Monday, August 30, 2021

ভ্যাকসিন এখন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’, অতএব সম্বল ‘রাখে হরি মারে কে’

 লিখেছেন 

অ নি ন্দ্য   ভ ট্টা চা র্য


আমেরিকার পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর প্রায় ফাটা রেকর্ড বাজানোর মতো নিত্য আওড়ে গেছেন যে কোভিড১৯ আসলে একটি ‘চীনা ভাইরাস’। অর্থাৎ, চীন থেকেই এর উৎপত্তি, এবং যেহেতু চীনাদের খাবার-দাবারের কোনও মা-বাপ নেই, অতএব, এমনতর ‘নিকৃষ্ট’ মানবজাতির দেহেই এইসব অলুক্ষণে ভাইরাস বাসা বাঁধতে পারে। সেই সঙ্গে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল একটি ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ যে, আসলে কোভিড১৯ ভাইরাসটি চীনের উহান পরীক্ষাগারে তৈরি। বলাই বাহুল্য, ‘শ্বেতাঙ্গ’ জাতির স্বঘোষিত অকলুষতা ও অন্যান্য জাতির প্রতি তাদের এক শ্রেণি মানুষের যে বহমান ঘৃণা- তাকে চাগিয়ে দিতেই এইসব কু-রটনা। তার সঙ্গে ছিল কোভিড মোকাবিলায় ইউরোপ সহ আমেরিকার সার্বিক ব্যর্থতা ও দিশাহীনতা এবং চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-প্রযুক্তিগত দ্বৈরথে তাদের পিছিয়ে পড়া হেতু ঈর্ষাকাতরতাও। 

এ হেন চাপানউতোরের মধ্যেই সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে কোভিড১৯ ভাইরাসের উৎস সন্ধানে আমেরিকার উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটি’র রিপোর্ট। কমিটির সমস্ত সদস্যদের মতৈক্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে যে কোভিড কোনওভাবেই কোনও জৈবাস্ত্র নয়। এই ভাইরাস জেনেটিকালি ইনজিনিয়ার্ড নয় বলেও এই কমিটি মনে করেছে। কমিটি’র  অভিমত, কোনও প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে অথবা এও হতে পারে যে উহান গবেষণাগারে সার্স-কোভ২’এর সংক্রমণে এই ভাইরাসের উদ্ভব ও ছড়িয়ে পড়া। 

নানা মুনির নানা মত ও বিতর্কে কোভিড১৯ নিয়ে বিজ্ঞানী থেকে চিকিৎসক, রাষ্ট্রের কর্ণধার থেকে সাধারণ নাগরিক সকলেই যারপরনাই চিন্তিত ও বিপুল পরিমাণে বিভ্রান্ত। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস এইভাবে মানব প্রজাতির গোটা কুলকে এমন পরাভূত করে রাখতে পারে, বিজ্ঞানদর্পী মানুষের সম্ভবত সে ধারণার আঁচটুকু পর্যন্ত ছিল না। এরই মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল আকচাআকচি। সাধারণ মানুষ পড়েছেন মহাবিপদে। এক দল বলছেন, আপনি যদি ভ্যাকসিন নেন, তাহলে আপনি মহামূর্খ; আরেক দলের মত, ভ্যাকসিন না নিয়ে আপনি শুধু মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছেন না, হীনতারও স্বাক্ষর রাখছেন, কারণ, আপনার ভ্যাকসিন না নেওয়ার ফলে আপনার চারপাশের মানুষজন বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। ‘শ্যাম রাখি না কুল’- এই আতান্তরের মধ্যে ডেনমার্ক সরকার কোভিড-সংক্রান্ত সমস্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ওদিকে আমেরিকায় যথেষ্ট ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও নতুন করে আবারও দ্রুত হারে কোভিড সংক্রমণ ছড়ানোয় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন, যারা ভ্যাকসিন নেননি তাঁরাই আক্রান্ত হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি ভ্যাকসিন নিয়ে থাকেন তাহলে ‘হার্ড ইম্যুনিটি’ গড়ে ওঠার যে গল্পটা ছিল তার কী হল! 

