Monday, June 21, 2021

টিনের তলোয়ার নাটকের পঞ্চাশ বছর: প্রতিবাদের নব আঙ্গিককে ফিরে দেখা

  লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী


নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে নট, নাট্যকার উৎপল দত্ত বলতেন, "আমি শিল্পী নই, আমি মনে করি আমি প্রোপাগানডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।" প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর প্রোপাগান্ডার বিষয়। আর ছিল মানুষকে ক্রুদ্ধ করে তোলা। তিনি জানতেন গণআন্দোলনের পথে নামলেই প্রকাশ পাবে সেই ক্রোধ ও সংগ্রামের মুষ্টিবদ্ধ প্রয়াস। বিশ শতকের প্রথম দশকে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকল অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের চেনা ছক, অভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক অবস্থা এবং তৎসম্পর্কিত আচার আচরণ। 

চল্লিশের দশকে তা আরও পরিণতি পেল। এই বিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যে উৎপল দত্তের নাট্যচেতনা পুষ্ট হয়েছিল। এরপর পঞ্চাশের দশকের সুচিন্তিত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং শৈল্পিক অনুভূতি নিয়ে তিনি বাংলা নাটক, থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র সম্বলিত সংস্কৃতির জগতে পা রাখলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের গণবিপ্লবের কাহিনীই হয়ে উঠেছিল তাঁর নাটকের উপজীব্য বিষয়। চার দেওয়ালের মধ্যে ঘেরা মধ্যবিত্ত নিস্তরঙ্গ জীবন নয়, তিনি চাইতেন ব্যাপ্ত প্রেক্ষাপট। তাই ইতিহাস থেকে নির্বাচন করতেন চরিত্রদের, তারা যোদ্ধা হোক বা শ্রমিক, নাট্যকর্মী বা সাধারণ মানুষ, শর্ত একটাই দেশ ও কালের মানচিত্রে অবদান আছে কিনা। তাই পৃথিবীর তাবৎ প্রতিবাদী চরিত্র তাদের কাহিনী নিয়ে ভিড় করেছে উৎপল দত্তের নাটকে। শেক্সপিয়র থেকে ব্রেখট, গান্ধী থেকে লেনিন, তার পাশে অবলীলায় এসে দাঁড়ায় চিৎপুরের মেথর কিংবা তিতুমীর। 

১৮৭২-এ ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৮৭৬-এর নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন বলবৎ হওয়া - বাংলা থিয়েটারের এক গুরুত্বপূর্ণ ও দমনপীড়নের ঘটনাবহুল অধ্যায়। নাট্যকার উৎপল দত্ত সেই সময়কে উনিশ শতকের থিয়েটার জগতের প্রেক্ষাপটে এক বাস্তবোত্তর সত্যে প্রতিষ্ঠা করলেন "টিনের তলোয়ার" নাটকে। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সেইসব অগণিত নাট্যকর্মীকে যাঁরা বহুস্তরীয়, বহুকৌণিক বাধা অতিক্রম করে নানা প্রতিবন্ধকতাকে শিরোধার্য করে বাংলা নাট্যচর্চাকে অব্যাহত রেখেছিলেন এবং অনাগত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর করিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এই নাটকে ছিল বহুমাত্রিক স্তর - শিল্পের সত্য, জীবনের সত্য, রাজনীতি, ইতিহাস ও সর্বোপরি থিয়েটার। কাপ্তানবাবু বেণীমাধব চাটুজ্জে, দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার গ্যারিক (সৌজন্যে দি ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা), মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের সঙ্গে আপোষ করে থিয়েটার চর্চা করছিলেন। 

