Wednesday, June 10, 2020

সায়ন্তন মাইতির প্রবন্ধ

‘ওরিয়েণ্টেশন’ কোনো লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নয়


[২০১৭ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত]

অনেকদিন ধরেই একদল মানুষের দাবী উঠেছে, LGBT থেকে ‘T’-কে বাদ দেওয়া হোক। আরেকদল বলছেন, শুধু LGBT নয়, তার সাথে ‘Q’ অর্থাৎ Queer যোগ করে সম্প্রদায়টার নাম LGBTQ দেওয়া হোক। কেউ আবার ‘Intersex’ ‘Asexual’ জুড়ে নাম দিতে চাইছেন LGBTQIA

একটু তলিয়ে দেখা যাক। ‘T’ এর পুরো কথা ‘Transgender’ (Transsex নয়)। এর মানে কী?

গুগলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, Transgender মানে ‘a person whose self-identity does not conform unambiguously to conventional notions of male or female gender’। অর্থাৎ, জন্মার্জিত লিঙ্গ (ইংরেজীতে Sex), যা নির্ধারিত হয় যৌনাঙ্গ দ্বারা, তার থেকে মনের যৌন পরিচয় (ইংরেজীতে Gender) আলাদা। এর বিপরীত Cisgender। মানে, যাদের জন্মার্জিত জৈবিক লিঙ্গ ও মানসিক যৌন পরিচয় অভিন্ন। এখানে Sex Gender-এর পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, হিজড়া বা আরো বিশেষভাবে অন্তর্লিঙ্গরা (Intersex) ট্রান্সজেণ্ডারের অংশ নন। কারণ, তাঁরা যৌনাঙ্গ নিরীখে ‘Trans’। কিন্তু সংজ্ঞাতে ‘self-identity’ আর ‘gender’ শব্দদুটো আছে।

এবার, শারীরিক লিঙ্গের স্পষ্ট ‘deciding factor’ আছে, যা হল যৌনাঙ্গ (অন্য কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য নয়)। কিন্তু মানসিকতার যৌন পরিচয়ের ক্ষেত্রে কীভাবে নির্ধারিত হবে কোনটা পুরুষত্ব আর কোনটা নারীত্ব?

এই পুরুষত্ব আর নারীত্ব খুব গোলমেলে জায়গা। আমরা এমন একটা সমাজে বড় হয়েছি, যা মানুষের আচরণের ওপর ‘ব্যাটাছেলে’ আর ‘মেয়েছেলে’ নামক দু’ধরনের শীলমোহর লেপে দিয়েছে। আমরা প্রাথমিক বিচারে পুরুষের ক্ষেত্রে বাহ্যিক কাঠিন্য আর নারীর ক্ষেত্রে বাহ্যিক কোমলতাকে প্রাধান্য দিই, তাই ওটাই চোখে পড়ে। যে কোনো মানুষকেই একটু গভীরে গিয়ে চিনতে পারলে তার মধ্যে কাঠিন্য ও কোমলতা দুয়েরই অস্তিত্ব দেখা যাবে। সুতরাং, এমন দাবী করাটা ভুল। এর থেকে আরো বৃহৎভাবে ভাবলে আমরা দেখতে পাব, ‘conventional notions of male or female gender’ এটা স্থান ও কালভেদে অনেক পাল্টে যায়।

তাহলে উত্তর পেতে গেলে সবার আগে দেখতে হবে, হরমোনের প্রভাবে কাদের মধ্যে কোনটা বেশি আছে। যেমন, চেহারা। পেশিবহুল চেহারা পুরুষের যৌন বৈশিষ্ট্য। তার মানে কি মহিলাদের মধ্যে এই চেহারা নেই? যথেষ্ট আছে। কিন্তু যেহেতু এই চেহারার সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় খুব কম, তাই এটাকে আমরা ‘পুরুষালী বৈশিষ্ট্য’ বলতেই পারি। এই বৈশিষ্ট্যটাকে চেহারা না বলে ‘Looks’ বলা ভালো (সঠিক কোনো বাংলা শব্দ ভেবে পেলাম না), কারণ চেহারার মধ্যে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বর্ণ ইত্যাদিও এসে পড়ে এবং সেগুলোকে আমরা কোনো লিঙ্গের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বলতে পারি না।

ভালো করে ভেবে দেখুন, এইভাবে আরো গুটিকতক বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা যায়। কণ্ঠস্বর, Gesture (এর মধ্যে হস্তমুদ্রা, বাচনভঙ্গি, হাঁটাচলা তিনটে পড়ছে) আর সাজপোশাক। এর মধ্যে সাজপোশাক বাদে বাকি তিনটে গৌন যৌন বৈশিষ্ট্য, যেগুলো হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। Looks আর কণ্ঠস্বর জৈবিক বৈশিষ্ট্যের অংশ, Gesture-এর মত ব্যক্তিত্বের অংশ নয়, তবু একে Sex নির্ধারক প্যারামিটারের মধ্যে না রেখে Gender নির্ধারকের মধ্যেই রাখলাম। কারণটা আগেই বলেছি, শারীরিক লিঙ্গের নির্ধারক একমাত্র যৌনাঙ্গ, আর কিচ্ছু নয়।


এখন ব্যাপার হল, এই চারটে বৈশিষ্ট্যের বাইরেও অসংখ্য লিঙ্গ দ্বিভাজন করা যায়। সংখ্যাধিক্য সার্ভে করেই। সেগুলো অন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। পুরুষত্ব আর নারীত্ব বস্তুতই বাইনারি। ড.রীনিতা মজুমদার ও সিমোন ব্র্যাকেটের ‘আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং জেণ্ডার’ বইতে বিশদভাবে লেখা আছে ঠিক কোথায় কোথায় পুরুষত্ব আর নারীত্ব আলাদা। জন গ্রে-র বিখ্যাত উপন্যাস ‘মেন আর ফ্রম মার্স উইমেন আর ফ্রম ভেনাস’ এই বাইনারির ব্যাপারটা অনেকটাই পরিষ্কার করে। আগাথা ক্রিশ্চি বা আর্থার কোনান ডয়েলের গোয়েন্দা গল্পে এমন দৃষ্টান্ত প্রায়ই দেখা যায়, এই কাজটা ছেলেসুলভ আর এই কাজটা মেয়েসুলভ। সে সবই গোয়েন্দার দৃষ্টিতে। আমাদের তার বেশিরভাগটাই বোধের বাইরে। হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অনেক মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। যদি পড়েও বা, তার অনেক আগেই কোনো মানুষের ওপর পুরুষত্ব-নারীত্ব লেপে দেওয়ার কাজটা ঘটে যায়। অর্থাৎ কোনো মানুষ মেয়েলি, না ছেলেলি সেটা আমরা ঐ চারটে বৈশিষ্ট্য দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। তার সাথে একটু বেশি মিশলে চরিত্রে কাঠিন্য, না কোমলতা কোনটা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে, তার বিচারেও করি। কিন্তু এ ছাড়া ব্যক্তিত্বের অন্য কোনো অংশ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে না। সুতরাং সবার আগে এই ধারণাটা গড়ে তোলা দরকার, ‘conventional notion’এর মধ্যে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেখে আর কিছু নেই।১

তাহলে, আমরা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যতেই মনোনিবেশ করি। ঐ চারটে লিঙ্গদ্বৈত-অনুসরণকারী বৈশিষ্ট্যকে সংক্ষেপে বলছি লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য। চারটের নিরীখেই যদি দেখি, তাহলেও অনেক মানুষের মধ্যে কোনোটা পুরুষালী, কোনোটা মেয়েলি পাওয়া যাবে। এমন নয় যে, যে মেয়ের কণ্ঠস্বর ‘পুরুষালী’, তার সাজপোশাকও ‘পুরুষের’ মত কিংবা যে ছেলের হাঁটাচলা ‘মেয়েদের’ মত তাকে দেখতেও ‘মেয়েদের’ মত। অর্থাৎ, চারটে বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সবরকম কম্বিনেশনই সম্ভব। তার মানে এরা কি সবাই Transgender?

