Tuesday, January 26, 2021

প্রজাতন্ত্রের নামে প্রহসন আর কত দিন?

 লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী



Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay



আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানীর বুকে যে ঘটনা ঘটল, তাকে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বলা যেতেই পারে। প্রজার কথা শাসক শুনবেন, প্রজার মঙ্গলে শাসক কাজ করবেন এটাই দস্তুর হওয়া উচিত। আজ ভারতবর্ষ যা প্রত্যক্ষ করলো তার কিন্তু সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে ভারতের রাজনীতিতে। গণ আন্দোলনকে যদি প্রসারিত না হতে দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে রাষ্ট্র তবে তার কি ফল হয় আমরা তা দেখলাম। ১৯৫৬ সালে যে প্রজাতন্ত্র সংবিধানের শপথ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আজ তা পথভ্রষ্ট।এর কারণ নিহিত আছে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের অন্তরসম্পর্কে।রাজনৈতিক দল কি রাষ্ট্রের পরিপূরক হতে পারে? প্রশ্নটা আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে এসেছিল এরিস্টটলের মাথায়। তাঁর মনে হয়েছিল ক্ষমতাসীন দল সংবিধানের পরিবর্তন ঘটালে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য।প্রকারান্তে এটাই রাষ্ট্র ও দলের অভিজ্ঞতা।আসলে সমকালীন গ্রিসের প্রায় প্রত্যেকটি নগর রাষ্ট্রে ধনিক ও গণতন্ত্রীদের মধ্যেকার তীব্র বিরোধ এরিস্টটল দেখেছিলেন, এবং এও দেখেছিলেন যে গণতন্ত্রীরা ক্ষমতায় এলে তা পাল্টে যায়। সংবিধানের পরিবর্তন সরাসরি প্রভাবিত করে নগর রাষ্ট্রের চরিত্রকে।বর্তমানে অবশ্য আমাদের দেশে সংবিধানের পরিবর্তন না ঘটিয়েও রাষ্ট্র চরিত্র পাল্টে ফেলা যায়।তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দল সমার্থক কিনা, এই প্রশ্ন বর্তমান সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক। আজকে ধারে-ভারে বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধানকে সামনে রেখে, শিরোধার্য করে, আইনের পাকাপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহ যে ভাবে নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাতে স্পষ্টতই সন্দেহ জাগে ভারত রাষ্ট্রে সংবিধান থাকলেও সাংবিধানিকতা আছে তো? ক্ষমতাসীনের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভারত রাষ্ট্রের আদর্শ, পরিচলন পদ্ধতি স্থিরীকৃত হয় বা পাল্টে যায়, তা সে সংবিধানের মুলভাবের সঙ্গে যতই সংঘাতপূর্ণ হোক না কেন। তা যদি না হত তবে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যাথা থাকত না, তা যদি না হত তবে চলতি কথায় গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি তার একেবারে প্রাথমিক শর্ত হিসাবে পৃথক মতের প্রতি সহনশীলতার যে ধারণা রয়েছে, তা নিয়ে গেল গেল রব উঠতো না। বড়ো বড়ো বুলি আওড়ানো সংবিধান, রাষ্ট্রপ্রকৃতির নির্দেশক ও রাষ্ট্রের পরিচালনার মৌলিক নীতি সম্বলিত সংবিধান পড়ে থাকলো এক কোনে, একেবারেই গুরুত্বহীন অবস্থায়।সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাজনৈতিক দল ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। একদিকে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ঢাক পেটাচ্ছি অন্যদিকে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সমস্ত দুর্বলতা আমাদের দেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের বিষয়টা তো প্রাত্যহিক চর্চার বিষয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চিন্তায় ও আচরণে সে চর্চা নেই।বৌদ্ধিক ভাবে ও চেতনায় গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার কোনও বাসনা নেই তাঁদের, সে কারণেই বিরুদ্ধমতকে তাঁরা শ্রদ্ধা দেখাতে পারেন না। ভুল করেও পারেন না। রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহারে প্রতিহিংসাপরায়ণতা চরিতার্থ করা, বিরুদ্ধ স্বর হলেই সর্বাত্মক ভাবে তা দমনের মানসিকতা নিশ্চয়ই ভারতের সংবিধানের মুলভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ আমাদের চারপাশে নিয়মিত ভাবে সেটাই হয়ে চলেছে। স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর না হলেও চলবে এই অসঙ্গতি গুলি দেখতে পাওয়ার জন্য।
 

Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay
পার্টি পলিসি, পার্টি পলিটিক্সই সত্য। তাই রাজনৈতিক দলগুলি এরকমটাই ভেবে অভ্যস্ত যে একবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারলেই শাসন, আইন সবই তার।যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা তার।সে-ই শাসন, সে-ই আইন, সে-ই বিচার। পুলিশ প্রশাসন তখন বোবা, কালা ও অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করে - সাংবিধানিকতা কোমায়(যেমন, উত্তরপ্রদেশের হাতরাস কান্ডে)। আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যার জায়গা এটাই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হলেই গণতান্ত্রিক উপায় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব(যেমন,৩৭০ধারা লোপ)। যেখানে আর্থিকনীতি, শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি এমনকি বিচার বিভাগ - সবখানেই ক্ষমতাসীনের অহং ও আত্মকেন্দ্রিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট। যার মাধ্যমে পোশাক পরিচ্ছদ থেকে খাদ্যাভ্যাস, চিন্তার স্বাধীনতা থেকে মত প্রকাশ (নতুন সংযোজন, লাভ জিহাদ) - সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।অধ্যাপক,সাংবাদিক,লেখক, সরকারি কর্মচারী - সবাইকে সবক শেখানো সম্ভব। তা ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক!সংখ্যা গরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত বলে কথা। আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা ক্রমশই হারাতে হারাতে ভারতীয় জনগণ এতেই খুশি যে সবটাই হচ্ছে আমাদের নামে।ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিকে থাকা অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির নেশা বড্ড মারাত্মক।এর সঙ্গে আছে নামের মোহ। আমি এবং আমিত্ব, সবটা বজায় রাখার জন্য এখনকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অধিকাংশই পোস্ট ট্রুথ সিনড্রোম-এ আক্রান্ত। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাই অসত্য, অর্ধসত্য এবং মিথ্যা, মনগড়া তথ্য হাতে হাতে ঘুরছে।এতে এক ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করাই যাঁদের কাজ, হটাৎ হটাৎ শোনা যায় তাঁরা রাজধর্ম পালন করছেন। নীতির সাথে প্রতিনিয়ত রাজ করা সম্ভব হলে দুম করে রাজধর্ম পালনের কৃতিত্ব দাবি করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তা সম্ভব নয় কারণ, রাজনৈতিক দলগুলির সব গিলে খাওয়ার হাঙ্গরের হাঁ রয়েছে।বিরোধী শূন্য ফাঁকা মাঠ চাই তাঁদের।ভোটের আগে প্রচার করতে না দেওয়া থেকে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ফতোয়া জারি কিংবা ভিটে মাটি ছাড়া করা - এর সবটুকু সংবিধান বিরুদ্ধ হলেও আমাদের দেশের দলতন্ত্র অনুযায়ী তা বৈধ। বৈধ বলেই একজন মানুষ এরকম সময়ে রাষ্ট্রের সাহায্য পান না।এই দলতন্ত্র অনুযায়ী বিরুদ্ধ মতের মানুষদের জন্য বিভিন্ন কমিটি, কমিশন বা এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়াও বৈধ।নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই এখানে মুখ্য। এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, উদারনৈতিক গণতন্ত্র তাত্বিক ভাবে নিজের বৃত্তের বাইরে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ দলতন্ত্র ক্ষমতার স্বার্থে যে কোনও 'বাদ'কে, যে কোনও 'বাদী'কে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে, প্রয়োজন ফুরোলে রাষ্ট্রের যুক্তি দিয়ে তাকে জেলেও পুরতে পারে(কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি)। তাই, দিনের শেষে রাজনৈতিক দলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের সমার্থক। যে ব্যবস্থায় তদন্ত কমিশন থেকে নির্বাচন কমিশন কিংবা মানবাধিকার কমিশন - সবই সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক দলের হরবোলা হিসেবে কাজ করে অভ্যস্থ সেখানে আলাদা কিছু প্রত্যাশা করা যায় কি?আমাদের বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা অর্জনকে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের নিরিখে দেখা হয়।বৈধতার প্রশ্ন এখানে উপেক্ষিত। বৈধতা হল কর্তৃত্বকে মান্যতা দেওয়া। এই বৈধতা সংবিধান ছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উচিত-অনুচিত বোধের প্রেক্ষিতে স্বীকৃতি পায়। তা না হলে সাংবিধানিকতা প্রতিষ্টিত হয় না এবং 'জোর যার মুলুক তার' নীতিতে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র উঁকি দেয়।আজকের ভারত তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেই যে বৈধতার দাবি করা যায় না - এই বোধ এবং শিক্ষা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের নেই, তাঁরা সেটা শিখতেও আগ্রহী নন। সরকারি পদক্ষেপ সঠিক কি না, ন্যায়সঙ্গত কি না এবং তার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার প্রতিটি মানুষের থাকা দরকার(কৃষি বিল নিয়ে কৃষকদের বিক্ষোভ)। তত্ত্বগতভাবে এটাই যে কোনও সরকারের সঠিক নীতি গ্রহণে সাহায্য করে। কিন্তু বাস্তবতা হল ক্যাডারের সংখ্যার আধিক্য এবং আসনগত ভাবে সংখ্যাগরিষ্টতা - এই দুই হল রাজনৈতিক দলের মোক্ষ। তাই কৃষক আন্দোলনকে এখন ঘুর পথে বাগে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসবের ফলে দলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই দল। এটা কিন্তু প্রজাতন্ত্র নয়, সেটা আমরা আর কবে বুঝবো।

Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay


[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]


Thursday, January 21, 2021

রোজা লুক্সেমবার্গ: মানবতার মুখ

  লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী



[নবিংশ ও বিংশ শতকের একটি ছোট পরিসরে ক্লাসিক্যাল মার্কসবাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রোজা লুক্সেমবার্গ, তাঁর ধ্যানধারণার জন্য। তারপর দীর্ঘকাল তাঁর চিন্তাধারা মার্কসবাদের অঙ্গনে ব্রাত্য থাকার পর সমাজতান্ত্রিক বিভিন্ন দেশে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন রোজা। আজকের পৃথিবীতে রোজা-র নব মূল্যায়নের একটি দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের মধ্যে গণতন্ত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রোজা তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিলেন, আর সেই সঙ্গে ছিল তাঁর মানবতাবাদের আদর্শ। জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন কঠোর সমালোচক। দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ আজ যখন বিশ্বের নানান দেশে তার দাঁত, নখ বের করে আমাদের প্রতিদিন আতঙ্কিত করে চলেছে, তখন রোজার চিন্তা ও বক্তব্য নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।


থচ তদানীন্তন মার্ক্সবাদ তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে একটা বিপথগামিতা লক্ষ্য করেছিল এবং প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে না হলেও স্বধর্মত্যাগীদের তাঁর সহাবস্থানকে মোটেই সুনজরে দেখেনি। বলশেভিকদের বিরূপ সমালোচনা ও মেনশেভিকদের মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর সাযুজ্যই রোজা-কে মার্কসীয় মতাদর্শের ধ্বজাধারীদের চক্ষুশূল করেছিল। আন্তর্জাতিক কমিউনিজম-এর ক্ষেত্রে রোজা তাঁর কালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলেন। জাতিতে ইহুদি পোল, তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল জার্মানি। জার্মান শ্রমিকশ্রেণীর একজন তাত্ত্বিক নেত্রী এবং প্রতিবাদী চিন্তক হিসাবেই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (১৮৮৯-১৯১৪) সময়কালে তাঁর নাম জনসমক্ষে উঠে আসে।প্রথমত এসপিডি-তে (জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দল) থাকাকালীনই এডওয়ার্ড বেয়ার্নস্টাইন ও কার্ল কাউটস্কির সঙ্গে তাঁর তাত্ত্বিক বিরোধ বাধে। ১৯০৩-এ বলশেভিক ও মেনশেভিক দু'টি দল আলাদা হয়ে গেলে তিনি দু'টি দলকে এক হওয়ার সুপরামর্শ দেন। এর পর ১৯০৪-এ শ্রমিক শ্রেণির পার্টিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রশ্নে লেনিনের সঙ্গে তাঁর মতাদর্শগত বিরোধ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসপিডি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি ইউএসপিডি (স্বাধীন এসপিডি) দল গড়ে তোলেন। পরে ১৯১৮ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কেপিডি(জার্মানির কমিউনিস্ট দল) বা স্পার্টাকাস দল গড়ে তোলার পর এসপিডি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারে চুকে যায়। সমাজতন্ত্রের প্রচলিত ধারাকে অস্বীকার করে রোজা লেনিনের সঙ্গে যে বিতর্কে নেমেছিলেন, তাতে লেনিনের রায় ছিল, রোজা ভুল পথ নিয়েছেন।১৯১৯-এর জার্মানিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গ্রেপ্তারের ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বার্লিন ছেড়ে পালাতে চাননি। এ বাড়ি ও বাড়ি করে থাকছিলেন। শেষে ১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণপন্থী ফ্রাইকর্পস-এর গার্ড ক্যাভালরির সিকিউরিটি ডিভিশন রোজা এবং কার্ল লিবক্লেখট -কে একসঙ্গে ধরে ফেলে। দুজনকেই হত্যা করে খালের জলে ফেলে দেয় তারা। এইভাবে রোজা অকালে মৃত্যুবরণ করেন। লেনিন ১৯২৪-এ রোজার ভুলগুলি উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন পোল্যান্ডের স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা ভ্রান্ত। ১৯০৩-এ মেনশেভিকদের প্রশংসা করেও তিনি ভুল করেছেন। পুঁজির সঞ্চয় সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা ঠিক নয়, মেনশেভিক ও বলশেভিকদের মিলনের কথা বলেও তিনি ঠিক করেননি। 

কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি রোজাকে প্রশংসা করতেও পিছপা হননি, রোজার অকুতোভয় মনোভাব ও যুক্তির প্রতি অগাধ আস্থার জন্য। লেনিনের পর স্টালিন এলে তিনিও রোজাকে ট্রটস্কির সমমনস্ক স্থির করে তাঁকে বর্জন করেন। লুক্সেমবুর্গিজম নাম দিয়ে রোজাকে তখনও ব্রাত্য করে রাখা হয়। পূর্ব জার্মানিতে একমাত্র সত্তরের দশকে রোজার রচনাসম্ভার প্রকাশের একটা প্রয়াস চালানো হয়। বলা বাহুল্য, পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলি সমাজতান্ত্রিক দেশ ভেঙে যাওয়ার পর, সোভিয়েট রাশিয়ায় ধস নেমে এলে রোজা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাঁকে নিয়ে একাডেমিক চর্চাতেও একটা জোয়ার আসে। এই কাজে সত্তরের দশক থেকেই যিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন, তিনি জাপানের নরিহিতো ইটো। তাঁরই উদ্যোগে জুরিখ-এ ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, 'ইন্টারন্যাশনাল রোজা লুক্সেমবার্গ সোসাইটি'। ইটো সত্তরের দশক থেকেই ভাবছিলেন স্টালিনীয় সমাজতন্ত্রের বোধ থেকে আলাদা করে তিনি মার্কসীয় তত্ত্বের বিকল্প একটি স্বাতন্ত্র্য কীভাবে শনাক্ত করবেন।এই থেকেই রোজার প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগে।রোজাকে নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণ উদ্যমে কাজকর্ম আরম্ভ করে দেওয়ার পর ১৯৮৫-তে গর্বাচেভ -এর সময়কাল থেকে রোজা ক্রমশ আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকেন। তার প্রধান কারন, এই সময় সকলের নজরে পড়ে যে, পুঁজিবাদের সংকট এবং সমাজতন্ত্রের অর্জিত বিষয় খোদ প্রাতিষ্ঠানিক মার্কবাদের অবস্থান থেকেই ক্রমশ প্রশ্নাত্বক হয়ে উঠছে এবং প্রকাশ্যেই তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এই সময় থেকেই বামপন্থীরা বুঝতে শুরু করেন, এতদিন ধরে যে-সমস্ত ধরতাই লম্বা লম্বা বুলি মার্কসবাদকে ঘিরে রেখেছিল, তা সবই শূন্যগর্ভ। যদিও তার মধ্যে অনেক বক্তব্যই ছিল মার্কসবাদের বিকৃতি, যা মার্ক্স কখনও বলেননি, পরবর্তী কালের নেতাদের কল্পনা প্রসূত। সে যাই হোক, এই সময় থেকেই  বামপন্থার একটা পুনর্নির্মানের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকেন রোজা।  