Saturday, February 6, 2021

আঁদ্রে ব্রতোঁ ও স্যুররেয়ালিস্ট আন্দোলন

লিখেছেন সৈয়দ কওসর জামাল

ছবিঃ ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ




[১৯১৫ সাল—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। উনিশ বছরের এক তরুণ, বাধ্যত তখন ফরাসি গোলন্দাজবাহিনীর সদস্য হলেও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কবি আপলিনের-কে পাঠিয়েছিলেন নিজের লেখা দুটি কবিতাসহ একটি চিঠি। তরুণটির পিতা প্যারিসের উপকণ্ঠে এক গ্লাসোয়ার্ক ফ্যাকটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র ডাক্তারি পড়ে পরিবারটিকে সম্মানজনক বুর্জোয়া প্রেণিতে স্থাপন করবে। কিন্তু মেডিসিনের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি তরুণ, আসলে কোনো বস্তুগত বিষয়ের দিকেই আগ্রহ ছিল না তাঁর, উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসে শিক্ষকের কাছে মালার্মের কবিতা শোনার পর থেকে তাঁর উচ্চাশা জেগেছিল তিনিও কবি হবেন। ]


আপলিনের ফেরাননি তাঁকে—চিঠির উত্তরে জানিয়েছেন, ‘তোমার লাইনগুলোতে আমি এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভার পরিচয় পাচ্ছি’। বরিষ্ঠ কবির সঙ্গে তরুণ কবির এই যোগাযোগ এভাবেই শুরু হয়েছে। ‘আমি তোমাকে চিঠি লিখতে পেরে আনন্দিত’, কখনও লিখেছেন, ‘তোমার মনে যেসব প্রশ্ন আসবে আমাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য, আমার চিঠিতে সে সবের উত্তর পাবে’, আর তরুণ কবিকে সম্বোধন করেছেন, Mon cher poète, ‘আমার প্রিয় কবি’ বলে। আপলিনের-এর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে উৎসাহিত এই তরুণ কবি,  আঁদ্রে ব্রতোঁ, দুটি সনেট লিখে পাঠিয়েছেন আর এক কবি-ব্যক্তিত্ব পল ভালেরিকে। বস্তুত এই সনেটদুটি—Décembre (ডিসেম্বর)  ও  A vous seule (শুধু তোমাকে)—মালার্মে-প্রভাবিত হলেও কবিতা রচনায় ব্রতোঁ-র একটা নির্দিষ্ট ঝোঁক লক্ষ করা গেছে। ভালেরি দ্বিতীয় কবিতাটিতে অন্তর্জগতের দ্বন্দ্বের উল্লেখ করেছেন। ব্রতোঁকে চিঠি লিখে ভালেরি জানান—

 

তোমার পাঠানো শেষ কবিতা পড়েছি। আমার মনে হয়েছে তুমি এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছো চিকিৎসকরা যাকে বলবেন সঙ্কটজনক। কবিতাদুটির ছন্দময় প্রবাহ, নির্দিষ্ট ধাঁচের মধ্যে মানিয়ে-যাওয়া নৈপুণ্য, আকস্মিকতার যে ইচ্ছাকৃত ও প্রতিমুহূর্তেই গুটিয়ে-নেওয়া ব্যবহার—এ সব থেকে বোঝা যায় যে তুমি বুদ্ধিবৃত্তির এক মিশ্রণ বা স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছেছ, যে অবস্থাটি সম্পর্কে আমি সম্যক জানি এবং যেখানে র‍্যাঁবো ও মালার্মের মতো চির-অমিল দুজন এক কবির মধ্যে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করছে।

 