সংজ্ঞা অনুযায়ী দেখলে তাই। কিন্তু বাস্তবে যাদের মধ্যে উভয়লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি ‘complex’ অবস্থায় বা ‘diffused’ থাকে, এবং যারা বিপরীত লিঙ্গের ভূমিকায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাদেরই আমরা Transgender বলি। এখানে ‘ভূমিকা’ শব্দটা তাৎপর্যপূর্ণ। কতটা হলে ভূমিকা? শুধু বিপরীত লিঙ্গের মত সাজতে ভালোবাসলেই? কিংবা হাঁটাচলা, হস্তমুদ্রা বিপরীত লিঙ্গের মত হলেই? ...এর কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা এখন অবধি কেউ দিতে পারেন নি। ফলে, সাধারণভাবে আমরা ধরে নিচ্ছি, যাদের জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য চালচলনে ডমিনেট করে তারাই Transgender। (ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যখন কেউ নিজেকে নিজে চিহ্নিত করতে পারবেন যে, তাঁর জৈবিক লিঙ্গের বিপরীত ভূমিকায় থাকতে অনেক বেশি ইচ্ছে করছে, একমাত্র তখনই তাঁকে ট্রান্সজেণ্ডার বলা যায়।)

এবার ‘ডমিনেট’ করাটা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে হতে পারে। তাই Transgender-এর অসংখ্য স্তরে বিন্যস্ত। এখান থেকেই যাবতীয় জটিলতা শুরু।

আমার মনে হয়, এই জটিলতায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এত স্তর জেনে হবেটা কী? মানুষকে নির্দিষ্ট কুঠুরিবদ্ধ করা? সেটা সম্ভব নয়। কারণ, কোনো একটা বৈশিষ্ট্যকে পুরোপুরি এক লিঙ্গের মত বলা খুব কঠিন। সামগ্রিকভাবে মানুষটার মধ্যে যেমন পুরুষত্ব আর নারীত্ব grayscale-এ থাকে, তেমনি কোনো একটা বৈশিষ্ট্যও পুরুষত্ব-নারীত্বের মাঝে grayscale-এ থাকতে পারে। যেমন, যে বিপরীত লিঙ্গের মত সাজপোশাক করে তাকে crossdresser বলা হয়। এবার, একজন crossdresser তার অন্যান্য লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে (হাঁটাচলা, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ইত্যাদিতে) উভয় লিঙ্গের ছাপ যেমন বহন করতে পারে। তেমনি তার crossdressing-ও একশো শতাংশ বিপরীত লিঙ্গের মত না-ই হতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক যেটা হচ্ছে, হাজারটা শ্রেণিবিন্যাস করতে গিয়ে এক একজনকে এক্সক্লুসিভ এক একটা ‘পরিচয়ে’ বন্দী করা হচ্ছে, আদতে সে হয়তো সেই পরিচয় থেকে অনেকটাই আলাদা। আবার, শ্রেণিবিন্যাসের পদ্ধতিটাও ঘুরে ফিরে সেই নারী-পুরুষ বাইনারি মেনেই। তাহলে, এটা কি ‘Transgender’ বৈশিষ্ট্যের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে গেল না? Transgender ক্যাটেগোরি তো তৈরীই হয়েছে নারী-পুরুষ বাইনারি ছককে চ্যালেঞ্জ করে।

Transgender-দের মধ্যে একটা বড় অংশ সমকামী। রূপান্তরকামী, লিঙ্গান্তরকামীরা প্রায় সবক্ষেত্রেই সমলিঙ্গের প্রতিই আকৃষ্ট হন। অর্থাৎ যাঁদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য প্রকট থাকে, তাঁরা। আবার, Transgender-দের অনেকে বিষমকামী, উভকামীও হতে পারেন। তবে তাঁরা সংখ্যায় কম। অন্যদিকে Lesbian, Gay, Bisexual দের মধ্যেও অনেক Transgender আছেন। LGB-র মধ্যে যারা অতিরিক্ত মেয়েলী পুরুষ বা অতিরিক্ত পুরুষালী মহিলা তাঁরা Transgender। একটু সহজ করে বলা যায়, সমকামী ও Transgender এমন দুটো সেট যারা পরস্পরকে অনেকাংশেই ইণ্টারসেক্ট করেছে।

এর ফলে কী হল? লিঙ্গদ্বৈত খণ্ডনকারী বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ‘sexual orientation’-ও অবধারিতভাবে চলে এল। এর যৌক্তিকতা নিয়ে অন্য আলোচনায় পরে যাব। সবার আগে লক্ষ করুন, L-G-B‘T’ এর সহাবস্থানের ফলে যে শ্রেণিবিন্যাসের কথা আগে বলেছিলাম, তার সাথে যৌন কামনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শ্রেণীগুলোও যুক্ত হল। যারা Transgender নয়, শুধু সমকামী, তাদের মধ্যেও অসংখ্য প্রকারভেদ রয়েছে। সবমিলিয়ে, শাখাপ্রশাখা আরো ছড়িয়ে গেল। এর সাথে আবার যদি ‘Queer’ জুড়ে দিই, তাহলে অর্থ আরো ব্যাপক আকার নেবে। কারণ, ‘Genderqueer’ আরো বিশাল বড় একটা ছাতা। যৌনাঙ্গের বিচারে যারা পুরুষ, নারী উভয় থেকে আলাদা, তাঁরাও চলে আসবেন। এইভাবে আরো একপোঁচ কালির দাপটে Sex Gender দুয়ের ভিত্তিতেই গাদাগুচ্ছের নন-বাইনারি আইডেণ্টিটির উদ্ভব হল। এত আইডেণ্টিটির রমরমায় কে আসলে কী, এটা বোঝা দুষ্কর হয়ে যাবে।২

অতিরিক্ত বর্গীকরণ কেন চাইছি না, তার তিনটে কারণ আগেই বলেছি। এক, এত চুলচেরা বিশ্লেষন মানুষ চেনার কোনো হাতিয়ার হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। দুই, এত খোপ বানিয়েও অনেক মানুষকেই নির্দিষ্ট কোনো খোপে ঢোকানো যাবে না। তিন, এই শ্রেণিবিন্যাস করতে গিয়ে প্রকারান্তরে পুরুষ-নারী দ্বৈত ছকটাকেই মেনে নেওয়া হচ্ছে। এবার আরো তিনটে কারণ বলছি। এক, এই যে নারী-পুরুষ ‘Gender’ শনাক্তকারী এত ‘বৈশিষ্ট্যের’ কথা বলে আসছি, সেগুলো আসলে সবটাই অস্থায়ী। সময়মত পাল্টেও যেতে পারে। ছোটবেলায় নিজেকে মেয়ে হিসেবে দেখতে পছন্দ করত, কিন্তু বড় হয়ে ভাবনাচিন্তা ও আচরণে পুরোপুরি পুরুষের মত, এমন আখছার দেখা যায়। এখানে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা উদ্ধৃতি না তুলে পারছি না, “জেণ্ডার আইডেণ্টিটিটা কোনো স্থায়ী চিহ্ন নয়। এটা নদীর মত প্রবহমান। সেই প্রবাহের মধ্যেই আমরা কখনো নারী, কখনো পুরুষ। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া চিহ্নে নারী পুরুষ শুধু একটা সামাজিক প্রত্যাশার নির্মাণ। আর কিছু নয়।” ....তাহলে যে জিনিস এত অনির্দিষ্ট, তাকে ধ্রুবক ধরে আমরা কেন নারীত্ব ও পুরুষত্বের স্কেল বানাবো?

