Friday, May 21, 2021

নাসেরের কবিতার স্বাদ-আস্বাদন

 লিখেছে

উ জ্জ্ব ল  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য় 

ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত

যে-লেখা প্রকাশিত হয় তা সকলের জন্যে তার গোপনীয়তা থাকে না আর তা পাঠ করে যে-ভাবনা দানা বাঁধে তার আনন্দ একা-একা ভোগ না করে অংশভাগের ইচ্ছাটাও কোনো ধৃষ্টতা নয় সে-কারণে গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো করার মতোই নাসেরের কবিতায় এই নাসের বন্দনা পাঠকের মনোযোগ পেলে বাধিত হব

ডাক

খুব সহজ-সরল করে, খুব পরিচিত শব্দবন্ধে কবি নাসের প্রকাশ করেছেন কাব্যিক ব্যঞ্জনা আসলে কবিতার শব্দবন্ধ যাই হোক না কেন, বাক্যবন্ধে যতই চমক থাকুক না কেন, নির্মাণ বা গঠনগত বৈচিত্রে যতই মুনশিয়ানা থাকুক না কেন, তার আবেদন অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে সেই দুর্লভ বিষয়টি হলো তার ব্যঞ্জনা দুর্লভ বলছি এই কারণেই যে ব্যঞ্জনা তৈরি করা যায় না - তা ব্যঞ্জিত হয় তাই তার সহজলভ্যতা নেই এখানে কবি পশ্চিমাকাশের অস্তমিত সূর্যের বিদায়লগ্নটিকে ধরতে চেয়েছেন খুব স্বল্প পরিসরে সে কেবল একটি সূর্যাস্তের বর্ণনা নয় যেখানে অস্ত-আসন্ন সূর্য ও পশ্চিমাকাশের লালিমা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয়ে হয়ে থাকছে না নিসর্গ থেকে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠতেই মানব জীবনের সর্বজনীন লীন-বেদনা কেমন সুন্দরভাবে ব্যক্তিক চেহারায় নৈর্ব্যক্তিলাভ করল, ‘এইবার কষ্ট শুরু হল প্রকৃত সে-কষ্টটা কীসের? কষ্ট ঠিক নয় - সারাদিনের ব্যস্ততার অবকাশে দেখা হয়নি যে-সব চিঠি তাদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখন গুরুত্ব মাফিক দরকারি হয়ে উঠবে, অথবা অদরকারি বলে তাকে ছিঁড়ে ফেলা হবে প্রস্রবণ যেন জলীয়বাষ্প অথবা অশ্রুর সমার্থক যা উষ্ণতায় ভরে ওঠে না, কৃতজ্ঞতা আরও আর্দ্র হয়তা উষ্ণতায় উবে যায় - বাষ্পীয় হয় এক ধরনের বেদনাবোধ, শূন্যতা, এক ধরনের মেলানকলি সময় এখানে কিছু জ্ঞাপন করে প্রত্যক্ষতসময়জ্ঞাপক ঘড়ির অস্তিত্ব দিয়ে ভালোবাসা-প্রেম-বিরহ খুব নতুন শব্দ নয় তাও তার ব্যবহারে কবি বেশ সপ্রতিভ ঘড়ি কি ভালবাসার তড়িঘড়ি দ্রুততার পরিমাপক শব্দ? হতে পারে তবু তার ব্যাখ্যা নিয়ে কবিতার বোধে কোন অসুবিধা ঘটায় না আর কবির সেই ভালবাসার গভীর প্যাশন আক্রোশ হয়ে ধরা পড়ে, যদিও আক্রোশ এখানে পাঠকের অপছন্দের শব্দ হতেও পারে কবির মনোগত শবব্যবচ্ছেদ এই অংশটিকে ইন্দ্রিয়ঘন, শরীরী করে তুলেছে মুহূর্তের নিসর্গ - চলে যাওয়ার শেষ যন্ত্রণাটুকু যেন টেনে বের করে আনল কবির মনোজগতের ক্যানভাসে লেগে গেল বিদায়ের বিষন্ন রঙ প্রতিদিন ওই একই বিদায়-বিষন্নতা, প্রতিদিন ওই একই চলে যাওয়া, প্রতিদিনই স্মরণের, মরণের নির্বাচনী রুটিন ব্যস্ততা কবির ব্যক্তিক অনুভূতি এখানেই যেন পাঠকের হৃদয়ে বিদায়-রাগের অনুভবি বিস্তার ঘটিয়ে দিয়েছে

