Sunday, July 11, 2021

সুকুমারী ভট্টাচার্য : শতবর্ষের আলোকে তাঁর চেতনা আমাদের আলোকিত করুক

   লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী



 ১২ জুলাই সুকুমারী ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষ(১৯২১-২০১৪)। তাঁর কাজ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে হয়ে রয়েছে মাইলফলক। অথচ তিনি মূলস্রোতের ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী সবার কাছেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ব্রাত্য। তাই তাঁর জন্মশতবর্ষ ঘিরে তেমন কোনও তোলপাড় নেই সমাজে। অথচ আজকের সময়ে সুকুমারীর কাজ আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তিনি অক্লান্ত অধ্যবসায়ে প্রাচীন ভারতের সমাজ, পুরান, ইতিহাস, বেদ নিয়ে যে কাজ করেছেন তাতে তাঁকে ওই সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে মেনে নিতে কারুর আপত্তি থাকার কথা নয়।জন্মসূত্রে সুকুমারী ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের উত্তরসূরি। ছোটবেলার এক মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং জন্মস্থান মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় চলে আসেন। প্রাথমিকের পড়াশোনা করেন ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে এবং ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সেন্ট মার্গারেট থেকে। সংস্কৃতে সাম্মানিক নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়তে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। ভর্তি হন ভিক্টোরিয়া কলেজে। খ্রিষ্টান পরিবারের মেয়ে, কিন্তু পড়তে চান সংস্কৃত, তাই কলেজ কতৃপক্ষ তাঁকে তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য ঈশান বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। 

কিন্তু পরবর্তী কালে যিনি লড়াই চালাবেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, নারীপ্রগতির পক্ষে তিনি তো দমার পাত্রী নন। তাই পরিবর্তে জুবিলি স্কলারশিপ নিয়ে বিএ পাস করেন, ১৯৪২-এ, পরে ইংরেজিতে এমএ। ১৯৪৫- এ শিক্ষকতা শুরু করেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। শিক্ষতা করাকালীন প্রাইভেটে সংস্কৃতে এমএ করেন। ১৯৫৭ সালে বুদ্ধদেব বসুর আমন্ত্রণে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। এরপর সুশিলকুমার দে'র আহ্বানে যোগ দেন সংস্কৃত বিভাগে, সেই বিভাগেই ছিলেন অবসর নেওয়া পর্যন্ত। বিয়ে হয়েছিল অধ্যাপক অমল ভট্টাচার্যের সঙ্গে। সুকুমারী ছিলেন বাংলা ও ইংরেজি লেখায় সমান দক্ষ। প্রায় তিরিশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন সুকুমারী, যার মধ্যে কয়েকটি যেমন ফেটালিজম ইন এনশিয়ান্ট ইন্ডিয়া, দ্য ইন্ডিয়ান থিওগনি আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিতি লাভ করে। প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, বিবাহ প্রসঙ্গ, ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য, বাল্মীকির রাম : ফিরে দেখা, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি গ্রন্থ দেশ কালের সময় সীমা অতিক্রম করে। এছাড়াও অনুবাদ করেছিলেন শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক। 

আমৃত্যু আস্থা রেখেছেন বাম রাজনীতিতে এবং প্রাচীন সাহিত্যের সনাতনপন্থী অজুহাত আপত্তির বাইরে গিয়ে খুঁজেছেন নারীর ভাষ্য।রামরাজ্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন, সে এক এমন রাজ্য, যেখানে চন্ডাল বন্ধু হলেও তার অতিথি হওয়া যায় না। উচ্চবর্ণের বালকের প্রাণনাশ হলে তার দায় গিয়ে পরে নিম্নবর্গের  মানুষের তপস্যার উপর। সেই বিশ্বাসেই নিষাদকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সেখানে সম্পুর্ন নির্দোষ নারীকে লোকাপবাদের ভয়ে শুদ্ধির পরীক্ষা দিতে হয়, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই মিথ্যা ছলে বনবাসে যেতে হয়। যজ্ঞসভায় বিস্তর লোকের সামনে বাল্মীকি নারীটির শুচি নিয়ে অঙ্গীকার করলেও কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করে না। রাম যখন লঙ্কায় সীতার প্রতি নিজের মনের অন্তর্গত ভাব প্রকাশ করা শুরু করলেন, তখন তিনি সীতাকে বলেন যে সীতা কুকুরে চাটা ঘিয়ের মত অশুচি। এই রাম রাজ্যে নারী ও নিম্নবর্গের মানুষ যাঁরা প্রজাকুলের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ  তাঁদের জন্য কোনও বিশ্বাস বা ন্যায়বিচার নেই।