রাশিয়ার বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা, বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের পক্ষে তাঁর যুক্তি, আত্মমুখিনতা ও গণ-ধর্মঘটের উপর তাঁর বিশেষ ঝোঁক, নিরঙ্কুশ কেন্দ্রবদ্ধতা এবং দলীয় আমলাতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর বিরূপতা সময়ের কষ্ঠিপাথরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মানুষ অন্যায় ও অসাম্যের বর্বরতার বিরুদ্ধে রোজার অনপনেয় দৃঢ়তা উপলব্ধি করে। সাবেক রাশিয়ার পতন উত্তর পৃথিবীতে মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং রোজার ধারণা সময়োচিত হয়ে ওঠে। আজকের বামপন্থীরাও ভাবছেন রোজা কী কারণে সমাজতন্ত্রের পরিধিতে গণতন্ত্রের ভাবনাকে সসম্মানে স্থান দিয়েছেন, গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি কতখানি বৈপ্লবিক ও মানবতাবাদী। সংসদীয় গণতন্ত্র ও ভোটের পাটিগণিতের পরিধির বাইরে যে বৃহৎ বামপন্থার জগৎ সেখানে আজ রোজা ভীষণ প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে রোজার রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরম্পরা। সমাজতন্ত্রের বিকল্প ছবিটিতে সেখানে একটি মানবতাবাদী কল্যাণকামী মুখও এসে যায়। রোজা এমন সব যোগসূত্র রেখে গেছেন, যার ফলে আমরা আজ বুঝতে পারি দলীয় আমলাতন্ত্রিকতা আসলে কী এবং কীভাবে তা জনগণের উদ্যোগ এবং উদ্যমকে নষ্ট করে। এর ফলে দল থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রোজা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন যে জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হয়ে বা তাদের মঙ্গলের অংশীদার না হয়ে শ্রমিকদলের প্রতিষ্ঠান যদি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলে তা সমাজতন্ত্রের অন্তঃশক্তিকেই অবহেলা করছে। রোজার তত্ত্বের একটা বড় গুণ এই যে, সেই তত্ত্বের মাধ্যমে যেমন রোজার সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তা তৈরি হয় তেমনই রোজার একটি আত্মপ্রকৃতি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সত্যের প্রতি অদম্য আবেগ ও দায়বদ্ধতা তাঁকে বিচারবিরুদ্ধবাদ থেকে দূরে রেখেছিল। কোনও কর্তৃত্বকারী শক্তির কাছে তিনি কখনও মাথা নোয়াননি। মার্ক্স-এর যোগ্য ছাত্রী ছিলেন রোজা, যার জন্য কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করার শক্তি পেয়েছিলেন। মার্কসের শিক্ষার যে নির্যাস , তার সঙ্গে যুক্ত থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোজা সবসময় স্বাধীন চিন্তা ও কঠিন সমালোচনাকে প্রয়োগ করেছেন। 

