Wednesday, June 10, 2020

সত্যবান রায়ের প্রবন্ধ

...তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল

[২০১৮ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত]

এক

... বন্যাতো শুধু ক্ষতি করে না, বরং খনিজ সমৃদ্ধ পলিমাটি দিয়ে প্রতি বছর জমিকে সে উর্বর ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর করে তোলে । ধরমপুরের এক বৃদ্ধ মানুষের কাছে সেই ভবিষ্যবাণী আমি শুনেছিলাম । ... ১৩৬০ সালের বন্যার পর গ্রামের মানুষ হায় হায় করছে এবং এই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবে কি না এইসব কথা আলোচনা করছে সেই সময় একদিন শশী রাণা বললেন, “বোকা মেনে কাঁদুচ । সুবন্নেখা সোনা দেইগেলা । এতবা বুঝবনি, পছে বুঝব ।“ ধরমপুরের মানুষের ভাষা বাংলা ছিল না । তাঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন এবং এখনও বলেন সেটা স্থানীয়ভাবে ‘হাটুয়া’ ভাষা নামে পরিচিত । ভাষাটার সঙ্গে ময়ুরভঞ্জের উড়িয়া ভাষার ফারাক খুব কম । তিনি যে কথাটা বলেছিলেন সেটার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “বোকারা কাঁদছ । সুবর্ণরেখা সোনা দিয়ে গেল । এখন বুঝবে না পরে বুঝবে ।“ তাঁর ভবিষ্যবাণী কতটা সঠিক তা পরে বোঝা গেছিল । ...

-               সন্তোষ রাণা,

রাজনীতির এক জীবন, পৃষ্ঠা-৪,

প্রথম সংস্করণ ডিসেম্বর ২০১৭

 

কর্ণাবতী একটি  নদীর নাম – যদিও কাল্পনিক নদী ।

 

সে প্রায় বিশ বছর আগে দেখেছিলাম ‘কর্ণাবতী’ ।  অমৃতা প্রীতমের কাহিনীসূত্র নিয়ে  একটি নাটক, চন্দন সেনের নাট্যরূপে মেঘনাদ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় সায়ক-এর মঞ্চায়ন। পটভূমি রাজস্থান। এ নাটক জুড়ে নদীর উপমায়  কুসুম্বী নামে এক গাঁয়ের মেয়ের গল্প। এ নাটক বলে নদীর মতোই নারীর  বহমানতার সমস্যাকে কোন ভুগোলেই বাঁধা যায় না। কৈলাশ রাওয়াতের মতো যে পুরুষ ক্ষমতা আর বৈভবের জোরে যে নারীর দখল নেয়, তাকে কোনদিক দিয়েই  সে জয় করতে পারে না।  সোনার শেকল আর বিলাসী ঘর ছেড়ে সে নারী পালিয়ে যায় যে নতুন স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে, সেই স্বপ্নও দ্রুত আটকে পড়ে ধুসর মরীচিকায়। তবু মরুপথে ছন্দ হারানো নদীর মতোই তার অনিঃশেষ প্রতীক্ষা, - প্রতীক্ষা মেঘমন্দ্রিত শ্রাবণের জন্য যা তাকে সমুদ্রের পথ দেখাবে কিংবা দুর্লভ এক স্বপ্নরাঙ্গা  পুরুষের জন্য যে রচনা করবে যন্ত্রণা-দগ্ধ  গর্ভিণীর নবীন এক কুমারসম্ভব।

 

সে ছিলো নদীর উপমায় নারীর গল্প।  উপমান আর উপমিতের অবস্থানটা যদি বদল করে দিই ! নারীর উপমায় নদীর গল্প ! কেমন হয় তাহলে ? নারীর বিপ্রতীপে যে ক্ষমতা সক্রিয় সেতো নদীর বিপক্ষেও ক্রিয়াশীল। জীবনের প্রায় তিন দশক কাটিয়েছি জলবিদ্যুতের সান্নিধ্যে জীবিকার সূত্রে । নদীর জলের উচ্চতা ও বহমানতাকে বিদ্যুতে রূপান্তরের  কৃৎকৌশল নিয়ে ঘর করেছি অনেকগুলো বছর। এসব প্রসঙ্গ ভীড় করে আসত, আসে জীবনে জীবিকায় কিছু কিছু পরিসরে।

 

ইতিহাস একটি  নদীর নাম – হয়তো তাই ।

 

ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলতেন – বাংলার ইতিহাস রচনা করেছে বাংলারই ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী । আর সর্বভারতীয় পটে গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী দত্তাত্রেয় বালকৃষ্ণ কালেলকর (১৮৮৫-১৯৮১) একটি সুগভীর আশ্চর্য কথা বলেছিলেন – “আমার সর্বদাই মনে হয় ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রদেশ বা রাজ্য অনুসারে না লিখে যদি নদী অনুসারে লেখা যেত” । আসলে এটি ঠিক পান্ডিত্যজাত কথা নয়। তাঁর পরিব্রাজক জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞান ও মর্মোপলব্ধির কথা। নদীর প্রতি তাঁর গভীর টান ছিল। একটু ভেবে দেখলে আমাদের ইতিহাস কি এক অর্থে নদী অনুসারেই লিখিত নয় ? ভারতের ভূভাগ দিয়ে অন্তত আটশ’ ছোট-বড় নদী বয়ে গিয়েছে । আক্ষরিক অর্থেই এ দেশ নদীমাতৃক। ভারতের ইতিহাসে মহাকাব্যে গল্পে উপন্যাসে কবিতায় সঙ্গীতে কি বিপুল সমারোহে প্রবাহিত নদী তার কলোচ্ছ্বাস বা বিষাদের ভাষা নিয়ে। পুজার্চনায় কতকাল আগেই এসেছে গঙ্গা যমুনা গোদাবরী সরস্বতী নর্মদা সিন্ধু কাবেরী। কোন অঞ্চলের মানুষ যখন তাঁদের নদীর ভয়ংকরী ধ্বংসের কথা মনে রেখে তার নাম দেন ‘কীর্তিনাশা’, তখন কি তা ইতিহাস নয় ? ছোটনাগপুরের মালভূমিতে উৎপত্তি যে ‘অজয়’ নদীর, তার মানেই হল যাকে পোষ মানানো যায় না। কতকাল ধরে রচিত হয়েছে অজয়ের সর্বনাশা রূপ নিয়ে গান কিংবা কবিতা। কবির বাড়ির ঠিকানাই তার নামে – ‘বাড়ি আমার ভাঙ্গন ধরা অজয় নদীর বাঁকে’। এতো ইতিহাস। আজও অজয়ের চরে বালি খুঁড়ে পাওয়া যায় দুই সহস্রবর্ষ আগের ধাতুনির্মিত দেবমূর্তি, তারও আগে নদীর অতলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গহনা, বাসনসামগ্রী, কারুকার্যময় নৌকার ভাঙ্গা টুকরো । নদীই এখানে ইতিহাস। কে যে তার বাস্তুর অদূরে বয়ে যাওয়া নদীর নাম রেখেছিল ‘ইছামতী’ – স্বপ্ন যেখানে সত্যি হয়। এ যেন মানুষের আকাঙ্খার ইতিহাস। সুন্দরবনের স্বল্প পরিচিত এক নদীর কি মোহ-জাগানিয়া নাম – ‘আড়বাঁশী’। উত্তরপ্রদেশের নাজিবাবাদ স্টেশনের অনতি দূরেই নদীর নাম – ‘চিরজীবতী’; কেরলের একটি নদীর নাম ‘শোকনাশিনী’ । এহেন সব  নামকরনে যেন লুকিয়ে রয়েছে আঞ্চলিক মানুষের আশাআকাঙ্খার ইতিহাস আশঙ্কার ইতিহাস।

 

নামকরণের আবেগী ইতিহাসের বাইরেও নদীর সাথে জড়িয়ে আছে প্রত্নতাত্বিক ইতিহাস সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। শুশুনিয়ার সানুদেশে, বিহারীনাথ পাহাড়-ঘেঁষা দামোদরের তীরে, বাঁকুড়ার কংসাবতীর তীরে, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়-সন্নিকট হনুমতী-আম্রহাস নদীতীরে, মেদিনীপুরে গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা-তীরে পুরাতন প্রস্তর যুগের মানুষের বাস ছিল। ময়ুরাক্ষী, অজয়, কুনুর, দ্বারকেশ্বর, কাঁসাই, শিলাই, কেলেঘাই ও বিদ্যাধরীর অববাহিকায় পাওয়া গেছে তাম্রযুগের চিহ্ন। নদীময় ইতিহাস এই বঙ্গের । এই নদীপথেই এসেছিল ভিন দেশী বনিক।

 

নদীকেন্দ্রিক এ ইতিহাস না হয় মনে রাখার পক্ষে বড়ই প্রাচীন। কিন্তু মনে কি রেখেছি ষাট-সত্তর বছর আগের এ কলকাতার ঘরের নদীটিকে যাকে এখন বলে থাকি আদিগঙ্গা। বিশ শতকের মধ্যভাগ অবধি গঙ্গার জোয়ারের  জলে পুষ্ট যে নদী ছিল বেগবতী, প্রাণবন্ত। আদিগঙ্গার ইতিহাস তো দক্ষিনবঙ্গের ইতিহাস। দক্ষিণ ২৪-পরগণার মাঝামাঝি বোড়াল, কোদালিয়া, বারুইপুর, মজিলপুর হয়ে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে যে নদী মিশত সাগরে। সাড়ে তিনশ’ বছর আগে পর্যন্ত এইতো ছিল জীবন্ত জলপথ । বাণিজ্যতরী নিয়ে চাঁদ সদাগর সমুদ্র-পাড়ি দিয়েছিলেন এই নদীপথ ধরেই। একদিন এই নদী পথেই এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য। তাঁর অবতরণকে স্মরণ করেই বৈষ্ণবঘাটা। এক রাত্রি এখানে কাটিয়ে এই গঙ্গা ধরেই সমুদ্রের কিনারে কিনারে  তাঁর পুরী গমন ।  শুনেছি স্বাধীনতার অনতি পরেও আদিগঙ্গা দিয়ে বেয়ে যেত মাটির হাঁড়ি-কলসি আর খড়ের গাদা বোঝাই বড় বড় মহাজনী নৌকা।  এমনই ছিল তার নাব্যতা  গত শতকের পাঁচের দশকেও । ভাটিয়ালির সুর শোনা যেত তীরে দাঁড়িয়ে।

 

