Wednesday, June 10, 2020

বিতস্তা ঘোষালের জীবনযাপন


আমি কেন সম্পাদক ? 
[২০১৪ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত] 

ছোটো বেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম। এক দাঁড়কাক পাখি সমাজে নিজের সম্মান বাড়াবার জন্য ময়ূরের পালক গুঁজে ময়ূর হবার চেষ্টা করে ধরা পড়েগেছিল। এই গল্পটার নীতিকথায় বলা হয়েছিল যে যা তাকে তাই নিয়েই সুখি থাকতে হয় ।আমি বোধহয় এই নীতি কথার মানে বুঝে উঠতে পারিনি ।তাই কলেজের চাকরি ছেড়ে হঠাৎ করেই এমন এক কাজ করতে শুরু করলাম যে ফায়ারিং স্কোয়্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমায় এই লেখাটি লিখতে হচ্ছে এবং প্রতিপদে অনুভব করছি আমাদের পূবপুরুষদের সাবধান বাণী।
লেখার আগে সম্পাদক শব্দটার মানে দেখতে গিয়ে বেশ ঘাবড়ে গেলাম।কি গুরুগম্ভীর বিষয় রে বাবা! অস্কফোড ডিকসিনারিতে দেখা যাচ্ছে,ল্যাটিন শব্দ এডিটর  কথাটির উৎপত্তি ১৭শতকের মধ্যভাগে এডেরা থেকে। ডেফিনেসনে বলা হচ্ছে     ‘a person who is in charge  of and determines the final content of a newspaper ,magazine ,or multi-author book’ এছাড়াও আর ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এই বিষয়ে ।
দেখে অনেকক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম ।হে ভগবান! আমি কি করেছি ! এমন এক দায়িত্বপূন কাজ আর আমি কিনা দিব্বি নিজেকে একটি বিশেষ ধরনের পত্রিকার সম্পাদক হিশেবে বড়াই করে চলেছি বিগত পাঁচ বছর ধরে  ! তখন স্বামিজীর দিকে তাকালাম।তিনি বললেন , ‘strength is life, weakness  is death’ আমি একটু সাহস পেলাম কিছু বাক্য এই বিষয়ে লেখার ।
এই গল্পের শুরু আমার জন্মের আরো আগে।ঘটনা চক্রে কি ভাবে আমি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে বাধ্য হলাম সম্পূন অন্য পথের পথিক হয়েও সেটা বোঝার জন্য আমার বাবা শ্রী বৈশম্পায়ন বাবু  ছেচল্লিশ বছর আগে  ভারত ভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন।ঘুরতে ঘুরতে তিনি পৌঁছন কেরলে।সেখানে মাথায় টুকরি কাঁধে বড় ঝোলা নেওয়া এক মহিলাকে স্থানীয় এক স্কুলের ঠিকানা জিজ্ঞেস করেন ইংরেজিতে, বাবার সেই জিজ্ঞাসায় ছিল ইংরেজি জানার অহঙ্কার। মহিলা বাবাকে ঈশারায় ঠিকানা বুঝিয়ে দেন ।বাবা স্কুলে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন সেই টুকরি মাথার মহিলা সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।তিনি বাবাকে বলেন ,সারা বিশ্বে শুধু একটাই ভাষা নেই। অনেক ভাষা।আমরা নিজের দেশের ভাষা –সংস্কৃতি না জেনেই শুধুমাত্র একটি বা দুটি ভাষা জেনে অহংকার দেখাই।এরপর তিনি বাবাকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎ চন্দ্র- তারাশঙ্কর –বিভূতি –মানিকের বিভিন্ন লেখার উল্লেখ করে বলেন -বাবা কোন কোন কেরালীয়ান ,মালায়লম ,তামিল ,কন্নড় সাহিত্য পড়েছেন।বাবা এবার মাথা নিচু করে জানান সে ভাবে তিনি কিছুই জানেন না।অথচ বিদেশি সাহিত্য তাঁর অনেকটাই জানা।সেদিন ই তিনি অনুভব করেন বিভিন্ন ভাষার মেলবন্ধন ঘটাতে গেলে এমন কিছু কাজ করা দরকার যাতে স্বদেশ ও বিদেশের সাহিত্য –সংস্কৃতিকে চেনা যায়।আর তা একমাত্র সম্ভব অনুবাদের মাধ্যমেই । কলকাতায় ফিরে এসে তিনি যোগাযোগ করেন অন্নদাশঙ্কর রায় মহাশয়ের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ।শেষ অব্ধি ১৯৭৫ সালের ২৬ শে জানুয়ারি অনুবাদ পত্রিকার জন্ম হয় বাবার নেতৃত্বে যা উত্তরাধিকার সূত্রে আমি বহন করে চলেছি সাহিত্য কিছু না বুঝেও ।

