Monday, August 30, 2021

ভ্যাকসিন এখন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’, অতএব সম্বল ‘রাখে হরি মারে কে’

 লিখেছেন 

অ নি ন্দ্য   ভ ট্টা চা র্য


আমেরিকার পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর প্রায় ফাটা রেকর্ড বাজানোর মতো নিত্য আওড়ে গেছেন যে কোভিড১৯ আসলে একটি ‘চীনা ভাইরাস’। অর্থাৎ, চীন থেকেই এর উৎপত্তি, এবং যেহেতু চীনাদের খাবার-দাবারের কোনও মা-বাপ নেই, অতএব, এমনতর ‘নিকৃষ্ট’ মানবজাতির দেহেই এইসব অলুক্ষণে ভাইরাস বাসা বাঁধতে পারে। সেই সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল একটি ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ যে, আসলে কোভিড১৯ ভাইরাসটি চীনের উহান পরীক্ষাগারে তৈরি। বলাই বাহুল্য, ‘শ্বেতাঙ্গ’ জাতির স্বঘোষিত অকলুষতা ও অন্যান্য জাতির প্রতি তাদের এক শ্রেণি মানুষের যে বহমান ঘৃণা- তাকে চাগিয়ে দিতেই এইসব কু-রটনা। তার সঙ্গে ছিল কোভিড মোকাবিলায় ইউরোপ সহ আমেরিকার সার্বিক ব্যর্থতা ও দিশাহীনতা এবং চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-প্রযুক্তিগত দ্বৈরথে তাদের পিছিয়ে পড়া হেতু ঈর্ষাকাতরতাও। 

এ হেন চাপানউতোরের মধ্যেই সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে কোভিড১৯ ভাইরাসের উৎস সন্ধানে আমেরিকার উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটি’র রিপোর্ট। কমিটির সমস্ত সদস্যদের মতৈক্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে যে কোভিড কোনওভাবেই কোনও জৈবাস্ত্র নয়। এই ভাইরাস জেনেটিকালি ইনজিনিয়ার্ড নয় বলেও এই কমিটি মনে করেছে। কমিটি’র  অভিমত, কোনও প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে অথবা এও হতে পারে যে উহান গবেষণাগারে সার্স-কোভ২’এর সংক্রমণে এই ভাইরাসের উদ্ভব ও ছড়িয়ে পড়া। 

নানা মুনির নানা মত ও বিতর্কে কোভিড১৯ নিয়ে বিজ্ঞানী থেকে চিকিৎসক, রাষ্ট্রের কর্ণধার থেকে সাধারণ নাগরিক সকলেই যারপরনাই চিন্তিত ও বিপুল পরিমাণে বিভ্রান্ত। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস এইভাবে মানব প্রজাতির গোটা কুলকে এমন পরাভূত করে রাখতে পারে, বিজ্ঞানদর্পী মানুষের সম্ভবত সে ধারণার আঁচটুকু পর্যন্ত ছিল না। এরই মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল আকচাআকচি। সাধারণ মানুষ পড়েছেন মহাবিপদে। এক দল বলছেন, আপনি যদি ভ্যাকসিন নেন, তাহলে আপনি মহামূর্খ; আরেক দলের মত, ভ্যাকসিন না নিয়ে আপনি শুধু মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছেন না, হীনতারও স্বাক্ষর রাখছেন, কারণ, আপনার ভ্যাকসিন না নেওয়ার ফলে আপনার চারপাশের মানুষজন বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। ‘শ্যাম রাখি না কুল’- এই আতান্তরের মধ্যে ডেনমার্ক সরকার কোভিড-সংক্রান্ত সমস্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ওদিকে আমেরিকায় যথেষ্ট ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও নতুন করে আবারও দ্রুত হারে কোভিড সংক্রমণ ছড়ানোয় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন, যারা ভ্যাকসিন নেননি তাঁরাই আক্রান্ত হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন তাহলে ‘হার্ড ইম্যুনিটি’ গড়ে ওঠার যে গল্পটা ছিল তার কী হল! 

যারা ভ্যাকসিনের প্রবল পক্ষপাতী তাঁরা এতদিন ইজরায়েলকে দেখিয়ে বলে আসছিলেন যে সে দেশ ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল আর তাই সেখানে নতুন করে কোভিডের সংক্রমণ নেই। এই বছর এপ্রিল মাস নাগাদ তথ্য দিয়ে দাবি করা হচ্ছিল যে ইজরায়েলে দৈনন্দিন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে। অথচ কী আশ্চর্য! ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। ২৮ অগস্ট’এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ইজরায়েলে নতুন করে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গড়ে দৈনন্দিন আক্রান্তের সংখ্যা ৯৫০০’এরও বেশি। তাহলে, হচ্ছে টা কী? 

তবে এও বাস্তব, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ হিসেব যে সময়টাকে আমাদের দেশে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই সময়টায় সরকারি হিসেবেই অন্তত ২ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা নাকি ১০-১২ লক্ষের কাছাকাছি। হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নেই, স্থানাভাবে মৃত মানুষের দেহ দাহ বা কবরস্থ করার উপায় নেই, গঙ্গা বা নদীতে শয়ে শয়ে লাশ ভাসছে- এই কঠোর বাস্তবের ছবি তো আমরা দেখেছি। এত মৃত্যু কেন? হতে পারে, এত বিশাল সংখ্যক মানুষ এক সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছেন যে ন্যূনতম চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাবের জন্যই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়াটাও তো চরম আশঙ্কার দিক। বিশেষ করে আমাদের মতো একটি জনবহুল দেশে তা আরও বেশি বিপদের। সেটুকুকে কি রোধ করার কোনও উপায় আমাদের হাতে ছিল না? উত্তর ভারতের কুম্ভমেলায় যে বিশাল লোকসমাগম অথবা পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে সভা-সমাবেশে মানুষের ঢল- এর জন্যই কি কোভিডের সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ছড়ায়নি? অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তো কোভিডের প্রকোপ বেশ কম ছিল। অথচ, অসম নির্বাচনের পর পরই দেখা গেল যে সে রাজ্যে ব্যাপক ভাবে কোভিডের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তা কি নিতান্তই কাকতালীয়? 

