Thursday, June 25, 2020

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ

বাণিজ্যের আজ কোনও দেশ নেই : খাওয়া-পরার নতুন গল্প

ম্প্রতি ‘আত্মনির্ভর’ শব্দটি জনমানসে প্রাবল্য পেয়েছে। তার কারণ অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী। কোভিড আক্রান্ত দেশবাসীর যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন তাঁর কথামালা সিরিজের মাঝখানে হঠাৎ কথাটি পেড়ে তিনি বেশ মজে উঠেছেন এই ভেবে যে আবারও নির্ঘাৎ সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কারণ, সর্বপ্রথম তিনি যখন থালাবাসন পেটাতে বলেছিলেন ও তারপর মোমবাতি জ্বালাতে, এই হিসেব কষে যে মহাভারতের যুদ্ধে যদি পাণ্ডব-জয় পেতে আঠারো দিন লেগে থাকে, তাহলে নিশ্চিত করোনা-যুদ্ধে তা একুশ দিনের বেশি হবে না। কিন্তু, অচিরেই যখন বুঝলেন, এ ঘোর কলি, অত সহজে তুকতাক ফলার নয়, তখন ‘আত্মনির্ভর’এর আর্তনিনাদ ছাড়া আর উপায় কী!

এই আত্মনির্ভর কথাটি আমরা ছোটবেলা থেকে অহরহ শুনে আসছি। বাবা বলতেন, নিজের পায়ে দাঁড়া। অর্থাৎ, আত্মনির্ভর হ’। আরও খোলসা করে বললে, চাকরি-বাকরি জোগাড় কর, বাবা তো আজ বাদে কাল রিটায়ার তারপর পরশু উপরে, তখন পাগলা খাবি কী! যা হোক একটা চাকরি-বাকরি, অথবা ছোটখাটো দোকান, বা ব্যবসাপাতি, নিদেনপক্ষে হালচাষ- কিছু একটা তো কর। দু’ তিনটে পাস দেওয়া শহুরে মধ্যবিত্ত কি নিম্নবিত্ত বাঙালি, ওই চাকরিবাকরিটাই আগে বোঝে; মানে, চাকরিবাকরি পেয়ে, ঘর সামলে আত্মনির্ভর হওয়া। প্রধানমন্ত্রী কি এই তাবৎ ক্লিশে কথাটিই, আর কিছু বলার না পেয়ে, বলেছেন? সম্ভবত হ্যাঁ, সম্ভবত না। সম্ভবত হ্যাঁ, কারণ, আত্মনির্ভর হওয়ার অর্থ ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো’। আর সম্ভবত না- এই কারণে যে তিনি কথাটি দেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন যেখানে ‘আত্মনির্ভর’ শব্দের অভিব্যক্তিটিই আজ এসে আমূল বদলে যেতে বসেছে। যদি বুঝি, দেশের মানুষ, দেশের কোম্পানি, দেশের ফসল, দেশের উৎপাদন- মোদ্দা কথায়, ঘরের ছেলে ঘরে নাইবে ঘরের খাবে- তাহলে আমেরিকায় ট্রাম্প এইচ-১বি ও অন্যান্য ভিসা বন্ধ করলে আমাদের ঘরের ছেলের গোসা হয় কেন? ট্রাম্প সাহেব তো তাঁর নিজের দেশের নাগরিকদের কথা ভেবেই তা করেছেন, নাকি? অথচ দেখুন, তাঁর দেশের গুগল, মাইক্রোসফট ধরনের প্রায় সমস্ত কর্পোরেট মহারথীরা এই সিদ্ধান্তে খেপে লাল! এমনকি তাঁর দলের সেনেটর’রাও আপত্তি জানিয়েছেন। আরে কী মুশকিল, উনি তো দেশের নাগরিকদের চাকরিবাকরি পাইয়ে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার পথকেই সুগম করছেন বলে ঠাহর করেছেন! 

Photo Source Link (Click Here)

আসলে, আত্মনির্ভরতার স্বাভাবিক প্রয়াসটি আজ আর কোনও দেশের গণ্ডিতে সীমায়িত নয়, তা বহুদিন বাঁধা পড়েছে জটিল ও বিস্তৃত গ্লোবাল চেইন’এর বহমানতায়। তাই, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিদান মেনে বিদেশি পণ্যের ওপর ইচ্ছেমতো উদোম কর চাপানো যায় না। বহু ঘোষিত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ যদি সত্যি সত্যিই সফল হত তাহলে সে সব জিনিসপত্তর কি শুধু এ দেশের লোকেরাই কিনে কিনে ঘরে ডাই করত? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা!

