Monday, February 15, 2021

আবছা বসন্ত পঞ্চমীর ঝাপসা জলছবি

লিখেছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

ছবি: ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ 

মাঘ সন্ধ্যার কাঁপন ফিকে হয়ে এলেই আকাশে একফালি চাঁদ ওঠে। কুয়াশার গা বেয়ে ঝুলে পড়ে রাতজাগা বাদুর। জোনাকির ঝাড় এসে রূপালী টিপ পরিয়ে দেয় ফুলের কপালে সজনে ফুল দুলে ওঠে সোহাগের শিহরণে। পলাশের নিঃশ্বাসে রঙ ঝরে পড়ে। শিমুলের সিঁথিতে জমাট হয় থোকা থোকা রক্ত সিঁদুরপাখির ডানায় সুদূরের গন্ধ গাঢ় হয়। দখিনা বাতাসে স্মৃতির দোলায় দুলতে থাকে তিরতিরে পাতারা। পায়ে পায়ে নেমে আসে মায়াবী আকাশও। “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে”! ঝাঁক ঝাঁক রোদ্দুর এসে উবু হয়ে বসে পড়ে মায়া টানটান উঠোনে। অশান্ত পানকৌড়ির ডানায় জল রোদ্দুরের কাটাকুটি খুঁড়ে জীবন খোঁজার চমক। এমনি ভাবেই অমোঘ বসন্ত পঞ্চমীতে আছড়ে পড়ে সরস্বতী পুজোর ধূম।  

দখিণা বাতাসের জলতরঙ্গে কোকিলের চমক জাগার আগেই আমি ঘ্রাণ পাই। পলাশ রঙা ভোরের গন্ধ। পোয়াতি ধানের আকাঙ্খার গন্ধ। দুকুল ভাসানো সর্ষে ক্ষেতের গন্ধ। ধানের শীষে লেগে থাকা শিশিরের মায়ার গন্ধ। সোহাগী করতলের গন্ধ। সরস্বতী পুজোর গন্ধ। সেই কোন ছেলেবেলায় ফেলে আসা কৈশোরের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় বাসন্তী সকালেবন-বনান্তর পেরিয়ে থোকা থোকা জোনাকির ঝাড়ের সঙ্গেও। বৎসর ভর সবকিছু আগলে রাখতে রাখতে বসন্ত পঞ্চমীতে ঝাঁপি ভেঙে বেরিয়ে পড়ে তারা। সেই সব গন্ধ মাখা, স্পর্শ লাগা, স্মৃতির ঘেরা তারুণ্যের জলছবিগুলো

ছেলেবেলায় আমার একটা বুক ভরা উচ্ছল নদী ছিল। এতদিনে তিলতিল করে শুকিয়ে গেলেও পিছন পানে বয়ে যেতে পারেনি। বসন্ত এসে উঁকি দিলেই নদীটায় প্রবল জলস্ফীতি হয়। উপচে পড়ে উচ্ছ্বাস। যৌবনের মণিমালারাও একে একে এসে জড়ো হয় নদী পাড়ে বাসন্তী পঞ্চমী আর নুড়িপাথরের খুনসুটির যুগলবন্দীর অমোঘ ইশারায় নুড়িপাথর ডিঙিয়ে উজান স্রোতে ভেসে চলে আবেগের নদী। বল্গাহীন তরঙ্গের হিল্লোল। ছায়া ছায়া বিপুল মাঠ। দুকুল বেয়ে টকটকে শিমূলের উল্লাস। নদী বক্ষে আমার প্রাণের কুয়াশা আর মেঘের ছাউনি ঘেরা ছোট্ট নৌকার গলুই ভেসে চলে টলোমলো পায়ে। একূল ছাড়িয়ে অন্য কোন কূলের আঘ্রাণে। ছেলেবেলার অচিনপুরের ডাহুক, পানকৌড়ি, মণিমালা, রক্তপলাশের সুলুক সন্ধানে। ভেজা চুল, থরথর ঠোঁট, ছলছল চোখের কালান্তরি ইশারায়। উচ্ছ্বাসময় উজান পেরিয়ে ভাটির টানে বয়ে চলা নদীও বসন্ত বাতাসের আশকারায় সুর ভাজে ... তুমি প্রান হয়ে এসো, উতলা এই বসন্ত দিনে।  

