর্থাৎ সঙ্ক্রমিতদের আইসোলেট করা; তাদের ক্লোস কন্টাক্ট তো বটেই, সম্ভাব্য সাম্প্রতিক কন্টাক্টগুলোকেও খুঁজে বের করে কোয়ারান্টাইনে রাখা এবং তারা সঙ্ক্রমিত কি না ভালো করে টেস্ট করে বুঝে নেওয়া ইত্যাদি।

 

মহামারীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, “কোয়ারান্টাইনশব্দটা প্রায় ৬৫০ বছরের পুরনো। এবং এই কথাটা দিয়ে এখন যা বোঝানো হচ্ছে, তখনও সেই অর্থেই তার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। শব্দটার বুৎপত্তি চতুর্দশ শতকের মধ্যযুগীয় ইতালিতে, ব্যুবনিক প্লেগের সময়ে, যেটা থেকে তৈরি হওয়া মহামারী ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে “Black Death” নামে। বহির্বিশ্ব থেকে জাহাজ চলাচল মারফৎ ইতালিতে সেই প্লেগের প্রসার ঠেকাতে ১৩৭৭ সালে একটা বন্দর নগরীতে - তখন যার নাম ছিল Ragusa, আর বর্তমানে Dubrovnik - অনেকটা এখনকার মতোই কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রথমে করা হয়েছিল ৩০ দিনের কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা, ইতালীয় ভাষায় যার নাম ছিল “trentino”। পরে সময়টা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪০ দিন। আর ইতালীয় ভাষায় একটা ৪০ দিনের পর্বকে বলা হয় “quarantino”। ইংরাজি “quarantine” শব্দটার উদ্ভব সেখান থেকেই।[35] এতো বছরের পুরনো সেই শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে, দ্রুততার সাথে এবং ব্যাপক ভাবে এবারে কাজে লাগানো হয়েছে কি? 

 

তাছাড়া, কেউ সঙ্ক্রমিত কি না তার টেস্টিং-এর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তো এখন অনেক এগিয়ে। সেই কাজও কি যথেষ্ট ব্যাপক ভাবে করা হয়েছে? এবারে এই কাজটা তো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে এই কারণে যে, রোগটার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে বেশ কয়েকটা দিন লেগে যায় এবং বাহ্যিক লক্ষণবিহীন ভাবে নিজের অজান্তেই অনেকে যে সঙ্ক্রমণ ছড়াতে পারে সেটা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছিল। কন্টাক্ট ট্রেসিং-এর কাজই বা হয়েছে কতোটুকু?

 

অন্তত এই দেশে এই কাজগুলো যে যথেষ্ট উপেক্ষিত থেকেছে তাই নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকতে পারে না। সঙ্ক্রমণ প্রসারে এই উপেক্ষার বিরাট একটা ভূমিকা কি নেই? কেন করা হয়েছে এমন উপেক্ষা? নিঃসন্দেহে এখানেও কাজ করেছে সরকারী অর্থনৈতিক হিসাব। এই কাজগুলো ঠিক ঠিক মতো করতে হলে প্রচুর খরচ। কিন্তু সরকারের তো ভীষণ অনীহা এসব কাজে খরচে। কথাটা কমবেশী সত্যি সব সরকারের জন্যই। একটা বিজনেস হাউসের মতো সমস্ত সরকারই সাধারণত চায় তার তহবিলকে খরচের তুলনায় অনেক বেশী বিনিয়োগ করতে। কারণ খরচ আর বিনিয়োগ এক জিনিস নয়; বিনিয়োগে তহবিল বেড়ে ওঠে, খরচে নয়।  

 