পরের কারণ, এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে ক্যাটেগোরি তৈরী করতে গিয়ে গাদাগুচ্ছের উপসাংস্কৃতিক পরিভাষার আগমণ হচ্ছে, যেগুলো লোকসমাজে গালাগালে পর্যবসিত হয়েছে। অন্তত এই ব্যাপারে আমার মনে হয়, ‘prevention is better than cure’ তত্ত্ব মেনে শব্দগুলোর ব্যবহার তুলে দিলেই ভালো। কারণ, যথার্থ মানে কী সেটা বোঝাতে গেলে অনেক কসরত করতে হবে, এত শব্দের যথার্থ মানে বোঝানো যাবেও না। তাও বা মানা যেত ক্যাটেগোরিগুলো যদি এক্সক্লুসিভ হত।

সবশেষে আপত্তির কারণ হিসেবে যেটা বলব, তা হল অতিরিক্ত বর্গীকরণ নিতে না পারায় মানুষ সরলীকরণ করে বসেন এবং সেটা ভুল পদ্ধতিতে। সরলীকরণ করতে গিয়ে ট্রান্সজেণ্ডার আর অন্তর্লিঙ্গের মধ্যে কাল্পনিক সমান চিহ্ন বসিয়ে দেন অনেকেই। আবার সেই সমান চিহ্নের মধ্যে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সমকামীরাও চলে আসেন। ঋতুপর্ণ ঘোষের মত ‘মেয়েলি সমকামী’দের কথা তো ছেড়েই দিলাম, রিকি মার্টিন বা টম রবিনসন-এর মত ‘পুরুষালী সমকামী’ সম্পর্কেও অনেকে প্রশ্ন করেছেন, “উনি কি ছেলে, মেয়ে না মাঝামাঝি?” এ ধরনের সরলীকরণের মূলে অনেক গভীর সাইকোলজি কাজ করে। লৈঙ্গিক অভিব্যক্তির দিক থেকে নারী আর পুরুষের একটু আলাদা হলেই তাকে ‘তৃতীয়’ বর্গে ঠেলে দেওয়া হবে – এই ধারণা এর একটা বড় কারণ। যে চারটে প্যারামিটারের ভিত্তিতে আমরা দৃশ্যত পুরুষত্ব-নারীত্ব আরোপ করি, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কোনো মানুষের মধ্যে এর পৃথক অস্তিত্ব দেখি না। মোটের ওপর যে কোনো একটা লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি। আর ছেলে মানেই মননে পূর্ণাঙ্গ ছেলের মত, মেয়ে মানেই মননে পূর্ণাঙ্গ মেয়ের মত এই ভুল ধারণা তো আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে রয়েছেই। ফলে কোনো একটা প্যারামিটারে ‘ব্যতিক্রম’ দেখলে তার সাথে ‘sex’-গত ব্যতিক্রম হওয়াটাকেও আমরা অনিবার্য ভেবে ফেলি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সরলীকরণও সমান বিপজ্জনক। এর সবথেকে বড় শিকার হন লিঙ্গান্তরকামী ও লিঙ্গান্তরিতরা। কেউ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গান্তরিত হয়ে গেলেন মানে, তিনি তাঁর সেক্স ও জেণ্ডারের সাজুয্য তৈরীতে (সোজা কথায় ট্রান্সজেণ্ডার থেকে সিসজেণ্ডার হতে) অভিলাষী। অথচ লিঙ্গান্তরিত হওয়ার পরেও তাঁদের ট্রান্সজেণ্ডার (বেশি অপভ্রংশে অন্তর্লিঙ্গ) ঠাওরানো হয়।

বর্গীকরণ, সরলীকরণ দুটোই যদি এত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, তাহলে আমরা কী করতে পারি?

আমার মনে হয়, একটা নির্দিষ্ট সীমা অবধি বোধগম্য এবং যৌক্তিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সামান্য কিছু শ্রেণিবিভাগ - এই অবস্থায় গিয়ে থেমে যাওয়াই ভালো। যে যে বিষয়ে বর্গীকরণ, সরলীকরণ দুটোই সমস্যার সৃষ্টি করে, সেখানে এটাই একমাত্র উপায়।

কী সেই ‘নির্দিষ্ট জায়গা’? যা ঠিক করে দেবে যে, ‘এতটুকু গিয়ে থেমে যাও, আর জাল ছড়ালে গোলমাল হয়ে যাবে?’

সেটা হল, লিঙ্গ (Sex), যৌন পরিচয় (Gender)‘Sexual orientation’-এর তফাত সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা। এটাই প্রাথমিক কর্তব্য। Sex Gender-এর পার্থক্য ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছি। এবার বুঝতে হবে, Gender Sexual orientation মোটামুটি সমান্তরালে চললেও আসলে এরা mutually exclusive। ধরুন একটি মেয়ে ভারী গলায় কথা বলে, বা একটি ছেলে মিহি সুরেলা গলায় কথা বলে। এই বৈশিষ্ট্যদুটোকে আমরা যথাক্রমে ‘ছেলেলি’ ও ‘মেয়েলি’ বলতে পারি। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি অন্য কোনো মেয়েকে যৌনসঙ্গী হিসেবে কামনা করে, এটা ‘ছেলেলি’ বৈশিষ্ট্যের আওতায় ফেলা যায় না।

তার মানে আমি বলতে চাইছি, Sexual orientation নামক মানসিক বৈশিষ্ট্যটা Looks, Gesture, Dressing, Voice এর সাথে এক আসনে বসালে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ হল ‘স্ট্যাণ্টার্ড’ আর সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তার থেকে ‘ডেভিয়েশন’ – প্রকারান্তরে এটাই বলা হবে। আর সেখান থেকেই চলে আসবে সমকামিতা ‘স্বাভাবিক’ নয়, ‘অস্বাভাবিক’। এরকম অযৌক্তিক ব্যাখ্যা আসার পথটা হল এইরকম - ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানেই ‘লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য’। ‘লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য’ মানেই যে কোনো লিঙ্গের পক্ষে একটা ‘default’ আর তার বিপরীতটা ‘deviation। আর, যেটা ‘default’ সেটা স্বাভাবিক, যেটা ‘deviation’ সেটা অস্বাভাবিক। এই Chain reaction-এ মাঝখানের বিবৃতিটা মোটামুটি ঠিক বলেই ধরে নিলাম। যদিও ‘লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য’ ও ‘default’এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, তবু আমি কথার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হল প্রথম আর শেষ বাক্যদুটো নিয়ে। একটা সত্যি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সমাজে বিষমকামীর সংখ্যা সমকামীর থেকে অনেক বেশি। এই সংখ্যাধিক্যতাই যাবতীয় ফারাক গড়ে দিচ্ছে। যেমনভাবে লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য কোনগুলো সেটা আমরা চিহ্নিত করেছি সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিচার করে, তেমনি বিষমকামিতা-সমকামিতাও তাই। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানেই কি আমরা তাকে লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য বলব?

