Monday, October 5, 2020

নীরদচন্দ্রের বাংলা সাহিত্য-পত্রিকা প্রয়াসের অজ্ঞাত কথা*

 

লিখেছেন : শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

 


বাংলা পত্রিকা প্রকাশের দুশো বছর হয়ে গেল; শ্লাঘার কথা বটে! অন্তত ভারতীয় ভাষার সাপেক্ষে তো বটেই। প্রসঙ্গক্রমে আবার তথাকথিত ‘ভারতীয় রিনেসেন্স’, অন্তত ‘বাংলা নবজাগরণ’ নিয়ে নানান কথা উঠতে পড়তে থাকবে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে ভারত উপমহাদেশে পরিবর্তন যে কিছু দ্রুতগতিতে চলছিল সে কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাক, কিন্তু বিষয়টি অনস্বীকার্য।

 


এই ক্রিয়াকলাপে বাংলা ভাষাভাষিদের স্থান যে কিছু স্বতন্ত্র, সে কথা এখন স্বীকৃত। তবে সংস্কৃতি, বিশেষত সাহিত্য ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান নিয়ে যত কথা হয়, অন্যগুলির ক্ষেত্রে তত হয় না। যদিও যাপনচিত্রের সংকীর্ণ সাহিত্য-ক্ষেত্রটিতেই শুধু নয়, রাজনীতি, সমাজনীতির ব্যপ্ত পরিসরেও বাঙালির ভূমিকা অনেকাংশেই অগ্রণীর। তার নানান ঐতিহাসিক কারণ আছে। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্রিটিশদের ঘনিষ্ট সংস্পর্শ, ইওরোপীয় সভ্যতার অভিঘাত এনেছিল বাঙালি জীবনে। পরবর্তী শতাব্দী জুড়ে তার সদর্থক প্রভাব অনেকখানি গ্রহণ করতে পেরেছিল বাঙালি। নতুন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে যতখানি হইচই হয়, জীবনের অন্য ক্ষেত্রগুলি নিয়ে ততখানি হয় না, সে-ও হয়ত ওই ইওরোপীয় সংস্কৃতিই প্রভাব। যেন, রাজনীতি-সমাজনীতি-বানিজ্য-বিজ্ঞান-ক্রীড়া সবেরই অভীষ্ট, ‘সূক্ষতর’ কলাক্ষেত্রের চর্চার পরিপোষণ। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলার মত তথাকথিত সূক্ষতর কলাক্ষেত্রগুলির মধ্যেও সাহিত্যের স্থান যেন বিশিষ্ট। সাহিত্য নিয়ে বাঙালির যতই মাতামাতি থাকুক অন্যতর কলা বিষয়গুলি শুধু নয়, রাজনীতি সমাজনীতির মতো জনপরিসরের বিষয়গুলিই যে সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য এবং বিষয়গুলি যে সাহিত্যকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে সে সব চিহ্ন এখন সুস্পষ্ট। আর সাহিত্য প্রসারে মুদ্রণ-সংস্কৃতির মতো নিতান্ত কেজো যান্ত্রিক সহযোগ যে একান্ত প্রয়োজন এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সূচনা লগ্ন থেকেই পত্রপত্রিকা প্রকাশ এবং পত্রিকার বিষয় হিসাবে সাহিত্যের পাশাপাশি যাবতীয় বিশ্ববিদ্যা যে বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল পুরানো পত্র-পত্রিকা দেখলে সে কথা বোঝা যায়।

 

আরো অনেক কিছুর মতই পত্র-পত্রিকা প্রকাশের সংস্কৃতি যেহেতু বাঙালির ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া, এর বিষয় প্রকরণ থেকে উপস্থাপনায় সে ছাপ স্পষ্ট। ব্রিটেনের  তখন প্রসারের সময়, সর্বক্ষেত্রে। ইওরোপ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে সে নেতৃস্থানীয়। ক্রমে ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকাল তাকে এমন এক গৌরবের শিরোপা দিয়েছে যার প্রভাব শিল্প সংস্কৃতি থেকে সাহিত্যে। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যের কোণে কোণে সাম্রাজ্যের দূতরা সেই গরিমা তুলে ধরছেন নানান ভাব ও ভাষায়। পণ্ডিতেরা দেখেছেন রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব, অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও ক্রমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সহায়তা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের রাজধানী হিসাবে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাঙালিও ক্রমে সেই গৌরবের ভাগী হয়ে উঠেছে, কিয়দ্বংশে তো বটেই। শাসনকার্যে সুবিধার জন্যই প্রথম যুগ থেকে ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা বাংলা শিখতে আগ্রহী। পাশাপাশি তারা ইংরাজি শিখিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছে একদল এ দেশীয় সহযোগী। বাঙালি ও ব্রিটিশদের মধ্যে এই ভাষাগত পারস্পরিকতার নানান জটিল মনস্তাত্বিক দিক আছে, কিন্তু স্থূলভাবে পারস্পরিকতাটুকু ছিল। একদিকে ব্রিটিশ শাসকরা শাসনের প্রয়োজনে বাংলা সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে গিয়ে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ এড়াতে পারেননি, এড়াতে পারেননি তার পৃষ্ঠপোষণা এবং প্রসারে ভূমিকা; অন্যদিকে ইংরাজি ভাষা-সংস্কৃতি আয়ত্ত করে, বাঙালি শাসন যন্ত্রের ক্রীড়নক হতে হতেও ইংরাজি ভাষা সংস্কৃতিকেই করে তুলেছে তার বিশ্বায়নের জানালা। প্রথম প্রকাশ থেকে পরবর্তী প্রায় একশো বছর বাঙালির পত্র-পত্রিকাও এই লক্ষণে আক্রান্ত।

 

সূচনাকালে শাসিত সমাজে ইংরাজি ভাষা প্রচলনের কোনো উদ্যোগ শাসকসমাজে দেখা যায়নি; বরং শাসিতের ভাষা শিখে নেওয়াতেই তাদের আগ্রহ ছিল বেশি। অন্যদিকে শাসকের ভাষা শেখায় আগ্রহ ছিল বরং দেশীয় ‘উঁচু’ সমাজে। শাসকের ‘কেরানি’ হওয়ায় আগ্রহ বোধ করার কোনো কারণ তাদের থাকার কথা নয়; বরং বিশ্বের জানালা হিসাবে ভাষাটির সম্ভাবনা নিশ্চয় তাঁরা বুঝেছিলেন। ক্রমে সময় বদলায়, দেশীয় সমাজের মধ্যে থেকেই ‘কেরানি’ উৎপাদনের ছকটি শাসকের মাথায় আসতে সময় লাগেনি, দেশীয় সমাজেও যে তার প্রভাব পড়েনি এমন নয়। কিন্তু ততদিনে ভাষাটির আন্তর্জাতিক সম্ভাবনার বোধও ছড়িয়ে গেছে। ইংরাজি ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইওরোপীয় রুচিও ছড়িয়ে গেছে অনেকদূর- রাজধানী শহর থেকে মফস্বলই কেবল নয়, বহুদূর গ্রামদেশেও। মাইকেলের মত জমিদার তনয় কেবল নন, দরিদ্র কথক ঠাকুরের ছেলে অপুরও মগজ দখল করে থাকে ইংরাজ কবি বায়রন। 