তাই, অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও লকডাউনের যে নিদান দেওয়া হয় তা কি ভুল, শুধু ভুল? একদিকে বলব, ফেব্রুয়ারি ২০২০’তে আহমেদাবাদে মোদির ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত থেকেই কোভিড এ দেশে মহামারির আকার নিয়েছে এবং দ্বিতীয় তরঙ্গেও তা আবার ফিরে আসার কারণ কুম্ভমেলা ও রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনের জমায়েত, আবার অন্যদিকে বলব, মাস্ক পরলে দম বন্ধ হয়ে আসে, সামাজিক দূরত্ব বিধি বা লকডাউন আসলে ডিজিটাল সংস্থার মুনাফাকে ত্বরান্বিত করার ষড়যন্ত্র- হরেদরে ঠিক কী বলতে চাইছি, জানি তো? তবে এও বাস্তব, লকডাউনের ফলে গরিব মানুষের রুটি-রুজির এক অভাবনীয় সমস্যা তৈরি হয় বা হয়েছে। এ সম্পর্কে এক বড় সংখ্যক অর্থনীতিবিদেরা পরিষ্কার নিদান দিয়েছেন যে প্রত্যেক অভাবী মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে, দরকার পড়লে নোট ছাপিয়েও। সেও এক পথ বটে। 

কিন্তু আমরা যারা নিতান্তই ছাপোষা সাধারণ জন- আমরা কীভাবে নিজেদের রক্ষা করব? এখানেই বিভ্রান্তির বিস্তার। এ বিষয়ে ডাঃ অরুণ সিং’এর একটি ভাষণ বেশ মনে ধরেছিল। তিনি বলেছিলেন, ভাইরাস আমাদের পূর্বপুরুষ, তারা আমাদের ধরবে না, তা হবার নয়। কিন্তু তারা ধরলেও, আমরা কিছুটা ভুগে-টুগে হলেও শেষমেশ বেঁচে থাকব- এই দিকটা হয়তো নিশ্চিত করা যায়। আর তার উপায় হল, আমাদের শরীরে যে কো-মর্বিডিটি আছে সেগুলোর সুধার করাটাই আসল নিদান। অর্থাৎ, আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ অথবা হার্টের কোনও ব্যারাম কিংবা কিডনির অসুখ থাকে, আপনি সেই সব যাতনা থেকে বরং সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। কোভিড যদি আপনাকে ধরেও, তা আপনার বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু কো-মর্বিডিটি থাকলে আপনার প্রাণ সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। দ্বিতীয়ত, বাইরে বেরলে মাস্ক পরে নেওয়াটা এমনিতেও ভাল বলেই মনে হয়। কারণ, বাতাসে এমনিতেই যা দূষণ তাতে একটা মাস্ক হয়তো আমাদের সকলকে সাহায্যই করবে। জাপানে তো মানুষজন কোভিডের বহু আগে থেকেই রাস্তাঘাটে মাস্ক পরে ঘোরেন। তৃতীয়ত, বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে হাত-পা-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে নেওয়াটাও তো ভাল কাজ। এ অভ্যাসও বহুকালের। পুরনোকালে গ্রামের বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ এলে উঠোনে রাখা ঘটি থেকে জল নিয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে তবে ঘরে প্রবেশ করতেন। 

তবে, তৎসত্ত্বেও মানুষ কোভিডে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। কো-মর্বিডিটির কারণে এই অসুস্থতার প্রকোপ বাড়তেও পারে। তাই ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজন অপরিহার্য। এখানেই আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। প্রবল শ্বাসকষ্টের সময় সামান্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে কত মানুষ যে মারা যান তার ইয়ত্তা নেই। রক্তের অভাবেও বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাই সবটা মিলিয়ে আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থাও মহামারির জন্য অনেকটাই দায়ী। আর সবচেয়ে বড় দায়ী অনাহার ও অপুষ্টি। 

কোভিড১৯ তার ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করবে, এ স্বাভাবিক। তৃতীয় তরঙ্গ আসা নিয়ে আমাদের আরও এক প্রস্থ বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ থাকবে, তাও স্বাভাবিক। আমরা প্রায়-সকলে ভ্যাকসিন নেওয়া সত্ত্বেও দেখব যে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কখনও কমছে অথবা বাড়ছে। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, কোভিডের ভ্যাকসিনগুলো নাকি ‘Emergency Use Authorisation’এ ছাড়পত্র পেয়েছে মাত্র। অর্থাৎ, খুব জরুরি ভিত্তিতেই এরা ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু চেষ্টা চলছে এর সর্বজনীন ব্যবহারের। রাষ্ট্রগুলি সরাসরি বাধ্য করতে পারে না, কিন্তু ঘুরিয়ে এমন সব নিয়ম করছে যে আপনি ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য। যেমন, ভ্যাকসিন না থাকলে আপনি অমুক দেশে বা অঞ্চলে প্রবেশাধিকার পাবেন না, ট্রেনে উঠতে পারবেন না, বিমানে যাতায়াত করতে পারবেন না- এমনবিধ নানা কিছু। 

