Wednesday, August 18, 2021

খিদের অতিমারিকে চিনতে পারিনি, কোভিড অতিমারিকে চিনব কী উপায়ে?

 লিখেছেন 

বি ষা ণ   ব সু

সূত্রঃ ইন্টারনেট

একেবারে উল্টো গল্প দিয়ে শুরু করি। ধরুন, একটি অল্পবয়সী মেয়ে স্নান করতে গিয়ে লক্ষ করল, তার স্তনে একখানা ডেলা। মেয়েটি দিনমজুরি করে খায়। একদিন কাজে না গেলেই মুশকিল। আবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আউটডোর ওই দিনের বেলাতেই খোলা। কাজেই দেখাচ্ছি দেখাব করতে করতেই কিছুদিন দেরি হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ডেলা-টি সাইজে বেশ বেড়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার দেখেই বললেন, বায়োপ্সি করতে হবে, কিন্তু সে তো এখানে হবে না। মহকুমা হাসপাতাল অব্দি ছুটতে হবে। সেও আবার কাজ কামাইয়ের ধাক্কা, যাতায়াতের খরচাও আছে। মেয়েটি কী করবে, ভেবেই পায় না। এদিকে কমপ্ল্যান খাওয়া বাচ্চার মতো ডেলা-টি দেখতে দেখতে বেড়ে চলেছে। অতএব, একটু দেরিতে হলেও, মেয়েটি সদর হাসপাতালে গেল, বায়োপ্সিও হল। দিনসাতেক বাদে রিপোর্ট - আরও একদিন কাজ কামাই, আরও একদফা যাতায়াত - জানা গেল, ক্যান্সার। ডাক্তার জানালেন, এখুনি অপারেশন করতে হবে। দুই কি তিন সপ্তাহের মাথায় অপারেশনের তারিখ দেওয়া হল, তার আগে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা। এদিকে সেই পরীক্ষানিরীক্ষা করতেও বিস্তর দৌড়াদৌড়ি - সরকারি হাসপাতালে বিনেপয়সাতে হলেও একেক পরীক্ষার একেক তারিখ, অনেকবার যাতায়াত, কাজ কামাই। মেয়েটি পেরে ওঠে না। অপারেশন করানো নিয়েও ভয় তার। অতএব, স্থানীয় এক টোটকা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় সে। তিনি বলেন, ওঃ, ওইসব অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার তো, ওদের কাজই ভয় দেখানো৷ কিচ্ছু ব্যাপার নয়, তিন কি চার হপ্তা ওষুধ খেলেই অসুখ-বিসুখ কোথায় হাওয়া হয়ে যাবে। দিনমজুরির কাজ কামাইয়ের দরকার নেই - শুধু আমার পরামর্শ মেনে চললেই হবে। 

এর পরের কাহিনী অনুমান করার জন্যে কোনও বাড়তি নম্বর নেই। মাসকয়েক বাদে যখন সে আরও একবার সেই হাসপাতালে যাবে, তখন তার স্তন থেকে গলা রস, পুঁজ, দুর্গন্ধ - ডাক্তারবাবু জানান, অপারেশন করার স্টেজ পার হয়ে গেছে। আপাতত ওষুধপত্র ড্রেসিং ইত্যাদি। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় ডাক্তারবাবুর গলার সুর বা শরীরী ভাষা দেখে বাকিটুকু অনুমান করতে অসুবিধে হয় না মেয়েটির পরিবারের। মেয়েটির পরিণতিও আপনারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। 

তাহলে মেয়েটির এই পরিণতির কারণ কী? 