এই প্রসঙ্গে অধুনা গঙ্গার প্রবাহপথের সামান্য উল্লেখ প্রয়োজন আদিগঙ্গার সম্ভাব্য প্রবাহপথের সূত্রে । হুগলি আর ভাগীরথী একই ধারা, শুধু নামভেদ । পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার প্রবেশ রাজমহলের কাছে ; অতঃপর দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে ফরাক্কার দক্ষিণে বর্তমানে বিশ্বনাথপুরের কাছে । পূর্বাভিসারী ধারাটি পদ্মা নামে প্রবাহিত বাংলাদেশে আর দক্ষিণাভিসারী ধারাটিই ভাগীরথী । নবদ্বীপের বিপরীতে জলঙ্গী-সঙ্গমের পরে ভাগীরথীর জোয়ার-প্রভাবিত অংশটি পেয়েছে বিদেশী বণিকের দেওয়া নাম হুগলী ।  পশ্চিমবঙ্গ-বিহারিণী ভাগীরথী তার প্রবাহপথ বদলেছে বহুবার , তুলনায় মোহনার আগে  হুগলী নদীর পথবদল কম । ত্রিবেণীতে পৌঁছে  ভাগীরথীর ত্রিধারা – গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী । একদা বলা হতো ‘মুক্তবেণী’, সত্যেন দত্ত’র কবিতায় যার নামেই ছিল বঙ্গের ঠিকানা । কিন্তু সেতো নয় তেমন অতি দূর অতীতের ধারাচিত্র । মানুষের সময়ের ঘড়ি আর নদী-সমুদ্র-পর্বত-অরণ্য’র জীবনের ঘড়ি-র স্কেল এক নয় । নদীর কাছে লক্ষ  বছর তেমন কিছু নয় । মানুষের কাছে একশ’ বছর অনেক । অথচ আধুনিক একশো-দুশো বছরের কাল-খন্ডেই প্রাগৈতিহাসিক কালের নদীর বিনাশ বা বিপর্য্যয়ে মানুষের তথাকথিত সভ্যতা বা উন্নয়নের ভুমিকা অসীম । ত্রিবেণীর অন্যতমা যমুনা আজ অবলুপ্ত । যে সরস্বতী একদিন ছিল বঙ্গের অন্যতম প্রধান প্রবাহিণী, যার তীরে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, ছিল সপ্তগ্রাম বন্দর, আজ তা’ জলহীন খাত । অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে একাদশ শতকের আগে আদিগঙ্গাই ছিল ভাগীরথীর প্রবাহপথ । সরস্বতী ও আদিগঙ্গার জলোচ্ছ্বাসী পথ ধরেই একদা নিস্পন্ন হত সমুদ্রযাত্রা । ষোড়শ শতক থেকে সরস্বতীর ক্রমাবনতি শুরু হয় ।  আর অষ্টাদশ শতক থেকে আদিগঙ্গা বিশীর্ণা হয়ে নাব্যতা হারায় । নদীর নাম হয়ে যায় টালিনালা । কালক্রমিকতায় নদীর বাঁক বদল হয়, খাত বদল হয়, এক কূল থেকে সরণ হয় অন্যকূলে ।  তার এই খেয়ালী বদলের ধাক্কায় বিলোপ ঘটে সভ্যতার, জনপদের । কিন্তু আপাত খামখেয়ালী বদলের পেছনে থাকে নিশ্চিত কার্য-কারণ সম্পর্ক । সে সম্পর্ক অনেকটা ভৌগলিক, অনেকটা মানুষের জীবনপ্রণালীর জন্য । কিন্তু একটা ব্যাপারে সব নদী একই ধাঁচ মেনে চলে । সব নদীই চায় সবচেয়ে কম বাধার পথে বয়ে যেতে । এই বাধাবিপত্তির দায় কখনো প্রকৃতির কখনো মানুষের ।

 

বাংলার মুক্তবেণীর কথায় এসেই যায় এলাহাবাদে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী-র মিলনস্থল ‘যুক্তবেণী’-র কথা । প্রয়াগ – এখানে কুম্ভমেলা হয় । কিন্তু সরস্বতীকে স্মরণাতীত কালের মানুষ চোখেই দেখেনি, সে নাকি অন্তঃসলিলা । ঋকবেদে বহু উল্লিখিত সরস্বতী, একদা হরপ্পা সভ্যতার প্রাণদায়িনী সরস্বতী সম্ভবত ভৌগলিক বিপর্য্যয়ে ২০০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে শুকিয়ে যায় । ধরে নেওয়া যায় যুক্তবেণীর যমুনা, সরস্বতী-র জনপ্রিয় অনুসঙ্গ মাথায় রেখেই বঙ্গে ত্রিবেণী বা  মুক্তবেণী-তে গঙ্গার সাথে মিলিত দুই নদীর নামকরণ হয়েছিল একইভাবে । 

 

জাতীয় নদী গঙ্গার আদি পথ কোথাও ভরাট কোথাও দখল কোথাও কোনক্রমে নর্দমার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে । শুধু গঙ্গা বা বড় নদীগুলিই নয়, বিপন্ন অসংখ্য ছোট নদী যাদের ধারায় পুষ্ট হয়ে দু’কূল ছাপায় গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র । বড় নদীদের অনেকখানি করে জমি দখল নিয়েছে বাঁধ । আর বেশ কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে ছোট নদীদের প্রাণ শুকিয়ে উঠছে জমি দখলের টানে । ‘পুকুর-চুরি’ হয়ত জনপ্রিয় প্রবাদ, কিন্তু নদী-চুরি আজকের বাস্তবতা । দূর ছেড়ে কলকাতার কাছের জেলার কথাই যদি ধরি – উত্তর ২৪-পরগণা, নদীয়া, হুগলীতে একের  পর এক নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে বা হয়ে চলেছে রাতের আঁধারে নয়, দিনের প্রখর সূর্যালোককে স্বাক্ষী রেখে। হুগলীতে সরস্বতীর মতো ঐতিহাসিক নদীর জলহীন খাতে এখন চোলাই মদের কারখানা । নদীয়ায় যমুনা বিলুপ্তির পথে । হাওর, বাচকো, কানাগঙ্গা, মরালী, সুবর্ণমতী এখন ইতিহাস । অঞ্জনা নদীকে এখন খুঁজে পাওয়া যায় শুধু কবিতায় । দিনের আলোয় প্রকাশ্যে চুরি হয়ে যাচ্ছে যমুনার উপনদী গোমতী, চুরির পরে যেটুকু পড়ে আছে তা মজা খাল, বা বিল । নদী বুজিয়ে স্ব-মহিমায় গড়ে উঠছে হাইব্রীড ধানচাষের  ক্ষেত, বসতবাড়ী, ফ্ল্যাট, রাস্তা, ক্লাব, ভাটিখানা – উপচে পড়ছে নগরায়ণের পেয়ালা। সারা দেশে একটি নদীও নেই যা তার নিজস্ব প্রাকৃতিক ধারায় বয়ে যাচ্ছে । ফলে বহুযুগ ধরে নদীর যে নিজস্ব খাত তৈরী হয়েছিল তা ভরাট হয়ে যাচ্ছে । এর ফলও মিলছে । নদী-কিনারি মানুষদের একটি পুরানো প্রবচন আছে – ‘সোঁত মরলেও রেক মরে না’ । অর্থাৎ নদী শুকোলেও তার চলার পদচিহ্নটি অমোঘভাবে থেকে যায় । কাজেই বর্ষার জল নদীর ভরাট হয়ে যাওয়া খাত বেয়েই নামে । তখন সে প্রলয়ংকরী ।  