Ø  মহামারীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি এই সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরে কী বিরাট মাত্রায় চাপ তৈরি হয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ডাক্তার ও নার্সদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো আগে থেকেই হাজির না থাকলে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, ইতিহাসে সেই ছবিও ভালো মতোই আঁকা হয়ে আছে। আর এমনও তো নয় যে একটা ছোঁয়াচে রোগ থেকে অতিমারী তৈরি হওয়ার বিপদ চিরতরে মুছে গিয়েছিল, সেটা ইতিহাস মাত্র। ইবোলা কতো বছর আগের ঘটনা? সোয়াইন ফ্লু কতো বছর আগের ঘটনা? পূর্ববর্তী SARS-ই বা কতো বছর আগের ঘটনা? স্প্যানিশ ফ্লু অবধি পিছনোরও তো দরকার নেই। অথচ কী দেখলাম আমরা? একেবারে দগদগে ভাবে ধরা পড়লো মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচাতে যেরকম স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকা উচিৎ ছিল, অবস্থাটা তার ধারেকাছেও ছিল না অনেক জায়গাতেই। মৃত্যুর মিছিলও বেড়ে চলেছে তো সেই কারণেই। এমনকী বহু ক্ষেত্রে সঙ্ক্রমণ ছড়িয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকেও, যেমন অতীতেও দেখা গেছে। 

 

Ø  সঙ্ক্রমণ বাঁচিয়ে চলতে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে নাগরিকদের করণীয়ের ব্যাপারে সরকারী তরফে চালানো প্রচার সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমেই বলা উচিৎ, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে সচেতনতা আগে থেকেই থাকতে পারতো যদি মহামারীর ইতিহাসগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছোটবেলা থেকেই পড়ানো হতো। দেখাই গেল, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই ইতিহাসের কোনও গুরুত্ব নেই। এখানে এটাও বলা উচিৎ যে সঙ্ক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় কী কী করা উচিৎ আর কী কী নয়, সেই ব্যাপারে এবারে সব থেকে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রাখতে পেরেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো (চিন সহ), সেখানে ২০০২-০৩-এ হওয়া অভিজ্ঞতা টাটকা রয়ে গেছিল বলেই। এটা যতো না ছিল ইতিহাস সচেতনতার প্রকাশ তার থেকে অনেক বেশী টাটকা অভিজ্ঞতার কারণে।

 

এখানে আরও একটা কথাঃ ছোটোবেলা থেকেই বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির কাজে যথেষ্ট জোর থাকলে মানুষকে বোঝাতে বেশী সমস্যা হওয়ার কথাও নয়। অথচ ঘটনা হল, সঙ্ক্রমণ প্রসার রোধে অনেক রকম কুসংস্কারকেও প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে এই দেশে। ১০০ বছর আগের সেই স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ের মতো এবারেও সঙ্ক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় অপ্রমাণিত ও অবৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরামর্শ এসেছে সরকারী মহল থেকেই, শুধু এখানে নয় আমেরিকাতেও।

      

Ø  এবারে আসা যাক গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার এবং সেগুলোর প্রভাব প্রসঙ্গে। এখানে প্রথমেই বলা দরকার যে, ছোটোবেলা থেকেই মানুষের মধ্যে বস্তুবাদী চিন্তা, যুক্তিবোধ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলার জোরালো প্রয়াস থাকলে এইসব প্রচারে মানুষ ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ার সুযোগ থাকার কথা অনেক কম। কিন্তু সেটাই হতে দেখা গেলো। এটাও বুঝিয়ে দিল কেমন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।

তাছাড়া স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীর ইতিহাসও আমাদের দেখিয়েছে এরকম সময়ে গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নতুন কিছু নয়। এটাও দেখিয়েছে যে এর পেছনে রয়েছে জাতিবিদ্বেষেরও একটা বিরাট ভূমিকা; এবং এটাও দেখিয়েছে মহামারী-জনিত আতঙ্ক ও জাতিবিদ্বেষ মিলেমিশে তৈরি হওয়া অবস্থাটা চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলোর শক্তিবৃদ্ধির এক অতি অনুকূল পরিবেশ। এবারেও কি একই জিনিস আমরা দেখছি না? অথচ দরকার ছিল ঠিক উল্টোটাঃ সঙ্ক্রমণ ও মৃত্যু মিছিল থামাতে জাতিরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা।

 

