Wednesday, June 10, 2020

চন্দন দেবনাথের প্রবন্ধ


সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার অবসান হোক


[২০১৪ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত]

[আগেই বলে রাখা ভালো যে, মার্কস-এঙ্গেলসের কাছে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘সাম্যবাদ’ দুটো কিন্তু ছিল সমার্থক। এই লেখাতেও তেমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছে।]

শুরু করা যাক আপাত এক মামুলি প্রশ্ন দিয়ে : পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য কি বাজার? আর এটাই কি সমাজতন্ত্রের সাথে তার পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য? অন্য ভাবে বললে ব্যাপারটা কি এরকম : পুঁজিবাদের ভিত্তি হল বাজার আর সমাজতন্ত্র মানে হল তার বিলোপ?

     প্রশ্নটা এই কারণে যে, পুঁজিবাদকে “পুঁজিবাদ” না বলে “বাজার অর্থনীতি” নামে অভিহিত করার একটা চালু রেওয়াজ আছে। অথচ ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও যাঁদের আছে, তাঁদের এটা একটা জানা কথা যে, পুঁজিবাদ আবির্ভাবের বহু আগেও বাজারের অস্তিত্ব ছিল। তখনও উৎপাদন হতো উৎপাদকদের নিজেদের ভোগের জন্য শুধু নয়, হতো হাটেবাজারে বেচে অর্থ উপার্জনের তাগিদেও। এক কথায়, পণ্য উৎপাদন হতো। অর্থাৎ এমন কথা বলা মোটেই ইতিহাসসম্মত নয় যে, পণ্য উৎপাদন তথা বাজার ব্যবস্থা হল কেবল পুঁজিবাদেরই বৈশিষ্ট্য। বরং পুঁজিবাদের বহু আগে থেকেই তার অস্তিত্ব। তাহলে পুঁজিবাদকে “পুঁজিবাদ” না বলে “বাজার অর্থনীতি” বলার কারণ কী? এটা কি শুধুই কথার কথা? নাকি এর ভেতরেও কোনও রহস্য নিহিত আছে? অবশ্যই আছে। আর সেটা হল এই যে, পুঁজিবাদকে শুধুই “বাজার অর্থনীতি” নামে চিহ্নিত করার ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদের পূজারিদের পক্ষ থেকে পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যটাকেই আসলে সযত্নে আড়াল করা হয়।  

     পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য তাহলে কী? কী সেই বৈশিষ্ট্য, যা দিয়ে প্রাক-পুজিবাদী সমাজগুলো থেকে তার তফাৎটা স্পষ্ট হয়? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর হতে পারে : পুঁজিবাদ আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই অস্তিত্বশীল ব্যক্তিগত মালিকানা ও পণ্য অর্থনীতির ক্রম বিকাশধারায় মানুষের শ্রমক্ষমতাটাও যখন পণ্য হয়ে দাঁড়ালো, সমাজ বিকাশের সেই সন্ধিক্ষণটাকেই আমরা পুঁজিবাদের জন্মলগ্ন হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। একটু খেয়াল করলেই লক্ষ করা যাবে, বিপুল তাৎপর্যসম্পন্ন এই ঐতিহাসিক সত্যটাকে সামনে আনার ব্যাপারে বুর্জোয়া ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদদের বড়ই অনীহা।  যেন বা এটা গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ই নয়! যেন বা মানুষের শ্রমক্ষমতা চিরকালই ছিল পণ্য! কিন্তু ইতিহাস তো সে কথা বলে না। তাহলে ঐতিহাসিক এই সত্যটাকে সোজাসাপটা ভাবে সামনে আনতে এই অনীহা কেন? কারণ আছে বৈকি। আর সেটা হল এই যে, এই সত্যটাকে ধরে সামনে এগোলে আরও এমন কিছু সত্য সামনে চলে আসবে, যেগুলোকে স্বীকার করার অর্থ হল পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান নেওয়া। যেমন এই প্রশ্নগুলো : মানুষের শ্রমক্ষমতা পণ্যে পরিণত হল কীভাবে; অন্যান্য পণ্যের সাথে এই পণ্যটির তফাৎ কোথায়; উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকদের শ্রমক্ষমতার দাম (অর্থাৎ মজুরি) মিটিয়ে দেওয়ার পরেও শ্রমক্ষমতার ক্রেতা যারা, সেই পুঁজিপতিশ্রেণীর পুঁজির সমষ্টি ক্রমাগত বেড়ে চলতে পারে কীভাবে ইত্যাদি।  