স্পষ্টতই ভালেরি ব্রতোঁর কবিতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনিও ব্রতোঁর কবিতায় মালার্মের সঙ্গে র‍্যাঁবোরও প্রভাব লক্ষ করেছেন। এই সময়ের কবিতাগুলো সংকলিত হয়েছে Mont de piété (১৯১৯) কাব্যগ্রন্থে। ব্রতোঁ কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন ১৯১৪ সাল থেকে। ১৮৯৬ সালে জন্ম, তাই তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। খুবই কল্পনাপ্রবণ ছিল তাঁর মন। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছিল প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র ও সমুদ্রতীরের বর্ণনা। আসলে আঁদ্রের জন্ম নরম্যান্ডির পুরোনো ফরাসি শহরে হলেও তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল ফ্রান্সের অ্যাটলান্টিক উপকূলে ব্রিটানির বন্দরশহর লরিয়া-তে। এ সবই তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। যে জীবন ব্রতোঁ কাটিয়েছিলেন তার সঙ্গে প্যারিসের দুস্তর ফারাক। তাঁর পিতার কথা আমরা বলেছি। মা সম্পর্কে ব্রতোঁ নিজেই লিখেছেন যে তিনি ছিলেন স্পষ্ট বক্তা, প্রাচীনপন্থী, এবং কোনো কিছু মনোমতো না হলে খুব রূঢ় হয়ে উঠতেন। বাবা-মার শাসন ও পুরোনো পন্থা হয়তো আঁদ্রে ব্রতোঁকে কোনো বাধা ও প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মানসিকতা তৈরি করেছিল। প্যারিসের স্কুলে আঁদ্রে পড়েছেন ১৯০৭ সাল থেকে, স্নাতক হয়েছেন ১৯১২তে এবং ১৯১৩তে সরবনে মেডিশিন পড়তে গেছেন। এই ডাক্তারি পড়ার প্রভাব ব্রতোঁর কবিতায় এসেছে নানা শব্দের ব্যবহারে।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোলন্দাজ বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতে হলেও পরে তাঁকে নঁত-এ হাসপাতালের নিউরোলজিক্যাল সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে কাজ করার পর তাঁকে আবার পাঠানো হয়েছে স্যাঁ-দিজিয়ের-এর সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে চিকিৎসা সহকারি হিসেবে। প্রথমে নঁত ও পরে স্যাঁ-দিজিয়ের এই দুই জায়গায় কাজের ফলে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি দেখেছেন কী ধরনের মানসিক অসুস্থতায় ভোগে সৈন্যরা; এছাড়া তাদের চিকিৎসার জন্য যে সব পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, যেমন জঁ-মার্ত্যা শারকো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও পিয়ের জানে-র প্রায়োগিক চিকিৎসা-পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ব্রতোঁকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি মানুষের মনের চিন্তাপদ্ধতি, গঠন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। মনের অবচেতনের অস্তিত্ব ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা  জেনেছেন ফ্রয়েডের কাছ থেকে। সব কিছুই ব্রতোঁর স্যুররেয়ালিস্ত কবিজীবনকে প্রভাবিত করেছে। স্বপ্ন ও অবচেতনকেই কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। তাঁর অটোমেটিক রচনার উৎস এই মনোবিজ্ঞানের পাঠ। বিশ্বযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে ফিলিপ সুপো-র সঙ্গে মিলিতভাবে রচিত কাব্য Les Champs magnétiques (১৯২১) ও তাঁর একক কাব্য Poisson soluble-এ। উপন্যাস ‘নাদজা’তেও দেখি এক রহস্যময় নারীকে যিনি সাইকোসিসের রোগী। এ ছাড়া পল এলুয়ার-এর সঙ্গে মিলিতভাবে ব্রতোঁ লিখেছেন L’Immaculée Conception; এই লেখাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল কথার ভিতর দিয়ে কাউকে উজ্জীবিত করা, যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অপ্রকৃতিস্থতার চিন্তাক্রম।

 

১৯১৭ সালে যুদ্ধের মধ্যেই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বন্ধু জাক ভাশের সঙ্গে আপলিনের-এর লেখা ‘স্যুররেয়ালিস্ত’ নাটক ‘Les Mamelles de Tirésias’(তিরেসিয়াসের স্তন) দেখে কৌতূহলী হন ব্রতোঁ এবং তাঁর ধারণা হয়েছিল যে এই নাটকের ভাবনা শিল্পকলার জগতে এক গভীর পরিবর্তন আনতে চলেছে। আপলিনের তাঁর চিন্তাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে –‘মানুষ যখন হেঁটে যাওয়াকে অনুকরণ করতে চেয়েছে, তখন সে চাকা আবিষ্কার করেছে, যা দেখতে পায়ের মতো নয়। এটা না জেনেই সে স্যুররেয়ালিস্ত হয়েছে’।

 