 

অন্যদিকে মাত্র একশো বছরের প্রয়াসেই বাংলা ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের’ অন্যতম ভাষা-সংস্কৃতি। হ্যাঁ, ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে তার কিছু আন্তর্জাতিক খ্যাতি। সংস্কৃতর পাশাপাশি বাংলায় লেখা বই সাহেবরাই অনুবাদ করেন ইংরাজিতে! বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি নেহাত ফেলনা নয়।

গঙ্গাকিশোরের বঙ্গাল গেজেটি-র কোনো নমুনা এ কালের হাতে এখনো এসে পৌঁছায়নি, কিন্তু সমাচার দর্পণ থেকে সমাচার চন্দ্রিকা, তত্ত্বকৌমুদী থেকে বঙ্গদর্শন, ভারতী থেকে প্রবাসী হয়ে কালে কালে দেশ, নমুনা দেখলে মনে হয় যেন এ যেন মাছ-ভাত খাওয়া, সঙের পালাগান শোনা, নিছক কুঁয়ার বাঙালির কথা ভেবে পরিকল্পিত নয়। যেন কোনো অ-বাংলাভাষী ইওরোপীয় মনের কথা ভেবে তৈরি। তার রচনা নির্বাচনে কেবল বাঙালি জীবনের পাঁচালি নেই, আছে নানা ভাবের চর্চা, নানা বিষয়ের চর্চা। গল্প কবিতার রস-রচনার পাশাপাশি গুরুগম্ভীর তত্বালোচনা তার আদিযুগের উপজীব্য। কেজো প্রবন্ধ নিবন্ধের পাশাপাশি গল্প কবিতায় বাঙালির জীবন, বাঙালির যাপনকে দেখার চেষ্টা আছে বিশ্বের অন্যান্য ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে, তুলনা করে। উপস্থাপনা থেকে চিত্রণ মুদ্রণ সবেই থাকে তার বিশ্বের প্রথম শ্রেণির কাজের ছাপ। (সমকালীন অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় পত্র-পত্রিকার নমুনা কম, যতটুকু পাওয়া যায়, পাশাপাশি রেখে বিবেচনা করলেই বাংলা পত্রপত্রিকার বিষয় ও উপস্থাপনার ব্যতিক্রম বোঝা যাবে)। অসাড় তর্কে না গিয়ে পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় প্রথম দিন থেকেই বাঙালি সমকালীন ইংরাজি পত্রপত্রিকার সঙ্গে পরিচিত ছিল; এবং সে সবই ছিল তার প্রধান অনুপ্রেরণা। সে যুগে বাঙালি ‘অনুকরণ মাত্র’কেই ‘দূষ্য’ মনে করত না। বরং সজাগ থাকত কীভাবে গ্রহণকে আত্তীকরণ করা যায়। রাজনীতি-ক্ষেত্রে সুরেন্দ্রনাথ হোন বা অরবিন্দ, সমাজ-ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর হোন বা দেবেন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দ, সাহিত্য-ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল, একটি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারেননি। বাঙালির সেই ধারা বজায় থেকেছে দুশো বছরেও। বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের দ্বিশতবর্ষ যাপন করতে বসে, পূর্বজদের স্মরণ করতে গিয়ে, কতদূর পথ পেরোনো গেল সেটুকুই শুধু বিবেচ্য না রেখে, পথের মানটুকুও কি একবার বিবেচনা করা যাবে!

 

 

ইংরাজ জমানায় বাঙালি জীবনে পট পরিবর্তনের কেন্দ্র কলকাতা। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কলকাতা নিছক ব্রিটিশ বানিজ্য কেন্দ্র আর নয়, নয় কেবল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীও। সুদূর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে তার রেশ পৌঁছায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম সংস্কৃতিকেন্দ্র হিসাবে- সেখানে হিন্দু কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, সেখানে ব্রাহ্মসমাজের সদর দফতর। কলকাতায় ভারতসভা, কংগ্রেস। কলকাতায় মেডিকেল কলেজ, কালটিভেশন অব সায়েন্স, ক্রমে বসু বিজ্ঞান মন্দির। কলকাতায় এমন অনেক কিছু যার দিকে শ্লাঘার চোখে তাকায় অপরাপর ভারতবাসীই কেবল নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের সংস্কৃতিমনস্করা।

 

কলকাতা-কেন্দ্রিক তো নিশ্চয়; কিন্তু সে ঢেউ লাগে রাজধানী থেকে বহুদূরে। সুদূর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে ‘ভূস্বামী বংশীয়’ আইনজীবীর পুত্র নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৩ বছর বয়সেই পড়ে ফেলে শেক্সপিয়র শুধু নয়, মিল্টনও। শেক্সপিয়র মিল্টনেই শেষ নয়, উলটে দেখা হয়ে গেছে দান্তে, প্লেটো এমনকি মার্কাস অরেলিয়াসও। সাম্রাজ্যের সেবায় লাগার কোনো আশু প্রয়োজন এই শ্রেণির ছিল না; তাই দান্তের ‘ইনফের্নো’ পড়ার পাশাপাশি মেঘনাদবধ কাব্য-র নরক বর্ণনা যে ফেলনা নয় সে বোধ হতে সমস্যা হয়নি। ইংরাজিতে ইলিয়াড ওডিসির স্বাদ পেয়েও আনন্দমোহন মিত্রের হেলেনা কাব্য যে  ত্যাজ্য নয় সে কথা ভাবতে অসুবিধা হয়নি।

 

ময়মনসিংহের গ্রাম্য বালকের কলকাতায় আসার আগে বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে জ্ঞান টনটনে। ইংরাজি শিক্ষার শুরুয়াৎও অনাড়ম্বর নয়। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ঘরের ছেলে, কাশীরাম, কৃত্তিবাস, ভারতচন্দ্রের গান শুনতে শুনতে বড় হওয়া মফস্বলের বালক অস্পষ্ট হলেও বুঝতে পারে কৃত্তিবাস থেকে মাইকেলের যাত্রাপথ বদলে দিয়েছে ইংরাজি শিক্ষা। কলকাতা সেই ইংরাজি শিক্ষার কেন্দ্রই কেবল নয়, নব্য-বঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থানও বটে। কলকাতা নীরদের জীবনে সংযোগ করে অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলের ফাদার প্রায়রের কাব্যরুচি এবং ইতিহাসবোধ। নেবুতলার কলকাতা পাবলিক স্কুলে এন্ট্রান্স ক্লাসে সাহিত্য পড়াতে আসেন নব্য সাহিত্যিক মোহিতলাল মজুমদার। কলকাতা যোগান দেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় উন্মাদনা। কলকাতা ক্রমে মফস্বলের বালক নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে করে তোলে স্কটিশ চার্চ কলেজের ইতিহাসের সাম্মানিক স্নাতকের ফার্স্ট বয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন বিস্তীর্ণ পূর্ব ভারতের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষকরা তার বিশ্ববিশ্রুত। সেই বিদ্যায়তনিক দীক্ষার ফল ফার্স্ট বয়ের জীবনে মধুর হয়নি।

