Sunday, August 15, 2021

বাইশে শ্রাবনঃ একটি কলঙ্কিত স্মৃতির দিনও কি নয়?

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

Source: Internet

বাঙালি পাঁজির ব্যবহার করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী। এই স্বভাব তাদের অনেকদিনের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের(৭ মে ১৮৬১ - ৭ আগস্ট ১৯৪১) জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালিত হয় বাংলা তারিখ মতে যথাক্রমে পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ। এই  দিন দুটি বেশির ভাগ বছরেই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে পড়ে দুটি আলাদা দিনে, ফলে বাঙালি এই একটি দিনের মজা নেয় উপর্যপরি দুই দিন ধরে। এবারের বাইশে শ্রাবনেও তার অন্যথা হয় নি। নানা মাধ্যমে বাঙালি তার রবীন্দ্রপ্রেম উগরে দিয়েছে। এ হল সেই আত্মঘাতী বাঙালি, যে তার নিজের অবিমিশ্রকারিতায় বাইশে শ্রাবণ তেরোশো আটচল্লিশ বঙ্গাব্দকে করে রেখেছে একটি কলঙ্কিত দিন। সেই দিন কবির মৃত্যুর কিছুক্ষনের মধ্যে "রবীন্দ্রনাথ কি জয়" চিৎকারে মত্ত উশৃঙ্খল জনতার ভিড় জোড়াসাঁকোর লোহার গেট ভেঙে পৌঁছে গেছিল দোতলার বারান্দায়, কবির শেষ শয্যার অনতিদূরে। 

কবির মৃতদেহ স্নান করানোর নিভৃত মুহূর্তটি হয়েছিল কালিমালিপ্ত। কবিকে নিয়ে জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনের মধ্যে টানাপোড়েন অনেক দিন ধরেই চালু ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতির এই 'জিনিয়াস' যে আসলে তাঁদের 'নিজস্বজন' এটা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল দু'পক্ষই। কবির শেষ বয়সে এই দ্বন্দ্ব তিক্ত আকার ধারণ করে এবং মৃত্যুলগ্নে এসে তা রীতিমত লড়াইয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে ঝুঁকে ছিলেন শান্তিনিকেতনের দিকে। নিকটজনদের কাছে তিনি লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন যে তাঁর শেষকৃত্য যেন শান্তিনিকেতনেই সম্পন্ন হয়। আশ্রমেই ছিল তাঁর প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তিনি মারা গেলেন কলকাতায়। তাঁর মৃত্যুর পর কবির দেহ শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। কারণ একদল লোক বেছে বেছে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অপমান করে জোড়াসাঁকো বাড়ির ভেতরে ঢুকে। তারপর, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে শুরু হয়ে যায় কবির শেষ যাত্রা। সেই শেষ যাত্রা অমর হয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস বা সত্যজিৎ রায়ের তোলা ডকুমেন্টারিতে(নিচে দেওয়া হল), এছাড়াও অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণীতে। সেখানে তাঁরা জানিয়েছেন যে একদল স্মারক লুব্ধ ভক্ত কবির মৃতদেহ আক্রমণ করে এবং মৃতদেহ থেকে চুল দাড়ি উপড়ে নিতে শুরু করে। 



শবের পাশে বসে থাকা নন্দলাল বসু শেষকালে পাখার বাঁট দিয়ে তাদের নিরস্ত্র করেন। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ সেই চুল দাড়ি পাঠিয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। এন্ড্রুজের বাড়িতে সেই স্মারক বহু মানুষ দেখেছেন। সেই স্মারক কিভাবে সংগৃহীত হয়েছিল বা কে সংগ্রহ করেছিল, তার উত্তর আজও মেলে নি। শবযাত্রা যত এগিয়ে চলে ততই প্রকট হয়ে ওঠে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। প্রিয় কবিকে দূরদূরান্ত থেকে অনুরাগীরা দেখতে আসছিলেন, তার আগেই অস্বাভাবিক দ্রুততায় একদল অভিসন্ধিপরায়ান লোক পুরো প্রক্রিয়াটিকে কব্জা করে ঝড়ের গতিতে দেহ নিমতলা শ্মশানে নিয়ে চলে যায়। বহু ভক্ত সেই শোকমিছিলের অবিশ্বাস্য বেগের কাছে পরাস্ত হন, তাঁদের ফুলের মালা হাতেই রয়ে যায়। শ্মশানের ছবিটি ছিল আরও ভয়াবহ। 