আমার ভালবাসার পত্রিকাটি

ছোটোবেলায় সম্পাদক কাকে বলে বুঝিনি ।বাড়িতে  যে সব সাহিত্যিক আসতেন তাদের কাছে শুনতাম বাবা নাকি সম্পাদক!সেটা কি জিনিস তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না।যদিও বই পড়তাম অনেক ।কিন্তু অনুবাদ পত্রিকা পড়িনি সে ভাবে কখনো। তখনো বিদেশি সাহিত্য কিছু পড়লেও ভারতীয় অন্য ভাষার সাহিত্য কিছুই জানিনা।বাড়িতে যারা আসেন শুধু তাদের নাম ই শুনি।আসলে  বাবার সাহিত্যিক – অনুবাদক সঙ্গীরা আসতেন ট্রিভোলী পার্কে বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঞ্জন সেনের বাড়িতে। সেখানে আমরা খুব একটা যেতাম না।কিন্তু বাবা পশ্চিমবঙ্গের যেখানেই সেমিনার,ওয়াকসপ হতো  অনুবাদ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সেখানেই আমাকে নিয়ে যেতেন।যদিও প্রথম অংশটুকু ছাড়া আমার দেখতে ভালো লাগত না।আমি সেখান থেকে উঠে এসে আশেপাশে ঘুরে বেড়াতাম ।তারপর সব মিটলে বাবা যখন আমার খোঁজ করতেন তখন শেষ আসনে গিয়ে চুপি চুপি বসে পরতাম। আসলে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হত সেগুলো নেহাতই নিরস লাগত আমার।সে তুলনায় আমার মেজবোন অনেক বেশি উৎসাহিত ছিল এসব আলোচনায় ।তাই তখন অনেকেই ভাবতেন পরবতী সম্পাদক হয়তো সেই হবে।
না।মানুষ ভাবে এক,হয় আরেক।বাবা মাত্র ১৫ বছর সম্পাদনা করলেন ,তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিলেন বাইরের পৃথিবী থেকে।মগ্ন হলেন আধ্যাত্মিক সাধনায় ।পত্রিকার ভার নিলেন বাবার অফিস স্টাফেরা।কিন্তু তা ক্রমশ নিম্নমানের হয়ে উঠল।ত্রৈ মাসিক- দ্বি মাসিক – মাসিক থেকে এখন মাত্র বছরে একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশিত হতে লাগল ,তাও তা কেবল অফিস ঘরেই ডাম্প হচ্ছিল। এই রকম অবস্থা যখন চলছে তখন আমি ইতিহাসে এম এর পর লাইব্রেরি সায়েন্স শেষ করে একটি কলেজে টেম্পোরারি ভাবে পড়াতে ঢুকলাম ।তখন পত্রিকা সামলাচ্ছেন  কবি অনুরাধা দি,আর অফিস ঘরটিতে আমার স্বামী সনাতন তাঁর চেম্বার করছেন ।তখনও আমার এ বিষয় নিয়ে কোন উৎসাহ নেই।একদিন সেখানে একটা জরুরি কাজে গেলাম।তখন সনাতন বললেন ,এত কিছু করে বেরাচ্ছ আর বাবার স্বপ্নের পত্রিকার ভগ্নদশা ,তাকে স্ব মহিমায় ফেরাতে পারছ না?একটা ভালো কাজ এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,আর মেয়ে হয়ে  কোন দায়ভার নিচ্ছ না।  মনটা খারাপ হয়ে গেল।দেখলাম পাশের ঘরে অবহেলায় পরে বাবার সাধের পত্রিকা ।তখন মাত্র ১০০ কপি প্রকাশিত হচ্ছে তাও বিজ্ঞাপন ছাড়া বাবার দেওয়া টাকায়তেই আর তা অফিস ঘরেই রাখা আছে ।