নব্যবঙ্গ প্রিয়নাথ মল্লিকের সংস্পর্শে এসে সেই আপোষ উত্তীর্ণ হয় প্রতিবাদে। বেণীমাধব হয়ে ওঠেন উপেন দাস, অর্ধেন্দু মুস্তাফি, গিরিশ ঘোষের সমন্বিত প্রতিবাদী চরিত্র। ময়নার মধ্যে প্রতিফলিত হয় গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনীর জীবন, আর বেঙ্গল অপেরা হয়ে ওঠে বেঙ্গল থিয়েটার ও গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের সম্মিলিত রূপ। উৎপল দত্ত পরম যত্নে উন্মোচিত করেছেন শতবর্ষ আগের সেই ঘটনাবহুল অধ্যায়ের বহুবিচিত্র গতিপথ। নাটকের শুরুতে যে মেথর নর্দমার ম্যানহোলের ভিতর থেকে উঠে এসে উঁচু গলায় ঘোষণা করে, "আমি কলকেতার তলায় থাকি", সেইই "ময়ূরবাহন" নাটকের পোস্টার দেখে প্রশ্ন করে , "এত নেকাপড়া করে টিনের তলোয়ার নিয়ে ছেলেমানুষি কর কেন?" নাটকের শেষে এই টিনের তলোয়ারই হয়ে ওঠে বিদ্রোহের প্রতীক। 

উৎপল দত্তের শ্রদ্ধা তাঁদের প্রতি "যাঁহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয় বেদনাকে দিয়াছিলেন বিদ্রোহী মূর্তি।" কিন্তু এই শ্রদ্ধা তো থিয়েটারের প্রতি, শিল্পের প্রতি। মার্কসীয় জীবনদর্শনে বিশ্বাসী প্রপাগানডিস্ট উৎপল দত্ত কোথায় টিনের তলোয়ার নাটকে? এই নাটকের পাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে উনিশ শতকের শেষার্ধের বাংলা নাট্যশালার ইতিহাস।কিন্তু উৎপল দত্ত সেই সব ঘটনার সমান্তরালে প্রকাশ করেছেন সেকালের সমাজ। নাটকের যবনিকা সরে গেলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৮৩৬-এর মোকাম কলকাতা এবং চিৎপুর, বউবাজার সহ শোভাবাজার নাট্যশালা। নিখুঁত চিত্রে পরিবেশিত হয় পথঘাট, মানুষ, পরিবেশ ও সংস্কৃতি। এছাড়া রয়েছে বাবুবিলাসের চিত্র, রক্ষিতা, উপপত্নী, আমেরিকান মদ 'আনিস', ব্রুহাম জুড়ি গাড়ি, নৌকাবিলাস, চতুরদোলা শরবত, বুলবুলির লড়াই, কুকুরের বিয়ে ইত্যাদি। 

অন্যদিকে কলকাতার সং, ফেরিওয়ালার ডাক, রোঁদে চৌকিদার, গড়গড়া, বার্ডস আই সিগারেট - এ যেন হুতোমি কলকেতার নিপুণ চিত্র। এর পাশেই রয়েছে দুর্ভিক্ষ, চাল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য দাঙ্গা, ছিন্নমূল মানুষের ভিড়, ভিখিরির চিৎকার। উনিশ শতকের কলকাতা, প্রিয়নাথের জবানিতে "এদিকে হাহাকার, ঐদিকে বুলবুলির লড়াই। ইহা এক প্রহসন।" এখন প্রশ্ন হচ্ছে নাট্যচর্চা, নাট্যজগৎ, নাট্যশিল্পীদের প্রতিবাদ, ত্যাগ এসবের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে গিয়ে সত্যিই কি দরকার ছিল কলকাতার 'প্রহসন'-কে জানানো? এর উত্তর দিয়েছেন স্বয়ং নাট্যকার। তিনি লিখেছেন, "বহুদিন পর্যন্ত কলকাতার নাট্যচর্চা রাজা রাজড়াদের দাক্ষিন্য নির্ভর ছিল। মাইকেলের "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ" এবং "একেই কি বলে সভ্যতা" রাজারা হুকুম দিয়ে লেখালেন অথচ অভিনয় করতে দিলেন না। সেই কারণে মাইকেল বেঙ্গল থিয়েটারের পরিষদ সদস্য হয়ে আপ্রাণ খেটেছিলেন স্বাধীন পেশাদার থিয়েটার প্রতিষ্ঠার জন্য। গিরিশ এবং অর্ধেন্দুকে বারবার পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা প্রতারিত হতে দেখে তিনি স্থির করেছিলেন থিয়েটারকে বড়লোকদের ইচ্ছা নির্ভরতা থেকে মুক্ত না করতে  পারলে কিছুই হবে না।"