 

ভারি হৃদয়-কাড়া নাম ‘বিদ্যাধরী’, কত লোকগাঁথাই যে জড়িয়ে আছে এই নামের সাথে । এককালে এই বিদ্যাধরী গঙ্গারই একটা গভীর শাখা ছিল । একদা ব্যস্ত নাব্যপথ, এরই তীরে তিনশ’ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে ছিল নদী-বন্দর চন্দ্রকেতুগড় । মেগাস্থিনিসের বিবরণীর গঙ্গারিডি সভ্যতা নাকি একে ঘিরেই ছিল – মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক । নদীয়া জেলার হরিণঘাটা থেকে যাত্রা শুরু করে ঊত্তর ২৪ পরগণার দেগঙ্গা, হাবড়া, বারাসাত হয়ে বিদ্যাধরী মিশেছে সুন্দরবনে গিয়ে রায়মঙ্গল নদীতে । যা ছিল একদা অহঙ্কারী প্রবাহিণী নদী, আজ তার পরিচয় কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগণার মুখ্য জলনির্গমন প্রণালী হিসাবে । তাও কি আছে ! বহুদিন ধরেই বসতির চাপে দুপাশের পার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে নদীর প্রস্থ । বিদ্যাধরীর স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি হয়েছে দুধারে গজিয়ে ওঠা ইটভাটাগুলির নদীখাত থেকে ক্রমাগত মাটি তোলার ফলে । পাঁকে-ভরে-যাওয়া, জল-না-সরা প্রাচীন অবসন্ন নদীটিকে আজ নর্দমাও বলা যায় না । শুনেছি জেলা-প্রশাসন এবং সেচ দপ্তরের উদ্যোগে পলি ও পাঁক ছেঁচে তোলার জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, যা দিয়ে কিছু কাজ হয়েছে হয়ত কিন্তু  তা নেহাতই অপ্রতুল । অতএব... ।

 

দুই  

...নদী দেখলে চোখ জুড়োয় । কিন্তু বড় বাঁধের জলাধারের জন্য যখন মানুষের বাস ওঠে, তখন ব্যাপারটা পরিণত হয় মানুষের সংকটে । ... বাপ-ঠাকুরদার ভিটে, যত্নে বহু পুরুষ ধরে তৈরি করা চাষের জমি জলের তলায় ছেড়ে কোন মানুষ যেতে চায় অচেনা গ্রামের প্রান্তে ? সারি সারি টিন ছাওয়া কলোনিতে গিয়ে উঠতে ?  আঙিনার জবা-তুলসীর গাছটাও তাকে ডাকে । নিকোনো দাওয়া, ফেলে আসা গ্রামের মাঠ, নদী, একসঙ্গে পালা-পার্বণে মেতে ওঠার আনন্দ । গ্রামের সবাই তো এক জায়গায় জমি কিনে উঠে যেতে পারে না, অত জমিই বা কোথায় ? পুনর্বাসনের সঠিক পরিকল্পনা বানানোর অভিজ্ঞতা নেই রাজস্ব কর্মীদের । জেলের পরিবার জমি পেল না নদীর ধারে, তাঁতীর নতুন ভিটে হল জঙ্গলের কাছ ঘেঁষে । ওখানে তার ধুতি, গামছা কিনবে কে ? ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় গ্রামজীবনের বন্ধন। মানুষ টুকরো হয়ে যায়, একা এবং শেষ পর্যন্ত নীরব।

-       অনিতা অগ্নিহোত্রী,

নদীর সঙ্গে কথা

প্রতিদিন – ছুটি / রবিবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 

 

নদী দখল ও নদীর জল কমে যাওয়ার ফলে মাটীর নীচের জলের ওপর চাপ বাড়ছে, ঠিক যেভাবে মানুষের চলতি রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে হাত পড়ে ফিক্সড্ ডিপোজিট ভাঙ্গানোর দিকে । নামছে ভূগর্ভের সঞ্চিত জলভান্ডার । আগে ভূগর্ভের জলস্তর থেকে ফল্গুধারার মতো যে অদৃশ্য প্রবাহ (বেস-ফ্লো)গঙ্গা বা তার উপনদীদের বা ছোট-বড় অন্যান্য নদীদের বাঁচিয়ে রাখত এখন সে ধারাও নেই । প্লাবনভূমির কৃষিক্ষেত্রে অগভীর ও গভীর নলকূপের সাহায্যে এত জল টেনে তোলা হয় যে নদীর দিকে প্রবাহের জন্য আর কোন জল অবশিষ্ট থাকেনা । ফলে আরও শুকোচ্ছে নদী, আরও বাড়ছে ভূগর্ভের জল তোলার প্রবণতা ; নদী নিধনের এ এক ভয়াবহ চক্র বা ভিসিয়াস্ সাইকল্ । আমাদের এঁকেবেঁকে চলা ছোট নদীতে ‘বৈশাখ মাসে তায় হাঁটুজল’ এখন মিথ্ । বর্ষা ভিন্ন অন্য সময়ে কোথায় জল ? ছোট কেন, বড় নদীতেও – অজয়, ময়ুরাক্ষী, দামোদরেও এখন গ্রীষ্ম ছাড়িয়ে শীতেও বিস্তীর্ণ চড়া । এই সংকটের ব্যাপ্তি সুদূরপ্রসারী; কৃষি-শিল্প, নৌ-পরিবহন ছাড়াও ব্যহত হবে নদী থেকে গৃহস্থালীতে জল সরবরাহ। ইতিমধ্যেই জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের জলসরবরাহ ব্যবস্থার ইনটেক পয়েন্টগুলিতে পলি জমতে শুরু করেছে । হঠাৎ রাতারাতি এসব ঘটেনি, যদিও এ বিনাশকালের সুচনা বেশীদিনের নয় – মোটামুটি গত শতকের আটের দশক থেকে প্রোমোটারী-রাজ শুরুর সাথেই । দেখতে দেখতে ছোট নদীগুলি কখন স্রোত হারালো, কখন আরও জমি নেমে এলো ক্রমশ ক্ষীণস্রোতা নদীর খাতের ভিতর পর্যন্ত প্রথমে চাষের তারপরে বাসেরও আগ্রাসী দাবিতে, তা দেখার কেঊ ছিল না । গ্রামসমাজ ক্রমশ পরিণত হলো দলসমাজে, রাজনৈতিক দলের জমিদারীতে ।  দলই রাষ্ট্র । ফলে নিজেদের স্থায়ী কল্যানের জায়গাগুলো প্রভাবশালী পেশীশক্তির দখলে চলে যাওয়া নিয়ে কোন আপত্তি ঊঠল না ।