  • ক্যান্সারের মতো অসুখ যে কতখানি ভয়াবহ হতে পারে, সেই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে মেয়েটির ব্যর্থতা? ক'দিন মজুরি হারানোর ভয়ে সে অপারেশন করাতে দেরি করল, কিন্তু বুঝল না অসুখ ভয়াবহ আকার নিলে মজুরি ব্যাপারটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে?
  • সেই স্থানীয় টোটকা "চিকিৎসক", যিনি ক্যান্সারের বিপদকে লঘু করে দেখিয়ে মেয়েটিকে আপাত-স্বস্তি জুগিয়েছিলেন? যিনি ওরকম করে আশ্বস্ত না করলে, মেয়েটি হয়ত যে করেই হোক অপারেশন করাতে দৌড়াত - দায় কি তাঁর কিছু কম??
  • স্বাস্থ্যব্যবস্থার দায়ও কি কম? বাড়ির কাছে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার ন্যূনতম বন্দোবস্তটুকু থাকলে কি মেয়েটি চিকিৎসায় এমন করে অবহেলা করতে পারত? অ্যাক্সেস টু হেলথকেয়ার - যার বাংলা করা যেতে পারে, সকলের নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা। আমরা নাগাল শব্দটিকে আর্থিক সামর্থ্যের সাথে এক করে ভাবতেই অভ্যস্ত - কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্ব অর্থে নাগাল শব্দটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ন্যূনতম পরীক্ষানিরীক্ষা বা চিকিৎসার জন্যে যদি লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়, তাহলে বিনেপয়সায় পেলেও চিকিৎসা করানোটা ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। যে ওষুধ পাঁচশ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়, তা বিনেপয়সায় মিললে খুবই ভালো কথা - কিন্তু সেই ওষুধ পেতে পরিবারের রোজগেরে মানুষের যদি একটি আস্ত কর্মদিবস নষ্ট হয়, এবং রাহাখরচের পরিমাণও কম কিছু নয়, তাহলে সেই বিনেপয়সায় পাওয়ার ভালত্বটি মাঠে মারা যায়।
  • রাষ্ট্রের দায়িত্বই বা কম কী? দিনমজুরি খেটে যাঁরা উপার্জন করেন, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে যাঁদের একটি দিন কাজ হারানোর অর্থ উনুন না জ্বলা - হাসপাতালে দিনদশেক ভর্তি থাকার অর্থ সপরিবার উপবাস - তাঁদের জন্য স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বাদেও থাকবে না ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা?
  • আর এতশত উচ্চমার্গের আলোচনা বা অমুকের 'পরে দোষের দায় ঠেলার মুহূর্তে নিজেদের দায়িত্বটাও ভুলে গেলেও চলবে কেন!! আমরা, অর্থাৎ দেশের "সচেতন" নাগরিক। স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর পেরোলো - প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কই, একটাও নির্বাচনের কথা শুনেছেন, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যচিকিৎসার অধিকার প্রধান বা অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে? অনেক বাচ্চার মধ্যে যে বাচ্চা কাঁদে কম, সেই বাচ্চার ভাগে মায়ের দুধ কমই জোটে - স্বাস্থ্যক্ষেত্রের হালও তেমনই। কর্পোরেট হাসপাতালের বিল, বিভিন্ন দুর্নীতি বা ডাক্তারকে গালমন্দ করার ব্যাপারে আমরা যতখানি আগ্রহী, সরকারের কাছে সবার স্বাস্থ্য-চিকিৎসার দাবি তোলার ব্যাপারে আমরা ততখানিই বিস্মরণ-প্রবণ। সুতরাং, আমাদের বরাতে এইই জুটবে৷ আজ এই মেয়েটি দরিদ্র বলে তার এমন পরিণতি - চিকিৎসার খরচ যেভাবে আকাশ ছুঁতে চলেছে, এখুনি সরব না হলে আমাদের সকলের এমন পরিণতিও খুব দূরে নয়।

এসবের মধ্যে অসুখের প্রসঙ্গ আর আলাদা করে আনলাম না। ক্যান্সার ভয়ানক অসুখ। সময়ে চিকিৎসা না করা গেলে পরিণতি ভয়ঙ্কর তো বটেই - এমনকি, সময়ে চিকিৎসা করা গেলেও একশ শতাংশ নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কিন্তু এই দ্বিতীয় অংশটুকুর অনিশ্চয়তাকে সামনে তুলে প্রথম অংশের গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ-নির্ণয় ও জলদি চিকিৎসা, বাঁচার পথ এটিই। মেডিকেল সায়েন্স কোনও গাণিতিক বিজ্ঞান নয় - দুইয়ে দুইয়ে চার ক্ষেত্রবিশেষে হয় না - তবু একথা অনস্বীকার্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেকদূর অগ্রগতির শেষে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিসেবটা মেলে। কাজেই, অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়েই বলা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় অসুখের চিকিৎসা করা গেলে অসুখ সারার সম্ভাবনা অনেক অনেএএএক বেশি। 



এই গল্পটিকে রূপক হিসেবে ধরে নিয়ে যদি ক্যান্সারের জায়গায় কোভিড বসিয়ে পড়া হয়, চিত্রটা কেমন হবে?

 হ্যাঁ, মারণক্ষমতায় তুলনীয় না হলেও, কোভিডের সংক্রমণক্ষমতার কারণেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি - চট করে একসাথে অনেককে কাবু করে ফেলার ক্ষমতাও বেশি - কাজেই আক্রান্তের খুবই কম শতাংশের মৃত্যু হলেও মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বিশেষত, নড়বড়ে স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিয়ে একসাথে অনেক মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সামলানো মুশকিল - সেক্ষেত্রে মৃত্যুহার এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা, উভয়ই বাড়ার সম্ভাবনা। 

তড়িঘড়ি অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করা গেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যায় - অবশ্য একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা শুরু করার পরেও মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্যে নামিয়ে আনা মুশকিল। কিন্তু এই দ্বিতীয় কথাটিকে বেদবাক্য ধরে প্রথমটির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখা যায় না।

