Monday, September 20, 2021

আত্মঘাতী মৃত্যুর নিস্তব্ধ বীথিকা : এবাদুল হকের কবিতা

   লিখেছেন

অ রী ন্দ্র জি ৎ   ব্যা না র্জী


সাধারণের স্পর্শে শিহরিত হবার মুহূর্ত যখন গতিশীল দরজায় আচমকাই থমকে যায়, কিংবা শূন্য প্রান্তরে যখন হাজারো শুকনো পাতার পাণ্ডুলিপি হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সারারাত্রি, কখনও উড়ে আসে কর্পূরের গন্ধ, কখনওবা আবহমান শবযাত্রীদের অদৃশ্য ধূসরিত ধূপধূম বয়ে যায় আচম্বিতে। তখন মনে হয় জীবন তো মৃত্যুগন্ধী ক্ষণিকের এইসব যাতায়াতের জন্যই উদ্দিষ্ট। সেখানেই তো সাঁতার কাটা পৃথিবী আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকে। হ্যাঁ, এবাদুল হকের কবিতা যেন সেই পরস্পর দ্বিমুখী অন্বয়ের সাক্ষী যার একদিকে মৃত্যুর দুর্লঙ্ঘ ডাক আর অন্যদিকে একজন কবির সামাজিক দায়। এই দ্বিবিধ অভিমুখের দ্বন্দ্বে পর্যুদস্ত এক ধরণের জরুরি সংকেত এবাদুল হকের কবি-অভিপ্রায়কে নিয়ন্ত্রিত করেছে –

“ভারতীয় ইলেক্ট্রার প্রিয় সম্ভাষণ পারসিক কার্পেট

মাড়িয়ে হেঁটে এলো যেন এক জাতীয় ঐক্যমত

নব্বইয়ের গোধূলির নির্বাসিত নব্বইয়ের বিষণ্ণ ইমারত

হায় হতভাগ্য রাষ্ট্র, তোমাকে বাঁচাতে হবে বাজে জরুরি সংকেত।”

(জরুরি সংকেত, এক গ্লাস জলের ছায়ায়)

এক নির্দেশ্যমান পলাতকা ছায়ায় কাছাকাছি যেন সর্বদাই থাকতে চাইতেন কবি। অন্ধকার, ঘনঘোর ত্রস্ততা, মৌন নক্ষত্রপুঞ্জ, আত্মহননের করিডোরে যেন সবাই মৃত, প্রত্যেকেই যেন সারিবদ্ধ হয়ে ঢুকে যাচ্ছে কবরে। বহুকাল থেকেই সেই কবর যেন খুঁড়ে রাখা হয়েছে, কখনও অজান্তেই নিজেরা খুঁড়েছে নিজেদের কবর। মৃত্যুর সারিবদ্ধ অভিঘাতই তো একবিংশ শতকের শহরে নতুন স্থাপত্য। কবি ‘পলায়কা ছায়া’ কাব্যগ্রন্থে বলেছেন,

“এক টুকরো আগুনের খোঁজে যাযাবর শীত এসে গেল

মৃত যারা বেরিয়ে আসে আত্মার কক্ষগুলো খুলে বিদীর্ণ রোদ্দুরে।

তোমার বুকের মধ্যে আগুনের পেণ্ডুলাম পূর্ব পশ্চিমে গতিশীল

সৌন্দর্যের ময়ূরপুচ্ছ হারিয়ে গেছে কোন এক বইয়ের ভিতরে।”

আসলে সময়ের এক অপরিবর্তনীয় সংযোগচিত্রকে ধারণ করে ঘৃণার অন্ধকার চিত্রমালা সংযোজিত হয়। যেহেতু ‘এক গ্লাস জলের ছায়ায়’, ‘পলাতকা ছায়া’ ও ‘সময়ের জলছাপ’ – এই তিন কাব্যগ্রন্থ ধরেই মূলত আমাদের আলোচনা, তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা সম্পর্কে জেনে রাখার প্রয়োজন বলে মনে হয়। সময়ের এই জলছাপকে তিনি বুকে ধারণ করতে চেয়েছেন কোনো এক অলীক মন্থনক্লিষ্ট স্বপ্নের কাছে। মাঝে মাঝে জেগে ওঠে জীবনানন্দীয় সুর –

“আমার হৃদয় ভরে ভরে ছিল

শত সহস্র শঙ্খচিল,

কোথায় গিয়েছে তারা চলে।

 

অনেকেই যাবে ওরা ঘরে,

ফিরবে দ্বীপের নীড়ে ভগ্ন ডানা মেলে;

আনন্দের আতিশয্যে বিষাদের ঝড়ে

কেউ যাবে ছিন্নপথে একা শীর্ণ ডালে

মন্থনের অপেক্ষায় আলোর আকালে।”

যেন এক মৃত্যুবীজ ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে, অজস্র মৃত্যুশাখায় ভর করে ওঠা অবিনশ্বর ক্ষয়ের রাজ্যে যাদের তখনও মনে পড়েনি ক্ষতবিক্ষত মৃত মাকড়ের ভারে। কবি খুঁজে চলেন –

“অমরত্বের অন্ধকারে মৃত্যুর বীজ যতই ছড়িয়ে পড়ে

জীবন নামক মৌন শাখায় চমকে ওঠে আলো,

প্রেমিকার বুকে ক্ষত শিহরণ পেল কি সমুদ্রের জীব?”

