Tuesday, January 26, 2021

প্রজাতন্ত্রের নামে প্রহসন আর কত দিন?

 লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী



Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay



আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে রাজধানীর বুকে যে ঘটনা ঘটল, তাকে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বলা যেতেই পারে। প্রজার কথা শাসক শুনবেন, প্রজার মঙ্গলে শাসক কাজ করবেন এটাই দস্তুর হওয়া উচিত। আজ ভারতবর্ষ যা প্রত্যক্ষ করলো তার কিন্তু সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে ভারতের রাজনীতিতে। গণ আন্দোলনকে যদি প্রসারিত না হতে দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে রাষ্ট্র তবে তার কি ফল হয় আমরা তা দেখলাম। ১৯৫৬ সালে যে প্রজাতন্ত্র সংবিধানের শপথ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আজ তা পথভ্রষ্ট।এর কারণ নিহিত আছে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের অন্তরসম্পর্কে।রাজনৈতিক দল কি রাষ্ট্রের পরিপূরক হতে পারে? প্রশ্নটা আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে এসেছিল এরিস্টটলের মাথায়। তাঁর মনে হয়েছিল ক্ষমতাসীন দল সংবিধানের পরিবর্তন ঘটালে রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য।প্রকারান্তে এটাই রাষ্ট্র ও দলের অভিজ্ঞতা।আসলে সমকালীন গ্রিসের প্রায় প্রত্যেকটি নগর রাষ্ট্রে ধনিক ও গণতন্ত্রীদের মধ্যেকার তীব্র বিরোধ এরিস্টটল দেখেছিলেন, এবং এও দেখেছিলেন যে গণতন্ত্রীরা ক্ষমতায় এলে তা পাল্টে যায়। সংবিধানের পরিবর্তন সরাসরি প্রভাবিত করে নগর রাষ্ট্রের চরিত্রকে।বর্তমানে অবশ্য আমাদের দেশে সংবিধানের পরিবর্তন না ঘটিয়েও রাষ্ট্র চরিত্র পাল্টে ফেলা যায়।তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দল সমার্থক কিনা, এই প্রশ্ন বর্তমান সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক। আজকে ধারে-ভারে বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধানকে সামনে রেখে, শিরোধার্য করে, আইনের পাকাপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহ যে ভাবে নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাতে স্পষ্টতই সন্দেহ জাগে ভারত রাষ্ট্রে সংবিধান থাকলেও সাংবিধানিকতা আছে তো? ক্ষমতাসীনের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভারত রাষ্ট্রের আদর্শ, পরিচলন পদ্ধতি স্থিরীকৃত হয় বা পাল্টে যায়, তা সে সংবিধানের মুলভাবের সঙ্গে যতই সংঘাতপূর্ণ হোক না কেন। তা যদি না হত তবে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যাথা থাকত না, তা যদি না হত তবে চলতি কথায় গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি তার একেবারে প্রাথমিক শর্ত হিসাবে পৃথক মতের প্রতি সহনশীলতার যে ধারণা রয়েছে, তা নিয়ে গেল গেল রব উঠতো না। বড়ো বড়ো বুলি আওড়ানো সংবিধান, রাষ্ট্রপ্রকৃতির নির্দেশক ও রাষ্ট্রের পরিচালনার মৌলিক নীতি সম্বলিত সংবিধান পড়ে থাকলো এক কোনে, একেবারেই গুরুত্বহীন অবস্থায়।সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাজনৈতিক দল ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। একদিকে আমরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ঢাক পেটাচ্ছি অন্যদিকে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সমস্ত দুর্বলতা আমাদের দেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের বিষয়টা তো প্রাত্যহিক চর্চার বিষয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চিন্তায় ও আচরণে সে চর্চা নেই।বৌদ্ধিক ভাবে ও চেতনায় গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার কোনও বাসনা নেই তাঁদের, সে কারণেই বিরুদ্ধমতকে তাঁরা শ্রদ্ধা দেখাতে পারেন না। ভুল করেও পারেন না। রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহারে প্রতিহিংসাপরায়ণতা চরিতার্থ করা, বিরুদ্ধ স্বর হলেই সর্বাত্মক ভাবে তা দমনের মানসিকতা নিশ্চয়ই ভারতের সংবিধানের মুলভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ আমাদের চারপাশে নিয়মিত ভাবে সেটাই হয়ে চলেছে। স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর না হলেও চলবে এই অসঙ্গতি গুলি দেখতে পাওয়ার জন্য।
 

Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay
পার্টি পলিসি, পার্টি পলিটিক্সই সত্য। তাই রাজনৈতিক দলগুলি এরকমটাই ভেবে অভ্যস্ত যে একবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারলেই শাসন, আইন সবই তার।যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা তার।সে-ই শাসন, সে-ই আইন, সে-ই বিচার। পুলিশ প্রশাসন তখন বোবা, কালা ও অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করে - সাংবিধানিকতা কোমায়(যেমন, উত্তরপ্রদেশের হাতরাস কান্ডে)। আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যার জায়গা এটাই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হলেই গণতান্ত্রিক উপায় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব(যেমন,৩৭০ধারা লোপ)। যেখানে আর্থিকনীতি, শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি এমনকি বিচার বিভাগ - সবখানেই ক্ষমতাসীনের অহং ও আত্মকেন্দ্রিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট। যার মাধ্যমে পোশাক পরিচ্ছদ থেকে খাদ্যাভ্যাস, চিন্তার স্বাধীনতা থেকে মত প্রকাশ (নতুন সংযোজন, লাভ জিহাদ) - সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।অধ্যাপক,সাংবাদিক,লেখক, সরকারি কর্মচারী - সবাইকে সবক শেখানো সম্ভব। তা ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক!সংখ্যা গরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত বলে কথা। আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা ক্রমশই হারাতে হারাতে ভারতীয় জনগণ এতেই খুশি যে সবটাই হচ্ছে আমাদের নামে।ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় টিকে থাকা অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির নেশা বড্ড মারাত্মক।এর সঙ্গে আছে নামের মোহ। আমি এবং আমিত্ব, সবটা বজায় রাখার জন্য এখনকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অধিকাংশই পোস্ট ট্রুথ সিনড্রোম-এ আক্রান্ত। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাই অসত্য, অর্ধসত্য এবং মিথ্যা, মনগড়া তথ্য হাতে হাতে ঘুরছে।এতে এক ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করাই যাঁদের কাজ, হটাৎ হটাৎ শোনা যায় তাঁরা রাজধর্ম পালন করছেন। নীতির সাথে প্রতিনিয়ত রাজ করা সম্ভব হলে দুম করে রাজধর্ম পালনের কৃতিত্ব দাবি করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তা সম্ভব নয় কারণ, রাজনৈতিক দলগুলির সব গিলে খাওয়ার হাঙ্গরের হাঁ রয়েছে।বিরোধী শূন্য ফাঁকা মাঠ চাই তাঁদের।ভোটের আগে প্রচার করতে না দেওয়া থেকে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ফতোয়া জারি কিংবা ভিটে মাটি ছাড়া করা - এর সবটুকু সংবিধান বিরুদ্ধ হলেও আমাদের দেশের দলতন্ত্র অনুযায়ী তা বৈধ। বৈধ বলেই একজন মানুষ এরকম সময়ে রাষ্ট্রের সাহায্য পান না।এই দলতন্ত্র অনুযায়ী বিরুদ্ধ মতের মানুষদের জন্য বিভিন্ন কমিটি, কমিশন বা এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়াও বৈধ।নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই এখানে মুখ্য। এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, উদারনৈতিক গণতন্ত্র তাত্বিক ভাবে নিজের বৃত্তের বাইরে কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ দলতন্ত্র ক্ষমতার স্বার্থে যে কোনও 'বাদ'কে, যে কোনও 'বাদী'কে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে, প্রয়োজন ফুরোলে রাষ্ট্রের যুক্তি দিয়ে তাকে জেলেও পুরতে পারে(কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি)। তাই, দিনের শেষে রাজনৈতিক দলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের সমার্থক। যে ব্যবস্থায় তদন্ত কমিশন থেকে নির্বাচন কমিশন কিংবা মানবাধিকার কমিশন - সবই সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক দলের হরবোলা হিসেবে কাজ করে অভ্যস্থ সেখানে আলাদা কিছু প্রত্যাশা করা যায় কি?আমাদের বর্তমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা অর্জনকে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের নিরিখে দেখা হয়।বৈধতার প্রশ্ন এখানে উপেক্ষিত। বৈধতা হল কর্তৃত্বকে মান্যতা দেওয়া। এই বৈধতা সংবিধান ছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উচিত-অনুচিত বোধের প্রেক্ষিতে স্বীকৃতি পায়। তা না হলে সাংবিধানিকতা প্রতিষ্টিত হয় না এবং 'জোর যার মুলুক তার' নীতিতে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র উঁকি দেয়।আজকের ভারত তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেই যে বৈধতার দাবি করা যায় না - এই বোধ এবং শিক্ষা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের নেই, তাঁরা সেটা শিখতেও আগ্রহী নন। সরকারি পদক্ষেপ সঠিক কি না, ন্যায়সঙ্গত কি না এবং তার উপযোগিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার প্রতিটি মানুষের থাকা দরকার(কৃষি বিল নিয়ে কৃষকদের বিক্ষোভ)। তত্ত্বগতভাবে এটাই যে কোনও সরকারের সঠিক নীতি গ্রহণে সাহায্য করে। কিন্তু বাস্তবতা হল ক্যাডারের সংখ্যার আধিক্য এবং আসনগত ভাবে সংখ্যাগরিষ্টতা - এই দুই হল রাজনৈতিক দলের মোক্ষ। তাই কৃষক আন্দোলনকে এখন ঘুর পথে বাগে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসবের ফলে দলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই দল। এটা কিন্তু প্রজাতন্ত্র নয়, সেটা আমরা আর কবে বুঝবো।

Picture Courtesy : Soumya Chattopadhyay


[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]


No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.