Friday, February 12, 2021

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সব তথ্যপ্রমাণ সাজানো : ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বিস্ফোরক ওয়াশিংটন পোস্ট

লিখেছেন শোভনলাল চক্রবর্তী 

শিল্পীঃ মলিয়ার ডিমানচে (উৎসঃ দ্য কনভার্সেশন পত্রিকা)


২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুনের শনিবারওয়াড়ায় ভীমা কোরেগাঁওয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এলগার পরিষদের সম্মেলন চলছিল। ওই সম্মেলন চলাকালীন বক্তৃতা করেছিলেন ভারাভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, রোনা উইলসন প্রমুখ আদিবাসী, দলিত ও নিপীড়িত মানুষের কাছের মানুষেরা। পরের দিন, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবজাগর প্রতিষ্ঠান ও হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির উস্কানিতে ও প্ররোচনায় সেখানে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে ও একজনের মৃত্যু হয়। এরপর পুলিশ এই দুটি সংগঠনের বিরুদ্ধে এফআইর করে। এরপরই চালচিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং ভীমা কোরেগাঁও মামলায় পুলিশ একে একে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে দশজন বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের, পুলিশ যাঁদের চিহ্নিত করেন 'শহুরে মাওবাদী' হিসেবে, কিন্তু এফআইআর-এ যাদের নাম ছিল না। এরপর খেলা আরও জমে ওঠে।মুম্বাই, দিল্লি, নাগপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও পাঁচজনকে। কয়েকঘন্টার মধ্যে মহারাষ্ট্র পুলিশ একটি ই-মেল বার্তার ফটোকপি পৌঁছে দেয় বাছাই করা কিছু সাংবাদিক ও দিল্লিতে শাসক দলের সদর দপ্তরে।বলা হয় ই-মেল বার্তাটি পাওয়া গেছে গ্রেপ্তার হওয়া একজনের কম্পিউটার থেকে।কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেশের প্রতিটি নাগরিক জেনে গেলেন, মহারাষ্ট্র পুলিশের তৎপরতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ভীমা মামলার মূল কুচক্রী 'শহুরে মাওবাদী' পাঁচ শীর্ষ নেতা নেত্রী, সোমা সেন, রোনা উইলসন, মহেশ রাউত, সুধীর ধাওলে এবং সুরেন্দ্র গ্যাডলিং। এখানেই শেষ নয়, পরের দিন জানা গেল প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন মাওবাদীরা! এবং এক মাসের মধ্যে আর একটি ই-মেলের প্রতিলিপি পুলিশ পৌঁছে দিল নির্দিষ্ট একটি টিভি চ্যানেলের দপ্তরে।গ্রেপ্তার হলেন সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ পেরেরা, গৌতম নওলখা ও ভারাভারা রাও। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে এদের নিক্ষেপ করা হল জেলে। এরপর ২০১৯ সালে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করে, অভিযুক্ত সমাজকর্মীদের সাহায্য করতে চাইছেন, এমন কয়েকজনের ই-মেলে 'নেটওয়্যার'-এর মতো ম্যালওয়্যার পাঠানো হচ্ছে। এমনেস্টি-র আরও দাবি ছিল, সমাজকর্মীদের পক্ষে সওয়াল করা কয়েকজনকে এনএসও গ্ৰুপের 'পেগাসাস স্পাইওয়্যার' দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। এই সংস্থাটি শুধুমাত্র সরকারকেই তাদের স্পাই - টুল বিক্রি করে।সে ক্ষেত্রে সরকারকে প্রশ্ন করা হলে কোনও উত্তর পাওয়া যায় নি। কিন্তু সত্যের এমনই জোর, যে তা প্রকাশিত হয়ে তবেই ছাড়ে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল সেই সত্য, যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় চার বছর ধরে চলতে থাকা এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার গ্রেপ্তার হওয়া 'শহুরে মাওবাদী'রা। ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। অভিযুক্ত রোনা উইলসনের আইনজীবী তাঁর মক্কেলের ল্যাপটপের ডিজিটাল কপি খতিয়ে দেখার জন্য মার্কিন ডিজিটাল ফরেন্সিক ফার্ম 'আর্সেনাল কনসাল্টিং'-এর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। বিদেশের নানা হাই প্রোফাইল ঘটনার তদন্ত করে থাকে এই ফার্ম।