     পুঁজিবাদের উচ্ছেদ যাঁরা চান, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে যাঁরা চান, তাঁদের কাছে এইসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর অবশ্যই থাকা দরকার। দরকার, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করার স্বার্থেই।

     একটা সময় ছিল, যখন নিঃসংশয়ে মনে করা হতো পৃথিবীর বিশাল একটা অংশ জুড়ে বিরাজ করছে এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে শোষণ নেই, বৈষম্য নেই, নির্যাতন নেই। দুনিয়ার তামাম মেহনতি মানুষের চোখে তখন সেটাই ছিল পুঁজিবাদের প্রকৃত বিকল্প, মানে সমাজতন্ত্রকিন্তু নির্মম সত্য এটাই যে, সেই “সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া” এখন ইতিহাস মাত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ার ঘটনায় পুরনো বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আর রাষ্ট্র হিসাবে চিনের কোনও ভাঙ্গন ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু সেখানেও যে চলছে আসলে পুঁজিরই শাসন, সেই সত্যও ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে। সব মিলিয়ে আজ ভয়ঙ্কর হতাশাজনক এক অবস্থা। স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগল, কেন এমন হল। এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হলে আগে বুঝে নেওয়া দরকার, মানব সমাজের কোন পরিবর্তন ঘটলে আমরা বলতে পারি সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে। এবং নির্মম ভাবে এটাও আজ বুঝে নেওয়া দরকার, পূর্বতন “সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া” সম্পর্কে আমাদের ধারণা কতখানি সঠিক ছিল। এই লেখাটির বিষয়বস্তুও সে কারণে সমাজতন্ত্র কাকে বলবো কেবল তাই নিয়ে। কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করতে হলে পুঁজিবাদ সম্পর্কেও ধারণা সঠিক হওয়া চাই, চাই পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যটাকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে পারা। 


     আগেই বলা হয়েছে, পুঁজিবাদ আবির্ভাবের পেছনে আছে মানুষের শ্রমক্ষমতা পণ্যে পরিণত হওয়া। মজুরির বিনিময়ে এখন যেটাকে আমরা কেনাবেচা হতে দেখি, এবং খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, সেটা কিন্তু চিরকাল পণ্য ছিল না। কীভাবে তা পণ্যে পরিণত হল, মানব সমাজ বিকাশের ইতিহাসে সেটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মানুষের শ্রমক্ষমতা পণ্য চরিত্র গ্রহণের পেছনে রয়েছে নির্মম উচ্ছেদের এক কাহিনী - শ্রমক্ষমতা ছাড়াও সামাজিক উৎপাদনের জন্য আর যেসব জিনিস আবশ্যক, অর্থাৎ উৎপাদনের হাতিয়ার, কাঁচামাল ও জমি, সেসব থেকে জনসমষ্টির এক বিশাল অংশকে উচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্ন করার এক নিষ্ঠুর কাহিনী। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তেই রয়েছে এরকম এক কাহিনীরূপ তার নানারকম হতে পারে, কিন্তু সারবস্তু একই। উৎপাদন ও জীবনধারণের উপকরণগুলো থেকে উচ্ছেদ ও বিচ্ছেদ ঘটানোর এই ইতিহাসেরই ফসল হল প্রলেতারিয়াত বা সর্বহারাবর্গের আবির্ভাব। আর মুষ্টিমেয় যে মানুষজনেরা উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিকে পরিণত হল, তারাই হয়ে উঠলো পুঁজিপতিবর্গ। ফলাফল দাঁড়ালো এটাই যে, নিজেদের ভরণপোষণের জন্য এই পুঁজিপতিবর্গের কাছে মজুরির বিনিময়ে নিজেদের শ্রমক্ষমতা বেচতে বাধ্য হওয়া ছাড়া সর্বহারাবর্গের সামনে আর কোনও উপায় খোলা রইল না। আর পুঁজিপতিবর্গের পক্ষেও সম্ভব হল সর্বহারাবর্গের কাছ থেকে শ্রমক্ষমতা কিনে নিয়ে উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত করা। কিন্তু নিছক উৎপাদনই তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের চাই পণ্য উৎপাদন। আবার পুঁজিবাদের আগে যে ধরনের পণ্য উৎপাদন চালু ছিল, সেরকম পণ্য উৎপাদন হলেও চলবে না। হতে হবে পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদন। অর্থাৎ এমন ধরনের পণ্য উৎপাদন, যার ভেতর দিয়ে শ্রমিকের শ্রমক্ষমতা নিংড়ে নিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য আদায় করা যায়। মানে উৎপাদন প্রক্রিয়াটা হতে হবে এমন যাতে উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকরা তাদের মজুরি বাবদ যে মূল্য, তার চাইতেও বেশি মূল্য উৎপাদনে বাধ্য হয়। আর এই উদ্বৃত্ত মূল্যটাই হল পুঁজিপতিশ্রেণীর পকেটস্থ হওয়া মুনাফার আসল উৎস। এই পুঁজিবাদী মুনাফারাজের কোনও জন্মই হতো না, যদি মনুষ্য শ্রমক্ষমতার পণ্যে রূপান্তর না ঘটতো। তাই উল্টো দিক থেকে বলা যায়, মনুষ্য শ্রমক্ষমতার পণ্য চরিত্রের যদি বিলোপ ঘটানো যায়, অর্থাৎ এমন একটা অবস্থা যদি সৃষ্টি করা যায়, যেখানে শ্রমক্ষমতা কেনাবেচার আর কোনও ব্যাপার নেই, একমাত্র তাহলেই বলা যাবে পুঁজিবাদের বিলোপ ঘটেছে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

