Monday, August 30, 2021

চলে গেলেন চলমান আরণ্যক - বুদ্ধদেব গুহ

 লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী


এই পৃথিবীর জঙ্গলমহলে ছিল তাঁর অনায়াস আনাগোনা। দিনের আলোকঝারিতে অরণ্য প্রকৃতিকে যেমন চষে ফিরেছেন তিনি, তেমনই আঁধার রাতের অববাহিকাতে চরাচর ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। দেশ কাল তুচ্ছ করে তাঁর মনের আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আদিম নিসর্গ। এহেন আরণ্যক লেখক বুদ্ধদেব গুহ, ওরফে লালাদা পাড়ি দিলেন অজানার দেশে। আজ মেঘলা আকাশের বৃষ্টির ফোঁটা যেন তাঁর বিদায়ে জন্য প্রকৃতির যোগ্য সঙ্গত। সেই তিনি যিনি একই হাতে প্রকৃতি ও রোমান্সকে অনাবিল ভঙ্গিমায় সমন্বিত করেছেন। 

আধুনিক মধ্যবিত্তের অন্তরের খবর যেমন দিয়েছেন তেমন ভাবেই জঙ্গলের বিভিন্ন রূপের অনুপম চিত্র এঁকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। পেশায় ছিলেন একজন অগ্রগণ্য চার্টার্ড একাউন্টেট এছাড়াও ছিলেন দক্ষ সংগীতজ্ঞ, অরণ্য প্রেমিক, শিকারি এবং বাংলা সাহিত্যের সফল লেখক। তাঁর জন্মদিন ২৯ জুন,১৯৩৬। রংপুর জেলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন ও সেখান থেকে কলকাতায় এসে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলকাতায় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি কলকাতার রবীন্দ্রসংগীত শেখার খ্যাতনামা স্কুল "দক্ষিণী"তে ভর্তি হন। এই দক্ষিণীতেই লেখকের আলাপ হয় পরবর্তীকালে তাঁর জীবনসঙ্গিনী ঋতু গুহ'র সঙ্গে। তাঁদের সেই প্রেম কাহিনী নিয়ে লেখা লেখকের "খেলা যখন" উপন্যাস হয়ে ওঠে বেস্ট সেলার। ষাটের দশকের গোড়ায় প্রকাশিত হয় লেখকের প্রথম গল্প সংকলন,"জঙ্গলমহল"। লেখকের জঙ্গলে প্রবেশ তাঁর বাবার হাত ধরে।

দশ বছর বয়স থেকে তিনি শিকার শুরু করেন কাজের সূত্রে ঘুরে ফিরেছেন সারা দুনিয়া কিন্তু অরণ্য প্রেম তাঁর পিছু ছাড়ে নি।ভ্রমণের ও অরণ্য দর্শনের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। বাংলা সাহিত্যে অরণ্যের পটভূমিতে তাঁর যত গল্প উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তেমনটির আর দ্বিতীয় কোনও নজির নেই।ভারতবর্ষ ও বিদেশের অরণ্য প্রকৃতি যেমন লেখকের লেখার পটভূমি হিসেবে বারবার এসেছে, তেমনই অরণ্যও হয়ে উঠেছে উপন্যাসের চরিত্র।ব্যক্তিজীবন নিয়ে এত লেখাও বা কে লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে? ছোটদের জন্য তিনি নিয়ে আসেন ১৯৭৩ সালে "ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে"। সেই প্রথম শুরু হল অরণ্য সংরক্ষণ নিয়ে ভাবনা, হ্যাঁ  ছোটদের জন্যই। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে অরণ্যপ্রকৃতির  সঙ্গে সঙ্গে সম্পুর্ন নাগরিক চেতনার আলোকে আলোকিত চরিত্ররা এসেছে। 

কিছু চরিত্র আবার অরণ্য প্রান্তরে পৌঁছে প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। এইভাবেই চরিত্রের ভাঙাগড়ার মাধ্যমে তিনি নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে বসাতে পেরেছেন অনায়াসেই। বুদ্ধদেব গুহর সফল উপন্যাসের স্রেফ নাম উল্লেখ করতে গেলেই আর এ লেখা শেষ হবেনা। তবু যে পাঁচটি উপন্যাসের নাম না নিলেই নয় সেগুলির মধ্যে থাকবে "মাধুকরী", "হলুদ বসন্ত","কোজাগর", "কোয়েলের কাছে" ও "একটু উষ্ণতার জন্য"। "মাধুকরী"- অনেকে বলেন বুদ্ধদেবের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।এটি গতিশীল, বর্নময় ও বিশাল।এই উপন্যাস শুধু পৃথু ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী রুষার দ্বন্দ্বময় জীবনের গল্প নয়, জঙ্গলমহলের শিকড় খোঁজার কিছু মানুষের কাহিনিও বটে। বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী এই বইটির ভাষা, কাহিনী, জীবন দর্শন, জীবনের প্রতি আসক্তি ও আসক্তির মধ্যে লুকানো বিতৃষ্ণা, সবই যেন এক নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছে। তাই "মাধুকরী" যেন জীবনের ভাষ্যের এক নতুন নাম।তাঁর বেশিরভাগ গল্প, উপন্যাসে এক স্বপ্নিল বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে চরিত্ররা ঘোরাফেরা করে - যার মধ্যে রোমান্টিক এক আবেদন সহজেই অনুভব করা যায়। তাঁর রচনা চিনিয়ে দেয় এক নিত্য পর্যটকের স্বভাবকে, ভ্রমনকারীর সৌন্দর্যের চোখকে এবং পথ দর্শনকে। ঋজুদা, ঋভু - এরা দুজনেই লেখক নিজেই। 