সুসামঞ্জস্যময়

কবিতাটির প্রাথমিক পাঠ আমাকে অমিয় চক্রবর্তীর মেলাবেন তিনি, মেলাবেনকবিতার ভাবনায় টেনে নিয়ে গেল সেই দর্শনটি যেন অন্যভাবে পেলাম নাসেরের কবিতায় চারপাশের সবকিছুই যে মনোমতো হচ্ছে তা নয়, যা চাইছি তাই ঘটছে - তাও নয় একেবারে বেসুরেই যেন বাজছে তবু মৌলিক দর্শন বলছে যে সুরহীনতা বলে কিছু নেই যা আপাত বেসুরো তা আপাতই বটে যা সুরেলা নয় - তার থেকেই নতুন সুরের জন্ম হচ্ছে বলেই তা আর বেসুরো থাকল না সুর ছিল বলেই অন্য সুর জন্মায় এমন তো নয় - যে বেসুরোই সুর যাবতীয় বিশৃঙ্খলা, যাবতীয় অসুর-কুশ্রীতা, অসামঞ্জস্য বিপরীত প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক এক মহাসত্য এই কবিতায় নতুন করে উঠে এসেছে সংঘর্ষ বা বিরোধ থেকে যে-ক্ষয় তৈরি হয় তাই সঞ্চিত হতে-হতে আবার নতুন সৃষ্টিকে স্বাগত জানায় ধ্বংসটা শেষ কথা নয় তার ভেতরেই থাকে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ছে – ‘সৃষ্টির মনের কথা, মনে হয় দ্বেষ তাই অসামঞ্জস্য থাকবেই - তার ভেতর থেকেই উঠে আসবে নতুন সামঞ্জস্য রবীন্দ্রনাথও বলেছেনঃ শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্ন শেষ পরে, ওরা কাজ করে মনে পড়ে যাচ্ছে Thomas Hardy-এর কবিতা, ‘This will go onward the same, though dynasties pass’ অথবা ‘War’s annals will fade into the night, “Ere their story die”?’

নাসের তাঁর কবিতাকে গদ্যধর্মী করে রেখেছেননিছকই গদ্যিক অনেকটাই বিবৃতিমূলক যদি পরপর সাজানো যায় - ঠিক গদ্যরচনা যেভাবে সাজে ঠিক সেইভাবেই পদ্য রচনার দায় নিশ্চয়ই তাঁর নয় তবু এই কবিতাগুলো পড়ে, যে-কটি আমার হাতে এসেছে, আমার মনে হয়েছে যে অত্যন্ত গদ্যধর্মী তাঁর এই কবিতাগুলি তাই ক্লান্তিকর, বেশ ক্লান্তিকর দার্শনিকভাব, কাহিনিগতভাব নাসেরের কবিতায় অসম্ভব গুরুত্ব পায় প্রথাগতভাবে কবিতার স্নিগ্ধতা অলৌকিকত্ব তা এখানে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না জাহাজ কবিতায় সিন্ধবাদের কাহিনিটাই যেন পদ্যের বা কবিতার গাঠনিক কৌশলে সাজিয়ে পরিবেশন করা হল সেটা মুক্তগদ্যের ফরম্যাটে সাজালেই বা কী হত?

