Wednesday, July 29, 2020

সৌমাল্য মুখোপাধ্যায়ের গদ্য

হয়তো রূপকথা নয় কিংবা একটি ব্যক্তিগত গদ্য 


হুঁশ ফিরতে টের পেলাম চারপাশের আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে গেছে। এখন ভরা বর্ষা। দুপুরে প্রচণ্ড বাজ পড়ছিল, সাথে আকাশভাঙা বৃষ্টিতে চারপাশ জলে জলময়। তারপরের কথা কিছু মনে পড়ছে না। কিন্তু এখন চারপাশের বাতাসটা বেশ শুকনো, একটা হালকা ঠাণ্ডার আমেজ ও আছে। আমের মুকুলের গন্ধ বাতাসে পাক খাচ্ছে। আর আমি যেখানটা বসে রয়েছি, সেটা একটা স্টেশনের খোলা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চ। আবছা আলোয় বোর্ডে শুধু  পুর শব্দটাই পড়া যাচ্ছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে একটা নীল-সাদা ফ্লাইওভার ও দেখতে পাচ্ছি। তবে কি সোদপুর ?  উঁহু, প্ল্যাটফর্মে কোনো দোকানের চিহ্ন ও নেই। বোলপুর ? তাও না। বোলপুরে কস্মিনকালেও ওরকম লালরঙা ইঁটের পিলারের ওপর মাথাঢাকা শেড নেই। তবে বোধহয় ব্যারাকপুর। নাঃ, কোনো হনুমান মন্দির তো দেখা যাচ্ছে না! এ কোথায় এসে পড়লাম !

 

একপাশে একটা অদ্ভুতদর্শন ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনটার কোনো ইঞ্জিন নেই, সামনে বা গায়ে কিছু লেখাও নেই। ডিজাইনটাও অদ্ভুত! গায়ে অজস্র সাদা ছোট ছোট বল আঁকা। না ভুল বলছি, ঠিক বল না। বলগুলোর গায়ে কেমন যেন কাঁটা কাঁটা। ধুতরোর ফল যেমনটা হয়। ভেতরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। কতগুলো লোক বসে, তারা মুখোশ পরে আছে, কেউ বা আবছা আলোয়, কেউ সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

 

কৌতূহল চাপতে না পেরে ট্রেনটায় পা দিতেই আমাকে অবাক করে ট্রেনটা রীতিমত জোরে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু খোলা জানলা দিয়ে আবছা আলোয় এ সব কী দেখছি ? ট্রেন ছুটছে, অথচ পাশের প্ল্যাটফর্মের সীমানাটা তো শেষ হবার নামই নেই। তাছাড়া এইরকম জোরে ট্রেন চললে পাশের সব ধোঁয়ার মত দেখার কথা। অথচ স্পষ্ট দেখছি প্ল্যাটফর্মটায় এখন একটা বিয়েবাড়ির বুফে চলছে, আর আমি আর দান্তে সেখানে বসে চিজ বেবিকর্ণ বল খাচ্ছি। হঠাৎ করেই সেই নেমন্তন্নের মাঝে একজন কাতর ভাবে বলে উঠলেন, চা আমরা খাব না ? আমরা খাব না চা ?” উত্তর দেব কি দেব না ভাবতে ভাবতেই আরেকজন যেন আমাকেই উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, আমরা এখানে চা খেতে এসেছি, আড্ডা মারতে না। চা খাওয়া হয়ে গেছে, চলে যাচ্ছি। কথাটা শেষ হল কি হল না, একদল লোক কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে লাগল, একদল মোমবাতি জ্বালিয়ে  গো করোনা গো  স্লোগান দিতে শুরু করল। কারো কারো হাতে আবার ফুলঝুরি, রংমশাল ও ! কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ঘুরে সহযাত্রীদের দিকে ঘুরে তাকালাম, তাঁদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে। আবার ঝটকা ! একজন ও নেই ! বদলে গোটা ট্রেনটার দেওয়াল জুড়ে ইরফান খান  আর চুনী গোস্বামীর ছবি, তলায় বড় বড় করে  লেখা “ Rest in peace”! কী হচ্ছে এসব !

 

হঠাৎ বাইরে তুমুল শব্দ। আবার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ গেল প্রবল ঝড় উঠেছে। বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ছে। ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ হচ্ছে। লোকজন আর্তনাদ করছে। কাঁদছে। জলের জন্য হাহাকার চলছে। অথচ এই ট্রেনটা কিন্তু সেই একই গতিতে ছুটছে তো ছুটছে। আমি ভেবেই চলেছি এ গাড়ি থেকে নামব কী করে। বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তারপর একসময় টের পেলাম প্রথমদিককার সেই মনোরম ঠাণ্ডা আর নেই, বদলে বেশ ভ্যাপসা গরমে দরদর করে ঘামছি। সেই প্রবল ঝড়ও শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের পাশে ও আবার কী !

