Wednesday, April 28, 2021

সেবক, অবহেলিত এবং এক অভিমানী রাজপুত্র

 লিখেছেন 

সু বী র বি শ্বা স

ছবি উইকিপিডিয়া থেকে গৃহীত

বাবার ইচ্ছেয় বিদেশ থেকে কৃষিবিদ হয়ে তিনি শিলাইদহে তৈরি করেছিলেন প্রশস্ত ক্ষেত-মাটি পরীক্ষার ল্যাবরেটরি। আমদানি করছিলেন ভুট্টার। একইসঙ্গে গৃহপালিত পশুর খাওয়ার উপযোগী ঘাসের বীজও এসেছিল। দেশীয় উপাদান ও প্রযুক্তিতে লাঙল, ফলা ও আরও নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করিয়েছিলেন। বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন একটা ট্রাক্টর। নিজেই চালাতেন সেটা। তিনি আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে মৃণালিনী দেবী ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তখন এই বিয়েতে রাজি হননি রবীন্দ্রনাথ। অন্যত্র বিয়ে হয় প্রতিমা দেবীর। ভাগ্য বিপর্যয়ে অতি অল্প সময়ে প্রতিমা দেবী বিধবা হন। ১৯১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি পিতার ইচ্ছায় সেই বাল্যবিধবা প্রতিমার সঙ্গেই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়। ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসে এর আগে বিধবা বিবাহ হয়নি, এই প্রথম। 

বিয়ের কিছুদিন পরে পাঁচ বছরের ছোট প্রতিমা দেবীর সঙ্গে শিলাইদহে সংসার জীবনের শুরু। যদিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এই সুখের জীবন। বাবার ইচ্ছায় তাঁকে সেই গোলাপের বাগান, সুদূরবিস্তারী ক্ষেত, পদ্মা নদীর বুকে সুখ-দুঃখের কাহিনি-ভরা বজরা ছেড়ে বীরভূমের ঊষর কঠিন লাল মাটির প্রান্তরে আসতে হল। 

স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক প্রথম থেকেই খুব একটা সহজ ছিল না। বেশ স্পষ্ট করে রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে তাঁর অন্তর্মুখী স্বভাবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে, স্ত্রী যেন তাঁর লাজুক স্বভাবকে স্বাভাবিক করে তোলার দায়িত্ব নেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, না পারলে প্রতিমা দেবীকে চিরকাল কষ্ট পাওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। 

প্রকৃত শিল্পী মনের মানুষ রথীন্দ্রনাথ বাবার অতি-বিখ্যাত হওয়ার কারণে বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক কাজকর্মে এবং বাবার একান্ত সচিব হয়েই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে আসা বিদগ্ধ লোকজনের দেখাশোনা করা, বাবার বিদেশযাত্রার সঙ্গী হওয়া তাঁর জীবনের অনেকটা সময় নিয়ে নিয়েছে। বহু বছর ছিলেন বিশ্বভারতীর  কর্মসচিব। বুঝতে পারছিলেন, বিশ্বভারতীর কাজ তাঁকে আর আনন্দ দেয় না, নৈতিক কর্তব্য পালনের তাগিদেই সে-কাজ করে থাকেন শুধু। বিশ্বভারতী  ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়, রথীন্দ্রনাথ তার প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন। ক্ষমতার রাজনীতি আর নিয়মের ঘেরাটোপ তাঁকে ক্রমশ হতাশ করে তুলেছিল। ব্যক্তিগত আক্রমণ আর কুৎসা তাঁকে আরও বেদনাদগ্ধ করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, যদিও আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিশ্বভারতীর দৈনন্দিন কাজকর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যাধিক হস্তক্ষেপে আচার্য জহরলাল নেহরু বিরক্ত হয়েছিলেন এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে সতর্ক করেছিলেন। আশ্রমের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী মীরার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের প্রথা-ভাঙা অন্তরঙ্গতা বিষয়ে শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। এইসময় প্রতিমা দেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। বাক্যালাপ ছিল না বললেই চলে। উপাচার্য থাকাকালীন তিনি একবার মীরা দেবীকে নিয়ে হাজারিবাগ বেড়াতে গিয়েছিলেন। বোম্বের এক  ট্যাবলয়েডে, নামোল্লেখ না করে, এই ঘটনা ছাপা হয়। সবমিলিয়ে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। 

প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত রথীন্দ্রনাথ তখন নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী একত্রিশ বছরের ছোট মীরাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলেন। শোনা যায়, আচার্য জহরলাল নেহরু নির্মলচন্দ্র আর মীরাকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেওয়ার মৌখিক পরামর্শ বাতিল করেন। উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ শরীর খারাপের অজুহাতে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও পলায়নী মনোবৃত্তি নয়, নিজেকে আবিষ্কার করার বাসনা নিয়েই তিনি  শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাচ্ছেন। তিনি মিশ্রমাধ্যমে বহু ল্যান্ডস্কেপ আর ফুলের ছবি এঁকেছিলেন। চামড়ার উপর কারুকাজ এবং দারুশিল্পেও দক্ষ ছিলেন। আসবাবপত্র, স্থাপত্য নির্মাণ, উদ্যান পরিকল্পনা এবং রূপায়ণে অনন্য পারদর্শী ছিলেন। বিভিন্ন ফুলের আতর আর সুগন্ধি পাউডার তৈরি করতে জানতেন।  ‘Arty Perfume’ নামে এই সমস্ত উপকরণ বাজারে বিক্রি হত। ঘরোয়া স্তরে জ্যাম, জেলি, আচার আর দই পাতায় নৈপুণ্য ছিল তাঁর। মৌমাছির  চাষ জানতেন, নেশা ছিল শিকারেরও। ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক ধারা তাঁর মধ্যেও ছিল। ভাল গান গাইতেন, বাজাতেন এস্রাজ। 

ইংরেজিতে “On the Edges of Time” বইটি লিখেছিলেন। অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। শেষে তিনি একবারের জন্য হলেও নিজের মতো করে বাঁচতে চাইলেন। ১৯৫৩ সালে নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের পূর্ণ সম্মতিতে মীরাকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ছাড়লেন এবং দেরাদুনে থিতু হলেন। যাওয়ার আগে প্রতিমা দেবীকে রথীন্দ্রনাথ লিখলেন , ‘‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’’ দেরাদুনে থাকাকালীন স্ত্রী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন রথীন্দ্রনাথ। 

১৯৬০ সালে বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে প্রতিমা দেবীকে  লিখেছিলেন, ‘‘আমরা দু’জনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারও প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা (শোভনীয়) হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনও রাগ নেই— আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’’ 

