Friday, June 12, 2020

আবির্ভাব ভট্টাচার্যের স্মৃতিযাপনের কথাঘর

আহা! সেইসব দিন : বিবক্ষিত-র পুরোনো সেই দিনগুলি-রাতগুলি


স্মৃতির মেহগনিবাক্সে এমন কিছু মণিমাণিক্য থাকে যা মাঝেমধ্যে বের করে, দেখে, একটু সুখ অনুভব করে আবার রেখে দিতে হয়। যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছেন, তাঁরা সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করতেন বলে শুনেছি, পড়েছিও কিছু। যাঁরা সত্তর দশক প্রায় দেখেনইনি, তাঁদেরও সেইসব উত্তাল সময়ের স্মৃতিচারণ করতে দেখেছি, পড়েছি আরও বেশি। কথায় কথায় হাওয়া থেকে স্মৃতি নামিয়ে কী দারুন ভেসে যেতে দেখেছি দস্যি দামাল সময়ের স্রোতে। আমাদের স্কুল পেরিয়ে কলেজ বা কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি যে সময়টা ছিল, সেই সময়টাও আমাদের দেশকালের নিরিখে বেশ দস্যি দামাল সময়ই বটে। এইরকম একটা সময়ে যখন বর্ধমানের লিটল ম্যাগাজিন আবার নতুন করে মাটির ভিতর থেকে আউশ ধানের শিশুর মতো মুখ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, সেই সময়ে, এই মফস্বলের একটি কিশোর স্বপ্ন দেখালো একটি দামাল নৌকা ভাসানোর । নিজেদের একটি পত্রিকা - বিবক্ষিত ঃ একটি দামাল নৌকা। 

২০১২ সাল ঃ উজানকালের শুরু
সালটা ২০১২ । আজ ২০২০-তেও একই নামে
  পত্রিকাটি কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তাই-ই নয়, বহরে ও বাহারে বেড়েছে আঠারো আনা । প্রথমে ছয় পাতা দিয়ে শুরু, তারপর আট হল । এরপর ঝাঁপ সোজা ৬৪ পাতায়, তারপর ১২৮ পাতা । দুদ্দার গতিতে এগোনো যাকে বলে আর কি ! তবে 'একটি দামাল নৌকা' শব্দগুলি শুধু সময়ের সঙ্গে বাদ পড়ে গেছে । কিন্তু, শুরুয়াতি দিনগুলিতে যেমন বিবক্ষিত নিজে কখনো খুব নিয়মিত ছিল না, আজও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এটা হয়তো লিটিল ম্যাগাজিন বলেই কিছুটা জন্মলগ্নের প্রভাব এবং সেটাই একদল দুরন্ত ছেলেদের হাতে পড়ে হয়ে উঠেছে চিরকালের দামালপনা। তবে বেশ বুঝতে পারছি তখন, কলেজে সবাই একটা অন্য চোখে দেখছে আমাদের - ভাবছে, ছোকরা লিটিল ম্যাগাজিন করছে, তর্কাতর্কিও, যুক্তিতে শান, বুঝি হেব্বি ইন্টেলেকচুয়াল হবার সাধ। স্মৃতিযাপনের এই এক সমস্যা, প্রথম পুরুষ দিয়ে শুরু করে শেষে নিজেকেই উত্তম পুরুষ থেকে টেনে আবার প্রথম পুরুষেই নিয়ে যেতে হয়। হচ্ছেই, কেননা বিবক্ষিত যে আমার এতটাই আপন। 