 

একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। আমার খুব খুব চেনা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ওলা ক্যাব ওলার ভেতরে ওটা সৌরভদা না ? আর সৌরভদার পাশে মারাত্মক টেন্সড মুখে যে ছেলেটা বসে, তার মুখটাও (যদিও এখন মাস্কে ঢাকা) আমার খুব চেনা ! ওরা দুজন ট্রেনের পাশে পাশে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে, একসময় থামল সেই ফ্ল্যাটটা এখন প্ল্যাটফর্মের পাশ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, বদলে একটা হলুদ-গোলাপী রং করা বাড়ি, ওপরে লেখা ডিপার্টমেন্ট অফ স্ট্যাটিসটিক্স, শিক্ষাভবন বিশ্বভারতী। আচমকা পেছন থেকে কান্নার শব্দ, এতজন সহযাত্রী কোত্থেকে এল ?  ওরা কাঁদছে কেন ? এ কী ! ট্রেনের মেঝেতে একটা চাদর চাপা মৃতদেহ ! দমকা হাওয়ায় মুখের চাদরটা উড়ে গেল, মুখটা যেন সুশান্ত সিং রাজপুতের মত ! না না, ওটা তো অর্পণ, কিছুদিন আগে অফিসের কর্মী ছাঁটাইয়ের নীতিতে যার চাকরিটা চলে গেছে। উঁহু, এ তো 78/1 বাসের কন্ডাকটর সুবীরদা, যে সেদিনই কথায় কথায় বলছিল, ছেলেটাকে বোধহয় আর স্কুলে পড়াতে পারব না, বুঝলে। স্মার্টফোন না হলে ক্লাস করতেই পারছে না বেচারা। কোথায় পাই বলো তো ! কান্নার আওয়াজ টা ক্রমশ বেড়ে আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার।

 

ঠিক তখনই বাইরে প্রবল গোলাবারুদের আওয়াজ, একদল ভারতীয় ইউনিফর্ম পরা সৈন্যবাহিনীর সাথে ধুন্ধুমার বেঁধেছে একদল চিনা সৈন্যের। প্ল্যাটফর্মটা রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এখন। আচমকা একটা চশমাপরা লোক এসে গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিল, তোমরা এখন যুদ্ধ থামাও, বিগ বি হসপিটালাইজড, আমরা এখন বিগ বি কে নিয়ে খবর করব ভাই। কথাটা শেষ হল কি হল না, চতুর্দিক থেকে রব উঠল, তরতাজা শুভ্রজিৎটা চলে গেল অকালে, কারোর কোনো হেলদোল নেই, বিগ বি কে নিয়ে নাটক হচ্ছে!

 

শুভ্রজিৎ নামটা কানে আসতেই ছিলেছেঁড়া ধনুকের মত উঠে দাঁড়ালাম। আমার সেই প্রিয় ছাত্রটার কী হল ? ওকে দেখতে কি আর পাব না ? এই মারণ ট্রেন থেকে আমাকে যে করে হোক নামতেই হবে। চেন কোথায় ? পেছন থেকে কে যেন খ্যাকখ্যাকে হাসির সাথে বলে উঠল, অত সহজে এই ট্রেন থামবে না বস! কর্ণপাত না করে দরজার কাছে ছুটলাম। এখন বাইরের প্ল্যাটফর্মে আবার অনেকগুলো আবছা মুখ, আমাকে ডাকছে। সেই মুখগুলোর ভিড়ে আমি খুঁজতে চেষ্টা করলাম আত্মীয়স্বজনদের, ছাত্রছাত্রীদের, ফেসবুক গ্রুপের বন্ধুদের। সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে! শেষ শক্তি সঞ্চয় করে মারলাম লাফ। আস্তে আস্তে চোখের ওপর কালো পর্দা নেমে এল

 

ছোট্ট ঘরটায় ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। নিকষ কালো আঁধার চারদিকে। সিলিং ফ্যানের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল। আমি তো এখন শান্তিনিকেতনে আছি, কবে সবার মাঝে ফিরতে পারব তা অনিশ্চিত। মনে পড়ল রাতে খবরে দেখেছিলাম দেশজুড়ে পরিস্থিতি ক্রমশ আয়ত্তের বাইরে যাচ্ছে। চোখে ঘুম নেমে আসার আগে শেষ এটাই মনে হচ্ছিল, আমরাই কি কাল থাকব ? ভাবতে ভাবতেই ভেন্টিলেটারটার দিকে চোখ গেল। ঘরের আঁধারের মাঝেও ভোরের প্রথম আলোর রেখা এসে পড়ছে ওখান দিয়ে। অনেকটা উঁচু, চেয়ারে উঠে দাঁড়ালেও ওই আলোর উৎসের কাছে পৌঁছোতে পারব কি?