শেষ আট বছর মীরাকে নিয়ে দেরাদুনে কাটিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৭.১১.১৮৮৮ – ৩.৬.১৯৬১)।

 

তথ্যঋণ: 

  • পিতৃস্মৃতি (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
  • আপনি তুমি রইলে দূরে: সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ (নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)
  • আনন্দবাজার পত্রিকা
  • রবীন্দ্রবর্ষপঞ্জি (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)

সুবীর বিশ্বাস - প্রাক্তন ব্যাঙ্ক আধিকারিক। তাঁর স্কুল জীবন কেটেছে দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলের খড়িবাড়ি চা বাগানে, কলেজ জীবন শিলিগুড়িতে। রাজ্য সরকারি কর্মচারী হিসেবে চাকরি জীবন শুরু। তিন দশকের বেশি ব্যাঙ্কে চাকরি করে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। কলকাতায় থিতু। কিন্তু তাঁর এই পরিচয় যথেষ্ট নয়। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন দীক্ষিত পাঠক। আজীবন সঙ্গী বইপত্র। সাহিত্যের গলি-ঘুপচি ঘুরে জীবনের রসাস্বাদনেই তিনি তৃপ্ত। তাঁর লেখনী সেখানে কখনও নম্র, কখনও দৃপ্ত। বিবক্ষিত'র পাতায় এই তাঁর প্রথম নিবন্ধ। পাঠক তাঁর জ্ঞানের উদ্ভাসে আলোকিত হবেন - এমন আশা আর কাল্পনিক নয়।  


Monday, April 26, 2021

ঝকঝকে প্রচ্ছদের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে গণতন্ত্রের নিস্তব্ধ অন্তঃসার


লিখেছেন 
দে ব র্ষি   ভ ট্টা চা র্য 

ছবিটি বিবক্ষিত ২০১৭ প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ থেকে গৃহীত


পশ্চিমবঙ্গের মধ্য-গগনে আরও একটি নির্বাচনের ফুটিফাটা বিকিরণ। করোনা অতিমারির নির্মমতাও জাঁকিয়ে বসেছে সেই নির্বাচনী তরঙ্গের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ভারতের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের একটি অঙ্গ-রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের মুখ্য ইস্যুগুলো ঠিক কী হওয়া বাঞ্ছনীয়, ভোট সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা নিয়ে ভাববার আর ফুরসৎ কোথায়! বরং, বিভাজনের রাজনীতির পরিখা টেনে যেনতেন প্রকারে ভোট বৈতরণী পার হওয়াই অনেক বেশি বাস্তবসম্মত! একবার ভোটে জিতে ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলেই তো জড়সড় জনতাকে শাসকের মেজাজে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গণতন্ত্রের দায় কড়ায়-গণ্ডায় মেটানো যাবে। তাতে চুলোয় যাক না ‘জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের জন্য সরকারের’ মার্গ দর্শন! ক্ষমতার আস্বাদের নাগাল পেতে দর্শন তত্ত্বের মোড়কে আচ্ছাদিত রাজনীতির প্রচ্ছদটা না হয় তোলা থাক ফুরফুরে বাসন্তী সন্ধ্যার টেলিভিশনের ‘টক শো’র ঝকঝকে পর্দার জন্য! ভরে যাক না বীভৎস পাঁকের গিজগিজে ভিড় রাজনীতির পাঠ্যপুস্তকের বাকি পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে! রাজনীতির কুশীলবরা বিলক্ষণ জানেন, তবু জনগণ ভোট দেবেন। সেই মানুষ বা সেই দলটিকেই দেবেন, যার বা যাদের কোন গঠনমূলক রাজনৈতিক দিশা নেই, নৈতিকতার কাছে দায়বদ্ধতার কোন অঙ্গীকার নেই, ভোট আদায় করে অঞ্চলের কেষ্টবিষ্টু বনে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো জনহিতকর অভিপ্রায় নেই। জনতা-জনার্দনের স্বল্পমূল্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মৌলিক কোন পরিবর্তন আনার পরিকাঠামোগত কোন পরিকল্পনা ভাঁড়ার নেই। কিছু ভোট সম্মোহনী প্রকল্প ঘোষণা করতে পারলেই উদ্দাম প্লাবনে ভোট বাক্স উচ্ছ্বাসে উপচে পড়বে যে! আর তাতে সাঙ্গোপাঙ্গদের জন্য নিশ্চিত ‘কাট মানির’ বন্দোবস্ত হয়ে যাবে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরেও রাজ্য তথা দেশের গণতন্ত্রের চালচিত্রটা কমবেশি এই রকমই হয়ে থাকবে? নাকি মনুষ্য হিসেবে বেঁচে থাকার তাগিদে রাজনৈতিক বাতাবরণের মৌলিক পরিবর্তনের আশু প্রয়োজন? এই নিয়ে ভাবার মতো কোন উপায় আছে কি দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার দৌড়ে পিলপিল করে ছুটে চলা আমজনতার হাতে!   