সবটা মিলিয়ে, দেখাই যাচ্ছে, ভ্যাকসিনের অবস্থা এখন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’। খেয়েও পস্তাবেন, না খেয়েও। অতএব সম্বল: ‘রাখে হরি মারে কে’।


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


চলে গেলেন চলমান আরণ্যক - বুদ্ধদেব গুহ

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী


এই পৃথিবীর জঙ্গলমহলে ছিল তাঁর অনায়াস আনাগোনা। দিনের আলোকঝারিতে অরণ্য প্রকৃতিকে যেমন চষে ফিরেছেন তিনি, তেমনই আঁধার রাতের অববাহিকাতে চরাচর ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। দেশ কাল তুচ্ছ করে তাঁর মনের আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আদিম নিসর্গ। এহেন আরণ্যক লেখক বুদ্ধদেব গুহ, ওরফে লালাদা পাড়ি দিলেন অজানার দেশে। আজ মেঘলা আকাশের বৃষ্টির ফোঁটা যেন তাঁর বিদায়ে জন্য প্রকৃতির যোগ্য সঙ্গত। সেই তিনি যিনি একই হাতে প্রকৃতি ও রোমান্সকে অনাবিল ভঙ্গিমায় সমন্বিত করেছেন। 

আধুনিক মধ্যবিত্তের অন্তরের খবর যেমন দিয়েছেন তেমন ভাবেই জঙ্গলের বিভিন্ন রূপের অনুপম চিত্র এঁকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। পেশায় ছিলেন একজন অগ্রগণ্য চার্টার্ড একাউন্টেট এছাড়াও ছিলেন দক্ষ সংগীতজ্ঞ, অরণ্য প্রেমিক, শিকারি এবং বাংলা সাহিত্যের সফল লেখক। তাঁর জন্মদিন ২৯ জুন,১৯৩৬। রংপুর জেলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন ও সেখান থেকে কলকাতায় এসে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলকাতায় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কলকাতার রবীন্দ্রসংগীত শেখার খ্যাতনামা স্কুল "দক্ষিণী"তে ভর্তি হন। এই দক্ষিণীতেই লেখকের আলাপ হয় পরবর্তীকালে তাঁর জীবনসঙ্গিনী ঋতু গুহ'র সঙ্গে। তাঁদের সেই প্রেম কাহিনী নিয়ে লেখা লেখকের "খেলা যখন" উপন্যাস হয়ে ওঠে বেস্ট সেলার। ষাটের দশকের গোড়ায় প্রকাশিত হয় লেখকের প্রথম গল্প সংকলন,"জঙ্গলমহল"। লেখকের জঙ্গলে প্রবেশ তাঁর বাবার হাত ধরে।

দশ বছর বয়স থেকে তিনি শিকার শুরু করেন কাজের সূত্রে ঘুরে ফিরেছেন সারা দুনিয়া কিন্তু অরণ্য প্রেম তাঁর পিছু ছাড়ে নি।ভ্রমণের ও অরণ্য দর্শনের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। বাংলা সাহিত্যে অরণ্যের পটভূমিতে তাঁর যত গল্প উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তেমনটির আর দ্বিতীয় কোনও নজির নেই।ভারতবর্ষ ও বিদেশের অরণ্য প্রকৃতি যেমন লেখকের লেখার পটভূমি হিসেবে বারবার এসেছে, তেমনই অরণ্যও হয়ে উঠেছে উপন্যাসের চরিত্র।ব্যক্তিজীবন নিয়ে এত লেখাও বা কে লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে? ছোটদের জন্য তিনি নিয়ে আসেন ১৯৭৩ সালে "ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে"। সেই প্রথম শুরু হল অরণ্য সংরক্ষণ নিয়ে ভাবনা, হ্যাঁ  ছোটদের জন্যই। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে অরণ্যপ্রকৃতির  সঙ্গে সঙ্গে সম্পুর্ন নাগরিক চেতনার আলোকে আলোকিত চরিত্ররা এসেছে। 

কিছু চরিত্র আবার অরণ্য প্রান্তরে পৌঁছে প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। এইভাবেই চরিত্রের ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তিনি নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে বসাতে পেরেছেন অনায়াসেই। বুদ্ধদেব গুহর সফল উপন্যাসের স্রেফ নাম উল্লেখ করতে গেলেই আর এ লেখা শেষ হবেনা। তবু যে পাঁচটি উপন্যাসের নাম না নিলেই নয় সেগুলির মধ্যে থাকবে "মাধুকরী", "হলুদ বসন্ত","কোজাগর", "কোয়েলের কাছে" ও "একটু উষ্ণতার জন্য"। "মাধুকরী"- অনেকে বলেন বুদ্ধদেবের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।এটি গতিশীল, বর্নময় ও বিশাল।এই উপন্যাস শুধু পৃথু ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী রুষার দ্বন্দ্বময় জীবনের গল্প নয়, জঙ্গলমহলের শিকড় খোঁজার কিছু মানুষের কাহিনিও বটে। বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী এই বইটির ভাষা, কাহিনী, জীবন দর্শন, জীবনের প্রতি আসক্তি ও আসক্তির মধ্যে লুকানো বিতৃষ্ণা, সবই যেন এক নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে। তাই "মাধুকরী" যেন জীবনের ভাষ্যের এক নতুন নাম।তাঁর বেশিরভাগ গল্প, উপন্যাসে এক স্বপ্নিল বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে চরিত্ররা ঘোরাফেরা করে - যার মধ্যে রোমান্টিক এক আবেদন সহজেই অনুভব করা যায়। তাঁর রচনা চিনিয়ে দেয় এক নিত্য পর্যটকের স্বভাবকে, ভ্রমনকারীর সৌন্দর্যের চোখকে এবং পথ দর্শনকে। ঋজুদা, ঋভু - এরা দুজনেই লেখক নিজেই। 

