Monday, June 14, 2021

শিব থেকে শিবময়ানন্দ : বৈরাগ্যই হলো সাধ ও সাধনা

  

লিখেছেন 

রা ম কু মা র   মু খো পা ধ্যা য়

স্বামী শিবময়ানন্দজি

(স্বামী শিবময়ানন্দ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর বিহারের সুপৌলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে বেলুড়মঠে যোগ দেন। রহড়ার বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয় এবং বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়ি, কাশীপুর উদ্যানবাটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের‌ও অধ্যক্ষ ছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের  সারগাছিকাটিহার, কলকাতার সেবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কেন্দ্রের সঙ্গেও নানা সময়ে যুক্ত ছিলেন। পরে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম সহাধ্যক্ষ হন। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে  গত ১১ জুন ২০২১ তাঁর দেহাবসান হয়েছে।)

বিদ্যামন্দিরের ‘বিবেক ভবনে’ দু-বছর কাটিয়ে ‘বিনয় ভবনে’ এসেছি ১৯৭৬ সাল দুর্গাপুজোর মাস তিনেক আগে বোধহয় আমাদের হস্টেল বদল হয়েছিল তারপর দিন গুনতে গুনতে দুর্গাপুজো এসে গেল আর আমরা ব্যাগ বেঁধে যে যার বাড়ি চলে গেলাম এক সময়ে পুজো শেষ পুজোর ছুটিও হুড়মুড়িয়ে কেটে গেল হস্টেলে ফিরলাম তার দু-এক দিনের মধ্যে শুনলাম কলেজের অধ্যক্ষ রণেন মহারাজ (স্বামী শিবময়ানন্দজি) রাতের প্রার্থনার পরে আমাদের কিছু কথা বলবেন  সুপারিনটেনডেন্ট তখন পরেশ মহারাজ আর ইতিহাসের অধ্যাপক গণনাথ মহারাজ হস্টেলে তাঁর সহকারী তাঁরাই কথাটা জানালেন ভাবলাম নিশ্চয় পড়াশোনার কথা ঢাকের শব্দ তখন হালকা কানে বাজছে তার মধ্যে পড়াশোনা ঢুকবে ভেবে অনেকেরই বেজার মুখ কিন্তু মহারাজ এসে বসার পর শুনলাম তিনি তাঁর পুজোর ছুটি কাটানোর গল্প শোনাবেন পরেশ মহারাজ বললেন তিনিই বলার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন

রণেন মহারাজ বললেন বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো হয়ে যাবার পর ভাবলেন কয়েকটা দিন বাইরে কোথাও ঘুরে এলে হয় অন্য একজন মহারাজকে রাজিও করালেন সেই মহারাজের নাম কী ছিল তা আর এতদিন পরে মনে নেই ঠিক হলো কামারপুকুর জয়রামবাটি যাবেন যাওয়া মানে গাড়িভাড়া লাগবে তখন ভাবলেন - 'আমরা তো সাধু, তাই হেঁটেই যেতে পারি' আর মানুষজনের বাড়িতে ভিক্ষে চাইলে পেটের চিন্তাও থাকবে না  সেই মতো কাঁধের ঝোলায় একটা ধুতি পাঞ্জাবি আর একটা উত্তরীয় ভরে বেরিয়ে পড়লেন সে-ঝোলায় ভিক্ষের একটা বড়ো বাটিও নিলেন তারপর বেলুড় থেকে বালি ছেড়ে একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে ভিক্ষে চেয়েছেন – ‘জননী ভিক্ষাং দেহি’ কপাল খারাপ হলে যা হয়! জননীর পরিবর্তে সে বাড়ির ছেলেটি বেরিয়ে এসেছে এসে দেখে কলেজের প্রিন্সিপাল দরজায় ভিক্ষে চাইছেন সে খানিক থতমত খেয়ে তারপর সোচ্চারে বাড়ির লোকজনদের ডাকাডাকি শুরু করে তখন 'ভিক্ষে চাই না, ছেড়ে দে বাবা' অবস্থা তাকে কোনো রকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়া

 