যাঁরা কোভিডকে গুরুত্বহীন বলছেন, কার্যক্ষেত্রে  তাঁরা বিপজ্জনক ভূমিকা পালন করছেন। খুবই আশ্চর্যের কথা, পশ্চিমে এসব কথা বলছেন ক্রিশ্চান রক্ষণশীলরা এবং অতি-দক্ষিণপন্থীরা - আর এদেশে অতিবামেদের একাংশ। কোভিড যদি গুরুত্বহীনই হবে, তাহলে তো এব্যাপারে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফাঁকফোকড়গুলো নিয়েও আলাদা করে সোচ্চার হওয়ার মানে হয় না। ঠিকই, কোভিডে যতজন মারা গেলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি শিশু এদেশে মারা যায় অপুষ্টিতে, পেটখারাপে - প্রতি বছরই। কিন্তু সেভাবে ভাবলে, আমফান বা বন্যায় যা মৃত্যু, তার চেয়ে বেশি মানুষ প্রতিবছর মারা যান পথদুর্ঘটনায় - তাহলে কি আমফান বা বন্যার প্রাণহানিকে গুরুত্বহীন ভাবব? 

টিকা নিয়েও একই কথা। আংশিক কার্যকরী টিকাও যদি জনসংখ্যার অধিকাংশকে তাড়াতাড়ি দেওয়া যায়, তা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে দারুণ কার্যকরী হতে পারবে। কিন্তু টিকার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই অকারণ প্রশ্ন তুললে সবাইকে তড়িঘড়ি টিকা দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রশ্নটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। 

অতিমারী মোকাবিলার নামে বেপরোয়া লকডাউন চললে অজস্র মানুষ কর্মহীন হবেন - হয়েছেনও। ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত ছাড়া অনাহার বেড়েছে। লকডাউনের শুরুর দিকেই অক্সফ্যাম-এর রিপোর্ট ছিল, বিশ্বের সর্বাধিক কড়া লকডাউন চালুর ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ছিল প্রথম সারিতে - কিন্তু লকডাউন চলাকালীন সামাজিক সুরক্ষাপ্রকল্পে ব্যয়ের হিসেবে আমরা ছিলাম একেবারে তলানিতে৷ এই দুইয়ের মিশেলের প্রতিফল যেমন হওয়ার, তেমনই হয়েছে। পাশাপাশি যানবাহন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় চিকিৎসা করাতে পারেননি বাকি অন্যান্য গুরুতর অসুখের রোগীরা - ক্যান্সার-আক্রান্তরা কেমোথেরাপি রেডিওথেরাপি নিতে আসতে পারেননি, কিডনির অসুখে ভোগা মানুষেরা ডায়ালিসিস করাতে পারেননি। লাগাতার ইশকুল বন্ধের ঠেলায় আস্ত একটি প্রজন্ম স্কুলছুট হয়ে পড়েছে - যাদের মধ্যে কতজন আবার ইশকুলে ফিরবে, বলা মুশকিল। 

আর অতিমারী বা মৃত্যুমিছিল চললে, লকডাউনও চলবে - অন্তত লকডাউনের সপক্ষে যুক্তিগুলো ভ্যালিড থাকবে। দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ... ঢেউয়ের পর ঢেউ আসতে থাকবে… যেহেতু আমরা কখনোই স্বাস্থ্যপরিকাঠামোকে মজবুত করার দাবি তুলিনি, সে কাজে এখনও সরকার মনোযোগী হবে না - নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে লকডাউনই সহজতম পথ। সহজতম, কেননা লকডাউনের শেষে সমাজের ধনীতম অংশের সম্পদ বেড়েছে বলেই খবর - ভুগছেন মূলত যাঁরা, তাঁরা আর্থিক উদারীকরণের বাজারে আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন, সরকারেরও তাঁদের কথা না ভাবলেও চলে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম লেখাপড়া করে প্রাইভেট ইশকুলে, আমরা চিকিৎসা করাই প্রাইভেট হাসপাতালে - পুরোনো সিনেমা দেখতে না বসলে গরীব কেমন দেখতে হয়, ভুলেই গিয়েছি। 

অতএব, এইই প্রাপ্য ছিল। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কোভিডের আগে থেকেই, অনেক বছর ধরে, বিশ্বের একটা বড় অংশ জুড়ে জারি আছে খিদের অতিমারী, এদেশে তো বটেই - সে অতিমারী বীভৎসতা এবং প্রসার, দুভাবেই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। সেটিকে যদি সঠিকভাবে চিনতে শিখতাম, তার সুরাহার ব্যাপারে যদি একটুখানি আগ্রহী হতাম - তাহলে সবাই মিলে কোভিড অতিমারী মোকাবিলার সেরা পথ কী, সে নিয়ে এত বেশি শব্দ খরচ করতে হত না।


বিষাণ বসু


No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.