বিমুগ্ধ প্রহরীর মতো তিনি অপেক্ষা করেন নতুন অবলম্বনের তাগিদে। সেখানে যে-সমস্ত প্রেমিকারা কবিতা লিখিয়ে নেয়, দুঃখ দেয়, প্রেমের চোরাবালিতে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রতিদিনের যন্ত্রণাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার ক্ষমতা দেয়। আসলে সত্যের ভাসমান দোলাচলমানতায় আমাদের স্বপ্নের সিঁড়িগুলি তছনছ হতে থাকে, ভেঙে যেতে থাকে বৃত্তের সমাজতাত্ত্বিক কাঠামো। একবিংশ শতকের এই পিপাসা বিক্ষুদ্ধ সমাজমানসিকতাকে যেমন ভাবে দেখেছেন কবি তেমনভাবেই বুনেছেন–

“আমার ও রানির এবং আমাদের জীবন পড়েছি

বুঝেছি আসলে আমাদের সভ্যতার উৎস কেড়ে

রত্নাকর দস্যুরা তাদের মতো করে ইতিহাস লিখে

নিজেদের মিথ্যার অহংকার কিংশুক উড্ডীন

প্রাচীন সভ্যতার উৎস গুহামুখের অন্ধকারে রেখে

আমাদের চোখের ভিতর কালঘুম ঢেলে সিংহাসনে আসীন।”

 যে-সমস্ত চিরজীবী প্রেম আমরা খুঁজতে থাকি কবিতায় ও অন্যান্য সৃজনের পরম্পরায়, তা শুধু আপাত মিথ্যা নয়, সর্বৈব মিথ্যাচারের নামান্তর – কবিতার সজ্জায় একের পর এক তাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। সময়ের চিহ্নায়নই মূলত তাঁর কবিতার সবথেকে বড় উপাদান ও উপকরণ হিসেবে থেকে গেছে। আমরা বিশেষত উল্লেখ করতে চাই – তাঁর ‘পলাতক ছায়া’ ও ‘সময়ের জলছাপ’ বইটির কথা। অপরিসীম বিশ্বাস যখন কঠিন কঠোর সময়ের কাছে অবশেষে হার মানে, পৃথিবীর হতবাক মানুষের অনর্গল নক্ষত্রের মুখে ঠিকানা পাঠিয়েও দিশেহারা হয়ে পড়ে, তখন এবাদুল হক সময়ের জলছাপে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে বলে ওঠেন –

“তর্ক বিতর্কের সোনালি দিনগুলি পিছনে ফেলে

আমি ছিলাম নিশ্চিন্ত, গর্ভিনী গাভির মতো কিছুটা বেপরোয়া”


সময়ের জলছাপ ও শব্দময় মহামারি পৃথিবীর সমস্ত জটিল অঙ্কের ছাপকে মুছে ফেলতে চায় ক্ষণিকেই। অনিবার্য অন্ধকার গহনে প্রতিটি দুর্ভাগ্য আমাদের প্রত্যেকের গোলাপের পরাজিত আবিরের মতো রাঙা করে রাখে। কী সেই দুর্ভাগ্য – কবির কথায় উঠে আসে মতদীর্ণ সেই ঘাতক সময়ের অভেদ্য রূপ –


“প্রতিটি দুর্ভাগ্য আমাদের প্রতিটি পোকার আক্রমণ

গোধূলি দিয়েছে ঠেলে দ্বন্দ্ববাদী মাথার কোটরে

জলের অলিন্দে যেন গোলাপের রক্ত ঝরে,

মতদীর্ণ পৃথিবীর পাঁজরের শ্রুতির ক্ষরণ

বিবশ করে নির্জন অশান্ত রাতে চাঁদের শরীর;

পাতার আত্মায় ক্রমাগত ঢুকে পড়ে কলঙ্কিত জল।

মেঘের বিষণ্ণ ঝুড়ি দূরতর একাকি উজ্জ্বল

ব্যর্থভাবে বিদ্ধ করে যেখানে নিমজ্জিত তুমি সমুদ্র গভীর।”


সময় ও শব্দময় আলেখ্যর মাঝেই মিশে গেছে দেশ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত সাধারণ মানুষের হাহাকার ও যন্ত্রণা। দেশের যুবসমাজের স্বপ্ন ও কল্পনার ফারাক যেন হাঁড়িকাঠে জ্বালানো ক্ষতবিক্ষত বুকের পাঁজরের আড়ষ্টতায় লীন হয়ে রয়েছে। এ যৌবন যেন প্রকৃত অর্থেই দিশাহারা দমবন্ধ অবস্থাকে তুলে ধরে –