 

ইতিহাস কেবল একটি বিদ্যায়তনিক বিষয় ছিল না নীরদের কাছে; ইতিহাস তাঁকে ঋদ্ধ করেছে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, নৈতিকতার বোধে। পরিপার্শ্ব তাকে বিভ্রান্ত করেছে। বন্ধু থেকে পরিজন- শিক্ষাকে সবাই গ্রহণ করেছে বস্তুগত জীবনের ভোগমুখীনতাকে পুষ্ট করার জন্য। আদর্শবাদের একগুঁয়েমি ক্রমে একা করেছে নীরদকে। স্নাতকোত্তর পাঠ্যসূচির একঘেয়েমি পরীক্ষায় বসতে নিরুৎসাহিত করেছে নীরদকে। মিলিটারি অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের সরকারি চাকরির উদ্দেশ্যহীনতা পীড়িত করেছে তাকে। ক্রমে ছেড়েই দিতে হয়েছে গড়-বাঙালির সর্বোচ্চ অভীষ্ট উচ্চ বেতনের সরকারি চাকরি।

 

কিশোরগঞ্জ ছেড়ে আসার পর কলকাতা-বাসকালে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সামান্যই পরিচয় ঘটেছে নীরদচন্দ্রের। ঘটেছে আবাল্যের ইংরাজি সাহিত্য অনুরাগের পরিশীলন আর নব-অর্জিত ফরাসি জ্ঞানের সাহিত্যিক প্রসার। ১৯২৫-এর মাঝমাঝি দীর্ঘ বিরতির পর নীরদচন্দ্রের সঙ্গে আবার দেখা হয় মোহিতলাল মজুমদারের। এন্ট্রান্স ক্লাসের লাজুক বালকটির বিশ্বসাহিত্যে জ্ঞান দেখে মাস্টারমশাই কেবল মুগ্ধ নন, বিস্মিতও বটে। ছাত্রটি জীবনের কৃত্য নিয়ে সন্দিহান, সরকারি চাকুরির লক্ষ্যশূন্যতা নিয়ে হতাশ। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ঘনিষ্টতা উভয়ের জীবনেই আনে অন্যতর আবেগ। সাহিত্যসমাজে খ্যাতিমান মাস্টারমশাই ছাত্রটির সাহিত্য-জীবন ব্যাপারে আশাবাদী; চান ছাত্রটিকে কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজে পরিচিত করাতে। লুই পাস্তুরের জীবন তাঁকে অনুপ্রাণিত করে জীবনকে কোনো মহত্তর সাধনায় একনিষ্ঠ করতে; সাহিত্য সাধনাকে নিজ জীবনের কৃত্য হিসাবে বাছতে চান নীরদচন্দ্র। না, কথাসাহিত্যে নিজের সম্ভবনা খতিয়ে দেখেননি তিনি, কবিতাতে তো নয়ই; প্রথমাবধি পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ সাহিত্যই তাঁর প্রকাশমাধ্যম। প্রথম লেখাই প্রকাশিত হয় The Modern Review-তে, বিষয় ভারতচন্দ্র; দ্বিতীয় লেখা The Statesman-এ, বিষয় ছোটলাট লর্ড রোনাল্ডশের লেখা হার্ট অব আর্যাবর্তর সমালোচনা। শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরীর আগেই নীরদ সি চৌধুরী দৃষ্টি আকর্ষণ করেন লিখনশৈলী এবং বক্তব্যের দার্ঢ্যে।

 

মোহিতলালের বন্ধুগোষ্ঠী প্রধানত The Modern Review - প্রবাসীর লেখককুল। রামানন্দ এবং তাঁর পুত্রদ্বয় অশোক কেদার, নীরদচন্দ্রের পাণ্ডিত্যে আস্থাশীল। লেখা দিতে বলেন তাঁরা। অনেককাল পর কোনো বাংলা পত্রিকায় চোখ বোলান নীরদচন্দ্র। নজর করেন রামানন্দের কাজের ধরণ। প্রবাসী পত্রিকার মান সমকালীন কোনো আন্তর্জাতিক পত্রিকার সাপেক্ষে অশ্রদ্ধেয় নয়। কিন্তু বাংলায় লেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। উৎসাহ দেন মোহিতলাল। কখনো নজরুলের সদ্য-প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের আলোচনা কখনো বা কোনো চিত্র প্রদর্শনীর- ছোটখাটো বাংলা রচনা প্রবাসীতে প্রকাশ হয়। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তাঁর লেখা প্রকাশিত হলে নিজের বাংলা লেখার ওপর ভরসা বাড়ে তাঁর।  

 


প্রবাসী প্রেসে কর্মরত সজনীকান্ত ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের মানুষ- উদ্যোগী, মজলিসি, রঙ্গ-ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ। নীরদকে জরিপ করে চলেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানে শনিবারের চিঠি বাংলা সাহিত্য সমাজে খ্যাতি অর্জন করলেও নিয়মিত প্রকাশ ছিল না। এই সময় শনিবারের চিঠি পুনঃপ্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়। মোহিতলালের আগ্রহে নীরদচন্দ্র সাহিত্য প্রসঙ্গ নিয়ে লেখেন তাতে। বলাহক নন্দীর সে লেখার ধরণ পাঠককে বিস্মিত করে; বিশ্বসাহিত্য থেকে মণিমুক্তা শুধু নয়, বিষয়কে সূচিমুখ করতে যে যুক্তিজাল যে ভাষায় প্রয়োগ করা হয়েছে, তা বাংলায় প্রায় অভূতপূর্ব!

 

