Wednesday, July 21, 2021

এবারের অলিম্পিক গেমস কাদের স্বার্থে, কাদের জন্য?

    লিখেছেন 

শো ভ ন লা ল   চ ক্র ব র্তী

Source: Google Images(Internet)


করোনা অতিমারীর কারণে ২০২০'র অলিম্পিক গেমস পিছিয়ে আনা হয় ২০২১-এ। আগামী ২৩ জুলাই  তারিখে জাপানের টোকিও শহরে এই গেমসের উদ্বোধন হবে। অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে গোটা  জাপানের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।কিন্তু জাপান সরকার তা মানতে রাজি হয়নি। করোনা পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে নিজেদের দেশে অলিম্পিকের আসর বসাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। জাপানের প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, অলিম্পিক গেমস জাপানেই হবে। অলিম্পিক শুরু হতে বাকি আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন।

তার আগেই অলিম্পিকের আয়োজন নিয়ে কালো মেঘ দেখা দিয়েছে জাপানে। কারণ করোনার দাপট দ্রুত বাড়ছে জাপানে, অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যে করোনার তৃতীয় ঢেউ জাপানে ঢুকে পড়েছে।গেমস ভিলেজে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন খেলোয়াড়রা। জাপান সরকার গত ৭ জুলাই তারিখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে অলিম্পিক চলাকালীন, ২২ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে চলবে করোনা ইমার্জেন্সি। ইমার্জেন্সির মধ্যে গেমস কিভাবে চলবে সেই নিয়ে মাথায় হাত পড়েছে আয়োজকদের। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে এক বার্তায় জানিয়েছেন জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ,এই মাসগুলোতে সবাইকে বাড়তি সাবধানতা নিতে হবে।করোনার কথা মাথায় রেখেই এবার অলিম্পিক গেমস দর্শক শূন্য আসনে করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এর আগে ঠিক হয়েছিল পঞ্চাশ শতাংশ সমর্থকদের মাঠে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ হতে থাকায় সরকারের তরফে সেই সিদ্ধান্ত খারিজ করা হয়। এই কঠিন পরিস্থিতিতে জাপান সরকার দেশ বিদেশ থেকে আগত খেলোয়াড়দের কতটা সুরক্ষা দিতে পারবেন তা নিয়ে উঠেছে গুরুতর প্রশ্নচিন্হ। খেলোয়াড়দের জন্য থাকবে সুরক্ষা বলয়, কিন্তু সেই বলয় ভেদ করে যে করোনা প্রবেশ করতে পারবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছেন না। একেবারে শুরুর দিকে করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যখন বিশ্বের অনেক দেশ রীতিমত যুদ্ধ করছিল তখন জাপান তা সামাল দিয়েছিল ভালোভাবে। তবে জাপানের টিকা প্রদানের হার ছিল কম, এবং পরের দিকে দেশের কিছু কিছু অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙে পড়ে। 

এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গেমসের আয়োজনের বিপক্ষে মত দেন।স্টেডিয়ামের ভিতর দর্শক প্রবেশের অনুমতি তাঁরা দেননি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শতকরা ৭০ জন মনে করেন করোনার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে অলিম্পিক গেমসের আয়োজন এক কথায় অসম্ভব। যে শতকরা ৩০ জন অলিম্পিকের পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁরা মনে করেছেন অর্থনীতির স্বার্থে এই গেমস হলেও নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলে তা একেবারেই হওয়া উচিত নয়। অলিম্পিক গেমসকে বলা হয়, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ - সেখানে অর্থনীতির যোগ থাকবে না, এ হওয়া সম্ভব নয়। ২০২০ সালের জাপানে অলিম্পিক গেমসের বাজেট ছিল ১২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেটাই এখন বেড়ে হয়েছে ১৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আজ যদি জাপান গেমস বাতিল করে তবে তাদের যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তার পরিমান প্রায় ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাপানের মুদ্রা ইয়েনে যার পরিমান প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন। বোঝাই যাচ্ছে যে জাপান একপ্রকার নিরুপায় হয়ে গেমসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিপূর্বে গেমস হওয়া নিয়ে জাপানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির একপ্রস্থ বাক বিতণ্ডা হয়ে গেছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন গেমসের সঙ্গে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকবেন তাঁদের টিকাকরণ সম্পুর্ন করতে, কিন্তু এখন প্রতিদিন ১ মিলিয়ন করে টিকা দিলেও সেটা সম্ভব নয়।টোকিও অলিম্পিকের যে চুক্তি ২০১৩ সালে সই হয়েছিল তাতে স্পষ্ট করে বলা আছে যে গেমস যদি বাতিল করতে হয় তবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকারী আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। তবে অতিমারী অবস্থায় অলিম্পিক বাতিল করার অধিকার জাপানের রয়েছে, কারণ ২০১৩ সালের চুক্তিপত্রে যাঁরা সই করেছিলেন, তাঁরা আজ জাপানের পরিচলন সমিতিতে নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও জাপান সরকারের মধ্যে লেগে যাবে এক বিশ্রী আইনি লড়াই, যা দুই পক্ষেরই মুখ পোড়াবে। জাপানের উপর গেমস করার জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বিপুল চাপ, কারণ কমিটির পকেটে ঢুকবে মোট আয়ের ৭৩% শুধু এই গেমসের সম্প্রচারণ স্বত্ব থেকে। অন্যদিকে জাপান অনেকটা লোকসানে। কারণ টিকিট বিক্রি থেকে কোনও আয় হবে না, তার চেয়েও বড় কথা যে সারা পৃথিবী থেকে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ খেলা দেখতে আসতেন তাদের থেকে একটা মোটা টাকা আয় হত জাপান সরকারের। যেমন ২০১৯এ জাপানে এসেছিলেন ৩১.৯ মিলিয়ন পর্যটক যাঁরা খরচ করেছিলেন জাপানি মুদ্রায় ৪.৮ ট্রিলিয়ন ইয়েন, প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার পুরোটাই আপাতত জলে। 