“যৌবন আজ কাঁপে থরথর চারিদিকে সন্ত্রস্ত

যৌবন ছিল একদিন জুঁই লবঙ্গলতিকার ফাঁসে।

আজ যৌবন হাজার বছর জপতপ করেও

লাটিম সুতোয় উড়ে যেন শঙ্খচিল আতঙ্কপ্রবর

ছত্রধর সেজে ক্ষমতার কাছে বন্দিজীবন।”


সত্যি এক দশকে দেশ ও দশের অবস্থা কেমন পাল্টে যায়, সাধারণে লেপ্টে যাওয়া ভবিতব্য, কিংবা অগোছালো ভাবে বেলাগাম জীবনযাত্রাই ক্রমে আমাদের সাম্যবাদকে নষ্ট করে। হ্যাঁ ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক অবস্থান্তরকেই কবি দায়ী করেন এর জন্য। আসলে সাধারণের সিদ্ধান্তের নিরিখে যে বা যারা দেশের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় আজ ক্ষয়ের মুখে সমস্ত দায় তো তাদেরই নিতে হবে। 

ভারতবর্ষের দীর্ঘতম ফুটপাত জুড়ে ভেসে থাকে যে-সমস্ত অপমান ও অপরাধের কালোছায়া, তারা জড়িয়ে রেখেছে প্রাচীন কুমড়োর মতো, পেটের ভিতর ফিতাকৃমির মতো অনলসে প্রতিমুহূর্তে। সেই উজ্জল সহবাসের অন্তরালে আজ যারা সন্ধ্যার পরগণায় মুখ ফেরায় তারা তো নির্বোধ ও বেহিসেবি। গভীর দুঃখের বিহ্বলতায় পা না বাড়িয়ে আনন্দ খোঁজে প্রাচুর্যভরা লাশঘরের অন্ধকারে। সেই আজন্ম অপঘাতী সন্তানের জন্ম আর মৃত্যু তো নিশ্চিত, চিরন্তন প্রস্থানের পথ খোলবার অপেক্ষায় – কবি তাই হাঁটতে চেয়েছেন মৃত্যুখণ্ডিত অভিনিবেশের পথ ধরে বাস্তুহারা, অন্নহীন জীবনযন্ত্রণাকে ধারণ করে –

“আমরা হেঁটে যাই স্বজন হারানোর মিছিলে বিহ্বলতায়

নিঃসঙ্গ পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের মজ্জায় তাদের উদাসীন

চোখের চাহনি শীতল হীরার মতো জ্বলে, আমরা গলে যায়

আমাদের গভীরে ক্লিষ্ট আত্মজ সারাদিন একান্ত মলিন

আমাদের গ্রীবা স্পর্শ করে আত্মজের বিষাদ তাদের হতাশা।”

এবাদুলদাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা জানতেন বা চিনতেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এ বিষয়ে একমত হবেন যে, এত নিরন্তর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির পত্রিকা সংগঠন হিসেবেই নয়, ৪০ বছর ধরে নিরসল নিবিড় দৃষ্টিকোণ সম্প্রসারের ভিতর দিয়ে তিনি বহু তরুণ লেখককে তৈরিও করেছেন, কিন্তু এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের যে সেই সব তরুণদের সনির্বন্ধ সহযোগিতা আর সাহায্য এবাদুলদা কোনদিনই পাননি, এবং একটা সময় পরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে একলাই লড়েছেন পত্রিকার জন্য। আজ তাঁর অনুপস্থিতি যেন বড়ো বেশি করে সেই অভিমানকাতর যোদ্ধার দায়ভারকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তবুও কবি তো শেষ পর্যন্ত, আশা নিরাশার দোলাচলমানতার মাঝেই বুনে চলেন জাল, সুদীর্ঘ সৌন্দর্যময় অনাগতের অথবা নিজেরই –

“জন্ম ছাড়া মৃত্যুর গৌরব নেই কোন, যদি মরে যাই

অবশ্য জন্ম নেব মধ্যরাতে জেগে ওঠা নারীদের মনে

শিশিরে জলে ভেসে ভেসে আমার কাগজের নৌকাগুলি

ভেড়ে আমার রক্তের দরজায়।

আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তুমি অপার্থিব আলোর দিকে ঝুঁকে

শব্দ খুঁজছিলে আঙুরলতার বনে প্রজাপতির উড্ডয়নে

নিজের বুকে পাথর ছুঁড়ে মেঘলোভী পর্বত চূর্ণ করে

তুমি ছড়িয়ে দিয়েছিলে মেরু সমুদ্রের অকর্ষিত ঢেউয়ের গভীরে।”

 

অরীন্দ্রজিৎ ব্যানার্জী


 

গ্রন্থপঞ্জি –

১) এবাদুল হক – পলাতকা ছায়া, শিল্প নগরী, ২০২০

২) এবাদুল হক -  সময়ের জলছাপ, শিল্প নগরী, ২০২১

৩) এবাদুল হক -  এক গ্লাস জলের ছায়ায়, পালক পাবলিশার্স, ২০২১

No comments:

Post a Comment

We are waiting for your opinion. Please Comment.

Thank You.