 

এহেন সর্বনাশের সাথে যুক্ত হয়েছে বালি মাফিয়াদের পৌষমাস । দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের দৌরাত্ম্য জেলায় জেলায় নদীতে নদীতে । দামোদরের চরে, সুবর্ণরেখার তীরে ...।  কিংবা কলকাতায় গঙ্গার মাঝ-নদীতে । বর্ধমান শহর ছাড়িয়ে সদর ঘাটের কৃষকসেতু ধরে পলেমপুর পার হয়ে জামালপুর, দাদপুর, সারাংপুর, ইত্যাদি অঞ্চলে এলেই নজরে আসবে নিষ্ঠুর বেপরোয়া বালির কারবার দামোদরের বুক চিরে । নদীর ওপর কোথাও তৈরি হয়েছে কাঠের অস্থায়ী ব্রিজ, কোথাও ইট পাথর কাদা ফেলে নদীবক্ষেই বালি দিয়ে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী রাস্তা । নদীর গভীর থেকে এভাবেই তুলে আনা হচ্ছে লরি আর ট্র্যাক্টর বোঝাই বালি প্রতিদিন সকাল দুপুর বিকেলবেলা । প্রতিনিয়ত এই বিপুল বালি উত্তোলনের খেসারত দিতে দামোদর ক্রমশ বদলাচ্ছে গতিপথ । অবৈজ্ঞানিকভাবে এই বালি তোলায় দামোদরের ওপর গড়ে তোলা বিভিন্ন এলাকার বাঁধ কোনদিন তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙবে কে জানে । কিংবা বর্ষার সময়ে দামোদর স্বাভাবিক পথে স্বাভাবিক গতিতে বইতে না পেরে কোনদিন পাড় ভেঙ্গে বহু মানুষ কে বিপন্ন করবে কে জানে । অনুরূপভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরে সুবর্ণরেখার তীরে অনিয়ন্ত্রিত অবাধ বালি খাদান চলছে ক্ষমতার হাত ধরে । অনুরূপ বিপন্নতা সেখানেও ভয় দেখাচ্ছে  । এবারে দেখি গঙ্গার বালি পরিস্থিতি । মুদ্রণ মিডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী বালি-দক্ষিণেশ্বর থেকে ব্যান্ডেল-কল্যাণী পর্যন্ত তিনশ’র অধিক জায়গায় বিপুল সংখ্যক মেশিন বসিয়ে বালি তোলা হচ্ছে । এর কতটা আইনি কতটা বেআইনি  সে প্রশ্ন ছাপিয়ে গিয়েছে পদ্ধতিগতভাবে এর অবৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকলাপ। মাঝগঙ্গায় নৌকা বা ভুটভুটি রেখে পাম্প-জেনারেটর আর সাকশন পাইপের মাধ্যমে উঠছে জলসমেত বালি, ডেলিভারি পাইপের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে পাড়ে । জমছে জলছাড়া বালি । বালির পরিবহনের জন্য প্রস্তুত আছে পে-লোডার ও লরি । নদীসেতুর  দুপাশে তিনশ’ মিটারের মধ্যে বালিতোলা যায় না । কিন্তু শোনে কে ? বালি থেকে কল্যাণীর মধ্যে চারটি পুরানো এবং একটি নির্মিয়মান সেতু রয়েছে নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে । নিরাপত্তাহীন ক্রমহ্রাসমান ইলিশ মাছ-সহ জলজ জীব এবং জীব-বৈচিত্র্য । পাইপে অনায়াসে ধুকে যাচ্ছে মাছের ডিম । ইলিশ তো ডিম পাড়ে নদীখাতেই । এদিকে নদীখাতের মাঝখান থেকে বালির নিঃসরণে দু’পাশের বালি মাঝে সরে আসছে । চাপ বাড়ছে পাড়ের ওপর । বাড়ছে ভাঙ্গনের সম্ভাবনা । ২০১৫ সালে দেশের সাতটি আই-আই-টি’র বিশেষজ্ঞরা ‘গঙ্গা রিভার বেসিন এনভারনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ শীর্ষক রিপোর্ট স্পষ্টভাষায় পরিবেশের স্বার্থে বালি-নিয়ন্ত্রনের কথা বলেছিলেন । জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ, দুষণ নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্র সবাই আছেন স্বীয় অস্তিত্বে, তবু হয়েই চলেছে অনেক গহন ক্ষতি ।

 

