তনুকনক
[ বিবক্ষিত ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত ]
ওর সঙ্গে কেউ মেশে না । ও একটা দ্বীপে জন্মেছিল । একজন নাবিক জাহাজ
ডুবি হয়ে সেই দ্বীপে আসে । ওই দ্বীপে একজন তপস্বিনী সাধিকা বহুবছর তপস্যারতা ছিলেন
। নাবিকের সঙ্গে সেই সন্ন্যাসিনীর প্রেম হয় । ছেলেটি সেই নাবিক ও সন্ন্যাসিনীর
প্রেমের ফুল । সে ওই দ্বীপে জন্মেছিল । পরে সে যখন পরিণত হয়, বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স,
সে সময় সে এই ছোট শহরে আসে । ততদিনে ওর মা বাবার এক সামুদ্রিক ঝড়ে দেহান্ত হয়েছে ।
বুড়ো ফাদার জনকে সে বলেছিল তার জন্মরহস্যের কথা । পেটে কথা থাকে না বুড়ো ফাদারের ।
কথাটা রাষ্ট্র হয়ে যায়। তাই,ওর সাথে পারতপক্ষে মেশে না এখানে কেউই । সবাই বলত ওর
জন্মের ঠিক নেই।
“ছি, ছি! কোথাকার একটা
নাবিক সন্ন্যাসিনীর ধর্মনাশ করেছিল। তাদের থেকেই জন্ম লোকটার—ওর সঙ্গে মেশাও পাপ!”
“ওকে দেখাও পাপ! দেখলে স্নান না করে আর ঘরে যেতে নেই। বেজন্মা!”
“অপয়া! অপয়া! এ লোকটাকে দেখে যাত্রা শুরু করলে অমঙ্গল হবেই।”
এরকম গুঞ্জনে গুঞ্জনে বিষাক্ত শব্দে ভরে যেত দ্বীপের বাতাস।
মানুষটির হাবভাবও বড় অদ্ভুত । সে কথা বলে পাখিদের সাথে,
প্রজাপতিদের সাথে, আকাশের সাথে । ঘরে পিচবোর্ড দিয়ে মুখোস বানিয়ে বাজারে বিক্রি
করে । অনেক ভেবেচিন্তে পেট চালাবার জন্যে সে এই পেশা বেছে নিয়েছিল । এ শহরে
মুখোসের চাহিদা অনেক, সে তত যোগান দিতে পারে না । যা পারে, তাতেই কষ্টেসৃষ্টে দিন
কেটে যায় লোকটার । ঘরে ফিরে বিকেলবেলায় ধূলট লাল মাঠের ধারে এসে বসে । আর আকাশ
থেকে নেমে আসে নানা রঙের পাখি, ওর কাঁধে, পিঠে, মাথায় এসে বসে । লোকটা পাখিদের
সাথে গল্প করে । সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় দূর থেকে দেখা যায় তাকে, সারা গায়ে পাখিরা
উড়ে এসে বসেছে, সে তাদের সাথে কথা বলছে, কথা বলছে ...
পাখিরা বলে, “গল্প বলো, পথিক!
“আমি কী জানি যে বলব?
“তুমি বলবে সেই দ্বীপের কথা, যেখানে তুমি জন্মেছিলে...সবুজ সেই
সমুদ্রের তরঙ্গের মাঝে ভেসে থাকা প্রবালের দ্বীপ!
“সে সব আমি ভুলে গেছি।
“তবে তুমি মনু নদীর গল্প বলো। মনু নদী। মন নদী।
“মনু নদী? সে কোথায়?”
“তুমি মনু নদীর কথা জানো না? উত্তরে, আরও উত্তরে!
অবশেষে একদিন সে মনু নদীটির প্রেমে পড়ল । নদীর তীরে ঘাসে শুয়ে শুয়ে
সে গান বুনত, ছবি গড়ত । সেসব গান, সেসব ছবি সে বাজারে বিক্রি করত না । শুধু নদীকে
শোনাতো, তারপর নদীর জলে ছিঁড়ে ফেলে দিত । নদী সেই সব গান, সেই সব ছবির খণ্ডগুলিকে
স্রোতে বহে নিয়ে যেত কলকল কলকল...
Google Images |
নদীর স্রোতের ভিতর নিজের ছায়া দেখতে দেখতে মানুষটা একদিন দেখল তার
মুখ দুভাগ হয়ে যাচ্ছে । সে দেখতে পেল তার হারানো মা-বাবাকে, সেই নাবিক ও সেই
সন্ন্যাসিনী, যারা দ্বীপভূমির নির্জনে একদিন তাকে পৃথিবীতে ডেকে এনেছিল
প্রণয়ব্যথায় জর্জর হয়ে । সৃষ্টির প্রথম ভ্রাতা যেভাবে মিলিত হয়েছিল সৃষ্টির প্রথম
ভগিনীর সাথে, সেভাবেই সেই দ্বীপখণ্ডে নাবিক ও তপস্বিনী, দুটি আদিম ভাইবোনের মত
গভীর ভালোবাসায় তাঁদের তনুকনকের সাথে তনুকনকের বিঘর্ষণে এই মুখোসবিক্রেতা মানুষটির
পিতামাতা হয়েছিলেন ।
নদীর জলতলে লোকটি তার নিজের সৃষ্টিরহস্যের প্রথম আখ্যায়িকাটি দেখতে
পেয়ে নদীর জলের মধ্যে আনন্দবিহ্বলতায় লীন হয়ে গিয়েছিল এক পূর্ণিমার চাঁদভাসি
রাত্রে ।
তার আর খোঁজ মেলেনি । শুধু পরের দিন ভোরবেলায় শহরের লোকেরা দেখেছিল
নদী বেয়ে ভেসে যাচ্ছে মানুষটির নিজের হাতে বানানো একটার পর একটা মুখোস ।
No comments:
Post a Comment
We are waiting for your opinion. Please Comment.
Thank You.