এন্ট্রান্স পাশের আগে থেকেই মোহিতলালের সাহিত্য-আদর্শে প্রভাবিত নীরদ। দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর সমকালীন বাংলা সাহিত্যের হাল হকিকত মোহিতলালের কাছ থেকেই জেনেছেন/জানছেন তিনি। বিশ্বসাহিত্যের জ্ঞান, সংস্কৃত সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি এবং তখনও পর্যন্ত খ্যাতিমান নতুন যুগের সাহিত্যিক- বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলালসহ অন্যান্যরা মোহিতলাল বা নীরদচন্দ্রদের মাপকাঠি। পূর্ববর্তী যুগের রাজনীতি বা সমাজনীতির নেতৃস্থানীয়রা অনেকেই মৃত অথবা অবসৃত; কিন্তু তাঁদের প্রভাব সমাজে তখন নিঃশেষ নয়। নেতৃস্থানীয়দের মত ও পথ নিয়ে বিভেদ তখনও ছিল, কিন্তু প্রত্যেকেই পূর্ববর্তী ধারার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই নতুন পথ সন্ধানকে সঠিক পথ বলে মনে করতেন, নিজের বক্তব্য যুক্তিসহ উপস্থাপনাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। গণমুখী হতে গিয়ে সস্তা জনপ্রিয় মত তুলে ধরার ভ্রান্তি তাঁদের গ্রাস করেনি। সাহিত্যও আধুনিকতার অনুসারী হয়েছে ঐতিহ্যকে মাথায় রেখেই। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রায় শুরু থেকেই বাংলা সংস্কৃতি যে নতুন মোড় নিচ্ছিল তা মোহিতলাল নীরদচন্দ্রদের বোধের বাইরে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পরবর্তী রাজনীতিতে ‘স্বদেশী’র গঠনমূলক প্রভাব পেরিয়ে ‘বয়কট’ যেমন অধিক জনপ্রিয়তা পায়, সেই রেশ ধরেই প্রায়, ইংরাজি সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ বিশ্ব-সংস্কৃতির প্রতি সমীহ পরিবর্তিত হয় রোষ, ক্ষোভ এবং বর্জনে। যা কিছু নিজস্ব, যা কিছু পরিচিত তাকেই তুলে ধরা হতে থাকে পালটা সংস্কৃতি হিসাবে। ‘পরিশীলন’কে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ করে অচ্ছ্যুত করে তোলা, হয়ে ওঠে নতুন যুগের সাহিত্য লক্ষণ। পূর্ববঙ্গীয় নব্য যুবকরা কল্লোল, প্রগতি, পূর্বাশা প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ‘বাস্তব’ জীবনকে ‘হুবহু’ তুলে ধরাকেই নতুন ধারা করে তুলতে চাইছিলেন। ভাব বা ভাষায় উঠে আসছিল এমন ‘ভঙ্গি’ যা মোহিতলাল বা নীরদচন্দ্রদের মনে হচ্ছিল বালখিল্য অস্থিরতা; ‘অশ্লীলতা’ যার অন্যতম প্রকাশ প্রকরণ। প্রমথ চৌধুরী এমনকি রবীন্দ্রনাথও জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এই ধারাটির সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষণা করছিলেন। শনিবারের চিঠি-কে আশ্রয় করে এই ধারাটির প্রতিবাদ করাই হয়ে ওঠে নীরদচন্দ্রের আশু সাহিত্য-লক্ষ্য। ‘প্রসঙ্গ-কথা’ নামে বলাহক নন্দীর কলাম যুক্তি ও উদাহরণ সহযোগে দেখাতে থাকে এই লেখককুল নির্বিচারে বিদেশী সাহিত্যকে স্বদেশী ছাঁচে ঢালছেন, পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক ভাষাকে সাহিত্যের মূল স্রোতের অন্যতম উপজীব্য করে তুলতে চাইছেন। সাহিত্য যদি সমাজের প্রতিনিধি হয়, সাহিত্য যদি সমাজকে প্রভাবিত করে, তবে ইওরোপীয় সাহিত্য আদর্শকে বাংলা সংস্কৃতির সমাজের অনুসারে আত্তীকরণ না করে চালাতে চাইলে অনুকরণের বোঁটকা গন্ধই শুধু লেগে থাকে না, সমাজের স্বাস্থ্যের পক্ষেও প্রতিকূল হয়।

 

১৩৩৪-এর কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ (১৯২৭, অক্টোবর- ডিসেম্বর) তিন সংখ্যায় ‘প্রসঙ্গ-কথা’ লিখেই বলাহক নন্দী ওরফে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলা সাহিত্য সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রবলভাবে। সঙ্গে শুরু হয় প্রতিক্রিয়া। ১৯২৮-এর শুরুতেই শনিবারের চিঠি সম্পাদনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নীরদচন্দ্রকেই অর্পণ করে গোষ্ঠী। উদ্যমের সঙ্গে সাহিত্যিক ‘ধর্মযুদ্ধ’-এ নামেন নীরদচন্দ্র। ১৩৩৪-এর ৪ এবং ৭ চৈত্র (জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা ভবনে সাহিত্যে অশ্লীলতা নিয়ে আলোচনা সভা হয় রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরীদের উপস্থিতিতে। বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্য সেনগুপ্তরদের বক্তব্যের বিরুদ্ধাচরণ করে বক্তব্য রাখেন নীরদচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্ররা কোনো মিমাংসাসূচক মন্তব্য না করলেও প্রমথ চৌধুরী উভয়পক্ষের বালখিল্যপনা (callowness) নিয়ে জনান্তিকে ঠাট্টা করেন। সে কথা পৌঁছয় শনিমণ্ডলীর কানেও। ১৩৩৫-এর বৈশাখ (১৯২৮ এপ্রিল) সংখ্যায় প্রমথ চৌধুরীর লেখক জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তাঁর সমকালীন সাহিত্য চর্চার অভিমুখ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্ন তোলেন নীরদচন্দ্র। সে লেখার প্রতিক্রিয়া প্রমথ চৌধুরীর শিষ্যমণ্ডলীকে তো বটেই, উষ্ম করে তোলে এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও। পত্র-পত্রিকায় যে সব প্রতিবাদ-পত্র প্রকাশিত হয়, তাতে নীরদচন্দ্রের বক্তব্যের কোনো যৌক্তিক প্রতিবাদ দেখা যায় না, বরং ব্যক্তি আক্রমণসহ কুৎসাই সে সবের উপজীব্য। শনিবারের চিঠি-র পরের সংখ্যায় নীরদচন্দ্র যে উত্তর দেন তাতে এসব কুৎসা পেরিয়ে সরাসরি প্রমথ চৌধুরীকেই আবারও পালটা প্রশ্ন করা হয় আরো জোরালো যুক্তি ও ভাষায়। শনিবারের চিঠিতে ক্রমে যোগ দিতে থাকেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায় থেকে রাজশেখর বসু, বনফুলের মত সাহিত্য প্রয়াসীরা।

 

বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশের সময় সমকালীন বাংলা সাহিত্য বিষয়ে কোনো জ্ঞান বা আগ্রহ ছিল না নীরদচন্দ্রের। মোহিতলালের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা এবং সঙ্গ তাঁকে এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল করে তোলে। ‘শনিমণ্ডলী’তে তাঁর যোগদান এবং ক্রমে সম্পাদকত্ব গ্রহণের পেছনে তাঁর অন্যতম প্রণোদনা ছিল সাহিত্যিক। আধুনিকতার নামে ধ্যাষ্টামোর বিহিত করাকে তিনি কৃত্য হিসাবে নিয়েছিলেন। তাঁর সমগ্র প্রয়াসটিই ছিল বাংলা সাহিত্যকে একই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের মূলধারার সঙ্গে সংযুক্ত রাখা এবং অবশ্যই তা নিজ ঐতিহ্যকে বিসর্জন না দিয়ে। কিন্তু এই লড়াইতে ক্রমেই তিনি একঘরে বোধ করতে থাকেন। পত্রিকায় অশ্লীলতা প্রচারের অভিযোগে সম্পাদক হিসাবে নীরদচন্দ্রকে লালবাজারের গোয়েন্দা পুলিশ তলব করে। নীরদচন্দ্র তাঁদের বুঝিয়ে পারেন না যে সংশ্লিষ্ট অংশ উদ্ধৃতি; আর এর বিরুদ্ধেই তাঁর লেখা। পরে একই বিষয় নিয়ে নীরদকে আদালতেও যেতে হয় সজনীকান্তের পক্ষে সওয়াল করার জন্য। তথাকথিত আধুনিক ধারাটির পেছনে যে প্রভাবশালী সাহিত্যসমাজের পৃষ্ঠপোষণা আছে তা-ও বুঝছিলেন ক্রমে। পাশাপাশি তাঁর এই ‘ক্রুসেড’ দলের অন্যান্য সদস্যরা কতখানি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিলেন বলা যায় না। পত্রিকার পরিচালন নিয়ে নীরদের আপত্তি দেখা দিতে থাকে। নীরদ সম্পাদক হলেও পত্রিকার মূল দায়দায়িত্ব সজনীকান্তের হাতেই ছিল। তাঁর সাহিত্যরুচি এবং প্রকাশের সঙ্গে নীরদচন্দ্রের বিরোধ ছিল। ব্যক্তি আক্রমণ বা কুৎসায় তাঁর রুচি ছিল না। ১৩৩৫-এর ভাদ্র (১৯২৮, অগস্ট) থেকে সজনীকান্ত নকুড় ঠাকুরের আশ্রম বলে একটি উপন্যাস শুরু করেন। এতে যে ধরণের আশ্রমিক কেচ্ছার বিবরণ ছিল তার সঙ্গে পত্রিকার ঘোষিত নীতির কোনো যোগ ছিল না; নীরদ মনে করেন এতে নিজেদের খেলো প্রতিপন্ন করা হয়। পরের সংখ্যা থেকে সম্পাদকত্ব ত্যাগ করেন তিনি। সংশ্রব সম্পূর্ণ বর্জন না করলেও এই ধরণের বাংলা সাহিত্য প্রচারের জন্য তিনি কোনো আগ্রহ বোধ করতেন না। পরবর্তীকালে সজনীকান্ত লিখেছেন, ‘তিনি কখনই শনিবারের চিঠির আপন হইতে পারেন নাই’। ১৯২৮-এর অগস্টে মোহিতলাল ঢাকা চলে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার দায়িত্ব পেয়ে। নীরদকে শনিবারের চিঠির সঙ্গে সংশ্রব ত্যাগ না করার পরামর্শ দেন তিনি। নীরদ শনিবারের চিঠির পরিচালনা ও সজনীকান্তর রচনা নিয়ে আপত্তি জানালে রুষ্ট হন মোহিতলাল। ১৯২৮-এ সম্পাদকত্ব ত্যাগ করলেও এই গোষ্ঠীর সঙ্গে নীরদের সংযোগ ছিল যতদিন তিনি কলকাতায় ছিলেন। ১৯৩৬ পর্যন্ত নানান সময়ে চিঠি-তে লিখেছেনও নীরদচন্দ্র, কিন্তু সজনীকান্ত ঠিকই বুঝেছিলেন শনিমণ্ডলীর সঙ্গে কখনই একাত্ম হতে পারেননি নীরদচন্দ্র। নীরদচন্দ্রের সাহিত্যিক রুচি ছিল ভিন্ন।

 

নীতির প্রশ্নে শনিবারের চিঠির সম্পাদকত্ব ছাড়লেও বাস্তবতার প্রশ্ন ভিন্ন। স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা না দিয়ে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ত্যাগ, পরে উচ্চ সম্ভবনাময় সরকারি চাকুরি ত্যাগ, আবার সাহিত্য মহলে যেটুকু পরিচিতি এবং সুযোগ তৈরি হচ্ছিল তা-ও ত্যাগ- বন্ধু পরিজনরাই নন, নিজের ওপরেই আস্থা রাখ দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল নীরদচন্দ্রের। পুজোর ছুটিতে কলকাতা এসে নীরদের দুর্দশা দেখে আবারও সহায় হয়ে দাঁড়ান মোহিতলাল। Modern Review- তে সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন নীরদচন্দ্র। সম্পাদকীয় নীতিতে নীরদচন্দ্রের কোনো ভূমিকা ছিল না স্বভাবতই। দ্রুতই পাশাপাশি প্রবাসীর কাজকর্মও কিছুটা তাঁর ওপর চাপে। ফলে বাধ্যতামূলকভাবে সমকালীন বাংলা সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয় তাঁর। সহ-সম্পাদনা তাঁকে প্রুফ দেখা, ছাপাই বাঁধাই সহ প্রকাশনার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে হাতে-কলমে অভিজ্ঞ করে তোলে। শনিবারের চিঠি ছাপা হয় প্রবাসী প্রেস থেকেই। রামানন্দ এবং তাঁর পুত্ররা চিঠি-র অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পাশাপাশি কাজকর্ম করলেও শনিবারের চিঠিতে আর লেখা দেন না নীরদচন্দ্র। মোহিতলালের তরফে কিছু অনুযোগ নিশ্চয় আসে। ১৯২৯-এর মাঝামাঝি মোহিতলালকে এক দীর্ঘ চিঠিতে শনিবারের চিঠির পরিচালনা, সজনীকান্তের লিখনশৈলী নিয়ে নিজের আপত্তি জানান নীরদ; পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ভবিষ্যত নিয়েই নিজের অনাস্থা প্রকাশ করেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের যে আন্তর্জাতিক মান পূর্ববর্তী লেখককুলের হাতে তৈরি হয়েছিল, যা নিয়ে সাহেবরা সাহেবি পত্রিকায় গর্ব ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে বাধ্য হত, সে ধারা যে অপস্রিয়মান সে নিয়ে নিজের মত অস্পষ্ট রাখেননি তিনি। গোপন করেননি বাংলায় লেখার ব্যাপারে নিজের সামগ্রিক অনীহা। ছাত্রের মূল্যায়ন মেনে নেননি মোহিতলাল। দীর্ঘদিন গুরু শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক রহিত হয়। দীর্ঘ ব্যবধানে Autobiography of an Unknown Indian প্রকাশের পর মোহিত-নীরদ সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। এতদিন পর শনিবারের চিঠি এবং সজনীকান্তকে নিয়ে নীরদের মূল্যায়ন মেনে নেন তিনি। সহ-সম্পাদনার পাশাপাশি অল্পসল্প লেখেনও নীরদচন্দ্র, প্রধানত ইংরাজিতে। বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে চিরকাল উৎসাহী তিনি, ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা, শাসকমহলে তার প্রতিক্রিয়া, পাশাপাশি ইওরোপের রাজধানীর হাল হকিকত নিয়ে Modern Review তে কিছু লেখা ছাপা হয় তাঁর, পাশাপাশি প্রবাসীতেও কিছু খুচরো লেখা। গোপাল হালদার, ব্রজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেশ বাগলদের সঙ্গে পরিচয় বাড়ে তাঁর। ক্রমে রামানন্দবাবুর হাত থেকে প্রবাসী- Modern Review - পরিচালনার দায়দায়িত্ব অনেকটাই তাঁর পুত্রদের হাতে যেতে থাকে।  কেদারবাবু বা অশোকবাবু নীরদের ওপর আস্থা রাখলেও পত্রিকার আর্থিক হাল খারাপ হতে থাকে। ১৯৩২ এ বিবাহ ১৯৩৩-এ প্রথম পুত্রের জন্ম নীরদচন্দ্রের আর্থিক দায়দায়িত্ব বাড়ায়। অন্যান্য সাংসারিক দায়দায়িত্বেও খরচ বাড়ে তাঁর। সহ সম্পাদকত্বের চাকুরির আয় ক্রমশ অনিয়মিত হতে থাকে। ১৯৩৩-এর শেষে চাকুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন নীরদচন্দ্র।