চিরকালের ‘মূর্তিভঙ্গকারী’ ভাবধারা ও নতুনত্বের পক্ষে থেকেছেন আঁদ্রে ব্রতোঁ। নতুন ধ্যানধারণাকে গ্রহণ করার ইচ্ছা ও সামর্থ্য দুই ছিল তাঁর। নতুনের অন্বেষণেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন দাদাবাদীদের। ১৯১৭ সালেই তিনি দাদাবাদীদের মুখপত্রের দুটি সংখ্যা পড়েছিলেন। তৃতীয় সংখ্যা ‘দাদা’ পড়েছেন আরো দুবছর পরে। ১৯১৯-এই  পড়েছেন ত্রিস্তাঁ জারার ‘দাদা মানিফেস্ত ১৯১৮’। ইস্তেহার অনুযায়ী ‘শৃঙ্খলা=বিশৃঙ্খলা; অহং=আত্মহীনতা; নিশ্চিতি=অনিশ্চিতি’। তাঁদের নীতি – ‘প্রতিবেশীকে ভালোবাসো’ বলা মানে ভণ্ডামি, ‘নিজেকে জানো’ বলাটা ইউটোপীয়, তবু এর মধ্যে মালিন্য থাকায় কিছুটা গ্রহণীয়। আমরা ভীত নই, কারণ আমরা আবেগপ্রবণ নই। আমরা ঝোড়ো বাতাসের মতো মেঘ ও প্রার্থনার গায়ের কাপড় ছিঁড়ে দিই; আমরা প্রবল বিপর্যয়, বিধ্বংসী অগ্নিকান্ড ও পচন-দৃশ্যের প্রস্তুতি নিচ্ছি... প্রতিটি মানুষের চিৎকার করা দরকার; খুবই ধ্বংসকারী, নঙর্থক চেষ্টায় সামিল হতে হবে।‘ কিংবা ইস্তাহারের ঘোষণা—‘ মুক্তি : দাদা দাদা দাদা, কুঁকড়ে যাওয়া রঙের আর্তনাদ, বৈপরীত্য ও যত রকমের বিরোধ, বীভৎসতা ও অপরিণামদর্শিতা : জীবন’।  ইস্তেহারের এই ভাষা ব্রতোঁ ও তাঁর দুই কবিবন্ধু সুপোল ও আরাগঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চিন্তা ও মূল্যবোধের জগতে যে আঘাত করেছিল তার সেই হতাশা ও মরিয়া অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে দাদাবাদকে তাঁরা দেখেছেন।  

         

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদাবাদীদের বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল নৈরাজ্য ও প্রলাপসর্বস্ব হট্টগোলের আশ্রয়। ফলে নঙর্থক এই আন্দোলন থেকে তাঁরা সরে এসে বিদ্রোহকে নতুন রূপ দিতে চেয়েছেন ‘স্যুররেয়ালিসম’ (Surréalisme) -এর আশ্রয়ে। এক দিক থেকে, দাদাবাদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল স্যুররেয়ালিসমের বীজ। দাদাবাদ যদি নাস্তির আশ্রয়, স্যুররেয়ালিসম তবে ছিল নাস্তির নাস্তি। এ এক নতুন স্বীকৃতি যা পরিলক্ষিত হয়েছে সদর্থক সৃষ্টিশীলতায় ও আদর্শবাদী ভাবনায়। ১৯২৪ সালের ‘দ স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’-র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে লেখা হয়েছিল—‘মানুষের অধিকারের নতুন ঘোষণা হওয়া দরকার’। ১৯২০ থেকে ১৯২৪—দাদাবাদ থেকে স্যুররেয়ালিসম—বিবর্তনের এই কালকে বলা হয়েছে নিদ্রার কাল, ‘লা পেরিওদ দে সোমেই’।

 


এই ‘নিদ্রাকাল’-এর মধ্যেই ১৯২২ সালে প্রকাশ পেয়েছে ব্রতোঁর পত্রিকা Littérature-এর একটি সংখ্যা, যেখানে  ২৪ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়েছিল প্রতীকবাদীদের মধ্যে তখনও সক্রিয়—ভালেরি, আঁদ্রে জিদ ও লেয়ঁ-পল ফার্গ-এর কবিতা ও গদ্য। ছিল ব্রতোঁ-র ‘ক্লে দ সল’ ও আরাগঁ-র একটি ছোটো কবিতা। এই সংখ্যাতেই ব্রতোঁ জানিয়েছেন কীভাবে তাঁর Les Champs magnetiques কবিতায় অটোমেটিক রাইটিং-এর সঙ্গে মিশে ছিল স্বপ্ন এবং ঔৎসুক্য তৈরি হয়েছিল কবিবন্ধুদের মধ্যে। এখানেই ব্রতোঁ ‘স্যুররেয়ালিসম-এর সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এইভাবে—

 

শব্দটি আমরা আবিষ্কার করিনি, কিন্তু নির্দিষ্ট অর্থে প্রয়োগ করেছি। আমরা সহমত হয়েছি এর মধ্য দিয়ে বোঝাব ‘সাইকিক অটোম্যাটিজম’ যা কমবেশি স্বপ্নাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তবে এই স্বপ্নাবস্থার সীমা বেঁধে দেওয়া এখন খুবই কঠিন।