     এখন প্রশ্ন হল, শ্রমক্ষমতার পণ্য চরিত্রের বিলোপ কীভাবে ঘটানো সম্ভব। এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে শ্রমক্ষমতা কীভাবে পণ্যে পরিণত হল সেই সত্যটার ভেতরেই। সামাজিক উৎপাদনের উপকরণগুলো থেকে ব্যাপক মানুষের উচ্ছেদ এবং মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সেগুলোর কেন্দ্রীভবনই যেহেতু শ্রমক্ষমতার পণ্যে পরিণত হওয়ার ভিত্তিভূমি, তাই বলা চলে, এই অবস্থাটা যদি আমূল বদলে দেওয়া যায়, অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণগুলোর ওপরে সমস্ত ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ ঘটিয়ে গোটা সমাজের হাতে যদি সেগুলোকে নিয়ে নেওয়া যায়, অর্থাৎ সেগুলোর প্রকৃত সামাজিকীকরণ ঘটানো যায়, একমাত্র তাহলেই শ্রমক্ষমতার পণ্যরূপী চরিত্রের বিলোপ ঘটানো যাবে এবং ফলত পুঁজিবাদেরও অবসান ঘটানো যাবে।

     তবে শান্তিবাদীরা যাই বলুন না কেন, এই সামাজিকীকরণের কাজ আদৌ শান্তিপূর্ণ ভাবে ঘটানো সম্ভব কি না, তাই নিয়ে বিরাট বড় একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন থেকেই যায়। সামাজিকীকরণ ঘটানোর অবশ্যই একটা পূর্বশর্ত আছে। আর সেটা হল, উৎপাদনের উপকরণগুলোর সামাজিকীকরণেই কেবল যাদের মুক্তি, অর্থাৎ পুঁজিপতিশ্রেণীর কাছে মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তি, সেই শ্রমিকশ্রেণীকে আগে নিজেদের বিপ্লবী শাসন কায়েম করতে হবে। যেটা কিনা একটা চরম রাজনৈতিক বিপ্লব; পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থবাহী চালু রাষ্ট্র যন্ত্রটাকে ভেঙ্গেচুরে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থবাহী নতুন এক বিপ্লবী রাষ্ট্র নির্মাণের মহা কর্মযজ্ঞ। এখানে ‘বিপ্লবী’ বিশেষণটার ওপরে জোর। কারণ, শ্রমিকশ্রেণীর এই নতুন রাষ্ট্রটার কাজ হবে সমাজ বিপ্লবের এমন এক মহাপ্লাবন শুরু করা, যার মূল কথা হবে সামাজিক উৎপাদন ও জীবনধারণের উপকরণগুলোর ওপরে সমস্ত ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সেগুলোর সেগুলোর প্রকৃত সামাজিকীকরণ ঘটানো।

