Wednesday, July 28, 2021

ডার্ক ম্যাটার নিয়ে আবার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠল

     লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

Source: Internet

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পিটার ভ্যান ডোখাম ও তাঁর সহকারীরা একটি বিশেষ গ্যালাক্সির উপর (যার সাংকেতিক নাম তাঁরা রেখেছেন এন জি সি১০৫২-ডি এফ-২) পরীক্ষা চালিয়ে একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছেন। তাঁদের পরীক্ষার  ফল অনুযায়ী ওই গ্যালাক্সিটিতে কোনও ডার্ক ম্যাটার নেই। বলাই বাহুল্য এই ফল হৈচৈ ফেলে দিয়েছে পৃথিবীর তাবর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে।ডার্ক ম্যাটার ঘিরে আবার উঠতে শুরু করেছে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে ডার্ক ম্যাটার এমন এক বস্তু যা সাধারণভাবে আমাদের পরিচিত যে সমস্ত কণা, যেমন, প্রোটন, নিউট্রন বা ইলেকট্রন, সে সব দ্বারা গঠিত নয়। কি করে পাওয়া গেল এই ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান? গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতে ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যান উর্ত সর্বপ্রথম লক্ষ করেন যে গ্যালাক্সিগুলির তাদের নিজের অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরার বেগ প্রচন্ড বেশি। এই নিয়ে শুরু হয় সারা পৃথিবী জুড়ে গবেষণা। 

বিজ্ঞানীরা জানান যে গ্যালাক্সিগুলির যা ঘূর্ণন বেগ তাতে গ্যালাক্সির যে  নক্ষত্রগুলি ওই গ্যালাক্সির সঙ্গে ঘুরছে সেগুলির ছিটকে পড়ার কথা। কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না। নক্ষত্রগুলি যেহেতু দৃঢ় ভাবে আবদ্ধ, তাই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে আসেন যে এখানে নিউটন আবিষ্কৃত মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল অত্যন্ত বেশি। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় বাধা সাধল একটি তথ্য। কি সেই তথ্য? আমরা সবাই জানি যে নিউটনের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল ভরের সমানুপাতিক। গ্যালাক্সি থেকে যে আলো নির্গত হচ্ছে সেই আলোর সাহায্যে মাপা হয় গ্যালাক্সির ভর। সেই ভর মেপে দেখা গেল যে সেই ভর ওই পরিমান আকর্ষণ বল তৈরি করতে সক্ষম নয়। ১৯৩৩ সালে এই সমস্যার সমাধান করলেন সুইস-আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জ্বইকি। তিনি হিসেব করে বললেন গ্যালাক্সির আপাত ভরের চেয়ে প্রকৃত ভর অনেক বেশি। কত বেশি? সেটাই ওই গ্যালাক্সিতে উপস্থিত ডার্ক ম্যাটারের পরিমান। অজ্ঞাতপরিচয় ওই ভর নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত নানা হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে যে পরিচিত পদার্থ বিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ অধিকার করে আছে, বাকি ৯৬ শতাংশ পদার্থ বা শক্তি এখনও বিজ্ঞানীরা চিনে উঠতে পারেননি। এই ৯৬ শতাংশের মধ্যে ডার্ক ম্যাটার অধিকার করে আছে ২৩ শতাংশ, বাকি  ৭৩ শতাংশ ডার্ক এনার্জি, যার প্রকৃত স্বরূপ এখনও পর্যন্ত অজানা রয়ে গেছে। ডার্ক ম্যাটার কিভাবে শনাক্ত হল তা আমরা জানলাম। কিন্তু ডার্ক এনার্জি কিভাবে শনাক্ত হল? ডার্ক এনার্জির সূত্রপাত হয়েছিল আইনস্টাইনের হাত ধরে। আইনস্টাইন নিজে ছিলেন স্থিতিশীল বিশ্বের ধারণার স্বপক্ষে। 

অর্থাৎ, বিশ্ব বাড়ছেও না বা ছোট হয়েও আসছে না। কিন্তু তাঁর নিজের হাতে তৈরি সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব গাণিতিক ভাবে প্রমান করলো যে হয় বিশ্বকে প্রসারণশীল হতে হবে অথবা হতে হবে সঙ্কোচনশীল। এমন একটি অভূতপূর্ব গাণিতিক সমস্যার সমাধানে আইনস্টাইন ধরে নিলেন যে সঙ্কোচনের বিরুদ্ধে কাজ করছে একটি প্রসারণ বল।অর্থাৎ, ব্যাপারটা সেই স্থিতিশীল হয়েই রইলো। এর জন্য খানিকটা গোঁজামিল করেই তাঁর গাণিতিক সমীকরণে আইনস্টাইন ঢুকিয়ে দিলেন একটি ধ্রুবক, যার নাম দিলেন কসমোলজিক্যাল কনস্টান্ট। ১৯২০-র দশকে বেশ কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী যেমন, এডউইন হাবল, রবার্টসন-ওয়াকার'রা যখন ডপলার ক্রিয়া(এই ক্রিয়া অনুযায়ী একটি আলোর উৎস দর্শক থেকে যত দূরে চলে যাবে ততই ওই উৎস থেকে যে রঙের আলো নির্গত হবে তা দর্শকের কাছে রামধনুর সাতটি রঙের মধ্যে ক্রমশ বেগুনি থেকে লালের দিকে সরতে থাকবে। একে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন, "রেড শিফট") কাজে লাগিয়ে প্রমান করলেন যে বিশ্ব প্রসারণশীল, তখন আইনস্টাইন মেনে নিলেন যে ওই ধ্রুবক তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ! বিশ্ব প্রসারণশীল এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে এই বিশ্বের অসংখ্য গ্যালাক্সি একে অপরকে আকর্ষণ করছে। এর প্রভাবে বিশ্বের প্রসারণের হার ক্রমশ কমে আসার কথা। প্রসারণের হার কি হারে কমছে তা পরিমাপ করার একটি পরীক্ষা পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা তৈরি করেন , এবং দুটি আলাদা দলে বিভাজিত হয়ে তাঁরা পরীক্ষাটি সম্পাদন করেন। 

