Wednesday, April 28, 2021

সেবক, অবহেলিত এবং এক অভিমানী রাজপুত্র

 লিখেছেন 

সু বী র বি শ্বা স

ছবি উইকিপিডিয়া থেকে গৃহীত

বাবার ইচ্ছেয় বিদেশ থেকে কৃষিবিদ হয়ে তিনি শিলাইদহে তৈরি করেছিলেন প্রশস্ত ক্ষেত-মাটি পরীক্ষার ল্যাবরেটরি। আমদানি করছিলেন ভুট্টার। একইসঙ্গে গৃহপালিত পশুর খাওয়ার উপযোগী ঘাসের বীজও এসেছিল। দেশীয় উপাদান ও প্রযুক্তিতে লাঙল, ফলা ও আরও নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করিয়েছিলেন। বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন একটা ট্রাক্টর। নিজেই চালাতেন সেটা। তিনি আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে মৃণালিনী দেবী ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তখন এই বিয়েতে রাজি হননি রবীন্দ্রনাথ। অন্যত্র বিয়ে হয় প্রতিমা দেবীর। ভাগ্য বিপর্যয়ে অতি অল্প সময়ে প্রতিমা দেবী বিধবা হন। ১৯১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি পিতার ইচ্ছায় সেই বাল্যবিধবা প্রতিমার সঙ্গেই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়। ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসে এর আগে বিধবা বিবাহ হয়নি, এই প্রথম। 

বিয়ের কিছুদিন পরে পাঁচ বছরের ছোট প্রতিমা দেবীর সঙ্গে শিলাইদহে সংসার জীবনের শুরু। যদিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এই সুখের জীবন। বাবার ইচ্ছায় তাঁকে সেই গোলাপের বাগান, সুদূরবিস্তারী ক্ষেত, পদ্মা নদীর বুকে সুখ-দুঃখের কাহিনি-ভরা বজরা ছেড়ে বীরভূমের ঊষর কঠিন লাল মাটির প্রান্তরে আসতে হল। 

স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক প্রথম থেকেই খুব একটা সহজ ছিল না। বেশ স্পষ্ট করে রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে তাঁর অন্তর্মুখী স্বভাবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে, স্ত্রী যেন তাঁর লাজুক স্বভাবকে স্বাভাবিক করে তোলার দায়িত্ব নেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, না পারলে প্রতিমা দেবীকে চিরকাল কষ্ট পাওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। 

প্রকৃত শিল্পী মনের মানুষ রথীন্দ্রনাথ বাবার অতি-বিখ্যাত হওয়ার কারণে বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক কাজকর্মে এবং বাবার একান্ত সচিব হয়েই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে আসা বিদগ্ধ লোকজনের দেখাশোনা করা, বাবার বিদেশযাত্রার সঙ্গী হওয়া তাঁর জীবনের অনেকটা সময় নিয়ে নিয়েছে। বহু বছর ছিলেন বিশ্বভারতীর  কর্মসচিব। বুঝতে পারছিলেন, বিশ্বভারতীর কাজ তাঁকে আর আনন্দ দেয় না, নৈতিক কর্তব্য পালনের তাগিদেই সে-কাজ করে থাকেন শুধু। বিশ্বভারতী  ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়, রথীন্দ্রনাথ তার প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন। ক্ষমতার রাজনীতি আর নিয়মের ঘেরাটোপ তাঁকে ক্রমশ হতাশ করে তুলেছিল। ব্যক্তিগত আক্রমণ আর কুৎসা তাঁকে আরও বেদনাদগ্ধ করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, যদিও আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিশ্বভারতীর দৈনন্দিন কাজকর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যাধিক হস্তক্ষেপে আচার্য জহরলাল নেহরু বিরক্ত হয়েছিলেন এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে সতর্ক করেছিলেন। আশ্রমের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী মীরার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের প্রথা-ভাঙা অন্তরঙ্গতা বিষয়ে শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। এইসময় প্রতিমা দেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। বাক্যালাপ ছিল না বললেই চলে। উপাচার্য থাকাকালীন তিনি একবার মীরা দেবীকে নিয়ে হাজারিবাগ বেড়াতে গিয়েছিলেন। বোম্বের এক  ট্যাবলয়েডে, নামোল্লেখ না করে, এই ঘটনা ছাপা হয়। সবমিলিয়ে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। 