"হলুদ বসন্ত"-এর ঋজুও তিনিই।তাঁর আরণ্যক গল্প, উপন্যাসে তিনি যে নাগরিক চরিত্রগুলিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে অরণ্যে নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের নাগরিক সত্তা ছেড়ে অরণ্যের সাথে মিশে গেছেন অনাবিল সারল্যে, কিংবা হতে চেয়েছেন আদিম। তাই তাঁর চরিত্র যেমন গাছের প্রেমে পড়ে, তেমনই প্রেমে পড়ে ওই অরণ্যের এক নারীর। গল্প, উপন্যাসে বাইরে তিনি অসংখ্য লেখা রেখে গেলেন আমাদের জন্য, এমনকি গোয়েন্দা কাহিনীও। তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন, কোদালকে কোদাল বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। সেই সুবাদে একটি বিশেষ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর একদল লেখক কিভাবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রবেশকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, সেই কাহিনী আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন তিনি। এমনকি তিনি এ কথাও লিখতে দ্বিধা করেননি যে ওই বিশেষ পত্রিকা নিজেদের কিছু মধ্যমানের সাহিত্যিককে দিয়ে দিনের পর দিন লিখিয়েছেন, পাঠকদের জোর করে গিলিয়েছেন, কিন্তু সত্যি যাঁদের লেখায় সাহিত্য মূল্য আছে তাঁরা থেকে গেছেন ব্রাত্য। সেই হিসাবে বুদ্ধদেব বলতেন ওই পত্রিকা গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছেন। ওই পত্রিকা গোষ্ঠীর একাউন্টস দেখতেন বুদ্ধদেব, এবং সেই সুবাদেই তিনি নাকি লেখার সুযোগ পান, এমন অপবাদও প্রকাশ্যে আনা হয়। 

একটা সময় ছিল যখন বাংলা সাহিত্যের উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু বলা হত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব গুহ'কে। বইমেলায় যখনই গেছেন তখন মহিলাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতেন দুজনেই। তবে কম বয়সীদের ভিড়টা থাকত বুদ্ধদেবের দিকে। এমন একটা মানুষকে তো সমসাময়িকরা একটু হিংসা করবেনই। নইলে আর হিংসে জিনিসটা আছে কেন? আসলে কী ছিল না তাঁর? বাড়ির সবাই রবীন্দ্রসংগীত করেন বলে নিজে ধরলেন টপ্পা। নিধুবাবুর টপ্পা গেয়ে একটা সময়ে জমিয়ে দিয়েছেন কলকাতা ও মফস্বলের বহু আসর।

ছবি আঁকতেন এমন যে একাডেমির প্রদর্শনীতে ভিড় জমাতেন চিত্র সমালোচকরা। নিজের পেশায় ছিলেন চূড়ান্ত সফল। সেলিব্রেটি কাপল বলতে কলকাতায় ছিলেন বুদ্ধদেব ও ঋতু গুহ। সাহিত্য পুরস্কার অনেক পেয়েছেন, কিন্তু সেরাটি ছিল ধাবায় খেতে বসে যে ছেলেটি তন্দুরি রুটি দিয়ে গেল, সে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিল,"স্যার, আমি আপনার মাধুকরী, কোজাগর পড়েছি।"এই অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন বুদ্ধদেব, বলেছেন তাঁর পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। আমরাও আজ সেই ছেলেটির মত প্রণাম করে বলছি আজ থেকে আমরাও বুধ্বং শরনং। তিনি আমাদের জীবনের জলতরঙ্গ এক অপরূপ সুরে বেঁধে দিয়ে গেছেন, স্রেফ তাঁর লেখা দিয়ে। যেখানে ফিরে যাওয়া যায় বারবার আর প্রতিবারই যেন মনে হয় নতুন এই জীবন।

শোভনলাল চক্রবর্তী

Wednesday, August 18, 2021

খিদের অতিমারিকে চিনতে পারিনি, কোভিড অতিমারিকে চিনব কী উপায়ে?