(টুওয়ার্ডস আ রেভুলিউশিনারী থিয়েটার) বাংলা নাটকের ইতিহাস বলছে যে ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে ওই বড়লোকরা থিয়েটারকে জনতার টাকার ওপর দাঁড় করাবেন বলেই তৈরি হল বাংলা নাটক। এটা ওঁরা শিখেছিলেন ইয়োরোপের কাছে। তাঁদের কাছে বাইজি নাচের মত থিয়েটারও বিনোদনের উপকরণমাত্র। এরপর নব্যশিক্ষিত রাজাদের হাতে পরে থিয়েটার চলে যায় বিত্তবান রাজা ও জমিদারদের উঠোনে। এরই মধ্যে চলতে থাকে নাট্যকর্মীদের, শিল্পীদের সংগ্রাম। তাই টিনের তলোয়ার নাটকে প্রয়োজন ছিল মোকাম কলকাতার আর্থ সামাজিকতার পূর্ন বিবরণ। এই নাটক তাই নিদারুণ যন্ত্রনায় একজন নাট্যশিল্পীর আত্মবিক্রিত হতে হতেও উত্তরণের মুহূর্তকে মহতী করে তোলে। নাট্যশিল্পীদের সংগ্রামের মধ্যে উৎপল দত্ত তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রীয় দমন নীতি, শ্রেণী বৈষম্য এবং উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের বৈষম্যের বিপরীতে। 

১৯৭১ সালে এই নাটক যখন লিখছেন উৎপল দত্ত তখন কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙ্গন, নকশাল আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নকশাল তকমায় যুবসমাজ আত্মবলিদানে রত, নকশালবাড়ির সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন, এদের দমন করতে শাসক দলের চরম অত্যাচার, প্রভৃতিতে উত্তাল ও উত্তপ্ত সময়। বাংলার মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করতে, স্বার্থকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা জোগাতে তিনি ১০০ বছরের পিছনের ইতিহাস থেকে নির্বাচন করলেন উনিশ শতকের বিত্তবান বাবু ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সাধারণ রঙ্গালয়ের নাট্যকর্মীদের নিরলস সংগ্রামকে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও শৈল্পিক ঐক্য স্থাপনে এই নাটক অনন্য। আর অনন্য ভাষার প্রয়োগে।

নাটকের পাতায় পাতায় এমন সব  শব্দ আছে (থুতকুড়ি, বেদেবুড়ি, নড়েভোলা, ফররার,চৈতন ফক্কা, আচাভুয়া) যা আজ হারিয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর যে শব্দ সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন তাতে এই 'আচাভুয়া' শব্দটি পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্রও ব্যবহার করেছিলেন এই সব শব্দ। আগাগোড়া ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত উৎপল দত্ত এই সব শব্দের উদ্ধার করেছিলেন মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর ঘেঁটে। উৎপল দত্ত নিজে জার্মান জানতেন, মূল জার্মান পড়তেন, কিন্তু কখনো ব্রেখট অনুবাদ করেননি। তার কারণ ছিল ব্রেখট-এর নাটকে ব্যবহৃত কথ্য ভাষা, যার অনুবাদ হয় না। সমাজের নিচুতলার এই ভাষা মূলস্রোতের জার্মান সাহিত্যে রয়ে গেল, কিন্তু আমাদের এখানে আমরা তাকে বসিয়ে রাখলাম দরজার বাইরে।

এতে যে দুর্বল হয়ে গেল বাংলা ভাষা, তা আমরা বুঝেও বুঝলাম না তার কারণ কি এই যে বাংলা সাহিত্য পাখা মেলেছে মূলত উচ্চবর্ণের লেখার টেবিল থেকে ?  বাংলার বহু আঞ্চলিক ভাষা, জেলার ভাষা কোথায় বাংলার সাহিত্য, নাটকে

তাই প্রশ্ন ওঠে, যে নিতে পারে না, সে কি দিতে পারে?


