ছবিটি বিবক্ষিত ২০১৭ প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ থেকে গৃহীত |
পশ্চিমবঙ্গের মধ্য-গগনে আরও একটি নির্বাচনের
ফুটিফাটা বিকিরণ। করোনা অতিমারির নির্মমতাও জাঁকিয়ে বসেছে সেই নির্বাচনী তরঙ্গের
প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে। ভারতের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের একটি
অঙ্গ-রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের মুখ্য ইস্যুগুলো ঠিক কী হওয়া বাঞ্ছনীয়, ভোট সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোর
কাছে তা নিয়ে ভাববার আর ফুরসৎ কোথায়! বরং, বিভাজনের রাজনীতির
পরিখা টেনে যেনতেন প্রকারে ভোট বৈতরণী পার হওয়াই অনেক বেশি বাস্তবসম্মত! একবার
ভোটে জিতে ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলেই তো জড়সড় জনতাকে শাসকের মেজাজে অঙ্গুলি
নির্দেশ করে গণতন্ত্রের দায় কড়ায়-গণ্ডায় মেটানো যাবে। তাতে চুলোয় যাক না ‘জনগণের
দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের জন্য সরকারের’ মার্গ দর্শন!
ক্ষমতার আস্বাদের নাগাল পেতে দর্শন তত্ত্বের মোড়কে আচ্ছাদিত রাজনীতির প্রচ্ছদটা না
হয় তোলা থাক ফুরফুরে বাসন্তী সন্ধ্যার টেলিভিশনের ‘টক শো’র ঝকঝকে পর্দার জন্য! ভরে
যাক না বীভৎস পাঁকের গিজগিজে ভিড় রাজনীতির পাঠ্যপুস্তকের বাকি পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে!
রাজনীতির কুশীলবরা বিলক্ষণ জানেন, তবু জনগণ ভোট দেবেন। সেই
মানুষ বা সেই দলটিকেই দেবেন, যার বা যাদের কোন গঠনমূলক
রাজনৈতিক দিশা নেই, নৈতিকতার কাছে দায়বদ্ধতার কোন অঙ্গীকার
নেই, ভোট আদায় করে অঞ্চলের কেষ্টবিষ্টু বনে যাওয়া ব্যতীত
অন্য কোনো জনহিতকর অভিপ্রায় নেই। জনতা-জনার্দনের স্বল্পমূল্যের সামাজিক ও
অর্থনৈতিক জীবনে মৌলিক কোন পরিবর্তন আনার পরিকাঠামোগত কোন পরিকল্পনা ভাঁড়ার নেই।
কিছু ভোট সম্মোহনী প্রকল্প ঘোষণা করতে পারলেই উদ্দাম প্লাবনে ভোট বাক্স উচ্ছ্বাসে
উপচে পড়বে যে! আর তাতে সাঙ্গোপাঙ্গদের জন্য নিশ্চিত ‘কাট মানির’ বন্দোবস্ত হয়ে
যাবে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই। স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরেও রাজ্য তথা দেশের
গণতন্ত্রের চালচিত্রটা কমবেশি এই রকমই হয়ে থাকবে? নাকি মনুষ্য হিসেবে বেঁচে থাকার তাগিদে রাজনৈতিক বাতাবরণের
মৌলিক পরিবর্তনের আশু প্রয়োজন? এই নিয়ে ভাবার মতো কোন উপায়
আছে কি দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার দৌড়ে পিলপিল করে ছুটে চলা আমজনতার হাতে!
আজকের সময়টা যেন এক নির্মম কালবেলা! প্রথম
পর্বের করোনা অতিমারির করাল দংশন কোনক্রমে সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর সন্ধিক্ষণেই করোনার
দ্বিতীয় ঢেউয়ের নিষ্ঠুর চপেটাঘাতে ভারতবর্ষ ভয়ংকর ভাবে বিধ্বস্ত। বিগত বারোমাস
সময়কালে রাজ্য তথা দেশের আর্থনীতিক অবস্থা প্রায় জরাগ্রস্ত। অগুন্তি প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকা চরমভাবে বিপর্যস্ত। দেশের রাজপথ, গলিপথে
ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে অগনিত কর্মচ্যুত মানুষজন। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের
তাণ্ডব রাষ্ট্রের চরম উদাসীনতা এবং অক্ষমতাকে চরমভাবে নগ্ন করে ফেলেছে। হাসপাতালে
খালি শয্যা নেই। অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ নেই। অক্সিজেনের চরম আকাল। সব মিলিয়ে এ-যেন
এক ঘোর দুর্দিন। এমনই এক বিরল সংকটকালে ভারতের এক অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী
প্রতিশ্রুতি ঠিক কি কি হওয়া সমীচীন ছিল? ধর্মীয় মৌলবাদের
ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতির জাল বুনে ভোট শিকার? শ্রেণী
বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে জাতপাতের ভিত্তিতে, বর্ণের
ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে সমাজে অধিকতর বিভাজনের রূপরেখা
টেনে ভোট আদায়? নাকি এই নির্বাচনের মুখ্য দিশা হওয়ার
অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা, শিক্ষা
প্রসারের অঙ্গীকার, নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি, কর্ম সুরক্ষার গ্যারান্টি, শান্তি ও সুশাসনের আশ্বাস?
