লিখেছেন
শো ভ ন লা ল চ ক্র ব র্তী
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে নট, নাট্যকার উৎপল দত্ত বলতেন, "আমি শিল্পী নই, আমি মনে করি আমি প্রোপাগানডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।" প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর প্রোপাগান্ডার বিষয়। আর ছিল মানুষকে ক্রুদ্ধ করে তোলা। তিনি জানতেন গণআন্দোলনের পথে নামলেই প্রকাশ পাবে সেই ক্রোধ ও সংগ্রামের মুষ্টিবদ্ধ প্রয়াস। বিশ শতকের প্রথম দশকে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকল অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের চেনা ছক, অভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক অবস্থা এবং তৎসম্পর্কিত আচার আচরণ।
চল্লিশের দশকে তা আরও পরিণতি পেল। এই বিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যে উৎপল দত্তের নাট্যচেতনা পুষ্ট হয়েছিল। এরপর পঞ্চাশের দশকের সুচিন্তিত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং শৈল্পিক অনুভূতি নিয়ে তিনি বাংলা নাটক, থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র সম্বলিত সংস্কৃতির জগতে পা রাখলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের গণবিপ্লবের কাহিনীই হয়ে উঠেছিল তাঁর নাটকের উপজীব্য বিষয়। চার দেওয়ালের মধ্যে ঘেরা মধ্যবিত্ত নিস্তরঙ্গ জীবন নয়, তিনি চাইতেন ব্যাপ্ত প্রেক্ষাপট। তাই ইতিহাস থেকে নির্বাচন করতেন চরিত্রদের, তারা যোদ্ধা হোক বা শ্রমিক, নাট্যকর্মী বা সাধারণ মানুষ, শর্ত একটাই দেশ ও কালের মানচিত্রে অবদান আছে কিনা। তাই পৃথিবীর তাবৎ প্রতিবাদী চরিত্র তাদের কাহিনী নিয়ে ভিড় করেছে উৎপল দত্তের নাটকে। শেক্সপিয়র থেকে ব্রেখট, গান্ধী থেকে লেনিন, তার পাশে অবলীলায় এসে দাঁড়ায় চিৎপুরের মেথর কিংবা তিতুমীর।
১৮৭২-এ ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৮৭৬-এর নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন বলবৎ হওয়া - বাংলা থিয়েটারের এক গুরুত্বপূর্ণ ও দমনপীড়নের ঘটনাবহুল অধ্যায়। নাট্যকার উৎপল দত্ত সেই সময়কে উনিশ শতকের থিয়েটার জগতের প্রেক্ষাপটে এক বাস্তবোত্তর সত্যে প্রতিষ্ঠা করলেন "টিনের তলোয়ার" নাটকে। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সেইসব অগণিত নাট্যকর্মীকে যাঁরা বহুস্তরীয়, বহুকৌণিক বাধা অতিক্রম করে নানা প্রতিবন্ধকতাকে শিরোধার্য করে বাংলা নাট্যচর্চাকে অব্যাহত রেখেছিলেন এবং অনাগত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর করিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এই নাটকে ছিল বহুমাত্রিক স্তর - শিল্পের সত্য, জীবনের সত্য, রাজনীতি, ইতিহাস ও সর্বোপরি থিয়েটার। কাপ্তানবাবু বেণীমাধব চাটুজ্জে, দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার গ্যারিক (সৌজন্যে দি ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা), মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের সঙ্গে আপোষ করে থিয়েটার চর্চা করছিলেন।