 লিখেছেন 

বি ষা ণ   ব সু

সূত্রঃ ইন্টারনেট

একেবারে উল্টো গল্প দিয়ে শুরু করি। ধরুন, একটি অল্পবয়সী মেয়ে স্নান করতে গিয়ে লক্ষ করল, তার স্তনে একখানা ডেলা। মেয়েটি দিনমজুরি করে খায়। একদিন কাজে না গেলেই মুশকিল। আবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আউটডোর ওই দিনের বেলাতেই খোলা। কাজেই দেখাচ্ছি দেখাব করতে করতেই কিছুদিন দেরি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ডেলা-টি সাইজে বেশ বেড়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার দেখেই বললেন, বায়োপ্সি করতে হবে, কিন্তু সে তো এখানে হবে না। মহকুমা হাসপাতাল অব্দি ছুটতে হবে। সেও আবার কাজ কামাইয়ের ধাক্কা, যাতায়াতের খরচাও আছে। মেয়েটি কী করবে, ভেবেই পায় না। এদিকে কমপ্ল্যান খাওয়া বাচ্চার মতো ডেলা-টি দেখতে দেখতে বেড়ে চলেছে। অতএব, একটু দেরিতে হলেও, মেয়েটি সদর হাসপাতালে গেল, বায়োপ্সিও হল। দিনসাতেক বাদে রিপোর্ট - আরও একদিন কাজ কামাই, আরও একদফা যাতায়াত - জানা গেল, ক্যান্সার। ডাক্তার জানালেন, এখুনি অপারেশন করতে হবে। দুই কি তিন সপ্তাহের মাথায় অপারেশনের তারিখ দেওয়া হল, তার আগে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা। এদিকে সেই পরীক্ষানিরীক্ষা করতেও বিস্তর দৌড়াদৌড়ি - সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সাতে হলেও একেক পরীক্ষার একেক তারিখ, অনেকবার যাতায়াত, কাজ কামাই। মেয়েটি পেরে ওঠে না। অপারেশন করানো নিয়েও ভয় তার। অতএব, স্থানীয় এক টোটকা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় সে। তিনি বলেন, ওঃ, ওইসব অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার তো, ওদের কাজই ভয় দেখানো৷ কিচ্ছু ব্যাপার নয়, তিন কি চার হপ্তা ওষুধ খেলেই অসুখ-বিসুখ কোথায় হাওয়া হয়ে যাবে। দিনমজুরির কাজ কামাইয়ের দরকার নেই - শুধু আমার পরামর্শ মেনে চললেই হবে। 

এর পরের কাহিনী অনুমান করার জন্যে কোনও বাড়তি নম্বর নেই। মাসকয়েক বাদে যখন সে আরও একবার সেই হাসপাতালে যাবে, তখন তার স্তন থেকে গলা রস, পুঁজ, দুর্গন্ধ - ডাক্তারবাবু জানান, অপারেশন করার স্টেজ পার হয়ে গেছে। আপাতত ওষুধপত্র ড্রেসিং ইত্যাদি। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় ডাক্তারবাবুর গলার সুর বা শরীরী ভাষা দেখে বাকিটুকু অনুমান করতে অসুবিধে হয় না মেয়েটির পরিবারের। মেয়েটির পরিণতিও আপনারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। 

তাহলে মেয়েটির এই পরিণতির কারণ কী? 

  • ক্যান্সারের মতো অসুখ যে কতখানি ভয়াবহ হতে পারে, সেই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে মেয়েটির ব্যর্থতা? ক'দিন মজুরি হারানোর ভয়ে সে অপারেশন করাতে দেরি করল, কিন্তু বুঝল না অসুখ ভয়াবহ আকার নিলে মজুরি ব্যাপারটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে?
  • সেই স্থানীয় টোটকা "চিকিৎসক", যিনি ক্যান্সারের বিপদকে লঘু করে দেখিয়ে মেয়েটিকে আপাত-স্বস্তি জুগিয়েছিলেন? যিনি ওরকম করে আশ্বস্ত না করলে, মেয়েটি হয়ত যে করেই হোক অপারেশন করাতে দৌড়াত - দায় কি তাঁর কিছু কম??
  • স্বাস্থ্যব্যবস্থার দায়ও কি কম? বাড়ির কাছে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার ন্যূনতম বন্দোবস্তটুকু থাকলে কি মেয়েটি চিকিৎসায় এমন করে অবহেলা করতে পারত? অ্যাক্সেস টু হেলথকেয়ার - যার বাংলা করা যেতে পারে, সকলের নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা। আমরা নাগাল শব্দটিকে আর্থিক সামর্থ্যের সাথে এক করে ভাবতেই অভ্যস্ত - কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্ব অর্থে নাগাল শব্দটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ন্যূনতম পরীক্ষানিরীক্ষা বা চিকিৎসার জন্যে যদি লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়, তাহলে বিনেপয়সায় পেলেও চিকিৎসা করানোটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। যে ওষুধ পাঁচশ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়, তা বিনেপয়সায় মিললে খুবই ভালো কথা - কিন্তু সেই ওষুধ পেতে পরিবারের রোজগেরে মানুষের যদি একটি আস্ত কর্মদিবস নষ্ট হয়, এবং রাহাখরচের পরিমাণও কম কিছু নয়, তাহলে সেই বিনেপয়সায় পাওয়ার ভালত্বটি মাঠে মারা যায়।
  • রাষ্ট্রের দায়িত্বই বা কম কী? দিনমজুরি খেটে যাঁরা উপার্জন করেন, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে যাঁদের একটি দিন কাজ হারানোর অর্থ উনুন না জ্বলা - হাসপাতালে দিনদশেক ভর্তি থাকার অর্থ সপরিবার উপবাস - তাঁদের জন্য স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বাদেও থাকবে না ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা?
  • আর এতশত উচ্চমার্গের আলোচনা বা অমুকের 'পরে দোষের দায় ঠেলার মুহূর্তে নিজেদের দায়িত্বটাও ভুলে গেলেও চলবে কেন!! আমরা, অর্থাৎ দেশের "সচেতন" নাগরিক। স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর পেরোলো - প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কই, একটাও নির্বাচনের কথা শুনেছেন, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যচিকিৎসার অধিকার প্রধান বা অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে? অনেক বাচ্চার মধ্যে যে বাচ্চা কাঁদে কম, সেই বাচ্চার ভাগে মায়ের দুধ কমই জোটে - স্বাস্থ্যক্ষেত্রের হালও তেমনই। কর্পোরেট হাসপাতালের বিল, বিভিন্ন দুর্নীতি বা ডাক্তারকে গালমন্দ করার ব্যাপারে আমরা যতখানি আগ্রহী, সরকারের কাছে সবার স্বাস্থ্য-চিকিৎসার দাবি তোলার ব্যাপারে আমরা ততখানিই বিস্মরণ-প্রবণ। সুতরাং, আমাদের বরাতে এইই জুটবে৷ আজ এই মেয়েটি দরিদ্র বলে তার এমন পরিণতি - চিকিৎসার খরচ যেভাবে আকাশ ছুঁতে চলেছে, এখুনি সরব না হলে আমাদের সকলের এমন পরিণতিও খুব দূরে নয়।