গত কয়েক দশকে নদী-দখল ও নদী-খাত থেকে বালি-মাটি উত্তোলনের সর্বনাশী প্রবণতার পাশাপাশি ভয়ংকর দুষণ দু’য়ে মিলে ঘটিয়ে চলেছে যে মারণ-যজ্ঞ, কিছু পরিবেশ কর্মী ব্যতিরেকে কোথায় তার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর বা নিদেনপক্ষে মোমবাতি মিছিল ! এটা ঠিক  নদীর নিজস্ব একটা পরিশোধন ক্ষমতা আছে , কিন্ত অন্তর্গত সেই ক্ষমতা দুষণ তৈরির গতি ও ক্ষমতার তুলনায় অপ্রতুল । দেশের পাঁচটি রাজ্যের ২৫০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের যে গঙ্গা-প্রবাহ তার এক-চতুর্থাংশও পশ্চিমবঙ্গে নয় । কিন্তু সারাদেশে মোট যত সংখ্যক নালা গঙ্গায় মিশছে তার প্রায় চল্লিশ শতাংশ এ রাজ্যের অবদান । সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট-এর তথ্য অনুযায়ী গঙ্গায় যে পরিমাণ ময়লা জল আসে তার বড়জোর কুড়ি শতাংশের পরিশোধন হয় । ৩৪টি শোধন কেন্দ্রের ১৩টি অকেজো । এর পাশাপাশি রয়েছে দু’পাড় জুড়ে আবর্জনার পাহাড় যার একটা বড় অংশ শেষাবধি গঙ্গাযাত্রা করে । রয়েছে চাষের জমি-ধোয়া কীটনাশকযুক্ত জলের অবিরাম গঙ্গাভিসার । নদীর ওপর ক্রমান্বয়ে বাঁধের ফলে শ্লথ হয়ে যাওয়া গতিতে এ দুষণ-ক্ষতি হয়ে ওঠে গহনতর । নদী একটাই, ভোক্তা বহু । কিন্তু মালিক কে ? নদীর বিপন্নতার দায় কার ? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর কি জানা ? গঙ্গা ও তার তীরের কিছটা অংশ কলকাতা বন্দরের সম্পত্তি । দুষণ দেখার দায়িত্ব দুষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-এর । আছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন । পাড় সৌন্দর্য্যায়নের ভারপ্রাপ্ত কেএমডিএ । পরিবেশ সংক্রান্ত মামলায় ন্যাশনাল গ্রীণ ট্রাইব্যুনাল সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সম্প্রতি ।

 

‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ থেকে ‘নমামি গঙ্গে মিশন’ - গঙ্গা দূষণ প্রতিরোধের  প্রতিটি কর্মসূচীতেই অন্তর্ভুক্ত ছিল কলকাতার আদিগঙ্গা । আদিগঙ্গার দূষণ-সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) পরিবেশ আদালতে হলফনামা জমা দেওয়ার ১৮ মাস পরেও পরেও দিতে না পারায় মুখ্যসচিবের কৈফিয়ৎ তলব করেছেন ট্রাইব্যুনাল-এর পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ গত ১৭ই নভেম্বর ২০১৬-য় । ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আদিগঙ্গায় ৫১টি নিকাশী নর্দমা নিয়ে আসে শহরের বিষ জল । গড়িয়া থেকে কুদঘাট পর্যন্ত টানা ৫ কিলোমিটার টালিনালা পুরোপুরি দূষিত । বিধানপল্লীর কালো জলের নালার দু’পাড়ে পচতে থাকা জঞ্জাল । বাঁশদ্রোণীতে মেট্রো ষ্টেশনের কাছে নালায় সে কালো জলও নেই, শুধুই কচুরিপানা আর আবর্জনা । কুদঘাটে বাজারের পাশে নর্দমা থেকে তোলা পাঁকও আছে নালার পাড়ে । খিদিরপুর ও হেষ্টিংসের দখলীকৃত আদিগঙ্গার পাড়ে বিস্তীর্ণ খাটাল দীর্ঘদিনের । চারু মার্কেট সংলগ্ন কাঠপোল এলাকায় হাইড্রেন কানায় কানায় ভরে গেছে পাঁকে, এক-দু’ পশলা বৃষ্টিতেই উঠে আসে রাস্তায়, আদিগঙ্গায় বিস্তর আবর্জনা জমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি । নিঊ আলিপুরের দিকে আবার আদিগঙ্গার অংশ দখল করে নির্মাণ চলছে  তিনতলা অবধি বাড়ি, ফ্ল্যাট ।  কিছুটা এগিয়ে বন্ধ চেতলা লকগেটের কাছে স্তুপীকৃত জঞ্জাল, পুতিগন্ধময় । কে জানে পরিবেশ আদালতের নির্দেশ কার্যকর করা কতটা সম্ভব সংশ্লিষ্ট সামাজিক পরিবেশ ও অভ্যাসে । চোখ বুজলে কি দেখতে পাওয়া যায় এই নদীপথ ধরেই চৈতন্যদেব কিংবা চাঁদ সদাগর ... !

 

এদিকে মহাভারতের দেশের নিজস্ব যে নদী পবিত্র গঙ্গা, দেশব্যাপী ২৫০০ কিলোমিটার প্রবাহিণী যে পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা, দেবীত্ব-আরোপ যাকে পারেনি মনুষ্য-সৃষ্ট ভয়ানক দূষণের হাত থেকে নিষ্কলুশ রাখতে, সেই মাতৃ-সমা নদীকেও এই লাঞ্ছনার অভিযোগ নিয়ে দাঁড়াতে হয় আদালত চত্বরে । বিশে মার্চ ২০১৭-য় জনস্বার্থ মামলা সংক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক রায়ে উত্তরাখন্ড হাইকোর্ট গঙ্গা, যমুনা ও তার শাখানদীসমূহকে মানুষের মতো জীবন্ত সত্তা হিসেবে ডিক্রী জারি করেছেন । সব ভারতীয় নাগরিকের মতো মৌলিক অধিকার থাকবে এই নদীর । মানুষের মতো আইনি অধিকার পাবে এই দুই নদী । মানবের পরিচয়ে নদীর মিশে যাওয়ার নমুনা হিসেবে এটি বিশ্বে দ্বিতীয় । রাজ্যের মুখ্যসচিব ও এডভোকেট জেনারেল মনোনীত হয়েছেন গঙ্গা-যমুনার অভিভাবক হিসেবে নদীর ‘মানবাধিকার’ যাতে রক্ষিত থাকে তার দেখভালের জন্য । মহামান্য আদালতকে আমাদের হৃদি-উৎসারিত ধন্যবাদ । দেবতায়ন যা পারেনি মানবায়ন যদি তা পারে সেও এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে ।

 

তিন  

এ নদীর জল

তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:

সব ক্লান্তি রক্তের থেকে

স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;

এই নদী তুমি।

এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি ?’