বসন্ত রোদ্দুরের একটা গন্ধ থাকে। একটা আহ্লাদী স্পর্শ থাকে। একটা মায়া থাকে। সারা গায়ে রোদ্দুর জড়িয়ে এক বাসন্তী সকালে সেও এসেছিল। যেন বহুদূরের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে কূলপ্লাবী জ্যোৎস্নার অমোঘ টানেতাঁর বুকের ভাঁজে যেন জ্যোৎস্না চলকে উঠেছিল। তাঁর কাছে ভালবাসার গোলাপ ছিল। মায়ার আকুতিও। নিজেকে উজাড় করে সে অনুভব করেছিল ... ফাল্গুনী ঠোঁটে মৌটুসির আকণ্ঠ চুমুক। আমি তাঁর মায়ার প্রশ্রয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বহু যুগ পরে যখন ঘুম ভেঙেছিল, কালের সমুদ্রতটে তাঁর কঙ্কালখানি শুধু পড়েছিল। ভালবাসার গোলাপটাও। কালান্তরি বাসন্তী সকালের রোদ্দুরের বাহুতে এখনও সেই গন্ধ লেগে আছে। আমি প্রাণপণে তার ঘ্রাণ নিই।

বাসন্তী সকালে প্রশান্তির আঁতর গায়ে মেখে ঝলমলে শাড়ির আঁচল বেয়ে একটি প্রাণোচ্ছল যুবতীকে পথ হাঁটতে দেখেছিলামকতই বা বয়স হবে! ২০ কিংবা ২২। কিন্তু মনে হয়েছিল, যেন কালের অনুশাসন পেরিয়ে বহুকাল ধরে সে হেঁটেই চলেছে। কোথায় চলেছে সে? কে জানে! হয়তো কোন ফাল্গুনী মায়ার দুর্নিবার টানে! হয়তো তাঁর সুলুক সন্ধানে, যার জিনসের পকেট ফুঁড়ে বসন্তের রোদ্দুর উঁকি মারে!   

আমার মতো প্রঢ়দের বসন্তে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’-র মোড়কে পাশ্চাত্য প্রেমের দিন যাপনের কোন অবকাশই ছিল না। আমাদের কচি পাতার মতো প্রেমের উদ্দাম জলপ্রপাত পাহাড় বেয়ে আছড়ে পড়তো বসন্ত পঞ্চমীর কাকভোরেই। সেকালে সরস্বতী পুজোয় যতটা না ধর্মীয় ভাবাবেগ ছড়িয়ে থাকতো, তার থেকে ঢের বেশি জড়িয়ে থাকতো বঙ্গীয় সংস্কৃতির চিরহরিৎ উচ্ছ্বাস। তাই বাংলার গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, মফঃস্বলে সরস্বতী পুজো হয়ে উঠত আক্ষরিক অর্থে সর্বজনীন।       

বাসন্তী পঞ্চমীর উচ্ছ্বাসের এলোমেলো আশকারায় জীবনটা যেন হঠাৎ পিছন ফিরে চলতে শুরু করে! কাকভোরে উঠে স্নান। ইস্কুলের পূজা প্রাঙ্গণ। বিদ্যা দেবীর পূজার কোলাহল মুখর আয়োজন। বন্ধুর বাড়ানো হাত। রংবেরঙের শাড়ি। রাঙা পলাশের হাতছানি। আলতা পায়ের আলাপী খুনসুটি। আলতো হাতের পরশ। চাহনি ভরা ইচ্ছের ঝলক। আঁচল বোঝাই মায়া। দিনদুপুরে অবিরাম বৃষ্টি ধারা। মুহূর্তদের হেলায় হারিয়ে ফেলি আমরা, যতক্ষণ না তাঁরা স্মৃতির আকুতি নিয়ে ফিরে ফিরে আসে তোলপাড় করা বক্ষ মাঝেবয়ে নিয়ে চলি আমরা, স্মৃতির ফল্গুধারা, জীবনের অথৈ আঁকেবাঁকে। ফুরিয়ে যাওয়া মুহূর্তদের আকস্মিক প্লাবনে চলকে ওঠে হৃদয়কুম্ভ কানায় কানায় স্মৃতির কপাল জুড়ে আলুথালু হয়ে জ্বলতে থাকে বোবা রোদ্দুরের টিপ।  

সেই কাঁচা বয়েসে, সারা বছর ধরে স্ফুলিঙ্গ ছোটানো রকের রকমারি ফুলঝুরি ... রবীন্দ্রনাথ না গ্যেটে, জীবনানন্দ না বিষ্ণু দে, শক্তি না সুনীল, পিকাসো না নন্দলাল বসু, মার্ক্সবাদ না ফ্যাসিবাদ, লেনিন না রোজা লুক্সেমবার্গ ... এইসব অমীমাংসিত তত্ত্বকথার তর্কের তোড় সরস্বতী পুজোর দিনগুলিতে শিকেয় তোলা থাকতো। তখন আমরা সবাই কেবলই কচ অথবা দেবযানী। রোমিও অথবা জুলিয়েট। কিংবা লায়লা অথবা মজনু। লাল-হলুদ শাড়ির আঁচলের বিহ্বলতায় কেবলই মজে থাকা। সেই যে কবে একবার লিখে ফেলেছিলাম না! ‘তুই যদি চাস ফাগুন আবার, আনতে পারি রক্তপলাশ’। যেন গাছে গাছে ফুটে থাকা রক্তপলাশের উচ্ছ্বাস বইত আমাদের রক্ত ধারায়। তখন ঝাঁক ঝাঁক সোনালি রঙের রোদ ছিল। সেদিনের হৃদয় কুম্ভ কানায় কানায় ভরে থাকতো ঝলমলে বাসন্তী রোদ্দুরে।  