আমরা ধাপে ধাপে এগোই। শুরুতেই যেটা প্রশ্ন, লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য কাকে বলব? ....উত্তর হল, বৈশিষ্ট্য নিজেই যখন লিঙ্গ পরিচয়কে নির্দেশ করে। বলাই বাহুল্য, এটা একটা শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য।

ধরুন, র‌্যাণ্ডম সমীক্ষায় দেখা গেল পুরুষরা ঘুমোন মহিলাদের চেয়ে বেশি (বাস্তবের সাথে মেলাবেন না)। তার মানেই কি ‘বেশি ঘুমোনো’ ক্রিয়াপদটা শুনলে অঙ্গাঙ্গীভাবে পুংলিঙ্গের কথা মনে পড়বে? নিশ্চয় না। অর্থাৎ এটা লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নয়। অপরপক্ষে, ‘শাড়ি-ব্লাউজ পরা’ শুনলে স্ত্রীলিঙ্গের কথাই মনে পড়বে। ধুতি-পাঞ্জাবি শুনলে পুংলিঙ্গ। অর্থাৎ ‘পরিধেয়’ নামক বিষয়টা লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের আওতায়। সব পরিধেয় বাঁধাধরাভাবে নারীর পোশাক ও পুরুষের পোশাক পৃথক তালিকাভুক্ত না হলেও কিছু পরিধেয়র বিচারে যখন দ্বিভাজনটা স্পষ্ট, সুতরাং একে লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য বলা যায়। এবার প্রশ্ন আসছে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কামনা - এটা কেন লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নয়? ‘মেয়েদের সাথে প্রেম করছে’ শুনলে তো ছেলেদের কথাই মনে আসে....

না, এখানেই ভুল। মনে আসে কারণ, আমরা দেখতে অভ্যস্ত।

একটু আগে দেখুন আলোচনা করেছি, চারটে conventional notion-এর বাইরে অন্যান্য অন্তরীণ বৈশিষ্ট্য কেন লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নয়। আপনি নিজেই লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য হওয়ার দুটো শর্ত বুঝতে পারবেন। এক, শুধু এক লিঙ্গের মধ্যে খুব বেশি দেখা যায় এমন নয়, বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় না - এটাও। শতকরা একশোজন মহিলা শাড়ি-ব্লাউজ পরলেও একে ‘নারী বৈশিষ্ট্য’ বলে অভিহিত করা যাবে না যতক্ষণ না দেখা যাচ্ছে, পুরুষরা প্রায় কেউই এই পোশাক পরছেন না (Crossdresser বাদে)। দুই, সেটা যতক্ষণ না সহজে আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, ততক্ষণ তার উপর নির্দিষ্ট কোনো লিঙ্গের স্ট্যাম্প দেওয়াও সম্ভব নয়। কারণ, দেখেশুনে যাচাই না করে কোনো ‘শনাক্তকারী’ বৈশিষ্ট্য স্থির করা যায় না। ধরুন একটা সমীক্ষা জানাল, ‘মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশি কেয়ারিং’। এটা সহজে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই, ‘বেশি কেয়ার নেওয়া’টা লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নয়। সহজে চোখে পড়লে না হয় এক নম্বর শর্ত প্রয়োগের কথা ভাবা যেত। কিন্তু কে কী পরছে, কেমন সুরে কথা বলছে এগুলো নিরন্তর আমাদের পরিলক্ষিত হয়। এবার, এর ভিত্তিতে সমকামিতা-বিষমকামিতাকে বিচার করুন।

প্রথমত, সমকামীরা বিষমকামীদের তুলনায় ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ – এটা অবাস্তব কথা। বৈজ্ঞানিকদের দীর্ঘ গবেষণা বিভিন্ন সময়ই জানিয়েছে যে, আমরা সবাই কমবেশি উভকামী। ফ্রয়েড এও বলেছেন, সবাই উভকামী হয়েই জন্মায়, তারপর সমাজ ঠিক করে দেয় সে কোন দিকে যাবে।৩ গুগলে ‘Innate Bisexuality’ লিখে খুঁজলে অনেক গবেষণার কথা জানতে পারবেন। এছাড়া সহজ ভাষায় যৌন কামনার মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য অনেক বইও আছে। আমি তার মধ্যে পড়ে নিতে অনুরোধ করব, জ্যানিস বোহানের ‘সাইকোলজি অ্যাণ্ড সেক্সুয়াল ওরিয়েণ্টেশন- কামিং টু টার্মস'। দ্বিতীয়ত, বাকি চারটে ভিন্নলিঙ্গ-সূচক লক্ষণের মত ‘orientation’-কে দেখা যায় না। যেটা দেখা যায় সেটা হল ছেলে-মেয়ে প্রেম করছে, বিয়ে করছে। কিন্তু তার মানেই এটা প্রমাণ হচ্ছে না, তারা সম্পূর্ণ ‘হেটারো’। যৌন চাহিদার উপর পাথর চাপিয়ে শুধু লোকলজ্জার ভয়ে প্রেম এবং বিয়ে করা – এটা অগুনতি উভকামী তো বটেই অনেক সমকামীও করে ফেলেন। সুতরাং, দৃশ্যমানতার অভাবের কারণে প্রথমেই একে লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য থেকে বাদ দেওয়া যায়। ওরিয়েণ্টেশন যে একেবারে দৃশ্যমান নয়, তা বলছি না। কিন্তু বাকী চারটের তুলনায় এর দৃশ্যমান হওয়ার সম্ভাবনা নগন্য।

তাহলে, তাত্ত্বিকভাবে লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য হওয়ার সম্ভাবনা নস্যাৎ হল। তাও একটু সাংখ্যহিসেবের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। Quantitative আলোচনা শুরু করার আগে একটা কথা বলে রাখি, মেজরিটি-মাইনরিটি দ্বিভাজন থেকে একটা ন্যক্কারজনক প্র্যাক্টিস চলে আসে এক দল আরেকদলকে অবনত করার। মূলত ধর্ম, বর্ণ, গাত্রবর্ণ এর শিকার হয়। সেটা খুবই খারাপ, কিন্তু আমি সেই প্রসঙ্গেই যাব না। আমার প্রশ্ন, বিষমকামীরা সমকামীদের তুলনায় কি এতটাই বেশি যে তাদের ‘overwhelming majority’ বলা যায়? আর তার ফলে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণটা ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’ হয়ে যায়?

সমকামীদের সংখ্যা গণনা খুব কঠিন কাজ। পুরোটাই দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তির ওপর, কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ওপর নয়। জরিপ করে যাদের সামনে পাওয়া যাচ্ছে, তারা সবাই প্রকাশ্যে নিজেদের যৌনতা জানানোর সাহস রাখে (Open homosexual)। এদের থেকেও একটা অংশ অনেক বেশি যারা নিজেদের যৌন কামনাকে গোপন করে রেখেছে (Closet homosexual)। এরা সামাজিক অবমাননার কারণে সামান্যতম মুখ খুলতে সাহস পায় না। কেউ কেউ আবার নিজেদের ওপর সন্দেহ নির্মূল করতে প্রকাশ্যে বলে বেড়ায় যে, তারা সমকামিতাকে ঘেন্না করে। বিশেষ করে তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে, যেখানে সমকামিতা বিশাল বড় সামাজিক ট্যাবু। ইসলামিক দেশগুলোতে তো সমকামিতার সমর্থনে কিছু বলাও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সেইসব দেশের সাংখ্যহিসেব দেখলে বিষমকামীদের overwhelming majority মনে হবেই। উন্নত দেশগুলোতে চারপাশে প্রচুর ‘open’ সমকামীকে বহুকাল ধরেই দেখা যায়। তাও বলব, এটা সমস্ত ‘closet’-এর বেরিয়ে আসার পক্ষে যথেষ্ট নয়, যদি তার ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সের পরিমাণ বেশি থাকে (একটা সামাজিক কুসংস্কারও এখানে কালান্তক যমের মত ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তার কথা একটু বাদেই বলছি)। ফলে পরিচয় গোপন রাখাটাই স্বাভাবিক। আবার, পরিচয় গোপন রেখে মূল্যবান পরামর্শের জন্য হেল্পলাইন চালু হলে তাতে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগকারীর সংখ্যা তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে – এই ঘটনা বিভিন্ন দেশে হামেশাই ঘটেছে এবং ঘটে চলেছেও

তাহলে এতই যদি রাখঢাক হয়, আমরা সঠিক সাংখ্যহিসেব পাব কোত্থেকে?

