Thursday, February 4, 2021

শাসকের দম্ভ বড়ই পলকা

লিখেছেন অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত
[গতে বাঁধা বাঙালি পড়েছে এখন মহাবিপদে। সান্ধ্য অবসরে টেলিভিশনে চড়া ডেসিবেলের সিরিয়াল যারা ততটা উপভোগ করতে পারেন না, তেমন মধ্য ও বেশি বয়সের মানুষের খানিক চরে বেড়ানোর জায়গা ছিল খবরের দুনিয়া ও তথাকথিত তর্ক-বিতর্কের মজলিস। ইদানীং সে সবও আতান্তরে পড়ে হারাতে বসেছে। এখন টিভি খুললেই কে কবে দল বদল করলেন, বা করতে চলেছেন অথবা করেও করলেন না- রাতদিন সাতদিন এমন সব হরেকরকম্বায় ও অতি নাটকীয়তায় ভরপুর পুনঃপুনঃ একই বিষয় অবলোকনে দর্শককুল পড়েছেন মহাফাঁপরে। এ কী গেরো রে বাবা! গোদি মিডিয়ার এ কী হাল হল যে দৃশ্যান্তরে যেতেও তাদের অনীহা বা জড়তা! নাকি কোনও অদৃশ্য নির্দেশ?]

 

দলবদলের এই কুনাট্যে প্রথম দিকে বেশ টি-২০ ধাঁচের উত্তাপ ও উত্তেজনা ছিল। আমোদ-গেঁড়ে লোকজন বেশ মজাও পাচ্ছিল। কিন্তু কোথায় জানি কেমন একটা একঘেয়ে ও অতি-নাটকীয় চড়া আওয়াজ এতে লেগে গিয়ে তা এমন গা-সওয়া হয়ে গেল যে ধীরে ধীরে সে মজাটাও এখন উধাও। যেন, এমন দলবদল রোজই হবে, কিন্তু তাতে গড়পড়তা আমজনতার কী আসে যায়, সে উত্তর যেন বড্ড বেশি অধরা। আর যাচ্ছে কারা? যারা নাকি ‘কাজ করতে পারেনি’। কী বিপদ! এক বন্ধু বলল, জঙ্গলে বাঘও নাকি কাজ না পেয়ে আজকাল চিড়িয়াখানায় এসে ঢুকে পড়ছে।

 

কলকাতায় গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে অমিত শাহের পদযাত্রা থেকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর  সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ হাজারে হাজারে ‘আমি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র’এর আবির্ভাব হয়েছিল, যারা প্রত্যেকে হুবুহু একই বয়ানে বলতে শুরু করে তারা সেদিন প্রত্যক্ষত কী কী দর্শন করেছিল। প্রত্যকের এমন নিখুঁত অবলোকন ছিল যা প্রকাশেও এতটুকু দাড়ি-সেমিকোলনের তারতম্য পর্যন্ত রাখেনি- যেন আরএসএস শাখার কোনও শিবির যেখানে রোবটের মতো হাফ-খাকি পরে সকলে এমন দাঁড়িয়ে আছে যে কে জগা আর কে পঞ্চা সেটুকু বোঝবারও জো নেই। একইভাবে তারা এখন কৃষক আন্দোলনের গুষ্টির শ্রাদ্ধ করতে ছড়িয়ে দিচ্ছে হরেকরকম ‘আমি এক ছোট চাষি’র বাচন। শুধু কি তাই! বলা হচ্ছে, লাখে লাখে এত মানুষ যে দিল্লির সীমান্তগুলিতে বসে আছেন তাঁরা নাকি প্রকৃত কৃষক নন, সন্ত্রাসবাদী। এমনকি পররাষ্ট্র দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হচ্ছে যে খুব অল্প সংখ্যক কৃষকেরাই এইসব ঝামেলা পাকাচ্ছে। এরেই কয় আইটি সেলের কেদ্দারি যা অবশ্য এখন বোঝাই যাচ্ছে যে বেশ ল্যাজেগোবরে মাখামাখি।

 

তবে শুধু আইটি সেলকে দোষ দিই কেন! গোদি মিডিয়াও তো এই মহাযজ্ঞে সামিল। ‘নিউজ বাংলা’ নামক এক চ্যানেলে তো সঞ্চালক ধমক দিয়ে বক্তাকে বলে দিলেন যে আম্বানির চ্যানেলে বসে আম্বানির চুরি-জোচ্চুরি নিয়ে বলা যাবে না। অতএব, দু-একটি চ্যানেল বাদ দিলে (যেমন এনডিটিভ) কোথাও আপাতত কোনও খবর নেই। সবই মোদি বন্দনা এবং ঘাড় ধরে দেশভক্তির পাঠ শেখানো। এদের মধ্যে সব থেকে উগ্র চ্যানেলটি তো টিআরপি রেটিং’এ হেরাফেরি করে জনৈক পার্থ দাশগুপ্তকে জেলে পাঠিয়ে এখন নিজেরা জেলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত।

 