এসবের মধ্যে অসুখের প্রসঙ্গ আর আলাদা করে আনলাম না। ক্যান্সার ভয়ানক অসুখ। সময়ে চিকিৎসা না করা গেলে পরিণতি ভয়ঙ্কর তো বটেই - এমনকি, সময়ে চিকিৎসা করা গেলেও একশ শতাংশ নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কিন্তু এই দ্বিতীয় অংশটুকুর অনিশ্চয়তাকে সামনে তুলে প্রথম অংশের গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ-নির্ণয় ও জলদি চিকিৎসা, বাঁচার পথ এটিই। মেডিকেল সায়েন্স কোনও গাণিতিক বিজ্ঞান নয় - দুইয়ে দুইয়ে চার ক্ষেত্রবিশেষে হয় না - তবু একথা অনস্বীকার্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেকদূর অগ্রগতির শেষে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিসেবটা মেলে। কাজেই, অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়েই বলা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় অসুখের চিকিৎসা করা গেলে অসুখ সারার সম্ভাবনা অনেক অনেএএএক বেশি। 



এই গল্পটিকে রূপক হিসেবে ধরে নিয়ে যদি ক্যান্সারের জায়গায় কোভিড বসিয়ে পড়া হয়, চিত্রটা কেমন হবে?

 হ্যাঁ, মারণক্ষমতায় তুলনীয় না হলেও, কোভিডের সংক্রমণক্ষমতার কারণেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি - চট করে একসাথে অনেককে কাবু করে ফেলার ক্ষমতাও বেশি - কাজেই আক্রান্তের খুবই কম শতাংশের মৃত্যু হলেও মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বিশেষত, নড়বড়ে স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিয়ে একসাথে অনেক মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সামলানো মুশকিল - সেক্ষেত্রে মৃত্যুহার এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা, উভয়ই বাড়ার সম্ভাবনা। 

তড়িঘড়ি অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করা গেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যায় - অবশ্য একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা শুরু করার পরেও মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্যে নামিয়ে আনা মুশকিল। কিন্তু এই দ্বিতীয় কথাটিকে বেদবাক্য ধরে প্রথমটির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখা যায় না।

যাঁরা কোভিডকে গুরুত্বহীন বলছেন, কার্যক্ষেত্রে  তাঁরা বিপজ্জনক ভূমিকা পালন করছেন। খুবই আশ্চর্যের কথা, পশ্চিমে এসব কথা বলছেন ক্রিশ্চান রক্ষণশীলরা এবং অতি-দক্ষিণপন্থীরা - আর এদেশে অতিবামেদের একাংশ। কোভিড যদি গুরুত্বহীনই হবে, তাহলে তো এব্যাপারে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফাঁকফোকড়গুলো নিয়েও আলাদা করে সোচ্চার হওয়ার মানে হয় না। ঠিকই, কোভিডে যতজন মারা গেলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি শিশু এদেশে মারা যায় অপুষ্টিতে, পেটখারাপে - প্রতি বছরই। কিন্তু সেভাবে ভাবলে, আমফান বা বন্যায় যা মৃত্যু, তার চেয়ে বেশি মানুষ প্রতিবছর মারা যান পথদুর্ঘটনায় - তাহলে কি আমফান বা বন্যার প্রাণহানিকে গুরুত্বহীন ভাবব? 

টিকা নিয়েও একই কথা। আংশিক কার্যকরী টিকাও যদি জনসংখ্যার অধিকাংশকে তাড়াতাড়ি দেওয়া যায়, তা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে দারুণ কার্যকরী হতে পারবে। কিন্তু টিকার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই অকারণ প্রশ্ন তুললে সবাইকে তড়িঘড়ি টিকা দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রশ্নটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। 

অতিমারী মোকাবিলার নামে বেপরোয়া লকডাউন চললে অজস্র মানুষ কর্মহীন হবেন - হয়েছেনও। ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত ছাড়া অনাহার বেড়েছে। লকডাউনের শুরুর দিকেই অক্সফ্যাম-এর রিপোর্ট ছিল, বিশ্বের সর্বাধিক কড়া লকডাউন চালুর ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ছিল প্রথম সারিতে - কিন্তু লকডাউন চলাকালীন সামাজিক সুরক্ষাপ্রকল্পে ব্যয়ের হিসেবে আমরা ছিলাম একেবারে তলানিতে৷ এই দুইয়ের মিশেলের প্রতিফল যেমন হওয়ার, তেমনই হয়েছে। পাশাপাশি যানবাহন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় চিকিৎসা করাতে পারেননি বাকি অন্যান্য গুরুতর অসুখের রোগীরা - ক্যান্সার-আক্রান্তরা কেমোথেরাপি রেডিওথেরাপি নিতে আসতে পারেননি, কিডনির অসুখে ভোগা মানুষেরা ডায়ালিসিস করাতে পারেননি। লাগাতার ইশকুল বন্ধের ঠেলায় আস্ত একটি প্রজন্ম স্কুলছুট হয়ে পড়েছে - যাদের মধ্যে কতজন আবার ইশকুলে ফিরবে, বলা মুশকিল। 