উত্তর হল, একেবারে সঠিক তথ্য পাওয়ার উপায় নেই।৪ তবে একাধিক নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট খুঁজলেই দেখতে পাবেন, বেশিরভাগ উন্নত দেশে সমকামীরা বিষমকামীদের তুলনায় overwhelming minority নন। আরেকটু পরিষ্কার চিত্র দেওয়ার জন্য চারটে তথ্যের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনা কেউ দিতে পারলে ভালো হয়। এক, কোন দেশে কবে আইনিভাবে সমলিঙ্গের যৌন আচরণ সিদ্ধ হয়েছে এবং কোন দেশে সামাজিক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আইন (Anti-discrimination laws) ও সমকামী যুগলদের সামাজিক স্বীকৃতির আইন (Recognition laws) জারি হয়েছে (পরের অংশদুটো না থাকলে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, হংকং, ভিয়েতনাম, লাওসের মত দেশগুলোকে দিব্যি ‘সমকামীদের প্রতি সহিষ্ণু’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। বাস্তবে এইসব দেশে খাতায় কলমে সমলিঙ্গের যৌনক্রিয়া বৈধ হলেও Anti discrimination Law Recognition Law নেই, এবং সমকামীদের সামাজিক অবস্থা ৩৭৭ আইনাধীন ভারতের থেকেও শোচনীয়)। দুই, সেইসব দেশে সামাজিক ও পারিবারিক বাধা দূরীকরণের ক্রমবিবর্তন এবং অ্যাক্টিভিস্ট, সাপোর্ট গ্রুপ, মনস্তত্ত্ববিদরা কতদিন ধরে, কীভাবে কাজ করছেন ভেদাভেদ দূরীকরণে তার বিবরণ। তিন, সেইসব দেশে সমপ্রেম সম্বন্ধে বলা হয়েছে এমন সিনেমা বা বই কোন সময়ে কতগুলো বেরিয়েছে। এই তিনটে সার্ভে করলে আবছাভাবে বোঝা যাবে, কোন দেশের অগ্রসরতার ইতিহাস কত পুরানো। এর পরে আসবে সমকামীদের সাংখ্যহিসেব। উইকিপিডিয়াতে একটা পেজ আছে, Demography of Sexual Orientation। কিন্তু সাংখ্যহিসেবের জন্য উইকিপিডিয়া নির্ভরযোগ্য নয়। বিশেষত, এই পেজের ডেটার সাথে অন্যান্য ওয়েবসাইটের ডেটার পার্থক্য হামেশাই চোখে পড়েছে। তাই গুগলে আলাদা আলাদা করে প্রত্যেক দেশের ‘LGBT population’ টাইপ করে প্রাপ্ত একাধিক সার্চ রেজাল্ট থেকে উত্তর খোঁজাই সবথেকে ভালো উপায় (তবে সমীক্ষণের অসুবিধা, পদ্ধতিগত ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা নিয়ে উইকিপিডিয়ার ঐ পেজে বিস্তারিত আলোচনা আছে, সেটা পড়ে নিতে পারেন)। আরো ভালো হয়, ই-মেল মারফত সেই দেশের একাধিক আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট আর মনোবিদের সাথে যোগাযোগ করলে। এইভাবে লিবার‌্যাল সমাজব্যবস্থার সাথে সমকামীদের আত্মপ্রকাশের একটা লেখচিত্র পাওয়া যাবে, যদিও সেটাও খুব অস্পষ্ট। যাঁরা এই ফিল্ডে কাজ করছেন বা ভবিষ্যতে করবেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে আমার অনুরোধ রইল, এই কাজটায় সময় নিয়ে হাত দিন।

কিছু সংখ্যক ক্লোজেট সবসময়ই পর্দার আড়ালে থেকে যাবেন। বংশবিস্তার করা যেহেতু বেশিরভাগ মানুষের ইচ্ছা এবং একমাত্র হেটারোসেক্সুয়ালিটি সেই সুযোগ দেয়, তাই অনেক মানুষই খুব স্বাভাবিকভাবে উভকামিতার একটা দিককে উপেক্ষা করেন। সচেতনভাবে নয়, কিন্তু করেন। তাঁরা নিজেরা জানেনও না যে তাঁরা উভকামী। আরো একটা কারণ এর জন্য দায়ী। ছোটবেলা থেকে পারিপার্শ্বিকে মধ্যে খুব বেশি বিষমকামী সম্পর্ক দেখতে দেখতে ওটাই তাঁদের জ্ঞান-বোধ তৈরী হওয়ার আগে থেকেই অবচেতনে ‘একমাত্র’ সম্ভাব্য উপায় হিসেবে খোদাই হয়ে গেছে। এর মূলে রয়েছে বহু যুগ আগে তৈরী করা একটা সামাজিক কুসংস্কার, যার নাম ‘হেটারোনর্ম্যাটিভিটি’। সমকামিতাকে কোণঠাসা না করে দিলে বংশলোপ হয়ে দূর ভবিষ্যতে মনুষ্যপ্রজাতির অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়বে, এমন ভয় থেকেই হেটারোনর্ম্যাটিভিটির গোড়াপত্তন। এর সাথে শারীরবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ধারণা অনুযায়ী একটা কাল্পনিক হায়ারার্কি বানানো হয়, যার একদম উপরে থাকে হেটারোসেক্সুয়ালরা। মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীর রমণের মূলগত পার্থক্য হল, ওদের রমণে কামসুখের তুলনায় বংশবিস্তারের চাহিদা বেশি, মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। এই সত্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হেটারোনর্ম্যাটিভিটি যেটা চাপাতে চাইছে, তাতে এই পার্থক্যটাই নেই। আবার, এটাই হোমোফোবিয়া সৃষ্টির জন্য মূল দায়ী। হেটারোনর্ম্যাটিভিটি অজান্তেই আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গেছে। কোনো মেয়ে যদি জানতে পারে তার বয়ফ্রেণ্ড অন্য কোনো মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করছে, তাহলে যত না রেগে যাবে তার থেকে অনেক বেশি রেগে যাবে সম্পর্কের তৃতীয় কোণে কোনো ছেলে থাকলে। ইতিমধ্যে অনেক দেশই ধীরে ধীরে হেটারোনর্ম্যাটিভিটির প্রকোপ ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু বহুকালের আরোপিত প্রপঞ্চ থেকে পুরোপুরি বেরোতে আরো অনেকদিন সময় লাগবে।৫ তারপরে না হয় সমকামী-বিষমকামী-উভকামীর ‘self reporting’-এর মাধ্যমে মাথাগণনার কথা ভাবা যাবে, এখন নয়। তবে এর মাঝে যে একটা অন্তর্ঘাতের চিত্র পাওয়া গেল কেউ খেয়াল করেছেন কি? অনেকে এখনো ঐ পুরানো দাবী করেন যে, সমকামিতাকে আইনি ও সামাজিকভাবে গ্রহণ করে নিলে সমকামের প্রবণতা এতই বেড়ে যাবে যে, মানুষের প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার দিকে এগোবে। তার মানে কি তাঁরা এটাই স্বীকার করে নিলেন না যে, আসলে সমকামীদের সংখ্যা বিষমকামীদের চেয়ে বেশি? প্রচ্ছন্নভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে বহাল না থাকলে কিভাবে সেটা একদিন মনুষ্যজাতিকে গ্রাস করবে আর নতুন প্রজন্ম আসা বন্ধই করে দেবে? ‘প্র্যাক্টিস’টা আইন ও সমাজের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে, ‘কামনা’টা তো নয়।