Source: Internet


ওই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। এই পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের তিনজন পরবর্তীকালে (২০১১ সালে) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই পরীক্ষা। পরীক্ষার ফল নিয়ে আলোচনার আগে  সেই তিনজনের নাম আমরা একবার দেখেনি  যাঁদের যুগান্তকারী পরীক্ষা আরও একবার প্রমান করেছিল আইনস্টাইনের সমীকরণের সত্যতা এবং সর্বোপরি উন্মোচিত করেছিল বিজ্ঞানের এক নতুন শক্তিকে। তাঁরা ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সল পালমুটার, অস্ট্রেলিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রায়ান স্মিট  ও বাল্টিমোরের জন হপকিন্স ল্যাবরেটরির এডাম রেস।তাঁদের পরীক্ষার ফল নিয়ে শোরগোল পরে যায় বিজ্ঞানের জগতে। দুই দলের পরীক্ষাতেই দেখা যায় যে বিশ্বের প্রসারণের হার কমছে না উল্টে বাড়ছে! তাহলে তো দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণে কসমলজিক্যাল কনস্টান্ট ঢুকিয়ে ঠিক কাজই করেছিলেন। বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এলেন,  যে শক্তি বিশ্বের প্রসারণের হারকে বাড়াচ্ছে, সেটাই ওই ডার্ক এনার্জি। বর্তমানে এন জি সি১০৫২-ডি এফ-২ গালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটারের অনুপস্থিতি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নতুন করে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত গালাক্সিতে যা রয়েছে তা ওই গালাক্সিতে নেই কেন? তবে কি পিটার ডোখাম ও তার সহকর্মীরা যে পরীক্ষা চালিয়েছেন তাতে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে ? এব্যাপারে ডোখাম ও তাঁর সহকর্মীরা দীর্ঘ বিবৃতি সহযোগে জানিয়েছেন যে এমন একটি আশ্চর্য ফলাফল আসার কারণে তাঁরা পরীক্ষাটি বারবার করেছেন, এবং প্রতিবার একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এমনকি তাঁরা আহবান জানিয়েছেন অন্যান্যদের পরীক্ষাটি করে দেখার জন্য। এত কিছু করেও কিন্তু ফলাফলের কোনও বদল ঘটেনি।অতঃপর, সন্দেহের তির ধাবিত হয়েছে নতুন তত্ত্ব মডিফায়েড গ্রাভিটি -র (পরিবর্তিত মহাকর্ষ) দিকে।এই তত্ত্ব অনুযায়ী একটি নতুন বল, বা পদার্থবিজ্ঞানের চারটি বল- স্ট্রং ফোর্স, উইক ফোর্স, ইলেক্ট্র-ম্যাগনেটিক ফোর্স ও গ্রাভিটেশন ফোর্স -এর পর একটি নতুন পঞ্চম বল দিয়ে নিউটনের আকর্ষণ বলকে সংশোধিত করতে হবে। অর্থাৎ ডার্ক ম্যাটারের বদলে নিউটনের মহাকর্ষ বলের ফর্মুলার অদলবদল ঘটানো। 

এখানে বলে রাখা দরকার যে একদল বিজ্ঞানী বহুদিন যাবৎ এই দাবি গাণিতিক প্রমান সহযোগে করে আসছেন যে নিউটনের মহাকর্ষের ফর্মুলায় অদলবদল ঘটালে ডার্ক ম্যাটারের সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু নিউটনের ফর্মুলা এমনই সর্বত্রগামী যে দু'এক জায়গায় তার এদিক ওদিক, প্রথমত, হওয়ার কথা নয়, আর দ্বিতীয়ত, সেটা হলেও, ফর্মুলা বদলে ফেলাটা কোনও কাজের কথা হবে না। স্বাভাবিক ভাবেই মডিফায়েড গ্রাভিটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা তেমন একটা উৎসাহী নন। এখানে ডোখাম ওই গালাক্সিতে ডার্ক ম্যাটার না থাকার কারণ হিসেবে একটি ব্যাখ্যা সামনে এনেছেন, যার ওপর জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ডোখাম ও তাঁর সহযোগীদের মতে এই গ্যালাক্সিটি গঠিত হয়েছে সাধারণ ভাবে গ্যালাক্সি যেভাবে গঠিত হয়, সেই ভাবে নয়। এই গঠন প্রক্রিয়ায় পার্থক্যের কারণেই গ্যালাক্সিতে কোনও ডার্ক ম্যাটার নেই। আপাতত, সেই পথেই শুরু হয়েছে কারণ অনুসন্ধান। ডার্ক ম্যাটারের অনুপস্থিতি কোন অজানাকে সামনে নিয়ে আসতে চলেছে, তার উত্তর একমাত্র সময়ই দিতে পারবে। আমরা তার অপেক্ষায় থাকব।


শোভনলাল চক্রবর্তী



No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.