WHO থেকে এরকম সহযোগিতার জন্য অনেক আবেদন সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি। তার জন্য WHO নিজেও অনেকটা দায়ী। তার অনেকগুলো কারণ। যেমন, চিনের দোষ-ত্রুটির প্রকাশ্য সমালোচনা কখনোই সে করেনি, বরং চিনের ইতিবাচক দিকগুলোকে - যেমন, নিজের দেশে মহামারী থামানোর সক্রিয়তা এবং নয়া কোরোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্স যথেষ্ট দ্রুত বিশ্বের কাছে প্রকাশ করা - বড্ড বেশী প্রশংসা করেছে; এয়ার ট্র্যাভেল বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার এক্তিয়ার তার না থাকলেও তার বিপদগুলোকে যথেষ্ট জোর দিয়ে মোটেই সে প্রচার করেনি বরং বুঝিয়ে গেছে এটা বন্ধ না করেও বিশ্বজুড়ে সঙ্ক্রমণের প্রসার ঠেকানো সম্ভব; প্যানডেমিক ঘোষণা করতে যথেষ্ট সময় নিয়েছে ইত্যাদি।

 

এতো কিছুর কারণে WHO-র ওপরে বিশ্বের আস্থা থেকেছে সামান্যই। যার ফলে দেখা গেছে, কোনও সঠিক কথাও যদি সে বলা থাকে এবং সঠিক পরামর্শ দিয়ে থাকে, সেগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ এরকম একটা সময়ে সব থেকে শক্তিশালী ও ইতিবাচক ভূমিকা থাকা দরকার ছিল তার দিক থেকেই।

 

তবে মহামারী রোধের প্রশ্নে WHO-র সমালোচনা এই প্রথম নয়। ২০০৯-১০-এর সোয়াইন ফ্লুর ক্ষেত্রেও এরকম জিনিস হয়েছে।[36] প্যানডেমিক ঘোষণা করতে যথেষ্ট দ্বিধা করা এবং সময় নেওয়ার জন্য সেবারেও সে সমালোচিত হয়েছে। এবারের মতো সেবারেও বলা হয়েছিল, তার সংজ্ঞা অনুযায়ী প্যানডেমিক ঘোষণার মতো পরিস্থতি এখনও তৈরি হয়নি। হয়তো তাই। কিন্তু সংজ্ঞা বড় নাকি বিপদ বড়? কিন্তু প্রথম দিকের সেই দ্বিধার ঠিক প্রায় উল্টো কাজ, অর্থাৎ পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে অনেক বড় করে দেখানো, আবার করা হয়েছিল পরে গিয়ে। যদিও আক্রান্ত দেশগুলো সবাই একই মাত্রায় আক্রান্ত ছিল না। সব থেকে আক্রান্ত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড আক্রান্ত হয়েছিল তুলনায় অনেক কম। যার ফলে, সেই সময়ে WHO-র বিরুদ্ধে এরকম সমালোচনাও উঠেছিল যে, পরিস্থিতিকে বড্ড বেশী ভয়ঙ্কর করে দেখানো হচ্ছে ভ্যাকসিন মেকারদের চাপে।

আসলে খুব গভীরে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে বোঝার চেষ্টা করলে হয়তো দেখা যাবে WHO নিজেও চলেছেবিশ্ব অর্থনীতির স্বার্থকেবড্ড বেশী মাথায় রেখে। যতোদূর মনে হয়, তার চিন্তা থেকেছে এমন ভাবে ভূমিকা রাখার যাতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না, অর্থাৎ প্যানডেমিক রোধ করা যাবে অথচ বিশ্ব অর্থনীতিতে সেই কাজে গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামান্যই। বাস্তবে হয়েছে ঠিক উল্টোটাই।

 

 

[ন্দন দেবনাথ, বিজ্ঞানসাধক ও মননে আপামর তথ্য ও 
তত্ত্বভিত্তিক সত্যনিষ্ঠ । মনোজ্ঞ বিশ্লেষণেই তাঁর মূল আগ্রহ । প্রকাশিত হয়েছে নানা বই । সাম্প্রতিকতম বইটি ই-বুক 
আকারেও প্রকাশিত । নিচের লিংক থেকে কিনে নিতে 
পারেন পাঠক ।]

 

 


E-Book (Click And Buy)

The climate crisis demands the most important enlightenment in today's public life. Its role during the epidemic is immense. But usually not ordinary people or politicians - no one cares. As a result, the need for this book is even greater. It's not just about writing or reading - it's about awareness in life.