এবার একটু দেখা যাক কাদের জন্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি এবং জাপান সরকার শত বাধা বিপত্তি প্রতিরোধ সত্ত্বেও, দেশের মানুষ এবং বিদেশ থেকে আগত খেলোয়াড়দের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কেন এই গেমস এগিয়ে নিয়ে যেতে তৎপর। কারণ একটাই, স্পনসরদের লগ্নি এবং কর্পোরেট পুঁজির বাধ্যবাধকতা। জাপানের ৬০টিরও বেশি কোম্পানি প্রথমে ২০২০র গেমসের জন্য ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার স্পনসর বাবদ খরচ করে। গেমস ২০২১এ হওয়ার সময় স্পন্সরদের লগ্নি আরও ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পায়। এই টাকা নিশ্চয় কোম্পানিগুলি জলছত্র খোলার কাজে দেয়নি, এর বিনিময়ে তাঁদের চাই "রিটার্ন", মানুষ মরলো কি বাঁচলো তাতে এঁদের কিছুই এসে যায় না।তাই বাধ্য হয়েই সবাইকে গলা মেলাতে হয় "দ্য শো মাস্ট গো অন" বলে। আরও আছে, এই স্পনসরদের টাকার বাইরেও আছে একদল "টপ টায়ার" স্পনসর, যাঁরা কত টাকা দেবেন সেটা জানবে শুধু অলিম্পিক কমিটি। বর্তমান অলিম্পিক গেমসের "টপ টায়ার" কোম্পানিগুলি হল টয়োটা, প্যানাসনিক, ব্রিজস্টোন এবং সামসুং। এঁরা কত টাকা দিচ্ছেন সেটা জানা না গেলেও, এঁরা হুমকি দিয়েছেন অলিম্পিক কমিটিকে যে গেমস যেন কোনও মতেই বাতিল না হয়। 

অলিম্পিক কমিটি জানিয়েছেন গেমস বাতিল হলে তাঁদের "টপ টায়ার" স্পনসরদের ক্ষতিপূরণ মেটাতে কমিটি দেউলিয়া হয়ে যাবে।এই স্পনসরদের বাইরেও থাকছে যে সব শহরে খেলা হবে সেখানকার স্থানীয় স্পনসররা যাঁদের টাকার মূল্যে মোট স্পনসর প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এদের বাইরেও থাকছে সম্প্রচারণের জন্য মার্কিন কোম্পানি এন বি সি উইনিভার্সালের ১.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ। অলিম্পিক এই অবস্থায় যদি হয়, তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন জাপানের জিডিপি সামান্য হলেও বাড়তে পারে। তাই কর্পোরেট বিনিয়োগ এবং তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে জাপান নিমরাজি হয়ে গেমস শুরুর সবুজ সংকেত দিয়েছে। এখন ভয় একটাই কর্পোরেট স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে অলিম্পিক যদি করোনার "সুপার স্প্রেডার" হয়ে দাঁড়ায়, তখন ওই কর্পোরেটরা দায়িত্ব নেবেন তো? মনে তো হয়না। তবে তেমন অবস্থার জন্য মোটা টাকার ব্যবসা ফেঁদে জাপানে বসে আছেন দেশ বিদেশের বীমা কোম্পানিগুলি।অগ্নিমূল্য হারে তাঁরা বীমা করেছেন, গেমসের সঙ্গে সংযুক্ত সকলের। সেই টাকার অঙ্কের কোনও হিসেব নেই। ১৮৯৪ সালে যে অলিম্পিক কমিটি তৈরি হয়েছিল খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে আজ সেখানে শুধুই টাকার গন্ধ , কর্পোরেট পুঁজির ভ্রাতৃত্ব।


শোভনলাল চক্রবর্তী





No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.