যারা ভ্যাকসিনের প্রবল পক্ষপাতী তাঁরা এতদিন ইজরায়েলকে দেখিয়ে বলে আসছিলেন যে সে দেশ ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল আর তাই সেখানে নতুন করে কোভিডের সংক্রমণ নেই। এই বছর এপ্রিল মাস নাগাদ তথ্য দিয়ে দাবি করা হচ্ছিল যে ইজরায়েলে দৈনন্দিন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে। অথচ কী আশ্চর্য! ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। ২৮ অগস্ট’এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ইজরায়েলে নতুন করে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গড়ে দৈনন্দিন আক্রান্তের সংখ্যা ৯৫০০’এরও বেশি। তাহলে, হচ্ছে টা কী? 

তবে এও বাস্তব, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ হিসেব যে সময়টাকে আমাদের দেশে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই সময়টায় সরকারি হিসেবেই অন্তত ২ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা নাকি ১০-১২ লক্ষের কাছাকাছি। হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নেই, স্থানাভাবে মৃত মানুষের দেহ দাহ বা কবরস্থ করার উপায় নেই, গঙ্গা বা নদীতে শয়ে শয়ে লাশ ভাসছে- এই কঠোর বাস্তবের ছবি তো আমরা দেখেছি। এত মৃত্যু কেন? হতে পারে, এত বিশাল সংখ্যক মানুষ এক সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছেন যে ন্যূনতম চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাবের জন্যই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়াটাও তো চরম আশঙ্কার দিক। বিশেষ করে আমাদের মতো একটি জনবহুল দেশে তা আরও বেশি বিপদের। সেটুকুকে কি রোধ করার কোনও উপায় আমাদের হাতে ছিল না? উত্তর ভারতের কুম্ভমেলায় যে বিশাল লোকসমাগম অথবা পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে সভা-সমাবেশে মানুষের ঢল- এর জন্যই কি কোভিডের সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ছড়ায়নি? অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তো কোভিডের প্রকোপ বেশ কম ছিল। অথচ, অসম নির্বাচনের পর পরই দেখা গেল যে সে রাজ্যে ব্যাপক ভাবে কোভিডের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তা কি নিতান্তই কাকতালীয়? 

তাই, অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও লকডাউনের যে নিদান দেওয়া হয় তা কি ভুল, শুধু ভুল? একদিকে বলব, ফেব্রুয়ারি ২০২০’তে আহমেদাবাদে মোদির ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত থেকেই কোভিড এ দেশে মহামারির আকার নিয়েছে এবং দ্বিতীয় তরঙ্গেও তা আবার ফিরে আসার কারণ কুম্ভমেলা ও রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনের জমায়েত, আবার অন্যদিকে বলব, মাস্ক পরলে দম বন্ধ হয়ে আসে, সামাজিক দূরত্ব বিধি বা লকডাউন আসলে ডিজিটাল সংস্থার মুনাফাকে ত্বরান্বিত করার ষড়যন্ত্র- হরেদরে ঠিক কী বলতে চাইছি, জানি তো? তবে এও বাস্তব, লকডাউনের ফলে গরিব মানুষের রুটি-রুজির এক অভাবনীয় সমস্যা তৈরি হয় বা হয়েছে। এ সম্পর্কে এক বড় সংখ্যক অর্থনীতিবিদেরা পরিষ্কার নিদান দিয়েছেন যে প্রত্যেক অভাবী মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে, দরকার পড়লে নোট ছাপিয়েও। সেও এক পথ বটে। 