স্যুররেয়ালিসম তখনও আন্দোলনের রূপ পায়নি, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে ভেবেছেন ব্রতোঁ। তাঁর মনে হয়েছে ‘কবিতা হল আমাদের জীবনের সমস্যার নির্দিষ্ট সমাধান’। যে কবিতার প্রশংসা তিনি করেছেন, ভেবে দেখলেন, ‘তা এসেছে মানুষের জীবনের ভিতর থেকে’। মানুষের জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে হয়েছে ‘এ এক পথ যেখানে মেনে নেওয়া যায় না এমন মানবিক অবস্থাকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে’। তাঁর মতে, ‘শব্দ ও ভাষা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এবং মানুষের মনই যোগ্যতম বিপ্লবের স্থান’। অর্থাৎ, কবিতা কোনো পৃষ্ঠার ওপর শব্দ নয়, তা একটা মাধ্যম যা দিয়ে স্বপ্ন পূর্ণ করা এক পৃথিবীতে প্রবেশ করা যায়।

 

ব্রতোঁর নেতৃত্বে স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলন, যাকে বলা হয়েছিল ‘স্যুররেয়ালিস্ত বিপ্লব’, স্পষ্টতা পেয়েছে ১৯২৪ সালে ‘মানিফেস্ত্ দ্যু স্যুররেয়ালিসম’ বা স্যুররেয়ালিস্ত ইস্তাহার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। এই ইস্তেহার রচনা করেছেন ব্রতোঁ। এবার তিনি স্যুররেয়ালিসম-এর সংজ্ঞা দিলেন এইভাবে—

 

স্যুররেয়ালিসম, বিশেষ্য, পুংলিঙ্গ। বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা (automatisme psychique pur), যার          সাহায্যে মৌখিক বা লিখিতভাবে চিন্তার প্রক্রিয়াকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়। এ হল নন্দনতাত্ত্বিক বা নৈতিক   বিষয়ের বাইরে, যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থায় চিন্তার কর্তৃত্ব (dictée de la pensée)।

 

দার্শনিক অর্থ : স্যুররেয়ালিসম বিশ্বাস করে নানা ধরনের অনুষঙ্গে প্রকাশিত, যা এতকাল অবহেলিত, এক উচ্চ বাস্তবে (réalité supérieure), স্বপ্নের সার্বভৌমত্বে এবং চিন্তার নিস্পৃহতায়। এর উদ্দেশ্য অন্য সমস্ত মানসিক কলকব্জাগুলোর চিরতরে বিনাশ (ruiner définitivement tous les autres          mécanismes  psychiques) এবং জীবনের প্রধান সমস্যাজাত সিদ্ধান্তের মধ্যে নিজেকে প্রতিস্থাপন।

 

 অবচেতনকে তিনি করলেন কাব্যের উৎস—অবচেতনেই কাব্যের মুক্তি। ইস্তাহারে ব্রতোঁ বললেন—‘আমি বিশ্বাস করি যে আপাতবিরোধী দুই মানবিক অবস্থা অর্থাৎ স্বপ্ন ও বাস্তব অপসৃত হয়ে তাদের মধ্যে থেকে উদ্ভুত হবে এক নতুন বাস্তব, এক  surréalité’। এই অবস্থাকেই কি জঁ আর্ত্যুর র‍্যাঁবো বলেছিলেন dérelegment de tous les sens, সমস্ত চেতনার বিপর্যয়?  এভাবেই ব্রতোঁ চাইলেন ‘মানসিক স্বয়ংক্রিয়তার জগতে’ প্রবেশ করতে। তার জন্য উদ্ভাবন করতে হবে স্বয়ংক্রিয় রচনাপদ্ধতি। স্যুররেয়ালিস্তদের ‘বিপ্লবী’ রচনা প্রকাশের জন্য সম্পাদিত হল নতুন পত্রিকা ‘লা স্যুররেয়ালিস্ত রেভোল্যুসিয়ঁ’। সবাই প্রাথমিকভাবে বিনা প্রশ্নে ব্রতোঁকে মেনে নিয়েছেন স্যুররেয়ালিস্ত আন্দোলনের নেতা হিসেবে। ব্রতোঁর জন্যই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ফিলিপ সুপো, ল্যুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, বেঞ্জামিন পেরে, রবের দেসনস প্রমুখ কবিরা।

         