আসলে হেটারোনর্ম্যাটিভ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বান্ত ভুল। বিষমকামীদের ক্ষেত্রে বিষমকামী হওয়ার কারণ নিশ্চয় এটা নয় যে, আইন ও সমাজ বিষমকামকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাহলে সমকামীদের ক্ষেত্রে এমনটা ভাবা হচ্ছে কেন যে আইন ও সমাজ স্বীকৃতি দিলে প্রচুর মানুষ সমকামী হয়ে পড়বেন? কামনা (এবং প্র্যাক্টিস) বিদ্যুতপ্রবাহ নয় যে, আইন ও সমাজ সুইচ টিপে দিলেই একদিকে প্রবাহ হবে, আর সুইচ বন্ধ করে দিলেই থেমে যাবে। তুরস্ক, ব্রাজিল, হণ্ডুরাস, আর্জেণ্টিনা, পেরু, জাপান, মেক্সিকো, বুলগেরিয়া, ইতালির মত দেশে এক শতকেরও অনেক বেশি সময় ধরে সমকামিতা আইনসিদ্ধ। বেলজিয়াম, নেদারল্যাণ্ডস, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি দেশে আর সুইৎজারল্যাণ্ডের কোনো কোনো অংশে দুই শতকের বেশি সময়ও। এসব দেশে তো সমাজ বিলুপ্তির দিকে এগোয় নি। বিলুপ্তি-ফোবিয়ায় আক্রান্তরা অবশ্য এটা শুনেও ক্ষান্ত হবেন না। বলবেন, ঐসব দেশে কি সামাজিকভাবে সিদ্ধ হয়েছে? ....ঠিক কথা। এত বছর এই আইনের মধ্যে থাকায় হেটারোনর্ম্যাটিভ দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা কমলেও উধাও হয়ে যায় নি। কিন্তু হেটারোনর্ম্যাটিভিটি যতটুকু সরেছে, তার সাথে জনসংখ্যা ‘হ্রাস’এর(?) লেখচিত্র যদি আঁকা যায়, তাহলে পরিষ্কার বোঝা যাবে এই স্বীকৃতি কোনোভাবেই ‘বিলুপ্তি’র দ্যোতক নয়।৬ তাই যদি হত তাহলে প্রাচীনযুগ থেকে মধ্যযুগে মানুষের উত্তরণই হত না। খোলামেলা সমকামিতার দৌলতে কবে ডায়নোসোরের মত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হত। এই বক্তব্যের উপর অসংখ্য বই আছে। আমি মাত্র দুটোর নাম বলছি। রুথ বনিতার ‘জেন্ডার, সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ এবং লুই ক্রম্পটনের ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’। প্রাচীন গ্রীস, প্রাচীন ভারতে সমকামীদের সংখ্যা কত বেশি ছিল এবং তাঁরা কত মুক্ত ছিলেন তার প্রামাণ্য দলিল এইসব বই। পাশাপাশি লক্ষণীয়, উক্ত সমাজে সমকামীদের মধ্যে কোনো বর্গীকরণ ছিল না। তার মানে, অতিরিক্ত বর্গীকরণ থেকে বেরোনোরও একটা উপায় হল হেটারোনর্ম্যাটিভিটি সরিয়ে দেওয়া এবং সমকামীদের অনেক বেশি পরিমাণে প্রকাশ্যে আসা।

মূল বক্তব্যে ফিরে আসি। আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলফ্রেড কিনসে সমকামী–বিষমকামী বিভাজনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল বক্তব্য ছিল, যৌন আকর্ষণ একটা বর্ণালীর মত। সেই তারল্যের মধ্যে থেকে ওরিয়েণ্টেশনের মাত্র দুটো ভাগ বানানো, আর তার মাঝামাঝি মানে উভকামী – এটা ঠিক নয়। কিনসের বইগুলোতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। চল্লিশের দশকে তিনি সমকালীন বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন যে, তাঁরা সমকামীদের মজ্জাগতভাবে স্বতন্ত্র্যভেবে নেন। তাই কিনসে নিজের গবেষণা অনুযায়ী মানুষের যৌন আচরণের ০ থেকে ৬ পর্যন্ত একটা স্কেল তৈরী করেন, যার দুই প্রান্তিক বিন্দু যথাক্রমে ১০০% বিষমকামিতা এবং ১০০% সমকামিতা নির্দেশ করে। এই স্কেল অবলম্বন করেই পরবর্তীকালে তৈরী হয় Klein Sexual Orientation Grid। কিনসের তত্ত্ব পরবর্তীকালে কেউ কেউ খণ্ডন করেছেন ঠিকই, তবে তার থেকেও অনেক বেশি সংখ্যক সমর্থন করেছেন। কিনসেকেই যৌন গবেষণার অধীশ্বর বলে বিশ্বের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মেনে নেন। যাঁরা মানেন না, তাঁদেরও অন্তত এমন দাবী শোনা যায় নি যে, জেণ্ডার ও ওরিয়েণ্টেশন পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত। প্রসঙ্গত রেফার করছি যৌনতত্ত্ববিদ জন মানির লেখা ‘গে স্ট্রেট অ্যাণ্ড ইন বিটুইন – দ্য সেক্সোলজি অফ ওরিয়েণ্টেশন’ (অক্সফোর্ড পাবলিকেশন)। ওরিয়েণ্টেশন ও অন্যান্য লৈঙ্গিক অভিব্যক্তির সুস্পষ্ট পার্থক্য বুঝতে বইটা ভীষণভাবে কার্যকরী। শুধু তাই না, বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোকে জন মানি এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা পড়ার পর পুরুষসত্তা-নারীসত্তার বিভিন্ন স্তর নিয়ে বিভ্রান্তির কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

ওরিয়েণ্টেশনের লিঙ্গমাপক প্যারামিটার না হওয়ার স্বপক্ষে সবথেকে মোক্ষম একটা যুক্তি দেওয়া যায়। যদি সত্যি ওরিয়েণ্টেশন লিঙ্গমাপক প্যারামিটার হত তাহলে সমকামী মাত্রেই ট্রান্সজেণ্ডার হত। ‘ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া’ যদি মেয়ের বৈশিষ্ট্য হয়, তাহলে গে মানেই তার মধ্যে মেয়ের একটা বড় বৈশিষ্ট্য আছে (উল্টোটাও সত্যি)। তার মানেই সে ট্রান্সজেণ্ডার। কিন্তু আদতে সেটা যেহেতু বলা হয় না, তার মানে ‘ছেলের প্রতি আকৃষ্ট’ হওয়াটা শুধু মেয়ের এবং ‘মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট’ হওয়াটা শুধু ছেলের বৈশিষ্ট্য নয়।

মোদ্দা কথা, LGB-র সঙ্গে আর কী কী শব্দ থাকবে, এ ব্যাপারে নজর না দিয়ে সবার আগে দুটো বোধ গড়ে তুলতে হবে। এক, ছেলে-মেয়ে-অন্তর্লিঙ্গ এই বিভাজনটা লিঙ্গভিত্তিক। আর সমকামী-বিষমকামী-উভকামী এই বিভাজনটা যৌন কামনাভিত্তিক।৭ দুই, ‘Transgender’ শব্দের আওতায় যে যে বৈশিষ্ট্য পড়ছে সেগুলো লিঙ্গ-দ্বিভাজনকারী যৌন পরিচয় ভিত্তিক (যার চারটে মাপক হল Looks, Voice, Dress Gesture)।

এবার ভেবে দেখি, LGB-র সাথে কাকে কাকে রাখা যায়, না যায়। প্রাথমিকভাবে LGB নয়, LGBT-ই ধরে নিচ্ছি।

প্রথমেই যেটা বলব, Intersex বাদ। একই কারণে, Queer যেহেতু সব্বাইকে এক ছাতার তলায় আনছে, সুতরাং বাদ।

এই মন্তব্যের পর কেউ হয়তো বলতে পারেন, Sex Gender আগাপাস্তারা আলাদা হলেও একটা যদি সুবৃহৎ সংগঠন থাকে ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ মন্ত্রে, তাতে অসুবিধা কোথায়?