আজকের সময়টা যেন এক নির্মম কালবেলা! প্রথম পর্বের করোনা অতিমারির করাল দংশন কোনক্রমে সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর সন্ধিক্ষণেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের নিষ্ঠুর চপেটাঘাতে ভারতবর্ষ ভয়ংকর ভাবে বিধ্বস্ত। বিগত বারোমাস সময়কালে রাজ্য তথা দেশের আর্থনীতিক অবস্থা প্রায় জরাগ্রস্ত অগুন্তি প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকা চরমভাবে বিপর্যস্ত দেশের রাজপথ, গলিপথে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে অগনিত কর্মচ্যুত মানুষজন। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডব রাষ্ট্রের চরম উদাসীনতা এবং অক্ষমতাকে চরমভাবে নগ্ন করে ফেলেছে। হাসপাতালে খালি শয্যা নেই। অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ নেই। অক্সিজেনের চরম আকাল। সব মিলিয়ে এ-যেন এক ঘোর দুর্দিন। এমনই এক বিরল সংকটকালে ভারতের এক অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঠিক কি কি হওয়া সমীচীন ছিল? ধর্মীয় মৌলবাদের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতির জাল বুনে ভোট শিকার? শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে জাতপাতের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে সমাজে অধিকতর বিভাজনের রূপরেখা টেনে ভোট আদায়? নাকি এই নির্বাচনের মুখ্য দিশা হওয়ার অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা, শিক্ষা প্রসারের অঙ্গীকার, নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি, কর্ম সুরক্ষার গ্যারান্টি, শান্তি ও সুশাসনের আশ্বাস? কিন্তু কোথায় কী! করোনা অতিমারীর বিধ্বংসী আক্রমণের পরেও আসন্ন নির্বাচনের মূল ইস্যুগুলো কিন্তু পাক খাচ্ছে সেই পরিকল্পিত বিভাজিত সমাজের প্রতিচ্ছবির ঘূর্ণাবর্তেই! প্রধান যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের ঝকঝকে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় যাই জ্বলজ্বল করুক না কেন, অন্তঃসার জুড়ে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে সমাজ বিভাজনেরই সুড়সুড়ি। প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের ‘কোট-আনকোট’ মুখ্য অ্যাজেণ্ডাই হল ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং তাদের টার্গেট ভোটার হল দেশ ও রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষজন অন্যদিকে, প্রধান অপর একটি রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক টার্গেট ভোটার হল রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা শুধু তাই নয়, তারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিভাজনের গুপ্ত কার্ডটি অবলীলায় খেলে যাচ্ছেন অলীক জনহিতের মোড়কে। কখনও তা বর্ষিত হচ্ছে পূর্ববঙ্গ থেকে অভিবাসিত মতুয়া তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্য করে। কখনও বা উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া রাজবংশী তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষদের হিতের ভাবনাকে পুঁজি করে। এমনকি সংসদীয় গণতন্ত্রে টিকে থাকার অমোঘ তাগিদে মার্ক্সবাদী আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোও এই আদর্শচ্যুতির চক্রব্যূহ থেকে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে পুরোপুরি বাইরে রাখতে পারছে না অথচ এই সকল রাজনৈতিক দলগুলোর পতাকা জুড়ে গণতন্ত্র, প্রগতি, দেশপ্রেমের প্রবল আস্ফালন। কিন্তু তাদের গুপ্ত আস্তিন বোঝাই কেবলমাত্র ভোট বৈতরণী পার হওয়ার গুচ্ছ-গুচ্ছ ভোট সম্মোহনী অ্যাজেণ্ডা! সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার আস্বাদ পেতে কারই বা দায় পড়েছে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন ও উন্নতিসাধনের স্বার্থে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার!     

এমনই এক রাজনৈতিক বাতাবরণকে আমরা বহন করে চলেছি, যার মুখমণ্ডল গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা, সাম্যের প্রতিষ্ঠা, প্রতিহিংসাপরায়নতা বর্জনের অঙ্গীকার, জনহিতকর কর্মকাণ্ডের ঢালাও প্রতিশ্রুতির বর্ণময় রঙে রঞ্জিত। কিন্তু অন্তঃসার জুড়ে লুক্কায়িত গণতন্ত্র হত্যার শাণিত গুপ্ত অস্ত্র, অসাম্য বজায় রাখার গুপ্ত মন্ত্র, প্রতিহিংসা পরায়নতায় ভরপুর গূঢ় রাজনৈতিক হৃদয় এবং জনহিতকর কর্মকাণ্ডের অন্তরালে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার গুপ্ত অভিপ্রায়। নইলে কেনই বা মরীচঝাঁপি গণহত্যার এতদিনেও বিচার হল না! কেনই বা নেতাই গণহত্যা অবলীলায় ঘটে যায়! কেনই বা অম্বিকেশ মহাপাত্র কিংবা শিলাদিত্যকে তুচ্ছ কারণে হাজতবাস করতে হয়! কেনই বা জাতিদাঙ্গার কলঙ্কিত খলনায়করা দেশনায়কের মর্যাদা পান! কেনই বা হাসরথের মেয়েটির পোড়া মাংসের গন্ধকে ছাপিয়ে শাসকের হুঙ্কারে দেশের আকাশ বাতাস ছেয়ে যায়! ভোটের পর ভোট আসে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে প্রশাসনিক মেরুদণ্ডের আস্তিনে জড়িয়ে দেওয়া হয় রাজনৈতিক অভিসন্ধির গন্ধ মাখা রঙিন পালক শাসক দলের অনুকম্পা ব্যতীত প্রশাসনের ডালপালাগুলোও স্থবির থেকে যায় প্রতিবাদ মুখর কতিপয় আমজনতা বনে যান হয় শহুরে নকশাল, নয়তো দেশদ্রোহী। গণতন্ত্রের মুখ কেবল জ্বলজ্বল করে ওঠে ঝকঝকে স্টুডিওর ঝলমলে রূপালী পর্দা জুড়ে। আর গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু শরীর বেয়ে গলে পড়ে কালাহাণ্ডি বা আমলাশোলের বুভুক্ষু মানুষগুলোর ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস কিংবা কামদুনীর অভাগী মেয়েটির করুণ আর্ত চিৎকার অথবা উন্নাওয়ের নির্যাতিতার অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অসহনীয় রক্তস্রোত। এতকাল ধরে ক্রমাগতভাবে ঘটে চলা এতকিছুর পরেও ছাপোষা জনতা জনার্দন তবু অবিরত পাক খেতে থাকে ভোট বাক্সের ঘূর্ণাবর্তের অমোঘ ইশারার টানেই! প্রশাসনকে নিজস্বার্থে ব্যবহার, পেশীশক্তির আস্ফালন ও ভোট সম্মোহনী অ্যাজেণ্ডাগুলোর মিলিত শক্তি ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ জয় ছিনিয়ে এনে নির্বাচিত করে দেশ এবং রাজ্যের সরকার। তন্দ্রাচ্ছন্ন গণতন্ত্রের প্রগাঢ় নীরবতা ঝুপ করে নেমে এসে ভিড় করে গেরস্তের সহিষ্ণু পাঁজরে। 


 



ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস), সিমলা, হিমাচল প্রদেশ । এই অ্যাকাডেমিক পরিচয় ছাড়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তিনি এমন একজন লেখক যিনি সময়ের রোজনামচাকে লেখকজীবনের আঙ্গিকে সাজিয়েছেন । তিনি নিয়মিত নানা দৈনিক সংবাদপত্রে, যেমন - আনন্দবাজার, এই সময়, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান একদিন ও পুবের কলম ইত্যাদি, লিখেছেন, লিখে চলেছেন বহু মূল্যবান সমাজ-দলিল । 