     তবে এই “সামাজিকীকরণ” কথাটা নিয়ে কিন্তু বেশ বড় মাপের একটা বিভ্রান্তি আছে। চালু ধারণা হল, সব কিছুকে যদি রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে নেওয়া যায়, রাষ্ট্রই যদি হয়ে ওঠে সব কিছুর মালিক, তাহলেই বলা যাবে সামাজিকীকরণের কাজ সমাপ্ত হল, মানে সমাজতন্ত্র কায়েম হল। এভাবে দেখলে বলা চলে, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চিন সহ “সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া” নামে যার অস্তিত্ব ছিল, তা ছিল সত্যিই সমাজতান্ত্রিক। কেননা, সেখানে প্রায় সব কিছুই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত। এমনকী, কৃষিক্ষেত্রে যে যৌথ খামার চালু ছিল, সেগুলোকেও বলা হতো “সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি”! কারণ, যে জমিতে চাষ হতো, চাষ আবাদের জন্য যেসব যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হতো, আইন অনুযায়ী সেসবও ছিল আসলে রাষ্ট্রের সম্পত্তি, যৌথ খামারগুলোর নিজেদের সম্পত্তি নয়। তাদের মালিকানা ছিল কেবল উৎপন্ন ফসলের ওপরে। যৌথ খামার সম্পর্কিত এই সত্যটাকে যদি উপেক্ষাও করি, তাহলেও থেকে যায় একটা বড় খটকা : সর্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা মানেই যদি হয় সামাজিকীকরণ, তাহলে ব্যাক্তিগত মালিকানার পুনরুদ্ভব আবার সম্ভব হল কীভাবে? সামাজিকীকরণের স্বাদ সেখানকার মানুষজন সত্যিই যদি পেয়ে থাকেন, তাহলে এই পশ্চাদপসরণ তাঁরা মেনে নিলেন কেন? এবং মেনে নিলেন বিনা প্রতিরোধে! কেন? কোনও প্রতিরোধ কিন্তু সত্যিই হয়নি! কেন? কারণ কি এটাই, প্রতিরোধের ইচ্ছা থাকলেও প্রতিরোধের ক্ষমতাটা তাঁদের ছিল না? না, কারণ আদৌ সেটা নয়। বরং সত্য এটাই যে, প্রতিরোধের কোনও তাগিদই আসলে ছিল না। এই সত্য থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, তথাকথিত “সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি” এবং সমাজ, এই দুইয়ের ভেতরে বিচ্ছিন্নতা ছিল ভালো মতোই। অর্থাৎ সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে ছিল ঠিকই, কিন্তু সমাজের হাতে তা ছিল না।

     আসলে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা আর সামাজিকীকরণ মোটেই সমার্থক নয়। কারণ, রাষ্ট্র মানেই তো সমাজ নয়। এঙ্গেলসের কথায়, সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী বিভাজন জনিত শ্রেণী বৈরিতার অমীমাংসারই কারণেই রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। তাই সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দেখতে হবে আলাদা করেই। একই কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানা আর ‘সামাজিক মালিকানা’র ভেতরে সুস্পষ্ট তফাৎ টানতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির শাসন মানেই শ্রমিকশ্রেণীর শাসন, এমনটা যেমন দাবি করা যায় না, একই ভাবে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা দেখিয়ে দাবি করা চলে না, এটাই হল ‘সামাজিক মালিকানা’ অর্থাৎ সমাজতন্ত্র। সামাজিকীকরণের কাজটা সম্পন্ন হয়েছে, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে, কেবল তখনই দাবি করা চলে, যখন উৎপাদন ও জীবনধারণের উপকরণগুলো থেকে প্রকৃত উৎপাদকদের যে বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদে আমরা দেখি, এবং স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, সত্যিই সেই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো গেছে বলে যখন আমরা দাবি করতে পারবো।