আবার একই ভাবে মার্কসের মানবতাবাদকেও টেনে এনেছেন তিনি, কারণ মার্কসের কাছে সমাজতন্ত্র যথার্থই মানবতাবাদী, মার্কস বলছেন যে, এখানে আমরা এমন একটা সমাজ পাই 'in which the full and free development of every individual is the ruling principle'(Capital,Vol 1)। রোজার জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে একদিকে যেমন তাঁর হৃদয় ও মেধা জুড়ে সমাজতন্ত্র বিষয়টি একটি স্থায়ী আবেগের বিষয়, তেমনই অন্ত্যজ ও নির্যাতিতদের জন্য তাঁর বুকভরা সহমর্মিতা। তাই তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে এই ধরণের মানুষের প্রতি অপার ভালবাসা কাজ করে। মানুষের হাসিতে, কান্নায় তাঁর চিত্ত ব্যথিত হলেও তিনি কিন্তু সমাজজীবনের সমৃদ্ধির প্রবণতার উপরেই আলোকপাত করেন, শ্রমিকশ্রেণীকে বলেন তাদের অনুদ্ভুত অথচ সম্ভনাময় বৃত্তিশক্তিকে কাজে লাগাতে।বলেন আবেগতাড়িত না হয়ে যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করতে।এর ফলে স্টালিন, মাও, পোলপট প্রভৃতির মানবতাবিরোধী কমিউনিজমে বীতশ্রদ্ধ বামপন্থীদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন রোজা।তাঁদের মনে এক অপার বিস্ময় তৈরি করেন তিনি, যিনি মার্কসীয় চিন্তাধারার মধ্যে আকন্ঠ ডুবে থেকেও সমাজতন্ত্রের ধারাকে গণতন্ত্র ও মানবতাবোধের সঙ্গে একই সুতোয় গেঁথেছিলেন।ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে রোজার প্রাসঙ্গিকতা মৌল মানবতাবাদী চিন্তার ভগীরথ মানবেন্দ্রনাথ রায়(প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য)-এর কাজের প্রেক্ষিতে।এম এন রায় একটা সময়ে স্ট্যালিনের হাতে মার্ক্সবাদের দুর্দশা দেখে প্রতিবাদ করেন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত হন।১৯৪০-স্থাপন করেন রোজার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যার মূলমন্ত্র ছিল যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ। তিনি মনে করেছিলেন বুদ্ধির মুক্তির সপক্ষে ও সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গেলে, তা চালাতে হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে। তিনি যে ভুল ভাবেননি, আজ অনেক পথ ঘুরে আমরা তা টের পাচ্ছি। প্রচলিত বামপন্থার উল্টো পথে একটা দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী, সেই রাস্তার পথিকৃৎ অবশ্যই এম এন রায়ের মানবতাবাদী বামপন্থা।এম এন রায়ের মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর দলে যোগ দিয়েছিলেন আর এক বিদগ্ধ মানবাতিবাদী শিবনারায়ণ রায়, বর্তমান বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। এই দুই রায় ও রায়পন্থীদের মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ কেন্দ্রিক পথ আজকের নয়া দক্ষিণপন্থীদের উদগ্র অনাচারে অসুস্থ ভারতবর্ষকে সুস্থতার পথ দেখাতে পারে।



বিঃদ্রঃ - ছবিগুলি ইন্টারনেটের দৌলতে প্রাপ্ত । ছবির উৎসকে বিববক্ষিতর তরফে কৃতজ্ঞতা । 

[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । এটি ওয়েবজিনে তাঁর প্রথম লেখা । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]