এমন একজন অসামান্য ব্যক্তির দেহ কীভাবে সম্মানজনকভাবে সৎকার করতে হয়, শ্মশান বা কলকাতা করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কেউই তার জন্য প্রস্তুতি রাখেননি। একটা বেড়া পর্যন্ত ছিল না মৃতদেহের সুরক্ষার জন্য। চিতার আগুন সম্পূর্ণ নেভার আগেই অর্ধদগ্ধ অস্থি সংগ্রহের জন্য পাগল হয়ে ওঠে একদল মানুষ। ভিড়ের চাপে রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ পর্যন্ত শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি ! শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুবীরেন্দ্রনাথ। কবির ইচ্ছা ছিল তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী, কিন্তু সেই ইচ্ছার মর্যাদা রাখা হয়নি।যার লেখনীর জোরে বাঙালির জাতিসত্ত্বা আজও বেঁচে আছে, সেই গুরুদেবের শেষযাত্রাকে কলঙ্কিত করেছিল হুজুগে বাঙালি। আজও রবীন্দ্র পুজোর অনেকটাই হুজুগ।  নইলে দুদিন ধরে বাইশে শ্রাবণ উদযাপন করা বাঙালি নিশ্চয় টের পেত যে এবার ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০ বছর উদযাপন। তাঁর 'রবিকা'রও ১৬০। মাঝখানের যোগসূত্র ৭ আগস্ট। অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। লেখা ছবি আর মুক্তির বৈপরীত্যে অক্ষয়, অবিনশ্বর হয়ে থাকে ঠাকুর বাড়ির দুই বিপরীত মেরুর জিনিয়াস। লক্ষণীয় যে জীবনের শেষ লগ্নে দুজনেই মুক্তি খোঁজেন নতুন কোনও শিল্পরূপে। অবনীন্দ্রনাথ ছবি জগৎ ছেড়ে পাগলামির কারুশিল্পে পেয়ে যান মুক্তির স্বাদ।সে সব লেখালেখি নিয়ে মত্ত থাকেন দিনরাত। আর লেখালেখির জগৎ ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ হাতে তুলে নেন রং তুলি, নিজস্ব মুক্তিতে বিভোর হয়ে শুরু করেন চিত্রশিল্পের চর্চা। রবীন্দ্রনাথের ছবির বর্ণনায় অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অগ্ন্যুৎপাতের বিস্ফোরনের মত একটা ব্যাপার হয়েছে। সেই একই বিস্ফোরণ ঘটে অবনীন্দ্রনাথের পুঁথি যাত্রার লেখায়। প্রায় দু'হাজার ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ! হ্যাঁ, ১৯২৮ থেকে শুরু করে ১৯৪১-এর মধ্যে। একদা যে মন ডুবে ছিল সুরে আর কথায়, সেই মন  ডুব দিয়েছিল রেখার ভিড়ে। ছবি এঁকে তিনি খ্যাতিলাভ করতে চাননি। ছবি ছিল তাঁর "এক জাতের নেশা", যেখানে ছিল "মাতলামি করবার অবিমিশ্রিত স্বাধীনতা"। 

ছবির দৌলতে খুলে গিয়েছিল রবীন্দ্র প্রতিভার এক অন্য ভুবন। অন্যদিকে ছবির অবনীন্দ্রনাথ মুক্তি খুঁজে নিলেন শব্দকল্পের লেখাজোকার বিশেষ এক ধরণে।সেই ভুবন বা নতুন পথের সন্ধান থেকে বিরত থেকেছে বাঙালি। তার চাই সবই চেনা চেনা। চেনা দুঃখ, চেনা সুখ। আমরা ভুলে যাই যে বাইশে শ্রাবণ আসলে সবাইকে নিয়ে হুল্লোড় করে উদযাপন করার দিন নয়। সেদিন আমাদের সাজিয়ে তোলার দিন। আমাদের দুঃখ, আমাদের শোককে। যেমনটা লিখেছেন আমাদের এই সময়ের এক অগ্রগণ্য কবি,"আমাদের শোক শুধু সেজে ওঠে বাইশে শ্রাবনে"। সেই শোক কী আমাদের সাজানো শোক? মিথ্যা শোক? এই প্রশ্ন আমাদের ভাবায় কি? এই হুল্লোড়ের মধ্যে প্রশ্নটি উঠলে ভালো হয়। যীশুখ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দিনে শান্তি প্রার্থনা করেন খ্রিষ্টানরা। বাইশে শ্রাবণ যে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের চরম অবমাননা করলেন, সেই দিনের জন্য তাঁরা যদি অনুতপ্ত হন, তবে কেন বাইশে শ্রাবন হতে পারে না নীরব প্রার্থনার দিন?


শোভনলাল চক্রবর্তী



No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.