লিখেছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য
ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত |
এক ঝাঁক কোকিলের কলতানে আবার একটা বসন্ত এল বলে!
সেদিনও ঝাঁক ঝাঁক ভূমিহীন খেটে খাওয়া মানুষের বজ্রমুষ্টি এনেছিল অন্য এক বসন্ত।
নাকি ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’! সময়টা পাঁচ দশকের বেশি সময় আগে। এতকাল ধরে বালাসন
নদীর দুকুল ভাসিয়ে অনেক অম্লমধুর জলের ধারা বয়ে গেছে। তবু বঙ্গদেশের ‘নিঃসঙ্গ
কবি’র(!) সেই অমোঘ লাইনটি কিন্তু এখনও টিকে আছে কুরুক্ষেত্রের এই পৃথিবীতে ...
“এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়”।
সে
এক অস্থির সময়। যার পটভূমি আঁকা হয়েছিল সেই ১৯৬৭ সালে। জোতদার বুদ্ধিমান তিরকে আর
ভূমিহীন কৃষক বিগল কিষাণের জমি বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে যেদিন পুলিশকর্মী সোনাম
ওয়াংদিকে তীর বিদ্ধ করে হত্যা করে ফেললো ক্ষিপ্ত ভূমিহীন কৃষকের মিছিল। পিকিং রেডিও থেকে যাকে বলা হয়েছিল ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’। এবং ১৯৬৭-র ২৫-শে
মে রাষ্ট্রশক্তির উদ্ধত রাইফেল থেকে ছিটকে আসা সীসার আগুনে প্রসাদজোতের ধুলোয় মিশে
যাওয়া এগারোটা তরতাজা লাসের থেকে চুয়ে পড়া রক্ত। সেদিনই সূচনা হয়ে গিয়েছিল
ভারতবর্ষে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক আন্দোলনের এক নূতন সুদূরপ্রসারী অধ্যায়। সেদিনের
আগুনের আঁচটা উপলব্ধি করতে পারেননি অনেকেই। তাই তদানীন্তন যুক্তফ্রন্ট সরকারের
ভূমি ও ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী তথা ডাকসাইটে কম্যুনিস্ট নেতা প্রয়াত হরেকৃষ্ণ কোঙারের
সক্রিয় হস্তক্ষেপের পরেও সে আগুন নেভানো গেল না। সেই ধিকিধিকি আঁচ ক্রমেই দাবানলের
মতো ছড়িয়ে পড়লো ... উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূব থেকে পশ্চিমে। ক্ষোভের বিকিরণে ক্রোধ, বদলের
আস্তিনে বদলা, হিংস্রতার মোকাবেলায় নৃশংসতা। একদল ভূমিহীন
কৃষক। সঙ্গী সশস্ত্র বিপ্লবের আগুনে দীপ্ত এক ঝাঁক শিক্ষিত মধ্যবিত্তও। রাষ্ট্র ও
তার শক্তি। এবং ‘খতম লাইন’।
স্নেহলতা
মুখোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে বলছি ...