বিবক্ষিত-র তিনখ্যাপা - অর্ধেন্দু, সুমিত,হাসান (বাঁ-দিক থেকে)
যদিও সিরিয়াসলি লিখব বলে কিছুই স্থির করিনি তখন, তবুও খামে করে লেখা জমা দিয়ে দিচ্ছি পূর্বনির্ধারিত স্থানে । স্থান মানে, হো হো, সেটা একটা ওষুধের দোকান।  সেখানকার কর্মচারীদের চোখে তখন এক অদ্ভুত সম্ভ্রম, বা হয়তো তাচ্ছিল্যও - সে যাই হোক উপেক্ষা কিন্তু নয়। তখন তো এখনকার দিনের মতো নিজেদের এমন গোছানো একখানা ঘর (বইবাসনা) হয়নি বিবক্ষিত-র। এখানে সেখানে ইতিউতিই ছিল তখনকার ঠিকানা । কিন্তু গুণমানের কথায় কখনো আপোষ করেনি সম্পাদক অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ মনে আছে, একেকটা সংখ্যা নিয়ে তুমুল তর্ক হতো আমাদের মধ্যে, কলেজের পাঁচিলের বাইরে চায়ের দোকানটায় বসে।
বিবক্ষিত ২০১৩ - হেমন্ত আর সুমিত (বাঁ-দিক থেকে)
একদিকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু হলো 'কবিতার ক্লাস'- শিরোনামে একটি লেখা। অন্যদিকে ক্রমে ক্রমে লেখা পাওয়া যেতে লাগল, মীরাতুন নাহার, অচিন রায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সাধন চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ কসর জামাল, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, সোমব্রত সরকার, সাগর মুখোপাধ্যায়, রজতকান্তি সিংহচৌধুরী, সন্মাত্রানন্দ ইত্যাদি কত কত কিংবদন্তি মানুষের কাছ থেকেও। ফিজিক্সের চন্দন দেবনাথ ছিলেন বরাবরই প্রকৃতি বিষয়ে খুব সচেতন। তিনি লিখতেন রাজনীতি, প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক আদান প্রদান ও দ্বন্দ্ব নিয়ে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়, ওঁর আহ্বানেই একটা সভাতে আমাদের, মানে আমার আর অর্ধেন্দুদার যোগাযোগ হয়।  তখন তো আর কেউ সেভাবে চিনত না আমায়, কাজেই কেউ আমাকে স্টলে বসতে ডাকতোও না। বইমেলায় তখন প্রথম নিজেদের স্টল বলতে আমাদের ছিল একমাত্র 'বিবক্ষিত'ই। আহা ! এরকম কত কথা কত স্মৃতি জমা হয়ে আছে । সব কিছুই যে লিখে ফেলতে নেই, বেশিরভাগটাই জমিয়ে রাখতে হয় কিংবা সম্পদের মত করে আগলে রাখতে হয়।  

ক্যারদানি ঃ বিবক্ষিত পত্রিকার ২০১৪ সালের সংখ্যা

আর একটা মজার স্মৃতি দিয়ে শেষ করি- সে সময় আর্যেষ্ণু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক রহস্যজনক লেখকের একটা প্রবন্ধ ছেপেছিল বিবক্ষিত, খুব সম্ভবত নাম ছিল, 'ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো', সেই লেখা নিয়ে এমন তর্ক শুরু হল যে আমার এক বন্ধুর আসানসোল ফেরার ট্রেনের সময় হয়ে যাওয়ায়, সে পত্রিকাটাই নিয়ে চলে গেল । বলেছিল, পরেরদিন ওটা পড়ে নতুন যুক্তি খুঁজে বের করে আনবে। সেই যুক্তির কী হয়েছিল জানি না, তবে অনেক পরে জানা গেছিল, বেনামে সেই লেখা আসলে আমাদের অর্ধেন্দুদাই লিখেছিল । আজও বইমেলায় কিংবা লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে অথবা মফস্বলের লিটল ম্যাগাজিন মেলায় চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের সাথে দেখা হলে, বলাবলি হয়, 'আমাদেরও কী সব দিন ছিল, আহা! সেইসব দিন!'...

বিবক্ষিত ২০১৩ সংখ্যা

মনে আছে, ওই সময়টা পেরিয়ে এসে পরে কয়েকটা লাইন লিখেছিলাম-

থার্ড ইয়ার

আমরা যখন হইহল্লায়

  পেরিয়ে যাচ্ছি বয়ঃসন্ধি

বিকেল ডুবে সন্ধ্যে হলেই

বাতাস তখন বিষাদগন্ধী।

আগুন এসে লাফিয়ে বেড়ায়

চোখের তারায় বুকের মাঝে

অস্থিরতা সান্তনা দেয়

ত্রিতাল ছন্দে যুক্তি নাচে।

আমরা তখন শক্ত চোয়াল

আস্তিনজুড়ে বিষাদ ক্ষত

যত্নে রাখা পত্রিকা সব

গোপন বিস্ফোরণের মতো!

আমরা তখন পেরিয়ে যাচ্ছি

সবুজ ঘাসের মিষ্টি জমি

আমরা তখন বৃষ্টি হলেই

ক্লাস পেরিয়ে মাঠে নামি।

জার্মান না ফরাসিরা

কারা বেশি ভেবেছিলো

ইউটোপিয়ার ডুব সাঁতারে

দিন পেরোলো রাত পেরোলো।

আমরা তখন চাইছি ছায়া

কেউ সিগারেট কেউ তো বিয়ার

কেউ ফ্রেঞ্চকাট কেউ ক্লিনসেভ

আমরা কলেজ, থার্ড ইয়ার!

 

তখন আমাদের সম্পাদকেরও থার্ড-ইয়ার ছিল 


[ওয়েবজিনের অস্বীকৃতি: এই লেখাটি লেখক কর্তৃক বিবক্ষিত ওয়েবজিনের জন্যে জমা দেওয়ার পরেই প্রকাশিত হয়েছে। যদি একই লেখা অন্য কোনও মাধ্যমে – বিবক্ষিত ওয়েবজিনে প্রকাশের আগে বা পরে প্রকাশিত হয় - তবে বিবক্ষিত ওয়েবজিন এর জন্য দায়ী হবে না। এটির দায় লেখকের এবং তাঁর নৈতিকতার ।]


No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.