শুধুমাত্র একটি দেশের নিরিখে, অতএব, আজকের সময়ে ‘আত্মনির্ভর’ শব্দবন্ধটি এক সোনার পাথরবাটি। কারণ, নিখাদ দেশজ পণ্য বলে আর তেমন কিছু নেই। যদি তর্ক জুড়ে বলেন, কেন, এই যে মাঠ ভর্তি ধান রুইয়েছি, সেগুলান তো আমার, এ মাটির। কিন্তু কত্তা, মাটিতে যে সার দিয়েছেন, পোকা ধংসের ওষুধ মেরেছেন, নিদেনপক্ষে চালের কলে ধান ভাঙ্গিয়েছেন, তার সব কি এ দেশের? এই তো, ভারত সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের একটি সূত্র থেকে পাচ্ছি, ২০১৮ সালে ভারতে আমদানিকৃত রাসায়নিক সারের মোট মূল্য যেখানে ছিল ৩৪৫.৩৯ কোটি মার্কিন ডলার, তা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০৪.৩৮ কোটি মার্কিন ডলারে। পাশাপাশি, ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে তৎকালীন রাসায়নিক ও সার মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীকান্ত কুমার জেনা লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন যে এ দেশে মোট ব্যবহৃত ফসফেট’এর ৯০ শতাংশ ও পটাশ’এর ১০০ শতাংশই আমদানি করা হয়। এমনতর ভুরি ভুরি নিদর্শন দিতে থাকলে আলোচনার অন্য পরিসরে আর পৌঁছনোই যাবে না। মোদ্দা কথাটা হল, আজকের বিশ্বে দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তি বা একটি সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা অনায়াসে ভাবতেই পারে কিন্তু তার জন্য সে শুধুমাত্র তার নিজের দেশের ভেতর থেকেই সমস্ত সম্পদ জোটাতে পারবে বা সেই দেশিয় সীমানার মধ্যেই তার পূর্ণ উপযোগিতা দেখাতে পারবে তেমনটা কখনই নয়। আর সামগ্রিক দেশের নিরিখে তো বিষয়টা আরও জটিল। কারণ, একটি দেশ তার দুয়ার এঁটে আজকের দুনিয়ায় চলতেই পারে না। 

তাহলে গিঁটটা কোথায়? গিঁটের সুতোটা বাঁধা আছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সক্ষমতা প্রকাশে, বাণিজ্যের রণনীতি ও কৌশল নির্মাণে এবং কল্পনাশক্তির দৌড়ের কাছে। এই তিন অস্ত্র যার যত নিপুণ, চৌখস ও বুদ্ধিদীপ্ত তার আত্মনির্ভরতার সোপান তত বেশি পোক্ত। এই তিন যাদুকাঠির মন্ত্রবলেই খুলে যেতে পারে দুনিয়ার দুরূহতম গিঁটগুলি। আমাদের দেশ বিশ্ব বাণিজ্যের প্রাঙ্গণে পসরা নিয়ে বসেছে বটে কিন্তু তেমন নতুনতর সম্ভার গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি; তা সে যে সরকারই গত কুড়ি বছরে ক্ষমতার তখতে আসীন হয়ে থাকুক না কেন। নিজ আত্ম-অবলোকনেই তার অনীহা। স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের এটা-সেটা বয়কটের হম্বিতম্বি আর সরকারের তরফে আইটি কুলি জোগান দেওয়ার কর্তব্যকর্মের বাইরে সে আর বিশেষ কিছু করার সাহস করেনি।

বরং, গ্লোবাল কর্পোরেটদের থেকে কাটমানি খেয়ে কেউ কেউ তাদের উঞ্ছবৃত্তি করেছে মাত্র। যে সব ভারতীয়ের সৃজনক্ষমতা ছিল তারা পাড়ি দিয়েছে ভিন্ন দেশে। আসলে, যুদ্ধ ও অতি জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে দু-একটা নির্বাচনী সাফল্য জুটতে পারে কিন্তু অর্থনীতির তাতে আখেরে কোনও ফায়দা নেই। কারণ, বিশ্বব্যাপী যে গ্লোবাল চেইন সেখানে নিজের জায়গা করে নিতে হলে সৃজনশীলতা ও বাণিজ্য কৌশলের গভীর পরীক্ষা দিতে হয়। আর এই পরীক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তিকে শুধু আয়ত্ব করা নয়, তার উদ্ভাবন ও স্বয়ংক্রিয়তার নিত্যনতুন সূত্র উদ্ভাসিত করা ছাড়া উপায় নেই। যদি এ দেশে অযূত স্ব-উদ্যোগী গড়ে তুলতে হয় তাহলে আধুনিক প্রযুক্তির বলয়ে তাদের মুক্ত ভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। সেখানে দেশের সীমানা কখনই কোনও বাধা হতে পারে না। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিসরে কোনও একক প্রভু নেই, সেখানে সকলেই কম-বেশি সম্ভাবনাময় অকস্মাৎ প্রভু। 