“একজন
বিখ্যাত হার্ট সার্জেন যিনি ১৯৭২ সালে পিজি হাসপাতালের সাথে যুক্ত ছিলেন। কাছাকাছি
কেউ কোথাও নেই দেখে ডাক্তারবাবু মর্গে ঢুকে পড়লেন। ঢুকে দেখলেন সম্পূর্ণ বডিটা
ছিন্নভিন্ন। মুখ চোখ ফোলা। অত্যাচারের চিহ্ন সারা দেহে। কাকাবাবুর পায়ের দিকে তার
হাত নিজের অজান্তে চলে গেল। যারা বেঁচে আছি, তাদের হয়ে তিনি যেন কাকাবাবুর পায়ের ধুলো নিয়ে নীরব মন্ত্র উচ্চারণ
করলেন।”
ঘটনার
সত্যতা যাচাইয়ের কোন অবকাশ আমার হাতে নেই। তবে ওই খর্বকায় জরাগ্রস্থ মানুষটির
মধ্যে যে আশ্চর্যজনক জন-সন্মোহনী ক্ষমতা ছিল এবং তা নিয়ে যে যথেষ্ট গবেষণার পথ
প্রশস্ত আছে, সে বিষয়ে
কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। যে মানুষটা গোগ্রাসে অজস্র বই পড়ে ফেলতেন, যে মানুষটা সংগীতের মূর্ছনায়
আত্মমগ্ন হয়ে থাকতেন, সেই মানুষটাই কোন ‘রাহুর কোপে’
শুধুমাত্র ‘খতম লাইন’কে আঁকড়ে ধরে মানব মুক্তি ঘটাতে চাইলেন! প্রচলিত সত্যের
অন্তরে যে অকপট সত্য লুকিয়ে থাকে, তা কি আমরা কখনো ‘খুঁড়ে’
দেখতে চেয়েছি? তার চেয়ে বরং অনেক সহজ পন্থা আমাদের জানা ছিল।
শুধুমাত্র ‘খতম লাইনের’ জনকের মুকুট অনায়াসে পড়িয়ে দিয়েই আমাদের দায়টুকু ঝেড়ে
ফেলতে পেরেছি। আমরা ... মানে, আমাদের সৃষ্ট ইতিহাসের হলুদ
পাতা। হ্যাঁ, কাকাবাবু নামে পরিচিত তিনিই চারু মজুমদার।
ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত |
সারা
বাংলা তথা ভারতবর্ষের গতানুগতিক ধ্যানধারণার একেবারে বিপরীত মেরুতে বিরাজ করা এক
রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগের ঐকান্তিক চেষ্টা (সেই চেষ্টার প্রয়োগে নিশ্চয়ই বিস্তর
ভুল ছিল), রাজনৈতিক মতবাদকে আমৃত্যু
নিষ্ঠা ভরে আঁকড়ে থাকা, ব্যক্তিজীবনের উচ্চাকাঙ্খা ও
স্বাচ্ছন্দ্যকে অবলীলায় অবদমিত করে সমষ্টিগত ভাবনার কাছে নিজেকে নিবেদন করা ... যা
আজকের রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগে হয়তো মূল্যহীন ধূসর পাণ্ডুলিপির মতো
পরিত্যক্ত বাক্সে তালাবন্দী হয়েই থাকার কথা! রাজনৈতিক বিশ্বাসকে প্রাণপণে আঁকড়ে
ধরে বাঁচা (তা সে ঠিক না ভুল, সে বিতর্কের পরিসর এখানে নেই)
এবং আপোষহীন মনোভাবকে একনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থেকে জীবনকে ছাপিয়ে মৃত্যুকেও তুচ্ছ করা,
স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে এমন ব্যতিক্রমী নিদর্শন তো শেষ দেখা
গিয়েছিল নকশালবাড়ীর অশীতিপর এক নকশালেরই কৃতকর্মে। ‘সেজ পাবলিকেশন’ থেকে “দ্য ফার্স্ট নকশাল” নামে যার জীবনী ছাপা হয়েছে।
দুরারোগ্য ব্যাধির করাল ভ্রুকুটি যার অশীতিপর শরীরকে যখন তিল তিল করে গিলে নিচ্ছে, এমনই এক সংকটকালে নকশালবাড়ীর
সেই ভূমিপুত্রের চিকিৎসার ব্যয়ভার তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকার গ্রহণ করতে চেয়েছিল। তিনি তা নির্দ্বিধায় কেবলমাত্র প্রত্যাখ্যানই করলেন না, প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানিয়ে
দিলেন যে, “যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার আজীবন