"হলুদ বসন্ত"-এর ঋজুও তিনিই।তাঁর আরণ্যক গল্প, উপন্যাসে তিনি যে নাগরিক চরিত্রগুলিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে অরণ্যে নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের নাগরিক সত্তা ছেড়ে অরণ্যের সাথে মিশে গেছেন অনাবিল সারল্যে, কিংবা হতে চেয়েছেন আদিম। তাই তাঁর চরিত্র যেমন গাছের প্রেমে পড়ে, তেমনই প্রেমে পড়ে ওই অরণ্যের এক নারীর। গল্প, উপন্যাসে বাইরে তিনি অসংখ্য লেখা রেখে গেলেন আমাদের জন্য, এমনকি গোয়েন্দা কাহিনীও। তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন, কোদালকে কোদাল বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। সেই সুবাদে একটি বিশেষ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর একদল লেখক কিভাবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রবেশকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি, সেই কাহিনী আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন তিনি। এমনকি তিনি এ কথাও লিখতে দ্বিধা করেননি যে ওই বিশেষ পত্রিকা নিজেদের কিছু মধ্যমানের সাহিত্যিককে দিয়ে দিনের পর দিন লিখিয়েছেন, পাঠকদের জোর করে গিলিয়েছেন, কিন্তু সত্যি যাঁদের লেখায় সাহিত্য মূল্য আছে তাঁরা থেকে গেছেন ব্রাত্য। সেই হিসাবে বুদ্ধদেব বলতেন ওই পত্রিকা গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছেন। ওই পত্রিকা গোষ্ঠীর একাউন্টস দেখতেন বুদ্ধদেব, এবং সেই সুবাদেই তিনি নাকি লেখার সুযোগ পান, এমন অপবাদও প্রকাশ্যে আনা হয়। 

একটা সময় ছিল যখন বাংলা সাহিত্যের উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু বলা হত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব গুহ'কে। বইমেলায় যখনই গেছেন তখন মহিলাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতেন দুজনেই। তবে কম বয়সীদের ভিড়টা থাকত বুদ্ধদেবের দিকে। এমন একটা মানুষকে তো সমসাময়িকরা একটু হিংসা করবেনই। নইলে আর হিংসে জিনিসটা আছে কেন? আসলে কী ছিল না তাঁর? বাড়ির সবাই রবীন্দ্রসংগীত করেন বলে নিজে ধরলেন টপ্পা। নিধুবাবুর টপ্পা গেয়ে একটা সময়ে জমিয়ে দিয়েছেন কলকাতা ও মফস্বলের বহু আসর।

ছবি আঁকতেন এমন যে একাডেমির প্রদর্শনীতে ভিড় জমাতেন চিত্র সমালোচকরা। নিজের পেশায় ছিলেন চূড়ান্ত সফল। সেলিব্রেটি কাপল বলতে কলকাতায় ছিলেন বুদ্ধদেব ও ঋতু গুহ। সাহিত্য পুরস্কার অনেক পেয়েছেন, কিন্তু সেরাটি ছিল ধাবায় খেতে বসে যে ছেলেটি তন্দুরি রুটি দিয়ে গেল, সে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিল,"স্যার, আমি আপনার মাধুকরী, কোজাগর পড়েছি।"এই অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছেন বুদ্ধদেব, বলেছেন তাঁর পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। আমরাও আজ সেই ছেলেটির মত প্রণাম করে বলছি আজ থেকে আমরাও বুধ্বং শরনং। তিনি আমাদের জীবনের জলতরঙ্গ এক অপরূপ সুরে বেঁধে দিয়ে গেছেন, স্রেফ তাঁর লেখা দিয়ে। যেখানে ফিরে যাওয়া যায় বারবার আর প্রতিবারই যেন মনে হয় নতুন এই জীবন।

শোভনলাল চক্রবর্তী

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.