১৯২৪ সাল থেকে আঁদ্রে ব্রতোঁর নেতৃত্বে স্যুররেয়ালিস্তদের নতুন নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ শুরু হয়েছে। কবিকল্পনা ছিল তাঁদের মনে আর নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন ছিল তাঁদের চোখে। স্যুররেয়ালিসম যে কোনো ্দার্শনিক প্রস্তাবনা নয়, শিল্প-সাহিত্যের এক নিরীক্ষা মাত্র, তা স্পষ্ট করে দিয়ে ব্রতোঁ বলেছেন, ‘ কবিতা চর্চা করতে হবে’। এই চর্চার অর্থ এমন ছিল না যে সবাই একসুরে কথা বলবেন। প্রত্যেক কবিরই নিজস্ব ও পুর্বলব্ধ ধারণা ছিল, এ কথা ব্রতোঁও স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

১) আমাদের কোন প্রতিভা নেই; উৎপাদনের স্বয়ংক্রিয় দ্রব্য এবং নিম্ন আয়ের বসবাস  লম্বা শহরগুলোকে ধ্বংস করবে (ফিলিপ সুপো)

২) আমি যে গল্প বলছি তা বহুবার বলা, একটি কবিতা যা আমি পুনর্বার পড়ছি : আমার তরুণ কান ও  পুড়ে খাস্তা হয়ে যাওয়া ঠোঁট নিয়ে আমি ঝুঁকে পড়ছি দেওয়ালের দিকে। (পল এলুয়ার)

৩) পার্টি শেষ হলে খেলোয়াড়রা যখন পানপাত্রের সামনে জড়ো হয় তখন আমি গাছটিকে জিজ্ঞেস করি সে কি সবসময় লাল রিবন পরে থাকে? ( লুই আরাগঁ)

 

আর ব্রতোঁ কবিতায় লিখেছেন—

 

          ১)পাথরের টুপিগুলো স্ফটিক হয়েছে

          তারা হিম আটকাচ্ছে সজোরে আঘাত করা শিরোস্ত্রাণ দিয়ে

          তারপর বিদ্যুতের দারুণ ঝিলিক

          ধ্বংসের পতাকায় আঘাত করে

          বালি এখন অনুজ্জ্বল এক ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়...

 

          ২)খাপছাড়া কিছু প্রাণী পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে

          তারা আমার কল্পনাইয় পৌঁছোনোর দিকনির্দেশ চায়

          যেটা নিজেই ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীজুড়ে

          তবে দুপক্ষই ঘুরছে উলটোদিকে

         

স্যুররেয়ালিস্তদের এই সৃজনশীলতা সক্রিয় থেকেছে ১৯৩০ সালে স্যুরলিয়ালিসম-এর দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত। পরের পর্যায়ের রচনাগুলোকে ব্রতোঁ বলেছেন স্যুররেয়ালিসম-এর যুক্তির পর্ব। ‘স্যুররেয়ালিস্ত বিপ্লব’-কে সংহত করতে চেয়েছেন ব্রতোঁ। এই সময় স্যুররেয়ালিস্তদের মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা যায়। একটি হল—কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ। আর দ্বিতীয়টি হল—স্যুররেয়ালিসমকে পশ্চিম ইউরোপ ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। দুটি ক্ষেত্রেই তাঁরা যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছিলেন সে কৃতিত্ব অবশ্যই আঁদ্রে ব্রতোঁর প্রাপ্য।

 

ব্রতোঁর নিজের সাহিত্যকৃতিতে তাঁর কবিতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাঁর অন্যান্য রচনার তুলনায় কবিতা পরিমাণের দিক থেকে বেশ কম। প্রথম কাব্যগ্রন্থ Mont de piété (১৯১৯) থেকে শেষ প্রধান কাব্যগ্রন্থ Ode à Charles Fourier (১৯৪৭) পর্যন্ত ব্রতোঁর কবিতায় সংগতি ও সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক তাঁর চিত্রকল্প, যেখানে কল্পনাশক্তির সঙ্গে মেশে মানুষের মূল প্রবণতা ও আকাঙ্ক্ষাগুলো, কখনও আবার দুর্বোধ্য অযৌক্তিকতার উদ্ভট রূপ গ্রহণ করে। চিত্রকল্পের মধ্যে আছে এমন তুলনা যা পরস্পরবিরোধী এবং এক উপমা থেকে হঠাৎ-ই অন্য উপমায় চলে যাওয়া আছে। তবে সব উপমাই স্বতঃস্ফূর্ত, ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা বলে মনে হয় না। অটোমেটিক রচনার এটাই বৈশিষ্ট্য যে তার মধ্যে থাকে চিন্তার বাস্তব প্রক্রিয়া; যে চিন্তার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে যৌনতা, অবচেতনের আকাঙ্ক্ষা ও চেতন মনের প্রকাশ। স্যুররেয়ালিস্তরা চেয়েছিলেন অবচেতনের জগতে প্রবেশ করে বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কার করতে। কারণ, ব্রতোঁ বলেছেন, ‘বিস্ময় সবসময় সুন্দর’।