নব্যবঙ্গ প্রিয়নাথ মল্লিকের সংস্পর্শে এসে সেই আপোষ উত্তীর্ণ হয় প্রতিবাদে। বেণীমাধব হয়ে ওঠেন উপেন দাস, অর্ধেন্দু মুস্তাফি, গিরিশ ঘোষের সমন্বিত প্রতিবাদী চরিত্র। ময়নার মধ্যে প্রতিফলিত হয় গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনীর জীবন, আর বেঙ্গল অপেরা হয়ে ওঠে বেঙ্গল থিয়েটার ও গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের সম্মিলিত রূপ। উৎপল দত্ত পরম যত্নে উন্মোচিত করেছেন শতবর্ষ আগের সেই ঘটনাবহুল অধ্যায়ের বহুবিচিত্র গতিপথ। নাটকের শুরুতে যে মেথর নর্দমার ম্যানহোলের ভিতর থেকে উঠে এসে উঁচু গলায় ঘোষণা করে, "আমি কলকেতার তলায় থাকি", সেইই "ময়ূরবাহন" নাটকের পোস্টার দেখে প্রশ্ন করে , "এত নেকাপড়া করে টিনের তলোয়ার নিয়ে ছেলেমানুষি কর কেন?" নাটকের শেষে এই টিনের তলোয়ারই হয়ে ওঠে বিদ্রোহের প্রতীক।
উৎপল দত্তের শ্রদ্ধা তাঁদের প্রতি "যাঁহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয় বেদনাকে দিয়াছিলেন বিদ্রোহী মূর্তি।" কিন্তু এই শ্রদ্ধা তো থিয়েটারের প্রতি, শিল্পের প্রতি। মার্কসীয় জীবনদর্শনে বিশ্বাসী প্রপাগানডিস্ট উৎপল দত্ত কোথায় টিনের তলোয়ার নাটকে? এই নাটকের পাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে উনিশ শতকের শেষার্ধের বাংলা নাট্যশালার ইতিহাস।কিন্তু উৎপল দত্ত সেই সব ঘটনার সমান্তরালে প্রকাশ করেছেন সেকালের সমাজ। নাটকের যবনিকা সরে গেলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৮৩৬-এর মোকাম কলকাতা এবং চিৎপুর, বউবাজার সহ শোভাবাজার নাট্যশালা। নিখুঁত চিত্রে পরিবেশিত হয় পথঘাট, মানুষ, পরিবেশ ও সংস্কৃতি। এছাড়া রয়েছে বাবুবিলাসের চিত্র, রক্ষিতা, উপপত্নী, আমেরিকান মদ 'আনিস', ব্রুহাম জুড়ি গাড়ি, নৌকাবিলাস, চতুরদোলা শরবত, বুলবুলির লড়াই, কুকুরের বিয়ে ইত্যাদি।
অন্যদিকে কলকাতার সং, ফেরিওয়ালার ডাক, রোঁদে চৌকিদার, গড়গড়া, বার্ডস আই সিগারেট - এ যেন হুতোমি কলকেতার নিপুণ চিত্র। এর পাশেই রয়েছে দুর্ভিক্ষ, চাল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য দাঙ্গা, ছিন্নমূল মানুষের ভিড়, ভিখিরির চিৎকার। উনিশ শতকের কলকাতা, প্রিয়নাথের জবানিতে "এদিকে হাহাকার, ঐদিকে বুলবুলির লড়াই। ইহা এক প্রহসন।" এখন প্রশ্ন হচ্ছে নাট্যচর্চা, নাট্যজগৎ, নাট্যশিল্পীদের প্রতিবাদ, ত্যাগ এসবের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে গিয়ে সত্যিই কি দরকার ছিল কলকাতার 'প্রহসন'-কে জানানো? এর উত্তর দিয়েছেন স্বয়ং নাট্যকার। তিনি লিখেছেন, "বহুদিন পর্যন্ত কলকাতার নাট্যচর্চা রাজা রাজড়াদের দাক্ষিন্য নির্ভর ছিল। মাইকেলের "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ" এবং "একেই কি বলে সভ্যতা" রাজারা হুকুম দিয়ে লেখালেন অথচ অভিনয় করতে দিলেন না। সেই কারণে মাইকেল বেঙ্গল থিয়েটারের পরিষদ সদস্য হয়ে আপ্রাণ খেটেছিলেন স্বাধীন পেশাদার থিয়েটার প্রতিষ্ঠার জন্য। গিরিশ এবং অর্ধেন্দুকে বারবার পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা প্রতারিত হতে দেখে তিনি স্থির করেছিলেন থিয়েটারকে বড়লোকদের ইচ্ছা নির্ভরতা থেকে মুক্ত না করতে পারলে কিছুই হবে না।"