আর অতিমারী বা মৃত্যুমিছিল চললে, লকডাউনও চলবে - অন্তত লকডাউনের সপক্ষে যুক্তিগুলো ভ্যালিড থাকবে। দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ... ঢেউয়ের পর ঢেউ আসতে থাকবে… যেহেতু আমরা কখনোই স্বাস্থ্যপরিকাঠামোকে মজবুত করার দাবি তুলিনি, সে কাজে এখনও সরকার মনোযোগী হবে না - নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে লকডাউনই সহজতম পথ। সহজতম, কেননা লকডাউনের শেষে সমাজের ধনীতম অংশের সম্পদ বেড়েছে বলেই খবর - ভুগছেন মূলত যাঁরা, তাঁরা আর্থিক উদারীকরণের বাজারে আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন, সরকারেরও তাঁদের কথা না ভাবলেও চলে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম লেখাপড়া করে প্রাইভেট ইশকুলে, আমরা চিকিৎসা করাই প্রাইভেট হাসপাতালে - পুরোনো সিনেমা দেখতে না বসলে গরীব কেমন দেখতে হয়, ভুলেই গিয়েছি। 

অতএব, এইই প্রাপ্য ছিল। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কোভিডের আগে থেকেই, অনেক বছর ধরে, বিশ্বের একটা বড় অংশ জুড়ে জারি আছে খিদের অতিমারী, এদেশে তো বটেই - সে অতিমারী বীভৎসতা এবং প্রসার, দুভাবেই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। সেটিকে যদি সঠিকভাবে চিনতে শিখতাম, তার সুরাহার ব্যাপারে যদি একটুখানি আগ্রহী হতাম - তাহলে সবাই মিলে কোভিড অতিমারী মোকাবিলার সেরা পথ কী, সে নিয়ে এত বেশি শব্দ খরচ করতে হত না।


বিষাণ বসু


Sunday, August 15, 2021

বাইশে শ্রাবনঃ একটি কলঙ্কিত স্মৃতির দিনও কি নয়?

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

Source: Internet

বাঙালি পাঁজির ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী। এই স্বভাব তাদের অনেকদিনের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের(৭ মে ১৮৬১ - ৭ আগস্ট ১৯৪১) জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালিত হয় বাংলা তারিখ মতে যথাক্রমে পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ। এই  দিন দুটি বেশির ভাগ বছরেই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে পড়ে দুটি আলাদা দিনে, ফলে বাঙালি এই একটি দিনের মজা নেয় উপর্যপরি দুই দিন ধরে। এবারের বাইশে শ্রাবনেও তার অন্যথা হয় নি। নানা মাধ্যমে বাঙালি তার রবীন্দ্রপ্রেম উগরে দিয়েছে। এ হল সেই আত্মঘাতী বাঙালি, যে তার নিজের অবিমিশ্রকারিতায় বাইশে শ্রাবণ তেরোশো আটচল্লিশ বঙ্গাব্দকে করে রেখেছে একটি কলঙ্কিত দিন। সেই দিন কবির মৃত্যুর কিছুক্ষনের মধ্যে "রবীন্দ্রনাথ কি জয়" চিৎকারে মত্ত উশৃঙ্খল জনতার ভিড় জোড়াসাঁকোর লোহার গেট ভেঙে পৌঁছে গেছিল দোতলার বারান্দায়, কবির শেষ শয্যার অনতিদূরে। 

কবির মৃতদেহ স্নান করানোর নিভৃত মুহূর্তটি হয়েছিল কালিমালিপ্ত। কবিকে নিয়ে জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনের মধ্যে টানাপোড়েন অনেক দিন ধরেই চালু ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতির এই 'জিনিয়াস' যে আসলে তাঁদের 'নিজস্বজন' এটা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল দু'পক্ষই। কবির শেষ বয়সে এই দ্বন্দ্ব তিক্ত আকার ধারণ করে এবং মৃত্যুলগ্নে এসে তা রীতিমত লড়াইয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে ঝুঁকে ছিলেন শান্তিনিকেতনের দিকে। নিকটজনদের কাছে তিনি লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন যে তাঁর শেষকৃত্য যেন শান্তিনিকেতনেই সম্পন্ন হয়। আশ্রমেই ছিল তাঁর প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তিনি মারা গেলেন কলকাতায়। তাঁর মৃত্যুর পর কবির দেহ শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। কারণ একদল লোক বেছে বেছে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অপমান করে জোড়াসাঁকো বাড়ির ভেতরে ঢুকে। তারপর, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে শুরু হয়ে যায় কবির শেষ যাত্রা। সেই শেষ যাত্রা অমর হয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস বা সত্যজিৎ রায়ের তোলা ডকুমেন্টারিতে(নিচে দেওয়া হল), এছাড়াও অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণীতে। সেখানে তাঁরা জানিয়েছেন যে একদল স্মারক লুব্ধ ভক্ত কবির মৃতদেহ আক্রমণ করে এবং মৃতদেহ থেকে চুল দাড়ি উপড়ে নিতে শুরু করে। 