তাঁদের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। রিপোর্ট-এ বলা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় কোনও ব্যক্তি ম্যালওয়ার ব্যবহার করে উইলসনের কম্পিউটার হ্যাক করে। আর তারপর সেখানে একটি লুকোনো ফোল্ডারে ১০টি চিঠি জমা করে। উইলসন গ্রেপ্তার হওয়ার পর  তাঁর ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার হওয়া এই দশটি চিঠিকেই চার্জশিটে তুলে ধরে পুলিশ। তাঁদের দাবি ছিল এই চিঠিগুলির মধ্যেই নাকি এক মাওবাদী নেতাকে অস্ত্র কেনার কথা বলেন উইলসন, এবং প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। আর্সেনাল কনসাল্টিং জানাচ্ছেন এই চিঠিগুলি ছিল এক গোপন ফোল্ডারে যা খুলেই দেখেননি উইলসন। এই সাইবার হামলার মূল কুচক্রীকে খুঁজে না পেলেও এটা পরিষ্কার যে একই সার্ভার এবং আইপি এড্রেস ব্যবহার করে বাকিদের ল্যাপটপ হ্যাক করা হয়েছে। আর্সেনাল জানিয়েছেন তাঁরা যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপের তদন্ত করেছেন তার মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। যে বিপুল সময় ও যতটা পরিকল্পিত ভাবে এই ঘটনা সাজানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। কি ভাবে হয়েছিল হ্যাকিং?২০১৬ সালে ভারাভারা রাওয়ের আকাউন্ট থেকে উইলসনের কাছে বেশ কিছু ই-মেল আসে। প্রতিটি মেলেই একটি বিশেষ ডকুমেন্ট খোলার কথা বলা হয়েছিল। আর্সেনাল কনসাল্টিং-এর মতে সে ই-মেলেই ছিল 'নেটওয়্যার'-এর লিঙ্ক। যে ম্যালওয়্যারের সাহায্যে উইলসনের ল্যাপটপের রিমোট একসেস নিয়েছিল আততায়ী। তাঁর পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে ব্রাউজিং এক্টিভিটি, সব কিছুর উপর চলেছিল নজরদারি। তারপর গোপন ফোল্ডার করে রাখা হয় চিঠিগুলো। এমনকি চিঠিগুলো ওয়ার্ডের যে নতুন ভার্সনে লেখা হয়েছিল , মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের সেই ভার্সন উইলসনের ল্যাপটপেই নেই। উইলসন যার খোঁজ পেলেননা পুলিশ তাঁর খোঁজ পেল কিভাবে? এই ভাবে আদাজল খেয়ে সমাজকর্মীদের পেছনে রাষ্ট্র লাগাতার ভাবে কাজ করে গেছে, এমনটা শেষ কবে দেখেছে বিশ্ব? আসলে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। তাঁদের লক্ষ্য , যাঁরা নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের সামনের সারিতে, তাঁদের 'অপরাধী' তকমা দিয়ে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করা।তাই এঁদের বিরুদ্ধে রচিত হয় দীর্ঘমেয়াদি ফাঁসানোর পরিকল্পনা। সরকারি মদতেই যে এসব হয় তা এমেনেস্টির রিপোর্টে পরিস্কার ইঙ্গিত করা হয়েছে।ভয় হয়, এরপর দেশদ্রোহীর খোঁজ শুরু হলে, ঠগ বাছতে না গাঁ উজাড় হয়ে যায়।দেশের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে যখন নির্লজ্জের মত দেশের অন্নদাতা কৃষকদের 'পরজীবী' বলছেন। কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিকে যাঁরা সমর্থন করছেন তাঁদের 'আন্দোলনজীবী' বলছেন, তখন তিনি নিজে যে একজন হীন 'কুচক্রীজীবী' সেটা তাঁকে অবিলম্বে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। কৃষকদের এরপর তিনি যদি 'দেশদ্রোহী' বলে বসেন তবে সারা দুনিয়া বিস্মিত হলেও, সেটাই হয়ত হবে প্রধানমন্ত্রীর মন কি বাত! দলিত, নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গ দিলে যদি দেশদ্রোহী আখ্যা মেলে, তবে তেমন দেশদ্রোহীর আমাদের দেশে অভাব হবে না। পরিশেষে জানিয়ে রাখি ,ভীমা কোরাগাঁও মামলায় পুলিশ যে দুটি হিন্দু সংগঠনের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল, তার মধ্যে একটি সংগঠনের প্রধান এক রাতের জন্য জেলে ছিলেন। অন্য সংগঠনের প্রধান আজও দলিতদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রচার করে চলেছেন, পুলিশের খাতায় তিনি আত্মগোপন করে আছেন। বোঝা যাচ্ছে আজকের ভারতে আত্মগোপন একরকমের আত্মনির্ভরতা!



[ শোভনলাল চক্রবর্তী শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন । তবে এসবই বাইরের কথা । অন্তরের পর্দার আড়ালে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ক্ষুরধার ও গভীর জ্ঞানবত্তার নির্যাস যা কেবলমাত্র কলমের মাধ্যমে নিজেকে ইতিউতি প্রকাশিত করে । লিখে চলেছেন বহু দশক ধরে নানা সংবাদপত্রে, যেমন - The Statesman, The Telegraph, Asian Age, দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, প্রতিদিন, এইসময় ইত্যাদিতে এবং একইসঙ্গে বহু লিটিল ম্যাগাজিনের পাতা কৃতার্থ হয়েছে তাঁর লেখার সৌকর্যে । বিবক্ষিত পত্রিকায় তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ । তাঁর কলম দীর্ঘায়ু হলেই তা প্রাপ্তির পূর্ণতার একটি আপেক্ষকরূপে কাজ করতে সক্ষম হবে - এমনই প্রত্যাশা ]

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.