 

ব্রতোঁর কবিতার চিত্রকল্প স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে তাঁর লেখনশৈলীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য। একটি বৈশিষ্ট্য হল বাক্যগঠনের পরিচিত ছকটিকে ভেঙে ফেলা, যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ কূটাভাস থেকে ভাষাগত বৈপরীত্য, অন্বয়গত অস্পষ্টতা, ও প্রসঙ্গের জটিলতা। ব্রতোঁর কবিতাশৈলীর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যভাষা, যা কাব্যিক ইমেজে-এর নাটকীয় প্রকাশে সহায়তা করে। এই ভাষার সামর্থ্যের জায়গা হল ব্রতোঁর সীমাহীন শব্দভাণ্ডার। এই শব্দভাণ্ডারে আছে শারীরবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রযুক্তিবিষয়ক অনুষঙ্গ, কিন্তু সমস্যা হল সেসব অনুষঙ্গ প্রায়শই কবিতার পাঠকের কাছে পরিচিত নয়। ব্রতোঁর কবিতাশৈলীর তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত হল একই বিষয়ের পুনঃপুন ব্যবহার ও প্রতীকধর্মী ‘মোটিফ’, যেমন রিভলভার হল যে কোনো ধরনের বিদ্রোহ বা বিপ্লবের আলঙ্কারিক ইমেজ।

 

ব্রতোঁর কবিতায় তিনটি মূল ধারণা প্রকাশ পেয়েছে—এক, কল্পনার মুক্তিদায়ী ক্ষমতা; দুই, জাগতিক পৃথিবীর ইউটোপীয় রাজ্যে রূপান্তর; এবং তিন, ভালোবাসার ভিতর দিয়ে মানবিক সামর্থ্যের অনুসন্ধান। তাঁর কবিতায় এই স্যুররেয়ালিস্ত দৃষ্টিভঙ্গিই ধরা পড়ে। মানবিক কল্পনার মুক্তিদায়ী ক্ষমতায় ব্রতোঁর বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল আধুনিক মনোবিশ্লেষণমূলক চিন্তা, বিশেষ করে অচেতনের ক্রিয়াকলাপে ফ্রয়েডের চিন্তা। ব্রতোঁর কাছে অচেতন বলতে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ স্থান বা শক্তি বোঝায় না, বরং তা হল জাগতিক বাস্তবতার জগৎ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ যা নিয়ে যায় পরাবাস্তবতার জগতে। আর পরাবাস্তবতার এই জগতে মানুষের যুক্তি ও কল্পনা পরস্পরের বিরুদ্ধে পড়াই করে না, বরং একসঙ্গে মিলে কাজ করে—এটাই হল মোক্ষম বাস্তবতা, আমাদের প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য এই বাস্তবতার চিহ্নগুলোর ক্রমাগত সন্ধান, এবং সেই অভিজ্ঞতা লাভ করার অর্থই হল জীবন বদলে যাওয়া।  সব মানুষের পক্ষেই এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সামর্থ্য আছে, এমন বিশ্বাস  ব্রতোঁ করলেও শিল্পীদের পক্ষে তা অবশ্যই যোগ্যতার মাপকাঠি বলে মনে করেছেন। শিল্পীর কাজ হল তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এই ‘আশ্চর্য’ (le merveilleux) –এর চিহ্নগুলোকে উপস্থাপিত করা। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য স্যুররেয়ালিস্তরা নানা পদ্ধতির কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে দুটি পদ্ধতির কথা ব্রতোঁর কাজের মধ্যে আমরা পাই—এক) বিশ্বের hazard objectif  বা বস্তুগত ভাগ্যের কাছে মানুষের আত্মসমর্পণ এবং দুই) অটোমেটিক লেখার মধ্যে দিয়ে অবচেতনের প্রাথমিক প্রক্রিয়াকে গ্রহণ। প্রথম পদ্ধতির উদাহরণ আমরা পেয়েছি ব্রতোঁর Clair de terre (পৃথিবীর আলোয়) কাব্যগ্রন্থের Au regard des divinités (দেবতাদের চোখে) কবিতা—