কিন্তু আমরা যারা নিতান্তই ছাপোষা সাধারণ জন- আমরা কীভাবে নিজেদের রক্ষা করব? এখানেই বিভ্রান্তির বিস্তার। এ বিষয়ে ডাঃ অরুণ সিং’এর একটি ভাষণ বেশ মনে ধরেছিল। তিনি বলেছিলেন, ভাইরাস আমাদের পূর্বপুরুষ, তারা আমাদের ধরবে না, তা হবার নয়। কিন্তু তারা ধরলেও, আমরা কিছুটা ভুগে-টুগে হলেও শেষমেশ বেঁচে থাকব- এই দিকটা হয়তো নিশ্চিত করা যায়। আর তার উপায় হল, আমাদের শরীরে যে কো-মর্বিডিটি আছে সেগুলোর সুধার করাটাই আসল নিদান। অর্থাৎ, আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ অথবা হার্টের কোনও ব্যারাম কিংবা কিডনির অসুখ থাকে, আপনি সেই সব যাতনা থেকে বরং সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। কোভিড যদি আপনাকে ধরেও, তা আপনার বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু কো-মর্বিডিটি থাকলে আপনার প্রাণ সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। দ্বিতীয়ত, বাইরে বেরলে মাস্ক পরে নেওয়াটা এমনিতেও ভাল বলেই মনে হয়। কারণ, বাতাসে এমনিতেই যা দূষণ তাতে একটা মাস্ক হয়তো আমাদের সকলকে সাহায্যই করবে। জাপানে তো মানুষজন কোভিডের বহু আগে থেকেই রাস্তাঘাটে মাস্ক পরে ঘোরেন। তৃতীয়ত, বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে হাত-পা-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে নেওয়াটাও তো ভাল কাজ। এ অভ্যাসও বহুকালের। পুরনোকালে গ্রামের বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ এলে উঠোনে রাখা ঘটি থেকে জল নিয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে তবে ঘরে প্রবেশ করতেন। 

তবে, তৎসত্ত্বেও মানুষ কোভিডে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। কো-মর্বিডিটির কারণে এই অসুস্থতার প্রকোপ বাড়তেও পারে। তাই ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজন অপরিহার্য। এখানেই আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। প্রবল শ্বাসকষ্টের সময় সামান্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে কত মানুষ যে মারা যান তার ইয়ত্তা নেই। রক্তের অভাবেও বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তাই সবটা মিলিয়ে আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থাও মহামারির জন্য অনেকটাই দায়ী। আর সবচেয়ে বড় দায়ী অনাহার ও অপুষ্টি। 

কোভিড১৯ তার ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করবে, এ স্বাভাবিক। তৃতীয় তরঙ্গ আসা নিয়ে আমাদের আরও এক প্রস্থ বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ থাকবে, তাও স্বাভাবিক। আমরা প্রায়-সকলে ভ্যাকসিন নেওয়া সত্ত্বেও দেখব যে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কখনও কমছে অথবা বাড়ছে। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, কোভিডের ভ্যাকসিনগুলো নাকি ‘Emergency Use Authorisation’এ ছাড়পত্র পেয়েছে মাত্র। অর্থাৎ, খুব জরুরি ভিত্তিতেই এরা ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু চেষ্টা চলছে এর সর্বজনীন ব্যবহারের। রাষ্ট্রগুলি সরাসরি বাধ্য করতে পারে না, কিন্তু ঘুরিয়ে এমন সব নিয়ম করছে যে আপনি ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য। যেমন, ভ্যাকসিন না থাকলে আপনি অমুক দেশে বা অঞ্চলে প্রবেশাধিকার পাবেন না, ট্রেনে উঠতে পারবেন না, বিমানে যাতায়াত করতে পারবেন না- এমনবিধ নানা কিছু। 

সবটা মিলিয়ে, দেখাই যাচ্ছে, ভ্যাকসিনের অবস্থা এখন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’। খেয়েও পস্তাবেন, না খেয়েও। অতএব সম্বল: ‘রাখে হরি মারে কে’।


অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


2 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. বেশ মজাদার লেখা । অনিন্দ্যদা এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের মত ভূমিকা পালন করেছেন -- কাউকেই বেশি খুশি বা দুঃখ দেননি । তবে মাস্ক পড়লে একটু উপকার হলেও অনেক বেশী ক্ষতি হয়, কারণ অক্সিজেনের ঘাটতি হওয়ায় শ্বাসকষ্টের প্রবল অসুবিধা হয় । যদিও আমি মাস্ক পড়ার প্রচন্ড বিরোধী এবং এই সমস্ত জালি ভ্যাকসিন নেওয়ারও প্রবল বিরোধী, তবুও মজাদার লেখা বলে এবং মোটামুটি ব্যালেন্সড লেখা বলে শেয়ার করে দিচ্ছি । 😁🤩🤚🏻

    ReplyDelete

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.