জাহাজ

জাহাজ যদি যদি কবিতা হয় (-বিষয়ে আমার কবিতার আলোচক হিসাবে কোন ব্যক্তিমত নেই - কেননা একজন লেখক কীভাবে তাঁর বক্তব্যকে উপস্থাপিত করবেন তা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় - কেবল মুদ্রিত অবস্থায় যখন তা সকল পাঠকের আস্বাদনের জন্যে উপস্থাপিত হবে তখন নানা অনুভূতির কথা তাঁকে শুনতে হবে) তাহলে সেই অলৌকিক ভাবনাটি আমরা খুঁজে খুঁজে পাবো না যা কিনা কবিতার কাঠামোয় একটা না-বলা বাণী পৌঁছে দেয় সিন্ধবাদ নাবিকের গল্প, দুর্ঘটনা, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত, সৌভাগ্য, ধনরত্নপ্রাপ্তি, প্রত্যাবর্তন - চোখের জল - আনন্দের মিলিত আবেগের মিশ্রণ গল্পটা আমাদের সকলেরই জানা আমরা কবিতা খুঁজছিলাম, গল্প নয় আসলে উনিশ শতক চলে যাবার পর আখ্যায়িকাকাব্য-মহাকাব্যের জগৎ শেষ করে দিয়েছিল গীতিকবিতা তারপর থেকেই ওই গীতিকবিতারই যুগ রবীন্দ্রনাথ পেরিয়ে জীবনানন্দে তার অন্য ঘনীভূত শরীর দেখল বাঙালি-পাঠক ছন্দটা কিন্তু হারালো না প্রবহমান যাপন হয়ে থেকে গেল অন্তর্লীন কাব্যিক ব্যঞ্জনা যে-কারণে মাটির শিল্পীদের পক্ষে আধুনিক গদ্য কবিতার আবৃত্তি সমানভাবেই জনপ্রিয় থেকে গেল কেবল তাকেও ভাঙার যে-প্রচেষ্টা শুরু হলো পাঁচের দশক থেকে - সেখানকার অহংকার যেন পড়তে পড়তে নাসেরে এসে বিবৃতি কবিতা হয়ে গেল এই কবিতায় কেবল অন্যের সমারোহ, ঘটনার ক্রমিক বিবরণ তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক কোনও অর্থেই কবিতা পেলাম না পদ্য পেলাম এর পাশাপাশি যখন আধুনিক কোন কাহিনিচিত্রে ততোধিক আধুনিক গান শুনছি, ‘এই জাহাজ মাস্তুল ছারখার, তবু গল্প লিখছি বাঁচবার’, যেখানেও ছন্দ পাচ্ছি - কোথাও যেন একটা দোলা অনুভব করছি জাহাজ নিয়ে নিতান্তই গদ্যধর্মী আলোচনায় আমি আলোচক হিসেবে একটু বিব্রত বোধ করছি

তিনি বলেছিলেন

কবিতা যখন জ্ঞানগর্ভবাণী প্রচার করে তখন তাকে কবিতা বলা যাবে কিনা এ-বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারলেও সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারব না ‘তিনি বলেছিলেন’ কবিতাটি সম্মাননীয় শ্রদ্ধেয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে কেন্দ্র করে লেখা ১২১ লাইনের কবিতা সাল ২০১৯, তারিখ ১৩ই নভেম্বর হল রচনাকাল সেখানে যে-উপদেশ দেওয়া হয়েছে, জীবনযাপন ও জীবনচর্চার যে-আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে, যে-সব আচরণীয় বা পালনীয় নীতি-নির্দেশ করা হয়েছে তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবসভ্যতার আদর্শ কল্পনা তো এইসব নবী-মনীষীরাই করে গেছেন নাসের অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে নিছক কথোপকথনের ভঙ্গিতে তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের মত পার্থিব কামবাসনা ও মোহে অন্ধদের জন্যে এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয় স্বর্গ কোথায়? মায়ের চরণে সবচেয়ে পুণ্যস্থান কোনটি? মায়ের চরণ নারী সম্মাননীয়া নারী-পুরুষ পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের ভেতর দিয়েই সম্মানিত হবে প্রত্যেকেই অনন্ত সম্ভবনা নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে প্রত্যেকের ভেতরে আছে মহানুভবতা তারা সকলেই আপন-আপন ধর্ম পালন করবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহিষ্ণুতার ভাব বজায় রাখতে হবে দান-ধ্যান করতে হবে, ইন্দ্রিয়সংযম অনুশীলন করতে হবে, শৈথিল্য - তা চারিত্রিক হোক বা নৈতিক ত্যাগ করতে হবে। লোভ-লালসা কামনা-বাসনাকে দমন করতে হবে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা, আক্রোশ দূর করতে হবে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, জাতিদাঙ্গা ও ভ্রাতৃদাঙ্গা থেকে দূরে থাকতে হবে