-       জীবনানন্দ দাশ

 

তবু বাকী রয়ে গেল কত কথা – নদী পরিকল্পনা নিয়ে, বাঁধ নিয়ে, বন্যা নিয়ে । অন্য পরিসরে বলা যাবে সেইসব ভাল-মন্দ কাহন । শুধু পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসমূহের সমস্যার দুটি পর্ব – এক, ভাগীরথী-হুগলীর সমস্যা আর দুই, দামোদর-রূপনারায়ণের সমস্যা । এ দুই সমস্যা আবার পরষ্পরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে । শুধু অন্তত গঙ্গা-ভাগীরথীর জল নিয়ে সাম্প্রতিক ছবিটির একান্তই উল্লেখ প্রয়োজন । চুক্তি অনুসারে গত ২০১৬-র মার্চ মাসের ১১-২০ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশকে ৩৫০০০ কিউসেক গঙ্গার জল দেওয়ার ফলে ভাগীরথীর বরাদ্দে টান পড়ে । জঙ্গীপুর থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত ২২০ কিলোমিটার নদী-দৈর্ঘ্যে এক ‘ফাইন মর্ণিং’-এ পাড়ের মানুষ হতবাক বিস্ময়ে দেখলেন জায়গায় জায়গায় চর জেগে উঠেছে । জানা গেল ফরাক্কা ফিডার ক্যানাল দিয়ে জল আসছে না । বন্ধ হয়েছে এনটিপিসি-র বিদ্যুৎ ইউনিট । অন্য যে সব উপনদী যেমন পাগলা, বাঁশলই, ময়ুরাক্ষী, অজয় যারা ভাগীরথীকে জলের যোগান দিত তারাও শুকিয়ে গেছে । এই হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়া কিন্তু আদপে ‘হঠাৎ’ নয় । গভীরতর সংকট এড়াতে নদী বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবিত জরুরী ভিত্তিতে তিনটি পদক্ষেপের একান্তই প্রয়োজন । এক   যে এগারোটি রাজ্যে গঙ্গা অববাহিকা বিস্তৃত, সেখানে গঙ্গা বা তার উপনদীগুলির উপর জলাধার নির্মাণ বা সেচের জন্য জল টানার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে যাতে নদীর কোন অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে না যায় । দুই   নদী পাড় থেকে ৫০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত গভীর বা অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের জল তোলা নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন যাতে জলস্তর থেকে নদীর দিকে বেস-ফ্লো স্বচ্ছন্দ থাকে । তিন তিন দশক আগে (১৯৯৬) সম্পাদিত ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গাজল চুক্তির পুনর্ম্যুলায়ন যেহেতু বদলে গেছে গঙ্গা অববাহিকার ভূগোল । কমেছে বহমান জলের পরিমাণ । হিমালয় থেকে নেমে আসা তিনটি প্রধান নদী সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র । এদের উপনদীগুলির বেশীর ভাগই হিমালয়ের হিমবাহপুষ্ট । তাই সারাবছর জল পেতে নিষেধ নেই ।  কিন্তু সিন্ধুর সামান্য অংশই ভারতের ভাগে । ব্রহ্মপুত্রের অধিকাংশই তিব্বত দিয়ে প্রবাহিত । তারপরে ভারতবর্ষে প্রবেশ । ভারতের আপন নদী বলতে গঙ্গা-ই । তাই বলতে হল এত কথা গঙ্গা-ভাগীরথী নিয়ে ।  

 

নদীবিজ্ঞানীরা প্রথমেই বলে থাকেন যে জীবিত প্রাণীদেহের মতোই নদী প্রবাহের সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে এক প্রাকৃতিক ভারসাম্য । নদীর কোন অংশে কোনও রকম পরিবর্তন ঘটলে বা ঘটালে সমস্ত অংশই নিজেদের পরিবর্তিত করে ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসী হয় স্বতঃস্ফূর্ততায় । আর সাময়িক লোভে বা লাভে সে পরিবর্তনসাধন যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং দূরদর্শিতার সাথে সুরিকল্পিতভাবে না হয় তবে ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাড়নায়  নদী সংহার মূর্তিতে দেখা দেয় । অবশ্যই যার ফল শুভ হয় না । খুব সাধারণ টেক্সটে এমনি এমনতরো কথা শুধু নদীবিজ্ঞানী কেন, যে কোন মরমী মানুষেরই কথা । জয়া মিত্রের মর্মছোঁয়া ভাষায় 

...নদী যে কলের জলের মতো কেবল একটি ধারা নয়, তার নিজস্ব জটিল প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা আছে, সেই শৃঙ্খলা হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে আর সেই নিয়মগুলো মেনেই মানুষ এতকাল ধরে নদীর পাশে বাস ও চাষ করেছে – এই কথা মনে না রেখে নদী এবং জলবিজ্ঞানকে অগ্রাহ্য করার দরুন, নদীর প্রকৃতি না বুঝে যেখানে-সেখানে তাকে আটকে দেওয়ার দরুন, সভ্যতার ধাত্রী নদীরা আজ বিধ্বংসী হয়ে উঠছে । যে বিপদ আজ কেরলে ঘটেছে, কাল তা পুরুলিয়া, বীরভূম বা অন্য কোথাও ঘটবে না, এমন না হতেও পারে ।