আমার মনে হয়, অসুবিধা সবথেকে বেশি কোথায় আগেই বলে দিয়েছি। সেটা হল, বিভ্রান্তি। বিভ্রান্তি ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। এই বিভ্রান্তি কাটানোর একমাত্র উপায় Sex কে Gender-এর থেকে বিচ্ছিন্নকরণ। বিভ্রান্তি সত্ত্বেও মানা যেত ভিত্তি মোটামুটি এক হলে, কিন্তু এখানে তা নেই। আরো একটা কারণ বলছি, এদেরকে আমরা এক মঞ্চে রাখছি তো ‘প্রান্তিক’ ভেবে। কিন্তু LGBT-রা প্রান্তিক নন। তাদের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। এটা বলে আমি কোনোভাবেই মধ্যলিঙ্গদের আন্দোলনকে ছোট করছি না। শুধু জানিয়ে রাখছি যে, কথাটা জলজ্যান্ত সত্যি। কথাটার সত্যতা বিচারের জন্য আমি কোনো রেফারেন্স দেব না, তার কারণ এই ক্ষেত্রে উকিলসুলভ প্রমাণপেশ করলে ‘LGBT’ এবং ‘Intersex’-এর মধ্যে একটা ‘পক্ষ-বিপক্ষ’ রেষারেষি চলে আসবে। সেটা আমি কখনোই চাইব না। তার চেয়ে আমার এই দ্বিতীয় পয়েণ্টটা কেউ যদি বিশ্বাস না করেন, তাও ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধু ভিত্তি আমূল আলাদা হওয়ার কারণেই এরা পৃথক থাকুক। এর জন্য Queer কথাটাকে বেশি ব্যবহার করারও আমি পক্ষপাতী নই। এইটুকু যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে অতিরিক্ত বর্গীকরণের সমস্যাও থাকে না, আবার অতিরিক্ত সরলীকরণও কমবে।

এর পরের ধাপে প্রশ্ন আসছে, একই বক্তব্য তো Transgender-দের ক্ষেত্রেও খাটে। সেখানেও তো Lesbian, Gay, Bisexual – এরা ওরিয়েণ্টেশনগত, আর ‘Transgender’ হল লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগত। এখানেও বিভ্রান্তির যথেষ্ট সুযোগ আছে। তাহলে ‘T’ কে বাদ দেওয়া হবে না কেন?

যুক্তিটা খুব জোরালো। এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। রাখার দিকেও অনেক যুক্তি রয়েছে। না রাখার দিকেও। যথাসম্ভব গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি।

বোঝানোর সুবিধার্থে আবার একটা উপমা নিয়ে আসছি। দুই সেট বাইনারি নিলাম, যারা মাঝেমধ্যেই ঘোঁট পাকিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। বাঙালী-অবাঙালী এবং হিন্দু-মুসলমান। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প-উপন্যাসগুলোতে পড়েছি, সেই সময়ে বাংলার ঘরে ঘরে “ওরা তো মুসলমান, আমরা তো বাঙালী” এই জাতীয় কথা শোনা যেত। এখনো শোনা যায়, তুলনায় কম।

এই জাতিগত ও ধর্মীয় ভেদাভেদের মূলে আছে বাঙালী = হিন্দু আর অবাঙালী = মুসলমান এইদুটো সমীকরণ। দুটোই একদম ভুল। ঠিক যেমন ট্রান্সজেণ্ডার = হোমো আর সিসজেণ্ডার = হেটারো এইদুটোও একদম ভুল। এবার, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ট্রান্সজেণ্ডারদের বড় অংশ সমকামী, আবার সমকামীদের বড় অংশ না হলেও কেউ কেউ ট্রান্সজেণ্ডার। অর্থাৎ, সিসজেণ্ডার সমকামীর সংখ্যা বেশি হলেও ট্রান্সজেণ্ডার বিষমকামীর সংখ্যা বেশ কম। জাতি এবং ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা – এই বিভ্রান্তিকে দূর করা গেছে তার কারণ অবাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমান দুয়েরই প্রাচুর্য। তার কারণ এই নয় যে, জাতি এবং ধর্মের পৃথক পৃথক সংজ্ঞা শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষকে সত্যিটা বোঝানো হয়েছে। এটা সব বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। অর্থোদ্ধার করিয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে আপনি একটার সাথে আরেকটার পার্থক্য শেখাতে পারবেন না। পারবেন বাস্তব উদাহরণ দিয়ে। এবার বলুন, সমকামী এবং ট্রান্সজেণ্ডার যদি এত অংশেই মিলে যায়, তাহলে আপনি কী করে বোঝাবেন যে দুটোর ভিত্তি এক নয়?

কঠিন হলেও বলব, বোঝানোর উপায় আছে। বেসিক জায়গাগুলো সম্বন্ধে আগে সবাইকে অবহিত করতে পারলে সমকামী এবং ট্রান্সজেণ্ডার এক মঞ্চে থাকল কি থাকল না তাই নিয়ে কিচ্ছু যাবে আসবে না। আমিব্যক্তিগতভাবে মনে করি, L-G-B-র সাথে T থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র বিভ্রান্তি বলে নয়, প্রথম তিনটের আধার আর T-এর আধার সম্পূর্ণ আলাদা বলেও। আমার যুক্তি, শুধুমাত্র ‘অবদমিত’ বলে যদি বিভিন্ন বিষয়ের অবদমিতদের এক ছাতার তলায় আনা হয়, তাহলে তো দলিতদেরও সেখানে নিয়ে আসতে হয়। বেছে বেছে ‘ওরিয়েণ্টেশেন’ ও ‘যৌন পরিচয়’ নিরীখে যারা অবদমিত তাদের এক জায়গায় আনব কেন? ধর্ম, বর্ণ, গায়ের রঙ নয় কেন? তার মানেই কি এই ইঙ্গিত দেওয়া হল না যে, এরা আসলে ইণ্টার রিলেটেড? এবং এর সাথে ‘লিঙ্গ’ নিরীখে অবদমিতদের এনে সেই প্যারামিটারটাও কি অবৈজ্ঞানিকভাবে যুক্ত করা হল না?।৮ তবে Asexual রা LGB-র সাথে থাকতেই পারেন। কারণ, ওটা ওরিয়েণ্টেশনের মধ্যেই পড়ে। যদিও Asexual-দের সামাজিকভাবে অবদমিত থাকতে হয় না।