Friday, April 23, 2021

সত্যজিৎ রায় : প্রয়াণ দিবসে ফিরে দেখা

  লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী

সত্যজিৎ রায়

বাঙালির একটা মুশকিল হল, কাউকে যদি সে একবার মাথায় বসায়, তবে তাকে নিয়ে আর কোনও কথা বলা যায় না। তাই রবীন্দ্রনাথকে যখন বিবেকানন্দ 'বাঙালি জাতিকে রসের সাগরে ভাসিয়ে সর্বনাশ করলেন' বলে অভিযোগ তোলেন তখন বাঙালি দাঁড়িয়ে পরে বিবেকানন্দের বিপরীতে। কবি ব্যঙ্গ করে লিখে ফেলেন 'চিরকুমার সভা'। আবার যখন বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন যে 'আমার বৈপ্লবিক ভাইকে এরা সাধু বানিয়ে ছেড়ে দিল', তখন সেই বাঙালিই আবার রে-রে করে ওঠে ভূপেনের 'কমিউনিস্ট' মতলবের বিপক্ষে। তাই বাঙালির কাছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে সত্যজিৎ পর্যন্ত এক লম্বা সারিতে প্রায় একডজন মনীষী রয়েছেন, যাঁদের বাঙালি কার্যত কাচের আলমারিতে বন্দি করে রেখেছে। তাঁদের দিকে ঢিল ছোঁড়া মানা,  কোনও কাটা ছেঁড়া করা একরকম 'অপরাধ'। 

ফলত, এঁদের নিয়ে যেটা হয় সেটা চর্বিত চর্বন, মহান থেকে সুমহান করার অতিপ্রয়াস। অথচ বিদেশে ব্যাপারটা একদম আলাদা। সেখানে দ্য ভিঞ্চি, শেক্সপিয়র, গ্যঠে, বিটোভেন কেউ-ই সমালোচনার উর্ধ্বে নন। তাই সেখানে এঁদের নিয়ে একবারে অন্য রকমের নানা কাজ হয়েছে বা হচ্ছে। একটা গোটা ডিকশনারি তৈরি হয়েছে শেক্সপিয়রের নাটকে ব্যবহৃত ইতর শব্দাবলী নিয়ে। এমন একটি কাজ এই বাংলার মনীষীদের নিয়ে করতে গেলে, লেখককে পাঠিয়ে দেওয়া হবে হয় পাগলাগারদে আর তা না হলে হাজতবাস নিশ্চিত। এই যে আমি সত্যজিৎ নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে, এত শব্দ খরচ করলাম সেটা ওই রক্ষণশীলদের জন্য, অনেকটা সেই বঙ্কিমকে যেমন করতে হত, স্বামী এসে স্ত্রীর কপালে ঠোঁট ছোঁওয়াবেন, তার আগে দু'পাতা ধরে পাঁয়তাড়া!  

আসলে, সংস্কৃত আর সংস্কৃতি একই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হলেও দুটো নিকট সম্পর্কিত নয়। কৃষির সঙ্গে কৃষ্টির তথা সংস্কৃতির নিকট সম্পর্ক। যে ফসল ফলেনি তাকে ফলানোই কৃষকের কর্ম। সে-জন্য সে মাঠে কাজ করে।  কালটিভেট করে। আর যা ফলে রয়েছে তাকে সিদ্ধ করে, শুদ্ধ করে পরিবেশন করা হচ্ছে পাচকের কর্ম। সে রিফাইন করে। সবাই যদি রিফাইন করে তবে কালটিভেট করবে কে? 

সত্যজিৎ প্রসঙ্গেই এই কথাগুলো বলা। চিত্রশিল্পী, সংগীতজ্ঞ, প্রচারবিদ, বাগ্মী, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সমান দক্ষ লেখক সত্যজিতের প্রধান পরিচয় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুক্তিদাতা। 'পথের পাঁচালি' ছবিতে সত্যজিৎ যেটা করেছিলেন তা  ছিল সংস্কৃতি জগতে একটি সম্পূর্ণ নতুন উৎপাদন। 'পথের পাঁচালি' ছিল এক নতুন ফলানো ফসল। তাঁর পরবর্তী ছবিগুলির মুক্তি ভারতীয় সংস্কৃতির সরণির এক একটি মাইলফলক, বিশ্বের মানচিত্রেও সেগুলো সগর্ব অধ্যায়। কিন্তু সেই ছবিগুলোতে কোথাও কি রয়ে গেল তাঁর প্রথম ছবির রিফাইনমেন্ট প্রক্রিয়া? প্রথম ছবির যে স্বাক্ষর তা কি সারা জীবন তাড়া করে ফিরল না তাঁকে? এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই যে তাঁর সাধনা নিষ্ঠাবান, যাত্রা তাঁর নিঃসঙ্গ, শিল্পরুচি সৃষ্টিতে অতিক্রম করেছেন নিজেকেই, দৃষ্টি ছিল সম্মুখবর্তী। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এমন একটা ছবিও হল না যা দেখলে মনে হয়, এ ছবি সত্যজিতের হতেই পারে না? অনেকে 'সীমাবদ্ধ' ছবির নায়কের মত জিজ্ঞাসা করতে পারেন, সেটা ভালো না খারাপ? সে বিচার অবশ্যই দর্শকের। চিত্রনাট্য, সংলাপ, রূপসজ্জা থেকে শুরু করে সম্পাদনা, বিজ্ঞাপন, প্রচারে সত্যজিৎ অনন্য। কিন্তু গোদার বা গুনে বা অন্তনিওনির যে বৈচিত্র্যময় দুনিয়া, সেই বৈচিত্র্য সত্যজিতের আছে কি? 

এ ব্যাপারে কুরুসওয়ার সঙ্গে সত্যজিতের মিল রয়েছে, দুজনেই সিগনেচার ফিল্মমেকার। যাঁদের ছবির প্রথম শটেই চিনে নেওয়া তাঁদের। যিনি 'দেবী' তুলেছেন তিনিই তুলেছেন 'শতরঞ্জ কি খিলারি'। 'দেবী'র ছবি বিশ্বাস আর 'শতরঞ্জ কি খিলারি'র আমজাদ খাঁ-কে পাশাপাশি রাখলে যেন মনে হয় তাঁদের দ্যোতনা একদম এক। তফাৎ শুধু প্রেক্ষিত, আর সময়ের। 'গুপি গাইন, বাঘা বাইন'-এ গুপি গাধার পিঠে চেপে যখন গ্রাম ছাড়ছে, তখন গুপি'র বাবার চোখের জল মোছা যেন ফিরে এলো 'শাখা-প্রশাখা'র আনন্দ মজুমদার-এর চোখের জল হয়ে। যাঁরা বহুবার করে সত্যজিৎ দেখেছেন তাঁদের কি কখনও মনে হয়নি, যে তিনি একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে বাঁধা পড়ে গেছেন। এতে হয়ত তাঁর ছবির উচ্চতা এতটুকু কমেনি, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা? 