শবের পাশে বসে থাকা নন্দলাল বসু শেষকালে পাখার বাঁট দিয়ে তাদের নিরস্ত্র করেন। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ সেই চুল দাড়ি পাঠিয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। এন্ড্রুজের বাড়িতে সেই স্মারক বহু মানুষ দেখেছেন। সেই স্মারক কিভাবে সংগৃহীত হয়েছিল বা কে সংগ্রহ করেছিল, তার উত্তর আজও মেলে নি। শবযাত্রা যত এগিয়ে চলে ততই প্রকট হয়ে ওঠে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। প্রিয় কবিকে দূরদূরান্ত থেকে অনুরাগীরা দেখতে আসছিলেন, তার আগেই অস্বাভাবিক দ্রুততায় একদল অভিসন্ধিপরায়ান লোক পুরো প্রক্রিয়াটিকে কব্জা করে ঝড়ের গতিতে দেহ নিমতলা শ্মশানে নিয়ে চলে যায়। বহু ভক্ত সেই শোকমিছিলের অবিশ্বাস্য বেগের কাছে পরাস্ত হন, তাঁদের ফুলের মালা হাতেই রয়ে যায়। শ্মশানের ছবিটি ছিল আরও ভয়াবহ। 

এমন একজন অসামান্য ব্যক্তির দেহ কীভাবে সম্মানজনকভাবে সৎকার করতে হয়, শ্মশান বা কলকাতা করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কেউই তার জন্য প্রস্তুতি রাখেননি। একটা বেড়া পর্যন্ত ছিল না মৃতদেহের সুরক্ষার জন্য। চিতার আগুন সম্পূর্ণ নেভার আগেই অর্ধদগ্ধ অস্থি সংগ্রহের জন্য পাগল হয়ে ওঠে একদল মানুষ। ভিড়ের চাপে রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ পর্যন্ত শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি ! শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুবীরেন্দ্রনাথ। কবির ইচ্ছা ছিল তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী, কিন্তু সেই ইচ্ছার মর্যাদা রাখা হয়নি।যার লেখনীর জোরে বাঙালির জাতিসত্ত্বা আজও বেঁচে আছে, সেই গুরুদেবের শেষযাত্রাকে কলঙ্কিত করেছিল হুজুগে বাঙালি। আজও রবীন্দ্র পুজোর অনেকটাই হুজুগ।  নইলে দুদিন ধরে বাইশে শ্রাবণ উদযাপন করা বাঙালি নিশ্চয় টের পেত যে এবার ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০ বছর উদযাপন। তাঁর 'রবিকা'রও ১৬০। মাঝখানের যোগসূত্র ৭ আগস্ট। অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। লেখা ছবি আর মুক্তির বৈপরীত্যে অক্ষয়, অবিনশ্বর হয়ে থাকে ঠাকুর বাড়ির দুই বিপরীত মেরুর জিনিয়াস। লক্ষণীয় যে জীবনের শেষ লগ্নে দুজনেই মুক্তি খোঁজেন নতুন কোনও শিল্পরূপে। অবনীন্দ্রনাথ ছবি জগৎ ছেড়ে পাগলামির কারুশিল্পে পেয়ে যান মুক্তির স্বাদ।সে সব লেখালেখি নিয়ে মত্ত থাকেন দিনরাত। আর লেখালেখির জগৎ ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ হাতে তুলে নেন রং তুলি, নিজস্ব মুক্তিতে বিভোর হয়ে শুরু করেন চিত্রশিল্পের চর্চা। রবীন্দ্রনাথের ছবির বর্ণনায় অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অগ্ন্যুৎপাতের বিস্ফোরনের মত একটা ব্যাপার হয়েছে। সেই একই বিস্ফোরণ ঘটে অবনীন্দ্রনাথের পুঁথি যাত্রার লেখায়। প্রায় দু'হাজার ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ! হ্যাঁ, ১৯২৮ থেকে শুরু করে ১৯৪১-এর মধ্যে। একদা যে মন ডুবে ছিল সুরে আর কথায়, সেই মন  ডুব দিয়েছিল রেখার ভিড়ে। ছবি এঁকে তিনি খ্যাতিলাভ করতে চাননি। ছবি ছিল তাঁর "এক জাতের নেশা", যেখানে ছিল "মাতলামি করবার অবিমিশ্রিত স্বাধীনতা"। 

ছবির দৌলতে খুলে গিয়েছিল রবীন্দ্র প্রতিভার এক অন্য ভুবন। অন্যদিকে ছবির অবনীন্দ্রনাথ মুক্তি খুঁজে নিলেন শব্দকল্পের লেখাজোকার বিশেষ এক ধরণে।সেই ভুবন বা নতুন পথের সন্ধান থেকে বিরত থেকেছে বাঙালি। তার চাই সবই চেনা চেনা। চেনা দুঃখ, চেনা সুখ। আমরা ভুলে যাই যে বাইশে শ্রাবণ আসলে সবাইকে নিয়ে হুল্লোড় করে উদযাপন করার দিন নয়। সেদিন আমাদের সাজিয়ে তোলার দিন। আমাদের দুঃখ, আমাদের শোককে। যেমনটা লিখেছেন আমাদের এই সময়ের এক অগ্রগণ্য কবি,"আমাদের শোক শুধু সেজে ওঠে বাইশে শ্রাবনে"। সেই শোক কী আমাদের সাজানো শোক? মিথ্যা শোক? এই প্রশ্ন আমাদের ভাবায় কি? এই হুল্লোড়ের মধ্যে প্রশ্নটি উঠলে ভালো হয়। যীশুখ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিনে শান্তি প্রার্থনা করেন খ্রিষ্টানরা। বাইশে শ্রাবণ যে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের চরম অবমাননা করলেন, সেই দিনের জন্য তাঁরা যদি অনুতপ্ত হন, তবে কেন বাইশে শ্রাবন হতে পারে না নীরব প্রার্থনার দিন?


শোভনলাল চক্রবর্তী