ভগ্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে গেলাম।বললাম আমি পত্রিকাটা নতুন করে চালাতে চাই।অনুমতি দাও।বাবা বললেন সফল হও ।পরদিন থেকে নিয়মিত অফিস যেতে শুরু করলাম ।সালটা ২০০৩।অনুরাধা দি কি ভাবে লেখা আনেন দেখলাম।যদিও  সেই সময় থেকে ২০০৯ অব্ধি আমি সহকারী সম্পাদক হিশেবেই অনুরাধাদির সঙ্গে কাজ করেছি ।সম্পাদনা ও  লেখা সংগ্রহের দায়িত্বভার সামলেছেন দিদিই।আমি কেবল জোর দিয়েছি বিজ্ঞাপণ ও প্রচারে । সে ভাবে তখনো পত্রিকার ভিতরে ঢুকিনি।কিন্তু ততদিনে আমার সঙ্গে অনুবাদ সাহিত্যের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বর পরিচয় ঘটেছে।পড়ার নেশায় পড়তে শুরু করেছি দেশি বিদেশি সাহিত্য ,এমনকি প্যাপিরাসের প্রকাশক অরিজিৎ কুমারের সাহচযে ও উৎসাহে অনুবাদের কাজ ও করতে শুরু করেছি ।এবং অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি সে সব অনুবাদ বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে।ক্রমশ মনে হচ্ছিল পারছি আমি একটু একটু করে হৃত গৌরব পুনুরুধার করতে ।পত্রিকা নিয়মিত বাজারে যাছে,এবং বিজ্ঞাপনের টাকাতেই সব মেটাতে পারছি । তখনো কিন্তু মূল সম্পাদনা থেকে দূরেই থেকেছি।
কারন প্রথম যে বিষয়টি আমার মাথায় এসেছিল সেটা ছিল নিজস্ব আয় না হলে কেবল ঘরের টাকায় পত্রিকা বেশিদিন চালানো যাবে না।আর বিজ্ঞাপন পেতে গেলে পত্রিকাকে পৌঁছতে হবে পাঠকের দ্রবারে এবং তা সম্ভব কেবল বিভিন্ন কিয়স্কে ম্যাগাজিন রেখেই।কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম এই কাজটা খুব শক্ত ,কারন পাঠকগোষ্ঠী কেবল ভালো অনুবাদ –ই পড়তে চান,যে যা দিলো ছেপে দিলে তা ক্রমে গুরুত্ব হারায়।কিন্তু এই কাজটি আমার পক্ষে বেশ শক্ত,আর ও শক্ত দিদিকে বোঝানো । এমন অবস্থায় দিদি অন্য একটি সংস্থায় যোগ দিলেন।এবার শুরু হল আমার একার লড়াই।বাবা বলতেন ,কোনো কাজ ই শক্ত নয় যদি নিষ্ঠাটা ঠিক থাকে।আমি ধীরে ধীরে নিজেকে গড়তে শুরু করলাম ।আর এ  কাজে আমাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করলেন আরিজিৎ কাকু,আমার প্রিয় দুই ব্যক্তি স্পন্দন ও চিন্ময় ।আর এই বিশাল কাজে আমার সঙ্গে পেলাম অতনুকে যে পুরো অফিস ,বিজ্ঞাপন ও বিপণনের দায়িত্ব সামলায় আর আমি কেবল মন দিই লেখার মান কি ভাবে আরো বাড়ানো যায় ,কিভানে নতুনদের এর সঙ্গে যুক্ত করা যায় সেই বিষয় গুলিতে।কারন আমার বিশ্বাস পুরনো বিখ্যাত অনুবাদকদের পাশে নতুনদের কাজ না থাকলে একটি ম্যাগাজিন সম্পুন হয়ে উঠতে পারেনা।আর ইতিহাস বলছে নতুনরাই সৃষ্টির চালিকাশক্তি।       

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.