প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত রথীন্দ্রনাথ তখন নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী একত্রিশ বছরের ছোট মীরাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলেন। শোনা যায়, আচার্য জহরলাল নেহরু নির্মলচন্দ্র আর মীরাকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেওয়ার মৌখিক পরামর্শ বাতিল করেন। উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ শরীর খারাপের অজুহাতে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও পলায়নী মনোবৃত্তি নয়, নিজেকে আবিষ্কার করার বাসনা নিয়েই তিনি  শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাচ্ছেন। তিনি মিশ্রমাধ্যমে বহু ল্যান্ডস্কেপ আর ফুলের ছবি এঁকেছিলেন। চামড়ার উপর কারুকাজ এবং দারুশিল্পেও দক্ষ ছিলেন। আসবাবপত্র, স্থাপত্য নির্মাণ, উদ্যান পরিকল্পনা এবং রূপায়ণে অনন্য পারদর্শী ছিলেন। বিভিন্ন ফুলের আতর আর সুগন্ধি পাউডার তৈরি করতে জানতেন।  ‘Arty Perfume’ নামে এই সমস্ত উপকরণ বাজারে বিক্রি হত। ঘরোয়া স্তরে জ্যাম, জেলি, আচার আর দই পাতায় নৈপুণ্য ছিল তাঁর। মৌমাছির  চাষ জানতেন, নেশা ছিল শিকারেরও। ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক ধারা তাঁর মধ্যেও ছিল। ভাল গান গাইতেন, বাজাতেন এস্রাজ। 

ইংরেজিতে “On the Edges of Time” বইটি লিখেছিলেন। অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। শেষে তিনি একবারের জন্য হলেও নিজের মতো করে বাঁচতে চাইলেন। ১৯৫৩ সালে নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের পূর্ণ সম্মতিতে মীরাকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ছাড়লেন এবং দেরাদুনে থিতু হলেন। যাওয়ার আগে প্রতিমা দেবীকে রথীন্দ্রনাথ লিখলেন , ‘‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’’ দেরাদুনে থাকাকালীন স্ত্রী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন রথীন্দ্রনাথ। 

১৯৬০ সালে বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে প্রতিমা দেবীকে  লিখেছিলেন, ‘‘আমরা দু’জনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারও প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা (শোভনীয়) হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনও রাগ নেই— আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’’ 

শেষ আট বছর মীরাকে নিয়ে দেরাদুনে কাটিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৭.১১.১৮৮৮ – ৩.৬.১৯৬১)।

 

তথ্যঋণ: 

  • পিতৃস্মৃতি (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
  • আপনি তুমি রইলে দূরে: সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ (নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)
  • আনন্দবাজার পত্রিকা
  • রবীন্দ্রবর্ষপঞ্জি (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)

সুবীর বিশ্বাস - প্রাক্তন ব্যাঙ্ক আধিকারিক। তাঁর স্কুল জীবন কেটেছে দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলের খড়িবাড়ি চা বাগানে, কলেজ জীবন শিলিগুড়িতে। রাজ্য সরকারি কর্মচারী হিসেবে চাকরি জীবন শুরু। তিন দশকের বেশি ব্যাঙ্কে চাকরি করে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। কলকাতায় থিতু। কিন্তু তাঁর এই পরিচয় যথেষ্ট নয়। তিনি প্রকৃত অর্থে একজন দীক্ষিত পাঠক। আজীবন সঙ্গী বইপত্র। সাহিত্যের গলি-ঘুপচি ঘুরে জীবনের রসাস্বাদনেই তিনি তৃপ্ত। তাঁর লেখনী সেখানে কখনও নম্র, কখনও দৃপ্ত। বিবক্ষিত'র পাতায় এই তাঁর প্রথম নিবন্ধ। পাঠক তাঁর জ্ঞানের উদ্ভাসে আলোকিত হবেন - এমন আশা আর কাল্পনিক নয়।  


2 comments:

  1. স্বল্প আয়তনে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দ্বন্দ্ব-মধুর পরিচয় ফুটে উঠেছে রচনাটিতে। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. স্বল্প আয়তনে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দ্বন্দ্ব-মধুর পরিচয় ফুটে উঠেছে রচনাটিতে। ভালো লাগলো। (শুভজিৎ পাত্র)

    ReplyDelete

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.