আজও বাঙালির প্রাণের মানুষ তিনি, ভদ্রলোক বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনিই আমাদের ছবি দেখতে শিখিয়েছেন, তাঁর অমূল্য সব প্রবন্ধের মাধ্যমে। তাই মনে হয়, এটা নেহাত কাকতলীয় নয় যে তিনি শুরু করলেন 'অপু ট্রিলজি' দিয়ে আর শেষ করলেন, 'গণশত্রু', 'শাখা প্ৰশাখা' আর 'আগন্তুক' - ট্রিলজি দিয়ে। হয়ত তিনিই চেয়েছেন এই ঘেরাটোপে থাকতে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আর একটা সম্ভবনার কথা মনে হয়। আমরা এতবার করে ছবিগুলো দেখেছি, শট, এঙ্গেল, ডায়লগ সব মুখস্ত হয়ে গেছে, তাই কি মনে হয় সব একই রকম। আলাদা গল্প, প্রেক্ষাপট, কাস্ট সত্ত্বেও। ছবির বাজনা শুনলেই কান বলে দেয় এটা সত্যজিৎ। আশা করি, আগামী দিনে এই নিয়ে আরও আলোচনা হবে।২০২১- সত্যজিতের শতবর্ষ। এই একটি সান্ত্বনাই আমাদের ভুলিয়ে দিতে পারে সব আতঙ্ক, অস্থিরতা। আবার হয়ত শুরু হবে নিভৃতবাস, অচল হয়ে যাবে পৃথিবী, খানিক শুশ্রূষার আবহ নিয়ে আসুক তাঁর লেখা বই, ছবি, ফিল্ম, সংগীত। সত্যজিতের কাজ হয়ে উঠুক সর্বার্থে থেরাপিউটিক।



[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এই সময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]

Wednesday, April 21, 2021

জীবনের ছন্দের শিক্ষক

 লিখেছেন অংশুমান কর

কবির হাতে "সীমানা ছাড়িয়ে" তুলে দেওয়ার মুহূর্ত (দ্বিতীয় ছবি)

ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কীভাবে এখন আর মনে পড়ে না। তবে এটুকু মনে আছে যে, ওঁর সঙ্গে প্রথম কথা বলেছিলাম ফোনেই। তার আগে অবশ্য নানা অনুষ্ঠানে ওঁকে দেখেছিলাম একাধিকবার। কী নিয়ে প্রথম কথা বলেছিলাম তাও ভুলে গেছি আজ। তবে ওঁর সঙ্গে যত কথা বলেছি ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে, তার চেয়ে বেশি কথা বলেছি ফোনেই। রবিবারের আড্ডাতেও গিয়েছি খুবই কম। হাতে গোনা কয়েকদিনই। কখনও কবিতা দেখানোর সাহস পাইনি। পাণ্ডুলিপি পড়ানোর কথা ভাবতেও পারিনি কোনোদিন। মাঝে মাঝেই অবশ্য নানা শব্দের শুদ্ধ বানান জিগ্যেস করেছি। শুধু একবার আমার একটি ছোট্ট বইয়ের নামকরণ নিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। ওঁকে ফোন করতেই মুহূর্তে সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন। আমার কয়েকজন বন্ধুর মতো ওঁর পায়ের কাছে বসে কবিতা লেখার পাঠ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি; বলা ভালো, আমার দিক থেকেই  সাহস ও সংকল্পের অভাব ছিল। তবে সাহিত্যের প্রকরণ কৌশল ওঁর কাছে শিখিনি কি কিছুই? একলব্যের মতো যেমন অনেক তরুণ কবিই দূর থেকে ওঁকে দেখে দেখেই শিখেছে অনেক কিছু, ওঁর লেখা পড়ে কিছুটা বুঝেছে রবীন্দ্রনাথ, কিছুটা ছন্দ, তেমন আমিও বুঝেছি। কবিতার পর কবিতা পড়ে শিখেছি নির্মাণের কৃৎকৌশলও। কিন্তু সেসব অভিজ্ঞতা আজ লিখব না। বছর তিনেক আগে ওই পাহাড়ের মতো স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষটি সরাসরি ছোট্ট একটি শিক্ষা দিয়েছিলেন আমায়, বলব সেই শিক্ষালাভের কথা।

        সেবার বইমেলায় আমার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশ পেয়েছে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা 'বীরুৎজাতীয়' সাহিত্য সম্মিলনী থেকে। নাম “সীমানা ছাড়িয়ে”। ভারতবর্ষের পাঁচটি ভাষার তরুণ কবিদের কবিতার বাংলা অনুবাদ ছিল সেই বইয়ে। প্রকাশনা সংস্থার ছেলেগুলি খুবই যোগ্য এবং তরুণ। তাঁদের আবদার বইটি শঙ্খ ঘোষের হাতে দিয়ে একটি ছবি তুলে আনতে হবে। স্যারের জন্মদিনে আমি চেষ্টা করতাম প্রতিবার যাওয়ার আর নিজের বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলি ওঁর হাতে তুলে দেওয়ার। কিন্তু ছবি তুলতাম না সাধারণত। আমাদের বন্ধু সন্দীপন কতগুলো ছবি এমনিই তুলে দিত, বা অন্য কেউ তুলতেন, সেই ছবি পরে পেতাম–এমনটাই হত। নিজের থেকে আমারই সম্পাদিত একটি বই ওঁকে দিয়ে সেই বইয়ের ছবি তুলে ফেসবুকে দেব এটি ওঁকে বলতে আমার সঙ্কোচ হবে জানিয়েছিলাম প্রকাশক ভাইদের। কিন্তু ওদের আব্দার, চেষ্টা করে দেখতে হবে, ছবি যদি পাওয়া যায়। অগত্যা, স্যারকে সেবার ৫ ফেব্রুয়ারি বললাম যে, স্যার একটি বই আপনার হাতে দিয়ে ছবি তুলব। উনি রাজি হলেন। এল ছবি তোলার পালা। আমি ওঁর হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাকালাম ফোনের ক্যামেরার দিকে। সাধারণত, এভাবেই ছবি তোলা হয়। এটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। একটা ছবি তোলাও হয়ে গেল। এরপরই উনি প্রায় ফিশফিশ করে আমাকে বললেন, “এটা কি ঠিক হল?” আমি তো গেলাম ঘাবড়ে! ভুল করলাম কোথায়? কিসে হল ভুল? উনি ঘরের আর কেউ যেন শুনতে না পায় সেভাবেই মৃদু স্বরে আমাকে বললেন, “এই যে তুমি আমার হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তাকালে ক্যামেরার দিকে, এতে কি মনে হল যে, বইটা তুমি আমাকে দিচ্ছ? এতে তো মনে হল ছবিটা সাজানো। ক্যামেরা না-থাকলে কি তুমি এভাবেই দিতে আমাকে বইটা?” বুঝলাম কোথায় হয়েছে ভুল! বুঝলাম ছোট্ট দু’তিনটি বাক্যে উনি আমাদের দেখনদারিত্বের ফাঁপা দিকটা কেমন মুহূর্তে উন্মুক্ত করে দিলেন! বলে দিলেন, স্বাভাবিক ছবি তোলার নিয়মটুকুও। আমি আবার সন্দীপনকে বললাম, নতুন করে ছবি তুলতে। এইবার ক্যামেরা না-থাকলে যেভাবে দিতাম বই, দিলাম সেভাবেই। ওঁর মুখে তখন স্মিত হাসি।