লড়াই-সংগ্রাম, সেই রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্যে তাঁর বেঁচে থাকা
মৃত্যুর চেয়েও মর্মান্তিক”। এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যু তো জীবনের পরাজয় নয়; মরণের কাছে জীবনের গর্বিত নিবেদন হয়ে ইতিহাসের পাতা জুড়ে জ্বলজ্বল করে
থাকবে। হ্যাঁ, এই “দ্য
ফার্স্ট নকশাল”-ই
হলেন কানু সান্যাল।
কিংবা
বালাসন নদীর প্রান্তে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া নির্লিপ্ত শান্তি মুণ্ডা! ১৯৬৭-র সেই
‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের’ দিনগুলোর কাছে গচ্ছিত রাখা অস্থির সময়কে আগলে রাখতে রাখতে
আজ যিনি দীর্ণ, নিঃস্ব,
অশীতিপর! তবু তো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা ... আজন্মের বিশ্বাস, হতাশার নির্মম তীরে বিদ্ধ ক্ষীণকায়া আশার অন্তরের স্নায়ুর ঝিলিক। আজও যিনি
গর্জে উঠতে পারেন “সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে, শিবে
সর্বার্থসাধিকে” ... আবার কোন এক বজ্রনির্ঘোষের কালান্তরি অপেক্ষায়। অথবা ক্ষুদন
মল্লিকের মতো নিঃস্পৃহ মানুষরা! বিশ্বাসকে যারা আঁকড়ে রেখেছেন ‘রক্তমনির হারে’!
চীনের ‘পিপলস হলে’ মাও সে তুং আর চৌ এন লাই-এর হাতে মেলানো হাতটায় শক্তির অনুভব যে
স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের শক্তির থেকে অনেক গুন বেশী। ভারতবর্ষে ‘ইয়েনান’ গড়ে তুলতে
পারেননি ঠিকই, কিন্তু সেই বজ্রনির্ঘোষের প্রবল শক্তির কাঁধে
ভড় করে গড়ে ওঠা হাতটার দিকে চেয়ে ক্ষুদন মল্লিকের মতো মানুষেরা যখন বিড়বিড় করে বলে
ওঠেন ... “বিশ্বাস নষ্ট হয় নাই। মানুষের মুক্তি হবে। শোষণের শেষ হবে”...... রক্তের
প্রতিটি বিন্দু যেন এক জায়গায় জড়ো হয়ে আর্তনাদে ফেটে পড়ে। ক্ষোভে, অপমানে, রাগে, দুঃখে। অপেক্ষার
পাহাড় যেন প্রবল শক্তিশালী দৈত্যের মতো আগলে থাকে মুক্তির দরজা। আর এক বসন্তের
বজ্রনির্ঘোষের শব্দের প্রতীক্ষায় কান পেতে।
ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত |
২০১৭
সাল ছিল নকশালবাড়ী আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ ছিল এবং ২০১৮ ছিল চারু মজুমদারের
জন্ম শতবার্ষিকী! এই পঞ্চাশ বছর ধরে আমরা কখনই বুঝতে বা বোঝাতে চাইনি, পরবর্তী প্রজন্মেকে জানাতেও
চাইনি ... কে ওই চারু মজুমদার? কেই বা কানু সান্যাল? জঙ্গল সাঁওতালই বা কে? নকশালবাড়ী আন্দোলনই বা আদতে
কি ছিল? কেনই বা তা বজ্রনির্ঘোষের মতো আছড়ে পড়েছিল? কোথায় ছিল তার আঁতুড় ঘরের নাড়ি? সেই আন্দোলন কিই বা
কেড়ে নিল এই সমাজজীবন থেকে? কতটুকুই বা দিয়ে গেল এই
সমাজজীবনকে? আজকের যুব সমাজকে আমরা জানিয়ে দিতে পারিনি সেই
রক্তক্ষয়ী ‘কালবেলা’র কতটাই বা সাদা আর কতটাই বা কালো ছিল। সেই আন্দোলন কতটাই বা আমাদের পথ আটকালো, কতটাই বা পথ দেখালো। আমাদের ডিজিটাল হাতে সেইসব কাঁটাছেঁড়ায় যাওয়ার মতো
কতটুকুই বা সময় আছে স্মার্ট ফোনের গোগ্রাসকে অগ্রাজ্য করে! ইন্টারনেটের সার্চ
ইঞ্জিন সাইটগুলোতে কতবারই বা আজ পর্যন্ত টাইপ করা হয়েছে ‘নকশালবাড়ী’ শব্দটা!