মধ্যরাতের একটু আগে সিঁড়ির কাছে

অবিন্যস্ত চেহারার কোনো নারী যদি তোমাকে অনুসরণ করে তাকিয়ো না তার দিকে।

এ হল নীল। নীলের থেকে তোমার ভয়ের কিছু নেই।

গাছের ওপরে থাকবে এক লম্বা সোনালি চুলের পাত্র।

গলিত রঙের গ্রামের কুণ্ডলীর একটি পাক

তোমার দিকচিহ্ন হবে। সহজভাবে নেবে,

মনে রেখো। অন্ধকার উষ্ণ প্রস্রবণ যা ছুড়ে দেয় ফার্নপাতা

আকাশের দিকে, স্বাগত জানায়

তোমাকে স্বাগত।

একগুচ্ছ নির্দেশনা কবির এবং hazard objectif পদ্ধতি, হঠাৎ-পাওয়া বাস্তবতার মধ্য দিয়ে থেকে উঠে আসছে এক ‘আশ্চর্যময়তা’ (le merveilleux)। ‘আশ্চর্য’কে আহ্বান করার আর এক পদ্ধতি অবচেতনার ভিতরে চিন্তার লাগামহীন অনুষঙ্গ, যা স্বয়ংক্রিয় লেখনিতে ধরা পড়ে—

১৯৩৪-এর মনোরম আধো-আলোর মধ্যে

বাতাস ছিল সাড়ম্বর গোলাপ ছিল লাল ফুলের মতো রং

এবং বন যখন আমি প্রবেশ করতে প্রস্তুত

শুরু করেছে এক বৃক্ষ দিয়ে, পর্ণ যার সিগারেটের পাতা

তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি...

 

La Clé des Champs গ্রন্থের ভূমিকায় ব্রতোঁ ব্যবহার করেছেন Le Merveilleux contre le Mystère, অর্থাৎ ‘আশ্চর্য’র সঙ্গে রহস্যের বিরোধিতা আছে; রহস্য বাস্তব নয়, মানুষের অজ্ঞতাজনিত কল্পনা। ‘আশ্চর্য’র সঙ্গে আছে বিস্মিত হওয়ার উপাদান। বাস্তবতার পরিচয় আবিষ্কারের পর মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। সুতরাং আশ্চর্যের অন্বেষণ রহস্যময় নয়, বরং মিস্টিসিজম-এর উপাদান আছে, যা কবির সঙ্গে সংপৃক্ত, দার্শনিকের সঙ্গে নয়। দার্শনিক বের্গসন এক মনের সংজ্ঞা দিতে চেয়েছিলেন যা যুক্তির নিয়ম মানে না; তিনি তাকে বলেছিলেন স্বজ্ঞা বা ইনটুইশন; আর ব্রতোঁ কবিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকে বলেছেন কল্পনা।          

 

ছবিঃ ক্ষীরোদবিহারী ঘোষ

তবে ব্যক্তিমানুষের জীবনকে শুধুমাত্র সৃষ্টিশীল কল্পনার সামর্থ্য দিয়ে পরিবর্তনের কথা ভাবেননি ব্রতোঁ, রাষ্ট্র ও সমাজকে সমাজতন্ত্রের চিন্তা দিয়ে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মনে হয়েছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন এই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর উপায়। ১৯৩০ সাল থেকে ব্রতোঁর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ এবং এই সংযোগ ফরাসি স্যুররেয়ালিস্তদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। এতদিন যাঁরা স্যুররেয়ালিসম-এর নন্দনতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভাবনায় আস্থা রেখেছেন তাঁরা বিশ্বাস করতে চাননি যে জীবন সম্পর্কে ধারণা রাষ্ট্র ও সমাজের বস্তুজগৎকে বদলে দিতে পারে। স্যুররেয়ালিস্তদের রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার এই  বিরোধিতাকে ব্রতোঁ দেখলেন স্যুররেয়ালিসম-এর প্রতি তাঁদের অপর্যাপ্ত আনুগত্যের ইঙ্গিত হিসেবে। অপরদিকে, যাঁরা বিরোধিতা করলেন তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণকারী চরিত্র, তার শ্বাসরোধকারী নিয়মানুবর্তিতা এবং শিল্পকর্মের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করলেন। বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রতোঁ তাঁর বিশ্বাস থেকে নিজেকে বিচ্যুত করতে চাননি। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ Ode to Charles Fourier তাঁর এই বিশ্বাসের পরিচয় বহন করছে। এই কবিতাগুলোতে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। 