এইভাবেই নাসিরের কবিতায় সেই পরম পুরুষ ও পরমগ্রন্থেরই সারাৎসার উঠে এসেছে একেবারে গদ্যে লেখা নিছকই ধর্মবাণী এখানে কাব্যের ব্যঞ্জনা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন এই কবিতা লেখার যে-গভীর প্রয়োজন কবির মধ্যে এসেছিল, সেই বোধটাই একে মানবপ্রেমের জীবনরসে জারিত করেছে এভাবে বললেই যেন সঠিক বলা হয় আমি বলতেও চাই সেইভাবেই আজ পৃথিবীতে মানুষে-মানুষে যে সম্পর্কের অবনতি, সংকীর্ণ জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের যে-লড়াই চলছে, বৃহৎ শক্তির দাবিদারিত্বে যে-অস্থিরতা তৈরি হয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে - মানবাধিকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, সেখানে উপদেশ কতটা কার্যকরী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে জানি, Preaching can do nothingতবু মানুষের সদর্থক প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করতে উপদেশ এর প্রয়োজন আছে এই কবিতায় নাসের সেই পরিত্রাণের বাণী পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কেননা কবিরা পরিত্রাতাদেরই একজন, পথপ্রদর্শক, আলোকদিশারী সত্যের বাণী তো অমৃতময় বটেই নবীর মানবিক জীবনভাবনা, তাঁর মৈত্রীভাবনা, বিশ্বমানবাত্মার মর্যাদা রক্ষার স্বপ্ন যেন কবির লেখনীর মধ্যে দিয়ে মানুষের হৃদয় সজ্ঞাত হচ্ছে শুভভাবনা, মাঙ্গলিকভাবনা যে মাধ্যমেই আসুক না কেন - তার পৃথক মূল্য আছে সেই মূল্যের বিচারে এ-কবিতাও তাই সচেতনতভাবে সার্থক

কবিতার সমালোচনা মানে কবির দোষত্রুটি বের করা নয় ছিদ্রান্বেষণ নয় অভিভাবকত্ব ফলানো নয় তার চেয়ে অনেক কাজের হল - তা সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে আলোচ্য ক্ষেত্রে কতদূর ব্যাকরণসম্মত বা কতটা উত্তীর্ন তা দেখা ও দেখানো পাঠক নিজে যা বোঝেন তার সঙ্গে যদি অন্য পাঠকের সমালোচনার উদ্দেশ্য বোঝেন, তাহলে তা একটু মিলিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই কবিতার পাঠ অর্থগত দিক থেকে সম্পূর্ণ হয় সেই চেষ্টাই করেছি তবু ভরিল না চিত্ত কবিতার যে-ন্যূনতম ব্যাকরণ সূত্রগুলি থাকে তা আমার পঠিত, যদিও শেষ রচনাটিতে তার তত পাইনি তবে তা আমারই দুর্ভাগ্য বটে পরবর্তীতে তাই আরও নাসের পাঠ করার ইচ্ছে থাকল

পুনশ্চঃ নাসেরের আরেকটি কবিতা নিয়ে দু-চার কথা

‘দেশ’-এর কবিতা সংকলন(১৯৮৩-২০০৭) ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলাম নাসের হোসেনের কবিতা ভারতবর্ষ’, একটি রূপকধর্মী কাহিনিপ্রবণ, সহজ-সরল কবিতা দুই ভবঘুরের গল্পটিতে নাটকীয় চমক আছে আছে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ-রসিকতা আছে রূপকথার আবেশ - যা নাসেরের কবিতায় প্রায় মুখর হয়ে ওঠে কবিতার বক্তা আমিসর্বনামধারী কবি ঘোষিত মুসলমান আর উদ্দিষ্টতুমিহিন্দু দুই ভবঘুরে বন্ধু এই বিষয়টাতে কোনো চমক নেই চমক আছে এই ঘোষনায় যে, আমি মুসলমান আর তুমি হিন্দু অথচআমিচেয়েছিল এই ভারতবর্ষে (যেখানে তারা ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিল) একটা মন্দির বানাতে আরতুমিচেয়েছিল মসজিদ যেন একটা বৈপরীত্য এনে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়