শোভনলাল চক্রবর্তী


Monday, June 14, 2021

শিব থেকে শিবময়ানন্দ : বৈরাগ্যই হলো সাধ ও সাধনা

  

লিখেছেন 

রা ম কু মা র   মু খো পা ধ্যা য়

স্বামী শিবময়ানন্দজি

(স্বামী শিবময়ানন্দ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর বিহারের সুপৌলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে বেলুড়মঠে যোগ দেন। রহড়ার বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয় এবং বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়ি, কাশীপুর উদ্যানবাটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের‌ও অধ্যক্ষ ছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের  সারগাছিকাটিহার, কলকাতার সেবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কেন্দ্রের সঙ্গেও নানা সময়ে যুক্ত ছিলেন। পরে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম সহাধ্যক্ষ হন। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে  গত ১১ জুন ২০২১ তাঁর দেহাবসান হয়েছে।)

বিদ্যামন্দিরের ‘বিবেক ভবনে’ দু-বছর কাটিয়ে ‘বিনয় ভবনে’ এসেছি ১৯৭৬ সাল দুর্গাপুজোর মাস তিনেক আগে বোধহয় আমাদের হস্টেল বদল হয়েছিল তারপর দিন গুনতে গুনতে দুর্গাপুজো এসে গেল আর আমরা ব্যাগ বেঁধে যে যার বাড়ি চলে গেলাম এক সময়ে পুজো শেষ পুজোর ছুটিও হুড়মুড়িয়ে কেটে গেল হস্টেলে ফিরলাম তার দু-এক দিনের মধ্যে শুনলাম কলেজের অধ্যক্ষ রণেন মহারাজ (স্বামী শিবময়ানন্দজি) রাতের প্রার্থনার পরে আমাদের কিছু কথা বলবেন  সুপারিনটেনডেন্ট তখন পরেশ মহারাজ আর ইতিহাসের অধ্যাপক গণনাথ মহারাজ হস্টেলে তাঁর সহকারী তাঁরাই কথাটা জানালেন ভাবলাম নিশ্চয় পড়াশোনার কথা ঢাকের শব্দ তখন হালকা কানে বাজছে তার মধ্যে পড়াশোনা ঢুকবে ভেবে অনেকেরই বেজার মুখ কিন্তু মহারাজ এসে বসার পর শুনলাম তিনি তাঁর পুজোর ছুটি কাটানোর গল্প শোনাবেন পরেশ মহারাজ বললেন তিনিই বলার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন

রণেন মহারাজ বললেন বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো হয়ে যাবার পর ভাবলেন কয়েকটা দিন বাইরে কোথাও ঘুরে এলে হয় অন্য একজন মহারাজকে রাজিও করালেন সেই মহারাজের নাম কী ছিল তা আর এতদিন পরে মনে নেই ঠিক হলো কামারপুকুর জয়রামবাটি যাবেন যাওয়া মানে গাড়িভাড়া লাগবে তখন ভাবলেন - 'আমরা তো সাধু, তাই হেঁটেই যেতে পারি' আর মানুষজনের বাড়িতে ভিক্ষে চাইলে পেটের চিন্তাও থাকবে না  সেই মতো কাঁধের ঝোলায় একটা ধুতি পাঞ্জাবি আর একটা উত্তরীয় ভরে বেরিয়ে পড়লেন সে-ঝোলায় ভিক্ষের একটা বড়ো বাটিও নিলেন তারপর বেলুড় থেকে বালি ছেড়ে একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে ভিক্ষে চেয়েছেন – ‘জননী ভিক্ষাং দেহি’ কপাল খারাপ হলে যা হয়! জননীর পরিবর্তে সে বাড়ির ছেলেটি বেরিয়ে এসেছে এসে দেখে কলেজের প্রিন্সিপাল দরজায় ভিক্ষে চাইছেন সে খানিক থতমত খেয়ে তারপর সোচ্চারে বাড়ির লোকজনদের ডাকাডাকি শুরু করে তখন 'ভিক্ষে চাই না, ছেড়ে দে বাবা' অবস্থা তাকে কোনো রকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়া

 