(টুওয়ার্ডস আ রেভুলিউশিনারী থিয়েটার) বাংলা নাটকের ইতিহাস বলছে যে ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে ওই বড়লোকরা থিয়েটারকে জনতার টাকার ওপর দাঁড় করাবেন বলেই তৈরি হল বাংলা নাটক। এটা ওঁরা শিখেছিলেন ইয়োরোপের কাছে। তাঁদের কাছে বাইজি নাচের মত থিয়েটারও বিনোদনের উপকরণমাত্র। এরপর নব্যশিক্ষিত রাজাদের হাতে পরে থিয়েটার চলে যায় বিত্তবান রাজা ও জমিদারদের উঠোনে। এরই মধ্যে চলতে থাকে নাট্যকর্মীদের, শিল্পীদের সংগ্রাম। তাই টিনের তলোয়ার নাটকে প্রয়োজন ছিল মোকাম কলকাতার আর্থ সামাজিকতার পূর্ন বিবরণ। এই নাটক তাই নিদারুণ যন্ত্রনায় একজন নাট্যশিল্পীর আত্মবিক্রিত হতে হতেও উত্তরণের মুহূর্তকে মহতী করে তোলে। নাট্যশিল্পীদের সংগ্রামের মধ্যে উৎপল দত্ত তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রীয় দমন নীতি, শ্রেণী বৈষম্য এবং উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের বৈষম্যের বিপরীতে।
১৯৭১ সালে এই নাটক যখন লিখছেন উৎপল দত্ত তখন কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙ্গন, নকশাল আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নকশাল তকমায় যুবসমাজ আত্মবলিদানে রত, নকশালবাড়ির সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন, এদের দমন করতে শাসক দলের চরম অত্যাচার, প্রভৃতিতে উত্তাল ও উত্তপ্ত সময়। বাংলার মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করতে, স্বার্থকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা জোগাতে তিনি ১০০ বছরের পিছনের ইতিহাস থেকে নির্বাচন করলেন উনিশ শতকের বিত্তবান বাবু ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সাধারণ রঙ্গালয়ের নাট্যকর্মীদের নিরলস সংগ্রামকে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও শৈল্পিক ঐক্য স্থাপনে এই নাটক অনন্য। আর অনন্য ভাষার প্রয়োগে।
নাটকের পাতায় পাতায় এমন সব শব্দ আছে (থুতকুড়ি, বেদেবুড়ি, নড়েভোলা, ফররার,চৈতন ফক্কা, আচাভুয়া) যা আজ হারিয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর যে শব্দ সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন তাতে এই 'আচাভুয়া' শব্দটি পাওয়া যায়। ভারতচন্দ্রও ব্যবহার করেছিলেন এই সব শব্দ। আগাগোড়া ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত উৎপল দত্ত এই সব শব্দের উদ্ধার করেছিলেন মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর ঘেঁটে। উৎপল দত্ত নিজে জার্মান জানতেন, মূল জার্মান পড়তেন, কিন্তু কখনো ব্রেখট অনুবাদ করেননি। তার কারণ ছিল ব্রেখট-এর নাটকে ব্যবহৃত কথ্য ভাষা, যার অনুবাদ হয় না। সমাজের নিচুতলার এই ভাষা মূলস্রোতের জার্মান সাহিত্যে রয়ে গেল, কিন্তু আমাদের এখানে আমরা তাকে বসিয়ে রাখলাম দরজার বাইরে।
এতে যে দুর্বল হয়ে গেল বাংলা ভাষা, তা আমরা বুঝেও বুঝলাম না তার কারণ কি এই যে বাংলা সাহিত্য পাখা মেলেছে মূলত উচ্চবর্ণের লেখার টেবিল থেকে ? বাংলার বহু আঞ্চলিক ভাষা, জেলার ভাষা কোথায় বাংলার সাহিত্য, নাটকে?
তাই প্রশ্ন ওঠে, যে নিতে পারে না,
সে কি
দিতে পারে?
শোভনলাল চক্রবর্তী |
Well written!
ReplyDeleteখুব ভালো লেখা।
ReplyDelete