        এই ঘটনাটির পরে আজ পর্যন্ত আর কাউকেই বই দিয়ে ছবি তুলিনি। কিন্তু তুললে, ওই ছোট্ট শিক্ষাটুকু ভুলব না। আসলে শঙ্খ ঘোষ ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি চাইতেন শুধু কবিতায় নয়, তরুণ কবিদের জীবনের ছন্দেও যেন ভুল না থাকে।


অংশুমান কর

অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় 

এবং 

প্রাক্তন সচিব, সাহিত্য আকাদেমি, পূর্ব অঞ্চল

অংশুমান কর সমসময়ের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কলমের মুগ্ধতায় মাতোয়ারা হয়েছেন বহু পাঠক। কবিতা ছাড়াও গদ্যের মুক্তাঞ্চলে তাঁর অবাধ গতায়াত। প্রকৃত অর্থে তিনি হলে লেখক, লেখাই তাঁর ধর্ম । তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ  "মৃত অশ্বের সওয়ার" ।  সংগ্রহ করুন নিচের লিংকে ক্লিক করে,

'বইঘর' - অনলাইনে বই কিনুন ও পড়ুন

 

Sunday, April 4, 2021

রমানাথ রায় : ঘটের মাথায় এঁচড়

 লিখেছেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়

রমানাথ রায়


রমানাথ রায় (জন্ম ৩ জানুয়ারি, ১৯৪০) সম্প্রতি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিন মেলা উপলক্ষ্যে বাংলা আকাদেমি সভাঘরে ৭ই ফেব্রুয়ারি একটি আলোচনাসভা ছিল। রমানাথ রায় ছিলেন সে সভার অন্যতম বক্তা । বছর খানেক পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। দেখে বেশ সুস্থ‌ই মনে হয়েছিল।  প্রায়  আধঘণ্টা সময় নিয়ে বললেনও ।

       ষাট বছর আগের কথা দিয়ে তিনি  শুরু করেছিলেন। যেভাবে গল্প লেখা হচ্ছিল তাতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না। 'সামাজিক বাস্তবতা' থেকে 'লেখকের দায়বদ্ধতা'  ইত্যাদি শব্দগুলো বেশ ভারী ঠেকছিল। মনে হচ্ছিল অন্য ভাবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতিতে, নতুন কিছু বলা দরকার । রমানাথের সে-সব ইচ্ছে  ১৯৬২-তে প্রকাশিত দশটি গল্পের সংকলন 'দু ঘণ্টার ভালোবাসা'-তে ধরা আছে। এক‌ই সময়ে রমানাথ প্রকাশ করতে শুরু করেন 'এই দশক' নামের একটি বুলেটিন। বুলেটিনের নামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যেন আগের দশকগুলি থেকে ভিন্ন কিছু ভাবা ও করার দরকার আছে। ন-টি বুলেটিন প্রকাশিত হয়।  ১৯৬৬-তে সেটি পত্রিকার চেহারা নেয়  এবং  শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের মুখপত্র হয়ে ওঠে। প্রায় ষোলো বছর বেরিয়েছিল সে পত্রিকা। ততদিনে শুধু শাস্ত্রবিরোধী লেখকদল নয়,  পাশাপাশি একটি পাঠকগোষ্ঠীও তৈরি হয়ে গেছে। শাস্ত্রবিরোধীতার ক্ষেত্র‌ও গল্প থেকে উপন্যাসে বিস্তৃতি পেয়েছে।

        বাংলা গল্পের প্রচলিত রীতি যে ভাঙা দরকার তা পাঁচের দশকের শেষ দিকে অনুভব করেছিলেন কেউ কেউ। ১৯৫৯ সালে বিমল কর চারজন গল্পকারের  চারটি ছোটোগল্প  প্রকাশ করে নতুন রীতির গল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন বলা যায় । এই চারটি গল্পের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'বিজনের রক্তমাংস' এবং দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জটায়ু'। এ  দুটি গল্প রমানাথের বিশ্বাসকে আর‌ও প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল যে অন্য  পথে যাওয়া দরকার এবং তা সম্ভব‌ও। সেই  নতুন পথের সন্ধানে গিয়ে রমানাথের মনে হয়েছিল কাহিনিনির্ভর গল্পের মধ্যে বড়ো বেশি যুক্তি ও শৃঙ্খলা।  সে সব গল্পের যে গার্হস্থ্য‌জীবন তাও বানানো । তাঁর মনে  প্রশ্ন জেগেছিল জীবনে যখন এতো অনিশ্চয়তা তখন সাহিত্যে এতো বানানো নিশ্চয়তা  কেন ? এই শৃঙ্খলা  এক অর্থে শৃঙ্খল, এই নিটোল নির্মাণ এক অর্থে স্থিতাবস্থার সহচর। শিল্প একটা মুক্ত পরিসর খোঁজে।  তত্ত্ব ও সূত্র  দিয়ে তাকে জড়ালে অন্তরের জটিল অনুভূতি প্রকাশের পথ  মেলে না।  তাই সাহিত্যের সংহিতা থেকে বেরিয়ে জীবনের সহজিয়া পথে কথাকারদের চলা দরকার। বিশ-বাইশ বছরের রমানাথ  'দু ঘণ্টার ভালোবাসা' পর্বের গল্পগুলিতে সে পথ ধরেই হেঁটেছেন।

          'দু ঘণ্টার ভালোবাসা' নামের যে গল্প তার শুরু একজন সেলসম্যান ও তার সঙ্গে আসা বাইশ-তেইশ বছরের এক অবিবাহিত যুবতীকে দিয়ে। তারা একটি বাড়িতে তাদের কোম্পানির বিস্কুট বিক্রি করতে এসেছে। সেলসম্যান জানাচ্ছে যে তাদের বিস্কুট কিনলে তারা  একটি বিশেষ গিফ্ট দিচ্ছে। তারপর গল্পে লেখা হয় ---