     এবারে প্রশ্ন হল, কী দেখিয়ে বলা যাবে যে এই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো গেছে। এই প্রশ্নের একটাই উত্তর হতে পারে : যখন নিঃসংশয়ে বলা যাবে, মানুষের শ্রমক্ষমতা এখন আর পণ্য নয়, অর্থাৎ তার পণ্য চরিত্রের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেছে। বৈষম্যহীন ভাবে বিশ্বব্যাপী গোটা সমাজটাই যখন সামাজিক উৎপাদন ও জীবনধারণের উপকরণগুলোর ‘মালিক’ - সমাজের নাম করে রাষ্ট্র নয় – তখন তো শ্রমক্ষমতা কেনাবেচার ব্যাপারটা আর টিকে থাকারও কথা নয়। যুক্তি তো সেই কথাই বলে। কারণ আমরা তো আগেই দেখেছি, ইতিহাসে শ্রমক্ষমতার পণ্যরূপী চরিত্রের উদ্ভব ঘটেছে, এবং সেই সুবাদে পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, সামাজিক উৎপাদন ও জীবনধারণের উপকরণগুলো থেকে ব্যাপক মানুষের পাইকারি হারে বিচ্ছিন্নতা ঘটানোর ভেতর দিয়ে। তাই সেই বিচ্ছিন্নতাটাই যখন আর থাকবে না, তখন শ্রমক্ষমতার পণ্যরূপী চরিত্রটারও তো বিলোপ ঘটে যাওয়ার কথা।

     এখন প্রশ্ন হল, পূর্বতন “সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায়” শ্রমক্ষমতার পণ্যরূপী চরিত্রের সত্যিই কি বিলোপ ঘটেছিল? উত্তর হল : না। যদিও এটা অনস্বীকার্য যে, সামাজিক উৎপাদনের উপকরণগুলোর ওপরে প্রায় সর্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় মালিকানা কায়েম হয়েছিল। এবং এটাও ঠিক যে, পুঁজিবাদী দেশগুলোর মতো বেকার বাহিনীর অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, শ্রমক্ষমতা সেখানেও ছিল আসলে পণ্যই। পুঁজিপতিশ্রেণী বলতে যে চেহারাটা দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সেই চেহারায় পুঁজিপতিশ্রেণীর কোনও অস্তিত্ব সেখানে ছিল না ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানার আড়ালে রাষ্ট্র সেখানে কার্যত পুঁজিপতিশ্রেণীর ভূমিকাই আসলে পালন করত। আর সমাজের প্রকৃত উৎপাদকরা ছিলেন রাষ্ট্রের মজুরি খাটা শ্রমিকের বেশি কিছু নয়।

     স্তালিন অবশ্য মানতেন না, সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রমক্ষমতা তখনও ছিল আসলে পণ্যই। এই ব্যাপারে তাঁর কথাটা ছিল বরং এই রকম : “শ্রমক্ষমতাকে পণ্য বলাটা, এবং মজুর ‘ভাড়া’ করার কথা বলাটা, এখন উদ্ভটই শোনায় : যেন বা আমাদের ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেণী, যারা উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিক, নিজেরাই নিজেদের ভাড়া করে এবং তার শ্রমক্ষমতা নিজেদের কাছেই বেচে।”1 এই কথার ভেতর দিয়ে স্তালিন নিশ্চয়ই এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, শ্রমিকরা নেজেরাই এখন যেহেতু উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিক, তাই শ্রমক্ষমতাকে এখন পণ্য বলার আর কোনও জায়গাই নেই। হ্যাঁ, স্তালিনের এই দাবি নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া যেতো, যদি দেখা যেতো, সোভিয়েত ইউনিয়নে মজুরি শ্রম প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে। অথচ বাস্তবে কিন্তু আদৌ তেমনটা ঘটেনি। শুধু তাই নয়, মজুরির বিভিন্ন স্তর বিন্যাসও সেখানে ছিল। এই নির্মম সত্যটাকে যদি আমরা অস্বীকার না করি, তাহলে এটাও আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে, তার অন্তর্বস্তুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনও ছিল আসলে পুঁজিবাদের গণ্ডীর ভেতরেই, সেই গণ্ডী কেটে একেবারে গুণগত উত্তরণ তার কখনওই ঘটেনি।  