ছেলেবেলার বন্ধু অনির্বাণ এমন রোদ ঝলমলে বাসন্তী সকালে নদীপাড়ের বালিতে কত কি আঁকিবুঁকি কাটতো। ওঁর আঙুলে বসন্তের রোদ্দুর লেগে থাকতো। মেঘ রঙা খামে মন কেমনের চিঠি পাঠাতো সহপাঠিনী সুচরিতাকে। দুজনের দেখা হতো কলকল নদীর উচ্ছলতায় বিভোর হয়ে। আদিগন্ত ব্যাপী পলাশ-শিমুলের আলিঙ্গনে। বাঁশবনের আবডালে খোপা বোঝাই জ্যোৎস্না মেখে। হৃদয়ের উথালপাতালের উচ্ছ্বাসে হাওয়ার বাঁশি কেঁপে কেঁপে উঠত। শিমূল-পলাশের কপাল নুইয়ে পড়তো মাটির ছোঁয়া পেতে। তারপর কত বসন্ত পঞ্চমীর অশান্ত ঢেউ বয়ে গেছে নদী বক্ষেসুচরিতা এখন পরপারের গৃহিণী। অনির্বাণ এখনও আঁকিবুঁকি কাটে নদীর এপারের ঢিবি করা বালির স্তূপে কাঁচাপাকা চুল। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। আঙুলে বোঝাই শ্রাবণী মেঘের ঘনঘটা। বাসন্তী সকালের রোদ্দুরে আজ যেন কত জন্মের ঘুমের অবসাদ!

এমনি ভাবেই কাঁচের মার্বেলের মতো গড়িয়ে যায় জীবনের কত মধুমাস! ছুটন্ত রেলগাড়ির থেকে দেখা প্রকৃতির মতো সরে সরে যায় পলাশ রাঙা বসন্ত দিনের করুণ আর্তিধাবমান গতির আবর্তনে ক্রমশই ফিকে হয়ে পড়ে ঝকমকে আলোর চকচকে মুহূর্তের আলিঙ্গনশুন্যতা বুকে বয়ে একাকী পড়ে থাকে থোকা থোকা রঙহীন রক্তপলাশরাত গভীরের তুমুল বৃষ্টিতে হয়তো মুছে যাবে রক্তিম আভায় এঁকে আসা শিমূলের রাঙা ঠোঁটের সকল আকুতি। এমনি ভাবেই পাকদণ্ডী পথ চরাই-উৎরাই পেরিয়ে সকলকেই এগিয়ে নিয়ে চলে জীবন পথের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রত্যন্ত প্রান্তে। পেরিয়ে এসেছি কাজল কালো চকিত চাহনির আঁচল ভরা অবগাহন। কিংবা মেঠো ফুলের খিলখিল হাসিতে টোল পরা গালের শিহরণ। অথবা বাসন্তী বিকেলের মায়াবী আস্কারায় টলমল করা সেই দুটি আকাঙ্খার ঠোঁট! বাঁকা চাঁদ আজও এসে উবু হয়ে বসে কৃষ্ণচূড়ার কাঁধে মিটিমিটি নক্ষত্ররা ঘুমিয়ে পরে বকুলের সোহাগী ডালে। এলোমেলো দখিণা বাতাস চিৎকার করে বলে, “ফিরায়ে দাও অক্ষত মন সাদা পাতা”। প্রতিধ্বনি ফিরে আসে না। তবু রাত জেগে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে প্রতীক্ষার অস্থির পাহাড়। রাত জাগা ঠোঁটে আজও ঝুলে থাকে বাসন্তী পঞ্চমীর আবেগময় অষ্টপ্রহর। 

 



ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস), সিমলা, হিমাচল প্রদেশ । এই অ্যাকাডেমিক পরিচয় ছাড়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি হল তিনি এমন একজন লেখক যিনি সময়ের রোজনামচাকে লেখকজীবনের আঙ্গিকে সাজিয়েছেন । তিনি নিয়মিত নানা দৈনিক সংবাদপত্রে, যেমন - আনন্দবাজার, এই সময়, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান একদিন ও পুবের কলম ইত্যাদি, লিখেছেন, লিখে চলেছেন বহু মূল্যবান সমাজ-দলিল । 

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.