লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
‘বর্ণপরিচয়’ কার লেখা? উত্তর আমাদের সকলের জানা, কিন্তু বইবাজারে বা বইয়ের ছোট দোকানে চোখ রাখলে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার উপক্রম। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, বাংলা প্রাইমারের এক মাইলফলক। এই বইকে সঙ্গী করে আজ দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে চলছে বাঙালির বর্ণশিক্ষা। এই দেড়শো বছরে ‘বর্ণপরিচয়’-এর বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে অন্যান্য প্রাইমার লেখক শুরুতে ‘বর্ণপরিচয়’ নামে বই লিখলেও তার আগে জুড়ে দিতেন - সহজ, সরল, সুবোধ, সচিত্র, নব, নতুন, প্রথম প্রভৃতি বিশেষণ। কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়’ -এর প্রভাব বা তার অনুকরণে প্রকাশিত প্রাইমারের মাঝে ঘটল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা, প্রকাশিত হল নকল ‘বর্ণপরিচয়’। বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থের হুবহু কপি বেরিয়ে পড়ল। এই নকলনবিশির সূচনা বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই।
খানিকটা সময়ের দাবি মেনেই তিনি অক্ষর বিন্যাসে, সংশ্লিষ্ট অক্ষর যোগে ছবি ও অন্য শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটালেন। বিদ্যাসাগর কৃত সারিবদ্ধ অ আ ক খ নবপরিচয়ে হল অ-অজগর, আ-আনারস, ক-কোকিল, খ-খরগোস - প্রতিটি শব্দের সাদাকালো সচিত্র পরিচয়। বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালে অন্যান্য সচিত্র প্রাইমার গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘বর্ণপরিচয়’-কে চিত্রভূষিত করেননি। সেটা করলেন নারায়ণ। শুধু তাই নয়, বর্ণযোজনার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’-এ যেসব বানান নির্দিষ্ট করেছিলেন, নারায়ণ বানান তালিকা থেকে সেগুলি যথেচ্ছ খারিজ করলেন, নতুন বানানের অনুপ্রবেশ ঘটালেন, বদল আনলেন বাক্যবন্ধেও। নমুনা হিসেবে সবচেয়ে যেটি উল্লেখযোগ্য সেটি হল ‘গোপাল-রাখাল’ পাঠ বদল। খুব বেশিদিন অবশ্য নারায়ণ তাঁর দখলে ‘বর্ণপরিচয়’-এর স্বত্বাধিকার রাখতে পারলেন না। কারণ বিদ্যাসাগরের উইল অনুযায়ী বহু ব্যক্তি বৃত্তি পেতেন। নারায়ণ তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই বৃত্তিভোগীরা এবার আদালতের দ্বারস্থ হলেন।
ঋণ - সংবর্তক বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা |
আদালতের নির্দেশ এল, বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি বন্ধক রেখে, বৃত্তির টাকা মিটিয়ে দিতে হবে। বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি হিসাবে বন্ধক রাখা হল তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িটি এবং তাঁর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’ সহ অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকগুলি। এইভাবে কিছুদিন বৃত্তিভোগীরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ পেলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একদিন যখন বন্ধক রাখা সম্পত্তি ছাড়ানোর মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেল, তখন পাঠ্যপুস্তকগুলির স্বত্ব বিক্রির জন্য ডাকা হল নিলাম। সেখানে সর্বোচ্চ দর দিয়ে বইগুলির স্বত্ব অধিকার করেন আশুতোষ দেব, যিনি এ টি দেব নামে অধিক পরিচিত। ততদিনে বিদ্যাসাগর পুত্র নারায়ণ বিদ্যারত্ন-কৃত ‘বর্ণপরিচয়’ সর্বসাধারণের মান্যতা লাভ করেছে, ফলে ‘বর্ণপরিচয়’-এর রিসিভার সংস্করণ এবং পরবর্তীকালে এ টি দেবের তত্ত্বাবধানে, দেব সাহিত্য কুটির প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত ‘বর্ণপরিচয়’ আসলে যতখানি না বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, তার চেয়ে বেশি নারায়ণ বিদ্যারত্নের ‘বর্ণপরিচয়’।