আমাদের চাওয়াটাই এমন উদ্ভট তারপর দুজনেই কাজের চাপে ভুলে গেল মন্দির-মসজিদের কথা আরও তো অনেক কিছুই করার ছিল তো সেগুলোতেই তারা মন দিল শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান-আলো-পানীয়জল-বিজ্ঞানপ্রযুক্তি, হ্যাঁ, সেই উন্নয়নের মহাযজ্ঞে ঝাঁপ দিল দুজন দুই ভবঘুরে মনুষ্যত্ব নীতি-আদর্শ বিবেক মানবিক মূল্যবোধে মানুষ এখন সেখানে পরিপূর্ণ মানুষ কুসংস্কার দূর হয়ে গেছে অপবিজ্ঞান, অধিজ্ঞান দূর হয়েছে, যুক্তিতর্ক বিচারে সিদ্ধান্ত গ্রহণপর্ব শুরু হয়েছে এখন আর নরক নেই, হয়েছে স্বর্গ এমন সময় দুজনেই গেল সেই জায়গায় যেখানে মুসলমান বানাতে চেয়েছিল মন্দির আর হিন্দু চেয়েছিল মসজিদ তো সেখানে গিয়ে দেখা গেলো -গিয়ে দেখি সেখানে চমৎকার হ্রদে কতরকমের হাঁস খেলে বেড়াচ্ছে/চারপাশের বাগানে কত যে পাখি/ পুরুষ নারী ও বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়/ জমে উঠেছে তুমুল পিকনিক

চমৎকার ফ্যান্টাসি ইউটোপিয়া সব পেয়েছির দেশ ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ/কোথায় গেলে পাবে কেহ ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ভারততীর্থকবিরা তো স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন স্বপ্ন দেখান কোটি কোটি নিরক্ষরদের যারা চালনা করে সেই রাজনীতি ও ধর্মব্যবসায়ীরা এই এক সদর্থক পাঠের মর্ম বোঝেনা কার্যত তারা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই পড়েন না পড়েন দু-চারজন সুশীল সমাজের সদস্য তাও তো আবার তাদের মতামত প্রভাবিত গোঁড়া, মৌলবাদীদের দল যা কিনা বুদ্ধিজীবীদেরও দল! এমনই উদ্ভট এই পরিকল্পনা মন্দির-মসজিদ বিতর্কে ওই দাবিদার বৈপরীত্য এমন যদি সত্যি হত, আহা! সত্যি হয় না, কিছুই সত্যি হয় না মূর্খদের আরও মূর্খ বানিয়ে এখানে মুষ্টিমেয় ধান্দাবাজরা আখের গোছায় সেই ফাঁদে পা দেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ

কাহিনির উপস্থাপনা, কল্পনা ও বিন্যাসটি চমৎকার এটাকে একটা অর্ধগল্প ভাবা যেতে পারে উদ্দেশ্যসূচকতা এর সর্বাঙ্গে তাকে চেপে রাখার কোনো ইচ্ছেও কবি দেখাননি মন্দির-মসজিদ নিয়ে অর্থহীন ঝগড়াকে অর্থবহ করে রেখে হাস্যকরভাবে দেশটাকে কয়েক দশক পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে - সেটাই কবি এখানে দেখাতে চেয়েছেন - অবশ্যই রূপকাশ্রিত একটি কাহিনির আড়ালে সদ্ভাবনা, সদর্থক কল্পনার একটি সার্থক প্রকাশ হিসাবে এটি শিক্ষনীয়ও বটে তবে ওই যে, Preaching can do nothing



পেশা আর নেশা যে-মানুষের একই সে নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই হিসাবে কেবল সুখী তা নয়, বরং সুখস্বর্গে তাঁর বাস। একদিকে পেশা ও নেশা যেমন শিক্ষকতা, তেমনই পক্ষান্তরে কবিতার নেশাও সমান্তরালে বজায় রেখেছেন আজীবন। বহু বিখ্যাত ছাত্রছাত্রীর ভবিষত্যের রূপকার যেমন তিনি, তেমনই কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মননেরও আত্মাকেও ধারণ করেছেন পাঠকসমাবেশে। লেখা ও বইপড়ার জীবনচর্যায় নিবিষ্ট এই কবি-মানুষটির প্রকাশিত বইগুলি হল - কবিতার বই(বিকেলের মুখ ভাসে নদীর জলে,তবু বেঁচে থাকে প্রেম, দুয়ারে তোমার প্রতিভাস,সত্তরের কবিতা,প্রিয়মুখ প্রিয় কবিতা) ও অণুগল্পের বই(পাঁচ মিনিটের গল্প,অণু গল্পের মুখগুলি) 

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.