[বিঃদ্রঃ -  ব্যবহৃত সমস্ত ছবিগুলি ও তথ্যগুলি গুগল সার্চের দ্বারা প্রাপ্ত । যথাযোগ্য উৎসের উল্লেখ করা হয়েছে ও লিংকও দেওয়া হয়েছে । ছবিগুলি সম্পূর্ণভাবে সেই সেই ওয়েবসাইটগুলির কৃতিত্ব । এখানে কেবলমাত্র লেখাটির মননের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণতা বজায় রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে । এর বেশি কোনও দাবি নেই, উক্ত ওয়েবসাইটে গিয়ে পাঠক তাদের প্রতিবেদনগুলি পড়তে পারেন । প্রত্যেকটি ওয়েবসাইটের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ । ]


তথ্যসূত্রঃ

[1]“Why October 1918 Was America's Deadliest Month Ever” - Christopher Klein; History.com, 5 October 2018 (original), 15 May 2020 (updated); https://www.history.com/news/spanish-flu-deaths-october-1918

[2] “Why the Second Wave of the 1918 Spanish Flu Was So Deadly” - Dave Roos; History.com, 3 March 2020 (original), 29 April 2020 (updated); https://www.history.com/news/spanish-flu-second-wave-resurgence

[3] “The Spanish Influenza Pandemic: a lesson from history 100 years after 1918” - M. MARTINI,V. GAZZANIGA,N.L. BRAGAZZI,and I. BARBERIS; NCBI, 29 March 2019; https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6477554/

 

[4]“1918 Pandemic (H1N1 virus)” - CDC (USA); https://www.cdc.gov/flu/pandemic-resources/1918-pandemic-h1n1.html

 

[5]“A Complete History of Pandemics” - Vaclav Smil; MIT Press Reader, 30 March 2020; https://thereader.mitpress.mit.edu/a-complete-history-of-pandemics/

 

[6]“1918 flu pandemic killed 12 million Indians, and British overlords’ indifference strengthened the anti-colonial movement” - Maura Chhun; The Conversation, 17 April 2020, Updated 24 April 2020; https://theconversation.com/1918-flu-pandemic-killed-12-million-indians-and-british-overlords-indifference-strengthened-the-anti-colonial-movement-133605

[7] “The evolution of pandemic influenza: evidence from India, 1918–19” - Siddharth Chandra and Eva Kassens-Noor; NCBI, 19 September 2014; https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4262128/

[8] “Why Was It Called the 'Spanish Flu?'” - Evan Andrews; History.com, 12 January 2016 (original), 27 March 2020 (updated); https://www.history.com/news/why-was-it-called-the-spanish-flu

 

[9] “1968 flu pandemic” - Kara Rogers; Encyclopaedia Britannica; https://www.britannica.com/event/1968-flu-pandemic

[10] “Revisiting the 1957 and 1968 influenza pandemics” - Mark Honigsbaum; The Lancet, 25 May 2020; https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(20)31201-0/fulltext

[11] “Why I’m taking the coronavirus hype with a pinch of salt” - Simon Jenkins; The Guardian, 6 March 2020;  https://www.theguardian.com/commentisfree/2020/mar/06/coronavirus-hype-crisis-predictions-sars-swine-flu-panics

 

[12] “Forgotten Pandemic Offers Contrast to Today’s Coronavirus Lockdowns” - Bojan Pancevski; The Wall Street Journal, 24 April 2020; https://www.wsj.com/articles/forgotten-pandemic-offers-contrast-to-todays-coronavirus-lockdowns-11587720625

 

[13] “Summary of the Global HIV Epidemic” - WHO; https://www.who.int/gho/hiv/en/

 

[14] “History of AIDS” - History.com Editors; History, 13 July 2017; https://www.history.com/topics/1980s/history-of-aids

 

[15] “How AIDS Remained an Unspoken—But Deadly—Epidemic for Years” - Joseph Bennington-Castro; History, 1 June 2020; https://www.history.com/news/aids-epidemic-ronald-reagan

 

[16] “Where Did HIV Come From? A Look at the Origins of the Pandemic of Our Time” - Dr. Peter Daszak; Eco Health Alliance, 1 December 2017; https://www.ecohealthalliance.org/2017/12/world-aids-day