        গিফ্টের কথা শুনে উৎসুক হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী  গিফ্ট ?
        লোকটি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এর গালে একটা চুমু খেতে পারেন।
        কথাটা শুনে চমকে উঠি, সত্যি?
        ---সত্যি।
        ---যদি দুটো নিই?
        ---তাহলে দুটো চুমু।  আর যদি দশটা প্যাকেট নেন তাহলে এর  সঙ্গে দু-ঘণ্টা সময় কাটাতে পারবেন। আপনার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে।

        রমানাথ রায় ঠিক এতখানি যান্ত্রিক এক জগতের গল্প শুনিয়েছিলেন এখন থেকে প্রায় ষাট বছর আগে। সেখানে একাধিক যুবতী নারী আছে,  তাদের তুলতুলে হাত আছে, তাদের গালে চুমু খাওয়ায় অধিকার আছে কিন্তু তাদের প্রেম নেই। তাদের ভিন্ন পরিচিত‌ও নেই। একটাই নাম তাদের--- টিনা। তারা কোনো স্বপ্ন দেখায়‌ না, দেখেও না।  পরিদের মতো ডানাওয়ালা যুবতীও  মেলে  কিন্তু মনে পড়ে ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ আর দু-বোনের প্রতীক্ষার কথা । তখন যুবতীটির সঙ্গে  ডানায় চড়ে পাহাড় কিংবা সমুদ্র দেখে আসার ইচ্ছে চলে যায়।  এই গল্পে কোনো রোমান্টিক ভাবালুতা নেই, প্রেমের পেলবতা নেই, যৌনতার আনন্দ নেই।  একটা পারিবারিক জীবনের ছবি আছে কিন্তু তা বেশ ভাঙাচোরা। মা রোগে কাতরায়, দিদি তার স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে না পেরে ফিরে আসে, ছোটো বোন দেখতে তেমন ভালো নয় বলে বিয়ে হয় না। তাই একটা বিষণ্ণতা সংসারের চারটি মানুষকে ঘিরে রাখে । আর দশ প্যাকেট বিস্কুটের বিনিময়ে চুক্তির যে কেনা ভালোবাসা, তা  ঠিক দু ঘণ্টা পরে, একবার‌ও পিছন ফিরে না তাকিয়ে  চলে যায়। বাস্তব ও ফ্যান্টাসি মিশিয়ে এমন‌ই এক গল্পের জগৎ সেদিন তৈরি করছিলেন রমানাথ।


           'কারণ অজ্ঞাত' গল্পে একটা চমৎকার পারিবারিক ও সামাজিক ছবি আছে । সে ছবি বেশ নিখুঁত ও নিটোল কিন্তু পাঁচুর রাগ  দুদিন পরেও না পড়াতে সেই ছবিটাই  দ্রুত এলোমেলো হতে শুরু করে। চারপাশের মানুষজনের ভিতরের চেহারাটা বেরিয়ে আসে। পাঁচুর রাগের প্রকৃত কারণ কেউ জানে না আর তাই সবাই ভাবে  তার উপরে  রাগ করেই পাঁচু কথা বলছে না । বাজারের যে  আলুওয়ালা, পেঁয়াজওয়ালা, মাছ‌ওয়ালারা বহুকাল ধরে পাঁচুকে ওজনে ঠকিয়ে আসছে, তারা এবার ঠিকঠাক ওজন দেওয়া শুরু করে। অফিসের বড়োকর্তা পাঁচুর  যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বঞ্চিত করে অযোগ্য শিবপ্রসাদকে প্রমোশন দিয়েছে কারণ সে  ইলিশ ও ট্যাংরা খাইয়েছে এবং  মদের বিল‌ও মিটিয়েছে। কিন্তু পাঁচুর রাগী মুখটা দেখে বড়োকর্তা ভাবে এবার পাঁচুর জন্যে কিছু একটা করতেই হবে । পাঁচুর ব‌উ ভাবে পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে  যোগাযোগ রাখার খবরটা  পাঁচু নিশ্চিত জেনেছে আর তাতেই এমন রেগে আছে। সে ঠিক করে এবার থেকে সে শুধু পাঁচুকেই ভালোবাসবে। পাঁচুর আত্মীয়স্বজন থেকে পাড়ার ক্লাবের কর্মকর্তারা পর্যন্ত  নিজেদের ভুল শুধরে নেবার কথা ভাবে। শেষ পর্যন্ত পাঁচুর ঘরে বাড়ির ও পাড়ার মহিলারা একসঙ্গে সোচ্চারে কান্না জোড়ে । তা দেখে পাঁচু হেসে ফেলে এবং চারপাশের মানুষজন আবার তাদের পুরোনো চরিত্রে ফেরে। রমানাথ রায়ের এই গল্পের শেষে পাঁচুর চারপাশের লোকজনদের মধ্যে আর কোনো আত্মগ্লানি নেই। পাঁচুর‌ও  রাগ নেই, বরং সে হাসছে। সব মিলে যা তৈরি হয় তা হলো ব্ল্যাক হিউমার। ডুবন্ত জাহাজের নাবিক, শত্রুপক্ষের কামানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক, ফাঁসির আসামির  কোনো কোনো কথা ও কাজে এই হাসি জন্ম নেয়।

           'ফু' গল্পের কথক কোনো একজনের কাছে বলেছিল যে তার জ্যাঠামশাই মিথ্যেবাদী। কেউ একজন সে কথা তার মুখ্যমন্ত্রী জ্যাঠামশাইয়ের কানে তুলে দেয়। তাতেই কলকাতার সরকারী দপ্তর থেকে ষোলো বছরের জন্যে নির্বাসিত হয়ে কুচবিহার, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জায়গায় ঘোরা। আবার জ্যাঠামশায়ের কৃপাদৃষ্টিতে কলকাতায় ফেরা এবং মনের আনন্দে চাকরি করা, ব‌উ মিনুর সঙ্গে সিনেমা দেখা, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাতায়াত করা। কিন্তু হঠাৎ একদিন জানলার কাছে দুর্গন্ধ পাওয়া গেল এবং দেখা গেল একটা মরা কুকুর পড়ে আছে। তারপর কুকুরের সঙ্গে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কর্পোরেশনে যোগাযোগ করে, পুলিশে খবর দিয়ে, এমনকী মুখ্যমন্ত্রী জ্যাঠামশাইকে বলেও কাজ হয় না। শেষে জ্যাঠামশাই প্রমাণ চেয়ে বসেন। একটার পর একটা প্রমাণ দিতে দিতে হঠাৎ দেখা গেল  'জ্যাঠামশাইয়ের চেয়ারে আমি বসে আছি আর আমার চেয়ারে জ্যাঠামশাই বসে আছেন।' জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে 'আমি কখন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেছি।' তখন  জ্যাঠামশাইয়ের মুখে রাস্তায় দুর্গন্ধ, বিনা চিকিৎসায় মানুষজনের মৃত্যু, বেকার সমস্যা,খাদ্য সমস্যা, মেধাহীনতা ইত্যাদি নানা অভিযোগ আর  ভাইপো সে সব অভিযোগের প্রমাণ চায়। জ্যাঠামশাই টেবিল চাপড়ে 'ফুঃ' বলেন আর মুখ্যমন্ত্রী ভাইপোও টেবিল চাপড়ে 'ফুঃ' বলে। রমানাথ রায় সেদিন বাংলা কাহিনির প্রচলিত বিন্যাস  এবং চরিত্রের নির্মাণকে ঠিক  এতখানিই ওলটপালট করে দেন। গল্পের মানুষজনের মধ্যে ভালোমন্দের কোনো ভাগাভাগি নেই। রমানাথ বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন না কিন্তু তার পরিচিত তাত্ত্বিক গড়নকে একেবারেই আমল দেন না।