বিদ্যামন্দির

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর কোনো এক বাড়ি থেকে কিছুটা মুড়ি বা চিঁড়ে মিলল সেটা একটা গাছের তলায় বসে খেয়ে আবার হাঁটা দুপুরের সময় পুকুরে চান সেরে কাপড় শুকিয়ে আবার খাবারের জন্যে ভিক্ষে প্রথম বাড়িতে চাল নিয়ে একটি বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে এলো কিন্তু তা ফোটাবার জন্য যে হাঁড়ি নেই, তাই শুধু ভাত-তরকারি নেওয়া সে-ছেলেটি এই খবর শুধু বাড়িতে দিল না, পাশাপাশি বাড়িতেও পোঁছে দিল সে-কাজে আরও দু-তিনটে ছেলেকে সঙ্গী পেয়ে গেল ফলে এক দুপুরে ভাত, ডাল, তরকারি যা জুটল তাতে রাতের খাবারের চিন্তাও চলে গেল একটি বাটির খাওয়া দু-ভাগ করে খেয়ে অন্যটা রাতের জন্যে তুলে রাখা হলো একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা 

বিকেলের দিকে রাস্তার গাঁয়ের একটা ডাঙায় কিছু ছেলে ভলিবল খেলছিল তারা চেঁচিয়ে বলল, ' সাধুবাবারা, খেলবে নাকি ?' দুজনকেই ভালো ভলিবল খেলতেন রণেন মহারাজ অঙ্কের মানুষ বলে হিসেব করে অনেক সময় ফাঁকা জায়গায় বল ফেলতে পারতেন তা ওঁরা দুজন ধুতি অর্ধেক গুটিয়ে নেমে পড়লেন দু-চারবার বলে হাত ছোঁয়াবার পর ছেলেগুলি রীতিমত অবাক ভক্তিও বেড়ে গেল তবে সাধুবাবাদের খেলার নিয়মিত অভ্যেস নাকি যোগবল ভেবেছিল কে জানে! তারপর রাত কেটেছিল একটি শিবমন্দিরের দরজার সামনের চাতালে 

পরের দিন এক ভাবে হাঁটা ভিক্ষের জন্যে গৃহস্থের দরজায় হাজির ওয়া এক বাড়িতে বলল, 'শরীরস্বাস্থ্য তো ভালোই আছে তা ভিক্ষে না করে খেটে খেলেই তো হয়!' তবে সবাই শরীরের উপর চোখ দেয়নি ফলে দুপুর রাতের খাবার জুটে গিয়েছিল হাটচালাতে উত্তরীয় বিছিয়ে রাতে ঘুমিয়েও ছিলেন সকালে উঠে আবার চলা বোধহয় পঞ্চম দিনে কামারপুকুরে পৌঁছে যান প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে পায়ে ব্যথা হয়েছিল, তবে তেল দিয়ে মালিশ করে দেন কোনো ব্রহ্মচারী তারপর জয়রামবাটি হয়ে কলকাতা তবে ফেরার সময় আশ্রম থেকে ভাড়ার টাকা দিয়েছিল। তাতেই ওঁরা দুজন প্রথমে বাস  পরে ট্রেন ধরে বালিতে নামেন সেখান থেকে বেলুড়ের সারদাপীঠে 

কামারপুকুর মিশন


স্বামী শিবময়ানন্দের ৮৬ বছর আগে, ১৮৯০- স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অখণ্ডানন্দ আর দুই গুরুভাই হিমালয় ভ্রমণে গেছেন দরজায় দরজায় ভিক্ষে চাইছেন কিছু কাঠ, কিছুটা আটা আর একটু আগুন কিন্তু তেমন কিছুই জুটছে না তখন উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত একটি প্রবাদ মনে পড়ল - কেড়ে নিতে পারলে গড়োয়ালবাসীদের মতো কোনো দাতা নেই তখন চার গুরুভাই গ্রামের মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেন - আগ লাও লকড়ী লাও শিব থেকে বিবেকানন্দ, অখণ্ডানন্দ হয়ে শিবময়ানন্দ পর্যন্ত এক ধারা বৈভব নয়, বৈরাগ্য হলো সাধ সাধনা



রামকুমার মুখোপাধ্যায়

1 comment:

  1. খুব হৃদয়গ্রাহী লেখা

    ReplyDelete

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.