এই ক’টা সত্যি বোঝানোর জন্য আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এত কথা বলার দরকারই পড়ে না। পাশ্চাত্যে বহুকাল আগেই এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে, যৌন কামনা কোনো লিঙ্গভিত্তিক বৈশিষ্ট্য নয়। এখন উন্নত দেশে যেসব গবেষণা চলছে, তা সমকামিতা উদ্ভবের ইতিহাস নিয়ে, জেনেটিক প্রভাব নিয়ে, সবাই কমবেশি উভকামী কিনা এই নিয়ে। প্রচুর পরস্পর বিরোধী মতও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমি এখানে যেটুকু বললাম, সেই ধারণা নিয়ে গবেষকদের কারোর বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। ফলে এর রেফারেন্স খুঁজতে হলে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকের বইগুলো খুঁজতে হবে (একটা বইয়ের নাম বলে দিই। বিজ্ঞানী হ্যাভলক এলিসের ‘স্টাডিস ইন দ্য সাইকোলজি অফ সেক্স’এর দ্বিতীয় ভলিউম। জন মানির যে বইটার কথা বলেছিলাম, সেটাও)। আমাদের দেশেও যাঁরা এই নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশুনা করেছেন, তাঁরা আমার ‘প্রামাণ্য বিষয়’ দেখলে হাসবেন। বলবেন, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে বসেছে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। হয়তো তাই করছি। কারণ আমাদের সমাজে মেজরিটির এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও নেই। ভুল ধারণা তৈরী হওয়ার একটা chain reaction দেখিয়েছিলাম। তাতে এর পরের ধাপে আছে ‘ডিফল্ট-ডেভিয়েশন’ আর তার পরে আছে ‘স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক’। পুরোদস্তুর হেটারোনর্ম্যাটিভ সমাজে দাঁড়িয়ে যদি স্বীকার করেও নিই যে, বিষমকামিতা ‘বাই ডিফল্ট’ আর সমকামিতা ‘ডেভিয়েশন’ তাহলেও এদের ওপর স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক তকমা সেঁটে দেওয়া যাবে না। যেমন, বাঁ-হাতিরা ডান-হাতিদের তুলনায় ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। তা সত্ত্বেও এদের ওপর ‘স্বাভাবিকত্ব-অস্বাভাবিকত্ব’ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি? এরকম অনেক ক্ষেত্র পাবেন যেখানে সংখ্যার আকাশ-পাতাল তারতম্য সত্ত্বেও কোনো বৈষম্য তৈরী হয় নি। তাহলে ধর্ম, বর্ণ, গাত্রবর্ণ, যৌন কামনা, লিঙ্গ পরিচয় এদের বেলাতেই বা বিভাজন চলে এলো কেন, যেখানে বিভাজনের পদ্ধতিটাই ভিত্তিহীন? একদিকে বলব, সংখ্যায় খুব কম(!) বলে অস্বাভাবিক, অন্যদিকে অজস্র জিনিস আরো কম হয়েও দিব্যি বৈষম্যহীনতায় আসীন – এ কোন নীতিবিশারদের নিধান?

সমকামিতাকে ‘অস্বাভাবিক’ ঠাওরানোর জন্য আরো ঠুনকো ‘যুক্তি’ শোনা যায় আর সেগুলো পর্যুদস্ত করার আলোচনা চারদিকে হয়েই চলেছে।৯ আমি নতুন করে কথা খরচ করব না। ‘সমকামিতা রোগ’, ‘রোগ না হলেও অস্বাভাবিক’ আর ‘স্বাভাবিক হলেও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর’ - এই তিন মতবাদকে (অশিক্ষিতদের অধঃক্রমানুসারে সাজালাম) ভুল প্রমাণ করার জন্য হাজারটা ওয়েবসাইট আর বই আছে। কিন্তু এইসব বড় ভুল তৈরীর মূলে যে ভুলগুলো রয়েছে, সেগুলো উপড়ানোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। চলতি ধারণায় মানুষ যতটা বুঝেছে, সেটা হাতিয়ার করেই বোঝাতে হবে, চলতি ধারণাটা কোথায় কোথায় ভুল, কোথায় কোথায় তার বহুমাত্রিক অর্থ। ‘Gender’ কথাটাই যেখানে specific নয়, সেখানে তাকে কংক্রিটে বদ্ধ করা ঠিক না। কেন নয় বলতে গেলে আরো হাজারটা প্যারামিটার নিয়ে আসতে হবে। তার চেয়ে এটুকুই থাক। জটিল হয়ে যেতে পারে বলে আমি গোটা প্রবন্ধে ‘Inversion’ এবং ‘Gender Dysphoria’ উল্লেখই করি নি। অথচ এখানে এদের নিয়ে এলে বিপরীত লিঙ্গের মত আচরণ এবং সমকামিতা – দুই ক্ষেত্রেই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা অনেক সহজ হত। আবার, ‘সেক্সুয়াল ওরিয়েণ্টেশন’কে ছোট করে ‘সেক্সুয়ালিটি’ বলা হয়, যার বাংলা যৌনতা। কিন্তু আমি কোথাও ‘সেক্সুয়ালিটি’ ব্যবহার করি নি। কারণ, একে ‘সেক্স’ নিরপেক্ষ প্রমাণ করার জন্য এমন কোনো শব্দ বয়ে বেড়ানোই ভালো যাতে ‘সেক্স’ শব্দটাই নেই। তাই ‘ওরিয়েণ্টেশন’ সবথেকে নিরাপদ।

কথাগুলো বলছি এই জন্য যে, যাঁরা আন্দোলনের সাথে জড়িত তাঁরা খুব বেশি হেঁজিপেঁজির মধ্যে না গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করুন। উন্নত দেশগুলোতে অফিসিয়াল ঘোষণার অনেক আগেই সামাজিক বাধা সরে গিয়েছে, তার কারণ প্রাথমিক ব্যাপারগুলো তারা আর পাঁচটা স্বাভাবিক বিষয়ের মত শিখে নিয়েছেন। আমাদের দেশে যখন হয় নি, তখন সাম্য প্রতিষ্ঠাকে পাখির চোখ করে এগোতে গেলে কিছু কৌশল অবলম্বন করাই ভালো। অশিক্ষিতদের এঁড়ে তর্ক থামানোর জন্য প্রথমেই জানিয়ে দিতে পারেন, ১৯৭৩ সালে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার সবথেকে বড় পীঠস্থান আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ‘রোগ’এর তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাদ দিয়ে একদম ‘স্বাভাবিক’ ঘোষণা করে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ICD (International Classification of Disease) থেকেও সমকামিতা সরে গেছে।১০ জানিয়ে দেওয়া অবশ্যই দরকার যে, ১৯৯৯ সালে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স, আমেরিকান কাউন্সেলিং অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ স্কুল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস, আমেরিকান ফেডারেশন অফ টিচার্স, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান স্কুল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ইণ্টারফেইথ অ্যালায়েন্স ফাউণ্ডেশন, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্কুল সাইকোলজিস্ট, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সোশাল ওয়ার্কার ও ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন সম্মিলিতভাবে জানান, সমকামিতা একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু এতকিছু জানানোর পরেও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করার কাজটা মোটেই সহজ নয়। তার জন্য সর্বাগ্রে হেটারোনর্ম্যাটিভিটি থেকে মুক্ত হতে হবে এবং ট্রান্সজেণ্ডারদের সম্বন্ধে ‘তৃতীয়’ ধারণাটা পরিহার করে ছেলে-মেয়ের থেকে ‘আলাদা’ না বলে ছেলে-মেয়ের ‘বিভিন্ন অনুপাতে সংমিশ্রণ’ - এই বোধটা গড়ে তুলতে হবে।

তাই চলুন না, আমরা এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকি যে লিঙ্গের মুখ্য স্তম্ভ দুটো, ছেলে আর মেয়ে। যৌনতারও মুখ্য স্তম্ভ দুটো। সমকামী আর বিষমকামী। মানসিক যৌন পরিচয়ে কে কেমন, সেটা হিসেব করে কী লাভ? যে বিষমকামী সম্পর্ক সবাই দেখে দেখে অভ্যস্ত, সেখানেও তো ছেলের মধ্যে মেয়েলি আর মেয়ের মধ্যে ছেলেলি বৈশিষ্ট্য পেতে পারেন। তাই, ‘conventional notion’ অনুযায়ী কতটা ছেলে, কতটা মেয়ে ওসব হিসেব করার দরকার নেই। তার চেয়ে চলুন শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবেই ওগুলোকে ভুলে যেতে শুরু করি। এর থেকে ব্লাড গ্রুপ বা চোখের পাওয়ারের বিচারে মানুষকে চেনাও অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত ও বিজ্ঞানসঙ্গত।


No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.