মনে রাখতে হবে, ওই পরিবর্তিত ‘বর্ণপরিচয়’-ই আজকের প্রচলিত বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। অন্যদিকে গ্রন্থস্বত্বের নিয়ম অনুযায়ী এ টি দেবের স্বত্বাধিকারের মেয়াদ ফুরোলে যে কোনো প্রকাশন সংস্থাই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশের যথেচ্ছ স্বাধীনতা পেয়ে যান। প্রকাশিত হয় ‘বর্ণপরিচয়’-এর নির্মল সংস্করণ, নন্দন সংস্করণ, সংসদ সংস্করণ। এছাড়াও নানা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে ‘বর্ণপরিচয়’। প্রকাশনা সংস্থার রুচি অনুযায়ী সেগুলি সেজে উঠছে, আধুনিক বানান-বিধির দোহাই দিয়ে পুরনো বানানে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আমদানি করা হচ্ছে নতুন বানান। পাঠ শেষে সংযোজিত হয়েছে প্রশ্ন ও অনুশীলনী। নারায়ণ বিদ্যারত্নের সময়ের সাদা কালো ছবির বদলে এখন রঙিন ছবির ছড়াছড়ি। অ-অজগর থেকে শুরু করে ‘গোপাল-রাখাল’ এবং দ্বিতীয় ভাগের ভুবন ও তার কুখ্যাত মাসি -সবই এখন রঙিন, চটকদার।
পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় জাল ‘বর্ণপরিচয়’-এর সন্ধান দিয়েছিল যে ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা, সেই জাল এখন আরও বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকাকালীন যদি জুয়াচোরেরা তাঁর গ্রন্থের হুবহু কপি করে, তাঁর নাম ও ছবি ব্যবহার করে লোক ঠকাতে পারে, তাহলে আজকের দিনে সেই চৌর্যবৃত্তির রমরমা হওয়াই স্বাভাবিক। ‘বর্ণপরিচয়’ আজ অভিভাবকহীন, স্বত্বহীন। তাই জাল গ্রন্থের অসাধু ব্যবসায়ীরা দিব্য বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-কে অবিকল নিজের নামে বা একটু-আধটু নিয়মরক্ষার হেরফের ঘটিয়ে ঢালাও ব্যবসা করে চলেছেন। বাংলা বই বাজারের নিয়মকানুন তাঁদের ছোঁয় না বা ছুঁতে পারে না। গ্রন্থস্বত্বের মেয়াদ শেষ হলে কোনো লেখকের লেখা যে-কোনো প্রকাশক ছাপাতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কি কেউ সে লেখা নিজের নামে ছাপাতে পারেন? ছাপাখানার নিয়ম যাই হোক, এটি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা বোধ করি কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না। এই জাল ‘বর্ণপরিচয়’ লেখকরা মদনমোহন তর্কলঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থের প্রথম ভাগের ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতাটি (পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল) দিব্য ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও ‘শিশুশিক্ষা’ গ্রন্থের অসংখ্য বাক্য ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থে ঢুকে আছে। আজ গ্রামেগঞ্জে-মফঃস্বলে এই জাল ‘বর্ণপরিচয়’-এর রমরমা।
বিশেষত গ্রামেগঞ্জে মুদির দোকানে যে ‘বর্ণপরিচয়’ মেলে, সে-সবের প্রায় সম্পূর্ণটাই জাল ‘বর্ণপরিচয়’। এই জাল বইগুলিতে যথারীতি বড় হরফে লেখা থাকে, ‘বর্ণপরিচয় - প্রথম ভাগ/দ্বিতীয় ভাগ’, তলায় বড় হরফে লেখা থাকে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’। এরপর ছোট হরফে লেখা থাকে ‘মহাশয়ের পন্থানুসারে’। শেষে লেখকের নাম, সেই নাম আজ আর ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা যেমনটা লিখেছিল, ‘জুয়াচোর লেখকদের নাম অণুবীক্ষণের তলায় ফেলিয়া দেখিতে হয়’, তেমনটা নয়, যথেষ্ট বড় হরফে লেখা। আজকের জুয়াচোরেরা অকুতোভয়, বিদ্যাসাগরের নামের সমান মাপের হরফে তাঁদের নাম। মলাটপাতায় ছাপাখানার ঠিকানা, দাম দশ টাকা। আর অতি অবশ্যই গোলাপি মলাটের মাঝখানে বিদ্যাসাগরের সাবেকি ছবিটি। শুধু ‘বর্ণপরিচয়’ নয়, ‘বর্ণবোধ’, ‘ধারাপাত’-সহ বাংলা বানানের নানা বই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর মুখোশে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। সেই সব বইও গোলাপি মলাটের, বিদ্যাসাগরের ছবিযুক্ত।
বিদ্যাসাগরের নাম ভাঁড়িয়ে, ‘বর্ণপরিচয়’ জালগ্রন্থে আজ
শিশুপাঠ্যের বাজার ছেয়ে গেছে। কালোত্তীর্ণ একটি শিশুশিক্ষার গ্রন্থ
, যার রচয়িতা বাংলা ভাষা ও
শিক্ষার বিস্তারে তথা বাঙালির শিক্ষারম্ভের এক মহান ব্যক্তিত্ব,
তাঁর নিকৃষ্ট নকল বা তাঁর চিত্র ও স্বাক্ষর দেখিয়ে লোক ঠকানোর এই অসাধু ব্যবসা
কি চলতেই থাকবে? যে-বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যাসাগরের
মৃত্যু ও
জন্মবার্ষিকীতে নিয়ম করে সংবাদপত্রে ও
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় শ্রদ্ধার্ঘ্য উগরে দিয়ে থাকে, তাঁরা কী এ-ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন? জবাব মেলে না।
শোভনলাল চক্রবর্তী