তাই, বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে দেশ এখন ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন এক পরিসরে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্বানি-আদানির সাম্রাজ্যকে দেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে সংসদের সমস্ত রীতিনীতিকে তুচ্ছ করে যে তিনটি কৃষি আইন পাশ করনো হয়েছে, তা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে এক মহা আলোড়ন তৈরি করেছে। পপ তারকা রিহানা থেকে পরিবেশ আন্দোলনের দৃপ্ত মুখ গ্রেটা থুনবার্গ সকলেই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, দিল্লির সীমান্তে যেখানে কৃষকেরা বসে আছেন সেখানে রাস্তায় লোহার গজাল পুঁতে, কংক্রিটের দেওয়াল তুলে, কাঁটাতারের প্রাচীর গড়ে মোদি সরকার কৃষকদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধে তার দরকার এমন এক প্রচারযন্ত্র যা কৃষকের মনকে বিভ্রান্ত করতে ও আপামর দেশবাসীর অন্তরে বিষবাষ্প ঢেলে এক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বাঁধাবার আবহ তৈরি করে রাখতে পারে। আর সে জন্যই তাদের দরকার আইটি সেলের পাশাপাশি গোদি মিডিয়াকেও যেখানে গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যা দৃশ্য রচনা করে ও অভিসন্ধিমূলক বাচন রেখে এক গভীর অন্তর্ঘাত সংগঠিত করা যায়। এর জন্য তারা অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ভায়াকনের নামে বহু নিউজ চ্যানেলকে কিনে নিয়ে আম্বানি গোষ্ঠী একটি কনফেডারেশন তৈরি করে রেখেছে। এই সামগ্রিক প্রয়াসে গত কয়েক বছরে তারা কিছু সাফল্যও পেয়েছে যেখানে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুপরিকল্পিত ভাবে একটি দাঙ্গা লাগিয়ে দিতেও তারা সক্ষম হয়েছিল। তবে ইতিহাস তো অমন সোজা পথে স্বৈরাচারীদের হুকুম মেনে চলে না। তাই এতদসত্ত্বেও, তারাও এখন থড়হরিকম্পমান।

 

প্রথমত, এমন অভূতপূর্ব এক কৃষক আন্দোলন যা আম্বানি-আদানি কোম্পানির হাতে দেশকে তুলে দেওয়ার বিজেপি-আরএসএস’এর ফন্দিটিকে শুধু ধরে ফেলেছে তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তা ক্ষমতায় আসীন এই ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শক্তি আগে থেকে মোটেও আন্দাজ করতে পারেনি। নিজেদের ‘ইকো চেম্বার’এ বসে তারা ক্ষমতার আয়েসে এতটাই মশগুল ছিল যে মানুষের ক্ষোভ ও জেগে ওঠার প্রস্তুতিকে তারা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে গড়ে ওঠা পিপলস মিডিয়া, যা সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলিকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে মানুষের গভীরে এতটাই সুবিস্তৃত হয়ে পড়েছে যে তার অভিঘাতেরও বিন্দুমাত্র আভাস তারা পায়নি। তারা নিশ্চিত ছিল গোদি মিডিয়া ও আইটি সেলের ওপর নির্ভর করে জনগণের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার জারি রাখতে পারবে। আসলে, স্বৈরাচারীরা কখনই বুঝতে পারে না যে তাদের ক্ষমতার দৌড় একটা নির্দিষ্ট সীমার পরে আর কাজ করে না।

 

এই আবহেই গোদি মিডিয়ার দ্বারা সজ্জিত হয়ে মোদি-শাহ চক্র এখন খোয়াব দেখছে পশ্চিমবঙ্গে আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসীন হবে। এরজন্য শাসক দলের মধ্যে ভাঙন ঘটিয়ে, গোদি মিডিয়ায় লাগাতার ডঙ্কা বাজিয়ে ও আইটি সেলের ঘৃণাবর্ষণকারী বাচন ছড়িয়ে তারা উন্মাদের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। এই দৌড় সত্যি সত্যি কোথায় গিয়ে থামবে তা তারা নিজেরাও জানে না।

 

আজকের কৃষক আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার যা উত্তর ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়ে এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মুখে তার জাগরণের ব্যাপ্তি ও প্রকাশের ব্যঞ্জনার মধ্যেই আগামী ভারতের বীজ লুকিয়ে আছে। কোনও আইটি সেল বা গোদি মিডিয়া অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যারিকেড-গোলাগুলি এই উত্থানের শক্তি ও তাৎপর্যকে বিন্দুমাত্র অনুধাবন করার অবস্থায় নেই। তাই শাসক যত বকবে, যত পেশিশক্তি দেখাবে, যত মিথ্যা প্রচারে মাতবে ততই নিজেদের ধ্বংসের পথকে আরও ত্বরান্বিত করবে। আশার কথা, ভারতের সংবিধান গণতন্ত্রের এমন এক আধারকে সুনিশ্চিত করে রেখেছে যা আমাদের রক্ষাকবচ। আজকের দুর্বিনীত শাসক যদি সেই রক্ষকবচে গুলিগোলা চালায় তবে আমি নিশ্চিত সারা দেশ একযোগে উঠে দাঁড়াবে:উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।’      


[অনিন্দ্য ভট্টাচার্য । 'ফ্রন্টিয়ারে' হাতে শান দেবার পরে আওয়াজ তুলেছিলেন, 'মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে যান' । 'এককমাত্রা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক । কয়েক দশক ধরে বাঙালি বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিনিয়ত সাপ্লাই করেছেন বৌদ্ধিক চর্চার অন্য পরিসর, ডিমান্ডের খবর না রেখেই । আত্ম-চ্যালেঞ্জেই রেখেছেন তাঁর কৃষ্ণ-অশ্বের মোক্ষম অবস্থান । এরই নাম বাজিমাত । ]  

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের বইগুলি পড়ুন, 

অর্ডার দিন বইঘরের অনলাইন স্টোর থেকে ক্লিক করুন এখানে








No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.