     এখানে প্রসঙ্গত পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯০৬-০৭ সাল নাগাদ প্রকাশিত “Anarchism or Socialism” শীর্ষক তাঁর এক রচনা সংকলনে স্তালিন কিন্তু খুব স্পষ্ট করেই লিখেছিলেন, সমাজতন্ত্রে শ্রমক্ষমতার পণ্য চরিত্রের বিপুপ্তি ঘটবে। তাঁর নিজের কথাই উদ্ধৃত করা যাক। “সর্বহারা সমাজতন্ত্র কাকে বলে?”, নিজেই এই প্রশ্ন তুলে নিজেই তার জবাব দিয়েছিলেন তিনি এই ভাবে : “পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেহেতু পণ্যোৎপাদন ভিত্তিক, তাই সব কিছুই এখানে পণ্য রূপ ধারন করে, সর্বত্রই ক্রয়-বিক্রয়ের নীতি বিরাজ করে। এখানে আপনি কেবল ভোগের উপকরণ নয় মানুষের শ্রম ক্ষমতাও কিনতে পারেন। আগামী সমাজ হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এটারও অর্থ হল, শোষণের অবলুপ্তির সাথে সাথে পণ্যোৎপাদন এবং ক্রয়-বিক্রয়েরও বিলোপ ঘটবে এবং, সেই কারণে, শ্রম ক্ষমতার ক্রেতা ও বিক্রেতা, নিয়োগকারী ও নিয়োজিতর কোনও জায়গা থাকবে না – সেখানে থাকবে কেবল মুক্ত শ্রমিক।   শেষত, এর অর্থ হল, সেই সমাজে উৎপাদনের উপকরণগুলোর ওপরে ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পূর্ণ অবলুপ্তির সাথে সাথে মজুরি শ্রমের বিলোপ ঘটবে2 ১৯০৬-০৭ সাল নাগাদ এই ছিল যাঁর বিশ্বাস, সেই স্তালিনই পরবর্তী কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধিনায়ক হিসাবে নির্দ্বিধায় বলে দিলেন, শ্রমক্ষমতা এখন আর পণ্য নয়! যদিও কেবল মজুরি শ্রম প্রথা নয়, মজুরির বিভিন্ন স্তর বিন্যাসেরও সুস্পষ্ট অস্তিত্ব সেখানে ছিল। পাঠক এখানে পড়ুন ১৯৩১-এ লেখা স্তালিনের এই কথাগুলো : “মজুরির সমতার বিলোপ আমাদের ঘটাতেই হবে এবং মজুরির পুরনো স্কেলগুলোকে বাতিল করতে হবে। এই অশুভের ইতি ঘটানোর জন্য আমাদের এমন একটা মজুরি স্কেল বানাতে হবে, যেটা দক্ষ ও অদক্ষ শ্রম, ভারি ও হাল্কা কাজের ভেতরে পার্থক্যকে মাথায় রাখবে। এমন একটা অবস্থা আমরা সহ্য করতে পারি না, যেখানে লোহা ও ইস্পাত শিল্পের রোলিং মিলের একজন শ্রমিক একজন ঝারুদারের চাইতে বেশি রোজগার করেন না। এমন একটা অবস্থা আমরা সহ্য করতে পারি না, যেখানে একজন লোকোমোটিভ ড্রাইভারের রোজগার একজন কপিং ক্লাকের রোজগারের সমান।”3 পাঠক, সাথে এটাও পড়ুন : ঐ ১৯৩১ সালেই জনৈক জার্মান লেখক এমিল লুডউইগ–এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে স্তালিন এই সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট ভাবেই বলেন, “যে ধরনের সমাজতন্ত্রে সবাই সমান [মজুরি/বেতন] পান, মার্কসবাদে তেমন সমাজতন্ত্র অজানা।”4 মার্কসের নিজেরও ঠিক এই একই অভিমত ছিল কি না, সেটা অবশ্যই একটা স্বতন্ত্র অনুসন্ধানের বিষয়। তাঁর “গোথা কর্মসূচির সমালোচনা” পড়ে কারও অবশ্য মনে হতেই পারে যে, “সাম্যবাদের নিম্ন পর্যায়ে” মজুরি প্রথা থাকবে এবং মজুরির বিভিন্ন স্তর বিন্যাসও থাকবে, কেবল “সাম্যবাদের উচ্চ পর্যায়ে” গিয়েই সেসবের বিলোপ ঘটবে। এই নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু মার্কসের দোহাই দিয়ে এই দাবি করাটা একেবারেই অসমীচীন যে, স্তালিন জমানায় সোভিয়েত ইউনিয়নে মজুরি প্রথা এবং মজুরির বিভিন্ন স্তর বিন্যাস বজায় থাকা সত্ত্বেও উৎপাদকদের শ্রমক্ষমতা সেখানে মোটেই পণ্য ছিল না।