           নিজের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপে নিজেকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, 'কাকে চাই?' দু-চার কথার পর জানা যায় যে শুধু ফ্ল্যাট‌ই বেদখল হয়নি, যার সঙ্গে থাকত সেই বিবিও বেদখল হয়ে গেছে। যে এখন ফ্ল্যাটের দখল নিয়েছে সেই বলাই দত্তের  সঙ্গে বিবি এখন স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকে। থানায়  গিয়ে অভিযোগ করাতে জানা গেল বলাই দত্ত রাজনৈতিক লোক এবং সব অর্থেই বেশ ক্ষমতাবান। তবু পুলিশ ফ্ল্যাটে যায় এবং বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে আর ভাড়ার রসিদ দেখে বলাই দত্তকে ফ্ল্যাট থেকে বার করে দেয়। সে সঙ্গে বিবিও বেরিয়ে যায় কারণ সে বলাই দত্তকে ভালোবাসে। অবশ্য বলে রায় বলাই দত্তের সঙ্গে ভালো না লাগলে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু ফেরার সে পথ বন্ধ করতে নতুন মেয়ের সন্ধান করে কিন্তু কেউ কালো, কেউ ঢেঙা, কার‌ও আবার কোমর মোটা। সে তাদের বাতিল করে আবার কেউ কেউ তাকেও বাতিল করে কারণ সে বেঁটে ও কালো। শেষ পর্যন্ত বিবি‌ই ফিরে আসে কারণ বলাই দত্তের সঙ্গে তার থাকতে ভালো লাগল না। মনে হলো সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেল। কিন্তু আবার অফিসের কাজে বাইরে থেকে ঘুরে এসে দরজার কলিং বেল টেপার পর সেই এক‌ই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়---কাকে চাই? তবে এবার শুধু বলাই দত্ত নয়, তার পিছনে আছে বাড়ির মালিক, অন্য প্রতিবেশী এবং পুলিশ‌ও। রমানাথ রায়ের এই গল্পের শুরু ও শেষে একটাই প্রশ্ন শোনা গেছে ---কাকে চাই ?  কে যে  ঠিক কাকে চায় তার নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই।  যাকে চায় সে  বিবি হতে পারে, ঝুমা হতে পারে, হেমা হতে পারে, চাঁপা হতে পারে।  আবার অন্য কেউ হলেও ক্ষতি নেই। উল্টোদিকে বিবি বা ঝুমারাও যে নির্দিষ্ট কাউকে চায়, এমন‌ও নয়।  কখন‌ও জৈবিক একটা সম্পর্ক, কখন‌ও অর্থনৈতিক একটা নিরাপত্তা একজন মানুষকে আর একজনের কাছে এনে ফেলে। এমন‌ই ক্ষণস্থায়ী কিছু অসম্পর্কে বাঁচা। ঘরের বাইরে গেলে আবার সেখানে ফেরাও অনিশ্চিত। আত্মকেন্দ্রিক ও নিরাশ্রয় এক জগতের অনাসক্ত  বিবরণ লিখলেন রমানাথ। সে বিবরণের একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো গল্পকার সেখানে দর্শক মাত্র। রমানাথ অনেক বেশি চরিত্রগুলির  সংলাপের উপর জোর দিলেন । ফলে গল্পকার‌ অনেক অনাবশ্যক দায় থেকে মুক্তি পেলেন।

           পুষ্কর দাশগুপ্ত তাঁর একটি লেখায় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে  তাঁদের অভিনব  স্টল সাজানোর কথা লিখেছিলেন। হাতে টাকা কম বলে তেমন ভাবে কিছু করে উঠতে পারেননি তবে হঠাৎ একটা মাটির ঘট পেয়ে যান।   সেটাকে সাজিয়ে স্টলে রাখবেন বলে রমানাথ রায়কে একটা ডাব আনতে বলেন কিন্তু কলেজ স্ট্রিট বাজারে গিয়ে রমানাথ দেখেন সব ডাব বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি অবশ্য ফাঁকা হাতে ফেরেননি। একটি এঁচড় কিনে নিয়ে যান এবং সেটাই ঘটের উপর রাখা হয়।  মঙ্গলঘটের প্রতীকটি এভাবে ভেঙে যাওয়াতে  স্টলে আসা মানুষজনের অনেকেই চটে যান।  রমানাথ বাংলা গল্পে ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন। কাহিনি, চরিত্রায়ণ, দায়বদ্ধতা, জীবনদর্শন, মহত্ত্ব ইত্যাদি মঙ্গলচিহ্নগুলিকে বিসর্জন দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের ঘটে এঁচড় চড়িয়েছিলেন।  ঘটটা সংগ্রহ করেছিলেন পুষ্কর দাশগুপ্ত কিন্তু মেলার মাঠে ঘটটা কে ছেড়ে এসেছিলেন, সেটা একটা প্রশ্ন। মার্ক টোয়েন, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়,  শ্রীরামকৃষ্ণ, সুকুমার রায়, পরশুরাম থেকে অঁতোন্যাঁ আর্তোর মধ্যে যে কেউ এটা করতে পারেন আবার তাঁরা একসঙ্গে গিয়েও রেখে আসতে পারেন।‌ তবে সে ঘটের মাথার এঁচড়টা যে  রমানাথ রায়‌ই বাজার থেকে কিনে নিয়ে যান,  এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। একজন লেখকের প্রধান কাজ‌ই তো হলো  প্রচলিত প্রতীক ও চেনা রীতিকে ভেঙে ফেলা।



রামকুমার মুখোপাধ্যায় 

ব্যস, আর কিচ্ছু নয় ।