 

শনিবারের চিঠি বা প্রবাসী-র কাজ ছাড়লেও এই দুই গোষ্ঠীর সঙ্গেই নীরদচন্দ্রের অন্তত বাহ্যিক সদ্ভাব বজায় ছিল। তাঁর মতো পণ্ডিত মানুষের বাস্তব জীবনের দুর্দশায় এঁরা হয়তো সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই সময়ই উপাসনা পত্রিকা প্রযোজনা করার দায়িত্ব নেন বঙ্গলক্ষী কটন মিলস এবং মেট্রোপলিটান ইন্সিওরেন্সের মালিক সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য। তিনি সম্পাদনার দায়িত্ব দেন সজনীকান্তকে। পত্রিকার নতুন নাম হয় বঙ্গশ্রী। সজনীকান্ত নীরদকে ডেকে নেন নতুন গোষ্ঠীতে। শুরুর দিকে অর্থের যোগান নিয়মিত থাকায় লেখকদের কিছু সুরাহা হয়। নীরদচন্দ্রের লেখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ চোখে পড়ে অল্প সময়ের মধ্যে। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। ক্রমে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে ব্রজেন্দ্রনাথের। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ, বছর তিনেকের গ্রন্থাধ্যক্ষতা (১৩৪১- ৪৪/ ১৯৩৪-৩৭), সংবাদপত্রে সেকালের কথা সম্পাদনায় সহযোগিতা সব এই সময়ের কথা। বঙ্গশ্রী গোষ্ঠীতে বা আড্ডায় নীরদচন্দ্র নিয়মিত হলেও সম্পাদনায় তাঁর ভূমিকা ছিল মনে হয় না; যদিও পত্রিকার উচ্চমান এবং সাহিত্য-প্রকৃতি দেখে তাতে নীরদচন্দ্রের পরামর্শ এবং সহযোগিতার দিকটি অনুমান করা চলে। দ্রুতই সজনীকান্তের সঙ্গে সম্পাদনা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় মালিক সচ্চিদানন্দের। সজনীকান্ত পত্রিকা ছাড়েন; লেখা বন্ধ হয় নীরদচন্দ্রেরও।

 

আর্থিক দুর্দশা দিন দিন আত্মপ্রত্যয় চুরমার করে দিচ্ছিল নীরদচন্দ্রের। ১৯৩৪ এর এপ্রিলে পিতার মৃত্যুতে নৈরাশ্য আরো গ্রাস করে তাঁকে। সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম তাঁর আর্থিক অসঙ্গতি আরো প্রকট করে তোলে। বিভিন্ন মহল থেকে প্রধানত পত্রিকা সম্পাদনার নানা প্রস্তাব এলেও কোনোটিই খুব ফলপ্রসু বা স্থায়ী হয়নি। পাটনা-প্রবাসী নদী-বিশেষজ্ঞ কপিলাপ্রসাদ ভট্টাচার্য প্রবাসী, শনিবারের চিঠি বঙ্গশ্রীতে লেখার সুবাদে সাহিত্যিক মহলে পরিচিত ছিলেন। নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য তিনি বনফুলকে প্রস্তাব দেন। বনফুল জানান পরিমল গোস্বামীকে। পরিমল গোস্বামী তৎকালীন সাহিত্য জগতের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তত্ব সজনীকান্তকে এই পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব দেন। সজনীকান্ত তাঁর দলবল নিয়ে নতুন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সম্পাদকত্বের প্রস্তাব দেন নীরদচন্দ্রকে। কপিলাপ্রসাদের উচ্চ রুচি নীরদকে আকৃষ্ট করে। তিনিও সবদিক থেকে দৃষ্টান্তমূলক একটি বাংলা সাময়িকী প্রকাশের জন্য যথাসাধ্য করেন। ২৪ জানুয়ারি, ১৯৩৬-এ প্রথম প্রকাশিত হয় অধুনা দুষ্প্রাপ্য সেই নূতন পত্রিকা; প্রথম সংখ্যার সূচী পরে নিজের স্মৃতিচিত্রণ গ্রন্থে প্রকাশ করেন পরিমল গোস্বামী-

 

  • সম্রাট পঞ্চম জর্জ, রাষ্ট্রীয় জীবনের বস্তুতন্ত্রতা, কিপলিং- নীরদচন্দ্র চৌধুরী
  • ইসলামী সভ্যতার স্বরূপ- স্যর যদুনাথ সরকার
  • মার্জিন (রম্যরচনা)- প্র-না-বি
  • জগদীশ সমীপে- অমল হোম
  • আংটি- মনোজ বসু
  • ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়- দিল্লিতে প্রবাসী সাহিত্য প্রতিষ্ঠান
  • কংগ্রেসের পঞ্চাশ বছর (গ্রন্থ সমালোচনা)- নির্মলকুমার বসু
  • দাদু (গ্রন্থ সমালোচনা)- সুকুমার সেন
  • কলকাতা স্টেশনের প্রোগ্রাম (রেডিও)- নলিনীকান্ত সরকার
  • নবনাট্য মন্দিরে রীতিমত নাটক (থিয়েটার পর্যালোচনা) – পরিমল গোস্বামী

 

প্রথম সংখ্যা থেকেই পত্রিকা সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও মাত্র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশের পরই পত্রিকার অকালমৃত্যু ঘটে। পরবর্তীকালে সজনীকান্ত পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে নীরদের কোনো ক্ষেত্রেই সমঝোতা না করতে চাওয়ার মানসিকতাকে কটাক্ষ করেন। অতিরিক্ত খরচ বৃদ্ধিই নাকি পত্রিকা প্রযোজক কপিলাপ্রসাদকে নিরস্ত করেছিল। পত্রিকার পাঁচটি সংখ্যার উপস্থাপনা নজর করলে পত্রিকা প্রকাশে নীরদচন্দ্রের কাঙ্খিত মান নিয়ে পাঠকের কিছু ধারণা নিশ্চয় হবে। এর আগে শনিবারের চিঠির সম্পাদনা করলেও তাতে সজনীকান্তের নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করা যাবে না। পরবর্তী আট বছরে নীরদচন্দ্র নিশ্চয়  সেই স্থান অর্জন করেছিলেন যাতে অন্যের প্রভাব মুক্ত হয়ে কাজ করা যায়। যদিও শনিবারের চিঠি বা নূতন পত্রিকা উভয় ক্ষেত্রেই আর্থিক দিকটি দেখতেন সজনীকান্ত নিজে।