কিন্তু নদী কি কখনো হয়ে উঠতে পারে মানুষেরই পরিবারের এক সদস্য, মানুষেরই মতো । এই    আপাত অলৌকিক প্রতীতির একটি স্বাক্ষর দিয়ে শেষ করি এ’ নিবন্ধের কথা ও কাহিনী  - এক আশ্চর্য দম্পতি শমিতা ও উৎপল চৌধুরী-র এক নদী-কন্যাকে ঘিরে অলৌকিক জীবন পরিক্রমা ; ওদের অ্যাকাডেমিক পড়াশুনো ফার্মাসী নিয়ে । তিন দশক আগে পাহাড়ের নেশার প্রাথমিক টান থেকে  ভালোবেসে ফেলেছিলেন পাহাড়ী নদী তিস্তাকে, ১৭২০০ ফুট উচ্চতার ‘ৎসো লামো’ জোড়া হ্রদের জলরেখার সাথে হিমবাহ উৎসারিত ‘চাম্বু চু’ নদীর সংযোগে   যার জন্ম সিকিমের পাহাড়ে । ভারতের উচ্চতম হ্রদ । লেখক ও চিত্রগ্রাহক দম্পতি তিস্তার এই উৎপত্তিস্থল থেকে চারশ’ কিলোমিটার নেমে ভ্রমণ করেছেন রংপুরের তিস্তামুখ ঘাটে যেখানে তিস্তা মেশে ব্রহ্মপুত্রে। একবার নয়, বারবার – নয়বার । তিন দশক জুড়ে শমিতা ও উৎপল দেখেছেন তিস্তাকে, দেখেছেন  পাহাড়ে তার অববাহিকায় বিভিন্ন উচ্চতায় এবং সমতলে অরণ্যপ্রবাহিণী তিস্তার বিভিন্ন অঞ্চলে কত বিভিন্ন জনজাতির বাস, কত শত বছর ধরে যাদের যাপন তিস্তা-বৌদ্ধধর্ম-কাঞ্চনজঙ্ঘা-ডুয়ার্সের অরণ্যকে ঘিরে।  সেই গভীর নির্জন পথের অভিজ্ঞতাকে গভীরতম মমতায় কথায় ও আলোকচিত্রে গ্রন্থায়িত করে উপহার দিয়েছেন পাঠকবৃন্দকে । সেই আশ্চর্য গ্রন্থের নাম – অ্যান্ড দ্য তিস্তা ফ্লোজ । এ’ গ্রন্থের একটি মর্মছোঁয়া পরিচিতি দেবেশ রায় দিয়েছিলেন দৈনিকের পৃষ্ঠায় । তাঁর সেই রিভিউ থেকে একাংশ উদ্ধৃত করে আজ ইতি টানি নদী-কথায় –

 

“লোকজীবনের এক নদীর ভিতর এমন অলৌকিককে তাঁরা খুঁজে পেলেন কেন ? খুঁজলেনই বা কেন ? আজ থেকে তিরিশ বছর আগে শমিতা-ঊৎপল যখন পাহাড়ে-পাহাড়ে উঠছেন, ঘুরছেন, তখনই তাঁদের প্রথম সন্তান সম্ভাবনায় পাহাড়-পর্বতের ছায়ায়, পাহাড়ী নদীর শিকরকণায় নিজেদের ভেজাতে ভেজাতে ঠিক করেন যে, ছেলে হলে নাম রাখবেন রঙ্গিত আর মেয়ে হলে তিস্তা । মেয়ে হল, তার নাম হল তিস্তা। তিস্তার যখন তেরো বছর বয়স,  সে এনকেফেলাইটিসে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। শমিতা-উৎপলের আর সন্তান হয়নি । তাঁরা তিস্তাকেই তাঁদের মেয়ে করে নিয়েছেন । তাই সমতল থেকে শিখরে ওঠার কাহিনী তাঁরা লেখেন না । লিখেছেন তিস্তার সেই জন্ম, দিস্তাং হিমবাহ থেকে, আর তাঁর নারী ও নদী হয়ে ওঠা ও পরিণত সেই তাঁদের কন্যার ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলনের কথা । তিস্তা তাঁদের শোককে জীবন দিয়েছে ।“

 

নদীকে ঘিরে জনজাতির জীবনধারায় কি কোন সূক্ষ্ণ-তন্ত্রীতে এসে মিশল আরবান  হৃদয়-ঝরা একবিন্দু রক্ত ? পুরাণে উপকথায় প্রায়শই নদী কারো কন্যা কারো জায়া কারো জননী । পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা ছিলেন গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার দুহিতা, উমার সহোদরা, রাজা শান্তনুর স্ত্রী এবং ভীষ্ম-জননী । ব্রহ্মপুত্রে  মিশে যাওয়া তিস্তা-র পিতামাতা কিভাবে হয়ে উঠলেন রক্ত-মাংসের এক দম্পতি ! গঙ্গা-দামোদর-সুবর্ণরেখায় অবৈধ বালি খাদানের কারবারীরা কি জানে এই হয়ে-ওঠা সত্য ? ঈশ্বর পাটনীর সন্তান আমরাই বা কতটা জানি ?

 

১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্বল্প পরে লেখক-শিল্পীদের এক প্রতিনিধিদল সে দেশে গিয়েছেলেন সৌজন্য সফরে । সে দলে ছিলেন ঋত্বিক ঘটক নামে এক বাউন্ডুলে অনিকেত মানুষ। শুনেছি পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে ঘোরজ্বরে প্রলাপের মতো মন্তব্য করেছিলেন – এরা একি অবস্থা করে ছেড়েছে পদ্মার !  যেন কোন ধ্বস্ত মানবীকে প্রত্যক্ষ করছেন । তারপরেই সঙ্গী মানুষদের বিহ্বল করে ভেঙ্গে পড়েছিলেন বাঁধভাঙ্গা কান্নায় । কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছিলেন, শুনেছি, সেদিন পানীয়ের মাত্রাটা একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল ।


No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.