     এবার কিছুটা লেনিনের কথায় আসা যাক। রুশ বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর লেনিন মাত্র সাত বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি অবশ্য কোথাও বলেননি যে রাশিয়াতে পুঁজিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, সমাজতন্ত্রের বিজয় হাসিল হয়েছে। বরং তাঁর কথা ছিল : “সমাজতন্ত্র হল শ্রেণীর বিলোপ। এই বিলোপের জন্য প্রলেতারীয় একনায়কত্ব যথাসাধ্য করেছে। কিন্তু অবিলম্বেই শ্রেণীর বিলোপ সম্ভব নয়। প্রলেতারীয় একনায়কত্বের যুগ ধরে শ্রেণী আছে ও থাকবে। শ্রেণী যখন লোপ পাবে, তখন একনায়কত্বের প্রয়োজন থাকবে না। শ্রেণী লোপ পাবে না প্রলেতারীয় একনায়কত্ব ছাড়া। পুঁজিবাদে প্রলেতারিয়েত ছিল নিপীড়িত শ্রেণী। উৎপাদন-উপায়ের উপর সর্ববিধ মালিকানা-বর্জিত শ্রেণী।  বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ ক’রে ও রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় করে প্রলেতারিয়েত হয়ে দাঁড়াল শাসক শ্রেণী। স্বহস্তে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রেখেছে সে। শোষকেরা পরাজিত কিন্তু বিলুপ্ত নয়। তাদের রয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ঘাঁটি, আন্তর্জাতিক পুঁজি, যার একটা শাখা হল তারা।”5 এই কথাগুলো লেনিন লিখেছিলেন নভেম্বর বিপ্লব সংগঠিত হবার ঠিক দু’বছর বাদে। এখান থেকে স্পষ্ট যে, লেনিনের বিচারে সেই সময়ে রাশিয়া ছিল প্রলেতারীয় একনায়কত্বের পর্বে, যখন বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব আছে এবং শ্রেণী সংগ্রামও আছে, এবং সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে কেবল তখনই দাবি করা যাবে যখন দাবি করা যাবে শ্রেণীর বিলোপ ঘটেছে।

     লেনিনের আমলে সমাজতন্ত্রের বিজয় ঘোষণা হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর বারো বছর বাদে, ১৯৩৬ সালে এসে, স্তালিন ঠিক সেই দাবিটাই করে বসেন। তাঁর নিজের কথাটাই এখানে উদ্ধৃত করা যাক : “আমাদের সোভিয়েত সমাজ ইতিমধ্যেই সমাজতন্ত্র অর্জনে মোটের উপরে সফল হয়েছে, তা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, অর্থাৎ মার্কসবাদীরা অন্য কথায় যাকে বলে থাকেন সাম্যবাদের প্রথম বা নিম্ন পর্যায়, তার জন্ম দিয়েছে।”6 ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে,  এই দাবি স্তালিন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই কেবল করা হয়নি, তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকেও এই দাবি করা হয়েছিল। লেনিন ঐ সময়ে বেঁচে থাকলে তিনিও একই দাবি করতেন কি না, সেটা অবশ্য বলা মুশকিল। তবে এটা স্পষ্ট যে, বিভ্রান্তির সূত্রপাত এই দাবি থেকেই। কারণ, সমাজতন্ত্রের বিজয় যদি সত্যিই সেখানে হাসিল হয়ে থাকে, তাহলে নতুন করে আবার সেখানে শ্রেণী বিভাজন তথা পুঁজিবাদের উদ্ভব হল কীভাবে? বাইরে থেকে? নাকি ভেতর থেকেই?

     বস্তুত, এই ব্যাপারে এখন আর আমাদের কোনও সংশয় থাকার কথাই নয় যে, পুঁজিবাদের “পুনরুত্থান” নয়, পুঁজিবাদের বস্তুগত ভিত্তিটা সোভিয়েত ইউনিয়নে আসলে থেকেই গিয়েছিল। মোটেই তার বিলুপ্তি ঘটেনি। এবং অনেক পরে স্পষ্ট ভাবে সেখানকার যা কিছু আমাদের নজরে এল, এবং তাই দেখে অনেকেই হতভম্ব হলেন, তার আবির্ভাব মোটেই “বাইরে থেকে” নয়, বরং ভেতর থেকেই ঘটেছে। নির্মম সত্য এটাই যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে পূর্বতন জমিদার, কুলাক ও পুঁজিপতি শ্রেণীগুলোর অস্তিত্ব মুছে গেলেও শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটা কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো টিকেই ছিল, যেখানে রাষ্ট্র ছিল আসলে মালিক আর সমাজের প্রকৃত উৎপাদকরা ছিলেন রাষ্ট্রের মজুরি খাটা শ্রমিকের বেশি কিছু নয়। এই সম্পর্কটাই পরে গিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছে।