Photo Source Link (Click Here)

আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই, আজ দেশের আপামর নাগরিকের সামাজিক সুরক্ষার সমস্ত দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কারণ, অর্থনীতির সূত্রগুলির দখল নিয়ে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত যন্ত্র যেখানে গোটা পরিক্রমাটাই হয়ে উঠছে অতীব পিচ্ছিল ও অনিশ্চয়তায় ভরপুর। হয়তো এ দেশে রেজিস্টার্ড কোনও স্টার্ট-আপ, যার মালিকানার একটা বড় অংশ ভারতীয়দের হাতে, কিন্তু দেখা গেল অচিরেই সেখানে চীন থেকে পুঁজি এসে একটা বড় অংশ কিনে নিয়েছে। সে সংস্থার কর্মীরা হয়তো ভারতীয়, কিন্তু চীনা অংশগ্রহণে তার কাজের পরিসর বিস্তৃত হয়ে এবার তা হয়তো মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডেও প্রসার পেল। তাকে কি এবার আর নিপাট ভারতীয় সংস্থা বলা যাবে? কিন্তু কর্মরত ভারতীয় কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষার দিকে দেশের সরকারকে নজর তো দিতে হবে! কাল যদি তাদের চাকরি না থাকে বা মাইনে কমে যায় তাহলে সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নটি আরও বড় হয়ে দেখা দেবে। এই পিচ্ছিল গতিময়তার জন্যই আজকাল ‘সর্বজনীন ন্যূনতম আয়’এর ধারণাটি বেশ বড় আকারে নানান আলোচনার পরিসরে ঢুকে পড়েছে। অর্থাৎ, কর্তব্যকর্মটি হল- সকল নাগরিকের সুস্থ জীবনের দায়িত্ব নাও। কে নেবে? সরকার মহোদয়। এই ধারণাটিই এখন গ্রাহ্য ও একেই সাব্যস্ত করার প্রয়াস চলেছে সর্বত্র। ইচ্ছেয় হোক কি অনিচ্ছেয়। জনমানসে সরকারের কর্মক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিচার এখন এই মাপকাঠিতেই চলেছে। 

Photo Source Link (Click Here))

তাই সাদা মনে অল্প কথায় বললে, আজকের অর্থনীতিতে দেশি বা বিদেশি কোম্পানি অথবা কর্মীদল- এসব বিভাজনের তেমন কোনও তাৎপর্য নেই আর। কোনও কোম্পানিই স্বয়ম্ভূ নয়- তা এই অর্থে যে তা সর্বৈব ভাবে গ্লোবাল চেইনে আবদ্ধ, তাকে অন্য কোনও বিদেশি কোম্পানি থেকে কাঁচামাল বা প্রযুক্তি কেনাবেচা করতেই হয়। আর কর্মীদল বা শ্রমিকেরাও কোনও নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হলেও তাদের কর্মস্থল বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই হতে পারে। দেশের মঙ্গল, যদি সে দেশের সরকার বসবাসকারী তার সমস্ত নাগরিকের সুস্থ ও সবল ভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে পারে। তা হতে পারে, একদিকে সমস্ত নাগরিকের ন্যূনতম আয়কে সুনিশ্চিত করে (Universal Basic Income) ও অন্যদিকে কর্মরত মানুষের অধিকার, সকল মানুষের ভিন্ন ভিন্ন যাপনের বিন্যাসকে (শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ প্রভৃতি) যথাযথ ভাবে পরিচর্যা করে।

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিসরে ক্রমপ্রবিষ্ট বিশ্ব গিগ অর্থনীতির এ ছাড়া আর পথই বা কী!


[অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত । ]  

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের বইগুলি পড়ুন, 

অর্ডার দিন বইঘরের অনলাইন স্টোর থেকে ক্লিক করুন এখানে







No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.