কিন্তু কোথায় কী! করোনা অতিমারীর বিধ্বংসী আক্রমণের পরেও আসন্ন
নির্বাচনের মূল ইস্যুগুলো কিন্তু পাক খাচ্ছে সেই পরিকল্পিত বিভাজিত সমাজের
প্রতিচ্ছবির ঘূর্ণাবর্তেই! প্রধান যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের ঝকঝকে প্রচ্ছদ
পৃষ্ঠায় যাই জ্বলজ্বল করুক না কেন, অন্তঃসার জুড়ে ক্রমেই
স্পষ্ট হয়ে উঠছে সমাজ বিভাজনেরই সুড়সুড়ি। প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের ‘কোট-আনকোট’
মুখ্য অ্যাজেণ্ডাই হল ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং তাদের
টার্গেট ভোটার হল দেশ ও রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষজন। অন্যদিকে, প্রধান অপর
একটি রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক টার্গেট ভোটার হল রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের মানুষেরা। শুধু তাই নয়, তারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিভাজনের গুপ্ত কার্ডটি
অবলীলায় খেলে যাচ্ছেন অলীক জনহিতের মোড়কে। কখনও তা বর্ষিত হচ্ছে পূর্ববঙ্গ থেকে
অভিবাসিত মতুয়া তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্য করে। কখনও বা উত্তরবঙ্গের
পিছিয়ে পড়া রাজবংশী তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষদের হিতের ভাবনাকে পুঁজি করে। এমনকি
সংসদীয় গণতন্ত্রে টিকে থাকার অমোঘ তাগিদে মার্ক্সবাদী আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা
রাজনৈতিক দলগুলোও এই আদর্শচ্যুতির চক্রব্যূহ থেকে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে
পুরোপুরি বাইরে রাখতে পারছে না। অথচ এই সকল রাজনৈতিক দলগুলোর
পতাকা জুড়ে গণতন্ত্র, প্রগতি,
দেশপ্রেমের প্রবল আস্ফালন। কিন্তু তাদের গুপ্ত আস্তিন বোঝাই কেবলমাত্র
ভোট বৈতরণী পার হওয়ার গুচ্ছ-গুচ্ছ ভোট সম্মোহনী অ্যাজেণ্ডা! সংসদীয় গণতন্ত্রে
ক্ষমতার আস্বাদ পেতে কারই বা দায় পড়েছে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন ও উন্নতিসাধনের
স্বার্থে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার!
এমনই এক রাজনৈতিক বাতাবরণকে আমরা বহন করে চলেছি, যার মুখমণ্ডল গণতন্ত্রের
নিশ্চয়তা, সাম্যের প্রতিষ্ঠা, প্রতিহিংসাপরায়নতা
বর্জনের অঙ্গীকার, জনহিতকর কর্মকাণ্ডের ঢালাও প্রতিশ্রুতির
বর্ণময় রঙে রঞ্জিত। কিন্তু অন্তঃসার জুড়ে লুক্কায়িত গণতন্ত্র হত্যার শাণিত গুপ্ত
অস্ত্র, অসাম্য বজায় রাখার গুপ্ত মন্ত্র, প্রতিহিংসা পরায়নতায় ভরপুর গূঢ় রাজনৈতিক হৃদয় এবং জনহিতকর কর্মকাণ্ডের
অন্তরালে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার গুপ্ত অভিপ্রায়। নইলে কেনই বা মরীচঝাঁপি
গণহত্যার এতদিনেও বিচার হল না! কেনই বা নেতাই গণহত্যা অবলীলায় ঘটে যায়! কেনই বা
অম্বিকেশ মহাপাত্র কিংবা শিলাদিত্যকে তুচ্ছ কারণে হাজতবাস করতে হয়! কেনই বা
জাতিদাঙ্গার কলঙ্কিত খলনায়করা দেশনায়কের মর্যাদা পান! কেনই বা হাসরথের মেয়েটির
পোড়া মাংসের গন্ধকে ছাপিয়ে শাসকের হুঙ্কারে দেশের আকাশ বাতাস ছেয়ে যায়! ভোটের পর
ভোট আসে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে প্রশাসনিক মেরুদণ্ডের
আস্তিনে জড়িয়ে দেওয়া হয় রাজনৈতিক অভিসন্ধির গন্ধ মাখা রঙিন পালক। শাসক দলের অনুকম্পা ব্যতীত প্রশাসনের ডালপালাগুলোও স্থবির থেকে যায়। প্রতিবাদ মুখর কতিপয় আমজনতা বনে যান হয় শহুরে নকশাল, নয়তো দেশদ্রোহী। গণতন্ত্রের
মুখ কেবল জ্বলজ্বল করে ওঠে ঝকঝকে স্টুডিওর ঝলমলে রূপালী পর্দা জুড়ে। আর গণতন্ত্রের
ক্ষয়িষ্ণু শরীর বেয়ে গলে পড়ে কালাহাণ্ডি বা আমলাশোলের বুভুক্ষু মানুষগুলোর ক্ষীণ
দীর্ঘশ্বাস। কিংবা কামদুনীর অভাগী মেয়েটির করুণ আর্ত চিৎকার। অথবা উন্নাওয়ের নির্যাতিতার অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অসহনীয় রক্তস্রোত। এতকাল ধরে
ক্রমাগতভাবে ঘটে চলা এতকিছুর পরেও ছাপোষা জনতা জনার্দন তবু অবিরত পাক খেতে থাকে
ভোট বাক্সের ঘূর্ণাবর্তের অমোঘ ইশারার টানেই! প্রশাসনকে নিজস্বার্থে ব্যবহার, পেশীশক্তির আস্ফালন ও ভোট
সম্মোহনী অ্যাজেণ্ডাগুলোর মিলিত শক্তি ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ জয় ছিনিয়ে এনে নির্বাচিত
করে দেশ এবং রাজ্যের সরকার। তন্দ্রাচ্ছন্ন গণতন্ত্রের প্রগাঢ় নীরবতা ঝুপ করে নেমে
এসে ভিড় করে গেরস্তের সহিষ্ণু পাঁজরে।
No comments:
Post a Comment
We are waiting for your opinion. Please Comment.
Thank You.