 

নূতন পত্রিকা-র মৃত্যু এবং সেজন্য অভিযুক্ত হয়ে আর বাংলা পত্রিকা সম্পাদনায় রুচি রইল না নীরদচন্দ্রের। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় স্বাধীনভাবে লিখে যা রোজগার তাই দিয়েই কোনোক্রমে ক্ষুণ্ণিবৃতি তাঁর। ইতিমধ্যে শনিবারের চিঠির সম্পাদনার দায়িত্বে এসেছেন পরিমল গোস্বামী। সাম্মানিক দিয়ে লেখা আদায় করেন নীরদচন্দ্রের; তাঁর লেখার অন্যতম গুণমুগ্ধ তিনি। প্রধানত ইংরাজিতে লিখলেও নীরদচন্দ্রের বাংলা প্রবন্ধের সমঝদার ক্রমবর্ধমান। ইংরাজিতে লিখলে অর্থ এবং খ্যাতি উভয়তই লাভ, তা সত্বেও বাংলা লেখায় অনীহা ছিল না তাঁর। কেন, সে প্রশ্নের উত্তর তিনি জানিয়ে গেছেন মৃত্যুর পূর্বে। আনন্দবাজারের সুরেশচন্দ্র মজুমদার নীরদচন্দ্রকে লেখার আহ্বান জানান এ সময়, কিন্তু পত্রিকার সহ সম্পাদকরা একযোগে অসহযোগিতা করলে এ যাত্রা আনন্দবাজা্রে লেখা হয় না তাঁর। তখন আর্থিক সঙ্গতি এবং শৃঙ্খলায় আনন্দবাজার বাংলার অন্যতম পত্রিকা। নীরদচন্দ্রের আর্থিক সঙ্গতির কিছু সুরাহা হোক তা না চাওয়ার লোক প্রথম দিন থেকেই অপ্রতুল ছিল না। তবে সুরেশচন্দ্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক কখনই খারাপ হয়নি নীরদচন্দ্রের। পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুরেশচন্দ্রের ব্যক্তিগত সহযোগিতার কথা বলে গেছেন নীরদ সি চৌধুরী।

 

অপ্রত্যাশিতভাবে আহ্বান আসে নতুন দুনিয়া থেকে। মোহনলাল স্ট্রিটে একই বাসাবাড়ির একতলাতে  থাকতেন বেতার জগৎ-এর সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকার, চারতলায় নীরদচন্দ্র। উভয়ের আলাপ এবং সৌহার্দ্য থাকলেও নীরদের সাহেবিয়ানা আর পাণ্ডিত্য নলিনীকান্তকে কিছু আড়ষ্ট রাখত হয়তো। কিন্তু উভয় বাড়ির বৌদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল উষ্ণ। বাইরে সৌষ্ঠবের হানি না হলেও  নীরদের আর্থিক দুর্দশার কথা ক্রমে গোচর হয় নলিনীকান্তের। প্রবন্ধপিছু পাঁচটাকা রোজগারও যে নীরদচন্দ্রকে কতখানি সহযোগিতা করেছিল, প্রায় দুবছর ধরে প্রতি সংখ্যায় তাঁর রচনাই তার প্রমাণ। ১৯৩৬-এর ১৬ অগস্ট বেতার জগৎ-এ প্রথম প্রবন্ধ ছাপা হয় নীরদচন্দ্রের। কলকাতা বেতারের আদি যুগে নীরদচন্দ্র এবং বেতার পরস্পরকে কী ভাবে পরিপুষ্ট করেছিল সে যুগের সংখ্যাগুলিতে চোখ বোলালেই বোঝা যায়। ১৯৩৬-৩৭-এ তিনি লিখতেন প্রধানত দেশে দেশে বেতার অনুষ্ঠান প্রচার, পরিচালনা, বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান সম্প্রচার নিয়ে। সে যুগে কলকাতায় বসে বিশ্ব-বেতারের এমন সংবাদ পরিবেশনা দুর্লভ। ক’মাসের মধ্যেই তাঁকে আহ্বান জানানো হয়, বেতার থেকে কথিকা সম্প্রচার করার জন্য। ১৯৩৭-এর ৬ জানুয়ারি থেকে ‘ঘটনা বৈচিত্র্য’ নামে আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির হালহকিকত, যুদ্ধবিদ্যার নানাকথা নিয়ে সম্প্রচার শুরু করেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমরবিদ্যা বিশারদ হিসেবে নীরদচন্দ্র পরিচিত হয়ে ওঠেন বৃহত্তর সমাজে। তাঁর কথিকাগুলি এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে ছোটদের জন্য অনুষ্ঠানেও এই নিয়ে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁকে। ১৯৪০ থেকে এইসব সম্প্রচারিত কথিকা বেতার জগৎ-এ ছাপা হত তাঁর নামে। বেতার জগৎ প্রবন্ধপিছু পাঁচটাকা দিয়ে যে সম্পর্ক শুরু হয়, তার অভিঘাত নীরদের জীবনে অশেষ।

 

১৯৩৭-এর মার্চে কলকাতার শেরিফ সত্যচরণ লাহার সেক্রেটারি হিসাবে কাজ শুরু করেন নীরদচন্দ্র। আবার ১৯৩৭-এর জুলাই থেকে নীরদকে সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগ করেন  শরৎচন্দ্র বসু। অর্থনৈতিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হলেও বেতার জগৎ-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি নীরদচন্দ্র। পত্র-পত্রিকায় নীরদের লেখা বা বেতারে ধারাভাষ্য সম্প্রচার নিয়ে কোনো আপত্তি করেননি শরৎচন্দ্রও।

 

১৯৩৯-এর মে-তে তৃতীয় পুত্রের জনক হন নীরদচন্দ্র। একাধিক উৎস থেকে রোজগার, পারিবারিক স্থিতি ও স্বাচ্ছন্দ্য নীরদচন্দ্রকে আবার একবার বাংলা সাহিত্যে হাতছানি দেয়। বন্ধু দিলীপকুমার সান্যালের পরামর্শে এবং সহযোগিতায় ১৯৪০-এর জুনে প্রকাশিত হয় সমসাময়িক। শুধু রচনার মানেই নয়, পত্রিকাটির সামগ্রিক উপস্থাপনা আবার একবার চকিত আলো ফেলে নীরদচন্দ্রের কল্পনার বাংলা সাহিত্য সাময়িকীর মানে। মাত্র দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়েই বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি। তার আগেই সুকুমার রায়ের ওপর দিলীপকুমার সান্যালের রচনা বা ইওরোপীয় সঙ্গীতের ওপর ‘একেলা’ ছদ্মনামে নীরদচন্দ্রের রচনা নজর কাড়ে সুধী সমাজের। সত্যজিৎ-নীরদচন্দ্র সংযোগ গড়ে ওঠে ইওরোপীয় সঙ্গীতের সূত্রে।

 