ব্রতোঁর আর একটি বিশ্বাসের জায়গা ছিল প্রেমের পরিবর্তনকারী ভূমিকায়। কল্পনাশক্তির মতো প্রেমের ক্ষমতার প্রতি এই বিশ্বাস অন্য স্যুররেয়ালিস্ত কবিদেরও ছিল। ব্রতোঁর ধারণা, রোম্যান্টিক প্রেমের মধ্য দিয়েই মানুষ পার্থিব পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে পরাবাস্তবতার সীমাহীন অনন্ত জগতের দৃঢ় মেলবন্ধন ঘটাতে পারে। তাঁর অনেক কবিতাতেই এই অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। ধারণাটি তাঁর প্রেমের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মূলত দুটি আকারে। প্রথমটি হল নারীকে গ্রিক পুরাণের দেবী ‘মিয়ুজ’ হিসেবে দেখা—প্রিয় নারী পরাবাস্তবের সঙ্গে সংযোগের সূত্র হয়ে ওঠেন, যেমন ব্রতোঁর বহুপঠিত দুটি কবিতা—Catalogue poème Free Union—প্রেমিকা ও কলূষমুক্ত প্রকৃতির জগতের মধ্যে জাদুকরি সম্পর্কের উদযাপন। Free Union দীর্ঘ কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে

আমার স্ত্রীর আছে কাঠের আগুনের চুল

তার আছে বিদ্যুৎ উত্তাপের মতো ভাবনা

আওয়ারগ্লাসের কটি

তার কটি বাঘের দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা ভোঁদড়ের

গোলাপ আকৃতি মুখ তার আর একগুচ্ছ নক্ষত্র ...

                                                           

আর Fata Morgana-তে দেখা যায় নতুন প্রেমের আবিষ্কারে কবির আনন্দপূর্ণ উদ্দীপন। দ্বিতীয় রীতি হল প্রেমের জাদুকরি শক্তির প্রতি এই বিশ্বাস যে কাব্যসৃষ্টির সঙ্গে যৌনপ্রেমকে সমদৃষ্টিতে দেখা, যেমন Sur la route de San Romano (সান রোমানোর রাস্তায়)—

কবিতা সৃষ্ট হয় বিছানায় প্রেমের মতন

তার এলোমেলো চাদরেরা হল নতুনের ভোর

 

আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি যে ব্রতোঁর প্রেমের কবিতায় অটোমেটিক রাইটিং-এর প্রভাব। তাঁর এই ধরনের কবিতায় ‘ইরোটিক’ বিষয়ও তাঁর কাব্যিকতার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। তাঁর কবিতায় শরীরী বর্ণনাতে মিশে আছে কাব্যিক ফ্যান্টাসির উপাদান। এক অবাস্তব রূপকথার পরিবেশ জড়িয়ে থাকে এই প্রেমের কবিতাগুলোতে। স্বপ্নাকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে আসে শরীরী উপাদান—

স্বপ্নে দেখি তুমি নিজেকে নিজের ওপর স্থাপন করে রেখেছ অনির্দিষ্টকাল

নিজেকে বসিয়ে রেখেছ প্রবাল-আসনে

তোমার আয়নার সামনে তুমি

চিরুনির জলের অংশে আছে তোমার দু’আঙুল

...

আমার আদর যাকিছু শুধুই তুমি

তোমার সবকিছু, এখনো যা হয়ে ওঠেনি

                                                        (Poèmes, ১৯৪৮ থেকে)

 

 ব্রতোঁর কবিতার আলোচিত তিনটি চিন্তাস্তর প্রভাবিত করেছে স্যুররেয়ালিস্ত কবি ও লেখকদের। তিনি নিজেও পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্বস্ত থেকেছেন নিজের ভাবনায়। ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলেও যে ধারণা তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন চিন্তায়, ইস্তাহারে, ও নিজের কবিতায়, তা এখনও সক্রিয় থেকে বিশ্বকবিতাকে আচ্ছন্ন ও  প্রভাবিত করে রেখেছে। 


[ লেখকের কর্পোরেট বায়োডাটা হয় না । লেখকের পরিচয় জন্মসাল-মৃত্যুদিনের উৎসব পালনে নেই । লেখক বেঁচে থাকেন স্রেফ লেখায় । সৈয়দ কওসর জামাল, একজন দাপুটে বাঙালি কবিপ্রাবন্ধিকঅনুবাদক ও সম্প্রচারক। আছে ১০ টি প্রকাশিত কবিতার বই এবং কবিতা সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধের সংকলন । শত শত সাহিত্য প্রবন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

পেয়েছেন, ১৯৯৫ সালে আশালতা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার । সোপন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে, কবিতা গ্রন্থ 'চেরনোবিলার মেঘএর জন্য ।]


সৈয়দ কওসর জামালের বইগুলি পড়ুন,






No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.