 

[17] “SARS Basics Fact Sheet” - CDC (USA); https://www.cdc.gov/sars/about/fs-sars.html

 

[18] “SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome)” - WHO; https://www.who.int/ith/diseases/sars/en/

 

[19] “Sars legacy still felt in Hong Kong, 10 years on” - Katie Hunt; BBC News, 20 March 2013; https://www.bbc.com/news/world-asia-china-21680682

 

[20] “The SARS epidemic in Hong Kong: what lessons have we learned?” - Lee Shiu Hung; NCBI, August 2003; https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC539564/

 

[21] “Lee Shiu-hung, former Director of Health, passes away at 80” - South China Morning Post, 9 January 2014; https://www.scmp.com/news/hong-kong/article/1401378/lee-shiu-hung-former-director-health-passes-away-80

 

[22] “Seasonality of SARS-CoV-2: Will COVID-19 go away on its own in warmer weather?” - Marc Lipsitch; Center for Communicable Disease Dynamics, 26 February 2020; https://ccdd.hsph.harvard.edu/will-covid-19-go-away-on-its-own-in-warmer-weather/

 

[23] “DNA sleuths read the coronavirus genome, tracing its origins and looking for dangerous mutations” - STAT News, 24 January 2020; https://www.statnews.com/2020/01/24/dna-sleuths-read-coronavirus-genome-tracing-origins-and-mutations/

 

[24] “Origins and evolutionary genomics of the 2009 swine-origin H1N1 influenza A epidemic” - Gavin J. D. Smith, Dhanasekaran Vijaykrishna, Justin Bahl, Samantha J. Lycett, Michael Worobey, Oliver G. Pybus, Siu Kit Ma, Chung Lam Cheung, Jayna Raghwani, Samir Bhatt, J. S. Malik Peiris, Yi Guan, Andrew Rambaut; Nature, 11 June 2009; https://www.nature.com/articles/nature08182

[25] “What is the pandemic (H1N1) 2009 virus?” - WHO, 24 February 2010; https://www.who.int/csr/disease/swineflu/frequently_asked_questions/about_disease/en/

[26] “Origin of 2009 H1N1 Flu (Swine Flu): Questions and Answers” - CDC (USA), 25 November 2009; https://www.cdc.gov/h1n1flu/information_h1n1_virus_qa.htm

 

[27] “Swine Flu Genes From Pigs Only, Not Humans or Birds” - Brandon Keim; WIRED, 28 April 2009; https://www.wired.com/2009/04/swinefluupdate/

 

[28] “2009 H1N1 Pandemic (H1N1pdm09 virus)” - CDC (USA), 11 June 2019; https://www.cdc.gov/flu/pandemic-resources/2009-h1n1-pandemic.html

[29] “History of Ebola Virus Disease” - CDC (USA); https://www.cdc.gov/vhf/ebola/history/summaries.html

[30] Ebola virus disease - WHO, 10 February 2020; https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/ebola-virus-disease

[31] “2014-2016 Ebola Outbreak in West Africa” - CDC (USA), https://www.cdc.gov/vhf/ebola/history/2014-2016-outbreak/index.html

[32] “Where Did Ebola Come From?” - Rachael Rettner; Live Science, 22 September 2014;          https://www.livescience.com/47946-where-did-ebola-come-from.html

[33] “Coronavirus: the first three months as it happened” - Nature, 22 April 2020                                                    https://www.nature.com/articles/d41586-020-00154-w

[34] “Coronavirus Started in China, but Europe Became the Hub for Its Global Spread” - by Joe Penny; The Intercept, 2 April 2020                                                       https://theintercept.com/2020/04/02/coronavirus-europe-travel/

[35] “Social Distancing and Quarantine Were Used in Medieval Times to Fight the Black Death” - Dave Roos; History.com, 25 March 2020 (original), 27 March 2020 (updated); https://www.history.com/news/quarantine-black-death-medieval

 

[36] “2009 Flu Pandemic Was 10 Times More Deadly Than Previously Thought” - Richard Knox; NPR, 26 November 2013; https://www.npr.org/sections/health-shots/2013/11/26/247379604/2009-flu-pandemic-was-10-times-more-deadly-than-previously-thought