তাহলে, খতম লাইনের কুখ্যাত বীজটা কি
প্রোথিত হয়েই রইলো আমাদের সমাজজীবনের গর্ভগৃহে? নাকি আমাদের
এই নাগরিক সমাজ মুল্য দিতে চাইলো সেই সকল অদম্য প্রাণগুলোকে, যাদের মায়ের প্রেতাত্মা আজও খুঁজে চলেছে হাজার হাজার লাশের স্তূপের
মাঝখানে ‘হাজার চুরাশি নম্বর’ লাগানো তাঁর দামাল ছেলের দলা পাকানো লাশটা? আজ এই ডিজিটাল দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের কারো কি কখনো মনে হয়েছে যে, ঐ একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যেখানে বাঙালি মনন হয়তো শেষবারের মতো ‘আমাদের’
নিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল! ব্যক্তিগত সীমারেখাকে অতিক্রম করে, সমষ্টিগত
ভাবনার তরে। পরবর্তী সমাজজীবন তো শুধু ‘আমি’ নিয়েই তোলপাড়! সেদিনের সেই অস্থির সময়
কি আমাদের দিয়ে গেল শুধুই খতম লাইনের দুঃস্বপ্নের ইতিহাস? শুধুই
আবেগসর্বস্ব বজ্রমুষ্টির দিশাহীন আস্ফালনের ব্যর্থ প্রয়াসের ‘কালবেলা’? নাকি কোথাও আমরা শুনতে পেয়েছি অদম্য সাহসের কাঁধে হৃদয় গচ্ছিত রেখে উদ্দাম
যৌবনের ‘হোক কলরব’-এর ঐকান্তিক কলতান? সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রব্যবস্থার
বিরুদ্ধে। সমাজের পিছিয়ে পড়া শোষিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার প্রয়াসে। সাম্যের সংগ্রামে। আজ আমাদের হাতে আদৌ ভাববার মতো সময় আছে কি? জীবনের মূল্যবোধ। রাজনীতির
নীতিকথা। সমাজজীবনের সহমর্মিতা। নাকি সব খুঁইয়ে আজ আমরা একে একে সকলে এসে জড়ো
হয়েছি আত্মকেন্দ্রিকতার আস্তাকুঁড়ে!
সমকাল
কখনো ‘এই সময়কে’ সঠিক মূল্যায়ন করতে শেখেনি। কিন্তু উত্তরকাল? উত্তরকালের দায় কিন্তু থেকেই
যায়, অতিতের ‘কালবেলা’ নামে খ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) ‘সেই
সময়কে’ লাশকাটা ঘরে চিরে তার ডিএনএ-এর প্রকৃত নির্যাস খুঁড়ে বের করার। সমাজের তরে।
সমাজজীবনের তাগিদে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে অবিকৃত ইতিহাসের পাতা অক্ষত রাখার
স্বার্থে। উত্তরকালের যে বড় দায় ছিল লাশকাটা ঘরে পুরে সময়কে ছিন্নভিন্ন করার!
ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস), সিমলা, হিমাচল প্রদেশ । এই অ্যাকাডেমিক পরিচয় ছাড়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তিনি এমন একজন লেখক যিনি সময়ের রোজনামচাকে লেখকজীবনের আঙ্গিকে সাজিয়েছেন । তিনি নিয়মিত নানা দৈনিক সংবাদপত্রে, যেমন - আনন্দবাজার, এই সময়, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান একদিন ও পুবের কলম ইত্যাদি, লিখেছেন, লিখে চলেছেন বহু মূল্যবান সমাজ-দলিল । বিবক্ষিতর পাতায় এটি তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ।
No comments:
Post a Comment
We are waiting for your opinion. Please Comment.
Thank You.