বিদ্যামন্দির

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর কোনো এক বাড়ি থেকে কিছুটা মুড়ি বা চিঁড়ে মিলল সেটা একটা গাছের তলায় বসে খেয়ে আবার হাঁটা দুপুরের সময় পুকুরে চান সেরে কাপড় শুকিয়ে আবার খাবারের জন্যে ভিক্ষে প্রথম বাড়িতে চাল নিয়ে একটি বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে এলো কিন্তু তা ফোটাবার জন্য যে হাঁড়ি নেই, তাই শুধু ভাত-তরকারি নেওয়া সে-ছেলেটি এই খবর শুধু বাড়িতে দিল না, পাশাপাশি বাড়িতেও পোঁছে দিল সে-কাজে আরও দু-তিনটে ছেলেকে সঙ্গী পেয়ে গেল ফলে এক দুপুরে ভাত, ডাল, তরকারি যা জুটল তাতে রাতের খাবারের চিন্তাও চলে গেল একটি বাটির খাওয়া দু-ভাগ করে খেয়ে অন্যটা রাতের জন্যে তুলে রাখা হলো একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা 

বিকেলের দিকে রাস্তার গাঁয়ের একটা ডাঙায় কিছু ছেলে ভলিবল খেলছিল তারা চেঁচিয়ে বলল, ' সাধুবাবারা, খেলবে নাকি ?' দুজনকেই ভালো ভলিবল খেলতেন রণেন মহারাজ অঙ্কের মানুষ বলে হিসেব করে অনেক সময় ফাঁকা জায়গায় বল ফেলতে পারতেন তা ওঁরা দুজন ধুতি অর্ধেক গুটিয়ে নেমে পড়লেন দু-চারবার বলে হাত ছোঁয়াবার পর ছেলেগুলি রীতিমত অবাক ভক্তিও বেড়ে গেল তবে সাধুবাবাদের খেলার নিয়মিত অভ্যেস নাকি যোগবল ভেবেছিল কে জানে! তারপর রাত কেটেছিল একটি শিবমন্দিরের দরজার সামনের চাতালে 

পরের দিন এক ভাবে হাঁটা ভিক্ষের জন্যে গৃহস্থের দরজায় হাজির ওয়া এক বাড়িতে বলল, 'শরীরস্বাস্থ্য তো ভালোই আছে তা ভিক্ষে না করে খেটে খেলেই তো হয়!' তবে সবাই শরীরের উপর চোখ দেয়নি ফলে দুপুর রাতের খাবার জুটে গিয়েছিল হাটচালাতে উত্তরীয় বিছিয়ে রাতে ঘুমিয়েও ছিলেন সকালে উঠে আবার চলা বোধহয় পঞ্চম দিনে কামারপুকুরে পৌঁছে যান প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে পায়ে ব্যথা হয়েছিল, তবে তেল দিয়ে মালিশ করে দেন কোনো ব্রহ্মচারী তারপর জয়রামবাটি হয়ে কলকাতা তবে ফেরার সময় আশ্রম থেকে ভাড়ার টাকা দিয়েছিল। তাতেই ওঁরা দুজন প্রথমে বাস  পরে ট্রেন ধরে বালিতে নামেন সেখান থেকে বেলুড়ের সারদাপীঠে 

কামারপুকুর মিশন


স্বামী শিবময়ানন্দের ৮৬ বছর আগে, ১৮৯০- স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অখণ্ডানন্দ আর দুই গুরুভাই হিমালয় ভ্রমণে গেছেন দরজায় দরজায় ভিক্ষে চাইছেন কিছু কাঠ, কিছুটা আটা আর একটু আগুন কিন্তু তেমন কিছুই জুটছে না তখন উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত একটি প্রবাদ মনে পড়ল - কেড়ে নিতে পারলে গড়োয়ালবাসীদের মতো কোনো দাতা নেই তখন চার গুরুভাই গ্রামের মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেন - আগ লাও লকড়ী লাও শিব থেকে বিবেকানন্দ, অখণ্ডানন্দ হয়ে শিবময়ানন্দ পর্যন্ত এক ধারা বৈভব নয়, বৈরাগ্য হলো সাধ সাধনা



রামকুমার মুখোপাধ্যায়