এই রাজ্য উচ্চবর্ণের পুরুষের সুখসম্মানের অনুকূলে শাসিত। আজ আমাদের রাষ্ট্রের পরিচালকরাও এমনি রাষ্ট্র প্রতিষ্টায় নিরন্তর সচেষ্ট। এর বিরুদ্ধে সেই কবেই কলম ধরেছিলেন সুকুমারী।আজকের রাষ্ট্র পরিচালকদের হাতের গুরুত্বপূর্ণ তাস সাম্প্রদায়িক জিগির। সাম্প্রদায়িকতা কখনও কোথাওই মানবমঙ্গল সাধনের চেষ্টা করেনি। শুধু সংকীর্ণ গোষ্ঠী অর্থাৎ সম্প্রদায়ের স্বার্থকে রাষ্ট্রক্ষমতায় উত্তীর্ণ করে, বিরুদ্ধ মতবাদীদের দমন, শোষণ ও ধ্বংসই এর চিরকালের অঙ্গীকার ও লক্ষ। অধিকাংশ দেশবাসী এখনও সাম্প্রদায়িকতা সম্বন্ধে সচেতনভাবে কিছু ভাবেননি, কিন্তু ভাবার দিন আগত।দেশের সর্বনাশ রোধ করার উদ্দেশ্যে এই ভাবনা ভাবা দরকার।এই ভাবনার কথা সুকুমারী লিখছেন আজ থেকে দুই দশক আগে। আজ একথা আমরা বিস্মৃত প্রায় যে হিন্দু ধর্ম একটি সংহত ধর্ম নয়, এর কোনও আদি প্রবক্তা নেই, কোনও কেন্দ্রীয় ধর্ম গ্রন্থ নেই এবং কোনও কেন্দ্রীয় ধর্ম সংগঠন নেই। ফলে পরমত সম্পর্কে এর কোনও নির্দিষ্ট মনোভাব নেই। এই ফাঁক দিয়েই ঢুকে পড়ছে পরমত সম্পর্কে প্রতিরোধ আর অসহিষ্ণুতা।জার্মানিতে হিটলার বলেছিলেন এক হাজার বছর টিকবে থার্ড রাইখ, সেই স্বপ্ন দেখিয়ে জার্মান জাতটাকে এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। 

ভারতবর্ষে ধর্মের একটা ভ্রান্ত চিত্র দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রবঞ্চনা চলছে। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্ম মৃত্যুর মুহূর্তে বলে গেলেন, মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নয় । এসব আমাদের আজ ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।দেবত্বের বদলে ধর্মের নামে শেখানো হচ্ছে দানবিকতা, অসহিষ্ণুতা, যা কেবল নিজের শ্রেষ্ঠত্বকেই বিশ্বাস করে, অন্য কাউকে সম্মান করতে পারে না। আমাদের পেছনের দিকে ঠেলে বলা হচ্ছে বৈদিক যুগের বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে শিক্ষাক্রমে। এখন বেদ মানলে যে আমরা পিছিয়ে পড়ব সে কথা কেউ কানে তুলতে রাজি নয়। হিন্দুত্বের সঙ্গে বেদকে এই যে জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস তার যে একেবারেই গোড়ায় গলদ থাকছে সে কথা বারবার তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন সুকুমারী। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন হিন্দুধর্ম আদতে বেদ বিরোধী। বেদের যজ্ঞে মূর্তির, মন্দিরের কোনও স্থান ছিল না। নৈবেদ্য সাজান হত সূরা, গো-মাংস দিয়ে। হিন্দুধর্মের তীর্থ, ব্রত, ধ্যান, জপ এসবের কোনও উল্লেখ বেদে নেই। 

তবে বেদ ও হিন্দুধর্মের যেখানে গলায় গলায় মিল তা হল এর কোনও  শাস্ত্রেই নৈতিকতার কোনও বালাই নেই। অথচ সমাজ এগিয়ে চলে নৈতিকতার নিরিখে। এই দ্বন্দ্ব বিরাজমান হিন্দুত্বের একেবারে কেন্দ্রে। তাই এই দানবদের ধ্বংস অনিবার্য। তবে আমরা আজ সংশয়ের একটা দু'রাস্তায় মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেব আমরা? সে বিচার একান্তই আমাদের । কোন পথ নিলে আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেত পারবো এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার? সেই পথ অনুসারেই তবে আবর্তিত হোক আমাদের সমস্ত আলোচনা, কথাবার্তা,আচরণ। রাজনীতির অবস্থান স্পষ্ট না হলে যে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি তাতে সাফল্য পাওয়া শক্ত। এই পথের আলোকবর্তিকা হতে পারেন সুকুমারী। তাঁর শতবর্ষে আমরা যদি তাঁর রচনার দিকে নজর ফেরাই তবে আমরা পেতে পারি আমাদের ধনুকের জন্য নব নব তীর। সুকুমারীর চেতনা তাঁর জন্মের শতবর্ষে আমাদের স্পর্শ করুক, এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কিছুই হতে পারে না।


শোভনলাল চক্রবর্তী



1 comment:

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.