     একটু আগেই আমরা দেখলাম, লেনিন বলেছিলেন, পুঁজিপতিশ্রেণীকে উচ্ছেদ করে রুশ প্রলেতারিয়েত নিজেই শাসকশ্রেণী হয়ে উঠেছে, নিজের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রেখেছে। কিন্তু এখন আমরা বলতেই পারি, লেনিনের সময়ে সত্যটা এই ভাবে প্রতিভাত হলেও পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চয়ই একটু একটু করে প্রলেতারিয়েতের হাতছাড়া হয়ে গেছিল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাস্তব জমি থেকে যে সোভিয়েত ক্ষমতার উদ্ভব ঘটেছিল, তার বিকাশ নিশ্চয়ই স্তব্ধ হয়ে গেছিল, ক্রমশ সেগুলো শুকিয়ে মরেছিল, আর শ্রমিকশ্রেণীর নাম করে পার্টিটাই হয়ে উঠেছিল প্রকৃত শাসক। পার্টি আর শ্রমিকশ্রেণীর আন্তঃসম্পর্কটা নিশ্চয়ই শাসক ও শাসিতের সম্পর্কে বদলে গেছিল। লেনিনের শেষ দিককার লেখাপত্র পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, বিপ্লবের বাস্তব জমি থেকে উদ্ভূত সোভিয়েত রাজের এই অভিমুখী পরিবর্তনের ইঙ্গিত ও সম্ভাবনাগুলো প্রত্যক্ষ করে তিনি কী ভীষণ পরিমান উদ্বিগ্ন ছিলেন। এরকম কোনও উদ্বেগ স্তালিনের মধ্যে কিন্তু আমরা লক্ষ করিনি। তিনি বরং চিন্তিত ছিলেন পার্টির কর্তৃত্ব রক্ষায়। তবে সেটা একটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। এখানে বলার শুধু এটাই যে, কেবল ভ্রূণ অবস্থায় থাকা নয়, সোভিয়েত রাজের ভেতর দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব সত্যিই যদি সেখানে কায়েম হয়ে থাকতো, রাষ্ট্রক্ষমতা সত্যিই যদি শ্রমিকশ্রেণীর কব্জায় থাকতো, তাহলে ঘটনাধারা নিশ্চয়ই অন্য খাতে বইতো। রাষ্ট্র ও উৎপাদকদের ভেতরে কার্যত শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার প্রবণতাকে রোধ করতেই তা   সচেষ্ট হতো। ঘটনা কিন্তু সেদিকে এগোয়নি। বস্তুত, রাষ্ট্র ও উৎপাদকদের মধ্যেকার সম্পর্কটা তার অন্তর্বস্তুতে হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের মতোই। অর্থাৎ সার কথা হল, এতো বড় মহান একটা বিপ্লবের পরেও পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের গণ্ডী কিন্তু অতিক্রম করা যায়নি। 

স্বাভাবিক ভাবেই এবারে প্রশ্ন হল, পুঁজিবাদের গণ্ডী অতিক্রম করা গেল না কেন। সেটা কি  পার্টির ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে? নাকি শ্রমিকশ্রেণীর সাংগঠনিক ও চেতনাগত দুর্বলতার কারণে? নাকি এই দুইয়েরই মিলিত কারণে? অথবা ব্যাপারটা কি এমন যে, পুঁজিবাদের সুরক্ষিত দুর্গগুলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা কয়েকটি দেশে আলাদা করে এই জায়গায় পৌঁছানোটা বস্তুগত ভাবে অসম্ভবই ছিল? অন্য ভাবে বললে প্রশ্নটা এবারে এরকম : পুঁজিবাদের গণ্ডী অতিক্রম করার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ হওয়া আবশ্যিক ছিল? কিন্তু যেহেতু এটা একটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়, তাই প্রশ্নগুলো এখানে কেবল তুলেই রাখা হল, আলোচনা করা হল কেবল সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা নিয়ে।



No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.