বেতারে শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরীর ধারাভাষ্য শুনে এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নীরদ সি চৌধুরীর লেখা পড়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের জনসংযোগ আধিকারিক জিওফ্রে টাইসন। তিনি ক্যাপিটল নামে প্রধানত অর্থনৈতিক বিষয়ের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নীরদ সি চৌধুরী ওই পত্রিকায় যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়ে লিখতেন। টাইসন ক্রমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের প্রচার উপদেষ্টা হন। যুদ্ধ নিয়ে প্রচার কীভাবে চালানো উচিত এ ব্যাপারে দিল্লি সরকারের বৈঠকে যোগ দিতে যান তিনি। যাওয়ার আগে এ ব্যাপারে নীরদ সি-র পরামর্শ চান তিনি। নীরদ সি বিশদে একটি নোট লেখেন; বেতার যে যুদ্ধ নিয়ে সংবাদ পরিবেশনায় নিতান্ত ব্যর্থ, এই ছিল তাঁর স্পষ্ট অভিমত। টাইসন বিশ্বস্ততা ভঙ্গ করে নোটটি নীরদ সি চৌধুরীর লেখা হিসাবেই উপস্থাপন করেন। 


অল ইন্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর আহমদ শা বুখারি এতে বিরক্ত হন। কলকাতা বেতার পরিদর্শনে এসে নীরদচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বেতার কর্তাদের না জানিয়ে অন্য দফতরে বেতারের বদনাম করায় রোষ প্রকাশ করেন তিনি। নীরদচন্দ্র জানান টাইসনের সঙ্গে তাঁর আদান-প্রদান নিতান্তই ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করেছেন টাইসন। বুখারি পরে নীরদচন্দ্রকে দিল্লি কেন্দ্রে সরকারিভাবে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানা। ১৯৪১-এর ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন শরৎচন্দ্র। আর্থিকভাবে আবার চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন নীরদচন্দ্র। উচ্চবেতনে সরকারি ছাড়ার কথা এখন আর ভাবতে পারেন না তিনি। ১৯৪২-এর মার্চে অল ইন্ডিয়া রেডিওর দিল্লি কেন্দ্রে ‘টকস অফিসার’ পদে যোগ দেন নীরদ সি চৌধুরী। আর কখনো ফিরে আসেননি বাংলায়। দিল্লিতে দীর্ঘকাল একঘেয়ে চাকুরি জীবনে প্রায় হীনবল হতাশ্বাস হয়েছিলেন এককালে বাংলা ভাষায় অন্যতম সম্ভবনাময় লেখক। কিন্তু জীবিকার নিশ্চন্ততা, দিল্লিতে নতুন করে একদল শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তির সংসর্গ ক্রমে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে তাঁর মধ্যে। জন্ম হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক নীরদ সি চৌধুরীর। 

 

বাংলা পত্রিকায় আবার যে কখনো নীরদচন্দ্রের রচনা দেখা যাবে ভাবেননি কেউই। একের পর এক তাঁর ইংরাজি গ্রন্থাদি যেমন তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে, তেমনি রুষ্ট করেছে স্বদেশী সমাজকে। উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ প্রায় অনপনেয়ই ছিল, আনন্দবাজার পত্রিকার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তিনি আবার বাংলায় লেখা শুরু করেন ১৯৬৬ থেকে। তারপর থেকে প্রধানত আনন্দবাজার এবং দেশ পত্রিকাতেই তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমদিনের মতই ঈর্ষণীয় পাঠকভাগ্যের সঙ্গে সঙ্গে নিন্দা, সমালোচনা, এমনকি কুৎসা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি তাঁর।

 

বিভিন্ন পর্বে বিরতি-সহ প্রায় সত্তর বছর ধরে বাংলা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন নীরদচন্দ্র। হয়তো এ ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ড তাঁরই। কিন্তু প্রথম দিনের মতই জীবনের শেষ লেখাতেও আদ্যন্ত মেধাবী তিনি। নিজের পরিচিত বিষয়ের বাইরে লেখেননি; আর পরিচিতির ব্যাপ্তি তাঁর অস্বাভাবিক। কিন্তু বাংলায় তিনি এস্কিমোদের জীবনযাপন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লেখার ধ্যাষ্টামো দেখাননি। পাণ্ডিত্য তাঁর প্রদর্শনের বিষয় ছিল না; ছিল মননের বিষয়। বাংলায় বাঙালি জীবনের বাইরে কোনোকিছু নিয়েই লেখেননি তিনি। কিন্তু নিজের রচনাকে স্থান ও কালের বিস্তৃতিতে তিনি চিরকালীন করে তুলতে চেয়েছেন। ইতিহাস-পাঠ তাঁর বিচারবোধকে স্থান-কালের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়েছিল। সেখানেই তাঁর আন্তর্জাতিকতা। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর অমোঘতা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ থাক, কিন্তু সুদীর্ঘ জীবনে তাঁর অভ্রান্ততার উৎস তাঁর বুদ্ধি নয়, স্বজাতির প্রতি তাঁর মায়া। নীরদ চৌধুরীর বাংলা রচনা এক মায়ামুগ্ধ পণ্ডিতের আত্ম-অন্বেষণ। আর সে সব রচনার ধারক ছিল, আজকের কোমাচ্ছন্ন বাংলা পত্র-পত্রিকাই। দ্বিশতবর্ষে বাংলা পত্রিকার যাত্রাপথে সেই বাঙালির পথচলাও স্মরণে থাকুক।

[*লেখকের বিশেষ দাবিতে এই লেখার ফর্মাট কিছুটা পরিবর্তিত করা হয়েছে] 


[শ্রু
ত্যানন্দ ডাকুয়া, কলকাতা শহরের চাকচিক্যময়তা থেকে দূরে ............ বহুদূরে, নিভৃতলোকের অন্তঃপুরে বসেই বুনছেন মেধা ও মননের নকশীকাঁথা । সেই অনাবিল অনাক্রম্যতার যাবতীয় উপাচার কোথাও যেন সমাপতিত মনের সবুজ পাতার টলটল করা বারিদবিন্দুর আধারে । পরিচয় বলতে বোঝায় অনেক কিছু - মানুষের কি আর পরিচয়ের শেষ আছে ! নেই । কিন্তু খুঁজে নিতে হয় তাকে । পাঠকও শ্রুত্যানন্দকে নিশ্চয় খুঁজে নেবেন - কোনও এক অভিজ্ঞানের অভিধানে ।]
 

শ্রুত্যানন্দর সম্পাদিত বইগুলি অবশ্যই পড়ুন, পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনেও, খোয়াবনামা, ধ্যানবিন্দু প্রভৃতি স্টলে,  



অগ্রন্থিত প্রবন্ধ - নীরদচন্দ্র চৌধুরী
সম্পাদনা - শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
প্রকাশক - সূত্রধর 
সটীক টেকচাঁদ...
সম্পাদনা - শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
প্রকাশক - খোয়াবনামা


 



 হরু ঠাকুর
সম্পাদনা - শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
প্রকাশক - খোয়াবনামা





সুকুমার রায় - জীবনকথা- হেমন্তকুমার আঢ্য
সম্পাদনা - শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া
প্রকাশক - খোয়াবনামা

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.